Photo by Will Wilson on Unsplash
১৯৭৭ সালের শেষে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে প্রায় সাত আট মাস ক্রমাগত আবেদন নিবেদন আর ইন্টারভিউ দিয়ে অবশেষে টিটাগরে একটা জুট মিলে ট্রেইনি মেইনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ারের একটা চাকরি পাওয়া গেল। যার এক বছর ট্রেনিং পিরিয়ড। তিন সিফটের ডিউটি। শুরু হলো আর ডেইলি প্যাসেঞ্জারি যাদবপুর শিয়ালদা হয়ে টিটাগর আপ এবং ডাউন। সপ্তাহে একদিন মানে রবিবারটা ছুটির দিন। শুরু হোলো ছকে বাঁধা জীবন। সেই সময় চিপ মেনটেনেন্স ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন মুখার্জীদা। তিনিও ছিলেন একজন বর্ণময় চরিত্র। ছিলেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায় এর গানের শিষ্য। মাঝে মাঝে ফুরসতে টি ব্রেকের সময় এসব নিয়ে টুকটাক গল্পসল্প হতো। মাঝে মাঝে ফ্যাক্টরি মেশিনে আগুন লেগে যেত। সভাপতি আমরা উদ্বেগ নিয়ে ছোটাছুটি করতাম কিন্তু দেখতাম মুখার্জীদা নির্বিকার হাসছেন। উনি বলতেন আরে এতো টেনশন নিও না। আমি অবাক হয়ে তাকাতেই উনি বলতেন আরে এই মেশিনটা পুরোনো হয়ে গেছে তাই জেনে বুঝেই এই অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয়েছে যাতে বীমা কোম্পানির কাছ থেকে টাকা পাওয়া uযায়। এমনি করেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। এসবের মাঝে কিছু ঘটনা আজও মনে আছে। তার মধ্যে একটি হোলো আমাদের জুট মিলের ক্যাশিয়ার ফণিবাবু ওই একই মেনটেনেন্স ওয়ার্কশপে আমাদের পাশের টেবিলেই বসতেন।
প্রতিদিনই দুপুরে উনি বাড়ি থেকে লাঞ্চ করে আসতেন রেললাইন ধরে। কারণ ফ্যাক্টরির পাশেই ছিল টিটাগর রেলওয়ে স্টেশন হাঁটা পথে দু তিন মিনিট দূর। এমনই একদিন দুপুরে দেখি ফণিবাবু টেবি বসে ঝিমোচ্ছেন। আমি ভাবলাম হয়তো বা শরীর খারাপ হয়েছে ওনার। শত হোক বয়স্ক মানুষ বলে কথা একটু বাদে জানতে চাইলাম কি হয়েছে ওনার। উনি যা বললেন তাতে তো আমার চক্ষু চরক গাছ। বললেন রোজকার মতোই উনি রেললাইন ধরে হাঁটছিলেন। পথে একটা সাপ ওনাকে ছোবল মারে। শুনেছো আমি “থ” হয়ে গেছি। আবারও উনি বলেন ছোবল মারার পর সাপ্তাহিক নাকি নেতিয়ে পড়ল। আসলে ফোনীবাবুর আফিমের নেশা ছিল তাই এই অবস্থা আর কি। সত্যিই কত অজানারে।
এরপর যে ঘটনাটা আজও মনে আছে সেটা মনে পড়লেও আজ শিহরণ বোধ করি। আমার তখন নাইট শিফ্ট চলছিলো। মুখার্জী দা আমাকে নিয়ে রাউন্ডে বেরিয়েছেন কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। হঠাৎ ওনার নজরে পড়ে একজন অয়েল ম্যান ওই যারা মেশিনে সার্ভিসিং করে ডিউটিতে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই দেখে মুখার্জীদা ওই অয়েলম্যানকে এক সপ্তাহের জন্য লে অফ্ করে দেন আর উইটনেস হিসেবে আমাকে সই করতে বলেন, আমিও সই করে দিলাম। আর আসল ঘটনা ঘটলো পরের দিন ভোরবেলা টিটাগর রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। রোজকার মতো এক কাপ ভাড়ের চা নিয়ে আমি শিয়ালদহ মুখী ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দেখি একজন অবাঙালি লোক চোখ দুটো লাল এসে আমাকে বলল “আপ হি হ্যায় না ওসব জো মেরা চাচা কো চার্জশীট দে করকে বৈঠা দিয়া এক হপ্তাকে লিয়ে।” আমি দেখলাম কথা কাটাকাটি করে লাভ নেই তাই বললাম “নেহি ভাইসাব ম্যায় তো ছোটা আদমী হুঁ ও মুখার্জি সাব হ্যাঁয় না? উনকাহি অর্ডার থা।”কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা কে শোনে কার কথা। যাই হোক এ কথা সে কথা বলে কিছু সময় কাটানোর পর ট্রেন এলে এক লাফে ট্রেনে উঠে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বাঁচি আর কি।
আরো আছে একরাত্রে কোন গন্ডগোলে শেয়ালদা মেন থেকে সব ট্রেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। আর আমাকে সারাটা রাত কাটাতে হয় শিয়ালদা স্টেশন চত্বরে। সে রাতে স্টেশনের যেসব অদ্ভুত ঘটনা দেখেছিলাম তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। ভেবেছিলাম ক্ষুধার্ত মানুষ প্লাটফর্মের পাশে কুকুরের সাথে খাবার কারাকারি করছে। আর তাছাড়া আরও অনেক দৃশ্য যা আজও আবছা চোখে ভাসে আমার।
এইসব ঘটনার প্রবাহে কখন যে এক বছর কেটে গ্যাছে বুঝতেও পারি নি। অবশ্য মাঝে আমার পিতৃ বিয়োগ হয়ে গিয়েছে। যাইহোক এসবের মাঝি চাকরির আবেদনে বিরাম ছিল না কোন। ঠিক এক বছরের মাথায় একটা নামই কনস্ট্রাকশন কোম্পানি থেকে চাকরির ইন্টারভিউ পেলাম এবং সিলেক্টও তো হয়ে গেলাম। কোম্পানিটার হেড অফিস ছিল কলকাতার পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে। যাই হোক আমাদের হলদিয়া প্রজেক্ট সাইটে। দিনটা ছিল ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৯ ৮০ সাল। অর্থাৎ বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক পরের দিন মানে বিসর্জনের দিন। আমার সাথে আমিও বিসর্জনের অংশগ্রহণ করেছিলাম সেদিন সন্ধ্যেবেলা। এবং সেই মিছিলে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। বিসর্জনের শেষে ফেরার পথে যখন রেডকাউন্ট হচ্ছে দেখা গেল একজন রিগিঙ ফোরম্যানের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। পরে জানা গিয়েছিল সে নাকি পেশাদার গাঁজাড়ু ছিল এবং সে সেদিন নেশায় বুঁদ হয়ে রাস্তার মাঝে একটা খাদে পড়ে গিয়েছিল। যেখানে সে সারারাত বসেছিল আর নেশা কাটলে আবার যথারীতি উঠে বাড়ি ফিরে এসেছিল। সত্যিই বিচিত্র ঘটনা বৈকি।
যাই হোক আমার ঠাঁই হয়েছিল সুতাহাটায় রহমান মেসের নিজের তলার রাস্তার দিকের একটা ঘরে। প্রথম রাতে আমাকে খুবই খাতির করেছিল ঘোষ দম্পতি যাদের শব্দ বিবাহিত জীবন শুরু হয়েছিল এবং ওরাও ওই মেসেই একটা ঘরে দাম্পত্য জীবন শুরু করেছিল। ঘোষবাবু ছিল কোম্পানির জুনিয়র একাউন্টেন্ট। প্রথম দিন সন্ধ্যায় একবারটি মুড়ি তেলে ভাজা দিয়ে আমার মত এক অপরিচিতকে আপন করে নিয়েছিল ওরা।
যাই হোক মাসে ছ’টাকা ভাড়ায় খাটের উপর শোয়ার বন্দোবস্ত হলো। আর আমার রুম পার্টনার ছিলো একজন কোম্পানির সুপারভাইজার বোস্ দা। তাকে আজও মনে আছে। আর মনে আছে প্রত্যেক মাসে মাস পয়লায় মাইনে হাতে পেয়ে দু’টাকার বিয়ার আর রুটি তরকা দিয়ে আমাদের সীমিত সামর্থের পার্টি মানানোর কথা। এভাবেই হয়েছিলো আমার প্রথম কনস্ট্রাকশন লাইফের হাতে খড়ি।
রোজ ভোরবেলা সাড়ে সাতটায় কোম্পানির সবুজ মিনিবাসে উঠে সাইটে পৌঁছানো আর রাত আটটা অথবা নটা কিংবা তার ওপরে মেসে পৌঁছে কোনো রকমে ডিনার করে আবার পরদিন ভোরে নাকে মুখে ব্রেকফাস্ট গুজে বাসে চড়ে
সাইটে পৌঁছানো। কারণ বেরোয়ার সময় ছিল ঠিক কাঁটায় কাটায় সাড়ে সাতটা কিন্তু ফেরার টাইমের কোন ঠিক ছিল না।। সাইট ছিল মেস থেকে প্রায় চল্লিশ মিনিট দূরত্বে। এইচএফ সি এল এর প্রজেক্ট সাইট। দিনগুলো যেন একটা ঘোড়ের মধ্যে কেটে যাচ্ছিলো। ব্রেকফাস্ট- লাঞ্চ- ডিনার আর সকাল থেকে রাগ অবধি ডিউটি গতে বাঁধা জীবন।
আমাদের বস মানে কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার ছিলেন জগাদা, যার নাম সেই সময়ে কাজ পাগলা নামেই সবাই জানতো। তাকে নিয়ে অনেক কাহিনী শুনেছি। তারই দু’একটা বলছি এখানে।
এই গল্পটা আমার বৌদি মানে জগাধার সহধর্মিনী মুখে শোনা। ওদের বিয়ের পর পরই জগাদা ঠিক করলেন উনি বৌদিকে নিয়ে ম্যাটিনি শো দেখবেন।
তখন ম্যাটিনি শো ছিল তিনটে-ছটা সিনেমা হল বাড়ির কাছেই তাই হাঁটা পথে সেই শ্রী সিনেমায় যাওয়া যেতো। যাই হোক সিনেমার দিন জগাদা, বৌদিকে বললেন “তুমি সিনেমা হলে পৌঁছে যেও আমি আজ তাড়াতাড়ি চলে আসবো, কাজ ছেড়ে সোজা সিনেমা হলে।”অতএব কথা মতো বৌদি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সিনেমা হলের ঠিক সামনে। এক ঘন্টা পার হলো এমন কি বিরতির পরেও প্রায় দশ মিনিট কেটে গ্যাছে অথচ জগাদার দেখা নেই। বৌদি স্বভাবতই রেগে গিয়ে টিকিট দুটো ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বাড়ি চলে এলেন। তারপর নাকি উনি জগাদার সাথে আর কোনদিন এরকমের আউটিং এ আর যাননি। জগাদা বারংবার মাফ চাওয়া সত্ত্বেও।
জগধার আসল নাম ছিল জে এন রায় চৌধুরী।
শর্ট এ জে এন আর সি। উনি সেই সকাল আটটায় মল্লিকের এম্বাসেডারে চেপে সেই যে সাইটে ঢুকতেন কখন যে ফিরবেন তা ছিল ভগবানেরও অজানা। কাজ পাগলা লোক ছিলেন আমাদের এই জগাদা। অনেক ঘটনার মধ্যে আরও একটা ঘটনা হোলো একবার জগধার বাড়িতে বিশেষ অতিথি এসেছে কলকাতা থেকে। তা বৌদি ভালো মাছ, চাল আর সবজির বাজার নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি করে আসতে। জগাদা আবারও কথা দিলেন যে উনি সাইটে যাবেন আর আসবেন। সাইটে পৌঁছেই ড্রাইভার মল্লিককে টাকা দিয়ে বললেন “যাও মাখনবাবুর বাজার থেকে ভালো মাছ চাল আর সব্জির বাজার নিয়ে এসো।”সবই এসে গেলে গাড়ি র ডিকিতে তুলে জগদা রওনা ও হলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু পাতিখালির মোড়ের কাছে এসে জগাদার মনে হল একটা কাজ বাকী থেকে গ্যাছে। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে জগাদা আবার যথারীতি সাইটে ফিরে গেলেন। আর সাইটের পীরে গিয়ে উনি ভুলেই গেলেন বাড়ি যাওয়ার কথা। যখন মনে পড়ল তখন প্রায় রাত ন’টা বাজে। ততক্ষণে মাছ সবজি সব খারাপ হয়ে
গ্যাছে। আর একবার জগদা লন্ডন গিয়েছিলেন অফিসের কাজে কারণ আমাদের কোম্পানি ছিল সেই সময়ের বনেদী ব্রিটিশ কোম্পানি। জগদ্বার ছিল তিন মাসের ডেপুটেশন। উনি যাবার সময় বেশ কয়েক কিলো চিড়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে বল্লেন সাহেবদের সেই চিড়ের পোলাও খাইয়ে কিভাবে টুপি পরিয়ে কাজ হাসিল করেছেন সেই অদ্ভুত মজার গল্প। এমনি করেই আরো নানান ঘটনার আবর্তে দুটো বছর কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারিনি। আর আমিও সময়ের সাথে সাথে চেইন স্মোকার হোয়ে উঠলাম।।
হলদিয়া পর্বের ইতি ঘটিয়ে এবার আমার যাত্রা শুরু হল পশ্চিমবাংলার বাইরে ভিন্ন রাজ্যের দিকে। পৌঁছে গেলাম রাজধানী এক্সপ্রেসের চেয়ার কার এ চেপে নেহের প্লেসে ইন্টারন্যাশনালের অফিসে। রাজধানী এক্সপ্রেস তখন সবে শুরু হয়েছে। সেখান থেকে মুম্বাই হয়ে পৌঁছে গেলাম কর্মক্ষেত্র রসায়নীতে। একটা ছোট্ট সুন্দর হিল স্টেশন। এইতো সি এল ছিল আমাদের কোম্পানির ক্লায়েন্ট আর সাইমন কার্ভস ছিল ইপিসি কন্ট্রাক্টর। ওই সাইটে মেরেকেটে মাসখানেক ছিলাম। সাইমন কার্ভস এর ইনচার্জ ছিলেন মুখার্জি সাহেব। ওনাকে দেখেছি সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে তুলতে তুলতে রিলাক্স করে জাম্বো গ্লাস এ
বিয়ার খেতে। সাথে অবশ্য মাঝেসাজে উনি আমাদেরও ডাকতেন। দেখতাম যখন স্টক ফুরিয়ে যেতো সাদা কাগজে সই করে নতুন বোতলের অর্ডার পাঠাতেন ওয়াইন শপে। এসব কথা আমি অনেক বড় বড় রাজনৈতিক নেতা অথবা বাহুবলীদের গল্প শুনেছি। কিন্তু চাকরি-সুত্রে এই দৃশ্যেরও সাক্ষী থেকেছি আমি।
যাইহোক মাঝখানে পরে ট্রান্সফার হয়ে চলে গেলাম ক্রিভকো হাজিরা সাইট সুরাট এ। সেখানে আমার আগের কোম্পানির এক দাদা ভৌমিকদা ছিলেন কনষ্ট্রাকশন ম্যানেজার। আমি এলাম ওখানে প্ল্যানিং ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। মাঝে মাঝে বরোদা যেতাম। ওখানে যখন আমার দাদার বাড়ি ছিলো। ওখানে ই আরো একটি সরকারি কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সাইট ইনচার্জ এর সাথে পরিচয় হয়। মূলত ওনার উপদেশই আগের কোম্পানিতে রিজাইন দিয়ে
বোম্বেতে ওদের অফিসে ইন্টারভিউ দিয়ে বরোদা আইপিসিএল প্রোজেক্ট সাইটে জয়েন করলাম।
ওখানে থাকার ব্যবস্থা ছিল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার্স
মেস এ। ওখানে নানা ঘটনার স্রোতে কেটেছিল প্রায় চার চারটে বছর। অনেক ঘটনার মধ্যে দুটো ঘটনা না বললেই নয়।
এক রাত্তিরে আমরা নাইট
শো দেখে অটো করে বেশ রাত কোরেই মেসে পৌঁছলাম। আমরা অটোচালককে রেটচার্ট মেনে যা ভাড়া হয় তাই দিলাম তবুও অঞ্চলক বেশি ভাড়া দাবি করতে থাকে। আমরা ভাড়া দিতে গেলে সে বলে দাবি মতো বাহানা দিলে ভাড়া নেবে না এবং কিছু পরে সে চলে গেল। আমরাও রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে পড়েছিলাম সে রাতে। আড়াইটে নাগাদ অটোচালক পুলিশ নিয়ে হাজির হলো মেস এ। সে পুলিশকে অভিযোগ করেছিল আমাদের নামে। আমরা পুলিশকে আসল ঘটনা বুঝিয়ে বলার পর পুলিশ উল্টো অটোচালককে ফাইন করে দিয়েছিল।
আরো মনে পড়ে সেই সময় দেশ পত্রিকার দাম ছিল দু’ টাকা। আর পত্রিকাটা শুধু বরোদা স্টেশনেই পাওয়া যেতো। আমাদের মেস থেকে বরোদা স্টেশন এর অটো ভাড়াও ছিল দু’ টাকা। সেই দু’ টাকার দেশ পত্রিকার চার টাকা অটো ভাড়া দিয়ে নিয়া আসতাম তখন। এখন এসব ভাবলে সত্যিই হাসি পায়। আবার কখনো বাঙালি রসগোল্লা খাওয়ার লোভে আশি টাকা অটো ভাড়া দিয়ে তিন চার জন মিলে সুরসাগরের কাছে একটা রসগোল্লার দোকানে গিয়ে রসগোল্লা খেয়েছি তৃপ্তি কোরে। আজও মনে পড়ে সেইসব অদ্ভুত দিনগুলোর কথা। এমনি করেই বরোদাতে চার বছর কাটিয়ে আবার নতুন চাকরিতে জয়েন করলাম বোম্বেতেই একটা এমএনসি তে ইন্টারভিউ দিয়ে।
সেই কনস্ট্রাকশন এম এন সি কোম্পানিতে আমার প্রথম সাইট ছিল আরআইএল(রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড) এর পাতালগঙ্গা প্রজেক্ট সাইটে।
থাকার জায়গা ছিল প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূর পানভেল এ। রোজ যাতায়াত মিলে প্রায় দু'ঘণ্টা সময় লাগতো। যাতায়াতের ব্যবস্থা কোম্পানিই করে দিয়েছিলো কোম্পানির গাড়ি আর বাসে। এই কোম্পানিতে জয়েন করেই আমার সাংসারিক জীবন শুরু হোলো। এই প্রজেক্ট সাইটটা ছিল বেশ বড়ো। আমি ছিলাম পাওয়ার প্ল্যান্ট কন্সট্রাকশন এ। আর আই এল এর কন্সট্রাকশন সাইট প্রথম থেকেই ছিল ওয়ার ফুটিং এবং পারলে সময়ের আগে কাজ শেষ করার প্রবণতা। এখানে অবশ্য ঘড়ির কাঁটায় ভোর সাড়ে সাতটায় কোম্পানির বাস ছাড়তো আর ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় বাড়ি ফেরার বাস ছাড়তো সাইট থেকে। মাঝে বারো ঘন্টা ডিউটি ও যাতায়াত নিয়ে। ইমারজেন্সি কাজ আসলে অবশ্য দিনরাত এক হয়ে যেত মাঝে
মাঝেই। আমার বস আগরওয়াল সাহেবের মুখে হামেশাই শুনতাম”ডু অর ডাই“। এভাবেই সময়ের ধারা এগিয়ে চললো। এসবের মাঝে আমি সংসার পেতে ফেলেছি
সিডকোর টাউনশিপএ। কোম্পানির ফ্রি ফার্নিশড আ্যকোমোডেশন। বিয়ের পর একটা মজার ঘটনা না বল্লেই নয়। আমার সহধর্মিনীর এই কনস্ট্রাকশন জীবন সম্বন্ধে কোন ধারণাই ছিলৈ না। বিয়ে করে আসার মাস দু’য়েকের মাথায় একদিন সে জিজ্ঞেস করল” আচ্ছা এরকম ডিউটি তো আমি আমার বাবা-দাদা কাউকেই করতে দেখিনি। সবারই আটঘন্টা থেকে দশ ঘন্টা সময় বাঁধা থাকতো। এ কেমন সকাল থেকে বারো ঘন্টার টানা চাকরি যার কোন সময়ের ঠিক নেই।“আমি মনে মনে হাসলাম তারপর একদিন ছুটির দিন দেখে আমাদের কোম্পানির বাস গুলো দেখিয়ে তার সন্দেহের নিরসন করলাম। সত্যিই কি বিচিত্র চাকরি যার যাওয়ার টাইম বাঁধা কিন্তু ফেরার সময়ের কোন নিশ্চয়তা নেই। যাইহোক এমনি করেই আমি ঘোর সংসারী হয়ে উঠলাম। ওখানে আমার প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম। যে এখন বিবাহিত এবং এক কন্যার মা। এরপর বদলি হয়ে এলাম সুরাটে ও এন জি সি র এক্সপানশন প্রজেক্ট হাজিরা সাইটে। সেখানেও আমার বস সেই আগারওয়াল সাহেব। সেই সময়কার অনেক সাথী সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে আবার কেউবা চলে গেছে, না ফেরার দেশে। আর যারা আজও আছে তাদের দু একজনের সাথে দূরভাষে এমন কি মাঝে মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎও হয়ে থাকে। হাজিরাতে গোটা চারেক প্রোজেক্ট সাইট ঘুরে আর তিনটে বাড়ি পাল্টে প্রায় সাত বছর কাটিয়ে দিয়েছি আমি। ওখানেই আমার দ্বিতীয় কন্যার জন্ম হয়। ওখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে আমি চলে গেলাম মহারাষ্ট্রের এনডিআইএল এর ওয়াডকাল পেন প্রজেক্ট সাইটে। ওটা ছিল লক্ষ্মী মিত্তালের একটা স্টিল প্ল্যান্ট প্রজেক্ট সাইট। থাকার জায়গা ছিল নবী মুম্বাইয়ের ভাসীতে। ওই সাইটেও কেটে যায় প্রায় দু'বছর।তারপর মধ্যপ্রাচ্যের হাতছানিতে ওই দশ বছরের চাকরিতে রিজাইন দিয়ে আমি পাড়ি জমাই আল্ রিয়াধ মানে সৌদি আরবের রাজধানী পিপি নাইন পাওয়ার প্ল্যান্ট এর কনস্ট্রাকশন সাইটে। একটা লেবানীজ কন্সট্রাকশন কোম্পানির হয়ে।
সেটা ছিল ১৯৯৬ সালের শেষ দিক। মুম্বাইতে ট্রান্সফার হয়ে আসার পর হঠাৎ করে আমি একটা মধ্যপ্রাচ্যের লেবানিজ কনষ্ট্রাকশন কোম্পানিতে খুব ক্যাজুয়ালি এপ্লাই করি। যদিও এই নতুন কোম্পানিতে জয়েন করার পর আমার উড় উড়ু মনকে থিতু করে নিয়েছিলাম চাকরি পাল্টাবো না এই ভেবে। চাকরিটাও ছিল স্থায়ী যদিও কোম্পানিটা ছিলো বেসরকারি। যাইহোক এপ্লাই করে দিয়েছি এবং ইন্টারভিউতে সিলেক্টও হয়ে গেলাম। মাইনেও শেষ সময়ের বিচারে খুবই লোভনীয় যদিও চাকরিটা
কন্ট্রাক্ট সার্ভিস ছিলো। প্রথমে মন সায় না দিলেও মধ্যপ্রাচ্য মানে সৌদি আরবের আকর্ষণ বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখা গেলো না। একদিন সেই আরব সাগরের ওপারে পাড়ি দিলাম দামাম হয়ে সৌদি রাজধানী শহর আল্ রিয়াধে। কারণ দামামে ছিল ওই কোম্পানির হেড অফিস। যাই হোক ফরমালিটিজ শেষ করে জয়েন করলাম পিপি নাইন পাওয়ার প্ল্যান্টের প্রজেক্ট সাইটে। তখন একজন ইতালিয়ান ছিলেন প্রজেক্ট ম্যানেজার। নাম তার ফষ্টো চারুতিনি। প্রথম রিপোর্ট তাকেই করলাম। ইটালিয়ানদের ইংরেজি উচ্চারণ অনেক পরিষ্কার কারণ ওরা ইংরেজিটা আমাদের ভারতীয়দের মতো শিখে উচ্চারণ করে। এ কথা সে কথার পর সে বলল” ইউ রিপোর্ট টু কেবিন আওয়ার কন্সট্রাকশন ম্যানেজার।“আমি বেশ ধন্দে পড়ে গেলাম ভাবলাম উনি হয়তো আমায় ভুল করে কি বলতে কি বলছেন। তাই ওর সেক্রেটারির থেকে নিশ্চিত হলাম ওই কনস্ট্রাকশন ম্যানেজারের নাম কেবিন ওডোনীল। যে কিনা একজন আইরিশ নাগরিক। যাক শুরু হলো আমার নতুন চাকরি প্রজেক্ট
কোঅর্ডিনেটার হিসেবে। একটা ঘটনার কথা না বললেই নয়। তখন ইন্সপেকশন ডিপার্টমেন্টের হেড ছিলেন লায়নেল
ক্লাটারহাম সাহেব যিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের মানুষ। ওদের ইংরেজি বোঝা বেশ কষ্টকর একদম জিলিপির প্যাঁচের মতন। ওর বয়স প্রায় ৬৫ বছর হবে তখন। মানে যে বয়সে আমাদের এখানে মানুষ অবসর জীবনযাপন করে সেই বয়সে
ক্লাটারহাম সাহেব জমিয়ে একটা ডিপার্টমেন্টের হেড হয়ে দাপিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। একদিন হঠাৎ আমার চেম্বারে এসে মাই বয় বলে একটা কাজের কথা বললেন। বার তিনেক রিপিট করার পরে বুঝতে পারলাম সাহেব কি বলতে
চাইছেন। যাই হোক লাঞ্চের পর যখন সেই কাজে গেছি তখন দেখলাম আরও তিনজন ওই একই কাজের জন্য ওখানে হাজির সাহেবের নির্দেশে। মানে সাহেব একজনের রিপোর্টে বিশ্বাস করেন না আর কি। এখন বুঝলাম এরকমটা না হলে ব্রিটিশ শাসকেরা দু’শ বছর ভারত শাসন করতে পারত না। সত্যিই একে বলে রঙের গুন বা পরম্পরা। যাই হোক দেখতে দেখতে প্রায় দশ মাস কেটে গেলো। আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিলো কোম্পানির ক্যাম্পে। সেখানে নানান দেশের মানুষ ছিল। জানু ছোট একটা দুনিয়া ভারতীয়, বাংলাদেশী,পাকিস্তানি, ফিলিপিনি, আমেরিকান, আর ইউরোপের নানান দেশের মানুষ। সবারই জীবন যাপন আর খাদ্যাভ্যাসের প্রচুর অমিল ছিলো। কিন্তু সুখ সইলো না এগারো মাসে আমার বস কেবিনের সাথে কথা কাটাকাটি করে আবার ফিরে এলাম দেশে। শুরু হলো নতুন চাকরির খোঁজা আর নতুন করে জীবন যুদ্ধে পা মেলানো। ইতিমধ্যে মাছ দিয়ে পর মুম্বাইয়ের পাততাড়ি গুটিয়ে সপরিবারে চলে এলাম কলকাতায় একটা বাড়ি ভাড়া করে। মাঝে মাঝে ইন্টারভিউ দিতে মুম্বাই যেতাম পড়তাম আমার দাদার বাড়িতে নবী মুম্বাইয়ের ভাসী তে। প্রায় দেড় বছর কলকাতা, মুম্বাই করে ফরেন এসাইনমেন্টের জন্য প্রেজেন্ট এর কাছে পাসপোর্ট জমা রেখে দিলাম। আর এরকম চেষ্টা করতে করতে হঠাৎ করেই আমার পুরনো কোম্পানিতে একটা শরট টার্ম কন্ট্রাক্টের চাকরি পেয়ে গেলাম হলদিয়া রিফাইনারি প্রজেক্ট সাইটে। শুরু হলো আবার কলকাতা হলদিয়া যাতায়াতের গতানুগতিক জীবন। দু সপ্তাহে একবার কলকাতা আসতাম। কখনো রায়চক ফেরিঘাট রুটে আবার কখনো বা ট্রেন পথে।
এইভাবে মাস খানেক কাটবার পর আবার এলো বিদেশের হাতছানি। এবার ডাক এলো উত্তর আফ্রিকার প্রান্তিক দেশ সুদান থেকে। সুদানের পড়শী দেশ হল ইথিওপিয়া। যাইহোক ম্যাজগাও ডক থেকে ইয়েলো ফিভারের ইঞ্জেকশন নিয়ে আরো কিছু মেডিকেল টেস্ট দিয়ে একদিন ভোরবেলা মুম্বাই এয়ারপোর্ট থেকে দুবাই হয়ে খারটুম এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম পরদিন প্রায় সন্ধ্যে ছ’টায়। খারটুম হচ্ছে সুদানের রাজধানী
শহর। আর নাইল হচ্ছে গিয়ে সুদানের জাতীয় নদী। যেমন আমাদের দেশের গঙ্গা নদী। এখানে নাইল নদীর
দুপাশে প্রচুর আখের চাষ হয়। আর একটা আশ্চর্য জিনিস হল
ব্লুনাইল আর হোয়াইট
নাইলের সঙ্গম। যেখানে দেখা যায় একদিকে সাদা জল আরেক দিকে ঘন নীল জল। এই নদী এগারোটা দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান। নাই নদীর মাছের স্বাদ খুব সুস্বাদু আর বেশ মোটা তেলের আস্তরণ অনেকটা আমাদের কাতলা মাছের মতো আর কি। যাই হোক হোটেলে দু’দিন কাটিয়ে
সুদানের উদ্দেশ্যে
অর্থাৎ আমার কর্মস্থলের দিকে রওনা দিলাম এক সিক্সটি সিটার ফ্লাইটে চেপে। রাত আড়াইটে নাগাদ পোর্ট অফ সুদানে পৌঁছলাম আমরা। আমাদের ক্যাম্প ছিলো,
রেডসীরএকদম পাড়ে।
পরদিন সকাল থেকে শুরু হল ডিউটি। ওখানে স্থানীয় যারা কাজ করে তাদের থেকে জেনেছিলাম রেড সী নামকরণের ইতিহাস। আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে নাকি একবার খ্রীষ্টান আর মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের
মধ্যে নাকি এক ভয়ন্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল আর সেই যুদ্ধে নাকি এত রক্ত ক্ষরণ হয়েছিলো যে সমুদ্রের জল লাল হয়ে গিয়েছিল। এই কাহিনী ওখানে বহুল প্রচারিত গল্প কথার একটি। একদিন শুনি আমার সাথে যে প্রায় সাত ফুট উচ্চতার বেশ লম্বা স্বাস্থ্যবান কোঁকড়া চুলের স্থানীয় আফ্রিকান মাঝ বয়সী ছেলেটি কাজ করতো সে শীষ দিয়ে” নীলে গগন কে তলে গানটি“গাইছে নিখুঁত নৈপুন্যে। আমি একটু আশ্চর্যই হয়েছিলাম সেদিন। তার নাম ছিলো জন। জনকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল সে যখন ছোট তার বাবার সাথে হামরাজ সিনেমা দেখেছিলাম যেখানে ওই গানটি ছিলো। গায়ক ছিলেন মহেন্দ্র কাপুর। তবে আমিও দেখেছি সেই সময় ওখানে মিঠুন চক্রবর্তী, রাজ কাপুরের সিনেমা খুবই জনপ্রিয় ছিলো তখন। না হলে হিন্দী না বুঝেও জন নিখুঁত শিস দিয়ে ঐ সুর তুলতে পারত না। ভেবে আজও আমি যেন ঠিক মেলাতে পারিনা। যাই হোক মাস তিনেক কোনরকমে কেটে গেলো। ওখানে তখন তাপমাত্রা ছিল ষাট ডিগ্রি সেলসিয়াস এরও ওপরে। জেনেছিলাম সেই জন্যই নাকি আফ্রিকান দের মানে যাদের আমরা নিগ্রো বলি তাদের গায়ের রং অতো মিশকালো আর মাথার চুল কোঁকড়ানো। মানে এটাই প্রকৃতির রহস্য।
রাতের বেলা মাঝে মাঝেই ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির আওয়াজ শুনতাম। মাঝে মাঝেই ফায়ারিং এর শব্দে ঘুম ভেঙে যেতো। পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম ওসামা বিনলাদিনের গেছিল নাকি ওখানে কাছাকাছি কোথাও। এরপর সত্যিই আমার আর বিন্দুমাত্র থাকার ইচ্ছা ছিলোনা। তাই কোম্পানিকে অনুরোধ করে একরকম প্রাণ হাতে করেই ফিরে এলাম আবার কলকাতায়।
তারপর প্রায় বছর দুই আবার হলদিয়াতেই একটা মাঝারি কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে শুরু হোলো আমার নতুন কর্মজীবন। সপ্তাহে একবার রায়চক ফেরিঘাট হয়ে কলকাতা আর হলদিয়া ফিরে যাওয়ার গতানুগতিক জীবন। তারপর দু’ বছরের মাথায় আবার মুম্বাইতে নতুন চাকরি নিয়ে কলকাতার পাট ঢুকিয়ে চলে যাওয়া। সেই চাকরির সময়কাল ছিলো প্রায় এক বছর। একদিকে চলেছিলো কোম্পানির ডিউটি আর তার সাথে নতুন চাকরির চেষ্টা। এবারও চাকরির সুযোগ পেয়ে গেলাম একটা ভারতীয় বহুজাতিক সংস্থায়। আর একদিন চলে গেলাম দেশান্তরী হয়ে আরব আমিরশাহীর রাজধানী আবুধাবীর
থেকে প্রায় শ’দুয়েক কিলোমিটার দূরে মরুভূমির মাঝে বুহাসার গ্যাসকো অয়েলফিল্ডে।
যে ক্যাম্পে আমি প্রথম উঠেছিলাম তার নাম ছিল বিনথানি ক্যাম্প। চারিদিকে শুধু ধূধূ মরুভূমি আর বেশ দূরে দূরে গোটা কয়েক ক্যাম্প দেখা যেতো। সন্ধ্যা হলেই দূরের ক্যাম্প গুলোতে টিম্ টিম্ করে আলো জ্বলতে দেখতাম। যেন এক অদ্ভুতুড়ে ভুতুড়ে পরিবেশ। আমরা মজা করে বুহাসার নাম দিয়েছিলাম ভূত হাসা। মাঝে মাঝে দেখতাম উটের দল মানে প্রায় ডজন দুই উট দলবেঁধে সারি দিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে চলে যেতো আর তাদের সাথে থাকতো উটের মালিক। ওদের বলা হয় বদ্দু। এই বদ্দুরাই আরব দেশের আসল আদিবাসী।
আবার কখনো দুপুরবেলা দেখতাম উটের পাল এসে ক্যাম্পে ঢুকে পড়তে। ওরা বাইরে বসে থাকতো আর উটেদের মালিক পেটপুরে খেয়ে উট নিয়ে চলে যেতো। আর এটা ওদের একটা মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। একবার মনে পড়ে আমরা অনেক রাত করে আবুধাবি শহর থেকে ক্যাম্পে ফিরে আসছিলাম। হঠাৎ রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল একটা বিশালাকায় উটপাখি রাস্তা পার হচ্ছিল। আবার একদিন শীতের সকালে দেখেছি কুয়াশার অন্ধকারে সিরিয়াল কার এক্সিডেন্ট। কুয়াশার ব্যাপারটাও ছিল একটু অদ্ভুত রকমের। ওখানে আমরা মোটামুটি ভোর ছ’টার সময় প্রাতরাশ সারতে যেতাম তখন আকাশ একদম পরিষ্কার থাকতো। কিন্তু আধঘন্টাটাক বাদে যখন প্রাতরাশ সেরে রুম থেকে বেরিয়ে আসছি কোত্থেকে যে চারদিক আঁধার করে কুয়াশা এসে নিশ্চ্ছীদ্র অন্ধকারে ছেয়ে যেতো কে জানে। সেই সময়টা থাকতো বেশ লম্বা না হলেও কম করে ঘন্টাটেক তো হবেই। ওই সময় সব কাজ বন্ধ থাকতো। আর তিন ঘণ্টার লাঞ্চ ব্রেক থাকতো। ওই সময় আমরা ক্যাম্পে এসে লাঞ্চ করে জমিয়ে ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে আবার সাইটে চলে যেতাম। তবে ওখানে কাজের সময় বাঁধা ছিলো। এইরকমই অনেক ছোটখাটো নানান ঘটনা প্রবাহে কখন যে আবুধাবীতে প্রায় বছর তিনে কেটে গেলো বুঝতেও পারিনি। এর মাঝে অবশ্য বার পাঁচেক ছুটিতে দেশে মানে ভারতে এসেছি । আমার পাসপোর্ট এর মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। পাসপোর্ট ও দিয়ে দিয়েছিলাম রিনিউ করতে। কোম্পানির পাওয়াই হেড অফিসের মাস তিনেক ডেপুটেশনে থাকার সময়ই ইরাণের একটা কোম্পানি থেকে অফার লেটার পেয়ে গেলাম। এবার পুরনো কোম্পানি তে ইস্তফা দিয়ে শুরু হল ইরাণ যাত্রার প্রস্তুতি।
তারপর একদিন দুপুরের উড়ানে মুম্বাই ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ইরাণ এয়ারওয়েজর
বিমানে পাড়ি দিলাম ইরাণের উদ্দেশ্যে।
গন্তব্যে যাওয়ার আগে পৌঁছলাম তেহরাণ বিমানবন্দরে।
চারিদিকে এত সবুজের সমারোহ দেখে মনে হচ্ছিল ভারতেরই কোন রাজ্যে এসে পড়েছি। এখানে সবই ভালো। তবে হাতেগোনা কিছু লোক শুধু ইংরেজি বলে এখানে। যাইহোক অফিস থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল
প্ল্যাকার্ড নিয়ে ইরাণি চালক এল বেশ কিছুক্ষণ বাদে। ইরানের সাথে ভারতের সময়ের ব্যবধান ঠিক দু'ঘণ্টা এগিয়ে। পথে যেতে যেতে নজরে এলো অত্যাধুনিক উড়ালপুল সারা শহর জুড়ে। আর ইরাণিরা কোন কিছুই আমদানি করে না বাইরের দেশ থেকে। তাই বিদেশী গাড়ি একদমই চোখে পরলো না আমার। তেহরাণে কোম্পানির হেডকোয়ার্টার্সে
রিপোর্ট করে প্রায় দিন দশেক ওখানে থেকে ঘরোয়া উড়ানে কর্মস্থল আসালরুইয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। তেহরাণ বা আশপাশের শহর ইস্পাহান কিংবা সিরাজে কোন বড় কারখানা নেই। তাই কোন পরিবেশ দূষণও সেখানে নেই। আর আসালরুইয়া
এবং বন্দর আব্বাস হোলো ইরাণের ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন। এইসব ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে যেতে হোলে পাহাড় এবং সমুদ্র পেরিয়ে যেতে হয়। এইসব জায়গা তৈরি হয়েছে পারস্য উপসাগরের সৈকতে জমি রিক্লেইম মানে ভরাট কোরে। প্রায় চার থেকে পাঁচশ কিলোমিটার বিস্তৃত সেই সৈকত। ওপারে দুবাই শহর দেখা যায় আবছা ভাবে। এইসব ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্টে ফ্লেয়ার স্ট্যাক অনেক দূরে ।প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের উপর ছেড়ে দেওয়া হয় পাইপলাইন বানিয়ে যাতে পরিবেশ দূষণের শিকার না হয় ওই এলাকার মানুষ। এরকমই স্বাস্থ্য সচেতন ওরা। তেহরাণে দেখেছি হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল। জানতে চাওয়ায় উত্তর এসেছিল এখানে মানুষ অসুস্থ খুব কমই হয়।। শুধু এক্সিডেন্ট এর জন্য কিছু হাসপাতালের ব্যবস্থা আছে সেখানে। আর ইরাণে তিনটে ঋতু। গ্রীষ্ম বসন্ত এবং শীত। জানুয়ারি মাসে এখানে ঝুর ঝুর করে শিউলি ফুলের মতো বরফ ঝরে। আর ওখানে পানীয় জলের কোন আলাদা ব্যবস্থা নেই। সবটাই পাহাড়ি ঝর্ণার জল। পান করার থেকে রান্নার স্নান সব কাজেই সেই জল ব্যবহার করা যায় একদম খাঁটি স্বাস্থ্যকর জল।
সত্যিই ভাবা যায় না। তেহরাণকে
আবার দ্বিতীয় কাশ্মীরও বলা হয়। ওখানে রাস্তার ধারে আপেল গাছ দেখেছি আমি। সত্যিই আমার জীবনের সবচেয়ে ভালো
কর্মস্থল ছিলো সেটা। ওখানে দেখেছি সাদ্দাম হুসেনের ফাঁসির পর স্থানীয় মানুষদের আনন্দ উল্লাস। আমরা যে ক্যাম্পে থাকতাম সেখানে সেদিন ভূরিভোজের ব্যবস্থা হয়েছিলো। আরও দেখেছি ইরাণের লোকেরা বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয় না কারণ ওদের দেশে মিলিটারি ট্রেনিং আবশ্যিক। তাই ওরা সত্তর বছর বয়সেও যুবা। ওখানে আমি কাউকে কথা কাটাকাটি করতে দেখিনি কখনও। আর ওদের ভাষা শুনে মনে হোতো যেন সুর লহরি বয়ে যাচ্ছে। এতসবের মধ্যেও একটাই সমস্যা ছিলো সেটা হচ্ছে ভাষার। যাইহোক ওখান থেকে প্রায় মাস সাতেক বাদে আবার ভারতে প্রত্যাবর্তন করলাম। মানে মুম্বাইতে ফিরে এলাম।
ইরাণ থেকে ফিরে এসে প্রায় মাস তিনেক বাদে আবার সৌদি আরবের পথে পাড়ি দিলাম আমি। এবার ঠিকানা বা গন্তব্যস্থল একটু ভিন্ন। প্রথমে দামাম বিমানবন্দর হয়ে কোম্পানির হেড অফিস আল্ কোবার এ হাজির হলাম আমি। রিপোর্ট করলাম এক আইরিস সাহেবকে। কোম্পানির নিয়ম মত চুক্তিপত্রে সই করে এবং ডাক্তারি চেক্ আপ করিয়ে এবার রওনা দিলাম সৌদি আরবের শিল্প নগরী আল্ জুবেইল এর পথে। এক আমেরিকান প্রজেক্ট ম্যানেজারের সাথে। থাকার ব্যবস্থা ছিল আল্ তামিমি নামে একটি ক্যাম্প এ। সেই ক্যাম্প যেন একটা ছোটখাটো টাউনশিপ আর কি। আমার ঠাঁই হোলো সিনিয়র
একোমোডেশন এ । এখানে কোম্পানিতে একজন বঙ্গ সন্তান মানে কলকাতার বাঙালি আর কি,সেও ছিল।নামটা বোধহয় এস মূখার্জী যদ্দুর মনে পড়ে। যদিও নামটা অনেকটা বড় বলে সাহেবরা মূখার্জীকে ছেঁটে মুখো করে দিয়েছিলো। আর আমাকে সাহেবরা আমার প্রথম নামেই ডাকত। সৌদিতে শুক্রবার ছুটি থাকতো। আর বৃহস্পতিবার কে বলা হতো জুম্মা বার। তো প্রায়ই জুম্মার রাতে আমরা কোম্পানির সহকর্মীদের সাথে শহরে যেতাম কেনাকাটা সারতে। আবার অনেকেই যেতো শুধু ঘুরতে। আর শুক্রবার সকালে মুখো হাজির হতো দু কাপ চা নিয়ে আড্ডা মারতে আমার দরজায়। দরজা খুললে ই দরাজ গলায় গেয়ে উঠতো সে” দাদা পায়ে পড়িরে মেলা থেকে বউ এনে দে, দাদা পায়ে পড়ি রে“। জমিয়ে আড্ডা আর ধূমপান চলতো আর তার সাথে চলত হিন্দি ও বাংলায় গানের সংগ্রহ থেকে আমার সাউন্ড সিস্টেম। আর প্রত্যেক শুক্রবার লান্চে থাকতো স্পেশাল মাটন বিরিয়ানি। ওখানে সকালে ডিউটি আর রাতের ডিনার করতে করতে কিভাবে যে প্রায় চার বছর কেটে গেল তা বোঝাই গেল না। এরমধ্যে ওই ক্যাম্পেই আরেকজন বাঙালির সাথে আলাপ হলো তার নাম ছিল এস চ্যাটার্জী। অন্য আরেকটা কোম্পানিতে সে কাজ কোরতো। একই খাবার খেতে খেতে সব একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো আমাদের। তাই একদিন এক বৃহস্পতিবারে একটা বড় দেখে মাছ কেনা হোলো। কিন্তু রান্না করাটা মুশকিল হয়ে গেলো। কারণ ক্যাম্পের
ক্যান্টিনে রান্না করতে চাইলো না। আর মাছটা নিয়ে আমরা দুজন গেটের বাইরে হোটেলেও চেষ্টা করলাম কিন্তু কেউই পয়সা দিয়েও রান্না করে দিতে রাজি হোলো না। তখন চ্যাটার্জি বলল দাদা চলুন ওটা আমার ফ্রিজে রেখে দি। আর আমার কাছে রান্নার ব্যবস্থা আছে দুদিন থাক তারপর আমি রান্না করে আপনাকে ডাকবো। ভালো কথা তাই ওর কথা মতো দিন তিনেক বাদে চ্যাটার্জি ঘরে গিয়ে বললাম আজ মাছটার গতি করুন তো ভাই। তখন চ্যাটার্জী দেখি মিচকি মিচকি হাসছে আর বলছে সে মাছ কি আর আছে দাদা। ওটা পচে ঢোল হয়ে গিয়েছিল আমি ওই পেছনে ওটাকে ফেলে দিয়েছিলাম। বেড়ালের দল কত আনন্দ করে খেয়েছে দাদা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না আপনি। যাই হোক মাছ ভাজা খাওয়ার স্বাদ সেবারের মতো অপূর্ণই থেকে গেল আমার।
ওই ক্যাম্পে ভারতীয় বলতে দক্ষীণ ভারতীয়ের সংখ্যাই ছিল বেশি যেমন কেরালা ও চেন্নাইয়ের লোক আর কি। আর ভিনদেশীদের মধ্যে ছিল ফিলিপিনি, পাকিস্তানিএবং বাংলাদেশের কিছু মানুষ। তবে বাংলাদেশের লোকেরা বেশিরভাগই ক্যাম্পের সাপোর্টিং স্টাফ হিসেবেই কাজ করতো। যাই হোক এমনি করেই কেটে যাচ্ছিল সময়। মাঝে মাঝে ইনস্পেকশনে যেতাম প্রায় অনেকটাই দূরে। আমার সাথে থাকতো আমাদের কন্ট্রাক্টারের এক ফিলিপিনি ইন্সপেক্টর। আমরা যেমন মাছ খেতে পছন্দ করি ওদেরও মাছ খুব প্রিয় খাবার। তবে ভিন্ন প্রিপারেশন। যাই হোক কাজ শেষে ও আমাকে লাঞ্চের জন্য এক বাংলাদেশী হোটেলে নিয়ে যেতো। ওখানে মৌরোলা মাছের ঝাল, পুঁটি মাছ ভাপে আর পদ্মা ইলিশের স্বাদ আজও মনে পড়ে। আর সবশেষ দিতো একখিলি মিঠে পান। এখনো সেইসব রান্না আর পানের স্বাদ রসনা সিক্ত করে। যাই হোক সব চুরি শেষ থাকে। আবার সৌদির পাট চুকিয়ে কিছুদিনের জন্য কলকাতায় এলাম এবং মাস ছয়েক বাদে আবার মুম্বাইয়ের পথে পাড়ি দিলাম আবার নতুন চাকরির খোঁজে।
এবার প্রায় মাস তিনেক পরে একটা এমএনসি থেকে অফার লেটার পেলাম। প্রথম পোস্টিং হলো ভাইজাগ এর হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম রিফাইনারীর
এক্সপানশন প্রজেক্ট সাইটে। ওখানে জয়েন করার প্রায় একমাস পর আমার পোস্টিং হলো উড়িষ্যার আঙ্গুলে। সেখানে জিন্দাল স্টীল অ্যান্ড পাওয়ার প্ল্যান্টের নতুন কেমিক্যাল
প্ল্যান্টে পৌঁছে গেলাম আমি। আমার সাথে ছিলো আরো একজন উত্তরপ্রদেশের
জুনিয়র ছেলে সেই প্রজেক্ট সাইটে। প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল যেন আমরা কোন ভিন্ গ্রহে পা রাখলাম আর কি। চারিদিকে ঘেরা শুধুই সবুজ বন বাদার। প্রকৃতি মা উজাড় করে সাজিয়ে দিয়েছেন যেন।
কয়েকশো একর জমির উপর ছিল সেই প্রজেক্ট সাইট। তারপর একে একে আরো সব স্টাফেরা এলো দেশের নানা প্রান্ত থেকে। ধীরে ধীরে জমে উঠলো প্রজেক্ট। সময়ের সাথে বেড়ে চললো কাজের গতি। সে তো হতেই হবে কারণ সময় যে সীমায় বাঁধা। যাই হোক মাঝে মাঝেই লোকাল মানে ওখানকার আদিবাসী মূলবাসীদের আক্রমণ লেগেই থাকতো। কারণ মালিকরা কিছু জমি জবর দখল করে নিয়েছিল কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়েই। একবার তো পুরো সাত দিন সব কিছু বন্ধ ছিলো। আমরা থাকতাম জিন্দালের টাউনশিপে। তবে টাউনশিপের প্রশংসা করতেই হয় সে যেন মর্তের মাঝে এক টুকরো স্বর্গপুরী। কি ছিলো না সেখানে। তবুও সেই আদিবাসীদের মারমুখী আক্রমণে সেই টাউনশিপ কম ভোগান্তি হয়নি মানুষের। এমনকি বাচ্চাদের দুধটুকুও পর্যন্ত ওরা বন্ধ করে দিয়েছিলো। শেষে আদালতের হস্তক্ষেপে সমাধান হয়েছিল সেই অবস্থার। তবুও মাঝে মধ্যেই ওরকম ঝামেলা লেগেই থাকতো। প্রথম প্রথম আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়তাম ধীরে ধীরে সবই গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল আমাদের।
এরকম ভাবেই নানান ঘটনার আবর্তে আঙ্গুলের জীবন বয়ে চলেছিল। ওখান থেকে বার তিনেক আমরা পুরী গিয়েছি। একবারের কথা আজও মনে আছে কারণ সেটা ছিলো ৩১শে ডিসেম্বর ২০১১ সাল। আমরা ঐদিন সন্ধ্যেবেলা পুরী পৌঁছে হোটেলে মালপত্র রেখে পুরীর বিখ্যাত দাদা বৌদির রেস্টুরেন্টে খেয়ে এবং বেশ বড় সাইজের স্পেশাল পমফ্রেট ফ্রাই প্যাক কোরে সমুদ্র সৈকতে বসে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশন উপভোগ করছিলাম। কারণ পুরীর সুদীর্ঘ সাগর সৈকতের ধারেই সব হোটেলের সারি। আর ঠিক রাত বারোটা থেকে শুরু হয় বাজীপোড়ানোদিয়ে বর্ষ বরণের উৎসব। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। যাই হোক সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা ভুলে সেই মাছের প্যাকেট ফেলে রেখে এসেছিলাম সি বীচের চেয়ারে। কিছু বাদে যখন মনে পড়ল ফিরে গিয়ে তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। যাই হোক মনটা একটু খারাপ হল সবারই। মুখের গ্রাস কেড়ে নিলে যা হয় আর কি। পরদিন সকালে আমরা রওনা দিলাম চিলকা লেকের উদ্দেশ্যে। মনোরম অভিজ্ঞতা। আমরা ছয় জন মিলে বিকেল পর্যন্ত একটা মোটর বোট ভাড়া করে হ্রদের বুকে ঘুরেছিলাম প্রায় সন্ধ্যা
পর্যন্ত। অবশ্য আমাদের মতো অনেকে মানুষই ছিলেন সেদিন। সেখানে চিলকা লেক আর সমুদ্রের সংযোগস্থলে মোটর বোট থেকে সূর্যাস্তের পড়ন্ত বিকেলে ডলফিন এর খেলা আজও চোখে ভাসে আমার। এইভাবে প্রায় বছর দেড়েক কাটিয়ে আবার স্থান পরিবর্তন হলো আমার। চলে এলাম মথুরা রিফাইনারীতে। ওখানে ও বেশকিছু রোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী আমি। একটি ঘটনা হলো কমল সিং নামে এক পহেলবানের দৌরাত্ম্যের কথা। পহেলবান মানে এক কথায় বাহুবলী আর কি। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমার কর্মজীবনের। প্রায় এক বছর বাদে নানা ঘটনার অবহেল শেষ হয়েছিল আমার মথুরার চাকরি জীবন।
একটা ঘটনা আজও আমার জীবনের পাথেয়। সেটা হচ্ছে জন্মাষ্টমীর রাতে শ্রীকৃষ্ণ জন্মভূমি দর্শন। সন্ধ্যা আটটায় লাইন দিয়েছি আমি লাখ দশেক লোকের ভীড়ে। রাত্রি বারোটায় দর্শন হোলো শ্রীকৃষ্ণের। আর যে ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটা আজও গা ছমছম করা দুর্ভেদ্য আঁধারে মোড়া। লাইনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই সবাই বলে উঠছিল “হাতি ঘোড়া পালকি জয় কানহাইয়া লাল কি।” যাই হোক এরপর আবার “হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনখানে যাবার পালা এলো।”এবারও রাজ্য উড়িষ্যা শুধু স্থান পরিবর্তন হয়ে হল পারাদ্বীপ ইন্ডিয়ান অয়েল রিফাইনারী প্রজেক্ট সাইট।
পারাদ্বীপের এই কোম্পানিটা ছিল একটা কনসালটেন্সি ফার্ম। তখন এই এম এন সির হেড অফিস ছিল ইউ কে তে পরে ওটা চলে যায় ইউ এস এ তে।
যাইহোক শুরু হলো আবার সেই বাঁধা গতের চাকরিজীবন। তবে এখানে ডিউটি টাইম একদম ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা ঠিক সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। যাইহোক এখানেও কিছু ঘটনার সাক্ষী আমি। যেমন জয়েন করার পর প্রথম পুজোর সময় মনে আছে ঠিক ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় আকাশ কালো করে ধেয়ে এলো সাইক্লোন ফাইলিন। পুরো দুদিন চলেছিল সেই ঝড়ের তান্ডব। ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়েই বেশিরভাগ মানুষ যে যার নিজের জায়গায় চলে গিয়েছিলো। শুধু আমরা গুটি কয়েক মানুষ রয়ে গিয়েছিলাম টাউনশিপে। পুরো টাউনশিপের প্রায় হাজার দুই লোকের মধ্যে মেরে কেটে শ’খানেক লোক থেকে গিয়েছিলো আমার মতন। প্রথম দু’দিন কেটেছিল শুকনো খাবার খেয়ে। তবে একটা বাঁচোয়া ছিলো যে পুরো পারাদ্বীপ, পুরী, ভূবণেশ্বরে বিদ্যুৎ না থাকলেও আই ও সি এল এর ইডি র নির্দেশে সারাক্ষণ আপৎতকালীনজেনারেটরের ব্যবস্থা ছিলো। তাই টাউনশিপে ইলেকট্রিসিটির কোন অসুবিধা হয়নি। সেই সাইক্লোনের আওয়াজ আজও অবচেতন মনে অনুভব করি। ৪৮ ঘন্টা বাদে ঝড় কেটে গেলো। জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসতে শুরু করলো। প্রায় দিন কুড়ি লেগেছিলো সবকিছু স্বাভাবিক হতে। পারাদ্বীপের সবচেয়ে বড় বাজার বারবাটিয়া মার্কেট ঝড়ের পর প্রায় দু’সপ্তাহ বন্ধ ছিলো। আর সাইটের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হোতেও প্রায় মাসখানেক লেগে গিয়েছিলো। সাইক্লোনের পূর্বাভাস পেলেই উড়িষ্যা সরকার যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিশেষ করে সমুদ্রের উপকূলবর্তী এলাকার মানুষের সুরক্ষার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ ১৯৯৯ সালে এরকমই এক ভীষন সাইক্লোনে অগুন্তি মানুষের মৃত্যু হয়েছিলো। শুধু এই
পারাদ্বীপেই। সেই ক্ষত আজও দগদগে। তখনও সাইক্লোনের নামকরণের প্রথা চালু হয়নি। এছাড়া বিশেষ ঘটনার কথা আমার স্মরণে নেই আজ। মাঝে মধ্যেই কোম্পানির পার্টি লেগে থাকতো। এভাবেই কেটে গিয়েছিল ২০১৫ র মার্চ মাস পর্যন্ত। কিছু কিছু মানুষের সাথে আজও যোগাযোগ আছে। সবাই নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার বয়সী বেশিরভাগ মানুষই এখন অবসর জীবন কাটাচ্ছে। তবে আমার চলমান জীবনের ধারা আজও বয়ে চলেছে। কখনো কলকাতার দু’কামরার ফ্ল্যাটে আবার কখনও ব্যাঙ্গালোরে মেয়ের বাড়িতে। এটাই আরব সাগর সৈকতে আমার জীবন প্রবাহ। বাঁচার তাগিদে যা এখনও উদ্দেশ্যহীন ভাবে লাট্টুর মতন ঘুরপাক খেয়েই চলেছে অবিরাম।
যার সুতোর রাশ আছে নিয়তির হাতে। আর আমি এগিয়ে চলেছি উদ্ভ্রান্তের মতন দিশাহীন দিশার লক্ষ্যের দিকে।