Image by Cory Staudenmaier from Pixabay
খেলার সাথী বলতে ছোট বোন অদিতি আর দিদি আঁখি, যদিও দিদিকে সে এখনো ভাই বলেই ডাকে।
শান্ত স্বভাব, গভীর চোখে একটা মায়া জরানো ; ছোট্টবেলায় একটু নাদুসনুদুস হওয়াতে গ্রামের সবাই তাকে গোপাল বলে ডাকলেও ঠাকুর মা ভুলনদেবী বড়ো সখ করে নাম রেখেছিলেন কর্ণ ।
জলপাইগুড়ি শহর থেকে রাজপথ বরাবর দক্ষিণে প্রায় আট কিলোমিটার পথ পেরিয়ে যাবার পর ছোট্ট একটি নদীর তীরে সবুজ বনানীতে ঘেরা গ্রামেই সে থাকে।
গতবছর ১৪ই জুলাই পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর মায়ের হাত ধরে ভর্তি হয়েছিল গ্রামেরই একটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, কর্ণ এখন প্রথম শ্রেণীর ছাত্র হলেও পড়াশুনার প্রতি মনোযোগ এবং বুদ্ধিমত্তা দেখে মাষ্টার মশাইরা কিন্তু ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ । অবশ্য হওয়াটাও খুব স্বাভাবিক, বংশগত পরম্পরা বলে তো একটা কথা আছে নাকি !
নাহ্ , আজ হয়তো এই বংশের প্রভাব প্রতিপত্তি সেই অর্থে কিছুই নেই কিন্তু কোনও একসময় পিতামহ, প্রপিতামহ এর আভিজাত্য, ঐতিহ্য, উচ্চ বংশের গৌরব কাহিনী সমসাময়িক বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শোনা যায়। ঠাকুরদা স্বর্গীয় নারায়ণ চন্দ্র সরকারের কথা এখনো ভুলে যায়নি অনেকেই ।
কিন্তু হায় ! সময়ের আবর্তে পরিবর্তিত হয়ে যায় মহাবিশ্বের যাবতীয় ঘটনাবলী , মানব জীবনের গতিপথও তার ব্যতিক্রম নয়, এক নিমেষেই ঘটে যেতে পারে রূপান্তর, শূন্য থেকে পূর্ণ অথবা পূর্ণ হতে শূন্য ; বর্ষিত হতে পারে সময়ের প্রভাব পুষ্প ধারা হয়ে অথবা বজ্রাঘাত হয়ে হানতে পারে নির্মম আঘাত।
বহুদিন হয়ে গেছে কর্ণ তার বাবাকে দেখে না । চারপাশে তার সহপাঠীদের বাবা-মা অনেকেই যখন তাদের নিয়ে বেড়াতে বের হয় ছোট্ট কর্ণের আবছা স্মৃতির গভীরে ভেসে ওঠে কিছু ছবি, তার বাবার কাঁধে শুয়ে বাড়ির উঠোনে ঘুরে ঘুরে চাঁদ দেখানো গল্প, বাবার আদর মাখা স্নেহ জরানো স্পর্শ।
আশিষ বাবু এবং অনামিকা দেবীর, যদিও পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে তিনি যমুনা বলেই পরিচিত, দ্বিতীয় সন্তান কর্ণ ; প্রথম সন্তান আঁখির জন্মের প্রায় দশ বছর পর নবাগত এই পুত্র সন্তান কে ঘিরে আনন্দে উচ্ছ্বসিত ছিলো বাড়ির প্রত্যেক সদস্য ।অবশ্য এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন নারায়ণ বাবু , কেননা বহুবছর পূর্বেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।
প্রতিদিনের মতোই কর্ণ বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে, রাতের খাবার খেয়ে সবাই যে যার ঘরে শুয়ে পড়লো। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! কে জানতো আজ রাতে ঘুমের মধ্যে দিয়েই কর্ণের জীবন থেকে চিরকালের জন্য হারিয়ে যাবে পিতৃস্নেহ ! নিষ্ঠুর নিয়তি আঘাত হানতে হয়তো দ্বিতীয়বার ভাবেনি, মাত্র ১০ মাস বয়সেই এই শিশুটির ললাটে লিখে দিলো পিতৃবিয়োগ । শনিবার রাতের দ্বিপ্রহর শেষ হয়ে তৃতীয় প্রহরের প্রারম্ভে ইংরেজি বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী ১৩ই মে ২০১৮ সাল, তারিখটা কর্ণের জীবনের জন্য একটি কালো রাত হিসাবে স্মৃতির কোণে সারাজীবন বেদনা দায়ক এবং অভিশপ্ত হয়ে রয়ে যাবে।
হঠাৎই মাঝ রাতে অসুস্থ বোধ হয়েছিলো আশিষ বাবুর, সেকথা স্ত্রীকে জানিয়েছিলো সে নিজেই। পাশের ঘরেই শুয়ে ছিলেন মা ভুলনদেবী, ঠিক উল্টো দিকের ঘরে ছোট ভাই জগৎবন্ধু এবং তার স্ত্রী রীনাদেবী। নিমেষেই ঘটে গেলো অঘটন কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আশিষ বাবু যাত্রা করলেন না ফেরার দেশে! চোখে তার হাজারো স্বপ্ন, সন্তানদের ভবিষ্যৎ তৈরী করার দায়িত্ব, মেয়েকে পাত্রস্থ করার কর্তব্য, পুত্রবধূ নির্বাচন, আরো না জানি কতো কি ; কিন্তু নিষ্ঠুর ভাগ্যের পরিহাস এক নিমিষেই সব স্বপ্ন বিবর্ণ করে দিলো। হয়তো সেকারণেই অন্তিম মূহুর্তেও তার চোখের পাতা দুটি বন্ধ হয়ে যায়নি, কেননা চোখে তো অসীম স্বপ্ন তখনও বাকি ছিলো।
কিছুটা দূরেই থাকেন কাকাতো ভাই বিশ্বজিৎ, ছুটে এসে দাদাকে এই অবস্থায় দেখে তার আর বুঝতে বাকি নেই বড়দা আর নেই!
নির্মম সত্যিটা বলার মতো সাহস হয়নি, তবুও যদি কোনও অলৌকিক চমৎকার ঘটে যায় ; বড়দা যদি প্রাণ ফিরে পায় । খানিকটা সে আশা নিয়েই ছোটদা জগৎবন্ধুর সাথে আশিষ বাবুকে নিয়ে রওনা দিলেন সদর হাসপাতালে। চিকিৎসক যথারীতি পরীক্ষা করে দেখার পর জানিয়ে দিলেন আর কিছুই করার নেই ।
পরদিন সকালে আশিষ বাবুর নিথর দেহ আনা হলো, গোটা পাড়ার লোকজন শেষ বিদায় জানানোর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলেন । সে যে কি করুণ দৃশ্য! তা লিখে ব্যক্ত করা সত্যিই অসম্ভব।
ছোট্ট ঐ শিশুর মুখটা আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাবাকে শেষ বারের মতো দেখছে অথচ বুঝতে পারছেনা কি হারিয়ে গেলো জীবন থেকে । সবার কান্না দেখে সেও কান্না করে উঠলো। বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকছে, শেষ বারের মতো ছুঁয়ে দেখার দুর্ভাগ্য ! কিন্তু বাবা যে কোনও সারা দিচ্ছে না? অন্য দিন তো বাবা ওঠে গিয়ে কোলে তুলে নেন ; ছোট্ট কর্ণ ভাবচ্ছে প্রতিদিন সকালেই তো এমন খেলা সে বাবার সাথে খেলে থাকে, হয়তো আজকেও বাবা ঘুম থেকে উঠে গিয়ে অন্য দিন গুলোর মতোই তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি যে বাবাকে চিরকালের জন্য ঘুমের দেশে নিয়ে গেছে সে কথা কর্ণ কি করে বুঝবে ?
চোখের সামনে দিয়েই ওর বাবাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে শেষকৃত্য করার উদ্দেশ্যে কিছু মানুষ । আজও ওর ঐ গভীর কালো চোখের না বলা কথার ভাষায় যে প্রশ্ন ছিলো তা আমাকে বিদীর্ণ করে তোলে।
আজ কর্ণের ষষ্ঠ জন্মবার্ষিকী পূর্ণ হলো, অতীতের দুঃখ মেনে নিয়েই নতুন করে সবাই চেষ্টা করছে দুঃখ ভুলে একটু আনন্দে মেতে উঠার।
কাকা জগৎবন্ধুকে কর্ণ, বিন্দু কাকাই বলেই ডাকে। পিতৃহারা হওয়ার পর মা, কাকা, ঠাকুরমা-ই তো কর্ণের আবদার ও ভালবাসার ঠিকানা। কাকা বিন্দু এবং কাকিমা রীনাদেবীর কাছে কর্ণ নিজের মেয়ে অদিতির থেকেও বেশী আদরের এবং স্নেহের ।
জন্মদিন উপলক্ষে আলিপুর থেকে রওনা দিয়েছেন পিসি প্রতিমাদেবী, পিসা মশাই রানাবাবু এবং দাদা রিপন ।
সন্ধ্যার আয়োজন অনুষ্ঠানে, ভিড়ের মাঝেও ছোট্ট শিশুটির চোখ দুটো যে তার বাবাকেই খুঁজে বেড়ায়, যার উপস্থিতি ও সান্নিধ্য সব থেকে বেশী খুশি করতে পারতো সেই মানুষটার অভাব যে শিশু মনে দাগ কেটে যায়, তা অস্বীকার করার কোনও অবকাশ নেই । বটবৃক্ষের মতোই শীতল ও শান্তির ছায়া প্রদানকারী বাবার আশ্রয় ও স্নেহের শূন্যতা পূর্ণ করার সামর্থ্য যে স্বয়ং বিধাতারও নেই।
সময়ের গতিপথ আমরা হয়তো পরিবর্তন করতে পারবো না, তবে সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে চলার নামই তো জীবন! কিন্ত এসব কথা বুঝবার মতো বয়স বা শক্তি কোনওটাই ছোট্ট কর্ণের হয়ে উঠেনি । এসব তাত্ত্বিক কথাগুলো হয়তো রূপকথা বা উপন্যাসের পাতায় শোভা পায় কিন্ত বাস্তবতা যে বড়ো নিষ্ঠুর এবং ভয়ানক সেটা আমরা হয়তো কল্পনা করতে পারি কিন্তু অভিজ্ঞতার দিক থেকে নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞ একমাত্র কর্ণ ।