Photo by Martijn Vonk on Unsplash

অনেকের কাছেই শুনেছিলাম রাজধানী এক্সপ্রেস ভারতের অন্যতম দ্রুতগামী ও উন্নতমানের পরিষেবা দেওয়া ট্রেন, মানে বন্দে ভারত চালু হওয়ার আগে পর্যন্ত অন্তত তাই ছিলো। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল একটিমাত্র ব্যক্তিগত ও বাস্তব অভিজ্ঞতায়। ২০২৩ এর জানুয়ারি মাসে একটা ইন্টারভিউ দিতে দিল্লী যেতে হয়েছিল দুদিনের জন্য। আমার যাওয়া ও আসার পুরো সফর রাজধানী এক্সপ্রেসেই হয়েছিল, যদিও ওটা যে সফর এর পরিবর্তে Suffer এ পরিবর্তিত হয়েছিল তাতে আমার কোনো সন্দেহই ছিলো না। ভাগ্যিস, পুরো যাতায়াতের খরচ বহন করা হয়েছিল কলকাতার এক পাবলিশার্সের তরফ থেকে। নিজের পকেট থেকে প্রায় ১০ হাজার টাকা দিতে হলে ভয়ানক আপসোস হতো। তাই মনে মনে ঐ পাবলিশার্সকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে ছিলাম।

যেদিন দিল্লি যাত্রা শুরু করলাম সেদিন রাজধানী একবারে কাঁটায় কাঁটায় নির্ধারিত সময়ে হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়লো। যেহেতু আমার ট্রেন ছিলো বিকেল ৪ টের সময় তাই গাড়ি বেশ গতি নিয়েই এগোলো অন্তত রাত পর্যন্ত। তারপর ভোরের সময় দেখা দিলো প্রচন্ড কুয়াশা, ফলে গাড়ির গতিও গেলো অনেক কমে। যাওয়া ও ফেরা দুবারই প্রচন্ড কুয়াশা ছিল, তাই গাড়ির গতি ছিলো লোকাল ট্রেনের মতো। তবে প্রাকৃতিক দূর্যোগের ওপর তো কারোর হাত নেই, তাই এটুকু মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হলো কুয়াশা কেটে গিয়ে ঝলমলে রোদ ওঠার পরও রাজধানীর গতি বাড়লো না, সে সেকালের ছ্যাকড়া গাড়ির মতই ছ্যাক ছ্যাক করে এগোতে লাগলো। যাত্রীরা ধৈয্যের পরীক্ষায় ফেল করলেন, বলাবলি চললো এর থেকে বোধহয় হেঁটে গেলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবো! অবশেষে পৌঁছাতে পারা গেলো নিউ দিল্লিতে নির্ধারিত সময়ের ৮ ঘন্টা পর, অর্থাৎ সকাল ১০টার পরিবর্তে সন্ধ্যে সাড়ে ৬ টা নাগাদ। ফেরার দিনও একই গল্পের রিপিট টেলিকাস্ট হলো! তবে এবার আরও বেশিরকম মারাত্মক! যেখানে দিল্লি স্টেশনে রাজধানীর আসার কথা বিকেল চারটে, সেখানে তিনি হেলতে দুলতে এলেন রাত দুটোর সময়। সত্যি কী মেজাজী! তেনার প্রতীক্ষায় থাকা আমি সমেত যাত্রীদের গোটা একটা দিন কাটলো স্টেশন ও ওয়েটিং রুমের মধ্যে। বাকিদের কথা জানিনা, কিন্তু আমি এই প্রথম বার দিল্লিতে এসেছি তাই একটু যে কোথাও ঘুরে বেড়াবো তারও উপায় ছিলো না। কারণ, অচেনা শহর; তার ওপর দিল্লি তো মেয়েদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিষম বিখ্যাত। তাই আর দুঃসাহসিক কোনো কাজের ঝুঁকি নেওয়ার সাহস পেলাম না। মেয়েদের ওয়েটিং রুমে ফোনে গান আর গল্প শুনে, আর ওয়েটিং রুমের পুরো চত্বরে চক্কর দিয়ে পুরো একটা দিন কাটিয়ে দিলাম।

রাজধানীর অভিজ্ঞতা মানে তো শুধু ট্রেনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নয়, রাজধানী শহরের অভিজ্ঞতাও বটে। তা সেটাও খুব একটা সুখকর না। ইন্টারভিউ উপলক্ষে মাত্র দুদিনই ছিলাম মান্ডি হাউসের কাছে ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামার সরকারি গেস্ট হাউসের ডরমিটরিতে। আসলে দিতে গিয়েছিলাম নাটকের ইন্টারভিউ তাই ছিলাম একাই। যেহেতু সরকারি গেস্ট হাউস তাই দিন প্রতি দুশো আশি টাকায় ডরমিটরিতে থাকতে পারলাম। নাহলে অনেকের কাছেই জেনেছি দিল্লিতে থাকা-খাওয়ার খরচ অনেক। বাইরে কোথাও দিন প্রতি হাজার টাকার কমে ঘর পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর কষ্টে সৃষ্টে পাওয়া গেলেও সেখানে নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই। আর খাওয়ার ব্যবস্থা ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামার নিজস্ব ক্যান্টিনে। যেখানে মোটামুটি ষাট টাকায় ভরপেট মিল পাওয়া যায় যা মোটামুটি খেতে ভালোই, আর রাজধানী এক্সপ্রেস এর দ্বিতীয় শ্রেণীর খাবারের স্বাদ ও গুণগত মানের তুলনায় অনেক উচ্চ মানের। দিল্লির দর্শনীয় স্থানের মধ্যে শুধু ইন্ডিয়া গেটটাই দেখলাম, তাও আবার দূর থেকে। ২৬ শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে নিরাপত্তার জন্য মেন গেটটা বন্ধ করা ছিলো, তাই বাইরে থেকে ছবি তুলেই চলে এলাম। আরও অনেক জায়গা দেখার ছিলো, কিন্তু বিশ্বস্ত গাইড ও টাকার অভাবের কারণেই অদেখা থেকে গেলো জায়গাগুলো। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে আবার দেখার সুযোগ পাবো। তবে, দিল্লির কোনো কিছু যদি ভালো লেগে থাকে তবে তা হলো দিল্লির মেট্রোরেল। কম সময়ে ও কম খরচে অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করতে চাইলে মেট্রোরেলের মতো ভালো পরিষেবা আর কোনো কিছুতে পাওয়া যাবে না। অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টগুলো ট্রাফিক জ্যামের চক্করে পড়ে ট্যাঁ ফোঁ করতে পারে না! তবে ওয়েটিং রুমে গোটা একটা দিনের অভিজ্ঞতাও ভোলার নয়। বহু বিচিত্র চরিত্রের দেখা পেলাম সেদিন। কেউ আমার মতো একলা যাত্রী, তো আবার কেউ দলের সাথে আছেন, বা কেউ পরিবারের সদস্যদের সাথে। হরিয়ানা থেকে আসা এক দঙ্গল দামালের কথা কোনোদিন ভুলবো না, যারা ওয়েটিং রুমটাকেই একদিনের জন্য নিজেদের ঘর-বাড়ি বানিয়ে নিয়েছিলো।

যাইহোক, আবার ফিরে আসি রাজধানী এক্সপ্রেস এর কথায়।তার গতির প্রশংসা তো অনেক করলাম! এবার বলি পরিষেবার কথা। আমি ছিলাম দ্বিতীয় শ্রেণীর যাত্রী, তাই আমার পক্ষে প্রথম শ্রেণীর ব্যাপার-স্যাপার বলা সম্ভব না; হয়তো তা দ্বিতীয়র থেকে উন্নত! তবে দ্বিতীয়তে শুধু নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থাই শুধু আমি কেন, বেশিরভাগ যাত্রীরই মনঃপুত হয়নি! যে খাবার দেওয়া হয়েছিলো তা মোটেই টাটকা ছিল না, ছিলো ঠান্ডা ও বিস্বাদ- তবে তার মধ্যে আরশোলা জাতীয় কোনো কীটপতঙ্গর উপস্থিতি যে টের পাওয়া যায় নি, এটাই বাঁচোয়া! যে বালিশ ইত্যাদি দেওয়া হয়েছিলো তা ছিলো অপরিচ্ছন্ন ও দুর্গন্ধযুক্ত আর টয়লেটের কথা বলবোই না, তা ভাবতেও বমি আসছে! আর এসির তাপমাত্রা প্রায়ই ঠিক থাকছিল না, হয় একেবারে উপরে উঠছে আর নয়তো নীচে নেমে যাচ্ছে! এরকম মন ভালো করে দেওয়া ঘটনাগলো দিয়ে নির্ধারিত সময়ের একদিন পর হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে রাজধানীর সফরনামা শেষ হলো। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আর রাজধানীর দ্বিতীয় বা তৃতীয়র মুখদর্শন করবো না ইহজীবনে, তবে প্রথমের কোনো অভিজ্ঞতা হয়নি তাই ওটাতে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু রাজধানী দিল্লি ভ্রমণ ও আগ্রার তাজমহল দর্শন তোলা রইলো ভবিষ্যতে ভ্রমণের জন্য যদি কোনো ভালো ভ্রমণসঙ্গী পাই তার কথা ভেবে, আর নয়তো একাই পাড়ি দিতে হবে। তবে চোখ কান খোলা রাখলে আর বিশ্বাসী একজন লোকাল টুর গাইড থাকলে একাও যাওয়া যায়।

.    .    .

Discus