Image by Jess Foami from Pixabay
আমাদের পাড়াতে ঘুম ভাঙতো একটা অতি পরিচিত চেঁচামেচিতে। "কই রে পুঁটি গেলি কই? দিদি মনির কাছে পড়তে যেতে হবে তো? আটটা বাজতে চললো যে।"
রান্না ঘরে আনাজ কুটতে কুটতে অপলা কাকিমার হাঁক। নাহ, কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই? মেয়েটা গেলো কোথায় এই বৃষ্টির মধ্যে? গ্যাসে একদিকে ভাত হচ্ছে অন্য বার্নারে কড়া চাপানো, আনাজ ছাড়তে গিয়ে দেখলেন বৃষ্টির মধ্যে পাড়ার কত গুলো হার বজ্জাত বাপে খ্যাদানো মায়ে তাড়ানো ছেলের সঙ্গে পুঁটি সাইকেল চালানো শিখছে। দেখেই মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো অপলা কাকিমার। এতো বেয়াদপ হয়েছে মেয়েটা, আর বলার কথা নয়। বাবার আশকারাতেই মেয়ের এতো বার। জানলা থেকেই চেঁচালেন "পুঁটি এক্ষুনি ঘরে আয়ে বলছি। " কিন্তু কথা মেয়ের কানে গেলেতো। তাই অগত্যা খুন্তি হাতেই বেড়িয়ে এলেন বকতে বকতে।
কাকিমাকে রেগে মেগে আসতে দেখেই পুঁটির বন্ধুরা সব চোঁ চাঁ পালালো, পুঁটি সাইকেলটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে, বাচ্ছু কে ফেরত দেবে কি করে বুঝতে পারছেনা, এরই মধ্যে কাকিমা এসে পিঠে দুটো গুম গুম দিয়ে কান ধরে তাকে হির হির করে টানতে টানতে বাড়ি নিয়ে চললেন। পুঁটিও তারস্বরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো "বাচ্ছু মা আমাকে যেতে দিচ্ছে না, সাইকেলটা এখানে পড়ে থাকলো তুই এসে নিয়ে যা। "
আবার কোনোদিন হয়তো দেখা যাবে ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পুঁটি এক গাল হাসতে হাসতে ফিরছে জামার কোঁচড়ে কাঁচা আম নিয়ে "কুঁড়িয়ে নিয়ে এলাম গো মা"।
স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি চলছে, দুপুরে ঘুমোচ্ছি আবার অপলা কাকিমার গলা, " তবেরে মেয়ে, এই কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে ঘুড়ির পেছনে দৌড়োচ্ছিস? কাক পক্ষী কেউ কোত্থাওটি নেই ? আমার হাড় মাস এক করে দিলো গো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে।" তারপরেই হয়তো দেখা যাবে অপলা কাকিমা পুঁটি কে টানতে টানতে দিদিমনির বাড়ি দিতে চলেছেন।
আমাদের সামনের বাড়ির মাম্পিদির কাছেই পড়তো পুঁটি। পুঁটি পড়তে ঢুকলো, একটু পরেই শোনা যাবে মাম্পিদি খুব জোরে পুঁটি কে বকছে "হ্যাঁ রে তোকে এতো করে পড়িয়ে দিলাম সবটা ভুলে গেলি, সব ভুল করে আনলি, থাক কান ধরে দাঁড়িয়ে বারান্দায়ে, দেখুক পাড়ার লোক জন সকলে"। কিন্তু এতে কি আর পুঁটির লজ্জা হয়ে? ও দিব্বি কান ধরে বারান্দায়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার কুকুর গুলোর সঙ্গে গপ্পো জুড়ে দিলো, নয়তো তো উদাস ভাবে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে কি আকাশ কুসুম ভাবতে লাগলো।
কোনোদিন শোনা যাবে জয়ের ঠাকুমা চ্যাঁচাচ্ছেন "ওরে পাজি মেয়ে তুই গাছের থেকে কাঁচা পেয়ারা গুলো ছিড়ছিস কেনো? পাঁকলে কি তোকে দেওয়া হয়না? দেখো অপলা তোমার মেয়ের কান্ড খানা দেখো। কি একখানা মেয়ের জন্ম দিয়েছিলে, হাঁড় মাস জ্বালিয়ে খেলো গো! শুধু কি তোমাদের, গোটা পাড়ার সক্কলের।
কালের নিয়মে এইসব বকুনি হৈ-চৈ এর মধ্যে পুঁটি মনের সুখে বড়ো হতে লাগলো। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে পুঁটি এখনো কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী।
কিছুদিন হলো জয়ের ঠাকুরমার কি এক কঠিন অসুখ ধরা পড়েছে। হাসপাতালে ভর্তি। অপারেশন হবে। অনেক রক্ত লাগবে। অনেক চেষ্টা করে কিছু বোতল রক্তের জোগাড় হয়েছে। তখনও দুবোতল রক্তের প্রয়োজন। জয়ের বাবা জয়ন্ত কাকু পাড়ার ক্লাবে কথা বলতে গেলেন।
আমরা সবাই উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করছি কাকু কি খবর নিয়ে আসেন। কাকু ফিরতে আমরা যারা ছিলাম সবাই জিজ্ঞেস করলাম কি বলেছে ক্লাব থেকে। কাকু একটু বিহ্বল ভাবে বললেন "জানিস ক্লাব থেকে কি বললো? বললো আপনাদের পাড়ার মেয়ে পুঁটি, ওর কাছেই তো আছে ব্লাড ডোনারের কার্ড।" বললাম সেকি চলোতো যাই, ওকে জিজ্ঞেস করি।
পুঁটিদের বাড়ি গিয়ে ডাকলাম "পুঁটি এই পুঁটি একবারটি আয়ে তো"। পুঁটি বেড়িয়ে এলে জিজ্ঞেস করলাম "তোর কাছে ব্লাড-ডোনারের কার্ড আছে ?" পুঁটি কথাটা শুনে "একটু দাঁড়াও" বলে ঘরের ভেতর চলে গেলো। অপলা কাকিমা ও অজয় কাকু তো আকাশ থেকে পড়েছেন। "সে কি ও কার্ড পেলো কোত্থেকে? ও কি ব্লাড ডোনেট করেছে নাকি কারো কার্ড নিয়ে এসেছে? আমরা তো কিছু জানিই না!"
পুঁটি ঘর থেকে কার্ড এনে আমার হাতে দিলো। দেখলাম ওর নাম লেখা।
কার্ড দুটো হাসপাতালে জমা দিতে রক্ত পেতে এতটুকু আর অসুবিধে হলোনা। এবং খুব ভালো ভাবে অপারেশন করে জয়ের ঠাকুমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আসা গেলো। যেদিন জয়ের ঠাকুমা বাড়ি ফিরছেন, পাড়ার সকলে রাস্তায়ে, হঠাৎ শোনা গেলো অপলা কাকিমার গলা "পুঁটি, ও পুঁটি কি গেলি রে? ভাত বেড়ে বসে আছি তো? মাসিমা আসছেন দেখতে যাব। বড্ডো জ্বালাস রে। " কথা টা শুনে আমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছিলো পুঁটি কি শুধু হাড় মাস জ্বালায়ে, কারো কি কোনও উপকারে আসেনা? আজ যে জয়ের ঠাকুমা সুস্থ হয়ে ফিরে আসছেন তাতে কি পুঁটির কোনো অবদান নেই ?