image by unsplash.com

২০০৮ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময়টি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার সংঘাত ও যুদ্ধবিরতির এক অস্থিতিশীল অধ্যায়। এই সময়ের মধ্যে অন্তত ছয়বার যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়েছে— ২০০৮, ২০১২, ২০১৪, ২০১৯, ২০২১ এবং সর্বশেষ ২০২৫ সালে। প্রতিবারের দৃশ্যপট ছিল প্রায় একই: হামাস চুক্তি মেনে চলে, ইসরায়েল তা ভঙ্গ করে; তারপর ইসরায়েলের আক্রমণ বাড়ে, হামাস পাল্টা রকেট হামলা চালায়; ইসরায়েল আবার গাজায় তাণ্ডব চালায়, বহু প্রাণহানি ঘটে; তারপর আসে নতুন এক যুদ্ধবিরতি— এবং এই ভয়াবহ চক্র আবারও ঘুরে ফিরে শুরু হয়।

২০০৮: অবরোধ, যুদ্ধবিরতি ও গাজায় রক্তপাতের সূচনা

২০০৮ সালের ১৯ জুন ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে প্রথম বড় যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়। এর আগে প্রায় দুই বছর ধরে গাজা উপত্যকা ছিল ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের মধ্যে। ২০০৬ সালে হামাস ফিলিস্তিনের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকেই ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং যুক্তরাষ্ট্র একযোগে এই সরকারকে অচল করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। হামাস সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দেয় এবং গাজার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা ইসরায়েলের জন্য ছিল এক বড় ধাক্কা।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা খোলাখুলিভাবেই বলেছিলেন— তাদের লক্ষ্য ছিল গাজাকে “ধ্বংসের কিনারায় ঠেলে দেওয়া।” প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টের উপদেষ্টা ডভ ওয়েইসগ্লাস পর্যন্ত ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন, “আমরা ফিলিস্তিনিদের একপ্রকার ডায়েটে রাখব”— অর্থাৎ খাবার ও সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে জনগণকে শাস্তি দেওয়া হবে।

অবরোধ ও প্রতিশোধমূলক হামলায় ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা গাজায় ১,১৭৯ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, যাদের মধ্যে ছিল ২১৮ জন শিশু। বিপরীতে হামাস বা অন্যান্য প্রতিরোধ সংগঠন হত্যা করে মাত্র ১০ জন ইসরায়েলি সেনাকে।

অবশেষে জুন ২০০৮-এ যখন যুদ্ধবিরতি হয়, তখন সেটি ছিল শান্তির এক স্বস্তিকর মুহূর্ত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, “এটি ছিল গত আট বছরে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা কমানোর সবচেয়ে কার্যকর কারণ।” হামাস তখন কেবল নিজের যোদ্ধাদেরই নয়, অন্য সংগঠনগুলোকেও রকেট ছোঁড়া থেকে বিরত রাখে।

কিন্তু ইসরায়েল চুক্তির শর্ত পালনে গড়িমসি করে। তারা জানায়, বন্দি ইসরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতকে মুক্তি না দিলে সীমান্ত খোলা বা অবরোধ শিথিল করা হবে না। ৪ নভেম্বর ২০০৮, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন, ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় প্রবেশ করে এবং ছয়জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। এর প্রতিক্রিয়ায় হামাসসহ অন্যান্য গোষ্ঠী রকেট ছোঁড়ে।

এরপরই শুরু হয় পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ— যা পরে “২০০৮–০৯ গাজা যুদ্ধ” নামে পরিচিত হয়। ওই যুদ্ধে ১,৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের অর্ধেকেরও বেশি বেসামরিক ও প্রায় ৩০০ জন শিশু। জাতিসংঘের গোল্ডস্টোন রিপোর্ট স্পষ্ট করে জানায়, ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল “গাজার জনগণকে শাস্তি দেওয়া, অপমান করা এবং ভয় দেখানো।” যুদ্ধ শেষে ইসরায়েল একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করলেও অবরোধ তুলে নেয়নি এবং সৈন্যও সরায়নি। গাজার মানুষের জন্য যুদ্ধ যেন শেষ হলেও শান্তি আসেনি।

২০১২: শান্তির সুযোগের মধ্যে হত্যাকাণ্ড

২০১১ সালের শেষ দিকে ইসরায়েলি শান্তি কর্মী গেরশন বাসকিন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে গোপন যোগাযোগ শুরু করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি স্থাপন করা। হামাস এতে আগ্রহী ছিল এবং কয়েক মাস ধরে একটি প্রস্তাবনাও তৈরি করে। কিন্তু ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক ও সরকারি সংস্থাগুলো “সিদ্ধান্ত না নেওয়ার” সিদ্ধান্ত নেয়। হামাস তখনও সংযম দেখায়।

মার্চ ২০১২-তে যখন প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ (PIJ) ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, হামাস এতে অংশ নেয়নি। বরং তাদের নেতা আহমেদ জাবারি রকেট হামলা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ইসরায়েলি সাংবাদিক আলুফ বেন এমনকি লিখেছিলেন, “জাবারি গাজায় ইসরায়েলেরই একপ্রকার ঠিকাদার, যিনি পাঁচ বছর ধরে শান্তি বজায় রেখেছেন।”

অবশেষে নভেম্বর ২০১২-তে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়। কিন্তু অনুমোদনের দিনই, ১২ নভেম্বর বিকেলে, ইসরায়েল আলোচনার বদলে জাবারিকে লক্ষ্য করে হত্যা করে। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় নতুন যুদ্ধ — অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্স। এতে ১৭১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়, বেশিরভাগই বেসামরিক, আর হামাসের পাল্টা হামলায় ৬ ইসরায়েলি প্রাণ হারায়।

২১ নভেম্বর ২০১২ নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়। এতে সীমান্ত খোলা, চলাচলের স্বাধীনতা ও গাজার মানুষকে লক্ষ্য না করার কথা বলা হয়। কিন্তু ইসরায়েল খুব দ্রুতই শর্ত ভঙ্গ করে। গাজা থেকে কোনো রকেট ছোঁড়া না হলেও ইসরায়েল নিয়মিতভাবে কৃষক, জেলে ও সাধারণ নাগরিকদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। পরবর্তী দুই বছরে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে হামাসের তুলনায় দ্বিগুণ বার, এবং প্রায় সব হতাহতের দায় ছিল ইসরায়েলের ওপর।

২০১৪ থেকে ২০২১: পুনরাবৃত্ত যুদ্ধ, ভাঙা প্রতিশ্রুতি

২০১৪ সালে ফাতাহ ও হামাস যখন একত্র হয়ে ঐক্যচুক্তি করে, ইসরায়েল তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর পশ্চিম তীরে তিনজন ইসরায়েলি কিশোরের হত্যাকাণ্ড ঘটে— যা হামাসের কাজ ছিল না, তবু ইসরায়েল সেটিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে হামাসের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। এর ফলে শত শত ফিলিস্তিনি গ্রেফতার ও নিহত হয়।

৭ জুলাই ২০১৪ ইসরায়েল গাজায় নতুন করে যুদ্ধ শুরু করে। ৫১ দিনব্যাপী সেই যুদ্ধে ২,২০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যার মধ্যে ছিল ৫৫০ শিশু। ১৮,০০০ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। হামাসের পাল্টা হামলায় ৬৭ ইসরায়েলি সেনা ও ৬ জন বেসামরিক নিহত হয়।

যুদ্ধ শেষে নতুন যুদ্ধবিরতি হয়, যেখানে ইসরায়েল প্রতিশ্রুতি দেয় সীমান্ত খোলার, সহায়তা প্রবেশের ও মাছ ধরার এলাকা বাড়ানোর। কিন্তু বাস্তবে অবরোধ বহাল থাকে, হামলা-প্রতিহমলা অব্যাহত থাকে, এবং কয়েক মাস পর পর নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। ২০১৯ ও ২০২১ সালে একই দৃশ্য পুনরায় দেখা যায়।

মে ২০২১-এর যুদ্ধে ইসরায়েল গাজায় ২৬১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক। হামাসের পাল্টা হামলায় ১৪ ইসরায়েলি নিহত হয়। ২০ মে ২০২১ নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়, কিন্তু মাত্র এক মাসের মধ্যে ইসরায়েল আবারও গাজায় বোমাবর্ষণ করে — যা ছিল স্পষ্ট চুক্তিভঙ্গ।

২০২৩ থেকে ২০২৫: অক্টোবরে বিস্ফোরণ, রক্ত ও রাজনীতির খেলা

২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গাজা সীমান্তে ফিলিস্তিনিরা অবরোধের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালিয়ে একজনকে হত্যা করে ও বহুজনকে আহত করে।

৭ অক্টোবর ২০২৩ হামাস ও অন্যান্য সংগঠন ইসরায়েলে আক্রমণ চালায়। এই ঘটনায় ১,১৩৯ জন মারা যায়, যার মধ্যে ৬৯৫ জন ছিল বেসামরিক। পরবর্তী তদন্তে জানা যায়, অনেক ইসরায়েলি নিজেদের সেনাদের গুলিতেই নিহত হয়— কারণ “হানিবাল নির্দেশ” অনুযায়ী সেনাদের আদেশ ছিল, বন্দি হওয়ার চেয়ে নিজেদের নাগরিকদের হত্যা করতে।

এরপর ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ প্রতিশোধমূলক হামলা শুরু করে। প্রতিদিন শত শত মানুষ নিহত হয়, ভবন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, হাসপাতাল ও শরণার্থী শিবিরে আঘাত হানে বোমা। নভেম্বরের শেষে এক সপ্তাহের মানবিক যুদ্ধবিরতি হয়, যেখানে বন্দি বিনিময় হয়, কিন্তু সেই সময়েও ইসরায়েল তিনবার চুক্তি ভঙ্গ করে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু তখন ঘোষণা করেন, “আমরা কোনো চুক্তি নয়, হামাসের সম্পূর্ণ বিনাশ চাই।”

২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল হামাসের নতুন মুখপাত্র সালেহ আল-আরউরিকে হত্যা করে, ফলে আলোচনা স্থগিত হয়। ফেব্রুয়ারিতে নতুন খসড়া চুক্তি তৈরি হলেও ইসরায়েল অনড় থাকে “পূর্ণ বিজয়ের” দাবিতে। মে মাসে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়া ঘোষণা করেন, তারা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিয়েছে, কিন্তু ইসরায়েল তা অস্বীকার করে এবং রাফাহ শহরে আক্রমণ চালায়।

এরপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন দাবি করেন, ইসরায়েল “দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে”— কিন্তু সেটিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

জুলাই ২০২৪-এ ইসরায়েল নতুন অগ্রহণযোগ্য শর্ত দেয়— গাজা-মিশর সীমান্তে স্থায়ী সেনা উপস্থিতি ও উত্তর গাজায় শরণার্থীদের ফেরত না দেওয়া। এমনকি ডানপন্থী পত্রিকা জেরুজালেম পোস্ট পর্যন্ত লিখেছিল, “নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে বন্দি মুক্তির চুক্তি ভঙ্গ করছেন।”

৩১ জুলাই ইসরায়েল হানিয়াকে হত্যা করে, অক্টোবরে ইয়াহিয়া সিনওয়ার নিহত হয়, ফলে আলোচনার সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। পরে নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির গর্ব করে বলেন, “আমরাই এখন পর্যন্ত চুক্তি হতে দেইনি।”

অবশেষে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও অভ্যন্তরীণ ক্ষোভের মুখে ইসরায়েল বাধ্য হয় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে। ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সই হয় নতুন চুক্তি— যা আসলে আগের বছরের মে মাসের একই প্রস্তাব ছিল। ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ছিল ১৫ মাস পর গাজার মানুষের জন্য প্রথম আনন্দের দিন। বন্দিরা ঘরে ফেরে, উত্তর গাজায় খাদ্য সহায়তা পৌঁছায়, ধ্বংসস্তূপে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। মানুষ আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তবু সবাই জানে— ইতিহাস যেমন বলেছে, এই শান্তিও হয়তো ক্ষণস্থায়ী।

উপসংহার

দীর্ঘ সতেরো বছরে দেখা গেছে, যুদ্ধবিরতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে কেবল একটি সাময়িক শ্বাস নেওয়ার বিরতি। প্রতিবার হামাস অপেক্ষাকৃতভাবে চুক্তি মানে, কিন্তু ইসরায়েল নতুন শর্ত, আক্রমণ ও অবরোধের মাধ্যমে সেটি ভেঙে দেয়। এই অবিরাম চক্রে গাজার সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত— যাদের জীবন সীমান্তের হিসাব-নিকাশের নিচে পিষ্ট হয়ে গেছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারির যুদ্ধবিরতি হয়তো কিছুটা আশা জাগিয়েছে, কিন্তু প্রকৃত শান্তির জন্য প্রয়োজন ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক সমাধান— যেখানে ফিলিস্তিনি জনগণের মৌলিক অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত হবে। না হলে ইতিহাসের এই রক্তাক্ত পুনরাবৃত্তি থামবে না, এবং “যুদ্ধবিরতি” শব্দটি কেবল আরেকটি অপেক্ষাকৃত বিরতির প্রতিশব্দ হয়েই থাকবে।

.    .    .

Discus