যে দেশ জন্মভূমি ও যে দেশের মাটিতে এই প্রবন্ধটি লেখার সূত্রপাত ঘটেছে তার নাম ভারতবর্ষ, যে দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে ৭৫ বছর আগে। যে দেশে এখন কান পাতলেই শোনা যায় 'আচ্ছে দিন' বা 'মেরা ভারত মহান' --- সেই দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যদি একটু আলোচনা করা হয় তাহলে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হবে 'আচ্ছে দিন' বা 'মেরা ভারত মহান' এর মহিমা। স্বাধীন হওয়ার আগে ভারতের আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য এবং স্বাধীনতা পরবর্তী অবস্থার মধ্যে খুব একটা ফারাক দেখতে পাওয়া যায় না, বরং আরও অবনতি ঘটেছে পরিস্থিতির একথা বিভিন্ন সমীক্ষায় বারবার প্রমাণিত হয়েছে। যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বিশেষত যাঁরা সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত ছিলেন, সেই দেশ আজও তৈরি হয়নি।
ভারতের প্রথম পর্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা কতটা যুক্তিসংগত ও যথাযথ সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা
বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ ও ঐতিহাসিকদের মতে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ছিলো ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম--- যদিও এই বিষয় নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। বিশেষ করে সমকালীন ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা নিরপেক্ষভাবে বিচার করে দেখেননি ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ইতিহাসবিদরা একথা অস্বীকার করেননি যে আসলে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম স্ফুলিঙ্গ ছিলো। এর পরের বিদ্রোহগুলি সংঘটিত হয় তথাকথিত আদিম অধিবাসীদের দ্বারা- সাঁওতাল, কোল, ভীল ও মুন্ডা। এদের স্বাধীনচেতা মনোভাব ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম আজও স্মরণীয়। তারপর সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের কথা যা কম সময়ের জন্য হলেও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। তবে একথা ভুললে চলবে না, এই বিদ্রোহগুলি সমগ্র দেশ জুড়ে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে অক্ষম হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে সমগ্রতার দিকে দৃষ্টি না দেওয়ার জন্য সমস্ত বিদ্রোহগুলিই ব্যর্থ হয়। মঙ্গল পান্ডে ধর্মীয় কারণে সিপাহী বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি, নানাসাহেব, বাহাদুর শাহ প্রমুখরা নিজেদের রাজত্ব বজায় রাখতে বিদ্রোহী সিপাহীদের সহায়তা প্রদান করেন। সাধারণ মানুষের কথা এঁরা কেউই চিন্তা করেননি। তাছাড়া মধ্যবিত্ত বাবু সম্প্রদায়েরও সমর্থন ছিলো না। সাঁওতাল বিদ্রোহের সিধু ও কানহু, মুন্ডা বিদ্রোহের বীরসা মুন্ডা প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মূলত নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর জন্যই আন্দোলনের আহবান জানান। তেমনই অপর দিকে নীল বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও নীলচাষীরাই মূলত সংগঠিত হয়। বাংলাদেশের ওয়াহাবি আন্দোলনের নেতা তিতুমীর বা মীর নিসার আলি মূলত বর্তমান বারাসাত ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা এলাকায় বিদ্রোহ ক্ষেত্র তৈরী করতে সক্ষম হন। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহ ব্যতীত উল্লিখিত বিদ্রোহগুলিতে চাষী, আদিম জনগোষ্ঠী ও নিম্নবর্গের মানুষের সার্বিক যোগদান স্বাধীনতার প্রতি তাদের আকাঙ্ক্ষাকে নির্দ্ধিধায় স্বীকার করে নেওয়া যায় বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও।
সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী আদর্শে বিশ্বাসী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমকালীন ভারতীয় মনীষীরা যে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং বর্তমান স্বাধীন দেশের পরিস্থিতি
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বিভিন্ন লেখায় বারবার যে দেশের কথা বলতে চেয়েছেন তা মুচি-মেথর-অজ্ঞ-মূর্খ সবাইকে নিয়ে এবং যেখানে কোনো জাত-ধর্ম-বর্ণ থাকবে না, সবার থাকবে শিক্ষার অধিকার। সাহিত্যক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রক্ষণশীল মনোভাব সত্ত্বেও সাম্যবাদী ধারণাকে কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করতে পারেননি একথা তাঁর 'সাম্য' প্রবন্ধ থেকে ভালোই অনুধাবন করা যায়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস 'পথের দাবী'তে সব্যসাচী চরিত্রের মাধ্যমে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের কথা ঘোষণা করেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'রাশিয়ার চিঠি'তে সমাজতান্ত্রিক সমাজের ইতিবাচক দিকগুলোর আলোচনা করেছেন। ভগত সিং, সুখদেব ও রাজগুরু যে দেশের স্বপ্ন নিয়ে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন সেই দেশে আজ সাভরকরের মত একজন বিশ্বাসঘাতককে দেশভক্ত অ্যাখ্যা দেওয়া হয়। সুভাষচন্দ্র বসুর সশস্ত্র 'আজাদ হিন্দ ফৌজ' এ 'ঝাঁসির রানি বাহিনী' সমানতালে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। রাসবিহারী বসু যে আজাদ হিন্দ এর গোড়া পত্তন করেছিলেন, তাঁকে কতজন মনে রেখেছেন? ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী স্বামীনাথনকে যিনি ছিলেন 'ঝাঁসির রানী ব্রিগেড'এর নেত্রী বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তকে যাঁরা ছিলেন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কারীগর সূর্য সেনের বীর সেনানীদের অন্যতমা কতগুলি পাঠ্যপুস্তকে স্থান দেওয়া হয়েছে তাঁদের? নেতাজীর আদর্শের কথাই বা কতটা আলোচিত হয়? কমিউনিস্ট পার্টিকে তো দেশদ্রোহী বলা হয়! অথচ আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাহায্য নিয়েই যে গুজরাটের নৃশংস দাঙ্গার নামে গণহত্যা হয়েছিলো তা সারা বিশ্ব ভুলবে না। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের দেশের মেয়েদের আজও পণপ্রথার নামে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। আজও দেশের মেয়েদের বাল্যবিবাহ হয়, অ্যাসিড আক্রমণ, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ এসব তো রোজকার ঘটনা অতি তুচ্ছই যেন! দেশের বেকারত্ব ইংরেজ আমলের চেয়েও খারাপ অবস্থায় দাঁড়িয়ে। জিডিপির কথা কোন মন্ত্রীরা বলেন না কারণ ওটাও মামুলি একটা কথা। তবে দেশকে হিন্দু রাষ্ট্র করতে হবে, মুসলিমরা হলো পাকিস্তানের লোক এই সমস্ত কিছুই রাষ্ট্রীয় নেতাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে দেশের বেশিরভাগ মানুষের কাছে ডাল-ভাতও আজ মূল্যবৃদ্ধির কারণে মহার্ঘ আর পেট্রোল তো সোনার চেয়েও দামী। সেই দেশের মানুষের মধ্যে ধর্ম নামক একটা কৃত্রিম জিনিসকে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যন্ত পরিকল্পিত পথে। গরীব মানুষকে হিপনোটিজম করা হচ্ছে ধর্ম দিয়ে।
দেশের এমন পরিস্থিতি যে স্কুলের পাঠ্য বইগুলি পর্যন্ত এক একটি ধর্মীয় গ্রন্থ হওয়ার দিকে। কে কি ধর্ম পালন করবেন বা আদৌও করবেন কি না এটা যে মানুষের মৌলিক অধিকার তা রাষ্ট্র সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে ফেলতে চায়। ড. আম্বেদকরের নেতৃত্বে যে সংবিধান রচিত হয় সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা। মানুষ কি পোশাক- খাদ্যাভাস সবই রাষ্ট্র নির্ধারিত। মৌলবাদকে প্রশয় দেওয়া, ইচ্ছাকৃতভাবে কাশ্মীর-পাকিস্তান ও চীন সীমান্ত সমস্যাকে জীইয়ে রেখে খাদ্য-চিকিৎসা-শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক পরিষেবা থেকে দেশের সিংহভাগ মানুষকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। পরিশেষে একথা অবশ্য বলা যায়, 'মন কি বাত' বা লালকেল্লার ১৫ ই আগষ্ট বা ২৬ শে জানুয়ারির ভাষণ ও কুচকাওয়াজ একদা আত্মহত্যা করা চাষীদের ভুলিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালালী করা রাষ্ট্রের নেতারা দেখেছেন কৃষকদের বিশাল লংমার্চ, দেখেছে গোটা দেশ। আত্মহত্যা না আন্দোলনই যে দাবী আদায়ের একমাত্র অস্ত্র তা তারা লড়াইয়ের ময়দানেই জেনে গেছে। ভারতের সংগ্রামী জনগণকে কোন মোহ দিয়েই ভুলিয়ে রাখা যাবে না, আগামী একশো বছর হয়তো নতুন সূর্য নিয়ে আসবে প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, সূর্য সেনের এই দেশে।