প্রথম যখন চোখ মেলে চায় সে, মা সর্বজয়ার মমতা ভরা মুখ জগতভরা আলো নিয়ে উদ্ভাসিত হয় তার শিশু দৃষ্টির পেলবতায়। মার ঐ উদ্ভাসিত মুখ ছিল তার জীবনে প্রথম আলো।
এই বিরাট পৃথিবীর মাঝে তার বিহ্বলতায় ভরা শিশু চোখ নিশ্চিন্দিপুরের পারিপার্শ্বিকতায় যখন খুঁজে পেল জীবনের প্রথম ছন্দ, তার সামনে উদ্ভাসিত হয় তার জীবনের দ্বিতীয় আলো, তার দুর্গা দিদি। শুরুতে দিদির কোলে চড়ে আর কিছু পরে তার নরম, কচি পায়ের টলমল ছন্দে, তার ছোটো হাত ধরা দিদির মুঠোভরা উষ্ণতার আশ্রয়ে সে খুঁজতে শুরু করে জীবনের মানে। থেকে, থেকে ভেসে আসা মা, দিদির স্নেহভরা "অপু" ডাকে সে শোনে বিশ্ব সংসারের সব থেকে মধুর সুর।
পরিবর্তিত শৈশবে দিদির পায়ে, পায়ে ক্রমবর্ধমান জীবনের পথে চলার মাঝে, মাঝে সে মুখ তুলে দিদির আশ্বাস ভরা চাঁদের হাসি দেখে। দিদির হাতে তার ভালবাসা মাখা আচার খেতে, খেতে দিদির দিকে চেয়ে মুচকি হাসে সে, তার একমাত্র বন্ধুর উষ্ণতার ছায়ায়। এই আশ্বস্ততা তাকে ঘিরে রাখে জগতের সব বাঁধা থেকে।
সকালে পাঠশালা যাত্রায় দিদির চুল আঁচড়ে দেয়া, সারা দিনের দুষ্টুমি আর দিদির ভেংচি কাটা আরো গভীর মমতায় সেই আশ্বস্ততার চাদর দিয়ে জড়িয়ে রাখে তাকে। শুধু দূর ভবিষ্যতের বৃহত্তর জীবনের ডাক প্রথমবার শুনিয়ে যাওয়া সেই রেলগাড়িটার দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাবার সময় তার ছোট্ট মন খেয়াল করতে পারেনা , সেই ডাকে সাড়া দিতে ব্যর্থ তার দিদির মুখ থুবড়ে পেছনে পড়ে থাকা।
দারিদ্র আর অপমানের জ্বালা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করা মার হাতে অমানুষিক মার খেয়ে ভাঙা মনে - শরীরে অন্ধকারে শুয়ে থাকা দিদির ওপর সে মেলে ধরে তার আশ্বস্ততার ছায়া - দিদি, তোর খুব লেগেছে না রে। হিমেল হাওয়ায় ছুটে আসা ঘোর বর্ষার শীতল চাবুক আঁছড়ে পড়া পিঠে তাকে বুকে আগলে সেই আশ্বস্ততার নিঃশব্দ বাণী শোনায় তার দুর্গা দিদি - আমি আছি।
নিয়তির অমোঘ নির্দেশ বারে, বারে নেমে আসে অসহায় মানুষের ওপর। কিন্তু মন, সে তো মানে না। সে তো জীবনের সব অপূর্ণ স্বাদ নিয়ে আরো বাঁচতে চায়। তাই সে অসুস্থ দিদির শিয়রে বসে প্রহর গোনে আর দিদির সাথে সামনের সুন্দর দিনের কথা বলে। কিন্তু অনাহার, অপুষ্টি আর মারণ রোগের চোরা অলিন্দ দিয়ে গুটি, গুটি এগিয়ে আসা মৃত্যু যখন শ্বাপদের মতো থাবা মেরে
ছিনিয়ে নিয়ে যায় তার দিদিকে, তার ঐ ছোট্ট দেহ এই বিপুল শোকের বোঝা আর বইতে পারেনা। ভেঙে পড়ে সে। কিন্তু দিন কয়েক পরেই সে উঠে দাঁড়ায়। তাদের ভাঙা ঘরের শূন্য দেউলে নতুন পিলসুজ জ্বালিয়ে নিজে হাতে চুল আঁচড়ে সে পাঠশালায় যাত্রা করে। দিদি - শূন্য মেঠো পথে বর্ষার পাগল হাওয়ায় গায়ের চাদর ছোটো হাতে সামলে নিয়ে পায়ে, পায়ে এগিয়ে যায় সে।
তবু , পরবাস থেকে ফেরা বাবার বুকফাটা আর্তনাদের ঢেউ আঁছড়ে পড়ে তার বুকে। পাঠশালা ফেরত সে বাড়ীর অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে জমে পাথর হয়ে যায়। পুঁথির হার পানা পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে দিদির জীবন স্মৃতির পাতায় লেপটে থাকা একমাত্র কালো বিন্দুটাকে মুছে দেয় সে। ক্ষনিকের জন্য জেগে ওঠা অসুন্দর স্মৃতির কালো জল ধিরে, ধিরে ঢেকে দেয় কচুরিপানা। তার দুর্গা দিদি থেকে যায় সব অপবাদের উর্ধ্বে।
প্রাচীন শহর বারাণসীর অলিতে, গলিতে ছটফটে অপু দৌঁড়ে বেড়ায়। শৈশবের শেষ আর কৈশোরের শুরু। প্রকৃতির জাদুস্পর্শে এতদিন ধরে জেগে থাকা অপুর স্বর্গীয় নিষ্পাপ সৌন্দর্য অতিক্রান্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করছে কৈশোরের এক নতুন কমনীয়তা যা কৈশোরের ঐ কত - অজানারে দিনগুলো আরো নিখুঁত ভাবে তার চোখে মুখে এঁকে দিয়ে যায়। নিশচিন্দিপুরের ঝোঁপঝাড় , জল - জঙ্গলের আনাচে কানাচে আর দূরবর্তী মাঠের ওপার থেকে ভেসে আসা বহু দূরের রূপকথার যেসব অজানা জগতের ডাক তার কাছে ভেসে এসেছিল, তা আবার নতুন করে সে শুনতে পেল বারাণসীতে। তার অন্তহীন অনুসন্ধিৎসা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় এই ঐতিহাসিক শহরের অজানা রহস্য ঘেরা গলিঘুঁজিতে, যেখানে পায়ে পায়ে লুকিয়ে থাকে অজানার দিশা। তার দুই ছটফটে কালো চোখের গহনে জ্বলতে থাকে তার ভবঘুরে আত্মার প্রদীপ। তার কৈশোর মন বুঝতে পারেনা, তার এই অজানার উদ্দেশ্যে ছুটে বেড়ানো জীবনরেখা নিঃশব্দে লিখে চলেছে তার অদৃষ্ট। যেখানে অপেক্ষা করছে এক শ্বাশত জীবন - পথিকের আকাশগঙ্গা।
কিন্তু এই সবেতে হঠাৎ করে ছেদ পরে পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার অপু মৃত্যুকে চাক্ষুষ করল। হরিহর - এর আত্মা পায়রার ঝাঁকের সঙ্গে উড়ে যায় অমৃতলোকে । ধরাচুঁড়া পরা অপুর থমথমে মুখ বহুকাল আগে ছেড়ে আসা, দর্শকের
কৈশোরের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। আর যাদের জীবনে একেবারে ঐ বয়সে ঐ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, ফোঁটা, ফোঁটা অশ্রুবিন্দু গোপনে তাদের হৃদয় সিক্ত করে , পরিণত হয় তাদের জীবন - জিজ্ঞাসার কেন্দ্রবিন্দুতে।
অচেনা শহরে একলা নারী সর্ববজয়া একমাত্র সন্তানকে নিয়ে আর নিরাপদ মনে করেন না। ফিরে আসেন বাংলাদেশে, নিশ্চিন্দিপুরের সেই চেনা বাঁশির সুর ধরে। মনসাপোতা গ্রামে দাদার বাড়ীর দাওয়া, সামনে ধুধু ধানক্ষেত, সীমানায় তাল নারিকেলের সারি নিমেষে নিশ্চিন্দিপুরকে হাজির করে সর্বজয়ার সামনে। শেষ দেখা ভগ্নদশার সেই গৃহকোণ এতদিন সুপ্তত্থিত
থাকার পর জেগে ওঠে তার মনে। দুঃখ আর অবসাদের ছায়া ধিরে, ধিরে ছেয়ে ফেলে সর্ববজয়ার মুখ। আর তখনই এক অশরীরী ধেয়ে এসে অসাঢ় করে দেয় তাকে। অবসাদের পাথরচাপা শরীর নিয়ে দাওয়ায় বসে থাকা সর্বজয়া আনত দু চোখে দেখে মেয়ে দুর্গা, আবছা দেখা আদেখায় সদর দরজায় এসে দাঁড়ায়। তার এক মাথা রুক্ষ চুল খোলা হাওয়ায় ওড়ে। নিঃশব্দে সে তাকিয়ে দেখে তার মাকে, ভাইকে। আর ঠিক তখনই দিগন্তে কালো ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে, ভেসে আসে হইসল। নিজের খেয়ালে মত্ত থাকা অপুর চেতনা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে দিগন্তে আবির্ভূত হয় রেলগাড়ী। দিগন্ত প্রসারী ঢেউ খেলে যাওয়া ধানের শীষ ছুঁয়ে লম্বা কালো ট্রেন বিদ্যুৎ খেলে দেয় অপুর মনে। স্মৃতির দৌড় শুরু হয়। ছুটে আসে নিশ্চিন্দিপুরের কাশবনের ওপারের সেই ট্রেন। - মা ট্রেন - সেদিকে আঙুল তুলে ঝলমলে মুখে অপু তাকায় তার মার দিকে। কিন্তু দেখে মার অবসাদে নুয়ে পড়া কালো মুখ। সে এও লক্ষ্য করে তার আনন্দে সায় দিতে গিয়ে এক ক্লান্ত হাসি দিয়ে মার সেই দুঃখকে আড়াল করার চেষ্টা। অপুর সামনে পৃথিবীটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। মার ঐ আঁধার ভরা দৃষ্টি থেকে বেরিয়ে আসে তার দুর্গা দিদি, যে ছিল সেদিন কাশবনে তার পাশে। দ্রুত ঢেকে ফেলা অবসাদের ছায়া মাখা থমথমে মুখ নিয়ে অপু সদর দরজায় হাত রেখে দেখে ট্রেন লাইনের কাছে খোলা চুল উড়তে থাকা এক মেয়ে এক মনে তাকিয়ে থাকে ট্রেনের দিকে, তারপর সেও চলে যায় দূরে, অনেক দূরে।
চির কৌতুহলী , জ্ঞান পিপাসু অপু স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখে , দূরের এক অন্য জীবনের ডাক শুনতে পায়। এক নতুন আশা বিদ্যুৎ খেলে তার মনে। রাতে মার কাছে স্কুলে পড়াশোনা করতে চেয়ে মার অনিশ্চিত চাউনি দেখে জিজ্ঞেস করে - আমাদের পয়সা নেই মা ? - সন্তানের এই নিষ্পাপ জিজ্ঞাসা ভরা চাউনি দেখে আর থাকতে পারেননা সর্বজয়া । বারাণসীতে সঞ্চয় করা কটা টাকা হাতে তুলে নেন। এক প্রভাতে অপু হাতে তুলে নেয় বই খাতা। মেঠো পথে ছোটো , ছোটো পা ফেলে এই দুঃখের পৃথিবীকে অতিক্রম করে সে এগিয়ে যায় এক আলোর পৃথিবীর দিকে। যেখানে জ্ঞানের আলো এক বৃহত্তর জীবন নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে।
পথের পাঁচালিতে হরিহরের দুর্গার মৃত্যু সংবাদ শোনার বিয়োগান্তক দৃশ্যে বাজে তার সানাইয়ের সুর। যা যে কোনো চেতনা সম্পন্ন দর্শকের ভেতরে তার অনুভূতির তারগুলোকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছিল। আবার অপুর সংসার এর শেষে এসে জন্মাবধি বিচ্ছেদের পর, সন্তান কাজলের দৌঁড়ে এসে অপুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঐ চূড়ান্ত মিলনাত্মক দৃশ্যেও দর্শক শোনে বহুদিন আগে শোনা নিশ্চিন্দিপুরের সেই তার সানাইয়ের কান্না। যা দর্শক মনে এক আনন্দানুভূতির জন্ম দেয়। পথের পাঁচালী তে তার সানাইয়ের কান্না
যে নাড়ির বন্ধনকে ছিঁড়ে দিয়েছিল। অপুর সংসার এ সেই তার সানাইয়ের কান্না ঐ বন্ধনটাকে জুড়ে দিল। অপুর বুকে কাজল ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপুর শূন্য আঙিনায় একে, একে ফিরে আসে দুর্গা দিদি, বাবা, মা আর স্ত্রী অপর্ণা। একই সুরকে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় দুই বিপরীত ধর্মী আবেগকে ঘনীভূত করার ক্ষেত্রে কত অবলীলায় ব্যবহার করেছেন।
কিন্তু এই ব্যবহার করার পেছনে চলচ্চিত্রকারের শিল্পি সুলভ সাহস বা আত্মবিশ্বাস আসছে কোথা থেকে ? ঐ তারসানাইয়ের নোটেশন আর তাকে জড়িয়ে থাকা দুই বিপরীত ভাবাবেগের দৃশ্যই গাঁথা আছে প্রত্যেক দর্শকের অবচেতনে লুকিয়ে থাকা আপন
মাতৃ জঠরের সাথে তার অবিচ্ছেদ্য টানে। যেই টানের জড় গ্রথিত থাকে আড়াই বছর বয়েসে পিতৃহীন, মা - সর্বস্ব সত্যজিৎ এর শৈশব এবং কৈশোরের দিন গুলোতে। যা তাঁর মানব চেতনার ভিৎ তৈরি করে দিয়েছিল। পথের পাঁচালী আর অপুর সংসার এর ঐ দুই দৃশ্যে তার সানাইয়ের সুর ধরে দর্শক ফেরে তার আপন শিকড়ের টানের কাছে। এবং চলচ্চিত্রকার নিজেও সবার অলক্ষে সেরে নেন তাঁর আপন বুড়ি ছোঁয়ার পালা।
মাঝে শুধু পথের পাঁচালী আর অপুর সংসার এর মধ্যে নিঃশব্দে সেতুবন্ধ রচনা করে দিয়ে যায় “ অপরাজিত”। আশৈশব, কৈশোর জুড়ে মা সত্তাটাকে জড়িয়ে বাঁচা , পরীক্ষায় ভাল ফল করা জ্ঞ্যান পিপাসু অপু যৌবনের চৌখাটের সামনে দাঁড়িয়ে এক বৃহত্তর জীবনের হাতছানি দেখে। মনসাপোতার নিস্তরঙ্গ জীবন আর মার স্নেহের আঁচল বড় ছোট মনে হয়। মহানগরী কলকাতার বিশাল জীবন চক্রের অংশ হয়ে এক উন্নততর জীবনের স্বপ্ন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। পিছিয়ে পড়া অজ গ্রামের কৃষি নির্ভর সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র অপূর্ব রায় এর নিজেকে বড় বেমানান ঠেকে। কলকাতার ক্রমশঃ অগ্রসরমান শিল্পতান্ত্রিকতার বিশালতা এক বৃহত্তর সম্ভাবনাময় জীবনের ঢেউ তোলে অপুর মননে। কলকাতায় পা রাখার সাথে, সাথে সেই ঢেউ এর ধাক্কা লাগে অপুর বাইরে এবং ভেতরে।
আবার সপ্তাহান্তে অপুর সব ক্লান্তি আর অবসাদ জুড়ায় মনসাপোতায় মার স্নেহছায়ায়। এক আত্মজীবনী ছায়াছবি হয়ে ভেসে ওঠে। শান্তিনিকেতনের শিল্প শিক্ষার দিনগুলোতে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য আর ভারতীয় শিল্প ঘরানার আবিষ্কারের আশ্চর্য
বিস্ময়বোধকে অতিক্রম করে ঐ নিস্তরঙ্গ গ্রাম্য জীবনে হাঁফিয়ে উঠতেন যুবক সত্যজিৎ। সপ্তাহের শেষে কলকাতায় ছুটে চলে আসতেন। কলকাতায় আছে মার সান্নিধ্য। যার যেখানে শিকড়ের টান।
কিন্তু অপুর সদ্য তৈরী হওয়া মহানাগরিক সত্তায় কোথায় যেন নিস্তরঙ্গ মনসাপোতা আবারো সেই পিছিয়ে পড়া একঘেয়েমির জন্ম দেয়। এখানেও আরেক সাদৃশ্য। ধর্মতলার সিনেমা, ম্যাগনোলিয়ার আইসক্রিম আর মার হাতের রান্না সত্যজিৎকে কলকাতায় চুম্বকের মত টেনে আনত। হাঁফ ছেড়ে বাঁচতেন শনি, রবি দুটো দিন। অপরাজিত - র সদ্য যুবক অপুর জীবন চলচ্চিত্রায়িত
করতে গিয়ে সত্যজিৎ নিজের অতীত যৌবনে ফিরে যান। ছবির দ্বিতীয় ভাগের এই বড় অপুর মধ্যে সূক্ষ থেকে সূক্ষতর ভাবে তিনি ধরে রাখেন তাঁর সেই ছায়াটিকে।
মনসাপোতার রেল স্টেশনে কলকাতার ট্রেন ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অপু কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারেনা। থেকে, থেকেই মনে পড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে বিদায় জানাতে থাকা অসুস্থ মার ক্লান্ত হাসি মাখা মুখ। সাউন্ডস্কেপে এক ধাতব শব্দের মৃদু তীক্ষ্ণতা , ঘুরে ফিরে আসা মার মুখচ্ছবি হয়ে অনবরত ঘা মেরে চলে অপুর মস্তিষ্কে। দৃষ্টি সংকুচিত হয়, শরীর ভারী হয়ে আসে। অপুর পা গেঁথে যায় নিশ্চিন্দূপুর , বারাণসী হয়ে মনসাপোতায় মার স্নেহরসে ভিজে ওঠা তার আপন মানব জমিনে। অলস পায়ে
মেঠো পথ ধরে ফিরে আসে অপু। মার ক্লান্ত মুখ খুশির আলোয় ভরে ওঠে। এই অপু সত্যজিতের একেবারে নিজের। সবার অলক্ষে ধীরে, ধীরে তাঁর হৃদয়ের নির্যাস ঢেলে তিনি প্রাণ সঞ্চার করেন এই অপুর মধ্যে।
মার ভয়ংকর অসুস্থতার খবর লেখা পোস্ট কার্ডটা মুঠোয় ধরে দুশ্চিন্তায় ডুবে যাওয়া অপু গুম মেরে বসে থাকে ট্রেনের কামরায়। নানান কথা, নানান চিন্তা ভাবনা নিঃশব্দে ছিড়ে খুড়ে ফেলতে থাকে তাকে। হাতে ধরা পোস্ট কার্ডে লেগে আছে মার ছোঁয়া। ঐ পোস্ট কার্ডটাই তখন মা, অপুর কাছে। মুঠোয় চেপে ধরে রাখে সে মাকে। পাছে মুঠো গলে মা হারিয়ে যায়। অনবরত দুশ্চিন্তার ঢেউ আঁছড়ে পড়ে অপুর মনে। তাকে টেনে নিয়ে যায় গভীর থেকে আরো গভীরে।
সারা বাড়ী পাগলের মত মাকে খুঁজে ফেরা সদ্য মা হারা অপুর মধ্যে মাতৃহীনতার প্রথম বোধ জাগে উঠোনে বট গাছের শিকড়ে হোঁচট খাওয়ার সাথে, সাথে। আবারো একবার নাড়ী ছেড়ার যন্ত্রণায় দুর্বল, অসহায় অপু এলিয়ে পড়ে সেই বটগাছের গুঁড়িতে। সদ্য মাতৃহারা শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণায় কাতর অপুকে ঐ বিশাল বট গাছ আরেক মার মত আশ্রয় দেয় তার স্নেহছায়ায়। তাকে ঘিরে রাখে তার বিশাল সব শেকড়ের স্নেহের বন্ধনে। নিঃশব্দে তাকে বলে চলে - বাবা, মা চলে গিয়েও কখনোই চলে যান না। তাঁদের স্নেহের শিকড় গেঁথে থাকে আমাদের হৃদয়ে। আজীবন ঘিরে রাখে আমাদের। কারণ, তা অবিচ্ছেদ্য। অন্ধকার থেকে উৎসারিত হয় আলো। আর সেই আলোয় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় আরো একবার মা সুপ্রভার প্রতি উজাড় করে দেন তাঁর হৃদয় নিংড়ানো সমস্ত শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।