ছবির ক্রেডিট: সৈকত কুমার বসু

আমরা বন্যপ্রাণী এবং বন ভালোবাসি; এবং সম্ভবত আমরা তাদের রক্ষা করতে চাই। কিন্তু কখনও কখনও আমার মনে হয় যে আমরা এটি অর্জন করার জন্য অনুসরণ করার সঠিক পথ জানি না | আমরা বৃক্ষরোপণ সহ অন্যান্য সচেতনতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত কার্যাবলী পরিকল্পনা করতে পারি। কয়েকজনকে উদ্যোগ নিতে হবে, তাহলে অনেকেই এগিয়ে আসতে পারে। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃতি সংরক্ষণের চিন্তা ও চেতনার প্রসার ঘটাতে হবে, তার জন্য চাই আন্তরিক প্রচেষ্টা। দুটি কাজ একান্ত ভাবে প্রয়োজনীয় : ১) ভৌগোলিক অবস্থান বুঝে গাছ লাগানো। সরকারের মতো ইউক্যালিপ্টাস বা সোনাঝুরি লাগিয়ে বৃক্ষরোপণ ভাবলে আরো সর্বনাশ। ২) যথাসম্ভব পুকুর খনন এবং মজা পুকুর সংস্কার। চাষের ফলে মাটির তলায় জলের স্তর এখনই অনেকটা নীচে। একমাত্র পুকুরের বা জলাশয়ের মাধ্যমেই জল মাটির গভীরে সঞ্চিত হওয়া সম্ভব। এই দুই কাজই শহরে খুব কম সম্ভব। তাও যতো টা পারা যায় এবং গ্রামাঞ্চলে উদ্যোগ নিতে হবে।

সবাই ছোট ছোট করে এগিয়ে এলেও অনেকটা হয়ে যায়, তাই না? জায়গা নির্বাচন করে পাঁচটা গাছ লাগিয়ে তার রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব নেওয়া যায় না? আরেকটা বিষয়ও আছে। সবাই যে যার বাসস্থানে যদি খুব পরিমিত জল ব্যবহার করি, অযথা অপচয় রোধ করতে পারি। সবাই ছোট করে এগিয়ে এলে, অনেকটা বড়ো হয়েই যাবে। পাঁচটা করে পাড়ায় পাড়ায় (যেখানে সম্ভব) লাগালে কিছুটা তো হবে। গাড়ি বা AC নগরায়নের ফল। গাছ বাড়াতে পারলে হয়তো ভবিষ্যতে AC এর ব্যবহার কমতেও পারে। গাড়ি নিয়ে বলার অধিকার নেই। তবে আমি চেষ্টা করি কালো ধোঁয়া বেরোন গাড়ি চিহিৃত করে রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল কে দেখানোর। আমরা যে যার মতো আমরা পরিবেশের জন্য ভাবছি সে তো ভালো কথা। তাহলেই তো আমরা আমাদের বাঁচাতে পারবো। কারণ উষ্ণায়ণের ফল কি তা তো বিভিন্ন জায়গায় আমরা চাক্ষুষ করছিই! কলকাতা জলের নীচে যাবে সেও তো মিথ নয়! অনেক পরিবেশকর্মী এবং পরিবেশবিদ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে অনেক বছর ধরে কাজ করছে | তারা তাদের জীবনের সর্বাধিক মূল্যবান সময়ের বিনিময় বহু বন্যপ্রাণীর বাসস্থানকে অভয়ারণ্য এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যান রূপে সংরক্ষণ করেছে; নইলে সে সব কিছুই থাকতোনা |

ছবির ক্রেডিট: সৈকত কুমার বসু

তারা সংরক্ষণ করেছে সখের বন্যপ্রাণীর পর্যটক নই | তাদের আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখেছি, কারণ তাদের এই কাজ ও সম্পর্কের মধ্যেই অরন্য ও বন্যপ্রাণীর প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ নিজের ভোগবাদি মনোভাবের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অরন্য ও বন্যপ্রাণীর প্রতি আসক্ত হয়। আমাদের প্রকাশিত অভিব্যক্তি হয়তো তার কথা ভেবেই। আমি সেটা বুঝি | কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা সবসময় এই নিবেদিত সম্প্রদায়ের সদস্যদের শ্রেণীবদ্ধ করেছি "বন্যপ্রাণী পর্যটকদের" শারিতেই । আমাদের সেই ভূল ভাঙানোর জন্যই অতো কথার অবতারণা করলাম। আমরা যারা বন্যপ্রাণী ও অরন্যকে ভালোবাসেন তাদের সম্মান করি |

আমার একটাই সহজ কথা। বন্যপ্রাণী কে আমরা বনেই ছেড়ে দিই না। বরং দেখি যেন জঙ্গল না কাটা হয় যাতে ওদের নিজস্ব জায়গা আরো বেড়ে ওঠে। গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে খুঁজে খুঁজে বন্য প্রাণী দেখার কী আছে? ঐ অত গাড়ি অত শব্দ ওদের বিরক্ত করে অস্থির করে। ব্যাপারটা সহজ নয়। আমরা চাইলেই সব হবেনা। আমাদের পেটে ভাত আছে, মাথাগোজার ঘর আছে,পকেটে টাকা আছে । কিন্ত যাদের এসব কিছুই নেই তাদের কথাও ভাবতে হবে। কারণ তারাই আছে অরন্যের চারপাশে। যদি তাদের খাদ্য বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুবিধা না থাকে তবে তারাই অরন্য ও বন্যপ্রাণীদের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে। আমি/ আপনি, সকলেরই একই অবস্থা হোতো যদি নিদারুণ খিদে নিয়ে আমরাও অরন্যের ধারে থাকতাম। যারা পয়সা খরচ কোরে অরন্য ও বন্যপ্রাণী দেখতে যায় তাদের টাকাতে অরন্যের চারপাশের মানুষের কিছুটা হলেও খিদে মেটে। তাই সেটারো প্রয়োজন আছে, বন্যপ্রাণীদের বাঁচানোর জন্য নায্য ভাবে সেটা করা হয়। সমগ্র পৃথিবীতেই এবং আমাদের দেশেও অনেক নিষ্ঠাবান লোক, বন্যপ্রাণীদের মঙ্গলের জন্য কাজ করছেন।। ওনারা বহুবছর ধরে কাজ করছেন; তারাই বন্যপ্রাণীদের বাস্তব মঙ্গলের কথা অনুধাবন করতে সক্ষম। তবে এটাও ঠিক যারাই বন্যপ্রাণীদের কথা ভাবছেন, যদি সেটা চির স্থায়ী হয় তবেই মঙ্গল, নইলে আর কি ? কিছুই না, সময় নষ্ট।।

ছবির ক্রেডিট: সৈকত কুমার বসু

মুশকিল কী জানেন তো মানুষ ভাবে আমরাই সবকিছু ঠিক করে দেবো। সব নির্ধারণ করে দেবো তবেই সেই মতো সব চলবে। কিন্তু মানুষ সব ঠিক করার কে? কে তাকে এই অধিকার দিয়েছে? সরকার অরণ্য কে প্রোটেক্ট করার লোক রাখুক যাতে পোচার রা বন্য প্রাণী না মারে। জঙ্গলে ঢুকে ওদের বিরক্ত করার কী প্রয়োজন আছে? ঐটুকূ রেভিনিউ না হলে সরকার মাইনে দিতে পারবে না? তার জন্য প্রাণীদের উপর অত্যাচার চালাবে?

গত বছর এই তাডোবা তে গিয়ে আমার শিক্ষা হয়েছে। একটা চিতার বাচ্চাকে 12 টা জিপ মিলে ঘিরে ছিলো। বেচারি কে একটা পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার করতে দেবেনা। উন্মাদ হয়ে যায় মানুষ। সবাই বিশাল ক্যামেরা বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছবি তুলতে হবে আর ফরেস্টের লোকগুলো ও টিপ্স এর লোভে সমানে বাচ্চা টাকে তাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রায় আধ ঘন্টা এরকম চলার পর সবাই নিরস্ত হলো। কে যে জন্ত আর কে মানুষ বোঝা যায় না। সেদিন থেকে আমি স্থির করেছি এই পাপ করবো না।

প্রত্যেকের অনুভব নিজের নিজের। ১৯০০ শতাব্দীর গোড়ায় বাঘের সংখ্যা ছিলো লাখ খানেক, মারতে মারতে সেই সংখ্যাকে আমারা এনেছিলাম অবিশ্বাস্য তলানিতে। ১৯৭৩ সালে যে বছর প্রজেক্ট টাইগার চালু হলো সেবছর দেশে বাঘের সংখ্যা ছিলো মাত্র ২৬৮ টি ।সেখান থেকে আজ মোট বাঘের সংখ্যাকে বারানো হয়েছে প্রায় চার হাজার। এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে --- হুলুক গিবন, পিগমি হগ, বারাশিংগা, লায়নটেল মেকাক, গন্ডার, ক্লাউডেট লেপার্ড ইত্যাদিরা সবাই হারিয়েযেতো যদিনা তাদের দেখে মানুষের অর্থ উপার্জন নাহোতো। আমরা হয়তো অনেকেই অনুভব করিনা যে মানুষেরা অভয়াৰণ্য ও রাষ্ট্রীয় উদ্যানের একটি সামান্য অংশেই প্রবেশের সুযোগ পায়। বাকি স্থানের বন্যপ্রাণীরা মানুষের সংস্পর্শেই আশে না। বন্যপ্রাণীদের দুই চারজনকে ঘিরে যদি কেমেরা, জিপ, টিপস্ ইত্যাদি হয় ( যেটা প্রকৃত বন্যপ্রাণী সংরক্ষকেরা করেনা ), আর তার ফলে যদি বাকিদের সুরক্ষিত ও আদর্শ রূপে সংরক্ষিত রাখাযায় তবে ক্ষতি কোথায় ? নৈতিক প্রশ্ন/ উত্তর ও আদর্শের কচ-কচানী দিয়ে বন্যপ্রাণীর কল্যাণ করা যায় না। মূল কথা বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষিত রাখতেই হবে, তার জন্য বাস্তব ভাবেই কাজ করতে হবে, আর সেটাই হচ্ছে। আধুনিক পৃথিবীতে মানুষ ও বন্যপ্রাণীর জীবন জীবিকা পরস্পর নির্ভরশীল। এই বাস্তব সত্যর অনুভব গুরুত্বপূর্ণ ।

ছবির ক্রেডিট: সৈকত কুমার বসু

কোলকাতায় অনেক পাড়াতেই রাস্তা থেকে ফ্ল্যাট বাড়ির বাউন্ডারি গেট। আর গ্যারেজ। ঘাস গজানোর মতোও জায়গা/ মাটি নেই। যেখানে মাটি আছে, গাছ লাগানো যায়। কিন্তু রক্ষানা বেক্ষন কি ভাবে হবে সে বিষয়ে আগে থেকে ভেবে নেওয়া ভাল | যাইহোক আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে এই ধরণের ধারণাটাই এসেছে কলোনিয়ালিজম থেকে। যেমন ভাবে একসময় ব্রিটিশরা স্থির করতো আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র। যা আবার এখনো ফিরে এসেছে এই দেশে। তাই চলছে বন বা বন্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও। কী উন্নতি হচ্ছে বলুন তো। খাদ্যের অভাবে নিয়ত হাতি চলে আসছে লোকালয়ে। কত প্রজাতির পাখি প্রজাপতি আরো কত প্রাণী হারিয়ে গেছে। পেঞ্চ বা তাডোবা তে আমরা পেরিফেরির অনেকটা বাইরে গেস্ট হাউসের গেটের বাইরে দুপুর একটার সময়ে বাঘ দেখেছিলাম। খেতের গরু ধরতে এসেছিলো। জানলাম মাঝে মাঝেই গ্রামে চলে আসে। আসলে ওরা গ্রামে আসে না আমরাই ওদের জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। বাঘের সংখ্যা কমেছিলো সে তো মানুষেরই দোষে। এক লক্ষ থেকে 3200। 

দেশের বন বিভাগ আর বন্য প্রেমীরা কী করছিলো এতদিন? যে খানে 'সভ্য' মানুষের নজর পড়বে সেই জায়গাই শেষ হবে। মানস থেকে বাঘ চলে এসেছে ডুয়ার্সে, কোন কোন করিডোর দিয়ে কেউ কল্পনাও করতে পারেনা। সম্ভবত 4000 কিমি দূরত্ব। শুধু সঙ্গীর খোঁজে! আমি মানুষের তৈরি এই সব থিয়োরিতে বিশ্বাস করি না। তবু প্রার্থনা করি যেন অবোধ প্রাণী গুলো বেঁচে থাকে নিজেদের নিয়মে; মানুষ ধ্বংস হলেও।

.    .    .

Discus