উনিশের শতকে এই বাংলায় চলমান বুদ্ধিবৃত্তিক একটি জাগরণ বা আসলে ইউরোপীয় ধারার একটি নবজাগরণ সংগঠিত হয়েছিল। আর এই নবজাগরণের দিশারিদের মধ্যে স্বামীজি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। সাহিত্যের সৃষ্টি ও রাজনৈতিক চেতনা, সামাজিক ও হিন্দু ধর্মের প্রচার ও প্রসার সহ উদীয়মান অন্যান্য বিষয়কে এই নবজাগরণের ইতিবাচক লক্ষণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
নবজাগরণ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে এসব বিষয়ের মূলে ছিল ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত বিভিন্ন ইউরোপীয় জ্ঞান। এই নবজাগরণে কেবলমাত্র বাংলার হিন্দু সমাজের উঁচুস্তরের সামান্য অংশ তাৎক্ষণিক ভাবে প্রভাবিত হ’লেও শেষ পর্যন্ত মুসলিম সমাজ ও অন্য সমাজের মধ্যেও এই নবজাগরণ প্রসার লাভ করেছিলো। সেই শতকের শেষপাদে নবজাগরণ আমাদের উপমহাদেশের অন্য সব প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে। এই নবজাগরণকে রেনেসাঁস হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
এই নবজাগরণে নিবেদিত মনীষীরা যেসব পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিল এবং তা ছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ,উপযোগবাদ,বিজ্ঞানবাদ, ব্যক্তিবাদ,দৃষ্টিবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়তাবাদে উৎসর্গীকৃত।
বাংলার নবজাগরণের এই যুগসন্ধিক্ষণে স্বামী বিবেকানন্দ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বাঙালির মননে স্বামী বিবেকানন্দ একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই মহান জ্ঞানী মহামানবের জন্য আজ সারা পৃথিবী গর্ব অনুভব করে। স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ১৮৬৩ সালের ১২ই জানুয়ারি,মকর সংক্রান্তির এক পূণ্যদিনে। ছোটবেলায় সবাই তাকে বিলে নামে ডাকতো। শৈশব থেকেই তিনি খুব চঞ্চল এবং মেধাবী প্রকৃতির বালক ছিলেন। উত্তর কলকাতার একটি কায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম ছিলো বিশ্বনাথ দত্ত এবং মা ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন একজন সফল ও বিশিষ্ট অ্যাটর্নি। মনে করা হয় স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন সপ্তঋষির এক ঋষি। যারা সেই উনবিংশ শতকের শেষ দিকে একসাথে দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর মন্দিরে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এবং সেই কুশীলবদের কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন অবিসংবাদিত ভাবে পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
কলকাতার মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে স্বামীজীর স্কুল জীবনের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়। পড়াশোনার প্রতি তাঁর চিরকালই গভীর আগ্রহ ছিলো। বলাই বাহুল্য যে তিনি একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি ১৮৭৯ সালে ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং পরে স্কটিসচার্চ কলেজে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি হন।
কলেজে পড়ার সময় তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন গীতা,বেদ,উপনিষদ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর অসীম আগ্রহ ছিলো। তিনি ধ্যানধারণায় আগ্রহী ছিলেন এবং প্রথম জীবনে কেশব চন্দ্র সেনের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনে যোগদান করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন ভাষা এবং বিভিন্ন মানুষের সাথে মিশে তিনি নিজের এক নতুন রূপ গঠন করেন এবং নিজেকে তৈরি করেন মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে। ভারতের বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে তিনি দেশপ্রেম,সংস্কৃতি এবং ধর্ম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন।
তিনি এক পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে আজও বিখ্যাত হয়ে আছেন। স্বামীজি ১৮৯৭সালের ১লা মে কলকাতায় শ্রীরামকৃষ্ণ মঠের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মূল আদর্শই হয়েছিলো সাধারণ মানুষের সেবা করা। তারপর তিনি বেলুড়ে বেলুড় মঠের প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজও বাঙালির মনে শ্রদ্ধা জাগায় ও বাঙালি অস্মিতার পরিচয় বহন করে।