Photo by Randy Jacob on Unsplash

নীল স্বচ্ছ আকাশের বুকে এঁকেবেঁকে উড়ে বেড়ায় চৌরঙ্গীটা। মাটি থেকে তার দূরত্ব অনেক। শীর্ণকায় ছোট্ট শরীরটা সেখানে পৌঁছতে পারেনা। কিন্তু তার মন ইচ্ছে ডানা মেলে এক লাফে শূন্যে উড়ে গিয়ে পাকড়ে ধরে ঘুড়িটার সুতো। তারপর শুধুই উড়ে চলা। নীল আকাশের বুকে উত্তাল হাওয়ার ঢেউয়ে দুই হাতে সাঁতার কেটে, কেটে ওলোট পালোট খেতে, খেতে চৌরঙ্গীর সঙ্গে উড়ে চলে সে এঁকে বেঁকে। তার তেলকালি মাখা অসংখ্য ভাঁজে ভরা শুকনো মুখটা এক অনাবিল খুশির আলোয় ভরে ওঠে।

কিন্তু হঠাৎ সে শোনে এক কান ফাটানো চিল চিৎকার। তার ছোটো মাথাটার ভেতরে ঝন ঝন করে ওঠে। তাড়াতাড়ি ঘুড়ির সুতো ছেড়ে দিয়ে দুহাতে কান চাপা দেয় সে। আর তখনই শুন্য থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে সে।

- এই হারামজাদা? কাজ ফেলে ওদিকে কি দেখছিস? - হুঁশ ফেরে বাবলুর। স্ট্যান্ডের ওপর ভর দিয়ে দাঁড় করানো মোটর সাইকেলটার তলায় শুয়ে এক মনে দূর আকাশে ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সে। ধমকটা কানে যেতেই তার ছোটো শরীরটা কেঁপে ওঠে। এইবার তাড়াতাড়ি তেলকালি মাখা ন্যাকড়াটা দিয়ে গাড়ীটার চাকার লোহার রডগুলো মুছতে শুরু করে দেয় সে। মূহুর্ত আগের উজ্জ্বল মুখটাতে গভীর চিন্তার ছায়া ছোটো, ছোটো চামড়ার ভাঁজে ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারে ঢেকে দেয়।

কদিন পরেই বিশ্বকর্মা পূজো। কদিন ধরেই বাবলুর ভীষন ইচ্ছে করছে ঘুড়ি ওড়াতে। গতকাল রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্য্যন্ত গ্যারেজের লাগোয়া এক চিলতে ঘরে শুয়ে তারই বন্ধু টুবলুর সাথে এই নিয়ে অনেকক্ষণ কথাও বলেছে সে। অবশ্য সেই যেদিন থেকে এই গ্যারেজে কাজ করতে ঢুকেছে, সেদিন থেকেই প্রত্যেক বছরই এই পরিকল্পনা করে আসছে। রাত সাড়ে এগারোটার সময় ফুটপাতের ট্যাঁপকলটার সামনে দাঁড়িয়ে সস্তার গায়ে মাখার সাবানের টুকরোটা গায়ে ঘষতে, ঘষতে পাশেই গায়ে জল ঢালতে থাকা টুবলুকে বলে ওঠে – এবারো ঘুড়ি ওড়ানো হবেনা রে।

- কোনোদিনও হবেনা। - নির্বিকার ভাবে উত্তর দেয় টুবলু।

- দ্যাখ নিমাইদা পূজোর দিনেও সারা দিন কাজ করাবে। - উত্তরে নীরব থাকে টুবলু। ফুটপাতের কমলা আলোয় উস্কখুস্কো ভেজা চুল মাথার দুটো ছোটো শরীর ধীর পায়ে চলে যায় দূরে তাদের বাসস্থান ঐ গ্যারেজটার দিকে।

এক চিলতে বিছানায় শুয়ে থাকে দুটি ছেলে। ঘুমে অচেতন টুবলুর পাশে বাবলু নিষ্পলক দৃষ্টিতে মাথার পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। ধীরে, ধীরে ভেসে ওঠে সকালের সেই উজ্জ্বল নীল আকাশ। আর তার বুকে উড়ে বেড়ানো চৌরঙ্গী। একটা চাপা খুশিতে তার চির বিস্ময় মাখানো গোল, গোল চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। লাইটপোষ্টের কমলা আলো ছোটো জানালা দিয়ে তার মুখে এসে পড়াতে মুখটা আরো উজ্জ্বল লাগে। হঠাৎ একটা মিনি বাস বিশ্রি শব্দ করে ব্রেক কষে একেবারে জানালার পাশে। চুরমার হয়ে যায় বাবলুর চিন্তা। এই ঘটনা এখানে আসার পর থেকে রোজই দেখে আসছে সে। তবুও একেক সময় ভীষণ বিরক্ত লাগে। এই যেমন এখন। ডিজেলের ঘন কালো ধোঁয়ার গন্ধ যেন সারা শরীর জাপটে ধরে বাবলুর। রাগে বিরক্তিতে মূহুর্ত আগের খুশিতে ভরা মুখটা অসংখ্য ভাঁজে ভরে ওঠে। বাসটা চলে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ কালো ধোঁয়ার গন্ধ থেকে যায় তাদের ঘরটাতে। এই গন্ধটাকেই যত অপছন্দ বাবলুর। গন্ধটা সব সময় জড়িয়ে থাকে তার সারা শরীর। রোজ রাতে যতই সাবান দিয়ে গা ঘষুক না কেন, কিছুতেই যেন গন্ধটা আর যেতে চায়না। আগামীকাল সকালের কথা মনে পড়ে। আবার ফিরে যেতে হবে তেলকালি মাখা সেই গাড়িগুলোর কাছে। আবার হাতে তুলে নিতে হবে ঐ ময়লা ন্যাকড়াগুলোকে। একটা চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে পাশ ফিরে চোখ বোজে সে।

এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন। ঘন কালো গাড়ীর ধোঁয়ায় আর বিষাক্ত তেলকালিতে ধীরে, ধীরে ঢেকে যেতে থাকে দুই কিশোরের রঙীন পৃথিবীটা। শুকনো রুক্ষ চামড়ায় ঢাকা শীর্নকায় শরীরদুটো আর অকালে কৈশোর হারানোর অবসাদে ঢেকে থাকা কালো থমথমে মুখদুটো নিয়ে দুই কিশোর বেঁচে থাকে দুই জ্যান্ত শবের মতো। যাদের জীবন থেকে মুক্তির শেষ আলোটুকুও মুছে যেতে চলেছে।

কিন্তু একদিন মুক্তি এসে যায়। কলকাতার অদূরে বারুইপুরের এক ধনী পরিবারের বাগানবাড়ীতে রাধুনীর কাজ করেন বাবলুর মা। অনেকদিন ধরেই তিনি ভাবছেন, ছেলেটাকে কটা দিনের জন্য একটু কাছে এনে রাখবেন। - সেই কবে বাবলুর বাবা হঠাৎ করে মারা যাবার পর অভাবের তাড়নায় হাতে ধরে ছেলেটাকে রেখে এলাম ঐ নরকে। তারপর থেকে বেচারা এতটুকুও স্বস্তি পায়নি। তা প্রায় তিন বছর হতে চলল। ছেলের আমার যে কি ছিরি হয়েছে, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন। - রোজ রাতে শুয়ে, শুয়ে এসব কথা ভাবেন বাবলুর মা আর আঁচলের খুটে দু চোখ মোছেন। - ছেলেটাকে নিয়ে এসে কাছে রেখে কটা দিন একটু যত্ন করতেই হবে। এক রাতে মনে, মনে ঠিক করে ফেলেন তিনি।

পরদিন সকালে মনিবের কাছে কথাটা বলতেই তিনিও বাবলুর মার আর্জি মঞ্জুর করে দেন। মনিবটি ভাল লোক। সেই দিনটা কোনোমতে কাটিয়ে পরদিন সকালেই তিনি রওনা হয়ে যান।

গ্যারেজের সামনে বাবলুর মা যখন এসে পৌঁছান তখন একটু বেলা হয়ে গিয়েছে। দূর থেকেই উনি দেখতে পেয়েছিলেন দুটো ছোটো, ছোটো ময়লা শরীর তার দিকে পেছন ফিরে বসে এক মনে কাজ করে চলেছে। তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই এতদিনের পাথর চাপা বুকের ওপর থেকে পাথরটা যেন সরে গেল। আর এত দিনের চেপে

রাখা স্নেহ ভালবাসা ঝড়ে পড়ল মার আদর মাখানো ডাকে - বাবলুরে। বিদ্যুৎবেগে পেছন ফিরে মাকে দেখতে পেয়েই বাবলু এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে তার মাকে। মার শরীরের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। মা তাঁর সমস্ত স্নেহ দিয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। কিছুটা দূর থেকে একজোড়া অসহায় দৃষ্টি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে এসব। তারও ইচ্ছে করে বাবলু যা করল তা করতে। কিন্তু সেই ইচ্ছের উষ্ণতা মুহূর্তেই তার মনের মধ্যে জমে শীতল পাথরে পরিণত হয়। কারণ বাবার সাথে, সাথে তার মাও টুবলুকে একা ফেলে রেখে বড় অসময়ে চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। সবার আত্মীয় স্বজন তো আর সমান হয় না। তারা আর কতদিন খবর রাখবে। তাই চোখের জল মুছে দেবার যখন কেউ নেই, তখন চোখে জল আনারও কোনো মানে হয় না। ঠিক এই কারণেই এই মুহূর্তে বাবলুর দিকে তাকিয়ে থেকে টুবলুর মন খারাপ হয় ঠিকই, কিন্তু তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নেয় সে। তাদের এক চিলতে ঘরে বসে বাবলুর মা সাথে করে আনা মিষ্টি ছেলে দুটোকে খাওয়ান। তারপর ওনার আসার কারণ খুলে বলেন। প্রথমটায় বাবলুর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও পরক্ষণেই আবার আগের মতো গম্ভীর হয়ে গিয়ে দুচোখের মাঝখানটায় ছোটো, ছোটো ভাঁজে ভরে যায়।

- কি হল রে? - ছেলের মুখের ভাবে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে, দিতে জিজ্ঞেস করেন মা। - টুবলুর কি হবে? - চিন্তার দৃষ্টিতে মার দিকে তাকিয়ে ধীরে, ধীরে জিজ্ঞেস করে বাবলু। - ওকে ফেলে রেখে আমি যাবনা। - তার মার উত্তর শোনার জন্য অধীর আগ্রহে ওনার দিকে তাকিয়ে থেকে বাকি কথাগুলো বলে সে।

ছেলের কৈশোরের রেশ মাখা দীর্ঘ অযত্নে অনাদরে শুকিয়ে রুক্ষ হয়ে যাওয়া মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন বাবলুর মা। ছেলে যে তাঁর এত সুন্দর এক মানুষ হয়ে উঠেছে, তা তিনি জানতেন না। অল্প হেসে ওর লাল হয়ে যাওয়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, - আচ্ছা, সেও তোর সঙ্গে যাবে খন। - বাবলুর মুখ আবার আগের মতো খুশিতে ভরে ওঠে।

গ্যারেজের মালিক নিমাই, বাবলুর মার অনুনয় বিনয় নেহাৎ ফেলতে না পেরে একটু বিরক্তি নিয়েই রাজি হলেন। এক মাসের ছুটি মঞ্জুর হল। এ যেন এক আশ্চর্য্য বিকেল। দুজোড়া পরিষ্কার জামা কাপড়ের মধ্যে থেকে একজোড়া পরে নিয়ে বাবলু আর টুবলু ধীর পায়ে এগিয়ে চলল গ্যারেজটাকে পেছনে ফেলে রেখে। আগে, আগে চলেছেন মা। আনন্দ আর যেন চেপে রাখা যায় না। দুজনে দুজনের দিকে তাকায় আর ফিক, ফিক করে হাসে। আশে পাশের চেনা লোকজন দোকানপাট সব ধীরে, ধীরে পেছনে সরে যায় আর তারা এগিয়ে চলে এক নতুন পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। 

বাসে সিটে জানালার ধারে কখনো বাবলু বসে তো কখনো টুবলু। ছুটে চলা বাসে উল্টো দিক থেকে আসা হাওয়া হাঁ করে যতটা পারে টেনে নিতে থাকে। কখনো বাসের জানালা দিয়ে মুখ বার করে ধেয়ে আসা জোরালো হাওয়ায় চোখ বন্ধ করে থাকে। বাবলুর মা বকুনি দিয়ে ছেলে দুটোর মাথা ভেতরে ঢোকান। এই ভাবে এক সময় বাস এসে পৌঁছায় নির্দিষ্ট স্টপেজে। তখন সন্ধ্যে নামছে।

বাস রাস্তা থেকে নেমে পাশের সুরকির পথ ধরে বাবলু আর টুবলু হাটতে থাকে মাকে অনুসরণ করে। লাল সুরকির দুধারে ঘন ঝোপের সারি, কিছু দূর পর, পর লাইটপোষ্টের আবছা আলো, এসব কিছুই তাদের কাছে আশ্চর্য্য রকমের নতুন জিনিস বলে মনে হতে থাকে। হাওয়ায় এক অদ্ভুত সুন্দর গাছপালার গন্ধ। ছেলে দুটো মাথা উঁচু করে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। এই ভাবে কিছুটা যাবার পরেই ডান দিকে একটা ছোটো বাঁক নিয়েই রাস্তা শেষ হয়ে যায়।

ছোটো বেলায় মার কাছে গল্পে শোনা স্বপনপুরী যেন দেখল বাবলু। এক বিরাট আলো ঝলমলে বাগানবাড়ী তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। বিস্ময়ের ঘোর যেন আর কাটতে চায়না। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে বাবলু আর টুবলু পায়ে, পায়ে এসে ওঠে বাগানবাড়ির ভেতরে। চারদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, দেখে তাক লেগে যায় তাদের। এ যে সত্যিই স্বপ্ন তাদের কাছে। রাতে খাবার সময় ছেলেদুটোর পরিপাটি দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননা মা। কতদিন যে ওরা একটু ভাল মন্দ খায়নি, ভাবেন তিনি। খাওয়া দাওয়া সেরে মার ঘরে পাতা পরিষ্কার নরম বিছানায় এক চূড়ান্ত আরামে গা এলিয়ে দিয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে আপন মনে হি, হি করে হেসে ওঠে দুই কিশোর। তারপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে সারাদিনের সব অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প করতে, করতে ঘুমে ঢলে পড়ে ক্লান্ত দুটো শরীর।

পরদিন সকাল। চোখ খুলেই বাবলুর মনে হয়, সে যেন স্বপ্ন দেখছে। একে, একে মনে পড়ে গতকালের সব কথা। অল্প ঠেলা দিতেই টুবলুর ঘুম ভেঙে যায়। এক লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে দুজনে ছুটে চলে আসে বাইরে। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ মাঠ। চারদিকে এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট, বিরাট সব গাছ আর মাথার ওপর নীল আকাশ।

খালি পায়ে ঘন সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে হাটার সময় শরীরের ভেতরে এক অদ্ভুত ভাল লাগা টের পায় ছেলে দুটো। এ তাদের কাছে একেবারে নতুন এক অনুভূতি। হাওয়ায় সব সময় একটা সতেজ গন্ধ মিশে রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ এলোমেলো ভাবে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় তারা দুজন। এর মধ্যে বাড়ীর কুকুরটার সাথেও বন্ধুত্ব পাতিয়ে নেয় তারা। কিছুক্ষণ পর মার ডাক শুনতে পায়।

সকালের খাবার খেয়েই আবার বাইরে বেরিয়ে আসে বাবলু আর টুবলু। এবার শুরু হয় তাদের আসল অভিযান। একেকটা গাছের কাছে গিয়ে ভাল করে দেখে গাছটা কিরকম। সেটায় চড়তে গেলে কিভাবে চড়তে হবে। এই ভাবে চলতে লাগল তাদের একেকদিন একেকটা গাছে চড়া। কোনো, কোনো গাছে আবার একটা দুটো পাখির বাসাও বেরিয়ে পড়ত। মাঝে, মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঘন সবুজ ঘাসের ওপর শরীর ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়তো আর এক দৃষ্টিতে ঐ উঁচুতে বিশাল নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকত।

প্রথম দিকে বাবলু কিছুক্ষণ পর, পরই মার কাছে ফিরে আসত, মার পাশে, পাশে থাকত। আর বাগানবাড়ির মালিক যখন জিজ্ঞেস করতেন তার এখানে ভাল লাগছে কিনা, সে আস্তে হেসে বলত - হ্যাঁ।

চারিদিকে নানারকমের ফল আর ফুলের বাহার। অগুন্তি কাঠবিড়ালি সারা গাছময় দৌড়ে বেড়ায়। মাঝে, মাঝে আবার মাঠের ওপরও নেমে আসে। এসবের সাথেই তাদের দিন কেটে যেতে লাগলো। তাছাড়া সারাদিনে দুবার স্নান করা ছিল। সুগন্ধি গায়ে মাখার সাবান দিয়ে মা নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বাবলু আর টুবলুকে স্নান করাতেন। তারপর দুজনের মাথায় ভাল করে তেল মাখিয়ে চুল আঁচড়ে দিতেন। এতদিনের রুক্ষ চামড়ার ভাঁজে ঢাকা অকালে পরিণত দুটো মুখ এবার আত্মপ্রকাশ করল স্বচ্ছ উজ্জ্বল দুই কিশোরের মুখ নিয়ে। তাদের দুজনের মুখ থেকে তাদের আসল জীবনের সমস্ত চিন্হ মুছে গেল।

দিনকে দিন প্রকৃতি নতুন, নতুন রূপ নিয়ে ধরা দিতে লাগল দুই কিশোরের কাছে। বাগানের বড় পুকুরটিতে লাফিয়ে পড়ে হুটোপুটি করতে ওদের সব থেকে ভাল লাগত। দুপুরবেলা খাওয়া সেরে কোনো গাছের ডালে বসে দুজনে গল্প করে চলত। একদিন বাবলুর মা কোথা থেকে একটা মাছ ধরার ছিপ এনে বাবলুর হাতে দিলেন। তাই নিয়ে শুরু হল আরেক নতুন মজা। দিনের অনেকটা সময় সে আর টুবলু পুকুরের ধারে গাছের ছায়ায় বসে জলে ছিপ ফেলে এক মনে সেদিকে তাকিয়ে থাকত। জল পোকার জলের ওপর আঁকিবুকি কেটে চলা আর জল ফড়িংয়ের মৃদু গুনগুন আওয়াজ করে এদিক ওদিক উড়ে বেড়ানো দেখতে, দেখতে তন্ময় হয়ে যেত তারা। ওদিকে যে মাছ বড়শিতে গেঁথে রয়েছে, সেদিকে কোনো হুঁশই থাকতনা। এই ভাবে দিনের পর দিন প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে থাকল তারা।

ধু, ধূ সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে প্রাণ খুলে দৌড়ে চলত ছেলে দুটো। আবার কখনো, কখনো ঘন সবুজ ঘাসের ওপর শুধুই গড়াগড়ি খেত আর আপন মনে খিলখিল করে হেসে চলত। প্রকৃতি তার সমস্ত কোমলতা আর মাধুর্য্য নিয়ে এই দুই কিশোরকে জড়িয়ে ধরল। তারা প্রকৃতির মধ্যে ডুবে গেল।

ছেলে দুটোর মন থেকে তাদের আসল জীবনের কথা যে মুছে গিয়েছে, তা বাবলুর মা বুঝতে পেরেছিলেন। তবুও তিনি ওদের এই আনন্দে ভরে ওঠা জীবনে সেই কথা এতদিন তুলছিলেন না। কিন্তু ছুটির দিন যতই ফুরিয়ে আসতে লাগল, ওনার মন ততই খারাপ হতে থাকল। আবার বুকের ছেলেটাকে ঐ আস্তাকুড়ে ফিরে যেতে হবে। কথাটা মনে হতেই দুচোখ ভিজে উঠত ওনার। আর ছেলে দুটো যেরকম আনন্দে বিভোর হয়ে রয়েছে, কিভাবে যে ওদেরকে কথাটা বলবেন ভেবে পেতেন না। অবশেষে যাবার দুদিন আগে সকালবেলা খাবার খাওয়ার সময় বাবলুর মা যতটা সম্ভব হালকা ভাবে কথাটা তুললেন।

এক মনে মুখ নীচু করে খেতে ব্যস্ত ছিল বাবলু আর টুবলু । ধীরে, ধীরে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উনি বললেন, - খাওয়া সেরে উঠে একসময় সব কিছু গোছগাছ করে রাখিস। আগামী পরশু তো তোদের যাবার দিন। মার কথাটা বাবলুর মাথার ভেতরে একটা বিদ্যুতের মতো খেলে গেল। প্রথমটায় সে হতোভমবের মতো তার মার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর তারস্বরে চিৎকার দিয়ে রীতিমতো হাত পা ছুঁড়ে খাওয়া ফেলে উঠে পড়ল। - না, না মা। আমি কিছুতেই আর ওখানে ফিরে যাবনা। - কথাগুলো বারবার চেঁচিয়ে বলতে, বলতে সারা রান্নাঘরটা কে সে যেন মাথায় তুলল। তার মা বহুক্ষণ ধরে বাবা বাছা বলে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অবশেষে এক সময় ছেলেকে শান্ত করলেন। অন্য দিকে রাগ, ভয়, অভিমান প্রকাশ করার মতো কেউ টুবলুর এই পৃথিবীতে ছিলনা। তাই সারাক্ষণ সে শুধু নীরব হয়ে রইল। একটা নতুন ভয়ে তার সারা শরীর অবশ হয়ে গিয়েছিল।

বাবলু সেই যে চুপ করে গেল, সারাদিনে সে আর টু শব্দটি করলনা। অন্যান্য দিন সারাটা দিন ধরে সে আর টুবলু যা, যা করে, সেসব কিছুই করলনা। শুধু সারাটা দিন বাড়ীর সামনে ঘাসের ওপর দুজনে চুপচাপ বসে দূরের দিকে এক মনে তাকিয়ে রইল। রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে বাবলুর দৃষ্টি স্থির হয়ে রইল। তার মাও খেয়াল করলেন না যে ধীরে, ধীরে ছেলে দুটোর মুখ থেকে এতদিন ধরে ফুটে ওঠা সেই স্বাভাবিক উজ্জ্বলতাটা হারিয়ে যেতে লাগল। আর এক গভীর চিন্তার কালো ছায়া তা ঢেকে ফেলল।

পরদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাবলু আর টুবলু একরকম বাড়ী থেকে বেরোলোই না। বাবলুর দুচোখের দৃষ্টি সেই আগের মতো হয়ে গেল। তার ছোট্ট কপালটা চিন্তার ছোট, ছোট ভাঁজে ভরে গেল। প্রায় সারাটা দিনই সে আর টুবলু রান্নাঘরে এক কোণে বসে এক অদ্ভুত শুন্য দৃষ্টিতে ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। বাগানবাড়ির কর্তা সবই জানতেন। দুপুরবেলা তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে একবার এলেন। বাবলুর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, - এর পরে আবার যখন আসতে ইচ্ছে করবে, মা গিয়ে নিয়ে আসবেন, কেমন।

বিকেলবেলা বাড়ীর লনে পায়চারি করার সময় ওনার স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন - কলকাতায় ছেলে দুটো কোথায় থাকে গো ?

- ও বাবা, ওরা যে পরিবেশের মধ্যে থাকে, চিন্তাও করতে পারবেনা। দুঃস্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন। - কথাগুলো মানুষটার অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে।

এ যেন আরেক অন্য বিকেল। বাবলু আর টুবলুর চোখের সামনে ধীরে, ধীরে বাগানবাড়ীটা দূরে সরে যেতে লাগল। থমথমে মুখে ছেলে দুটো মার সঙ্গে এসে দাঁড়ালো বাসস্টপে। সেই এক চেনা রাস্তা, চেনা দোকানপাট, লোকজন সব সামনে আবির্ভূত হতে লাগল। অবশেষে এক সময় দূর থেকে দেখা গেল গ্যারেজটাকে। তখন সন্ধ্যা নামছে।

গ্যারেজের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে এক দৃষ্টিতে চলে যাওয়া মার দিকে তাকিয়ে রইল বাবলু আর টুবলু। টুবলু তাকিয়ে থাকে, যেন তার মা তাকে ফেলে চলে যাচ্ছে। রাস্তার শেষে পৌঁছে পেছন ফিরে একবার দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকালেন বাবলুর মা। এত দূর থেকে ছেলের ঐ ছোটো মুখটা ভাল করে দেখাও যায়না। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আঁচলে দুচোখ মুছে বড় রাস্তার ভিড়ে হারিয়ে গেলেন তিনি।

দিন আসে, দিন যায়। কালো ধোঁয়া আর বিকল হওয়া গাড়ীর বিষাক্ত তেলকালিগুলো ধীরে, ধীরে ঢেকে ফেলে ছেলে দুটোর উজ্জ্বল মুখ দুটো। কামড়ে বসে তাদের সারা শরীরের ওপর। আবার সেই আগের চালচুলোহীন, ছিরিছাদহীন রুক্ষ চেহারায় ফিরে যায় তারা। কিন্তু এসবের আড়ালে ঐ অন্ধকার জীবনের মধ্যেও অনেক দূরে ফেলে আসা ঐ কটা স্বপ্নের দিনের উজ্জ্বল স্মৃতি দুটো ক্ষীণ শিখার মতো জ্বলতে থাকে ঐ দুই কিশোরের মনের প্রদীপে। গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, গ্যারেজের সেই এক চিলতে ঘরের বিছানায় শুয়ে থাকা দুজোড়া চোখ এক রঙীন স্বপ্নের আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে অনেক দূরের পৃথিবীর সেই বাগানবাড়ীটার গল্পে, যেখানে তারা ফেলে এসেছে ক্ষণিকের জন্য ফিরে পাওয়া তাদের কৈশোরকে। চাপা উত্তেজনায় ফিসফিস করে একে অপরকে বলে চলে পুকুরে মাছ ধরার গল্প, গাছে চড়ার গল্প, কাঠবিড়ালির পেছনে দৌড়নোর গল্প আর বিশাল সবুজ মাঠের ওপর দিয়ে শুধু ছুটে চলার গল্প।

একটা মিনি বাস বিশ্রী আওয়াজ তুলে ব্রেক কষে এসে থামে জানালার একেবারে পাশে। একগাদা কালো ধোঁয়া বেরিয়ে আসে। - কি বাজে গন্ধ। - বিরক্তিতে বলে ওঠে বাবলু। - এই গন্ধটা আর আমাদের গা থেকে কিছুতেই যায়না, না রে ?

- কোনোদিনও যাবেনা। - বলে টুবলু ।

চিৎকার করে ঝগড়া করতে, করতে বাস থেকে নামে এক প্যাসেঞ্জার। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা কন্ডাক্টর লোকটার উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। সাথে যোগ দেয় আরো কয়েকজন যাত্রী। তীব্র কোলাহলে চাপা পড়ে যায় দুই কিশোরের মৃদু কণ্ঠস্বর।

.    .    .

Discus