Image by David Krüger from Pixabay

ভূমিকা

'অশরীরী’ বারোটি কায়াহীনের কাহিনীর সংকলন।‘অশরীরী’র প্রত্যেকটি কাহিনী প্রত্যক্ষদর্শীর বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া। শুধু কাহিনীর প্রয়োজনে স্থান কাল এবং পাত্রের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এই কাহিনী গুলোতে একেবারেই কোনো

কল্পগল্পের আশ্রয় নেওয়া হয়নি।

আশা রাখি ‘অশরীরী’র কাহিনী গুলো পাঠক মহলে রহস্য রোমাঞ্চ সঞ্চার করতে সমর্থ হবে আর সেটাই তো লেখকের কাছে পরমপ্রাপ্তি ও সার্থকতা।

রোমহর্ষক

এই ঘটনাটি ১৯৬৫ সালে টাটানগরে ঘটেছিল। এই ঘটনার কুশীলব সবাই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছে বহু বছর আগে। প্রথমে টাটানগর সম্বন্ধে কিছু কথা বলে কাহিনী শুরু করা যাক্।

জামশেদপুর হোলো পূর্ব ভারতের প্রধান শিল্প নগরী। এই অত্যাধুনিক ইস্পাত নগরীটি ১৯১২ সালে টাটা গোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ জামসেদজী নৌসেরজী টাটার সম্মানে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ইস্পাত নগরীর এক অন্যতম আকর্ষণ হোলো জুবিলী পার্ক। জুবিলী পার্ককে কেন্দ্র করেই ইস্পাত নগরী ছড়িয়ে আছে। জুবিলী পার্কের আয়তন আনুমানিক ছশো পঁচিশ একর। এই পার্কের আকর্ষণে প্রচুর দর্শনার্থী প্রতিদিনএখানে আসেন। ১৯৫৮ সালে ইস্পাত নগরীর পঞ্চাশ তম

বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে সাধারণের জন্য প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। এই পার্কে ভ্রমণপিপাসুদের মূল আকর্ষণ হোলো লাইট শো, বিনোদন কেন্দ্র, ঝরনা, চিড়িয়াখানা ইত্যাদি। এই পার্টির মালিকানা আজও টাটা শিল্প গোষ্ঠিরই। জামশেদপুর কে চলতি পাতায় টাটানগরও বলা হয়। কোন্নগর প্রাথমিকভাবে বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। রাজ্য গুলির নতুন বিন্যাসের ফলস্বরূপ পায়খানগর বর্তমানে ঝাড়খন্ড রাজ্যের অংশ হয়েছে। টাটানগর বিশ্বমানের মাপকাঠিতে দ্বিতীয় স্বচ্ছ শহর হিসেবে সারা পৃথিবীতে স্থান পেয়েছে। এই শহরে সারা পৃথিবীর এবং ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রদেশ থেকে বহু মানুষ দুটির সন্ধানে আসে। এদের মধ্যে অনেকেই ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেছে।

অরুণ গুপ্ত ও ঐসব মানুষদের একজন। অরুন বাবু যাদবপুর থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে টেলকোতে কর্মরত। উনি সেই ১৯৬০সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে টেলকোতে চাকরি নিয়ে টাটানগরে কোম্পানির আবাসনে থাকেন ‌ উনি এখন ম্যানেজার কবে আছেন। তবে কাজের চাপে মাঝে মাঝেই ওনার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়। অরুন বাবুর বাড়ি ফেরার রাস্তা জুবিলী পার্কের পাশ দিয়েই। তুমি বর্তমানে এই জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। অরুণ গুপ্তর মা,বাবা,স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে সুখী গৃহকোণ।

রাতের কুহকিনী

অরুণ গুপ্ত কোনদিনই ভূত অথবা কোন অশরীরীর অবিশ্বাস্য গল্প কাহিনী বিশ্বাস করতেন না। ছাত্র জীবন থেকে বেশ ডাকা বুকো ছেলে

ছিলেন অরুণ বাবু। অসম সাহসী না হ’লেও ভিতু তিনি একদমই নন। যাইহোক ঘটনার দিন রাতেও একটা জরুরী কাজ সেরে অরুণবাবু কোম্পানির গাড়ি নিয়ে বেরোতে বেরোতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে সেদিন। দশটা এমন একটা বেশি রাত মোটেই নয়। আর ওর গাড়িটা টাটারই পদ্মীনি প্রিমিয়ারের লেটেস্ট মডেল। এইসবে মাস দু’য়েক আগে কোম্পানি থেকে ওকে দিয়েছে। অনু বাবু নিজেই ড্রাইভ করতেন। সেরাতেও তিনি নিজেই ড্রইভ করে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন।

কিন্তু জুবিলী পার্কের কাছাকাছি আসতেই নজরে পড়লো রাস্তা এবং পার্কের লাইট কোন যান্ত্রিক গুরুযোগে হঠাৎ নিভে গিয়েছে। সাধারণতঃ এরকমটা হয় না। কিন্তু কি আর করা যাবে। মনে মনে অরুন বলছে “এটা সাময়িক কিছুক্ষনের মধ্যেই সব ঠিক স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

জুবিলী পার্কের কাছাকাছি আসতেই অরুনের নজরে পড়লো একটি মেয়ে ওই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই সে মেয়েটির কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি থামালো। তার মন বললো এই অন্ধকার রাস্তায় মেয়েটিকে একা ছেড়ে যাওয়া ঠিক হ’বে না। সে সময় মানুষের মনে অবিশ্বাস এত মাথাচাড়া দেয়নি। মানুষ একজন অন্যজনকে বিশ্বাস করতো। আজকের মত কথায় কথায় খুন রাহাজানি হোতো না।

বাবু মেয়েটির কাছে জানতে চাইলো মেয়েকে গন্তব্য কোথায়। মেয়েটি যে জায়গার নাম বলল সেটা যে অরুণের বাসস্থান থেকে এক কিলোমিটার সামনের দিকে। অরুণ মেয়েটিকে নিয়ে প্রথমে মেয়েটির বাড়ির দিকে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। তখন সে লক্ষ করল রাস্তা ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন শুধু গাড়ির আলোতে রাস্তা দেখা যাচ্ছে। রাস্তাঘাট সব শুনশান। এক অদ্ভুত নীরবতা যেন ছেয়ে গেছে সে রাতে। এবার কথায় কথায় সে মেয়েটির পরিচয় জানতে চাইলো। মেয়েটি বলল তার নাম মায়া সেন এবং বাড়িতে তার বাবা ,মা ও একটি ছোট ভাই আছে। সে বিএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ফিঝীড্র ছাত্রী। এ কথা সে কথা বলতে বলতে মায়ার বাড়ির দরজায় গাড়ি এসে পৌছালো। মায়াকে ওর বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে অরুন গাড়ি স্টার্ট করে নিজের গন্তব্যের পথ ধরলো। আর কি আশ্চর্য ঠিক তখনই সব আলো যেন কোন যাদুকাঠির ছোঁয়ায়

জ্বলে উঠলো। অরুণ মনে মনে বললো”যাক বাবা বাঁচা গেল। বাড়ি গিয়ে শান্তিতে অন্তত একটু ঘুমনো তো যাবে।

দিন কয়েক বাদে

দিন কয়েক বাদে অরুণ আবারও মায়াদের বাড়ির রাস্তা দিয়েই গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছিলো। হঠাৎ ওর মনে হোলো”একবার মায়াকে দেখে আসতে হ’বে। আর ওর বাবা মায়ের সাথে আলাপ করতে হবে।”

তখন সবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়েছে। অলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন এক প্রৌঢ়

মানুষ। অরুণ পরিচয় দিতেই সেই প্রৌঢ বললেন

“আমার নাম অমিত সেন মায়া আমারই মেয়ের নাম। ভেতরে আসুন আপনি।”

একটু জল পানের পর অরুণ বললো “মায়া কোথায়? ওকে একবার ডাকুন না মেসোমশাই।”

তখন অমিতবাবু অরুণকে পাশের ঘরে নিয়ে গেলেন এবং দেয়ালের দিকে দেখিয়ে একটা মালা লাগানো ফটো দেখালেন তিনি। সেই ফটোর দিকে তাকিয়ে অরুণের দু’চোখ বেরিয়ে আসার যোগাড় আর কি! ওর মাথা ততক্ষণে চক্কর দিতে শুরু করেছে। কোন রকমে একটা চেয়ারের হাতল ধরে অরুণ বসে পড়লো। ওই চেয়ারটা না থাকলে মাথা ঘুরে মাটিতেই পড়ে যেতো।

একটু প্রকৃত হওয়ার পর অমিতবাবু মানে মায়া সেনে এর বাবা বললেন আসলে যেদিন অরুণ মায়াকে জুবিলী পার্কে রাস্তায় দেখেছেন সেদিন থেকে ঠিক দু‘বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে মায়া প্রাণ হারায়। আর তারপর থেকে শুধু

অরুণই নয় আরও অনেকেই গভীর রাতে মায়াকে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। কারণ ওটাই ছিল সেরাতের দুর্ঘটনাস্থল। এই বলে অমিতবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন”বুঝলে অরুণ আমার এ জীবনে এ কেমন মায়ের খেলা কে জানে?”সেদিন অবিশ্বাসী অরুণের কাছে এই কথার কোনো উত্তর ছিলো না।

কায়াহীন

বর্গভীমার মন্দির

বর্গভীমার মন্দির পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমা শহরে। এটি একান্ন শক্তি পীঠের এক অতি মাহাত্ম্যপূর্ণ শক্তি পীঠ। এই মন্দিরটি “বিভাষ” শক্তিপীঠ নামেও বিখ্যাত। আবার এই মন্দিরটি সতী মায়ের ভীমকালী মন্দির নামেও খ্যাত। বর্গভীমার মন্দিরটির অবস্থান রূপনারায়ণ নদীর পাড়ে।

এই মন্দির নিয়ে অনেক কাহিনীই প্রচলিত আছে। এটি একটি জাগ্রত কালীমন্দির এবং এই মন্দিরের নাম মহাভারতেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই মন্দিরে দ্বিতীয় পাণ্ডব মহাবলী ভীমসেন মায়ের আরাধনা করেছিলেন তাই এই মন্দিরটির অন্য নাম ভীমা কালী মন্দির। এই মন্দিরটির আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দেশের মুক্তিযোদ্ধারা মা কালীকে সাক্ষী রেখে ধর্মের পথে চলার শপথ নিতেন। এই মন্দিরে সতী মায়ের বাঁ পায়ের গোড়ালী পড়েছিলো। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই মন্দিরটিকে ঐতিহ্য বা হেরিটেজ হিসাবে সংরক্ষণ করছে। এই মন্দিরটির দূরত্ব কলকাতা থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার। তাই প্রায়ই শহর কলকাতার মানুষ তাদের নানা-নাজি নিয়ে বর্গভীমা মায়ের শরণাপন্ন হন। বিখ্যাত বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এই মন্দিরে পুজো দিতে আসতেন। এই মন্দিরে মায়ের আমিষ ভোগ হয় শোল মাছ দিয়ে।

ইতিহাসে আছে এই মন্দিরটি ময়ূর সাম্রাজ্যে প্রায় ১১৫০ বছর আগে ময়ূর বংশের তমরদ্ধজ রাজা প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরটি ভোর ছ’টা থেকে সন্ধ্যা আটটা পর্যন্ত ভক্তদের জন্য খোলা থাকে।

আমিও বহু মানুষও নিয়মিত এই মন্দিরে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ করার জন্য ভক্তিভরে পুজো দিতে আসেন। এমনই একজন হলেন অজয় মাইতি। মাইতি বাবুর বাড়ি শ্রীকৃষ্ণ চকে। এই পূর্ব মেদিনীপুরে অনেক জায়গার নামের সাথেই চক অথবা মোড় শব্দটি যুক্ত আছে। যেমন দুর্গাচক বা হাজরা মোড় এইরকম আর কি।

হাড়হিম অভিজ্ঞতা

অজয় বাবুর বয়স তখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। সময়টা ১৯৮৪ সাল। শ্রীকৃষ্ণ চক মানে অজয় বাবুর বাসস্থান থেকে ঘন্টা দেড়েক দূরেই বর্গভীমা মায়ের মন্দির। মাইতি বাবু নিয়ম করে ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ রামুর ভ্যান রিক্সা চেপে প্রত্যেক শনিবার বর্গভীমা মন্দিরে গিয়ে পুজো দেন এবং মায়ের ভোগ প্রসাদ নিয়ে আবার ওই রামুর ভ্যান রিক্সাতেই বাড়ি ফিরে আসেন।

সেদিনটাও ছিলো শনিবার কিন্তু সেদিন রামো আসেনি তাই বাধ্য হয়ে মাইতি বাবুকে সেদিনএক অচেনা ভ্যান রিক্সায় যেতে হয়েছিলো। কিছুক্ষণ রাস্তায় অপেক্ষা করার পর হঠাৎই এই অচেনা ভ্যান রিক্সাটি এসে মাইতি বাবুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে, ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়ছে। ভ্যান রিক্সা চালক তার সারা শরীর কম্বলে ঢেকে রেখেছে এমনকি তার মুখও মাইতি বাবুর নজরে পড়েনি। শুধু মন্দিরে যাওয়ারই কথা হয়েছে মাত্র। যাইহোক মাইতি বাবু ভ্যান রিক্সায় উঠে ঠান্ডার আমেজে ঢ়ুলতে ঢুলতে আধো ঘুমেযছিলেন পুরো রাস্তাটাই। কোনদিন রামুর সাথে মাইতি বাবু, কাঁটাটা রাস্তা নানান বিষয়ে কথা বলতে বলতে মন্দিরে পৌঁছে যান। আজ সবকিছুই একটু যেন অন্যরকম। চারিদিক শুনশান এবং রিক্সাওয়ালা ও কেমন যেন গম্ভীর গোছের। মনে মনে মাইতি বাবু একবার বললেন”বড্ড দেমাক দেখছি। এ কেমন মানুষ এক মানুষ শুধু রিক্সা চালিয়েই চলেছে।”

যাই হোক্ মন্দিরের কাছাকাছি একটা মোড়ে এসে ভ্যান রিক্সা থামলো। মেজ আপু চোখটা একটু লেগে এসেছিল হঠাৎ এই ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় চোখ খুলে পকেট থেকে রিকশা ভাড়া বার করে দিতে গিয়ে দেখেন সামনে কেউ নেই। এবার তো হাড় হিম করা হিমেল স্রোত বয়ে গেল মাইতি বাবু শিরদাঁড়া বেয়ে। অজ্ঞান হয়ে ভ্যান রিক্সা থেকে রাস্তায় পড়ে গেলেন মাইতি বাবু। কতক্ষণ পড়েছিলেন তা উনিও জানেন না কারন অতো ভোরে রাস্তায় মানুষজন একটু কমই থাকে। একজন পথ চলতি মানুষ ওনাকে দেখতে পেয়ে চোখে মুখে জলে ঝাপটা দিলে মাইতি বাবুর জ্ঞান ফিরে আসে। উনি শুধু বলতে থাকেন ”ভূত----ত”। তখন আরও লোক জড়ো হয়ে যায় এবং আরও একটি রিক্সা ধরে ওনাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন স্থানীয় মানুষেরা। বাড়ি ফিরে প্রায় এক সপ্তাহ উনি যেন একটা ঘরের মধ্যে ছিলেন। আর মাঝে মাঝেই বলে উঠতেন “ভূ----ত”। তাছাড়া আর কোন কথা নয়। যাই হোক সম্বিত ফিরলে মাইতি বাবু সেদিনের অশরীরীর সমস্ত কাহিনী বলেছিলেন বাড়ির মানুষদের কাছে।

অপঘাত

সে প্রায় বছর ত্রিশেক আগেকার কথা। তখন বনগাঁর দিকে বহু

রাস্তাতেই ল্যাম্পপোস্ট ছিলো না। ফলে বিকেল গড়ালৈই অন্ধকারে ডুবে যেত পুরো এলাকা। খুব একটা দরকার না পড়লে বেশিরভাগ মানুষই বাড়ি থেকে বের হতো না একে অন্ধকারে সাপ খোপ আর পাগলা শিয়ালের ভয় তার উপর আবার অশরী আপনাদের উৎপাত হামেশাই লেগে থাকতো। আমিও বয়স্ক মানুষদের সাবধান করতে শুনেছি রাস্তায় যেতে যেতে কখনো ঝাড়ের সবুজ বাস পড়ে থাকলে সেটা ভুলেও পার হ’তে নেই। ওটা নাকি

প্রেতাত্মাদেরই পাতা একটা ফাঁদ। কারণ মানুষ যখনই ওই কাঁচা বাঁশটা ভারতে যাবে তখন সেটা নিজের থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওই মানুষটাকে তুলে দূরে ছুঁড়ে দেবে। আর এরকম ঘটনায় অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু আমি বিজ্ঞান জানা মানুষ তাই আমার ওসব গল্প কাহিনীতে বিশ্বাস হোতো না একদমই।

কিন্তু চোখের সামনে একটা ঘটনা ঘটতে দেখে আমিও আজ বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি।

ঘটনাটা হোলো এইরকম। তখন রাত প্রায় ন’টা হবে, আমি আর পাড়ার দীলুদা

যাচ্ছিলাম আমার মাসির বাড়ি মামুদপুরে। জায়গাটা আমাদের বনগাঁ থেকে যেতে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক লাগে। কিছুটা পথ বাসে গিয়ে তারপর পায়ে হাঁটতে হোতো। এই হাঁটার পথেই একটা জঙ্গল ছিল আর ঠিক মাঝখানে ছিল একটা অতি পুরোণো বটগাছ। ওই বট গাছকে ঘিরেই ছিলো যত রহস্য রোমাঞ্চ আর কি! এদিকে রাত যত বাড়ছে ঝিঁঝিঁর নিরলস ঐকতানও ততই বাড়ছে, আর আলো বলতে চারপাশে জোনাকিরা টিপটিপ করে জ্বলছে আর নিবছে। মাঝে মাঝে বন্য জন্তুর ডাক শোনা যাচ্ছে সে এক সত্যিই গা ছমছম করা ভৌতিক পরিবেশ। আমার মত ভূতে অবিশ্বাসী মানুষ একটা সময় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। মাঝে মাঝেই দীলুদাকে জিজ্ঞেস করছি

“আর কত দূরগো দীলুদা?”

কারণ এই পথে দীলুদা প্রায়ই আসা যাওয়া করে, তা মাসে একবার তো বটেই। কথার মাঝে হঠাৎ ই বটগাছের উপর থেকে কে যেন একরাশ মাটির ডেলা ছুঁড়ে দিলো ঝুরঝুর করে।

আমি সামনে পেছনে আর চারপাশে টর্চ মেরে কারো কোন টিকির সন্ধানও পেলাম না। তখন দিলুদা বললো “খুব সাবধান ভাই তেনারা আছেন এ কথা জানান দিচ্ছেন।”আমাকেও তা মেনে নিতে হোলো। ততক্ষণে মাসির বাড়ির প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছি আমরা। অর্ডার দেখি রাস্তা জুড়ে একটা কাঁচা বাঁশ পড়ে রয়েছে। আমি সেই কাঁচা বাঁশটার কাছে যেতেই দীলুদা হাঁ হাঁ করে বলে উঠলো “না না ওই বাঁশ তুই পার হোস্ না ভাই।” আমিও দীলুদার কথায় কিছুটা পিছিয়ে এলাম। এই কাঁচা বাঁশের কথা আমি স্থানীয়দের কাছে অনেকবার শুনেছি কিন্তু চাক্ষুষ দেখা এই প্রথম। আমি পিছি আসার পর দিলুদা বলল “দেখ্ ভাই এবার কি করি আমি?”

দেখলাম দিলু দা একটা থান ইট নিয়ে ওই কাঁচা বাঁশটার ওপরে রেখে দিলো। আর যেইনা ইট ঐ বাঁশ ছুঁয়েছে বাঁশটা যেন জ্যান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উঠে ওই ইটটাকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তারপর দীলুদা আমাকে সামনের দিকে এগোতে বললো। আর আমিও সে রাতে ওই জঙ্গলী রাস্তা ধরে মাসির বাড়িতে পৌঁছে গেলাম সেই অশরীরীর ফাঁদা, ফাঁদে পা না গলিয়ে।

বাঁকুড়াতে দীলুদা

মাঝে বহুদিন দীলুদার সাথে আর দেখা সাক্ষাৎ নেই তবে যোগাযোগ ছিলোই। দীলুদা এখন খুবই ব্যস্ত হেভি ট্রাক ড্রাইভিং এ।

সে ট্রাক নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সব জেলা শহর চষে বেড়ায়। ট্রাকে করে রেফ্রিজারেটর ডিস্ট্রিবিউটরদের কলকাতা গোডাউন থেকে মাল নিয়ে জেলায় জেলায় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে সময় মতো পৌঁছে দিলেই

দীলুদার রুটি রুজি জোগায়।

আমি তখন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে একটা কাজ নিয়ে দিন কয়েকের জন্য গেছি। সকালের দিকে বাড়ির কাছাকাছি একটা দোকানে প্রাতঃরাশ করতে ঢুকে খাওয়ার অর্ডার করে এক কাপ গরম জানিয়ে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি। হঠাৎই দেখি আমার নাম ধরে কে যেন ডাকছে। চোখ তুলে দেখি দীলুদা। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। বলে উঠলাম “আরে, দীলুদা কতোদিন বাদে দেখা বলো! এসো বোসো বোসো।”দীলুদা বসলো উল্টোদিকে আমার ঠিক মুখোমুখি। একথা

সেকথার পর দীলুদা বললো বললো “হ্যাঁরে তোর সেই কাঁচা বাঁশের কাহিনী মনে আছে মামুদপুর যাওয়ার রাস্তায় সেই বটগাছওলা জঙ্গলে?”

উত্তরে বললাম “তা আর মনে থাকবে না দীলুদা। ওই ঘটনা আমি সারা জীবন মনে রাখব চোখের সামনে যেভাবে একটা বাঁশকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখলাম তা কি কখনো ভোলা যায় নাকি!”

দীলুদ এবার বলতে শুরু করলো কলকাতা থেকে মাল নিয়ে পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল সে বাঁকুড়ার একটা শোরুমে। এইসব হেভি ট্রাকগুলো রাতের দিকেই চলে। দীলুদার প্রাকো হাইওয়ে দিয়ে প্রায় আশি কিলোমিটার বেগে ছুটছে তখন। হঠাৎ দীলুদার চোখে পড়লো একটা লোক রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত দেখাচ্ছে। রুবেল ট্রাক থামিয়ে লোকটাকে তুলে নিল গাড়িতে। গাড়িতে দীলুদার সাথে ওর হেল্পার কেষ্টাও ছিলো সে রাতে। যাই হোক দীলুদা গাড়ি চালাচ্ছে আর ওপাশ সেই লোকটা জানালার পাশে বসে আছে ওদের মাঝখানে সিটের উপর কেষ্টা শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে আর নাক ডাকছে। যখন বাদে মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হোলো। সময়টা ছিলো শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি।

কিছুক্ষণ চলার পর ট্রাকের ওয়াইপার বিকল হয়ে জল সাফ্ করার কাজ বন্ধ করে দিলো। দীলুদা গাড়ির গতি কমিয়ে একটু আস্তেই ড্রাইভ করছিলো তখন। এবার কিছুক্ষণ বাদে, দীলুদার চোখ ছানাবড়া হোলো যখন সে দেখল ওই লোকটা জানালার পাশে বসে দীলুদার পিছন দিয়ে হাত গলিয়ে গাড়ির কাঁচ পরিষ্কার করছে। এবার দীলুদা, হকচকিয়ে গিয়ে ড্রাইভিং বন্ধ করে রাস্তার এক পাশে ট্রাক দাঁড় করিয়ে দিয়ে লোকটার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে রইলো।

তখন সেই লোকটা বলে উঠলো “তুমি ভয় পেয়ো না আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। আমিও তোমার মতোই মানুষ ছিলাম। আমারও তোমাদের মত একটা বউ আর একটা ছোট ছেলে আছে। ওরা দুর্গাপুরে থাকে। আজ আমি দুর্গাপুর থেকে গাড়ি নিয়ে বাঁকুড়া যাচ্ছিলাম পথে আমার গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পরে আমার মৃত্যু হয়েছে। একটু সামনে কবর ডাঙ্গার কাছে ঠিক প্রতাপ বাবুর বাগানের সামনে আমার দেহটা এখনো পড়ে আছে ।দুর্গাপুরের বেনাচিটি মার্কেট এর কাছেই আমার বাড়ি” বলে লোকটা তার ঠিকানা দীলুদাকে বলেছিলো সেই মাঝ রাত্তিরে। আরও বলেছিল “তুমি বাড়িতে আমার পরিবারকে খবর দিও আর আমার দেহটাকে সৎকার করার ব্যবস্থা কোরো।”

আর এই কথা বলার পরেই দীলুদা দেখলো লোকটা তার সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে জানালার পাশের সিটটা ফাঁকা। দীলুদা কেষ্টাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। পাঁচ কিলোমিটার মতো গাড়ি চালিয়ে দীলুদা

দেখেছিল প্রতাপ বাবুর বাগানের সদর দরজার কাছে একটা লোকের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে একটা দুমড়ে যাওয়া ক্যাবের ডাইভারের সিটে। এই ঘটনাটা গোগলাসে শোনার পর আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিলো। আর চোখ বড় বড় করে সামনে বসা দীলুদার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম আমি। সত্যি অবিশ্বাস্য এরকম ঘটনা আজও ঘটে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুক্তিবাদী অবিশ্বাসের যুগেও। যুক্তিতে যার ব্যাখ্যা মেলেনা।

শেয়ানে শেয়ানে

শুরুর কথা

সব কাহিনীরই একটা শুরু থাকে। এই কাহিনীর শুরুতেই চাঁপা ডাঙ্গার সম্বন্ধে কিছু কথা বলা যাক্। চাঁপা ডাঙ্গা হোলো হুগলি জেলার দামোদর নদের পাড়ে আভিজাত্যময় একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এই চাঁপা ডাঙ্গা নিয়ে বহু গল্পকাহিনী প্রচলিত আছে। চাঁপা ডাঙ্গা তারকেশ্বর থেকে আট কিলোমিটার পশ্চিমে।

বর্তমানে এটি একটি মফঃস্বল শহরে উন্নত হয়েছে। শহরের মোটামুটি সব রকম সুযোগ-সুবিধায় এখানে আছে। এই চাঁপা ডাঙ্গার একটি বিখ্যাত অতীত স্মৃতি হোলো রায় ভিলা। এই রায়গুলাকে কেন্দ্র করে কয়েকশো বছরের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের কথা আজও লোক কথায় বাতাসে ভেসে বেড়ায়। চাঁপা ডাঙ্গার এই রায় ভিলা দামোদর নদের পাড়ে বর্তমান শহরের এক প্রান্তে আজও স্ব মহিমায় নিজের পরিচয় বহন করে চলেছে। কৌলিন্য যদিও আছে সেই রায় ভিলার কিন্তু দেখাশোনার অভাবে সেদিনের সেই বাগান ঘেরা ভিলা আজ পোড়ো বাড়ির চেহারা নিয়েছে। ‌

শোনা যায় সেই রায় জমিদারদের বংশধর বলতে কেউ নেই আজ আর থাকলেও তারা বহুকাল এ পথ মাড়ায়নি। তাই এই বাড়িকে হানা বাড়িও বলা হয়ে থাকে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই এদিকটা শুনশান হয়ে এক পান্ডব বর্জিত এলাকার রূপ নেয়। স্থানীয় মানুষরা সন্ধ্যার পর এদিকটা এড়িয়ে চলেন। ইদানিং কারো কারো চোখে পড়েছে একটু রাতের দিকে নাকি ওই রায় ভিলার একটি ঘরে টিমটিম করে আলো জ্বলতে দেখা যায়। ইদানিং স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় সুধাংশু রায় নাম দিয়ে প্রত্যেক রবিবার করে কেউ বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। স্থানীয় মানুষরা মনে করেছেন হয়তোবা রায় জমিদার বংশেরই কেউ ঐ বাড়িতে ফিরে এসেছেন। তবে তার খোঁজ করতে অবশ্য আজ অব্দি যেচে কাউকে যেতে দেখা যায়নি।

নতুন ভাড়াটিয়া

একদিন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। রাতের তৈয়ারি সবে শুরু হয়েছে। রায় ভিলায় এক মাঝ বয়সি মহিলাকে ঢুকতে দেখা গেল। কলিং বেল বাজাতেই ষাটোর্ধ্ব ভদ্রলোক মানুষের দরজা খুলে দিলেন এবং সাদর অভ্যর্থনা করে ভেতরে তাকে ঘর দেখাতে নিয়ে গেলেন। ভদ্র মহিলার মুখ দেখে সুধাংশু বাবুর মনে হোলো “যাক্ এতদিন বাদে যাহোক একটা হিল্লে হোলো তাহ’লে। এবার পরিচয়ের পালা। উনি বর্ধমানের বাসিন্দা নাম সুমিত্রা ঘোষ। কাছেই একটা স্কুলের বদলি হয়ে এসেছেন তাই তাঁর স্কুলের কাছাকাছি একটু নিরিবিলিতে একটা ভালো বাড়ির খোঁজ করছেন। উনি জানালেন ঘর তার পছন্দ হয়েছে। তারপর শুরু হলো দু’জনের আলাপচারিতা। এই যেমন সুধাংশু বাবু কি করেন বাড়িতে আর কে কে থাকে এইসব আর কি।

এসব কথার মাঝে হঠাৎ সুমিত্রা দেবী বলে উঠলেন “আপনার ঘরটা কি কেউ ঝাড় পোঁছ করে না। ধুলোর আস্তরণ যে পড়েছে খেয়াল করেনি আপনি?” উত্তরে সুধাংশু রায় বললেন আসলে উনি এই বাড়িটা ভাড়া দেয়া নিয়ে একটু ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই এইসব বিষয়ে খেয়াল করেননি। তাছাড়া তিনি নিজের কাজ নিজে করতেই বেশি পছন্দ

করেন। কাজের লোক রাখা তিনি পছন্দ করেন না। আর এই ভাড়ার বিজ্ঞাপন দিয়ে এতই অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন যে ভেবেছিলেন এই ঘরের ভাড়াটিয়া বোধ হয় আর পাওয়াই যাবে না। কেননা প্রায় ছয় মাস কেটে গেছে বিজ্ঞাপন দিতে দিতে। আজ সুমিত্রা দেবীই

প্রথম ভাড়াটিয়া হয়ে এলেন। এবার সব কাজে তিনি মন লাগাতে পারবেন।

তখন সুমিত্রা দেবী হঠাৎ বলে উঠলেন আরে আপনার তো দেখছি পায়ের পাতাটা ওপর দিকে আর আপনার তো ছায়াও পরছে না। তখন সুধাংশু বাবু একটু জোরে হেসে বলে উঠলেন”কেন আপনি কি খুব ভয় পেলেন

না কি সুমিত্রা ম্যাডাম?”

তখন হালকা হেসে সুমিত্রা দেবী এক কথায় ছোট্ট উত্তর দিলেন “আমার আবার আপনাকে ভয় লাগতে যাবে কেন?ও রায় মশাই আমিও যে আপনারই মতন।”

শেয়ানে শেয়ানে আর কাকে বলা যায় এবার পাঠকই বলুন দেখি।

বিদেহী আত্মা

শুরুর কথা

অনিল বাবু মানে অনিল ঘোষ ভারতীয় রেলে কাজ করতেন। চাকরির কারণে অনিল বাবুর প্রায় সারাটা জীবনই কেটে গেছে বাংলার বাইরে। চাকরির প্রথমদিকে অনিল বাবু কয়েক বছর সাঁতারাগাছির রেল কোয়ার্টার্সে থাকতেন। তারপর কখনও নাগপুর কখনও চক্রধরপুর অথবা বিশাখাপত্তনম এইসব বহু জায়গায় চাকরি সূত্রে বদলি হয়েছেন তিনি। বর্তমানে অনিলবাবু চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। পর এখন বারুইপুর স্টেশনের কাছে উনি পরিবার নিয়ে আছেন তারপরে বছর পাঁচেক হয়ে গেছে। অনিল বাবুর চারমেয়ে ও এক ছেলে। দু’মেয়ের বিয়ে আগেই হয়ে গেছে। রুমে মনিকার জন্য অনিলবাবু সুপাত্রের খোঁজ করছেন। ছেলে অমল এখন বিএসসি র তৃতীয় বর্ষের পরে। অনিল বাবুর বিশেষ চিন্তা হোলো অবিবাহিতা দুই মেয়েকে পাত্রস্থ করার বিষয়ে।

প্রায়ই তিনি কথায় কথায় বলেন “মণিকা আর তুলিকাকে পাত্রস্থ না করতে পারলে আমি যে মরেও শান্তি পাবো না।”

আর তখনই অনিল বাবুর স্ত্রী সর্বাণী দেবী বলে ওঠেন “এইসব অলুক্ষণে কথা বলতে নেই।”এরকম করেই দিন কেটে যাচ্ছিল তার নিজের গতিতে। কারণ সময় এবং নদী থেমে থাকতে জানে না যে।

তবে পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে মনিকাই ছিল অনিল বাবুর সবচেয়ে প্রিয়। মনিকা কে অনিলবাবু “মানি” বলে ডাকতেন। ওকে যেন তিনি চোখে হারাতেন।

এরপর হঠাৎ একদিন রাতে অনিল বাবুর হঠাতই হার্ট অ্যাটাক হলো। সর্বাণী দেবী তার সামর্থ্য মতো নার্সিংহোমে ভর্তি করে অনিল বাবুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। তবুও শেষ রক্ষা হোলো না। তিন চার দিন যমে মানুষে টানাটানির পর অনিলবাবু না ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন। এবার অনিল বাবুর শেষ কাজ সম্পন্ন করে সর্বাণী দেবী অনিল বাবুর অসমাপ্ত কাজ অর্থাৎ মণিকার জন্য সুপাত্র খুঁজতে শুরু করলেন। চেনা জানা মানুষদের বলা থেকে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া সহ চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি তিনি। এমনি করে প্রায় দুটো বছর কেটে গেলো।

যতকাণ্ড পানভেলে

হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে সর্বাণী দেবী এক সুপাত্রের খোঁজ পেলেন। নাম প্রদীপ দাস। মুম্বাইতে একটা প্রাইভেট ইস্পাত কারখানায় ফ্যাক্টরি ম্যানেজারের পদে চাকরি করে সেই ছেলে। সর্বাণী দেবী আর কাল বিলম্ব না করে প্রদীপ আর মণিকার চার হাত এক করে দিলেন। বিয়ের পর ওরা এসে উঠলো পানভেলের কোম্পানি আবাসনে। পানভেল মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার একটা ছোট্ট শহর। এই ঘটনা আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের। পানভেল তখন ধীরে ধীরে সেজে উঠছে আর কি! সেখানে তখন ভারতবর্ষের সব রকম প্রদেশের মানুষের

বাস। কারণ আরো অন্য কোম্পানিতে কর্মরত মানুষদের থাকার ব্যবস্থাও পানভেলেই ছিলো।

প্রদীপের স্টীল প্ল্যান্টটা পানভেল থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে মহারাষ্ট্রের পেন জেলার ওয়াঢ়কালে। তাই প্রতিদিন প্রদীপকে সকাল সাতটার মধ্যে কোম্পানির গাড়িতে বেরিয়ে পড়তে হোতো কারণ সকাল ন'টায় ছিল রিপোর্টিং টাইম। আর ছুটি হোতো সেই সন্ধ্যে ছ’টায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কখনও রাত সাড়ে সাতটা অথবা কোন কোনো দিন

রাত আটটাও হয়ে যেতো। ফেরার পথে রাস্তায় কি রকম যানজট হবে সেই হিসেবে বাড়িতে ফিরে আসা নির্ভর করতো। তাই সারাদিন মণিকাকে টিভি দেখে আর বাংলা গান শুনে অথবা কখনো কখনো পাশের ফ্ল্যাটের বাঙালি বৌদির সাথে গল্প গুজব করেই এই লম্বা সময়টা কাটাতে হোতো। সকালে সাড়ে সাতটার সময় প্রদীপ ডিউটিতে বেরিয়ে গেলে মনিকাও আর এক প্রস্থ ঘুমিয়ে নিতো।আর ঠিক সকাল সাড়ে আটটার সময়

কলিংবেল বাজিয়ে দুধওয়ালা দুধের প্যাকেট দিয়ে যেতো। কখনো দরজা না খুললে দুধওয়ালা একটা ব্যাগের ভেতর দুধ রেখে কলিংবেল বাজিয়ে দরজায় ঝুলিয়ে রেখে যেতো।

সেদিনও প্রদীপ ডিউটিতে বেরিয়ে যাবার পর মনিকার চোখটা একটু লেগে এসেছিল। তাই দুধ ওয়ালা কলিং বেল বাজালেও মণিকা দরজা খুলেছিলো অনেকটা সময় বাদে। আর দরজা খুলেই ওর নজরে পড়েছিল দুধের প্যাকেট মাটিতে পড়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের সামনেটায় সাদা দুধে ভেসে গেছে। তড়িঘড়ি মণিকা প্রথমে দরজার সামনেটা পরিষ্কার করে নিয়েছিলো সেদিন।

প্রদীপ বাড়ি ফিরে আসলে ওর কানে যখন সমস্ত ঘটনা গেল তখন সে মণিকাকে দু’চার কথা শুনেয়েছিলো সে রাতে। রেগে নয় শান্তভাবেই বলেছিল সেসব কথা প্রদীপ মণিকাকে।

তবুও মণিকা একটু চাঁপা কষ্ট পেয়েছিল সে রাতে। পরের দিন প্রদীপ ডিউটিতে বেড়িয়ে যাবার পর যখন সেই দুধ ওয়ালা কলিংবেল বাজালো তখনও মণিকার চোখ দুটো আগের দিনের মতোই লেগে এসেছিলো। কিন্তু সেদিন কলিংবেল বাজতেই মণিকা স্পষ্ট শুনতে পেলো যেন ওর বাবা মানে অনিলবাবু বলছেন “মানিমা দুধ এসেছে দুধ নিয়ে নে।”এমনকি মণিকা ওর গায়ে অনিল বাবুর হাতের স্পর্শও ঘুমের ঘোরে অনুভব করেছিলো সেদিন।

এরকম ঘটনা তখন প্রায়ই ঘটতে লাগলো। এমনকি মণিকার মাঝে মাঝে মনে হোতো ওর পেছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে ওকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। কিছুদিন যাবার পর মণিকা

কথায় কথায় ওর মা সর্বাণী দেবীকে ব্যাপারটা বিস্তারে জানায়। উনি সব শুনে বলেন “শোন্ তুই কোন ভয় পাস্ না যেন। আসলে তুই তোর বাবার সবচেয়ে কাছের ছিলিস্ আর তোকে উনি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তাই উনি তোকে রক্ষা করছেন। শোন্ যদি ভয় ভয় লাগে তুই ঠাকুরের নাম স্তব করিস দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।”মায়ের কথা শুনে মণিকা এবার নাম জপ করা শুরু করে দিলো। এরপর একদিন মণিকার নজরে পড়লো ওর ওপরে সিলিং এর দিকটা হঠাৎ গাঢ় ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে এবং মিনিট পাঁচেক বাদে সেই ধোঁয়া নিজের থেকেই পরিষ্কার হয়ে গেলো। তারপর থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো মণিকার জীবনে। এরই নাম অপত্য স্নেহ যে স্নেহ মৃত বাবাকেও তার মেয়েকে অদৃশ্য থেকে সুরক্ষা দেওয়ায়।

অতৃপ্ত আত্মা

আমার বন্ধু অমিতের শ্বশুর বাড়ি দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে পায়ে হেঁটে ঠিক দশ মিনিট দূরে। খুব বেশি হ’লে এক থেকে দেড় কিলোমিটার হ’বে। জায়গাটা আধো শহর বলা চলে। ভেতর দিকটায় গাছগাছালি ঘেরা ছোট ছোট বাঁশ ঝাড়ও চোখে পড়ে একটু খেয়াল করলে। অমিতের শালাবাবু বাপী তখন সবেমাত্র নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা করে সার্ভেয়ার এর চাকরি করছে। বাপীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোলো বাবলা। সে ও ওই একই পাড়ায় থাকে। ওরা দু’জন খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাবলা আকাউন্টেন্সি অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশন করে কস্ট একাউন্টেটসির ফাইনাল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

একদিন বাবলা দুপুরের দিকে আড্ডা মারতে মারতে বলল “জানিস্ বাপী... আমার পাশের বাড়ির মেসোমশাই বল্লেন যে তিনি নাকি একদিন গভীর রাতে ওই শীতলা মন্দিরের রাস্তায় আসছিলেন কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার পথে। সেদিন ট্রেনের গোলমালে উনার পিঠতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। উনি নাকি শীতলা মন্দিরের পাশ দিয়ে কালভার্টের গা ঘেঁষে যে মেঠো রাস্তাটা বাঁশঝাড়ের দিকে গেছে সেই পথে একজন সাদা কাপড় পরা মেয়েমানুষকে যেতে

দেখেছেন। তবে সেই মেয়ে তার কোন ক্ষতি করেনি। কিন্তু ওনার মনে একটা রহস্য তৈরি হয়েছে সেদিন থেকে। একটু পরেই তিনি লক্ষ্য করেছেন সেই সাদা কাপড় পরা মেয়েটি ধীরে ধীরে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল ও তারপর সে ভোজবাজির মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো। তাকে উনি আর দেখতে পাননি। তারপরেও অনেকের কাছেই সেই মেয়ে মানুষটির কথা শোনা গেছে।

এ কথা শুনে অমিতের শালাবাবু বাপী বলে উঠলো “তা’হলে আজ রাতেই হয়ে যাক্। আমি আর তুই আজ রাত এগারোটা নাগাদ ওই মানুষটাকে দেখতে যাবো।”

ঠিক রাত এগারোটায় বাপী আর বাবলা দুই বন্ধু গিয়ে শীতলা মন্দিরের পাশের রাস্তার কালভার্টের উপর বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। বারোটা বেজে গেলো সাড়ে বারোটাও বাজলো তবুও কারুর দেখা নেই। এদিকে ওরা দুই বন্ধু মিলে সব বান্ডিল বিড়ি শেষ করে দিয়েছে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ওদের চোখে পড়ল একটা সাদা কাপড় পরা মেয়ে যার মুখ খানা শুধু দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে ওদের দিকে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে। কিছুটা আসতেই বোঝা গেল সেই মেয়ে মৃদু হাসছে।

এই দেখে তো দুই বন্ধুর পিলের চমকে গেছে ততক্ষণে। বাপী আর বাবলা দু’জন দুজনের হাত ধরে কাঠ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে ছিল

সেই মাঝ রাত্তিরে। তবে সেই সাদা কাপড় পরা মেয়েটি সেদিন ওদের দু’জনকে কিচ্ছুটি না বলে রাস্তা দিয়ে একটু এগিয়ে চুপচাপ সামনের বাঁশ ঝাড়ের কাছাকাছি গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলো সেই রাতে। ওদের কাছে সেই ঘটনা শুনে পাড়ার আরো দু’জন ছেলে গভীর রাতে কালভার্টে বসে সেই সাদা কাপড় পরা মেয়েটিকে দেখেছিল এবং যথারীতি ওদের কোন ক্ষতিই করেনি সেই মেয়ে।

শোনা যায় প্রেমে ধোঁকা খেয়ে সেই মেয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। তাঁর সেই অতৃপ্ত তাই দেখা যেত গভীর রাতের আঁধারে।

পিছু ডাক

অমিত দে আমার পুরোনো কলিগ ওদের বাড়ী সোনারপুর স্টেশন থেকে একটু দূরে। ও বাড়ীর বড় ছেলে। ছোটোবেলায় ও যখন কলেজে পড়ে সেই সময়ের ঘটনা এটা। তাও হ’বে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগের ঘটনা। সেই সময়ের সোনারপুরকে প্রত্যন্ত অঞ্চলই বলা চলে। সন্ধ্যের পর রাস্তাঘাট সব শুনশান হয়ে আসতো বিশেষ করে ষ্টেশন থেকে ওদের বাড়িতে আসার রাস্তাটা একদমই নির্জন ছিলো। দিনের বেলাতেই ওই রাস্তায় লোক চলাচল ছিলোনা বললেই চলে। অমিতের বাবা মিলিটারিতে সিভিলিয়নের চাকরি করতেন মানে মিলিটারি অফিস ওয়ার্ক আর কি। তাই অমিতের বাবা খুব কমই বাড়িতে আসতেন। বছরে উনি একবার ছুটিতে আসতেন। চাকরির সুবাদে উনি কখনও লক্ষ্ণৌতে বা কখনো সেকেন্দ্রাবাদ অথবা পুনেতে থেখেছেন মানে যেখানে মিলিটারি অফিস আছে সেখানে ওনার পোস্টিং হোতো।

আর অমিত বাড়ির বড় ছেলে। বাড়ির বাজার হাট কেনাকাটা সব অমিতকেই করতে হতো।

সেই সময় অমিতের বাবা লক্ষ্ণৌতে বদলি হয়ে গেছেন। অমিত একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে বাড়ির জন্য বাজার কিনে হাতে মাছের থলে নিয়ে রেল লাইনের পাশ দিয়ে শর্টকাট পথটাই বেছেছিলো কারণ ওই রাস্তায় গেলে প্রায় মিনিট কুড়ি সময় বেঁচে যায়। অমিত রেললাইন বরাবর মাঝামাঝি পেরোনোর পর হঠাৎ শুনতে পেলো “আমাকে মাছ দে, আমাকে মাছ দিবি না” বলতে বলতে কেউ যেন ওর পেছন পেছন আসছে। তখন অমিত ডাকাবুকো ছেলে ভয়ডর বড় একটা পায় না সে। ও একবার পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলো কে বলছে কথাটা। তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। অথচ যখনই ও চলা শুরু করছে তখনই পেছন পেছন ওরকম বলতে বলতে কেউ এগোচ্ছে সেটা ও বেশ বুঝতে পারছিলো তখন। তবে অমিত ভয় না পেয়ে রেললাইনের ধারের ওই পথটুকু পার হয়ে যেই বাড়ির রাস্তায় পা বাড়িয়েছে সেই আওয়াজ আর কানে আসেনি তার।

ওরে স্থানীয়দের কাছ থেকে অমিত জানতে পেরেছিল ওখানে রেললাইনে চলন্ত ট্রেনে ঝাঁপ দিয়ে কেউ আত্মহত্যা করেছিল সেই অতৃপ্ত আত্মা নাকি ওরকম ভাবে পেছন থেকে মানুষকে ডাকে। সে কারণেই স্থানীয়রা ও পথ এড়িয়ে চলে। অমিতের মা এসব শুনে ওকে বারণ করে দিয়েছিলেন ওই পথ না মারাতে।

কিন্তু অমিতের তখন যৌবনের যোশ আর সাহসী মন। ও সেই রাস্তায় ব্যবহার করত কাছেই ওর দিদির বাড়ি যাবার পথে। আর সেই কারণে যখনই ওর মা আমিষ খাবার ওর হাত দিয়ে পাঠাতেন উনি ওই খাবারের কৌটোর উপর কাঁচা লবণ ছড়িয়ে দিতেন। লবণ ছড়ালে নাকি এইসব অতৃপ্ত আত্মারা

কাছে ঘেঁষে না। সত্যি কতো কিছুই যে ঘটে!

কায়ার মায়া

ভবিষ্যৎ চিন্তা

এই কাহিনীর সময়কাল প্রায় বছর চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ আগে। অমিয় গুপ্ত বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন থেকে ইলেকট্রনিক্সে ডিপ্লোমা করে এয়ারপোর্ট এর মেইনটেনেন্স বিভাগে জয়েন করেছিলেন। সেও প্রায় বছর ত্রিশেক হয়ে গেছে। প্রমোশন পেয়ে অমিয় বাবু সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। বছর দশেক আগে মানে ১৯৬৫ কাছাকাছি সময়ে অমিয় বাবু এয়ারপোর্ট এর কাছেই একটি দোতলা বাড়ি করে এখানে পরিবার নিয়ে সংসার পেতে বসেছেন। অমিয় বাবুর ভরা সংসার,ওনার দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিপ্লোমা কোর্সে সবে ঢুকেছে। তাই অমিয়বাবু সবসময় চিন্তায় থাকেন ওঁর অবর্তমানে সংসারের কি হাল হ’বে এইসব আকাশ পাতাল ভেবে।

আর উনার সবচেয়ে প্রিয় বসার জায়গা হোলো দোতলার ঘরে জানালার পাশে শোয়ার কাঠের বিছানার একটা নির্দিষ্ট কোনে। যেখান থেকে বাইরের রাস্তাঘাট সব পরিষ্কার দেখা যায়। উনি আবার লোকজনের সাথে ফারুক পক্ষে মেলামেশা করতে পছন্দ করেন না। তাই কাজের জায়গা থেকে ফেরার পথে একবারে

বাজার নিয়ে সেই যে বাড়িতে ঢুকতেন আর বেরোতেন না বেশিরভাগ সময়টাই তিনি বিছানার উপর জানলার ধারে বসে থাকতে না আর ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতেন। মেয়ে দুটোর বিয়ে দিতে হবে। দুটো পাশ করে কি করবে কে জানে?

চাকরির যেরকম আকাল ওদের ভবিষ্যৎ কি যে হ’বে সেই সব ভেবেই উনি কূল কিনারা পেতেন না। মেয়েদের জন্য সৎ পাত্রস্থ করার চিন্তায় তিনি সারাক্ষণ দুঃশ্চিন্তায় থাকতেন আর ওই বিশেষ জায়গায় বসে জানালা দিয়ে রাস্তা দেখতেন। এমনি করেই দিন কেটে যাচ্ছিল অমিয় বাবুর।

মায়ার সংসার

এদিকে অমিয়বাবুর এইসব দুঃশ্চিন্তা ও আকাশ-পাতাল ভাবার কারণে ওর মনের উপর অস্বাভাবিক চাপ পড়ছিল। আর বসে থাকার ফলে ওনার কিডনির সমস্যা ধরা পড়লো। মেডিকেল চেকআপের পর ওনার উনার কিডনি অপারেশন হয়েছিলো। অপারেশনের পর হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে এসে মাসখানেক সুস্থই ছিলেন তিনি। কিন্তু একদিন হঠাৎ বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় দিলেন না অমিয় বাবু। তিনি চলে গেলন নিজের দায়িত্ব অসম্পূর্ণ রেখে না ফেরার দেশে। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না সময় বয়ে চলল তার নিজের ছন্দে। একদিন অয়ন মানে অমিয় বাবুর বড় ছেলের সহপাঠী কমল ওদের বাড়িতে এসেছে। সবে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। অয়ন বন্ধু কমল কে বললো “তুই ওপরের ঘরে গিয়ে বোস আমি একটু নীচ থেকে জল তুলে ওপরে যাচ্ছি।” কারণ তখন বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বাড়িতে এখনকার মতো জল তোলার জন্য পাম্পের ব্যবস্থা ছিলো না। এ কথার পর কমল দোতলার ঘরে সবেমাত্র ঢুকতে যাবে তখন সে দেখে বিছানায় জানালার পাশে একটা লোক বসে আছে দেখতে অবিকল অমিয়বাবুর মতন। কারণ একই পাড়ার মানুষ হিসেবে কমল অমীবাবুকে দেখেছে যখন তিনি বেঁচে ছিলেন। তারপর যেই কমল ঘরে ঢুকতে যাবে ও দেখল অমিয়বাবু ধীরে পাশের জানলা দিয়ে বেরিয়ে হাওয়ায় উড়ে গেলেন। এই দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে কমল এক নিঃশ্বাসে নীচে নেমে এলো এবং ও যা দেখেছে বিস্তারিত ভাবে অয়নকে বলে সেই যে অমিয়বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলো আর জীবনে কোনদিন ওমুখো হয়নি।

আসলে সংসারের উপর অমিয় বাবুর একটা আকর্ষণ বা গভীর টান ছিলো তাই মৃত্যুর পরও সেই টান বা আকর্ষণের রেশ রয়ে গিয়েছিলো তাঁর। বেশ কিছুদিন বাদে অয়ন অমিবাবুর নামে গয়ায় গিয়ে পিন্ড দান করে এসেছিলো শান্তি স্বস্তয়ন করে। তারপর থেকে ঐরকম ঘটনা আর ঘটেনি। কায়ার মায়া বোধহয় একেই বলে।

প্রতিশোধ

উচ্চাকাঙ্ক্ষা

এই কাহিনীর প্রেক্ষাপট আজ থেকে বছর বিশেক আগে। কাহিনীর পটভূমি আইআইএম জোকা। এই আইআইএম জোকা ভারতবর্ষের এমবিএ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে অগ্রগন্য।

কুহেলীদের বাড়ি ওই জোকার কাছাকাছি বেহালা ক্যান্টনমেন্টের যদু কলোনীতে। কুহেলী অ্যাকাউন্ট্যান্সী নিয়ে বিএ পাশ করেছে লরেটো কলেজ থেকে। ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে শ্বসন মানে বি.এ পাস করেছে সে। ওর লক্ষ্য ছিলো স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করে জোকাতে এমবিএ পড়বে। ও বসেছিল এমবিএর কমোন এডমিশন(ক্যাট) টেস্টে।

এখানেও কুহেলী একবারই উত্তীর্ণ হয়ে ফাইনান্স নিয়ে এমবিএ কোর্সে জোকাতে ভর্তি হয়েছে। তবে বেহালাতে বাড়ি হ’লেও কুহেলী কে জোকার হোস্টেলে থাকতে হোতো। কারণ জোকা একটি আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভালোই চলছিলো কুহেলীর পড়াশোনা। এর মাঝেই ওর আলাপ হয়েছিলো ফাইনাল ইয়ারের প্রমিতের সাথে। প্রমিত খুবই বুদ্ধিমান ও মেধাবী ছেলে ওর বাড়ি আবার বালুরঘাটে।। প্রমিত যাদবপুর থেকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিটেক করার পর এমবিএ তে ভর্তি হয়েছে। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা আর ঘনিষ্ঠতা থেকে ওদের ভালোবাসা সূত্রপাত। কুহেলী প্রমিতকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওর মা-বাবার সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। ‌ ওরা ঠিক করেছিল দুজনেই পাশ করে চাকরিতে একটু সেটল হয়ে বিয়েটা ফেলবে। তখন কুহেলী প্রথম বছরের পাট সবে শেষ করে দ্বিতীয় বর্ষে উঠবে। তবে প্রমিত ইতিমধ্যেই ফাইনাল পরীক্ষা পাশ করে একটা ভালো প্লেসমেন্ট্ পেয়ে গেছে। তবে সেই চাকরির প্রাথমিক শর্ত ছিলো ইউএস যেতে হবে এবং চাকরির সময়কালের তিন বছরের মধ্যে বিয়ে করা চলবে না। তবে প্রমিত তার নিজের উজ্জল ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেই বন্ডে সই করে কুহেলিকে কিচ্ছু না

জানিয়েই। পরে যখন প্রমিত কুহেলীকে বোঝাতে চেষ্টা করে তখন কুহেলী ওকে পরামর্শ দেয় ওই চাকরিতে জয়েন না করতে। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে তুমি ওই চাকরিতে জয়েন করে এবং কুহেলি অনেক বারণ করা সত্বেও

ইউএসএর ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যায় সে।

কুহেলী মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। একদিন সময় সুযোগ বুঝে কাছাকাছি একটা লেকের কাছে গিয়ে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে কুহেলী। ভাগ্যক্রমে তখন নীলাভ যে পেশার ফটোগ্রাফার ওখানে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভিডিও শুট করছিলো। নীলাভ ই

কুহেলী কে ওই অবস্থা থেকে প্রাণে রক্ষা করে। নীলাভ কুহেলীর থেকে প্রায় বছর দশকের বড়। নীলাভ তাকে আত্মহত্যার কারণ জানতে চাইলে কুহেলী ওকে সবকিছু খুলে জানায়। নীলাভ কূহেলীকে

অস্বস্ত করে যে সে ওকে জীবনে এগিয়ে চলার পথে সবসময় সাথে থাকবে। এরপর ওদের ঘনিষ্ঠতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং কুহেলী ও নীলাভর বিয়েও হয়ে যায় ওদের মা বাবার সম্মতি নিয়ে।

জিঘাংসা

এমবিএ ফাইনাল পরীক্ষাও কুহেলী কৃতিত্বের সাথেই পাশ করে এবং একটা এমএনজিতে ভালো অফার নিয়ে ম্যানেজমেন্ট পোস্টে জয়েন করে। কুহেলীর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ আবার এইভাবে ফিরে আসে। কিন্তু সেই সুখ ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ কুহেলী যে কোম্পানিতে কাজ করতো সেই কোম্পানিতে ইউএস থেকে প্রমিত জয়েন করে ভারতবর্ষে চলে আসে সিইওর দায়িত্বভার নিয়ে। প্রথম দিন যখন প্রমিত অফিসে আসে ওর সাথে দেখা করার জন্য স্টাফদের ভিড় লেগে যায়। ওই ভিড় ঠেলে কুহেলী আর সিইওর সাথে দেখা করতে পারেনি সেদিন। দিন দু’য়েক বাদে একটু ফাঁকায় ফাঁকায় কুহেলী সিইওর ঘরে যায় দেখা করতে। তখন পর্যন্ত ও জানতো না যে এই সিইও ওরই প্রাক্তন প্রেমিক

প্রমিত। প্রমিতকে দেখেই কুহেলী বাইরে আসার জন্য পা বাড়ায়। আর চেয়ার থেকে উঠে এসে প্রমিত ওর পথ আগলে দাঁড়ায়। তখন কুহেলী শান্ত ভাবে বলে “দেখো তুমি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার পর আমার নীলাভর সাথে বিয়ে হয়ে গেছে। এখন আমি বিবাহিতা আমার কথা তুমি ভুলে যাও এখন আমি নীলাভ র বিবাহিত স্ত্রী। যেতে দাও তুমি আমাকে।”

তখনকার মতো যেতে দিলেও প্রমিত কারণে অকারণে ওকে ডেকে পাঠাতো একান্তে কথা বলার জন্য। কুহলী এতে বেশ বিরক্তই হতো।

যাই হোক এরকম চলতে চলতে প্রমিত তার অফিসের বিশ্বস্ত তিন অ্যাসিস্ট্যান্ট অমিত, অমল আর প্রবালকে বিষয়টা বলে। একদিন ষড়যন্ত্র করে প্রমিত কুহেলী কে তার চেম্বারে ডেকে পাঠায়। যখন ওই তিনজন গোপনে অপেক্ষা করছিলো। ওরা গোপনে কুহেলীর কিছু ছবি তুলে নেয় এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে বিকৃত করে ওইসব ছবি ছড়িয়ে দেয়। এসব ছবি নীলাভর চোখে পড়ে। সে যখন কুহেলীর কাছে জানতে চায় তখন কুহেলী ওকে সবকিছু খুলে বলে। কিন্তু নীলাভও কুহেলীর কথায় পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। ওর মনে কুহেলীর প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম হয়।

এতসব করেও যখন প্রমিত কুহেলীকে নিজের বশে আনতে পারছিলো না তখন সে ওকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে। সে তার তিন অ্যাসিস্ট্যান্ট এর সাথে শলা পরামর্শ করে অফিসের ড্রাইভার জগাকে বেশ কিছু টাকার বিনিময়ে কুহেলী কে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলার সুপারি দেয়। জগাও টাকা পেয়ে রাজি হয়ে যায় এবং একদিন যখন কুহেলী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল জগা তাকে ভয়ানকভাবে ধাক্কা দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই কুহেলী র মৃত্যু হয়। পুলিশ এসে নীলাভকে জেড়া করলে নীলাভ বলে “ঠিক হয়েছে এরকম চরিত্রহীন মেয়ে মরে যাওয়াই উচিত।”

পুলিশ ওকে ও কাউকে সন্দেহ করে কিনা জানতে চাইলে নীলাভ কোন উত্তর দেয় না। এমনি করেই কুহেলীর মার্ডার কেসা ধামাচাপা পড়ে যায়। কুহেলী র অতৃপ্ত আত্মা অদৃশ্য থেকে সবকিছুই নিরীক্ষণ করে।

ইতিমধ্যে কুহেলীর পোস্টে ওরই চেয়ারেএকটি নতুন ছেলে সিদ্ধার্থ জয়েন করে। সিদ্ধার্থ মাঝে মাঝে জলের গ্লাসে সদ্যমৃত কুহেলীর মুখ দেখতে পায়। আবার কখনো সিদ্ধার্থ অনুভব করে কেউ ওকে পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে চলে গেলো। একদিন তো ধাক্কার চোটে চেয়ার থেকে পড়েই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো সে। সেই ঘোরের অবস্থাতেই কুহেলীর অতৃপ্ত আত্মা সিদ্ধার্থ কে ওর মৃত্যুর কারণজানিয়েছিলো।

সিদ্ধার্থ বলেছিল ও কিভাবে কুহেলী কে সাহায্য করতে পারে। কুহেলী উত্তরে বলেছিলো “তোমাকে কিছুই করতে হ’বে না এবার আমিই সব করবো। তোমাকে শুধু সব জানিয়ে রাখলাম। তুমি যেন কোনো ভয় পেয়ো না আমাকে নিয়ে।”

প্রথমে কুহেলী ওই ড্রাইভার জগাকে ধরেছিলো এবং জোগাওকে জানাই প্রমিত এবং ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট তিন জনের ওকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রের কথা। সব জেনে অশরীরী কুহেলী একটা দড়ি দিয়ে জগাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়।

তারপর একদিন বিকেলে হঠাৎ ই কোম্পানির এমডি মিঃ কোহলি প্রমিত অমিত অমল ও প্রবালকে বিশেষ মিটিংয়ে ডেকে পাঠায় তার চেম্বারে। ওরা ঘরে ঢুকে দেখে এমডি সাহেব পেছন করে চেয়ারে বসে আছেন। ঢুকতেই চেম্বারের দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং তখন চেয়ার ভুলে যেতে পারে তাকে চেয়ারে বসে এমডি কোহলি সাহেব নয় বসে আছে কুহেলী। সে ওদের বলে “আমি আজ বদলা নিতে এসেছি তোমাদের একজন কেউ আজ ছাড়বো না। তোমাদের সব ষড়যন্ত্রের কথা ড্রাইভার জগার কাছ থেকে আমি জেনেছি। ওকে ফাঁসিতে লটকিয়ে দিয়ে এসেছি।এবার তোমাদেরও একই দশা করবো আমি।”

এই কথা বলে ওদের চারজনকে এক এক করে ফাঁসিতে লটকে দেয় কুহেলী এবং ওকে নির্মম খুনের বদলা নেয় কুহেলী। তারপর সে দেখা করে নিল আপুর সাথে এবং ওকে বলে “আমার কাজ আমি শেষ করেছি। তবে তোমার তো কোন দোষ নেই। তোমার আমি কোন ক্ষতি করবো না। তুমি এবার একটা বিয়ে করো। আমি বিদায় নিলাম।”

এটাই হলো কুহেলীর অশরীরী আত্মার ভয়ংকর জিঘাংসার কাহিনী।

অভিশপ্ত লেভেল ক্রসিং

এই কাহিনীও প্রায় বছর ত্রিশেক আগেকার। ঘটনাস্থল বিলাসপুর রায়পুরের মাঝে এক লেভেল ক্রসিং। অবিনাশ বাবু মানে অবিনাশ দিয়ে থাকুন গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে হেড টিটির ডিউটিতে ছিলেন বেশ কিছুদিন। উনি বেশ কয়েকবার ঘটনাটা লক্ষ্য করেছেন। সেই রাত ছিলো বর্ষণমুখর। আপ গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস সে রাতে রাত ঠিক দেখতে নাগাদ বিলাসপুর থেকে রায়পুরের দিকে ছুটছে। রায়পুর পৌঁছতে প্রায় পৌনে দু’ঘন্টা লাগে। রায়পুর স্টেশনের ঠিক আগে একটা লেভেল ক্রসিং এ ট্রেনটা সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ অবিনাশ বাবুর কানে এলো কেউ কামরার দরজায় ধাক্কা দিয়ে খুলতে বলছে। তিনি দরজা খুলতেই মাথায় ঘোমটা টানা একটি বিবাহিত যুবতী মেয়ে এক লাফে কামড়ায় উঠলো। অভিরাজ বাবু আর কি করেন ওকে একটা খালি সিট দেখে বসতে দিলেন। কিছুক্ষণ বাদে ট্রেন এসে রায়পুর স্টেশনে দাঁড়ালো। যাত্রীদের ওঠানামা শুরু হোলো। একটু বাদে ট্রেন ও

চলতে শুরু করলো। অভিনাশ বাবু এবার কামরার মধ্যে সেই মেয়েটির খোঁজ করলেন। সেই মেয়ের টিকিটিও খুঁজে পেলেন না তিনি। যেন সে উবে গেছে। এরকম ঘটনা আরো কয়েক বার করেছে ওই একই রুটে। পরে তিনি খোঁজ করে জানতে পেরেছেন সেই লেভেল ক্রসিং পার হতে গিয়ে এক কম বয়সী সদ্য বিবাহিতা মেয়ের ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর কথা।

অনেক মানুষ এইসব লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন থামলে ট্রেনে উঠে পড়তেন সেই সময় যাদের খুব প্রয়োজন থাকতো।

স্থানীয় মানুষেরা বলে এ সেই মেয়েরই অতৃপ্ত আত্মা যখন কোন ট্রেন সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়ায় সেই সময় ট্রেনের কামরায় সেই মেয়ে সওয়ার হয় এবং রায়পুর আসার আগেই সেই মেয়ে উধাও হয়ে যায়। তবে সেই অশরীরী আত্মা কখনোই কারো অনিষ্ট করেনি। অঘটন আজও ঘটে একবিংশ শতাব্দীর এই বিজ্ঞানের প্রগতির যুগে যা অবিশ্বাস্য হলেও বিশ্বাস করতে হয় বৈকি।

অশরীরী সীমান্তরক্ষী

প্রায় বছরখানেক বাদে আমার ছোটবেলাকার বন্ধু রাজুর সাথে দেখা ঋ আমরা স্কুলে একসাথে পড়েছি। রাজু হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে ভারতীয় মিলিটারি সার্ভিসে জয়েন করেছিলো। এ কথা শেখানোর পর রাজু তার এক লোমহর্ষক বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনেছিলো সেদিন।

বছর দুয়েক আগে রাজুর পশ্চিম ছিল নাথুলা পাশে। এই নাতুলা পাস বা গিরিপথ হল দংলা পর্বত শ্রেণীতে তিব্বতে চীনের ইয়াতুঙ কাউন্টি এবং ভারতের সিকিম রাজ্যের সীমান্ত এলাকা।

এই নাথুলা গিরিপথটি ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় চোদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং এটা ভারত এবং তিব্বতের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী পার্বত্য পথ। এখানে মাত্র বাইশ বছর বয়সে শিবাইই হরভজন সিং শহীদ হয়েছিলেন। হরভজন সিং এর জন্ম 30 আগস্ট ১৯৪৬ সালে পাঞ্জাবের ব্রনডাল গ্রামে। ১৯ ৬৫ সালে হাইস্কুলের পরীক্ষা পাস করে হরভজন সিং ১৯ ৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিলিটারি সার্ভিসে যোগদান করেন। যখন তার বয়স মাত্র কুড়ি বছর। এবার তিনি বদলি হয়ে নাথুলাতে পূর্ব সিকিম সীমান্তে পোস্টিং পান। ১৯৬৮ সালের চৌঠা অক্টোবর হরভজন সিং সেই সময় ভয়াবহ বন্যার বিলি করতে গিয়ে জলে পড়ে যান এবং পাহাড়ি নদীর খরস্রোতে ভেসে যান। পরে তার মরদেও পাওয়া যায়। তবে প্রথম সাতদিন তার মরদেহ খুঁজে না পেয়ে তার অন্য সাথীরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর মাঝে প্রীতম সিং নামে তার এক সাথীকে হরবিজন স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন তিনি ঠিক কোথায় ভেসে গিয়েছিলেন এবং পরে খোঁজ করে ঠিক সেই জায়গাতেই তার মরদেহ পাওয়া যায়। এখানেই বাবা হরভজন সিং মন্দির নির্মিত হয় হরভজন সিং এর সমাধিস্থলের ঠিক কাছেই।

কিন্তু কাহিনী এখানেই শেষ নয়। মেয়েটারই সাথীদের অভিজ্ঞতা বলে সিপাহী হরভজন সিং এর বিদ্যাপী আত্মা আজও ঘুরে বেড়ায় এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে। রাজুর কাছে সোনা, নাথুলা পার্বত্য সীমান্তেথ চেকপোষ্টে দুজন সৈনিকের ডিউটি থাকে। যদি কাউকে ডিউটিতে ফাঁকি দিতে দেখা যায় তাহলে নাকি হরভজন সিং এর বিদায়ী আত্মা কখনো তার চুল ধরে টানে অথবা কষিয়ে থাপ্পড় দিয়ে থাকে। এটা অবশ্য আমার বন্ধু রাজুর নিজস্ব অভিজ্ঞতা। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে আজও হরভজন সিং এর বিদায়ী আত্মা অতন্দ্র পরি হয়ে দেশকে রক্ষা করে চলেছে। মৃত্যুর এতদিন পরেও। ভারত সরকার অবশ্য তাকে মরণোত্তর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ মহাবীর চক্র প্রদান করে সম্মানিত করেছে। হরভজন সিংহের উপস্থিতি নাথুলা পাশের পদে পদে আজও জানান দেয়। এইসব দেশপ্রেমীদের জন্যই আমরা ভারতবাসীরা সুরক্ষিত থাকি। ও নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমোতে পারি। এদের আত্মত্যাগের কোন তুল্য মূল্য হিসেবে করা নিতান্তই নির্বুদ্ধিতামাত্র। শহীদ হরভজন সিংকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জয় হিন্দ বলে এই কাহিনীর ইতি টানছি।

.    .    .

Discus