Photo by Swarnavo Chakrabarti on Unsplash
আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি ভারতবর্ষের সভ্যতা শুরু হয়েছিল সবার ভাল, সবার মঙ্গল, এই জীবন দর্শনকে উদ্দেশ্য করে। এই ভাবনাকে উল্লেখ করা হয়েছিল প্রাচীন ইন্ডাস উপত্যকা সভ্যতার (৫,৫০০ - ১৩০০ খ্রীষ্ট পূর্বাবদ) লেখনিগুলোতে। যেখানে "আরোগ্যকে" সামগ্রিক মঙ্গল চেতনা হিসেবে দেখানো হয়েছে। চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন (৩৯৯-৪১৪ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে সে সময়কার ভারতবর্ষের খুব ভাল একটি রোগ নিরাময় মূলক পরিষেবা ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইউরোপ মহাদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর পূর্বে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক এবং ফ্রিম্যাসনদের বিভিন্ন গোপন গোষ্ঠীর মধ্যে চলত। কারণ, মধ্যযুগের তমসাচ্ছন্ন সময়ে রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর নিয়মানুযায়ী বিজ্ঞান চর্চা ধর্মবিরোধী বলে চিহ্নিত হত এবং কঠোর শাস্তি এমনকি প্রাণদণ্ড পর্যন্ত হতো। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতেও চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্বেও চিকিৎসার অগ্রগতি একটা পর্যায় অবধি এগিয়ে থেমেছিল। তারই মধ্যে "রেস্টোরেশন" (১৬৬০-১৬৮৮) অধ্যায়ের সময়কালে ঘটে যাওয়া লন্ডন শহরের ভয়ানক বিউবনিক প্লেগ (১৬৬৫) এর সময় চিকিৎসকরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন মানুষকে বাঁচানোর জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ক্রিমিয়ান যুদ্ধ, প্রুশিয়ান যুদ্ধ , নেপোলিয়ন এর অভ্যুত্থান প্রভৃতি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের হাত ধরে, পরবর্তীকালে প্রথম এবং দ্বীতিয় মহাযুদ্ধের আপৎকালীন প্রয়োজনীয়তা জীবনদায়ী চিকিৎসা এবং জীবনদায়ী ওষুধ আবিষ্কারের প্রক্রিয়াকে এমনভাবে তরান্বিত করল যে মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর নতুন করে ভরসা করতে শুরু করল। এমনকি এই পরিবর্তিত সময়ে মানুষ চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পেশাগত ভাবে বা জীবন ধারণের অবলম্বন হিসেবে নেয়ার কথাও ভাবতে শুরু করল। ফলতঃ, এতদিন দুরারোগ্য মনে হওয়া অসুখগুলো থেকেও রোগীরা সেরে উঠতে লাগল এবং মানুষের জীবনের পাশাপাশি পশুপাখিদের জীবনের ক্ষেত্রেও চিকিৎসাশাস্ত্র অপরিহার্য হয়ে উঠতে লাগল। (পরের পাতায় দেখুন)
চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রাচীন ভারতবর্ষে একটি স্বেচ্ছাসেবা মূলক কাজ ছিল। প্রাচীন কাল থেকে চিরাচরিত চিকিৎসকরা সেবা মূলক উদ্দেশ্যেই মানুষকে সেবা করে আসছিলেন। ঔষধি ভেষজ এবং শেকড় বাকড় সম্বন্ধে জ্ঞান চিকিৎসকদের এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতো। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন এই ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটায়। খৃষ্টান মিশনারীদের তৈরি হাসপাতাল চিকিৎসা জগতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এমনকি বিদগ্ধ জনেরা তাদের পাশ্চাত্য ঘেঁষা মনোভাব নিয়ে পাশ্চাত্য চিকিৎসার দিকেই ঝুঁকলেন।
স্বাধীনতাত্তোর ভারতে, জনকল্যাণ মূলক রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার সাথে, সাথে রাষ্ট্র নাগরিকদের ত্রাণ, চিকিৎসা পরিষেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার বণ্টনের জন্য দায়ী হয়ে পড়ল। এসবের মধ্যে চিকিৎসা পরিষেবার দায়িত্বটা সব থেকে স্পর্শকাতর বিষয়ে পরিণত হল, কারণ এর সাথে মানুষের বাঁচা মরা নির্ভর করে। ক্রমশঃ বাড়তে থাকা চিকিৎসার চাহিদার সাথে পাল্লা দেয়ার জন্য সরকার, সরকারি চিকিৎসার পাশাপাশি বেসরকারি চিকিৎসার প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রেও জোর দিতে লাগল। আবার এর সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিক্ষিত এক বিরাট সংখ্যক চিকিৎসক তৈরি করাও জরুরি হয়ে পড়ল। সারা দেশ ব্যাপী মেডিকেল কলেজগুলো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকার এমবিবিএস, এমডি এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করতে লাগল। পুরোনো বৃটিশ চিকিৎসা পাঠক্রমে শিক্ষিত এলএমএফ ডিগ্রীধারী চিকিৎসকদের সুযোগ দেয়া হল, তৎকালীন আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষায় নিজেদেরকে শিক্ষিত করে এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করার জন্য। এলএমএফ ডিগ্রীকে চিরতরে বাতিল করে দেয়া হল। তবে ১৯৭০ এর দশকের শেষ থেকে জাতীয় মেডিকেল কলেজের নতুন করে প্রতিষ্ঠা থামিয়ে দেয়া হল।
স্বাধীনতার আগে ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। সংক্রামক ব্যাধি থেকে বিরাট সংখ্যক মানুষের মৃত্যু হতো। স্বাধীনতার পর ভারত সরকার সারা দেশ জুড়ে প্রাইমারি স্বাস্থ্য পরিষেবার দিকে নজর দেয়। কিন্তু ক্রমবর্ধক জনসংখ্যার সাথে তাল রেখে সরকার প্রাইমারি, সেকেন্ডারি এবং টার্টিয়ারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পালন করতে পারছিলনা। অন্যান্য অর্থাগমের পথ খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল এই ঘাটতিকে পূরণ করার জন্য। '৮০- র দশকের আগে পর্যন্ত বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ছিল খুবই ক্ষুদ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ। ছোট হাসপাতাল এবং নার্সিং হোম, যেখানে পরিষেবার মান ছিল বেশ ভাল। ১৯৮০ - র দশক থেকে সরকার এটা যখন বুঝল যে এই বিশাল সংখ্যক জনগণের সেবা দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবেনা, তারা বেসরকারি হাসপাতালের জন্য দরজা খুলে দিল। ধীরে, ধীরে উন্নত মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য প্রযুক্তি, বিপিও, টেলিমেডিসিন এবং মেডিক্যাল ট্যুরিজমের হাত ধরে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত হয়ে উঠল। বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলি ব্যয়বহুল পাঁচতারা হাসপাতালগুলো তৈরি করল। তাতে অবশ্য সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হয়নি, কারণ সেসব হাসপাতালের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সাধারণের সাধ্যের বাইরেই রয়ে গেল।
স্বাধীন ভারতের চিকিৎসার ইতিহাসকে তিনটি অধ্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ, ১৯৪৭-১৯৮৩ - এই সময়কালের মধ্যে সরকার ঘোষণা করেছিল আর্থিক অভাবের জন্য কোনো মানুষকে চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। সরকারের দায়িত্ব সব মানুষের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা । দ্বীতিয় অধ্যায়ে, ১৯৮৩ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি চালু হল। যার মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে হাসপাতাল আর নার্সিংহোম করার অনুমতি দেয়া হল, ভর্তুকির সুবিধের সাথে। এই নীতি সরকারি খাতে তৈরি প্রাইমারি হেলথ কেয়ার পরিষেবাকে আরো ছড়িয়ে দিল এবং গ্রামীণ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিষেবাকে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির মাধ্যমে আরো প্রসারিত করা হল। ২০০০ সাল অবধি দ্বীতিয় অধ্যায়ের সীমা চিহ্নিত করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে ২০০০ সালের পরে পাবলিক - প্রাইভেট পার্টনারশিপ, বীমা ক্ষেত্রে মুক্তিকরণ এবং সরকারকে অর্থ যোগানকারী হিসেবে দেখা গেল। সরকারি উদ্যোগ স্মল পক্স, গিনি ওআর্ম কে মুছে ফেলতে পেরেছে এবং কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া আর পোলিওর হার অনেকটা কমিয়ে আনতে পেরেছে ( ন্যাশনাল হেল্থ প্ল্যান, ২০০২)। তবুও আমাদের কৃতিত্ব আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অনেক নিচে রয়ে গেছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ আজও বিশাল সংখ্যক ভারতবাসী যক্ষায় আক্রান্ত হচ্ছে। তাছাড়া এত সচেতনতা শিবির করার পরও এইচ আই ভি/ এইডস এর রোগীর সংখ্যাও একটা চিন্তার বিষয় হয়ে রয়েছে। আজ ভারতবর্ষ ১৪০ কোটি মানুষের দেশ। ভারতের এই বিশাল এবং বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থার সমস্ত স্তরে পর্যাপ্ত পরিমাণে চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেয়া ভারত সরকারের সামনে বর্তমানে সব থেকে গুরুত্বপুর্ণ একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
ভারতের চিকিৎসা পরিষেবা পাবলিক এবং প্রাইভেট এই দুই শ্রেনীর মধ্যে বিভক্ত। পাবলিক সেক্টরে সরকার চিকিৎসা পরিষেবার দায়িত্ব নেয়। পাবলিক সেক্টর ১৮% বহির্বিভাগের রোগী এবং ৪৪% আভ্যন্তরীণ বিভাগের রোগীর দায়িত্ব বহন করে। পাবলিক সেক্টর মূলতঃ তৈরি হয়েছিল সব স্তরের মানুষকে পরিষেবা দেবার জন্যই। কিন্তু ৫৭% শতাংশ মানুষের মতে নিম্ন মানের চিকিৎসা পরিষেবার কারণেই সাধারণতঃ দরিদ্র শ্রেণী ছাড়া মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষেরা খুব একটা সরকারি চিকিৎসার ওপর ভরসা করেনা। নিম্ন চিকিৎসা পরিষেবার কারণ হচ্ছে অনভিজ্ঞ এবং এক প্রকার অনিচ্ছায় চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ার কারণে গ্রামে থাকতে বাধ্য হওয়া শিক্ষানবিশদের দ্বারা দেশের বেশিরভাগ অংশ, গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিসেবাকে চালানো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভাল চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীরা গ্রামে যেতে চান না। ফলতঃ এই হাল।
দেশের সংবিধান পাবলিক সেক্টরকে কেন্দ্র এবং রাজ্য, এই দুয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। কেন্দ্র চিকিৎসার প্রযুক্তিগত শিক্ষা এবং গবেষণার দিকগুলো সামলাবে, বৃহত্তর পরিবার কল্যাণ, প্রাণঘাতী রোগ, মহামারী এবং অতিমারিকে নিয়ন্ত্রণ করা। আর রাজ্য কাঠামোগত দিক, কর্মসংস্থান, আঞ্চলিক হাসপাতালের ব্যবস্থা, জন সংযোগ এবং সাফাই কাজের পরিষেবা দেবার দিকগুলো দেখবে। রাজ্যের যেখানে তার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর স্বায়ত্তশাসন রয়েছে , কেন্দ্র আবার রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের ফিসকাল (Fiscal) নীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
২০১৪ সালে ন্যাশনাল হেলথ অ্যাসুরান্স মিশন শুরু হয় যা ভারতের নাগরিকদের বিনা খরচায় চিকিৎসা, তা সংক্রান্ত পরীক্ষা নীরিক্ষার সুবিধে এবং গুরুতর অসুস্থদের জন্য চিকিৎসা বীমার সুবিধের কথা ঘোষণা করে। ২০১৮ সালে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প চালু করে ৪০% ভারতীয়কে নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা দেবার প্রচেষ্টা শুরু হয়, যা আবার অনেকাংশে বেসরকারি সংস্থাগুলো দ্বারা পরিচালিত হবে। বছরে গড় খরচ নির্ধারিত হয়েছে ১.৭ বিলিয়ন টাকা।
ভারতের সংসদ ১৯৮৩ সালে জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি (NHP) গ্রহণ করে এবং ২০০২ আর ২০১৭ তে যথাক্রমে পরিমার্জন এবং পুনর্পরিমার্জন করে। ২০১৭ সালে গ্রহণ করা মূল চারটি নীতি ছিল, অ - সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা, একটি শক্তসমর্থ চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরি করা, চিকিৎসা খাতে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত খরচ নিয়ন্ত্রণ করা। তবে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করে ইউনিভার্সাল হেলথকেয়ার (UHC) কর্মসূচীকে সার্থক ভাবে পালন করা।
২০০৫ এর পর থেকে ভারতের চিকিৎসা জগতের প্রসার লাভ হয়েছে মূলতঃ বেসরকারি ক্ষেত্রে। দেশের ৫৮% হাসপাতালে বেসরকারি, ২৯% হাসপাতাল বেড এবং ৮১% চিকিৎসক বেসরকারি চিকিৎসার সাথে যুক্ত।
ন্যাশনাল হেল্থ মিশন (NHM) ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি উদ্যোগ যার আওতায় পড়ে ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন (NRHM) এবং ন্যাশনাল আরবান হেল্থ মিশন (NUHM)। NHM এর কাজ হল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবার গঠনগত পরিকাঠামো এবং সেবার উন্নতি করা , নতুন পরিষেবা চালু করা, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং তার নিয়মিত যোগানের উন্নতি সাধন করা। গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় মানব সম্পদ যোগান দেয়া যেমন, চিকিৎসক, সেবিকা এবং প্যারামেডিকেল কর্মীদের যোগান দেয়া এর উদ্দেশ্য। গর্ভকালীন উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিশুর জন্মকালীন দক্ষ চিকিৎসা কর্মীর উপস্থিতি এবং টিকাকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মা, নব জাতক এবং শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষা ছিল NHM এর আরেকটি উদ্দেশ্য। শেষে জন স্বাস্থ্য শিবিরের মাধ্যমে সংক্রামক এবং অসংক্রামক রোগের মোকাবিলা করাও NHM এর উদ্দেশ্য। ২০২৪ এ NHM এর বাজেট ছিল ২৯০ মিলিয়ন টাকা।
২০১৮ সালে শুরু হওয়া আয়ুষ্মান ভারত আরেকটি স্বাস্থ্য উদ্যোগ যা হেল্থ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার (HWC) এবং প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা - র (PMJAY) মাধ্যমে ভারতের আর্থিক ভাবে ভঙ্গুর সম্প্রদায়গুলিকে সাহায্য করবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ১১৭ হাজার আয়ুষ্মান ভারত - হেল্থ অ্যান্ড ওয়েলনেস সেন্টার (AB - HWC) কেন্দ্র সারা দেশে স্থাপিত হয়েছিল। AB - HWC বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণ করে, চিকিৎসা সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং টেলি মেডিসিন সেবা দিয়ে থাকে। HWC প্রতিষেধক মুলক, প্রচার মুলক এবং নিরাময় মুলক সেবা দান করে থাকে গ্রাম এবং শহরের মানুষকে। ২০২২ সাল নাগাদ ২১৭ হাজার জন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ভারতে স্থাপিত হয়েছে। বহির্বিভাগের দ্বারা ১.৪ বিলিয়ন রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব হয়েছে যা ২০২১ এ ছিল ১.১ বিলিয়ন।
ভারতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ৪১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি পরিকাঠামো। তাও এই ব্যবস্থাকে অনেক বিপত্তির সন্মুখীন হতে হয়। যেমন বর্ধিত স্বাস্থ্য রক্ষার খরচ, দম্পতি - কেন্দ্রিক পরিবার বেড়ে চলার জন্য একলা পড়ে থাকা বয়স্ক পিতা - মাতা এবং অন্যান্য বয়েজ্যেষ্ঠদের সেবা করা এবং সব সময়ে দেখে রাখার জন্য লোক প্রয়োজন। দরিদ্র শ্রেনীর ওপর তৈরি হওয়া তীব্র অর্থনৈতিক চাপ, নতুন ধরনের রোগের ভয়ানক প্রভাব এবং অপ্রতুল সরকারি লগ্নির কারণে জনস্বাস্থ্যের খাতে চূড়ান্ত অবহেলা এবং গ্রাম এবং শহরে অসমান স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ । জনগনের নিজস্ব সঞ্চিত অর্থ থেকে চিকিৎসার খরচ চালানোর ব্যয়ভার কমানোর জন্য স্বাস্থ্য বীমা পরিষেবা চালু হল যা এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। মাত্র ৩৭% ভারতীয় জনগণকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনা গিয়েছে।
ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিকদের কাছে এই তৃতীয় সহস্রাব্দেও চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দেয়া এক সমস্যার বিষয়। কারণ, সমস্ত নাগরিকদের মধ্যে, শারীরিক প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী, সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া, সমাজের প্রান্তিক গোষ্ঠী সমূহ এবং সামাজিক ভাবে এক ঘরে হয়ে যাওয়া মানব গোষ্ঠিগুলিও পড়ে। এছাড়া, পার্বত্য এলাকার মানুষজন এমন এক প্রতিকূল পরিবেশে থাকে, যেখানে স্বাভাবিক সময় এবং বিপর্যয়ের কালে হেলিকপ্টার এবং সামরিক হেলিকপ্টার করেও চিকিৎসা পরিষেবা পৌঁছে দিতে হয়। দেশব্যাপী জিইয়ে থাকা চিকিৎসা পরিষেবা সম্পর্কিত সামগ্রিক সমস্যাগুলি হল :
ভারতের মানুষ তাদের স্বাস্থ্যের গুরুত্বপুর্ণ বিষয়গুলি সম্পর্কে কতটা অবগত? ভারতবাসীর স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে বহু পড়াশোনা এবং গবেষণা হয়েছে। দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মাত্র তিন ভাগের এক ভাগ প্রসব - পূর্ব মায়েরা স্তন্যদান বিষয়ে সঠিক ভাবে জানেন। হরিয়ানার শহরাঞ্চলে মাত্র ১১.৩% কিশোরীরা জন্মসংক্রান্ত শারীরিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে সঠিক ভাবে জানে। মাত্র ২০.৩% বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ বার্ধক্য কালীন অসুস্থতার ক্ষেত্রে কোন্, কোন্ রোগের প্রাদূর্ভাব দেখা দেয়, এবং তাদের প্রতিরোধ করার উপায় কি, তা সম্বন্ধে সঠিক ভাবে অবগত।
ভারতে স্বাস্থ্য সচেতনতার হার এত কম কেন ? উত্তর লুকিয়ে আছে নিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা, কম স্বাক্ষরতার পরিমাণ, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্বন্ধে নিম্ন মানের সচেতনতা এবং জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য না দেবার প্রবণতার মধ্যে। তবুও উৎসাহের কথা হল, স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিগত প্রচেষ্টাগুলি ফলপ্রসূ হয়েছে এবং হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বিহার এবং ঝাড়খন্ডের প্রসূতি মহিলাদের কিছু অভ্যাস বদলের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর গর্ভপাতের ক্ষেত্রে তাদের সচেতনতা এবং ধারণা বেড়েছে। কিশোরীদের , সন্তানের জন্মের সময়ে তাদের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন করার পর দেখা গিয়েছে, তাদের ভেতরে শিশু জন্ম , শিশুর স্বাস্থ্য, মা ও শিশুর পুষ্টি, পরিবেশমূলক স্বাস্থ্য এবং সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে সচেতনতা অনেকাংশে বেড়েছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়াতে হবে, অপেক্ষাকৃত নিচু তলার শিশু এবং কিশোর কিশোরীদের মধ্যে প্রয়োজনীয় অভ্যাসগত বদল আনার জন্য।
অক্সফোর্ড অভিধান অনুযায়ী, স্বাস্থ্য পরিষেবার সাহায্য নেয়াকে, "স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ব্যবহার করার এবং উপকৃত হওয়ার অধিকার এবং সুযোগকে" বলা হয়েছে। এর পরেও যখন আমরা স্বচ্ছল শহুরে সমাজের বাইরে শহরেরই দরিদ্র পরিবারগুলির দিকে তাকাই, তখন স্বাস্থ্য পরিষেবার সুবিধাগুলি তাঁরা কতটা নিতে পারছেন, সেটা একটা বিরাট প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায়। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পরিষেবার সহজলভ্যতা, তার সঠিক ব্যবহার এবং পরিষেবার সঠিক সরবরাহ এক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় আর্থিক, প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা স্বাস্থ্য পরিষেবার সঠিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
৩) নিয়ম অনুযায়ী রোগীর বাসস্থান থেকে ৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে নিকটবর্তী স্বাস্থ্য পরিষেবা না থাকায়, বহু সংখ্যক রোগী সঠিক সময়ে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান না। ২০১২ সালের একটি সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের গ্রামে মাত্র ৩৭% মানুষ তাদের বাসস্থানের ৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পান। এবং ৬৮% মানুষ ঐ একই দূরত্বের মধ্যে হাসপাতালের বহির্বিভাগের স্বাস্থ্য পরিষেবা পান। এই কারণে, শহরাঞ্চল থেকে ক্রমশঃ দূরবর্তী স্থানে থাকা মানুষরা দুর্বলতা, অপুষ্টি এবং অসময়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হন।
যদিও বা স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি ৫ কিলোমিটার বা তার আশেপাশে অবস্থিত, তার পরিষেবার মান কি এবং সেটি কি সরকারি নিয়মানুযায়ী ২৪ ঘণ্টা অনবরত পরিষেবা দেয় ? যদিও ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন বৃহত্তর প্রচেটা করেছে গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য, ২০১২ সালের একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, গ্রামীণ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলি গোড়ার পরিকাঠামোগত অভাব যেমন, পর্যাপ্ত রোগীর বিছানা, পর্যাপ্ত রোগের বিভাগ, সঠিক শৌচালয়, পানীয় জলের ব্যবস্থা, পরিষ্কার আতুড় ঘর এবং অনবরত বিদ্যুৎ সরবরাহ, এই সব কিছুর অভাবে জর্জরিত।আমাদের উচিৎ সমস্ত রকম সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক ব্যবস্থার বাঁধা বিপত্তিগুলি দূর করে সুষ্ঠ স্বাস্থ্য পরিষেবাকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
(পরের পাতায় দেখুন)
কোনো স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হল, মানব সম্পদ। স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে কি সঠিক সংখ্যায় কর্মী আছেন বা থাকলেও তারা কি সঠিক ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ? তাদের কি স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির প্রয়োজনানুযায়ী নিয়োগ করা হয়েছে ? কর্মীদের কি তাদের কাজ সম্পর্কে সঠিক মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে ? ২০১১- র সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষে প্রত্যেক ১০০০ জন মানুষের জন্য ২০০ জন স্বাস্থ্য কর্মী উপস্থিত আছেন। এদের মধ্যে ৩১% অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক, ধাত্রীমা এবং সেবিকা ৩০%, ঔষধ প্রস্তুতকারক ১১%, আয়ূষ চিকিৎসক ৯% এবং অন্যান্য বিভাগীয় কর্মী ৯% আছেন। এবং এই মানব সম্পদকে ঠিকঠাক পরিমাণে বিতরণ করা হচ্ছেনা, কারণ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পেশাদাররা শহরে থেকে কাজ করাই পছন্দ করেন, যেহেতু শহরে জীবন যাপনের সমস্ত সুযোগ সুবিধেগুলো পাওয়া যায়। কিন্তু ভারতের ৬৬% মানুষ গ্রামে থাকেন। সেখানে চিকিৎসক - রোগীর অনুপাত খুবই কম, মাত্র ০.৭% চিকিৎসক প্রতি ১০০০ জন মানুষের জন্য। যেখানে ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন (WHO) এর নির্ধারিত অনুপাতটি হল প্রত্যেক ১০০০ জন মানুষের জন্য ২.৫% চিকিৎসক থাকতে হবে। এই সমস্যাকে মেটাতে গেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মেডিকেল কলেজ এবং ট্রেনিং কলেজ তৈরি করতে হবে।
বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রগুলি যেমন সারা দেশের মানুষের স্বাস্থ্য খাতে খরচের সিংহ ভাগ নির্ধারণ করে, তেমনি দেশ জুড়ে অনুন্নত দরিদ্র শ্রেণীর মানুষদের বাঁচার একমাত্র ভরসা সরকারি হাসপাতালগুলো। গ্রামাঞ্চলে একজন গুরুতর অসুস্থ রোগী দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক সরকারি হাসপাতালে যখন একজন নিম্ন মানের প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্য কর্মীর সন্মুখীন হন, তখন তা ব্যক্তিগত ভাবে এবং সমষ্টিগত ভাবে মানুষের আঞ্চলিক স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতি অভ্যাসগত বদল তৈরি করে। ২০১৫- র ভারত সরকারের গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী ধাত্রীমা এবং সেবিকা পদের ১০.৪% খালি রয়ে গিয়েছে। পুরুষ স্বাস্থ্য কর্মীদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ৪০.৭%। পাবলিক হেল্থ কেয়ারগুলিতে ২৭% চিকিৎসকের পদ শূন্য, যা সরকারের নির্ধারিত পদের চার ভাগের এক ভাগ।
বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে, বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে পাবলিক হেল্থ কেয়ার পরিষেবা দেবার বিষয়ে। যাঁর সর্বশেষটি হল, বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্য প্রকল্পের ধারায় বেসরকারি হাসপাতালে রোগীকে বিনামূল্যে পরিষেবা দেয়া, যার খরচ সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রদান করবে। একটি আদর্শ সমাজে এই রকম ব্যবস্থা স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসা খরচ মেটানোর পরিধিটাও বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু সেটা কি দায়িত্বের পরিবর্তনকে সুনিশ্চিত করে ? বা পাবলিক হেল্থ কেয়ার ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোকে স্বীকার করে ? সময় এসে গিয়েছে এমন একটা নীতি নেবার যার মাধ্যমে সঠিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসাকর্মীরা ভারতের শেষ নাগরিককেও একটি সংবেদনশীল, যোগ্য স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে পারে।
৫) স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাকে আরো অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এর জন্য গোটা পরিচালনা ব্যবস্থার মধ্যে আরো স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন।
৬) ভারতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কাঠামোগত ভাবে সেই শুরুর দিন থেকে একটি বিরাট ত্রুটি নিয়ে চলছে। যা হল পর্যাপ্ত শিক্ষাগত পরিকাঠামোহীন মেডিকেল কলেজ। এবং প্রয়োজনানুসারে সঠিক পরিমাণে, সমস্ত সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন মেডিকেল কলেজও সেই ভাবে তৈরি হচ্ছেনা।
৭) বেশ কিছু সময় আগে দেশের সরকার আইন পাশ করেছে যে, নূন্যতম ৫ একর জমির ওপর মেডিকেল কলেজ তৈরি করতে হবে। সেই নিয়ম মেনে, গ্রামাঞ্চলে বেশ কিছু হাসপাতাল তৈরি হয়েছে। কিন্তু শহরাঞ্চলের হাসপাতালের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মাইনে এবং শহরাঞ্চলের সুযোগ সুবিধার অভাবের জন্য সুযোগ্য চিকিৎসকরা সেই সব হাসপাতালে নিযুক্ত হতে চাইছেন না। সম্প্রতি, ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন ৫ একর জমির নিয়মটি বাতিল করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে একটি মেডিকেল কলেজের আসন সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সেই কলেজের সংশ্লিষ্ট হাসপাতালটির শয্যার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার কথাও এই নতুন নিয়মে বলা হয়েছে। এবং বক্তৃতা কক্ষ, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার, ছাত্রাবাস এবং শিক্ষকদের অফিসের ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়েছে।
বহু বছর ধরে সরকারি হাসপাতালগুলি অকল্পনীয় রোগীর চাপ বহন করে চলেছে। বর্তমানে, প্রায় বাৎসরিক ১.৪ বিলিয়ন রোগীকে চিকিৎসা পরিষেবা দেয়া একটি পর্বত প্রমাণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নির্দিষ্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে বহির্বিভাগ এবং অন্তর্বিভাগে রোগীর চিকিৎসার স্বাভাবিক গতি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার যাতে তা কোনোভাবে বাধাপ্রাপ্ত না হয়। এর সাথে যুক্ত করতে হবে, প্রযুক্তিগত চিকিৎসা পরিষেবা যার একটি অংশ হবে দূরাভাস নির্ভর চিকিৎসা। এই পদ্ধতিতে সাধারণ রোগী তার বাড়ীতে বসেই প্রয়োজনীয় চিকিৎসা এবং ওষুধের নাম পর্যন্ত জেনে যাবেন। ফলে হাসপাতালে রোগীর চাপ কিছুটা কমবে।
৯) তথাকথিত উচ্চ মানের ডায়াগনস্টিকস বা রোগ নির্ণয় কেন্দ্রগুলি মূলতঃ শহর এবং তার আশেপাশেই অবস্থিত। গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসা পরিষেবা শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, যার মাধ্যমে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুই রোগীরা পেয়ে থাকেন। গ্রামীণ ভারতে মূল অসুখগুলো হল, মা এবং সন্তানের অপুষ্টি, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ফুসফুসের সংক্রমণ, ডায়রিয়া, এই সব নানা ধারণের দূষণ জনিত অসুখ। অস্বাস্থ্যকর বসবাসের পরিবেশ, সচেতনতার অভাব, ভাল বসবাসের পরিবেশ পাওয়ার সীমাবদ্ধতা, সুশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত ওষুধের অভাব এবং সুচিকিৎসকের অভাব, ৭০% নাগরিকের নিত্য সঙ্গী। গ্রামীণ ভারতে কম মূল্যের, ভাল যোগাযোগ সম্পন্ন এবং নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি অনুপস্থিত, যার মাধ্যমে সুলভে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয়া যায়। এইসব অঞ্চলের কম প্রশিক্ষিত কর্মীদের জন্য সহজে গ্রহণযোগ্য প্রশিক্ষণ মাধ্যম চালু করা দরকার, যার ফলে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটিকে পরিচালনা করতে পারবে। সাম্প্রতিক কালে ভারত এবং ইসরায়েল এর মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে এই সব সমস্যা সমাধানের পথ খোঁজা শুরু হয়েছে।
প্রত্যেক বছর ৫.৮ মিলিয়ন ভারতবাসী হৃদরোগ, ফুসফুসে সংক্রমন, স্ট্রোক, কর্কট রোগ এবং ডায়াবিটিস থেকে মারা যায়। ৭০ বছর বয়েসে পৌঁছনোর আগে, প্রত্যেক ৪ জন ভারতীয়ের মধ্যে ১ জন নন-কমিউনিকেবল ডিসিস (NCD) থেকে মারা যায়। NCD র কারণে ২০১২ থেকে ২০৩০ এর মধ্যে ভারত সরকার ৪.৫৮ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি স্বীকার করতে চলেছে। কার্ডিওভাসকুলার অসুখ, ক্যান্সার, পুরোনো ফুসফুসের অসুখ, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য নন কমিউনিকেবল ডিসিস থেকে ৬৯% ভারতবাসী মারা যান। এছাড়া, হাসপাতালের ৪০% ইন্ডোর পেশেন্ট এবং ৩৫% নতুন ভর্তি হওয়া রোগী জানা যায় NCD র রোগী। আংশিক ভাবে এই সব অসুখের জন্য দায়ী অবশ্য পরিবর্তনযোগ্য অভ্যাসগুলো হল, তামাকজাত দ্রব্যের মাত্রাতিরিক্ত সেবন, বাঁধনছাড়া মদ্যপান, শরীর চর্চার অভাব, নিম্ন মানের ক্ষতিকারক খাদ্য দ্রব্য খাওয়া, নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি এবং অস্বাস্থ্যকর বসবাস। এসব বদঅভ্যাসের থেকে মানুষ মারা যায়। সরকার একটি উচ্চমানের সৃষ্টিশীল প্রযুক্তি মাধ্যমের খোঁজ করছে যা সাশ্রয়কারী, সহজে ব্যবহারযোগ্য, দীর্ঘমেয়াদি এবং সময়ানুযায়ী, স্বাস্থ্যের ওপর নজর রাখবে। এই প্রযুক্তিটি রোগীর বাড়ীতে সেবা যত্নের বিষয়েও উপদেশ দেবে। দূরবর্তী স্থানে রোগীর সেবা যত্ন কেমন হবে, নিয়মিত বিরতিতে স্বাস্থ্য সম্বন্ধে পরামর্শ এবং স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়গুলি দেখবে। এই নতুন প্রযুক্তি চলে আসা পুরোনো প্রযুক্তির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে।
১১) আমেরিকার বৃহত্তম সংবাদ সংস্থা সিএনএন এর পর্যটন উপদেষটা মণ্ডলীর ২০১৯ এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২০ নাগাদ ভারত বিশ্বের বৃহত্তম চিকিৎসা পর্যটন (medical tourism) কেন্দ্র হিসেবে ৯ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার রোজগার করার কথা। এই সম্ভাবনার পেছনে থাকা কারণগুলি ছিল, অপেক্ষাকৃত কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবা, চটজলদি ভিসা পরিষেবা এবং বিপুল সংখ্যক ভারতীয়ের ইংরেজিতে কথা বলার অভ্যাস। বাংলাদেশ ছাড়া আর যেসব দেশগুলি ভারতকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসা সংক্রান্ত পর্যটক সরবরাহ করে, তারা হল, মালদ্বীপ, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু ভারতীয়রা নিজেরা কি তাদের সরকারের থেকে তাদের অবশ্য - প্রাপ্য স্বাস্থ্য সাহায্যগুলো পাচ্ছে ?
২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদী চালু করেন "ন্যাশনাল হেল্থ প্রোটেকশন মিশন" বা "মোদী কেয়ার"। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ব্যারাক ওবামার প্রতিষ্ঠিত "ওবামা কেয়ার" এর আদলে তৈরি "মোদী কেয়ার" ভারতের ৫০ কোটি নাগরিককে সুলভে স্বাস্থ্য বীমা পরিষেবা দেবার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত আর্থিক পুঁজির অভাবে পরিকল্পনাটিকে পুরোপুরি বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয় নি। অন্য দিকে, বিশ্ব ব্যাংক তাদের পরিসংখ্যানে ঘোষণা করেছে, বিশ্বের বৃহত্তম স্বাস্থ্য পরিষেবা ভারতবর্ষে পাওয়া যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে স্বাস্থ্য বীমা পরিষেবা না পাওয়ায় ৬৫% ভারতবাসী এখনো চিকিৎসার খরচ তাদের নিজেদের পকেট থেকেই দেয়।
বিশ্বের দীর্ঘমেয়াদি সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য বীমা "আয়ুষ্মান ভারত" প্রচুর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। উচ্চমানের পরিষেবা সুনিশ্চিত করা, পরিষেবার আকাশছোঁয়া খরচ, বীমা পরিষেবা গ্রহীতার সচেতনতার অভাব, তথ্যের গুণমান এবং সুরক্ষা বজায় রাখা, স্বাস্থ্য কর্মীদের কর্মদক্ষতার বৃদ্ধি ঘটানো এই সব বাকী সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এইসব বাধাগুলো পেরোনোর জন্য ভারত সরকার পদক্ষেপ নেবার ডাক, "a call for action" এর দায়িত্ব দিয়েছে স্টার্ট আপ গোষ্ঠীকে ( Start up India).
সরকারি এবং বেসরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্র মিলিয়ে বার্ষিক স্বাস্থ্য খরচ মোট GDP - র ২.৯%। মোট চিকিৎসা ব্যয়ের এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৩০% আসে সরকারি খাত থেকে। অন্য উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকারি চিকিৎসার খরচের পরিমাণের তুলনায় ভারতের এই খরচের পরিমাণ বেশ কম। এটা নির্দেশ করে রোগীর পরিবার একক ভাবে নিজেরাই তাদের চিকিৎসার ভার বহন করে। একেই বলে "আউট অফ দ্যা পকেট এক্সপেন্ডিচার" (OOPE)। এটা আরো পরিষ্কার করে যে ভারতে রোগী এবং তার পরিবার চিকিৎসা খাতে সরকারি আর্থিক সুরক্ষা খুবই কম পরিমাণে পায়। OOPE এর ক্ষেত্রে সর্বাধিক ৫২% খরচ হয়ে থাকে ওষুধ ক্রয়ের ক্ষেত্রে। যার মধ্যে ৩৮.০১% ব্যয় হয় শহরে আর ২৬.২৯% খরচ হয় গ্রামে। শুধু স্বাস্থ্য বীমার দ্বারা গ্রামে ১৪% এবং শহরে ১৯% অঞ্চলের মানুষ চিকিৎসার ভার লাঘব করে থাকে। প্রত্যেক বছর নিরুপায় হয়ে এই বিশাল চিকিৎসার ভার বহন করতে গিয়ে ৭% এর কাছাকাছি জনগণ দারিদ্র সীমার নীচে চলে যাচ্ছে। ২০২০ সালের করোনা ভাইরাসের অতিমারির ফলে বার্ষিক ২৮% শতাংশ মানুষ চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে দারিদ্র সীমার নীচে চলে গিয়েছেন।
১৪) সরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্র ছাড়াও বেসরকারি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও নিম্ন এবং মাঝারী অর্থনীতির দেশগুলি বহু সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা করে থাকে। যেমন, ভিয়েতনাম দেশটির সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা সেই দেশের ৬০% রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে থাকে, যেখানে ভারতে ৯০% ডায়রিয়া আক্রান্ত শিশুদেরকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই জায়গা থেকেই, ভারতের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারি লগ্নি আরো বাড়াতে হবে।
১৫) সামাজিক ব্যবস্থার সাথে জড়িত যে শিক্ষা, তা গ্রহণ এবং বর্জন করার অনেক উপায় থাকে। চিকিৎসা শিক্ষায় শুধু রাসায়নিক বিক্রিয়াজাত যে নাম, যাকে ওষুধের জেনেরিক নাম বলে, তার ব্যবহার হয়। কিন্তু বাস্তবে চিকিৎসা করার সময় সেই চিকিৎসক যদি সেই নামটি প্রেসক্রিপশনে লেখেন, তাহলে ওষুধের দোকান জানতে চাইবে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড নেম যেটা ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা দেয়। সেক্ষেত্রে চিকিৎসককে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড নেমগুলি মুখস্থ করতে হয়।
১৬) বর্তমান ভারতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নীতি সমূহ ১৯৪৬ সালে পেশ হওয়া "ভোরে কমিটির" বিবরণ এর ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে, যা থ্রি টায়ার বা উন্নয়নশীল সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিট তৈরি করেছিল। প্রাথমিক কেন্দ্র, সহায়ক কেন্দ্র এবং কমুনিটি সেন্টার এর মাধ্যমে সেই ভিট স্থাপিত হয়েছিল। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ন্যায়সঙ্গত অধিকার ছিল এর লক্ষ্য। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণে ধীরে, ধীরে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠলো।
ক) HTA কে পরিচালনা করার জন্য মানানসই কর্মীবল পাওয়ার অসুবিধা। যদিও মেডিকেল টেকনোলজি অ্যাসেসমেন্ট বোর্ড (MTAB) এই কাজের জন্য ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচী এবং অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।
খ) পদ্ধতিগত ভাবে প্রযুক্তির বিশুদ্ধতা এবং ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখার অসুবিধে।
গ) ভারতে তথ্য - অবকাঠামো খুব একটা উন্নত না হওয়ায় খারাপ মানের তথ্য মেলে এবং প্রয়োজন মাফিক তথ্য মেলেনা।
ঘ) কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে স্বচ্ছতা এবং নীতিগত ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
ঙ) চিকিৎসক এবং অন্যান্য লগ্নিকারীরা যারা MTAB - র সুপারিশের সাথে একমত হতে পারেনা তাদের তরফ থেকে বাঁধা আসে।
১৮) বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবায় আছে প্রায় ১১৮৫২৪২ টি শয্যা। সরকারি হাসপাতালে আছে প্রায় ৭১৩৯৮৬ টি শয্যা। গড়ে হিসেবটি দাঁড়ায় প্রতি ১০০০ জনে ১.৪ টি করে শয্যা। যা WHO এর ধার্য করা মাপকাঠি , প্রতি ১০০০ জনে ৩.৫ টি শয্যার থেকে অনেক কম। ২০২৩ এর হিসেব অনুযায়ী সরকারের স্বাস্থ্য খাতে লগ্নি হল বার্ষিক GDP - র ২% এরও কম। আবার বেসরকারি খাতে বার্ষিক জি ডি পি - র ৩% এর কম। এই দুটো খাতে মিলিয়ে সরকার স্বাস্থ্য পরিষেবায় যা লগ্নি করে তা বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে গড় লগ্নি ৯.৫% - র তুলনায় অনেক কম।
১৯) ধনী - দরিদ্র, শহর - গ্রাম বিভাজন স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা অর্থবহ বাঁধার সৃষ্টি করে। কর্ণাটকে ৪.২ টি হাসপাতাল বেড আছে প্রতি ১০০০ জনে, বিহারে ০.২৯ টি বেড আছে প্রতি ১০০০ জনে। সব রাজ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বৈষম্য রয়েছে। এইসব কারণে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের বহু কষ্ট সহ্য করে, বহু মূল্যবান চিকিৎসার সময় নষ্ট করে দূরের বড় শহরগুলোতে যেতে হয় চিকিৎসা পাবার আশায়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই অব্যবস্থার জাতাকলে পড়ে বহু রোগী কার্যতঃ বিনা চিকিৎসায় মারা যান।
২০) দেশে ১.৩ মিলিয়ন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক রয়েছে এবং ৫,৬৫০০০ আয়ুশ চিকিৎসক রয়েছে। কিন্তু যে সংখ্যায় চিকিৎসক থাকা দরকার, সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অবস্টেট্রিসিয়ান, সার্জন, স্ত্রীরোগ বিশষজ্ঞ, জেনারেল ফিসিসিয়ান এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ৭৪.২% থেকে ৮১.৬% কম রয়েছে কমিউনিটি হেলথ সেন্টারগুলোতে (CHC)। একইভাবে নথিবদ্ধ সেবিকার সংখ্যা ৩.৩ মিলিয়ন, যা প্রয়োজনীয় চিকিৎসক সেবিকার ১:৩ অনুপাতের থেকে অনেক কম।
২১) ৭০% এর বেশি বহির্বিভাগ, ৬০% এর বেশি অন্তর্বিভাগ এবং ৮৫% বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পরিষেবা আসে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে। ২০১৮ তে আয়ুষ্মান ভারত এবং প্রধান মন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনার (PMJAY) প্রণয়নের মাধ্যমে এবং এর সাথে আগে থেকে চলে আসা সরকারি স্বাস্থ্য বীমাগুলি যেমন, CGHS, ESI, ECHS এর মাধ্যমে প্রায় ৭০% মানুষ বিনা মূল্যে বা আগে নগদ মূল্য দিয়ে পরে বিল মারফত ফেরত পাবার পদ্ধতিতে চিকিৎসা পরিষেবা পাচ্ছে। সরকার এই ধরনের চিকিৎসা পরিষেবা মূলতঃ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই চালনা করে। কিন্তু সমস্যা হল, সরকার যে মূল্য কাঠামো অনুসারে হাসপাতালগুলোকে তাদের পরিষেবার খরচ ফেরত দেয়, তা বাজার মূল্যের থেকে এতটাই কম যে সেই কারণে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল এইসব সরকারি প্রকল্পের সাথে যুক্ত হতে চায়না। বিশেষ করে উন্নয়নশীল শহর বা টায়ার থ্রি শহরগুলিতে বেসরকারি হাসপাতাল কোনো শাখাও চালু করতে চায়না।
রোগীরা স্বাস্থ্য পরিষেবা পায়, হাসপাতাল সেই রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে দেখভাল করবে এবং বীমা প্রতিষ্ঠান সেই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করবে। বীমা প্রতিষ্ঠানগুলি স্বাস্থ্য সেবা প্রয়োগ পদ্ধতির খুঁটিনাটি সম্বন্ধে অনেক ক্ষেত্রে ওয়াকিবহাল থাকেনা। আবার হাসপাতালগুলো বীমা প্রদান পদ্ধতির বিষয় অনেক ক্ষেত্রে পুরোপুরি বুঝতে পারে না। রোগী আবার এই দু তরফের বিষয়ই অনেক সময় পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেনা। এই ভুল বোঝাবুঝি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতাল, রোগী এবং বীমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অস্বচ্ছতা জনিত জটিলতার সৃষ্টি করে। এছাড়া, দায়িত্ববোধের অভাব আর পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব তৈরি করে। ভারতে সাধারণতঃ হাসপাতালগুলো তাদের পরিষেবার নিরিখে বীমা কোম্পানির প্রদেয় অর্থমূল্যের সাথে সন্মত হয়। চিকিৎসার পরিণতি যাই হোক না কেন, বীমা প্রতিষ্ঠান হাসপাতালকে নিয়মানুসারে সেই টাকাটা দিতে বাধ্য থাকে। সেই কারণে, হাসপাতালের গাফিলতির দরুণ হওয়া রোগীর ক্ষতি বা বড় মৃত্যুর আর্থিক দায়ভারও বহন করতে হয় বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে, যেখানে হাসপাতাল দায়মুক্ত হয়েই থাকে। তার ওপর যদি বীমা প্রতিষ্ঠান কোনো নিয়ম বশতঃ কোনো চিকিৎসা পরিষেবার মূল্য দিতে বাধ্য না থাকে বা অস্বীকার করে, সেক্ষেত্রে হাসপাতাল রোগীর থেকে সরাসরি সেই অর্থ নিয়ে নেয়। যা রোগীর ওপর সংকটের সময় বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ক্ষমতার অসাম্যকে বেশি করে সামনে তুলে ধরে।
২৩) বিমা কোম্পানিদের করোনা কালে এত পরিমাণ টাকা স্বাস্থ্য বিমায় মানুষকে দিতে হয়েছে যে তারা তারপর থেকে হাসপাতালগুলোকে প্রতিদান দেবার পরিমাণ অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে হাসপাতালগুলোর ওপর আর্থিক বোঝা অনেক বেড়ে গিয়েছে।
২৪) সামনের সারির ( front line) স্বাস্থ্যকর্মী যারা, নার্স, অ্যাটেনডেন্ট, এরা করোনা মহামারীর আসল বিপদের মোকাবিলা করেছিল একেবারে সামনে থেকে। ফলবশত সারা বিশ্ব জুড়ে প্রচুর সংখ্যায় নার্স এবং অ্যাটেনডেন্ট করোনা কালে মারা গিয়েছেন। আবার প্রচুর সংখ্যায় সেই তীব্র পরিস্থিতির ভয়ংকর মানসিক এবং শারীরিক চাপ সহ্য করতে না পেরে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেই চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। এইভাবে তৈরি হওয়া এক বিরাট কর্মী ঘাটতি মেটাতে গিয়ে হাসপাতাল এবং নার্সিং হোমগুলোকে ফ্রন্ট লাইন কর্মীদের মাইনে এবং অন্যান্য ভাতা অনেক বাড়াতে হয়েছে, যাতে কাজ করছে যারা তারা আর ছেড়ে না যায়। উপরন্তু, নতুন কর্মী নিযুক্ত করার ব্যাপারেও নিয়োগ ভিত্তিক কাজকর্ম করতে গিয়েও বাজেটের বেশ কিছু টাকাও খরচ হয়ে গিয়েছে।
২৫) করোনা কালে অন্য বিভাগের জন্য বরাদ্দ অর্থ করোনা বিভাগে জরুরি ভিত্তিতে খরচ করা হয়েছিল। ফলে অন্য বিভাগ গুলোর বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয়ায় সেই সব বিভাগের চিকিৎসাও ঠিক মতো করা যাচ্ছেনা।
২৬) সারা বিশ্বে বিশেষ করে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিশু মৃত্যুর হার যখন কমছে, ভারতবর্ষে শিশু মৃত্যুর হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ শিশু মৃত্যুর দেশগুলোর মধ্যে পড়ে।
২৭) " প্রতিরোধমূলক যত্ন" চিকিৎসা পদ্ধতি ভারতবর্ষে একেবারে কম অনুসরণ করা হয়। যদিও দেখা গিয়েছে এই পদ্ধতিতে রোগীর অবসাদ এবং আর্থিক অসুবিধার মতো সমস্যাগুলোর অনেকাংশে উপশম হয়।
২৮) ভারতবর্ষের শুধুমাত্র ৩% চিকিৎসক থাকেন গ্রামে, যেখানে দেশের ৭০% মানুষই থাকেন গ্রামে। অবস্থাটা খুবই হতাশাজনক। ৮০% বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শহরবাসী । ফলে, ৭০% মানুষ ভালো চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হন। গ্রামবাসীরা মাত্র ১৩% প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়ে থাকেন, ৩৩% সাব সেন্টারগুলোতে চিকিৎসা পান, ৯.৬% ক্ষেত্রে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা পান।
২৯) বিরাট সংখ্যক মানুষ একটু ভাল মানের প্রাথমিক চিকিৎসা পাননা। ফলতঃ, অবহেলা থেকে অসুখ খারাপের দিকে চলে যায়। আবার যেসব গুরুতর অসুস্থ রোগী সরকারি হাসপাতালে জায়গা পেলেননা, বাঁচার তাগিদে বেসরকারি হাসপাতালে গেলে সেখানে তাদের রক্ত জল করা অর্থের একটা বিরাট পরিমাণ বেরিয়ে যায়। এইভাবে, প্রতি বছর গড়ে দশ লক্ষ পরিবার দারিদ্র্সীমার নীচে চলে যায়।
৩০) গ্রাম এবং মফঃস্বলে কুসংস্কারের বশবর্তী মানুষ কিছু অর্থহীন দেশজ পন্থা যেমন জলপড়া, তাবিজ - কবজ, মাদুলি, হাতে, কোমরে ডোর বাঁধা এইসবে গভীর বিশ্বাস করার ফলে ঠিক সময়মতো আসল চিকিৎসা করান না।
৩১) জাতিগত সংস্কার : অদ্ভুত দেশ ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতির প্রাচীন সংস্কার সমাজের অন্দরে চিকিৎসার প্রবেশের ক্ষেত্রে বিরাট বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমেই নারীর ওপরে নিষেধাজ্ঞা। অবাক ব্যাপার, আজকের যুগের নারীদের গুরুতর অসুস্থ হয়ে ডাক্তার দেখানোর ব্যাপারে পুরুষদের অনুমতি নিতে হয়। বহু জাতিতে আজ বিশ্বাস করা হয়, নারীদের ডাক্তার দেখানো মানে পরপুরুষের সামনে যাওয়া নিষিদ্ধ। এছাড়া পারিবারিক অশান্তিতে নারীদের মারধোর করে আহত করার পরও তাদের ঠিকমতো চিকিৎসা করানো হয় না। গৃহবধূরা ডাক্তার দেখানো, মেডিকেল টেস্ট করানো , ওষুধ কেনার ব্যাপারে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয় প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য।
৩২) আরেকটি বেদনাদায়ক দিক হল, বৃদ্ধ বাবা মাকে, ডাক্তার দেখানোর জন্য রোজগেরে ছেলের দিকে চিকিৎসার অর্থের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয়। অথচ তাদের সন্তান ভুলে যায় যে এই বাবা - মা বুকের রক্ত জল করে অনেক কষ্ট সহ্য করে তাকে মানুষ করেছিল যাতে সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। আর আজকে সে তার বাবা মা কে চিকিৎসার খরচের জন্য উঠতে বসতে কথা শোনায়। বহু ক্ষেত্রে বিনা চিকিৎসায় বাবা মার মৃত্যু হয়।
মানসিক রোগ, স্নায়বিক রোগ, সন্তান ধারণের সমস্যার মতো অসুখগুলো নিয়ে আজও বহু রোগী খোলাখুলিভাবে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন, সামাজিক কলঙ্কের ভয়ে। প্রতিবেশীদের রোগীকে পাগল বলে খেপানো, সন্তান ধারণে অসুবিধের স্বীকার মহিলাকে নিয়ে প্রতিবেশী মহিলাদের সমালোচনা প্রভৃতি সামাজিক ব্যাধির স্বীকার, এইসব অসুখের রোগীরা মুখ বুজে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেন।
৩৪) চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগীর অবহেলা, অপমান এবং তার সাথে দুর্ব্যবহার এক ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়। কিন্তু ভারতবর্ষের মতো অনুন্নত দেশে এখনো এই অপরাধ হয়ে চলেছে। মানসিক রোগী এবং স্নায়বিক রোগীদের সাথে সেবিকা আর অ্যাটেনডেন্টদের ভয়ানক দুর্ব্যবহার। তাদেরকে ঠিকমতো ওষুধ না খাওয়ানো, অপরিষ্কার ভাবে ফেলে রেখা, ভাল করে খেতে না দেয়া, বকাঝকা করা, এমনকি মারধোর করা রোগীদের জীবন নরক করে তোলে। ফলতঃ, একবার মেন্টাল অ্যাসাইলাম থেকে ফিরে এসে সেই রোগী বিষম আতঙ্ক থেকে আর সেখানে ফিরে যেতে চায়না। অসুখ থেকেই যায়। মানুষটা আর কোনোদিন সুস্থ হয় না।
৩৫) ভাষাগত সমস্যা অনেক সময় চিকিৎসা কর্মী আর রোগীর মধ্যে যোগাযোগের সমস্যা তৈরি করে। এর জন্য দায়ী ভারতবর্ষের অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকা বিরাট সংখ্যক মানুষ।
সরকারি নীতি নির্ধারকরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যতটা অর্থ বরাদ্দ করা উচিৎ তা বেশিরভাগ সময়ই করেননা। স্বাস্থ্য অর্থ লগ্নির পরিমাণ বাড়ানো উচিৎ এবং সেটাকে ঠিকমতো কাজে লাগানোর জন্য অন্তর্বর্তী নিয়মরক্ষা সমিতির থাকা দরকার যা স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সরকারি দপ্তরের সঠিক যোগাযোগ বজায় রাখবে। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো হল :
ক) ভারতে স্বশাসিত সরকারি এবং বেসরকারি স্বাস্থ্য সংস্থার মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিভক্ত বলে সবার জন্য সমান ভাবে প্রযুক্ত কোনো আর্থিক নীতি গ্রহণ করা যায়না এবং এব্যাপারে এই দু তরফের মধ্যে কোনো মেলবন্ধন করা যায়না।
খ) স্বাস্থ্য পরিষেবায় রেগুলেটরি ব্যবস্থা গড়ে তুলে সমস্ত বিভাগগুলির মধ্যে খোলাখুলি যোগাযোগ , রোগীর নিরাপত্তা এবং হাসপাতালের গুণগত মানের উন্নতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। চিকিৎসা কর্মীদের আরো শিক্ষিত করে তুলতে হবে ক্লিনিকাল গভর্নেন্স বিষয়টি সম্বন্ধে। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে তথ্য আহরণ, তার বিশ্লেষণ এবং হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থার ফলাফলের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে।
৩৭) দেশের ৬১% পাবলিক হেল্থ সেন্টারগুলোতে (PHC) মাত্র ১ জন করে চিকিৎসক আছে। ৩৩% PHC গুলোতে কোনো ল্যাব টেকনিশিয়ান নেই এবং ২০% PHC গুলোতে কোনো ফার্মাসিস্ট নেই।
৩৮) উড়িষ্যার মতো একটি রাজ্যে প্রায় তিন হাজার চিকিৎসক পদ শূন্য পড়ে আছে।
৩৯) উত্তর ভারতের রাজ্যগুলোতে পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন। উত্তর প্রদেশে কোনো সাব সেন্টার আর প্রাইমারি হেল্থ সেন্টার প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানে প্রত্যেক ২৮ টি গ্রাম পিছু একটি করে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র।
৪০) আজও দেশের টায়ার ২ এবং টায়ার ৩ শহরগুলোতে সেরকম ভাল প্রাইভেট স্পেশালিটি হাসপাতাল নেই বললেই চলে।
৪১) বিশ্বে মাথা পিছু স্বাস্থ্য খরচার নিরিখে ভারত একেবারে নিম্ন স্তরের দেশগুলোর মধ্যে পড়ে। স্বাস্থ্য বীমায় বার্ষিক সরকারি ভর্তুকি ৩২%, যেখানে ব্রিটেন সরকারের এই খাতে বার্ষিক ভর্তুকির পরিমাণ ৮৩.৫%। আজও ৭৬% ভারতীয় কোনো স্বাস্থ্য বীমার আওতায় পড়ে না। যেকারণে ভারতবাসীর OOPE এত বেশি।
৪২) রুরাল মেডিকেল প্রাক্টিশনার্স যারা গ্রামীণ ভারতের ৮০% বাইরের রোগীর চিকিৎসা করেন, তাদের কোনো চিকিৎসা সংক্রান্ত বৈধ শিক্ষা নেই। মানুষ কোয়াক বা হাতুড়ে চিকিৎসকদের পাল্লায় পড়ে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রাণহানি পর্যন্ত ঘটে।
৪৩) রক্তে শর্করার পরিমাণ বা ব্লাড সুগার এর পরিমাণ বয়েস্কদের মধ্যে ২০১৫-'১৬ সালের NFHS ৪ এর রিপোর্ট অনুযায়ী যা ছিল তার ২০১৯-'২১ এর NFHS ৫ এর রিপোর্ট অনুযায়ী অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে, শহর এবং গ্রামে। দেখা গিয়েছে মহিলাদের ব্লাড সুগারের মাত্রা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। আবার পুরুষদের ব্লাড প্রেসার বা রক্ত চাপের মাত্রা মহিলাদের তুলনায় অনেক বেশি।
৪৪) জীবনযাত্রা সম্পর্কিত অসুখের পরিমাণ গ্রামের থেকে শহরে অনেক বেশি। ওবেসিটি এবং অত্যধিক ওজন বৃদ্ধি জনিত অসুখ শহরে অনেক বেশি। স্বাভাবিকের থেকে কম বডি মাস ইনডেক্স বা BMI থাকা প্রাপ্তবয়স্কদের সংখ্যা কমছে, যা অপুষ্টির উন্নতির দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান ওবেসিটির মাত্রা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শহরে এবং গ্রামে মহিলারা পুরুষদের থেকে বেশি স্থূল, দেখা গিয়েছে। তবে শহরে গ্রামের থেকে ওবেসিটির মাত্রা অনেক বেশি।
৪৫) ভারতবর্ষ দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত এক প্রাপ্তবয়ষ্ক জনসমষ্টির সমাজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। তবে NCD জনিত অসুখের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪৬) হাসপাতালে প্রসূতির মৃত্যু : কারণ, চিকিৎসকের দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতা ? না কি অক্সিটোসিন হরমোনের প্রয়োগ ?
বর্তমান সময়ে সরকারি হাসপাতালে প্রসূতি মায়েদের ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর কারণ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের সঙ্গে শহরের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের তীব্র বিবাদ শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রসবের সময় ব্যবহৃত অক্সিটোসিন নামে হরমোনটি এই বাড়তে থাকা মৃত্যুগুলির জন্য দায়ী। গত ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪, রাজ্যের প্রসূতি মৃত্যু নিয়ে এক অনলাইন বৈঠকে দুই তরফের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। বৈঠকে রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ অধিকর্তা, সহ অধিকর্তা, একাধিক মেডিকেল কলেজের কর্তা এবং স্ত্রীরোগ চিকিৎসকরা উপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রের খবর অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিকর্তারা চিকিৎসকদের গাফিলতি, দেরি এবং ভুল চিকিৎসাকে কারণ হিসেবে দর্ষিয়ে তাদের নিন্দা করার সাথে, সাথেই কয়েকজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ এর প্রতিবাদ করেন। স্বাস্থ্য কর্তাদের অভিযোগ ছিল, "বহু ক্ষেত্রে প্রসূতির চিকিৎসা দেরিতে শুরু করা হচ্ছে। ফেলে রাখা হচ্ছে। তার দেহে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা হচ্ছেনা। সিনিয়র ডাক্তারেরা প্রসূতিকে দেখতে আসছেন না। তাদের বদলে পিজিটি বা স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়াদের দিয়ে অস্ত্রোপচার করানো হচ্ছে। এতেই প্রসূতি মারা যাচ্ছেন।" এর উত্তরে চিকিৎসকরা দাবী করেছেন, হাসপাতালগুলোতে প্রসব পদ্ধতি সহজ করার জন্য যে অক্সিটোসিন হরমোনের ব্যবহার করা হচ্ছে, তার গুণগত মান একেবারেই নিরাপদ নয়। এবং তা প্রয়োগ করার পরই বহু ক্ষেত্রে সুস্থ প্রসূতিদের অবস্থার অবনতি ঘটছে। একরকম, বিনাকারণে তাদের কিডনি হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে শরীরে জলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বহুবার ডায়ালাইসিস করার পরও সেই পরিমাণ স্বাভাবিক করা যাচ্ছেনা। চিকিৎসকদের অভিযোগ, বহু বার বিষয়টি রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের নজরে আনা সত্বেও তারা কেন্দ্রীয় সরকারের অধিনস্ত একটি সংস্থার থেকেই অক্সিটোসিন কিনে চলেছেন। বৈঠকে স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের সাথে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এক স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের বিবাদ তীব্র হতে থাকে। সূত্রের খবর অনুযায়ী, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তরের অধিকর্তা, প্রসূন কুমার দাস এক সময় ঐ চিকিৎসককে ঐ বৈঠক থেকে বার করে দেবার চেষ্টা করেন। কিছু পরে স্বাস্থ্য কর্তারাই ঐ বৈঠক অসমাপ্ত রেখে বন্ধ করে দেন। মেডিক্যাল কলেজের ঐ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের থেকে তার ঐ ব্যবহারের জন্য লিখিত কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে। ১১ই ডিসেম্বর স্বাস্থ্য ভবনে পাঠানো তাঁর লিখিত উত্তরে ঐ চিকিৎসক জানিয়েছেন, "২০১৮ সালের পর থেকে ঐ অক্সিটোসিন ব্যবহার করেই পশ্চিমবঙ্গে প্রসূতি মৃত্যুর হার প্রতি এক লক্ষ জীবিত শিশুর জন্মের নিরিখে ৯৪ থেকে বেড়ে ১০৩ হয়েছে। যা জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। কিন্তু স্বাস্থ্য দপ্তর শুধু ডাক্তারদেরই ধমকাচ্ছে।" প্রসূন কুমার দাস এই প্রসঙ্গে বলেন, "যা বলার স্বাস্থ্য অধিকর্তা বলবেন।" স্বাস্থ্য অধিকর্তা স্বপন সোরেন জানান, "বৈঠকে ব্যস্ত আছি। কিছু বলতে পারব না।" অন্য এক স্বাস্থ্য কর্তার বয়ান অনুযায়ী, "কেন্দ্রীয় সরকারের ঐ সংস্থা থেকেই বেশির ভাগ রাজ্য অক্সিটোসিন কেনে। নিকট অতীতে একাধিকবার তার মান পরীক্ষা করা হয়েছে ল্যাবরেটরিতে। খারাপ কিছুই মেলেনি। পশ্চিমবঙ্গে বছরে প্রায় ১২ লক্ষ প্রসব হয়। তার মধ্যে সিজার হয় কম বেশি পাঁচ লক্ষ মায়ের। তাদের মধ্যে প্রায় ৭০০ - ৭৫০ প্রসূতির মৃত্যু হয়। কিন্তু একই অক্সিটোসিন তো প্রত্যেককে দেওয়া হয়। তার মান খারাপ হলে তো অনেক বেশি প্রসূতির মৃত্যু হওয়ার কথা।" এর বিপরীতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ঐ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞর যুক্তি, "কেরল, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডের মতো অনেক রাজ্য ঐ সংস্থার অক্সিটোসিন ব্যবহার বন্ধ করেছে এবং তার পরেই সেখানে প্রসূতি মৃত্যু চোখে পড়ার মতো কমেছে। অথচ, পশ্চিমবঙ্গ চুপ করে আছে।"
৪৭) ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক, সংসদকে অবহিত করেছে, PMJAY এর অধীনে হাসপাতালে ভর্তি করার ক্ষেত্রে ৩,৪২,৯৮৮টি মিথ্যে নথিকরণের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ৫৬,২১৭টি শল্য চিকিৎসার কেস হিসেবে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ এই বিশাল সংখ্যক মিথ্যে নথিকরণ অনুযায়ী বিল হওয়া বিশাল পরিমাণ টাকাটাই আত্মস্মাত করা হয়েছে। কংগ্রেস মন্ত্রী মুরারি লালা মীনা - র অভিযোগের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রী প্রতাপরাও যাদব চিঠিতে জানিয়েছেন, ১১ই ডিসেম্বর, ২০২৪ এর হিসেব অনুযায়ী ২,৮৬,২১১টি মেডিকেল ম্যানেজমেন্ট এর জাল নথিকরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৬,২১৭টি শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে দেখানো হয়েছে। ২০১৯ থেকে চালু হওয়া PMJAY - র অধীনে এখন পর্যন্ত ০.৫ শতাংশ জাল নথিকরণের ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েক বছরের গবেষণায় দেখা গেছে, বিরাট সংখ্যক অনগ্রসর মহিলাদেরকে লক্ষ্য করে তাদের নাম অপ্রয়োজনীয় ভাবে সিজারিয়ান বিভাগ এবং হিস্টেরেকটমি বিভাগে নথিবদ্ধ করা হয়েছে। গবেষনাকারীরা এই বিষয়টিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চূড়ান্ত সমন্বয়ের বিচ্যুতি এবং অনগ্রসর শ্রেনীর ওপর আর্থিক শোষণের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। রাজস্থানের দাউসা থেকে নির্বাচিত লোক সভা সদস্য মীনা প্রশ্ন রেখেছেন, সরকার কি সেইসব মৃত্যুর খবর জানেন যেখানে PMJAY এর আওতায় একেবারে অপ্রয়োজনীয় ভাবে জোর করে এনজিওপ্লাস্টি সার্জারি করার ফলে প্রচুর রোগীদের মৃত্যু হয়েছে ? এবং সরকার কি সেইসব তথ্যগুলো জোগাড় করেছেন, যেখানে PMJAY এর আওতায় অন্যান্য ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ভাবে সার্জারি করার ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রচুর রোগীদের মৃত্যু হয়েছে ? স্বাস্থ্য মন্ত্রক বলেছেন, এই দুই ক্ষেত্রেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ৯ই ডিসেম্বর গুজরাট সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছেন, অনুসন্ধান করে দুজন সুস্থ সবল রোগীর এনজিওপ্লাস্টি করার পরে মৃত্যুর খবর পেয়ে তারা পাঁচটি বেসরকারি হাসপাতালকে PMJAY এর আওতা থেকে বাদ দিয়েছেন। এইসব হাসপাতালগুলোতে কর্মরত দুজন চিকিৎসকের PMJAY এর পরিষেবা দেবার অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। ৯ই ডিসেম্বর পিটিআই এইসব সংবাদ জানায়। পিটিআই এর খবর অনুযায়ী, আমেদাবাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে PMJAY এর অধীনে থাকা রোগীদের ওপর অপ্রয়োজনীয় ভাবে এনজিওপ্লাস্টি করা হচ্ছিল, শুধু PMJAY এর সরকারি অর্থগুলো আত্মস্মাত করার জন্য। যাদব, মীনার প্রশ্নের উত্তরে জবাব দিয়েছেন, সরকার জিরো টলারেন্স নিয়ে PMJAY এর কারচুপিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তার কথা অনুযায়ী ন্যাশনাল হেল্থ অথরিটি নানা ধরণের প্রক্রিয়া কার্যকর করেছে PMJAY এর অধীনে ঘটে চলা এবং ঘটা সম্ভব কারচুপিগুলোকে খুঁজে বার করা, প্রতিহত করা এবং নির্মূল করার ক্ষেত্রে।
ভারত এবং ভারতের বাইরের কিছু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হৃদরোগীদের অপ্রয়োজনীয় করোনারি স্টেন্ট বসানোর খবর ফাঁস করেছেন। মার্কিন মুলুকের চিন্তা বিশারদ প্রতিষ্ঠান "দ্য লোন ইনস্টিটিউট" এর ২০২৩ এর অক্টোবরে পেশ করা খবর অনুযায়ী, ২০১৯ থেকে '২১ এর মধ্যে একাধিক আমেরিকান হাসপাতাল তাদের অধীনে থাকা হৃদরোগীদের ওপর ২,২৯০০০ এর ওপর অপ্রয়োজনীয় করোনারি স্টেন্ট বসিয়েছেন।
সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় এটি সামনে এসেছে, প্রত্যেক ১০ জন পলিসি হোল্ডারের মধ্যে ৬ জনকেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার বিষয়ে ৬-৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়, তাদের বীমা কর্পোরেটদের কভারেজ এর পরিমাণ নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে টালবাহানা করার ফলে। সমীক্ষা অনুযায়ী প্রত্যেক ১০ জনের মধ্যে ৮ জন রোগী পরিবারের মতে, এগুলো আসলে একধরনের উপায় যার মাধ্যমে পলিসি হোল্ডারের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে তারা অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ অর্থেই সমঝোতা করেন। "লোকাল সার্কেলস" নামে একটি অনলাইন মিডিয়া প্লাটফর্ম এর তরফ থেকে এই সমীক্ষাটি করা হয়েছে। ২০২৪ এর মে মাসে প্রকাশিত IRDA এর বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী বীমা সংস্থাগুলো হাসপাতালের থেকে রোগীকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ পাওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে রোগীর হাসপাতাল থেকে মুক্ত হওয়ার অফিসিয়াল কাজকর্ম শুরু করতে হবে। ২০২৩-'২৪ আর্থিক বছরে বীমা কোম্পানীগুলো মোট ১৭০০০ কোটি টাকা স্বাস্থ্য বীমা দাবির পরিবর্তে ১৪,৪৯৩ কোটি টাকা বীমাকারীদের বা রোগীদের দিয়েছেন। প্রত্যেক ১০ জন বীমাকারীর মধ্যে ৫ জন লোকাল সার্কলস কে বলেছেন, তাদের বীমার দাবির টাকা হয় বীমা কোম্পানিগুলি বাতিল করেছে তুচ্ছ অজুহাত দিয়ে, নয়তো আংশিক অর্থ দিয়েছে। ৩২৭টি জেলার ২৮৭০০ ইন্টারভিউ নেয়া মানুষের মধ্যে ২০% মানুষকে বীমার অর্থ দেয়া হয়নি আর ৩৩% কে আংশিক অর্থ দেয়া হয়েছে। মাত্র ৩১% রোগী পরিবার বলেছেন তাদের বীমার টাকা পুরো দেয়া হয়েছে। ৩০,৩০০ স্বাস্থ্য বীমকারীদের মধ্যে ২১% বলেছেন, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় বীমা অর্থ দাবির মীমাংসা হতে সময় লেগেছে ২৪-৪৮ ঘণ্টা, ১২% বলেছেন প্রক্রিয়াটি লেগেছে ১২-২৪ ঘণ্টা আর ১৪% বলেছেন সময় লেগেছে ৯-১২ ঘণ্টা। মাত্র ৮% এর মতে প্রক্রিয়াটি সাথে, সাথে হয়ে গিয়েছে। "IRDA আদেশ দিয়ে দিয়েছে যে রোগীকে হাসপাতাল থেকে মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো দেরি করা চলবেনা। কিন্তু আমরা দেখলাম, তা মানা হচ্ছেনা। এই বিলম্বের পরিমাণ বিশালাকার ধারণ করেছে," বলছেন সচিন তারপাড়িয়া, লোকাল সার্কলস্ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। তিনি আরও বলেন, "হাসপাতাল আর বীমা কোম্পানির মধ্যে বীমার দাবি আর প্রদানের ব্যাপারে ফোন আর ইমেইল এর মাধ্যমে কথা হয়। বীমাগ্রহিতারা চান একটি স্বচ্ছ, সময় নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে তারা হাসপাতাল এবং বীমা কোম্পানির মধ্যে যোগাযোগ পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারবেন।" লোকাল সার্কেলস্ তাদের সমীক্ষার রিপোর্ট IRDAI এর কাছে পেশ করবে।
৪৯) প্রায় প্রত্যেক সরকারি হাসপাতালগুলিতে এক শ্রেণীর জুনিয়র এবং সিনিয়র চিকিৎসক আছেন যারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে হাত মিলিয়ে প্রতিবাদী শিক্ষক এবং ছাএদের হুমকি দেয়া, ছাত্রদের থেকে মেডিকেল কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে বেআইনি ভাবে টাকা তোলা, এমবিবিএস এবং এমডি ডিগ্রি দেয়ার বিনিময়ে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চাওয়া, যা না দিলে যোগ্য ছাত্রছাত্রীদেরও ডিগ্রি আটকে দেয়া, জাল ওষুধ ব্যবসায়ীদের থেকে ঘুষ নিয়ে হাসপাতালে জাল ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহার করার মতো দুর্নীতি মূলক কাজ করে চলেন। জানলে অবাক হতে হয়, এই সমস্ত কাজের মাধ্যমে যোগাড় করা অর্থের সিংহ ভাগ যায় রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরে। তাই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে স্বাস্থ্য দপ্তরও এই চিকিৎসক গোষ্ঠীকে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। যার বলে বলীয়ান হয়ে তারা হাসপাতালে এই সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সব প্রতিবাদকে দমিয়ে রাখে।
৪ঠা জানুয়ারি, সংসদে, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের দেয়া তথ্য অনুসারে দিল্লি, যোধপুর এবং হৃষিকেশ এর AIIMS গুলো গত ১৮ মাস ধরে শিক্ষকের অভাবে ভুগছে এবং সারা দেশের প্রায় সব AIIMS গুলোই এই অসুবিধার স্বীকার। নিউ দিল্লী, ভোপাল, ভুবনেশ্বর, যোধপুর, পাটনা, রায়পুর এর ভালভাবে চলতে থাকা AIIMS গুলোতেও ২৩-৩৮% নির্ধারিত পদগুলো শিক্ষক শূন্য হয়ে পড়ে আছে। নিউ দিল্লীর AIIMS এ বর্তমানে ১২৩৫টি নির্ধারিত শিক্ষক পদ আছে। যার মধ্যে ৪২৫ টি পদ শূন্য। যোধপুরে ৩০৫ টি পদের মধ্যে ৮৫টি শূন্য পদ আছে, হৃষিকেশ এর কেন্দ্রে ৩৫৫টি পদের ভেতরে ১৪১টি শূন্য পদ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কল্যানী AIIMS এ ২৫৫টি পদের মধ্যে ১০০টি শূন্য পদ রয়েছে। কেন্দ্র ২০২৫-'২৬ বাজেটে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ জুড়ে আরো ৭৫০০০টি অতিরিক্ত স্বাস্থ্য পদ তৈরির ঘোষণার তিন দিনের মাথায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রক এই শিক্ষক অভাবের তথ্যটি সামনে আনলেন। কিন্তু আশংকা করা হচ্ছে যে, পর্যাপ্ত শিক্ষক ছাড়াই এত সংখ্যক স্বাস্থ্য পদ বাড়ালে, আখেরে চিকিৎসা শিক্ষার মান ভেঙে পড়বে। মন্ত্রকের দেয়া তথ্যে AIIMS গুলোতে বিরাট অশিক্ষক পদও শূন্য পড়ে রয়েছে। নিউ দিল্লিতে ১৪৩০০টি নির্ধারিত পদের মধ্যে ২৪৩২টি পদ শূন্য পড়ে আছে। কল্যানীতে ১৫২৭টি পদের মধ্যে ৬১৫টি পদ শূন্য পড়ে আছে।
Photo by Christine Sandu on Unsplash
ভারতের ছটি শহরে সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রত্যেক ১০০ জন প্রবীণ ভারতীয়ের মধ্যে আঠাশ জন, অপ্রয়োজনীয় এবং এক রকমের ভুল ওষুধ খাচ্ছেন। গবেষণাটি করা হয়েছিল, বহুল পরিমাণে ওষুধ খাবার প্রবণতা এবং রোগীর নিজের চিকিৎসা করার প্রবণতার ওপর। কলকাতা, চেন্নাই, দিল্লী, পাটনা এবং উজ্জয়নীতে ঘরে, ঘরে সমীক্ষা চালিয়ে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ খাওয়া এবং প্রয়োজনীয় ওষুধগুলো সঠিক ভাবে না খাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এই দুটি প্রবণতাই রোগীর শরীর নষ্ট করে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। ছটি শহরে ৬০০ রোগীর মধ্যে নিদর্শন হিসেবে ১৭৩ জন রোগীর ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে তারা তাদের প্রাত্যহিক ওষুধের মধ্যে একটি ওষুধ অপ্রয়োজনীয় ভাবে খাচ্ছেন এবং খাওয়ার নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে গিয়েও খেয়ে চলেছেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, বেনজোডিয়াজেপিনস এর মতো একটি ঘুমের ওষুধ, অম্বলের ওষুধ এবং পেট, বুক আর গলা জ্বালার ওষুধ অপ্রয়োজনীয় ভাবে খাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে আবার একই অসুখের জন্য দুটো ওষুধ খাওয়ার প্রবণতাও দেখা গিয়েছে, যাকে ডুপ্লিকেট থেরাপি বলা হয়। রোগীদের এবং সুস্থ মানুষের মধ্যেও এইভাবে বাড়তি ওষুধ খাওয়ার ভয়ংকর ফলশ্রুতি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়িয়ে তুলতে হবে। গবেষণার জন্য, ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল এন্ড রিসার্চ ফর এজিং এন্ড মেন্টাল হেল্থ এর কলকাতা শাখার গবেষক, শৈবাল দাস এবং তাঁর সহকর্মীরা, ছটি শহরের প্রত্যেকটি থেকে ৬০ বছরের ওপরে গড়ে ১০০ জন রোগীকে বেছে নেন এবং তাদের ওষুধ খাওয়ার মধ্যে এমন কোনো ওষুধ আছে কি না, যেটা তারা প্রেসক্রিপশনের বাইরে গিয়ে বা নিজের সিদ্ধান্তে খাচ্ছেন, তো পর্যবেক্ষন করেন। "ষাটোর্ধ্ব মানুষদের নবীনদের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে," বলেন শান্তনু ত্রিপাঠী, কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন এর একজন প্রাক্তন ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজিস্ট এবং দলের একজন সদস্য। উনি আরো বলেন, "এই বিষয়টাকে এতদিন সেভাবে নজর দেয়া হয়নি।" গবেষণায় আরো দেখা গিয়েছে, ৬০০ জন রোগীর মধ্যে ১২২ জনের পোটেনশিয়াল প্রেসক্রাইবিং ওমিশন (PPO) রয়েছে। যার অর্থ হল, একটি দরকারি ওষুধ প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসক লেখেন নি। সাধারণতঃ ডায়াবেটিস আর কার্ডিও ভাসকুলার রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসক রক্ত জমে যাওয়া প্রতিরোধ করার চিকিৎসা করতে ভুলে গিয়েছেন। যে সব রোগীর করোনারি আর্টারি অসুখ রয়েছে তাদের ক্লোপিডগ্রেল এর মতো প্রয়োজনীয় ওষুধ দিতে ভুলে গিয়েছেন এবং অস্টিওআর্থ্রাইটিস এর রোগীদের ক্যালসিয়াম বা ভিটামিন ডি ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিতে ভুলে গিয়েছেন। রোগীর নিজের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ব্যথার ওষুধ, জ্বর অথবা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল এবং শ্বাস - প্রশ্বাসের সংক্রমণের আর ডায়ারিয়ার জন্য এন্টি - বায়োটিক্স খাওয়ার প্রবণতা খুব বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছে।
২০শে ফেব্রুয়ারী কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সব রাজ্যের মুখ্য সচিব এবং মেডিকেল কলেজগুলিকে বলেছেন, অপ্রয়োজনীয় এবং অতিরিক্ত ইয়ারফোন এবং হেডফোন ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে। মন্ত্রক একটি গবেষণার ফলাফল সামনে এনে দেখিয়েছেন, যে বর্তমানে এই মাত্রাতিরিক্ত ইয়ারফোন এবং হেডফোন ব্যবহারের ফলে কিভাবে মানুষের শ্রবণশক্তি চিরতরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। একটি চিঠিতে তারা জানিয়েছেন, "শ্রবণশক্তির লোপ পাওয়া ইয়ারফোন এবং হেডফোনের ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অনেকাংশে অবহেলা করা হচ্ছে। বিষয়টি বিশেষভাবে নবীন প্রজন্মকে ক্ষতি করছে। স্বাভাবিক শব্দ মাত্রাতেও ইয়ারফোন আর হেডফোন ব্যবহার করা উচিৎ নয়।" চিঠিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ইয়ারফোন এর শব্দমাত্রা ৫০ ডেসিবেলের নীচে রাখা উপকারি এবং দিনে দুঘন্টার বেশি এগুলো ব্যবহার করা উচিৎ নয়। কলকাতা মেডিকেল কলেজের ENT অধ্যাপক, ডাঃ দীপ্তাংশু মুখার্জী বলেন, "কোভিড অতিমারীর পর থেকে আমাদের কাছে প্রচুর ছেলেমেয়েরা এসে বলছে তারা স্বাভাবিকের থেকে কম শুনছে। অনেকে আবার বলছে, লাগাতার একটা যান্ত্রিক শব্দ তাদের কানের ভেতর বেজে চলেছে, যাকে বলে টিনিটাস (tinnitus)।" চিকিৎসকদের মতে কোভিডের সময় থেকে অনলাইন পড়াশোনা আর বাড়ী থেকে কাজ করার সময় প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইয়ারফোন আর হেডফোনের ব্যবহার এই সমস্যাগুলোর জন্ম দিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের চিঠিতে আরো বলা হয়েছে যে সাম্প্রতিক অনলাইন খেলার সংস্কৃতি বাচ্চাদের ইয়ারফোন এবং হেডফোন দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা থেকে এই শ্রবণশক্তির সমস্যাগুলি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা প্রতিদিন ৫ ঘণ্টার বেশি এবং ৫০ ডেসিবেল এর ওপরে ব্যক্তিগত ইয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহার করছেন, তাদের এই সমস্যাগুলো হচ্ছে। ২০২৩ সালে "আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ পেডিয়াট্রিক্স " শিশুদের মধ্যে এইসব শ্রবনযন্ত্রগুলোর ব্যবহার কমানোর ওপর বিশেষ করে জোর দিয়েছে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু স্বাস্থ্যের অধ্যাপক সুসান উলফোর্ড এর মতে, "শিশুদের ইয়ার কানাল বয়স্কদের থেকে আকারে ছোট। ফলে শব্দ মাত্রা তার ভেতরে অনেক বেশি জমাটবদ্ধ এবং জোরালো ভাবে প্রবেশ করে, যা ঘুম, শিখন, মানসিক চাপ এবং রক্ত চাপের ক্ষতি সাধন করে।" ভারতের চিকিৎসকদের মতে, ওভার দা ইয়ার হেডফোন যেগুলো কানের ভেতরে প্লাগ করা থাকেনা, সেগুলো ব্যবহার করা অপেক্ষাকৃত ভাল। কারণ, কিছু পেশায় হেডফোন ব্যবহার করতেই হয়। ইয়ারপ্লাগ, যা কানের ভেতরে প্রবেশ করে তা বহির্ভাগের শব্দ প্রতিরোধ ব্যবস্হাটিকে এড়িয়ে যায় এবং ইয়ার ক্যানালগুলোকে স্থায়ীভাবে নষ্ট করে দেয়। "একবার শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে গেলে, কোনোরকম শ্রবণ যন্ত্রের মাধ্যমে তা কখোনো ঠিক করা যায়না", স্বাস্থ্য মন্ত্রকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
কলকাতার বিধাননগর পৌরসভার এক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একদল মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী গণস্বাক্ষর করে সেখানকার এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে দুর্ব্যবহার এবং যৌণ হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। প্রবীণ ঐ চিকিৎসক ঐ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার। তার বিরুদ্ধে কুরুচিকর মন্তব্য, যৌণ ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষার ব্যবহার এবং একজন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মীকে অশ্লীল প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এক অভিযোগকারীর দাবি, "উনি মহিলাদের সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলেন। খুব দুর্ব্যবহার করেন। একবার আমাকে নির্দেশ দেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা বহিরাগত কয়েকজনকে কলকাতা ঘুরিয়ে দেখাতে। সেটা আমার কাজ নয়। ওরা আমাকে নৈশভোজে নিউটাউনে নিয়ে যেতে চান। আমি সেই প্রস্তাবে সারা দেই নি। তখন ডাক্তারবাবুও আমাকে নৈশভোজে যাবার জন্য জোরাজুরি করতে থাকেন। ঐ চিকিৎসক অবসরের পর এক্সটেনশনে আছেন। বিধাননগর পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের মেয়র পারিষদ বাণীব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "ঐ চিকিৎসকের বিরুদ্ধে আগেও এই ধরণের অভিযোগ উঠেছে। ওকে জেলা স্বাস্থ্য দপ্তর নিয়োগ করেছে। ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারাই নিতে পারে। আমরা আগেও জেলা স্বাস্থ্য দপ্তরকে বিষয়টি জানিয়ে ছিলাম। এবারও জানাব।"
২৯ শে মার্চ কলকাতার পাশের হুগলি জেলার একটি ঘটনা সর্বসমক্ষে আসার পর থেকে বিষয়টি নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বীতিয় শ্রেণীর এক ছাত্রকে তার বাবা মা HIV রোগী হওয়ার জন্য কতিপয় অভিভাবকের হুমকির মুখে পড়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিদ্যালয়ে আসতে বারণ করে দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য দপ্তর এলাকার মানুষকে বুঝিয়ে কেন ছেলেটিকে বিদ্যালয়ে ফেরাতে পারছেনা, সেই প্রশ্নও উঠছে। এছাড়া, এত বছর ধরে HIV সচেতনতা নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য স্তরের বিশাল কর্মসূচীর ফল আখেরে কি হল, তাই নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা বলেন, "অভিভাবকদের বোঝানোর জন্য আমার একার ওপরে অন্যায় ভাবে প্রশাসন চাপ দিচ্ছে। ঐ বাচ্চাটাকে ঢুকতে দিলে বিদ্যালয়ে তালা মেরে দেয়া হবে বলে যেখানে প্রায় প্রতিদিন হুমকি আসছে, সেখানে আমার একার পক্ষে বোঝানো সম্ভব ?" স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মতে HIV সচেতনতা নিয়ে দেশের সরকার প্রচুর অর্থ খরচ করলেও রোগীদের ওপর ঠিকভাবে নজর রাখা হচ্ছে না। তাই এদের সামাজিক ভাবে একঘরে হতে হচ্ছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মৃগাঙ্কমৌলি কর বলেন, "ঐ শিশুর থেকে কারো HIV সংক্রমনের সম্ভাবনা নেই। স্কুল যদি পাড়ার লোকের কথা অনুযায়ী চলে, খুবই দুর্ভাগ্যজনক। স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে স্কুলে গিয়ে বৈঠক হয়েছে। লাগাতার প্রচারেও মানুষ শুনছেন না। কুসংস্কার আর অজ্ঞতা ছাড়া কিছু নয়।" স্থানীয় পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানের মতে, "খুবই লজ্জার ঘটনা। গ্রামবাসীদের নিয়ে পঞ্চায়েতে বসা হয়েছিল। বিষয়টি মেটানোর চেষ্টা চলছে।"
ভারতবর্ষের বেশিরভাগ হৃদরোগী ফার্মাকোলজিকাল কেয়ারের আবশ্যিক অঙ্গ, গাইডলাইন ডিরেক্টেড মেডিকেল থেরাপি (জিডিএমটি) পান না। ৫০০০ হৃদরোগের চিকিৎসকদের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এই তথ্য সামনে এসেছে। এদের মধ্যে অর্ধেক চিকিৎসক বলেন, প্রতি চারজন রোগীর মধ্যে এক জন এই চিকিৎসা পেয়ে থাকেন। এর মাধ্যমে, রক্ত কণিকাগুলো আরাম পায়, দেহরস তৈরি হওয়া কমে, হার্টের ওপর চাপ কমায় এবং হার্টের সংকোচন - প্রসারণের ক্ষমতা বাড়ায়। যে ৫০১২ জন চিকিৎসককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, দেখা গিয়েছে তাদের মধ্যে প্রতি ১০ জনের ভেতর ৪ জনই জিডিএমটি - র অন্তর্গত অতি প্রয়োজনীয় এনটি - প্রো - বিএনপি রক্ত পরীক্ষাটির কথা রোগীকে বলেন না। অথচ এই পরীক্ষাটি একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে মাপতে সাহায্য করে, যেই প্রোটিনটি অসুখটার গতিপ্রকৃতিকে বুঝতে এবং চিকিৎসার গতিপ্রকৃতিকে বুঝতে সাহায্য করে। হার্ট ফেইলিওর অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া - র নয়জন চিকিৎসকের একটি দল এর করা প্রথমবার ভারতবর্ষে হৃদরোগ জনিত চিকিৎসার ওপর এই সমীক্ষাটি, জিডিমটি থেরাপির এত কম ব্যবহার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।
যদিও জিডিএমটি থেরাপি হৃদরোগীর জীবনযাপনের মান নির্ধারণ করা একজন চিকিৎসকের প্রাথমিক কর্তব্য বলে নির্ধারিত করে, তবুও দেখা গেছে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন চিকিৎসক এই বিষয়টিতে রোগীকে ঠিকমতো জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকেন। ৫৮% চিকিৎসক চিকিৎসার ব্যয়বহুলতা এবং ৫৪% চিকিৎসক রোগীর জিডিএমটি থেরাপিকে অনুসরণ না করাকে জিডিএমটির ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন। ২০% চিকিৎসক বলেন, কিছু অযোগ্য চিকিৎসক রোগীর চিকিৎসার ভার নিয়ে না বুঝেই জিডিএমটি থেরাপীকে মাঝপথে বন্ধ করে দিয়েছেন। নাগপুরের চিকিৎসক শান্তনু সেনগুপ্ত, যিনি এই সমিক্ষাটিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বলেছেন, "আমরা আশা করি, এই সমীক্ষাটি রোগীদের মধ্যে জিডিএমটি থেরাপির ব্যবহার আরো বাড়াবে এবং তাদের সঠিক চিকিৎসার পরিমাণও আরো বাড়বে। সেনগুপ্ত স্বীকার করেছেন, কিছু জিডিএমটী থেরাপির ওষুধ দুর্মূল্য। তিনি এও বলেন যে, জিডিএমটি প্রসারের ক্ষেত্রে রোগীদের মধ্যে আরো বেশি করে এর প্রচার করতে হবে। এবং সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে, এই ব্যয়বহুল চিকিৎসায় সরকারকে অবশ্যই ভর্তুকি চালু করতে হবে। (পরের পাতায় দেখুন)
ঠিক কত চিকিৎসক আমাদের দেশে প্রয়োজন ? উত্তর দেয়া কঠিন। বিদেশে পাড়ি দিয়ে নিজেকে আরো বেশি করে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা নতুন এবং অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। তথাকথিত আমেরিকা এবং ইউরোপের ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি উত্তর আফ্রিকা মহাদেশ এবং মধ্য প্রাচ্যের অনুন্নত দেশগুলিতেও ভারতীয় চিকিৎসকরা ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমাচ্ছেন। সারা দেশ জুড়ে জুনিয়র চিকিৎসকরা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অন্যায়, অবহেলার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিবাদ, আন্দোলন করে চলেছেন। সাধারণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালের শূন্য পদের পরিমাণের বিপরীতে তার ২০% বেশি চাকরির দরখাস্ত জমা পড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে মেডিকেল কলেজগুলো তীব্র প্রতিযোগিতায় সামিল হয়। বেসরকারি কলেজগুলোতে ভর্তির ব্যাপারে মাথাপিছু দেয় অর্থের নিয়ম চালু হয়েছে, যাকে ক্যাপিটেশন ফি বলা হচ্ছে। অন্যদিকে দুর্নীতি, স্বজনপোষণ এবং নানান অবৈধ পন্থা মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তির ব্যাপারে অবলম্বন করা হয়।
সাম্প্রতিক অতীতে কেরালা রাজ্যে একজন সম্ভাবনাময় চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রকে তার আইনি অধিকার পাইয়ে দেবার জন্য তার পিতা - মাতা প্রথমে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ করেন, তারপর আবার পূর্বের ন্যায় স্বামী - স্ত্রীর মতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পশ্চিম বঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের মানুষদের সন্তানদের মেডিকেল এ সুযোগ পাইয়ে দেবার জন্য মুখ্য মন্ত্রীর নিজস্ব একটি কোটা ব্যবহার করা হয়। যুগ, যুগ ধরে ভারতবর্ষের মতো একটি জনবহুল দেশে সাধারণ চিকিৎসার এবং জরুরি চিকিৎসার চাহিদা এত বেশি যে একজন MBBS চিকিৎসকের জন্য রোজগারের সীমা হচ্ছে আকাশছোঁয়া। সেই জায়গা থেকেই MBBS এর পার্শ্ববর্তী অন্য চিকিৎসা শিক্ষা পদ্ধতিগুলো , যেমন হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা, ইউনানি চিকিৎসার পাঠক্রমগুলির এত বিপুল চাহিদা বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া মূল ধারার এলোপ্যাথি চিকিৎসার সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে প্যারা মেডিকেল কোর্সগুলি, যেমন আকুপাংচার, আকুপ্রেসার, ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন, ন্যাচারোপ্যাথি, যোগা থেরাপি এবং ফিজিওথেরাপির চাহিদা বিপুল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে, সীমাহীন অর্থোপার্জনের সুযোগ থাকার দরুন।
১৯৮০- র দশকের মাঝামাঝি ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিকেল রিসার্চ (ICMR) একটি মিশ্র পাঠক্রমের প্রস্তাব দেয়, যাতে প্রাচীন ভারতের দেশজ চিকিৎসা পদ্ধতি এবং হোমিওপ্যাথি , আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই প্রস্তাবটি কিছু যুক্তিসঙ্গত নিরীক্ষণের ওপর ভিত্তি করে চিন্তা করা হয়েছিল।
১) চিকিৎসা পাঠক্রমে অসুখের চিকিৎসা, পুষ্টি, প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণ, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার নীতি এবং সাধারণ স্বাস্থ্য উন্নতির বিষয়ে পড়াশোনা করা হয়।
২) সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পঠন পাঠন রোগ প্রতিরোধ মূলকই হওয়া উচিৎ যেখানে চিকিৎসক শুধু মাত্র রোগীর চিকিৎসাই করবেনা, তার পরিবারের সভ্যদেরও সুস্থ জীবন কাটানোর ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলবে। এইভাবে চিকিৎসক গোটা সমাজকে রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে শিক্ষিত করে তুলবে। এই দর্শন থেকেই "কমিউনিটি মেডিসিন" কথাটির জন্ম হয়েছে। এই ধারণাটি বর্তমান ভারতের উন্নয়নশীল সমাজে আজও প্রাসঙ্গিক।
এরা হচ্ছে দেশের সেরা ছাত্রদের অন্যতম। এরা চিরকালীন যৌবনের দূত। কিন্তু চিরদিনই এরা কোনো না কোনো কারণে অসুখী। এরা হচ্ছে ভারতবর্ষের জুনিয়র চিকিৎসক যারা দেশ জুড়ে এক আন্দোলন শুরু করেছেন, তাদের সাথে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা বঞ্চনা এবং অবহেলার ইতি টানার জন্য। তাদের সাথে হয়ে আসা অবিচারের প্রতি তারা আর উদাসীন থাকতে পারছেনা।
১) মেডিকেল কলেজগুলোতে পড়া শোনার খারাপ পরিবেশ ।
২) চিকিৎসার সরঞ্জামের অপ্রতুলতা সম্বন্ধে সরকারের কাছে বারংবার লিখিত অনুরোধ জানিয়েও কোনো সাড়া না পাওয়া। সম্প্রতি পিজি হাসপাতালে এবং আর জি কর হাসপাতালে সার্জারি চলার সময় জঙ্গ ধরা ভাঙা কাচির টুকরো এবং অতি পুরনো ছুরি রোগীর ব্যবচ্ছেদ হওয়া পেটের ভেতর পড়ে যায়। বেখেয়ালবশত তা রোগীর পেটে থেকে গেলে রক্তদূষণ থেকে মৃত্যু অবধি হতে পারত।
৩) মেডিকেল কলেজের হোস্টেলগুলির বেহাল দশা। বাথরুম, শোবার ঘর কোনো ভদ্র সন্তানের বসবাসের উপযুক্ত নয়।
৪) হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজগুলোতে কিছু চূড়ান্ত অসাধু অধ্যক্ষের জুলুমবাজী আর সেই কাজে ব্যবহৃত একদল জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তারদের , নতুন মেডিকেল ছাত্রদের ওপর নানান মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার, যেমন কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য একেকজনের থেকে চাপ দিয়ে ১০-১৫ হাজার টাকা চাঁদা নেয়া, প্রতিবাদী ছাত্রদের নানা ভাবে অত্যাচার করা, পরীক্ষা দিতে না দেয়া।
৫) ডিগ্রি দেয়ার নাম করে লক্ষ, লক্ষ টাকা ছাত্রদের কাছে দাবী করা, ছাত্ররা দিতে রাজি না হলে ডিগ্রি আটকে দেয়া ।
৬) বছরের পর বছর পরিশ্রম করে তৈরি করা মেধাবী ছাত্রদের গবেষণা পত্র দুর্নীতি পরায়ন অধ্যক্ষের মাধ্যমে তারই অনুগত ছাত্রদের কাছে পাচার হয়ে যাওয়া, এসব নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে বিশাল অসন্তোষ জমছিল।
৭) এবার সেই বারুদে আগুণের ফুলকি পড়ল কলকাতার আর. জি. কর হাসপাতালে এই সমস্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া এক ৩১ বছর বয়স্ক দ্বিতীয় বর্ষের মহিলা জুনিয়র ডাক্তারকে ২০২৪ এর ৯ ই অগাস্ট ভোর রাতে হাসপাতালের ভেতরেই, অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ - এর অনুগত একদল জুনিয়র এবং সিনিয়র ডাক্তারদের দিয়ে নৃশংস অত্যাচার করে প্রথমে খুন করানো এবং পরে সেই মৃতদেহকে ধর্ষণ করানোর ঘটনায়। অসন্তোষ আরো তীব্র আকার ধারণ করে যখন জানা যায় খোদ রাজ্য সরকার, রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তর এবং পুলিশ প্রশাসন এই পৈশাচিক ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত।
সারা দেশ জুড়ে এর বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ডাক্তারদের আন্দোলন, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভয়ংকর অরাজকতা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষায় ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে সারা দেশের সামনে নিয়ে এসেছে। এত দিন এসব বিষয়ে অজ্ঞতার অন্ধকারে থাকা সারা ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষ এবার নড়েচড়ে বসে পুরো বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করছে। কারণ এর সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা রাজ্যের সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ জড়িত। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, সরকারি কাগজে যদিও জুনিয়র ডাক্তারদের শিক্ষানবীশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে, কিন্তু আসলে সরকারি হাসপাতালগুলোকে সচল রাখে এই জুনিয়র ডাক্তাররাই। প্রমাণস্বরূপ, প্রত্যেকবার কোনো হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা ধর্মঘটে বসলেই সেই হাসপাতালটি অচল হয়ে পড়ে।
১) প্রাথমিক ভাবে ভারতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে খামতি রয়ে গিয়েছে তা হল, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর প্রতি মনোযোগের অভাব। বহু বছর ধরে পরিষেবার মানোন্নয়ন নিয়ে সরকারি তরফে চোখে পড়ার মতো কোনো হেলদোল দেখা যায়নি।
২) আমাদের দেশের চিকিৎসা শিক্ষার পদ্ধতিটি এমনি যে ছাত্রদের ভেতর কোনো সামাজিক দায়িত্ববোধ তৈরি করে না। তাদের নিজস্ব পরিমন্ডল এবং আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল জীবনের গন্ডির ভেতর থাকতে, থাকতে তারা বহিরসমাজের কাছে আগন্তুকে পরিণত হয়।
৩) পাঠক্রমে ত্রুটি ছাড়া, এক সার্বিক অব্যবস্থা, যথেষ্ট সুযোগের অভাব এবং ছাত্রদের তরফ থেকে আসা অভিযোগ অনুযায়ী অধ্যাপকরাও এই বিপর্যস্ত , বিভ্রান্তকর অবস্থার জন্য কিছু ক্ষেত্রে দায়ী। বেশিরভাগ পরিদর্শক চিকিৎসক, শল্য চিকিৎসক এবং বিভাগীয় প্রধানরা হাসপাতালকে ওনাদের ব্যক্তিগত নার্সিং হোমের মতো দেখেন। সাধারণতঃ, কোনো কর্মব্যস্ত দিনে তারা হাসপাতালে খুব বেশি হলে এক থেকে দুই ঘণ্টা সময় দেন। তাদের ব্যক্তিগত চেম্বার এবং নার্সিং হোমের রোগীরা , চিকিৎসকদের সুপারিশের জোরে সহজেই হাসপাতালে শয্যা পেয়ে যান।
৪) প্রশ্ন হল, এই সব তথ্য তাদের কাছে থাকা সত্বেও কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার নীরব রয়েছে কেন ? তারা কেন কোনো নিয়মমাফিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন না ? পশ্চিম বঙ্গের স্বাস্থ্য দফতর কি আজ পর্য্যন্ত কোনো স্বাস্থ্য আধিকারিককে শাস্তি দিয়েছেন ? উত্তর হল, একজনকেও নয়। আসল সত্যিটা হল, সরকার নিজেই চায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাটা এভাবেই চলুক। চিকিৎসা সম্পর্কিত পরীক্ষা নীরিক্ষার যন্ত্রপাতি এবং ওষুধ হাসপাতালে কখনোই প্রয়োজনের পরিমাণে পাওয়া যায়না। বছরের পর বছর এই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে, যেতে চিকিৎসকদের হতাশা এমন একটি স্তরে গিয়ে পৌঁছয় যে তারা একসময় ক্ষোভে ফেটে পড়েন।
৫) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য দপ্তরের উচ্চ আধিকারিকদের সাথে হাত মিলিয়ে জুনিয়র এবং সিনিয়র চিকিৎসকদের নানা ভাবে প্রাণহানির হুমকি, পেশাগত হুমকি থেকে শুরু করে মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচারও করে, যাতে এইসব চিকিৎসকরা বিনা প্রতিবাদে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর স্বাস্থ্য আধিকারিকদের অলিখিত দাস হয়ে থাকেন। গত ৯ অগাষ্ট ভোর রাতে কলকাতার আর. জি. কর হাসপাতালে কর্মরত অবস্থায় ৩১ বছর বয়স্ক দ্বীতিয় বর্ষের পোস্ট গ্রাজুয়েট ট্রেনি মহিলা চিকিৎসকের ওপর ঘটে যাওয়া ভয়ংকর অত্যাচার, খুন এবং তার মৃতদেহের ধর্ষনের ঘটনা , স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই ভয়ংকর মাফিয়া সংস্কৃতির এক চূড়ান্ত ছবি তুলে ধরেছে।
৬) সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, ভারতে চিকিৎসা পরিষেবা কত ব্যয়বহুল ? এবং ঠিক কত ভারতীয় এই ব্যয়ভার সামলাতে পারেন ? এটা সর্বসম্মত ভাবে জানা যে বেসরকারি চিকিৎসা পরিষেবাই ভারতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূল নিয়ন্ত্রক। মানুষের বার্ষিক স্বাস্থ্য খরচের ৭৫% আসে রোগীর পরিবারের সঞ্চিত অর্থ থেকে। এবং এই সর্বনাশা খরচ বহন করতে গিয়েই কিন্তু পরিবারগুলো দারিদ্র্যের মুখে পড়েন। আরো দুশ্চিন্তা জনক হল, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং পরিষেবার খরচের ক্ষেত্রে সমস্ত চিকিৎসা সংস্থার জন্য কোনো বাঁধাধরা মূল্য - কাঠামোর নিয়ম কানুন নেই। ফলস্বরুপ, বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল বিভিন্ন রকম দানবীয় প্যাকেজ দর হাঁকতে থাকে। আর এর মধ্যে পড়ে রোগীর পরিবার এক নাস্তানাবুদ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন।
অভিযোগটা সত্যি, যে চিকিৎসা জগতে সহজে টাকা করার জন্য নানারকম অসাধু কাজকর্ম চলে। জাল ওষুধ কেনা হয় এবং রোগীর ওপর প্রয়োগ করা হয়। অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। কিন্তু এইসব অসাধু কাজকর্মগুলিকে কেবলমাত্র পাঠক্রম পুনর্গঠন করে বন্ধ করা যাবেনা। ছাত্ররা কেবলমাত্র বই আর অধ্যাপকদের ভাষণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না। বাস্তব জীবনের ঘটনা সমূহ, সামাজিক আদান প্রদানের সংস্কৃতি, মানুষের চাহিদা, চিকিৎসক - রোগীর সম্পর্ক, সামাজিক মূল্যবোধ - এই সমস্ত কিছু ছাত্রদের মনে চিরস্থায়ী দাগ কেটে যায় এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। এই বিষয়টিকে একটি উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। স্টেরয়েড ওষুধ জীবন বাঁচানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কিছুক্ষণের জন্য স্টেরয়েড সব যন্ত্রণা এবং কষ্টগুলোকে আশ্চর্যজনক ভাবে কমিয়ে দেয়। কিন্তু আসলে স্টেরয়েড ওষুধের ভয়ানক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে। সেই কারণে যখন রোগীকে সমূহ বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য স্টেরয়েড ওষুধই একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায়, কেবলমাত্র তখনই স্টেরয়েড ওষুধ দেয়ার নিয়ম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্ররা এটাই শেখে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে পাশ করে বেরোনোর পর একজন ছাত্র যখন দেখে তার শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক নিজেই রোগীর সামান্য জ্বর কমানোর জন্য স্টেরয়েড ওষুধ প্রয়োগ করছেন, ছাত্রটি নিমেষে তার পূর্বের সব শিক্ষা ভুলে গিয়ে অধ্যাপকের বর্তমান চিকিৎসা প্রনালী অনুসরণ করতে থাকে। অধ্যাপককে ছাত্রটি যখন এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করে, তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননা। বাস্তবের মাটিতে, সত্যিকারের চিকিৎসা শিক্ষা বইয়ের পাতাতেই আবদ্ধ থেকে যায়, আর প্রয়োগের ক্ষেত্রে একেবারে অন্যরূপ নেয়। বেশিরভাগ রোগী চটজলদি আরাম চান। সেটা পেয়ে গেলেই তারা নির্দিষ্ট চিকিৎসককে ভাল চিকিৎসক বলে মনে করেন। বেশিরভাগ রোগী মনে করেন, গত দুদিনেও যখন চিকিৎসক জ্বরটা কমাতে পারলেন না, তার মানে উনি বোধহয় অসুখটা ঠিক বুঝতে পারেননি। এই চিকিৎসক নির্ভর করার মতো নয়। তাই সেই রোগী ছোটে সেই চিকিৎসকের কাছে যিনি রোগীকে কেবলমাত্র চটজলদি আরাম পাইয়ে দেওয়ায় বিশ্বাস করেন। সাথে তিনি এটাও জানেন যে স্টেরয়েড ওষুধই পারে রোগীকে সেই চটজলদি আরাম এনে দিতে। সুতরাং তিনি রোগীর ওপর সেই স্টেরয়েড ওষুধ প্রয়োগ করেন এটা জেনে যে এর ফলে রোগীর শরীরের অনেক গুরুত্বপুর্ণ রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে এবং রোগীর প্রভূত ক্ষতি হবে। এই ভাবে সেই চিকিৎসক তার ব্যবসায় প্রচুর আর্থিক মুনাফা লাভ করেন, রোগীকে অজ্ঞতার অন্ধকার ঠেলে দিয়ে এবং একজন ভাল চিকিৎসক বলে পরিচিত হন। যেখানে এই ক্ষেত্রে প্রকৃত চিকিৎসা হওয়ার কথা ছিল, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জ্বরের গতিকে অনুসরণ করা এবং সেই মতো চিকিৎসা করা।
৮) গোটা উপমহাদেশের মাত্র ২০% জনসংখ্যা নিয়ে দক্ষিণ ভারত থেকেই দেশের PMJAY এর অর্ধেক দাবী করা হয়। তা সত্বেও এই দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ আজও জানেনা, যে তারা প্রতি বছর ৫ লাখ টাকার চিকিৎসা পরিষেবা বিনা মূল্যে পান। এই মূল্যের অর্থ এই সব মানুষের অনেকেই সারা বছরে উপার্জন করতে পারেনা।