AI-generated Image by ChatGPT

ভূমিকা

ভারত একটি বহুত্ববাদী দেশ, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মানুষ একত্রে বসবাস করে আসছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখার মূল ভিত্তি হলো আমাদের সংবিধান, যা ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য, ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারগুলিকে সুরক্ষা দেয়। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ধর্মীয় বিদ্বেষের অন্ধকার ছায়া এই ঐক্যের শেকড়ে আঘাত হানতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বিভিন্ন বিতর্কিত চলচ্চিত্র—যেমন দ্য কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরি, আজমের ৯২ এবং সাম্প্রতিক উদয়পুর ফাইলস—একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে যেভাবে ঘৃণা ছড়াচ্ছে, তা শুধু সামাজিক শান্তিকে বিঘ্নিত করছে না, বরং ভারতের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও চ্যালেঞ্জ করছে। এসব চলচ্চিত্রে মুসলিম সম্প্রদায়কে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সম্মানিত ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলিকে অসম্মান করা হয়েছে। ‘উদয়পুর ফাইলস’ নামক চলচ্চিত্রটি শুধু ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের উপর উদ্দেশ্যমূলক আক্রমণ নয়, বরং একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ, যার মাধ্যমে দেশের সংবিধানবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য, সম্প্রীতি এবং সংবিধানের মর্যাদা রক্ষার জন্য আমাদের সকলেরই দায়িত্ব সচেতন ও সোচ্চার হওয়া।

গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের দেশে ঘৃণা ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই বিভাজনের রাজনীতি আজ শুধু রাজনীতির মাঠেই নয়, পৌঁছে গেছে সিনেমা হল পর্যন্ত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের এক অংশ এখন সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি নিরব কিন্তু সুপরিকল্পিত প্রচারে লিপ্ত। রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের অনেক প্রতিনিধিও এই মনোভাবকে উৎসাহ দিচ্ছেন। আগে চলচ্চিত্র ছিল সমাজের দর্পণ, যেখানে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সামাজিক বার্তা ফুটে উঠত। সেই সিনেমাগুলোতে জাতীয় ঐক্য, ভালোবাসা ও সম্প্রীতির চিত্র দেখা যেত। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে—চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য এবং চরিত্র দুটোই যেন ঘুরে গেছে।

বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে একধরনের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব সিনেমা তৈরি হচ্ছে, তার অনেকগুলোর মধ্যে মুসলিম বিরোধী মনোভাব স্পষ্ট। ইসলাম ধর্ম ও মুসলিম সমাজকে অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। মুসলমানদের ধর্মীয় পরিচয় ও প্রতিষ্ঠান যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগা—সব কিছুকে সিনেমার পর্দায় নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই প্রবণতা শুধুই একটি সম্প্রদায়কে আঘাত করে না, বরং আমাদের দেশের সংবিধান, যার মূল ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্য, সেটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।

উদয়পুর ফাইলসের আগেও আমাদের দেশে তৈরি হয়েছে একাধিক বিতর্কিত ও ঘৃণামূলক চলচ্চিত্র, যেমন দ্য কাশ্মীর ফাইলস, কেরালা স্টোরি, ৭২ হোরস, এবং আজমের ৯২। এই ছবিগুলো দেশের নানা প্রান্তে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সমালোচনার মুখেও মুক্তি পেয়েছে। শুধু পরিচালক বা প্রযোজকরাই নন, এইসব ছবিকে অনুমোদন দেওয়া সেন্সর বোর্ডের দায়ও এখানে অনেকখানি। কারণ, সেন্সর বোর্ডের কাজই হলো এমন ছবিগুলিকে যাচাই করে জনসাধারণের মনের শান্তি ও সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষায় দায়িত্ব পালন করা।

ভারতে চলচ্চিত্র যাচাইয়ের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে গঠিত হয়েছে সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশন (CBFC)। এটি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের অধীনে কাজ করে এবং ছবিকে শ্রেণীবদ্ধ করার একমাত্র আইনগত সংস্থা। বোর্ডের মূল দায়িত্ব, কোনও চলচ্চিত্র যদি দেশের জাতীয় স্বার্থ, শান্তি-শৃঙ্খলা বা জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে—তবে সেটিকে শংসাপত্র না দেওয়া। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, এই সমস্ত নিয়ম শুধুই কাগজে লেখা আইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবে অনেক ছবিই এমন বার্তা বহন করছে, যা সমাজকে বিভক্ত করে দিচ্ছে এবং সংবিধানের মূল আদর্শকে আঘাত করছে।

উদয়পুর ফাইলসের ট্রেলার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেলারটি আপলোড হতেই সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ধর্মীয় সংগঠনগুলো প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দ-এর পক্ষ থেকে এই বিতর্কিত ছবিটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। ছবিটির মূল কাহিনির কেন্দ্রে রয়েছে উদয়পুরের এক দর্জি, কানহাইয়া লাল কুমার, যিনি বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে করা অপমানজনক মন্তব্যকে সমর্থন করেছিলেন। এই অপমানজনক মন্তব্য করেছিলেন কুখ্যাত বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মা, যিনি নবী (সা.) সম্পর্কে প্রকাশ্যে অবমাননাকর বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই বিতর্কিত বক্তব্য ছবির ট্রেলারে রাখা হয়েছে, যা শুধু দেশের সাম্প্রদায়িক পরিবেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে না, বরং ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেও কালিমা লেপন করেছে। এতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও নেতিবাচক প্রভাবিত হয়েছে।

এই সিনেমায় শুধু বিতর্কিত বক্তব্য নয়, বরং গোপনে একটি সাম্প্রদায়িক এজেন্ডা চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ছবিতে এমনকি জ্ঞানবাপী শাহী মসজিদের মতো সংবেদনশীল ধর্মীয় ইস্যুকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় উত্তেজনা উসকে দেওয়ার কৌশল। দুঃখজনকভাবে, ভারতের অন্যতম প্রাচীন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ এবং জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দ-এর মতো সম্মানিত সংগঠনগুলোকেও অপমান করার চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক মুসলিম পণ্ডিত ও নেতার ব্যক্তিত্বকে হেয় করার মাধ্যমে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। এই সিনেমা যেন একটি প্রচ্ছন্ন চক্রান্ত, যার মাধ্যমে সরল ও সাধারণ হিন্দু ভাইদের মনে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটি শুধু মুসলমানদের অসম্মান করার চেষ্টা নয়, বরং ভারতের সংবিধানে লিপিবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের সরাসরি বিরোধিতা করে।

এই চলচ্চিত্রটি যেমন ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের প্রতিফলন, তেমনি এটি সরাসরি ভারতের সংবিধানকেও চ্যালেঞ্জ করে। আমাদের সংবিধানের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিটি নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করে, আর ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ ধর্ম, জাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বৈষম্যকে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছে। ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদ আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিলেও, সেটির কিছু সীমা নির্ধারণ করেছে—যাতে কেউ যেন অন্যের সম্মান ও ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত না করে, অথবা দেশের অখণ্ডতা ও জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত না হয়। একইভাবে ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রতিটি নাগরিককে সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার দেয়। অথচ এই ‘উদয়পুর ফাইলস’ নামের বিতর্কিত চলচ্চিত্রটি সংবিধানের এই সমস্ত মৌলিক অনুচ্ছেদকে অবজ্ঞা করে, এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে এক বিপজ্জনক বার্তা প্রদান করে।

এই ছবিকে সমর্থনকারী কিছু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করছে—তাদের ধর্মীয় অনুভূতি, পরিচয়, সম্মান ও মর্যাদাকে আহত করছে। এটি নিছক একটি চলচ্চিত্র নয়, বরং দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট ষড়যন্ত্র। তাই আমরা কেন্দ্রীয় সরকার এবং সেন্সর বোর্ডের প্রতি জোর দাবি জানাই—এই ধরনের ঘৃণামূলক ও সাম্প্রদায়িক চলচ্চিত্র অবিলম্বে নিষিদ্ধ করা হোক, এবং যারা এসব ছবির পরিকল্পনা ও নির্মাণের সঙ্গে জড়িত, সেইসব পরিচালক ও প্রযোজকদের বিরুদ্ধে কড়া আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। যেন ভবিষ্যতে আর কেউ দেশের ঐক্য ও সংবিধানের বিরুদ্ধে এমন ধৃষ্টতা না দেখায়। আমরা প্রার্থনা করি—ঈশ্বর যেন আমাদের প্রিয় দেশের গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতিকে রক্ষা করেন, এবং আমরা সকলে মিলে জাতীয় ঐক্য, সম্প্রীতি ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারি। ঈশ্বর আমাদের দেশকে অখণ্ড, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক রাখুন। আমিন।

উপসংহার

উদয়পুর ফাইলস নামের বিতর্কিত চলচ্চিত্রটি শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়কে অপমান করার জন্য নির্মিত হয়নি, বরং এটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র, সাংবিধানিক আদর্শ এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেওয়ার মতো একটি ভয়ঙ্কর প্রয়াস। এই চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যে ঘৃণা, বিভেদ ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তা শুধু সংখ্যালঘু মুসলমানদেরই নয়, বরং গোটা দেশের জনশৃঙ্খলা, আইন-শৃঙ্খলা ও আন্তর্জাতিক সুনামকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা কখনওই কারও ধর্মীয় বিশ্বাস বা পরিচয়কে হেয় করার হাতিয়ার হতে পারে না। সংবিধানের ১৪, ১৫, ১৯ এবং ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ স্পষ্টভাবে নাগরিকদের অধিকার ও মর্যাদার নিশ্চয়তা প্রদান করে, অথচ এই ধরনের চলচ্চিত্র তা ভেঙে চুরমার করে। এমন অবস্থায় সরকারের উচিত সেন্সর বোর্ডের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করা, এবং যেসব চলচ্চিত্র সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে, সেগুলিকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা। পাশাপাশি, যারা এই ধরনের ঘৃণামূলক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। আমাদের প্রার্থনা, ঈশ্বর যেন আমাদের দেশকে বিভাজনের রাজনীতি থেকে রক্ষা করেন এবং দেশের প্রতিটি নাগরিক যেন শান্তি, সম্প্রীতি ও সহানুভূতির বার্তা নিয়ে এগিয়ে চলেন। একমাত্র ভালোবাসা ও সম্মান দিয়েই প্রকৃত ভারত গড়া সম্ভব—যেখানে ধর্ম নয়, মানুষ আগে।

.    .    .

Discus