ভূমিকা 

তবে আফসোসের বিষয় হোলো পন্চান্ন নম্বর বাস অর্ধশতকেরও বেশি সময় জুড়ে পরিষেবা দিয়ে বিগত প্রায় বছর দশেক আগে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আজও পন্চান্ন নম্বর বাস রুট আর বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যমণি হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শিবপুর বি ই কলেজ যা আজ আইআইএসটি নামে পরিচিত এবং ভারতবর্ষের কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত একটি স্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়।

সে কালের বি ই কলেজ বা আজকের আইআইইএসটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব হোলো এটি ভারতবর্ষের দ্বিতীয় প্রাচীনতম ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রথমটি হোলো রূরর্কি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরে এই প্রতিষ্ঠানটিই আইআইটি (রুরকি) নামে পরিচিতি লাভ করে। একই রকম ভাবে, ১৮৫৬ সালে গঙ্গার তীরে সি ই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় যা পরে বি ই কলেজ পূরো নাম বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে পরিচিতি লাভ করে এবং এই প্রতিষ্ঠানটি সেই সময় ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা পরিচালিত। প্রায় আশি বছরের ওপর(১৯২১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত) এভাবে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বি ই কলেজ পরিবর্তিত হয় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি (২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত) নামে পরিচিতি লাভ করে। তারপর সেই বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি ২০১৪ সালের পর থেকে আই আই ই এস টি নামে আত্মপ্রকাশ করে। তবে আজও আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে এই প্রতিষ্ঠানটি বি ই কলেজ নামেই সমীহ আদায় করে চলেছে।

হাওড়া স্টেশন লাগুয়া বড় বাস স্ট্যান্ড থেকে বি কলেজ পৌঁছতে প্রায় আধঘন্টা লাগতো আমাদের। কারণ তখন শিবপুরের রাস্তা খুব অপরিসর ও ঘিঞ্জি ছিলো। বিস্মৃত সেই পন্চান্ন নম্বর বাসে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আঠেরো পয়সা বাস ভাড়া ছিলো। হাওড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে বাস ছেড়ে হাওড়া ময়দান, বঙ্গবাসী সিনেমা, ব্যাতাইতলার মোড়, অলকা ,মায়াপুরী, শালিমার রেলওয়ে ক্রসিং পেরিয়ে বাস পৌঁছতো বি ই কলেজ ফার্স্ট গেট বা সেন্টিনারি গেট টপেজে। তারপরের স্টপেজ ছিল বি ই কলেজ সেকেন্ড গেট। বি ই কলেজের তবে যে এসে বাস কন্ডাক্টরের সেই অসাধারণ উচ্চারণে ”বিক্কলেজ বিক্কলেজ”বলে তারস্বরে চিৎকার আজও মনে রোমাঞ্চ জাগায়। পন্চান্ন নম্বর বাসের স্টপেজ ছিলো বি গার্ডেন যা সেই সময় বোটানিক্যাল গার্ডের নামে পরিচিত ছিলো। এই বোটানিক্যাল গার্ডেন যাকে আমরা ভালোবেসে বটস্ বলতাম বর্তমানে তার নতুন নামকরন “আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন”পরিচয়ে। এই গার্ডেনটি বিশ্ব বিখ্যাত হয়েছে একটি বটগাছের জন্য। এই বটগাছটি প্রায় আড়াইশো বছরের পুরনো। এই বট গাছটির আসল গুঁড়িটি কোন এক ঝড়ে বহুদিন আগেই উড়ে গ্যাছে কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হোলো বট গাছটি আজও তার পরিধি বাড়িয়েই চলেছে। এই বটগাছটি পৃথিবীর প্রাচীনতম বট গাছেদের মধ্যে অন্যতম। তাই দেশের দূরদূরান্ত থেকে এই গাছটিকে দেখার জন্য দর্শনার্থীর ভিড় লেগেই থাকে বিশেষ করে শীতের মরসুমে। বি ই কলেজ ওরফে বেঙ্গলি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কথা বললে পন্চান্ন নম্বর বাস রুট, বোটানিক্যাল গার্ডেন আর গার্ডেনের বিশাল বটগাছের কথা অবশ্যই স্মরণ করতেই হ’বে।

রোমন্থন

এই পর্বে ফিরে দেখতে হ’বে প্রায় বাহান্ন বছর পেছনে। সেটা ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাস আমাদের ফার্স্ট ইয়ার সবে শুরু হয়েছে তখন।

আমরা থাকতাম ডাউনিং হোস্টেলে। যে ডাউন হোস্টেল আজও বি ই কলেজের ঐতিহ্যময় দ্রষ্টব্য স্থানগুলোর একটি। বর্তমানে সেটি ভারত সরকারের একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেই সময় ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের ব্যাচের বেশিরভাগ ছেলেই থাকতো ডাউনিং হোস্টেলে। আমাদের কিছু ব্যাচমেট থাকতো তেরো নম্বর হোস্টেলে যা বর্তমানে পি জি হোস্টেলে রূপান্তরিত হয়েছে।

সেই ডাউনিং হোস্টেলের তিনটি উইং ছিলো সেন্ট্রাল, ও ওয়েস্ট। মাঝখানে বিশাল জায়গা নিয়ে ছিলো সবুজ লন। শুনেছি এই ডাউনিং হোস্টেল ব্রিটিশদের সময়ে ছিল একটি দুর্গ। এই হোস্টেলের গরনও সেই পরিচয়ই বহন করে। যাইহোক ডাউনিং এর পাশ দিয়ে যে পাকা রাস্তাটা চলে গেছে কলেজ বিল্ডিং এর দিকে লন থেকে সেই রাস্তায় ওঠার আগে এক পাশে ছিলো কলেজের থার্ড গেট। সেই থার্ড গেট লাফ দিয়ে পার হতাম আমরা। কারণ ওই গেট বন্ধ করে রাখা হোতো যাতে বাইরের স্থানীয় মানুষ ঢুকতে না পারে। ওই গেট পেরোলে বাঁ হাতে মিনিট দুয়েক হাঁটলেই ছিলো গঙ্গার ঘাট। সেই গঙ্গার ঘাটও অনেক স্মৃতি সাক্ষী। আর ডানদিকে তিন চার মিনিট হাঁটলেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেট যার পাশেই ছিলো পন্চান্ন নম্বর বাস ডিপো।

বর্তমানে সেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের নামকরন হয়েছে “আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক্যাল গার্ডেন।”কলেজের ছেলেরা সেই বোটানিক্যাল গার্ডেনেরও ভালোবেসে একটা নিক্ নেম দিয়েছিল”বটস্”। সেই সময় বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেট সাধারনের জন্য অবারিত ছিলো কিন্তু বর্তমানে বটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকতে গেলে এন্ট্রি ফি গুনতে হয়।

আমরা ফার্স্ট ইয়ারে প্রতি রবিবার কয়েকজন ব্যাচমেট মিলে কাক ভোরে “বটস্”এ যেতাম।

তবে প্রায়ই নজরে পড়তো ওই আলো-আঁধারিতে গঙ্গার মাঝে চড়াতে অতি পুরোনো একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় একজন সাধুকে কৌপীন পড়ে ডিগবাজি খেতে এবং গায়ে গঙ্গামাটি মাখতে।

তবে ফেরার পথে যখন সূর্য উঠে যেত তখন আর সেই সাধুকে দেখা যেতো না। এই দৃশ্য আমরা অনেকবারই দেখেছি আর ভেবেছি ওই সাধু কি খায় কোথায় থাকে কে জানে? সেইসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে আজও অধরা।

এরপর ফার্স্ট ইয়ার থেকে আমরা সিনিয়র হোস্টেলে চলে এলাম। এই হোস্টেলের নাম ছিল আমাদের সময়েনয় নম্বর আর বর্তমানের হিক্স(HIX)। সেকেন্ড ইয়ারে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ডাউনিং হোস্টেলে কোনো ইলেকট্রিক ফ্যান ছিলো না। গঙ্গার ঠান্ডা বাতাসই ছিলো গরমকালে আমাদের কাছে প্রকৃতির আশীর্বাদ। কিন্তু এইসব সিনিয়র হোস্টেল গুলোয় প্রত্যেক ফ্লোরে একটা করে স্টাডি রুম থাকতো যে রুমগুলো মাপে একটু বড় হত এবং দু’খানা করে ইলেকট্রিক ফ্যান থাকতো।

এই নয় নম্বর হোস্টেলে বা বর্তমানের হিক্স এ আমরা তিন বছর কাটিয়েছি। এক একটা বছর নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হয়েছি আর এক একটা করে উপরের ফ্লোরে থাকার সুযোগ পেয়েছি আমরা।

এইসব অনুষ্ঠানগুলো ছিল চার তলা।

এই ৯ নম্বর হোস্টেলের কাছেই ছিলো বি কলেজের সেকেন্ড গেট। সেই গেট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তা পার হলেই কয়েকটা দোকান ছাড়ালেই ছিলো জ্যাঠামশাইয়ের মিষ্টির দোকান। সেই মিষ্টির দোকানের কিছু মিষ্টির ছাদ আজও জিভে লেগে আছে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল গরম কচুরি আর সিঙ্গারা। আমরা জনপ আছে ব্যাচমেট সেই দোকানে একসাথে যেতাম। প্রথমে কচুরি অথবা সিঙ্গারা কে তারপর চায়ের অর্ডার দেওয়া হোতো।

রবিবার সকালে ওই দোকানে অনেক মানুষের ভিড় হোতো। আমরা পাঁচজন গেলে খাওয়া শেষ করে একজন একজন করে হাত ধুতে বেরিয়ে আসতাম। আর সবার শেষে যে থাকতো তাকেই ধরতো দোকানের লোকেরা দাম মেটানোর জন্য। পরে অবশ্য আমরা সেই পাওনা আমাদের ব্যাচমেটকে মিটিয়ে দিতাম। তবে সেটাই ছিল সেই সময়ের একটা মজা আর কি!

সেই সময় আমাদের সিনেমা দেখতে যেতে হতো পন্চান্ন নম্বর ধরে মায়াপুরী, অলকা, বঙ্গবাসী কিংবা ঝরনা অথবা পার্বতীতে তবে সবগুলো হলই ছিলো বেশ দূরে। আমাদের সেই কষ্ট লাঘব হয়েছিলো যখন আমরা থার্ড ইয়ারে সেই সময় লিপি সিনেমা চালু হওয়ার পরে। আজও মনে আছে লিপির প্রথম সিনেমা ছিলো উত্তম কুমার ও অঞ্জনা ভৌমিক অভিনীত ছবি “রৌদ্র ছায়া”এবং হিন্দী সিনেমা ছিলো “মনোরঞ্জন”যে ছবির হিরো ছিলো শাম্মী কাপুর এবং হিরোইন জিনত আমন। শাম্মি কাপুর সেদিন ওপেনিং ডে ওপেনিং শোতে এসেছিলেন ছবির মুহরতে। আমাদের কলেজের অনেকেই কেউ সাম্যের চুল বা কেউ তার পাঞ্জাবির ছেঁড়া টুকরো স্মৃতি হিসেবে নিয়ে এসেছিলো। এই লিপি সিনেমা বি ই কলেজের ছাত্রদের কথা ভেবেই তৈরি হয়েছিলো। কারন আমরা নাইট শো মানে ন’টা বারোটা দেখতেই পছন্দ করতাম তাও আবার একদম ফ্রন্টরো তে পঁচাত্তর পয়সার টিকিট কেটে। যেদিন নাইট শো হাউসফুল থাকতো কলেজের ছেলেরা গেলে হল কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত চেয়ার পেতে তাদের বসার ব্যবস্থা করে দিতো।

আমরা যখন থার্ড ইয়ারে উঠেছি সেই ১৯৭৪ সালে জর্জ ফার্নান্ডেজ এর ডাকে সারা ভারত রেল ধর্মঘট হয়েছিলো। এই ধর্মঘটের দ্বিতীয় সপ্তাহে হঠাৎ আমাদের কিছু ব্যাচমেট পকেটে অল্প কিছু টাকা নিয়ে বিনা টিকিটে রেল যাত্রা করে কেউ গিয়েছিল এলাহাবাদ কেউ গিয়েছিল পুরী আবার কেউবা দিশাহীন ভাবে কানপুরের উদ্দেশ্যে। ওরা সবাই ভেবেছিলো রেল ধর্মঘট বেশ কিছুদিন চলবে। কিন্তু ঠিক কুড়ি দিনের মাথায় সেই ধর্মঘট তুলে নেওয়া হয়েছিলো। তাই যারা একটু দূরে গিয়েছিল তাদের বেশ ভোগান্তির সম্মুখীন হ’তে হয়েছিলো। কারণ একে তো টিকিট কাটার টাকা নেই আর বেশিদিন থাকার মতো রেস্তও পকেটে ছিল না ওদের। সেই বিপদে সেই সব বিদেশ বিভুঁইয়ে যেসব সিনিয়ররা চাকরি করতো তাদের ঠিকানা জোগাড় করে সেইসব সিনিয়রদের সাহায্য নিয়েছিল আমাদের ব্যাচমেটরা সেই দুঃসময়ে।

এবার আরো কিছু স্মৃতি যা মনে শিহরণ জাগায় তা হচ্ছে র‍্যাগিংএর স্মৃতি। আমাদের সময়ে র‍্যাগিং ছিল ফিজিক্যাল ও মেন্টালের সমন্বয়।

এই যেমন বাড়ি থেকে আসার সময় আমরা সবাই একটা করে টিনের সুটকেস নিয়ে আসতাম আর তাতে থাকতো যাবতীয় ব্যবহার্য জিনিসপত্র। হঠাৎ কোনো সিনিয়র এসে জিজ্ঞেস করতো “এই তোর বাক্সের ওজন কতো রে?’”আর তখন সেই প্রশ্নের উত্তরে সরলমতি আমরা উত্তর দিতাম”কতো আর হ’বে পনেরো কেজি হবে বা বড়জোর বিশ কেজি।”সিনিয়রের তাৎক্ষণিক প্রশ্নমান ছিলো ”তোর ওজন কত?”নবীন আমরা উত্তরে বলতাম“ পঁয়তাল্লিশ বা বড়জোর পঞ্চাশ কেজি।” তখন ঠান্ডা গলায় সেই সিনিয়র আদেশ করতোবাক্স মাথায় নিয়ে ওঠবোস করতে। নিরুপায় আমরা মুখ বুঁজে আমরা সিনিয়রের আদেশ তামিল করতাম। বেশ কিছুক্ষণ বাদে প্রশ্ন আসতো”ওয়ার্ক ডান কত হোলো?”, আমাদের উত্তর ছিলো “ওয়ার্ক ডান নীল কারণ ডিস্প্লেসমেন্ট জিরো তাই।”তখন আদেশ হোতো “ওঠবোস চালিয়ে যা।”

এইভাবে ওঠবোস চালিয়ে যেতে যেতে প্যান্ট শব্দ করে পেছন থেকে ফেটে গেলে ওঠবোস থেকে নিষ্কৃতি মিলতো আমাদের। আসলে উত্তর ছিল। ওয়ার্ক ডান নীল কিন্তু এনার্জি লস হচ্ছে।

এর পরবর্তী পর্যায়ে নব্বইয়ের দশকে ঐরকম বাক্স ছাড়াওঠবোস করানো হতো এবং এক থেকে দশ পর্যন্ত গোনার পর ১০.১,১০.২---গুনে যাওয়া হোতো যতক্ষণ না সিনিয়রের মনে হোতো যে এবার ছেড়ে দেওয়া হোক।

আরো এক রকম র‍্যাগিং ছিলো এটা অবশ্য মেন্টাল। যেমন কোন বিখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত”বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে লও----”এই গানটি আর ডি বর্মনের”মনে পড়ে রুবি রায়---”

এর সুরে গাইতে হ’বে, এইরকম আর কি। এসব পুরণো কথা নিমন্ত্রণ করেই সময় তার আপন ধারায় নিজের খেয়ালে বয়ে চলেছে। যা আজও মনকে দমকা হওয়ার মতন দোলা দিয়ে যায়।

স্মৃতি বিস্মৃতি

কিছু কিছু কাহিনী আজও বি কলেজের বাতাসে ভেসে বেড়ায় কিংবা হোস্টেলের দেওয়ালে কান পাকলে চুপিসারে শোনা যায় নির্জন দুপুর কিংবা গভীর নিশীথে। আবার অনেক কাহিনী আজ হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির পর্দার পেছনে। এই পর্বে সেরকমই দুটো কাহিনী আমার অতীত স্মৃতি হাতরে নির্ভেজাল মজার রসদ হিসেবে পরিবেশন করাই মূল উদ্দেশ্য।

রাধার কাছে ধার

আমার কলেজ জীবনের কিছু কিছু টুকরো ঘটনা আছে যেগুলো গল্প হোলেও স্মৃতি। একদিন এক উদ্বিগ্ন বাবা হন্তদন্ত হয়ে হোষ্টেলে এসে হাজির।আর তারস্বরে চেঁচিয়ে ছেলেকে বকে চলেছেন কুলাঙ্গার তোমাকে এইজন্য ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পাঠিয়েছি আমি।মাসে মাসে আমার রক্ত জল করা টাকাগুলো জলে যাচ্ছে।আর তুমি কি না রাধার কাছে ধারের খাতা খুলে বসে আছ?এই মারে কি সেই মারে আর কি।নেহাৎ বড় ছেলে বোলে তখনো গায়ে হাত দেন নি।আর ছেলেটা মরিয়া হয়ে বোঝাবার চেষ্টা করে চলেছে যে ব্যাপারটা উনি যা ভাবছেন তা একদমই নয়।

কিছুক্ষণ পর পিতৃদেবের মেজাজ একটু ঠান্ডা হলে ছেলে বলল চলো তোমাকে রাবার কাছে নিয়ে যাই। বাবা ও বলল ঠিক আছে চলো দেখি রাধাটাকে। এবার ছেলে বাবাকে নিয়ে একটা সেলুনের কাছে হাজির হলো। সেই সেলুনটা ছিল। রাধার দোকান। এতক্ষণে বাবা নিশ্চিন্ত হোলেন এবং ব্যাপারটা পরিষ্কার যে ছেলে বকে যায়নি।

বাবাটি তখন মুচকি হেসে রাধার পাওনা গন্ডা মিটিয়ে দিলেন।

এমনি কতো মণিমুক্তো লুকিয়ে আছে মনের মণিকোঠায় উঁকি দিয়ে দেখলেই অন্যরকম ভালোলাগার আবেশের অনুভূতি হয়।

লগ টেবিলের পায়া

আমাদের বি ই কলেজে সবসময়ই প্রত্যেক ব্যাচে কিছু ভিন্ প্রদেশের ছেলেরা পড়তে আসতো। তেমনি একজন মাড়োয়ারী ছেলেও পড়তে এসেছিলো।

যদিও এই কাহিনীটা আমার এক সিনিয়র দাদার কাছে শোনা। এটা কিন্তু একদম নির্ভেজাল সত্যি ঘটনা।

আমরা সেই সময় পঁচাত্তর পয়সার টিকিট কেটে একদম সামনের রোতে বোসে সিনেমা দেখতাম আর সিগারেট বলতে চারমিনার নাহলেউডবাইনই ছিলো আমাদের ব্রান্ড তাও আবার তিনচার জন বন্ধু মিলে কাউন্টার টেনে। তাই সব খরচটরঢ করেও আমাদের তেমন একটা অসুবিধে হয়নি কোনোদিন। টানাটানি তো লেগে থাকতোই।

কিন্তু মে ছেলেটিকে নিয়ে এই কাহিনী তার একটু আমিরী চাল ছিলো।সে মাঝে মাঝেই এসপ্লানেড যেত সিনেমা দেখতে, সেখানে নামী রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়াও করতো আর ক্যাপষ্ট্যান সিগারেট ছিলো ওর ব্রান্ড। ফলে খরচ গেছে বেড়ে। বাবা যে মাস খরচা হিসেব কোরে দিতেন তাতে কুলোতোনা কিছুতেই।প্রত্যেক মাসে এটাসেটা বলে বাবার কাছথেকে এক্সট্রা টাকা চাইতে হোতই ওকে। ইতিমধ্যে সব রকম বাহানাই হয়ে গেছে। এবার নতুন কিছু বলতে হবে এক্সট্রা টাকার যে খুউব প্রয়োজন। অনেক ভেবে চিন্তে সে বাবাকে চিঠিতে লিখলো যে ল্যাবরেটারিতে এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে লগটেবিলের পায়া ভেঙে গেছে তাই নতুন লগটেবিল কিনতে হবে কিছু টাকা পাঠাতে।না হলে সমূহ বিপদ আর কি।

চিঠি পেয়ে তো পিতৃদেবের টেনসনে মাথার চুল খাড়া হোয়ে গেলো। ভদ্রলোক পরদিনই প্রিন্সিপালের কাছে হাজির হোলেন। সব শুনে প্রিন্সিপাল বললেন আইয়ে আপকো লগটেবিল দেখাতা হু। উনি একটা পাতলা বই টেবিলের উপর রেখে আস্তে কোরে বললেন ইসকা নাম হ্যায় লগটেবিল। লগটেবিলের আসল চেহারা দেখে ভদ্রলোক আর এক মুহূর্তও প্রিন্সিপালের ঘরে বসেন নি মাথায় হাত দিয়ে একছুটে বেড়িয়ে গেলেন। ছেলেটির কপালে যে বেশ কয়েক ঘা জুটেছিলো তাতো সহজেই অনুমেয়।

অশান্ত সত্তর

আ্যডমিশন তো হয়ে গেল শিবপুর বি ই কলেজে। বেশ আনন্দই হচ্ছিল আর বেশ কিছুদিন মানে এই মাস দুয়েক ধরে আর কি সেই আনন্দের ছিল যতদিন না হোস্টেলে যাওয়ার ডাক এসেছে। অবশেষে এলো সেই দিন দশই ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল। এক অজানা আনন্দের সাথে একটু ভীতিও ছিলো কারণ তখন র‍্যাগিং নামে ব্যাপারটা শোনা হয়ে গিয়েছিল। নানা রকম রোমাঞ্চকর ভয় ধরানো গল্প শুনে একটু উত্তেজনা বা রোমাঞ্চ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক। সে যাক সেই দশই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে একটা টিনের ট্রান্ক আর বেডিং মানে বালিশ,তোষক আর মশারি বেঁধে লোকাল গার্জেন জামাইবাবুর সাথে উঠে পড়লাম ডাবল ডেকার বাস এইট বি বাসের দোতলায় জানালার পাশে যাদবপুর এইটবি স্ট্যান্ড থেকে। সেই বাসস্ট্যান্ডের নাম আজও পরিচিত এইট বি বাস স্ট্যান্ড নামে শুধু সেই এইট বি বাসটাই আজ আর নেই। বাস চলল হাওড়া স্টেশন লাগোয়া হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আপাতত সেটাই প্রথম গন্তব্য।

তারপর হাওড়া পৌঁছে সেখান থেকে পন্চান্ন নম্বর বাসে চেপে বসলাম যার লাস্ট স্টপেজ বোটানিকাল গার্ডেন বা ছোট করে বি গার্ডেন। কন্ডাক্টর বি গার্ডেন বি গার্ডেন করে যাত্রী ডাকতে ব্যাস্ত। আমার মত আর ও দু চারজন ছিল সেই বাসে কিন্তু কেউ কাউকে চিনতাম না বলে আর কথা হয়নি। তারপর নামলাম কলেজ ফার্স্ট গেট বা সেন্টেনারি গেটে। ওখান থেকে অফিসিয়াল এন্ট্রি করে জানা গেল আমার হোস্টেল হল ডাউনিং হল। প্রথম দর্শনে তো চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার যোগাড় এ তো হোস্টেল নয় এটা যে আস্ত একটা ফোর্ট আর পাশেই থার্ড গেট এক লাফে গেট পেরোলেই রাস্তা আর ওপাশে বোটানিক্যাল গার্ডেন। যাই হোক হলে সেন্ট্রাল উইং এর একটা ঘরে আমার থাকার জায়গা। ঘর তো নয় একটা ছোটখাটো খেলার মাঠ যেন যার চার কোনায় চারটি লোহার রড লাগানো লোহার সিঙ্গেল খাট।

আর হোস্টেলে ছিল দোতলা। তবে ঘরের উচ্চতা প্রায় দেড়তলা সমান আর ওপরে করি বর্গা। দরজা দিয়ে হু হু করে গঙ্গার ঠান্ডা মুক্ত বাতাস ঢ়ুকছে সে এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি।

একে ভরা ডিসেম্বরের সন্ধ্যা আর তার সাথে গঙ্গার হিমেল হাওয়া আর ওপাশে গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর বকের আলোর মালা দেখা যাচ্ছে। আর সামনে বিশাল সবুজ লন যার তিনদিক ঘিরে বিরাট ডাউনিং হলের কম্পাউন্ড যার তিনটে উইং ইস্ট, ওয়েস্ট এবং সেন্ট্রাল।আর দেখেছিলাম কলেজের সুরক্ষার দায়িত্বে কম্পাউন্ড জুড়ে ছিলো সশস্ত্র সি আর পি এফ।কারন বছর খানেক আগেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি নকশাল আন্দোলনের জোয়ারে বেসামাল হয়েছিল উগ্রবাদী নকশাল আন্দোলনের দাপটে। তবে বাহাত্তরের শেষে সেই আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছিল। তবে তার রেশ কিছুটা তো ছিলোই।আরও একটা ঘটনা মনে আছে তখন ছিল ইমারজেন্সির সময় মিটিং মিছিল একদমই নিষিদ্ধ ছিল সে সময়ে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। কিন্তু কোন একটা ইস্যুতে আমরা কলেজের ছেলেরা মিছিলে হেঁটেছিলাম। পুলিশ শুধুই দাঁড়িয়ে দেখেছিল। সেই মিছিল গিয়েছিল শালিমার রেল ক্রসিং পর্যন্ত।

র‍্যাগিং

বি কলেজের কথা হবে অথচ র‍্যাগিং এর প্রসঙ্গ থাকবে না তা হ’তে পারে না। এটা এরকম লবণ ছাড়া রান্না করার মতনই। তাই এই পর্বে র‍্যাগিং কেন্দ্রিক আমার কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ডালি সাজিয়ে দিলাম।

গোড়ার কথা

সময়টা ছিলো ঠিক যখন পশ্চিমবাংলায় নকশালবাড়ি আন্দোলন স্তিমীত হয়ে গেছে তার ঠিক পরের বছর। কিছুটা হলেও ভয়ের রেশ ছিল তখনও।

যাইহোক ওরই মাঝে জয়েন্টে কোয়ালিফাই কোরে শিবপুর বি ই কলেজের আ্যডমিশন পেলাম। ডিসেম্বরের এক শীতের সন্ধ্যায় বাক্স প্যাটরা নিয়ে কলেজ হোস্টেলে পা রাখলাম লোকাল গার্জেনের সাথে। হোস্টেলের নাম ডাউনিং হল। হোস্টেল না বলে এটাকে একটা দুর্গ বলাই চলে। আসলে ব্রিটিশ আমলে এটা একটা দূর্গই ছিল। কি উঁচু ঘরগুলো আজকালকার দোতলা বাড়ির থেকেও উঁচু। ভেতরে মেন একটা ছোটখাটো খেলার মাঠ। ঘরের চার কোনায় আমরা চারজন আবাসিক। মাথার ওপর তাকালে নজরে পড়ছে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত শতাব্দী প্রাচীন কড়িবর্গা।

পাশের ঘরেই আমার একই স্কুলের সহপাঠী সেও ভর্তি হয়েছে। এটাই আমাদের বড় হওয়ার পরে বাড়ির বাইরে প্রথম রাত কাটানো। আমরা দুজন মেসে ডিনার করে একখানা উডবাইন সিগারেট ধরিয়ে সামনের লনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া খুবই উপভোগ করছিলাম। একটু বাদেই একজন সিনিয়র দাদা এসে বলল কিরে কি করছিস তোরা আমরা বললাম এইতো এবার ঘুমোতে যাব রাত তো হলো সে বলল আরে এখন তো সবে সন্ধ্যে হলো এখন কি ঘুমোতে যাবি তোরা?

সিনিয়র দাদা বলল চল্ তোদের কলেজটা একবার ঘুরে দেখাই কোথায় কি আছে তোদের তো জানতে হবে নাকি। শুরু হলো দাদার সাথে পথ চলা প্রথমে একটা মাঠ পরল দাদা বলল এটা ওভাল তারপর বলল ওই দেখ্ কলেজ বিল্ডিং। তারপর বলল ওই দেখ্সেন্টেনারি গেট, বড়ঘড়ী।

ওই দেখ্ কবরখানা এখানে অনেক সাহেবের কবর আছে। তারপর বলল তোরা যে দিকটায় আছিস সেটা মুচিপাড়া আর এটা সাহেবপাড়া এবার আরো একটা মাঠ দেখিয়ে বলল এটার নাম হোলো লর্ডস বুঝলি।একটু বাদেই আমরা একটা হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওই সিনিয়র দাদা বলল এই হোস্টেলটার নাম কি জানিস্? এটার নাম হোলো রিচার্ডসন হল। এবার হোস্টেলের গেটের সামনে পৌঁছেই সিনিয়র দাদাটির চোখমুখ পাল্টে গেল কিছু বিশেষণ যোগ করে বলল ঢোক্ এবার। ভেতরে দেখি আরো তিন চার জন সিনিয়র দাদা আমাদের জন্য ওত পেতে বসে আছে আর আমাদের মতো আরও দুজন ফ্রেসার। ব্যাস শুরু হয়েগেল র‍্যাগিং।

পুরোদমে র‍্যাগিং

রিচার্ডসন হোস্টেলের দোতলার একটা ঘরে আমাদের দুজনকে ঢ়ুকিয়ে দিয়ে ওই সিনিয়র দাদাটি বললো এই নে আরো দুটো নতুন মোর্গা দিয়ে গেলাম।

এবার শুরু হলো পরিচয়পর্ব।নাম কি,কোন্ স্কুল কোথায় থাকা হয় এইসব আর কি।কিন্ত অতিসাধারণ এইসব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়েও কেমন যেনো ভয়ভয় কোরছিলো।কারণ ওই সিনিয়র দাদাদের আঢার আচরণে কেমন যেন আধুনিক তান্ত্রিক তান্ত্রিক লাগছিলো। ওদের সেই কথা বলার ষ্টাইল মুখের এক্সপ্রেশন আর ভাষার থ্রোয়িং অতিসহজেই বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ছিলো আমার মতো ওই চারজন সদ্য আগত মোর্গারূপী ফ্রেসারের। আমার সহপাঠী বন্ধুটি বোধহয় কোন অভিজ্ঞ পরামর্শ দাতার কাছ থেকে আগের থেকেই কিছুটা আঁচ কোরতে পেরেছিলো কি হোতে পারে। তাই ও ডান পায়ে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে রেখে ছিলো আগে থেকেই।

এসব তো ছিলো ট্রেলার এবার শুরু হলো পিকচার।

দাদারা বল্লো "তোরা চারজন জোরায় জোড়ায় মূজরো করবি বুইলি"। সাথে সাথে আমার স্কুলের সহপাঠীটি বলে উঠলো "আমার না ডান পায়ে ফুটবল খেলতে গিয়ে মোচড় লেগেছে এই দিন দুয়েক আগে ঠিকমতো হাঁটতেই পারছিনা কি ব্যাথা যে করে। এইতো ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে"।

এক দাদার দয়ার শরীর ইমিডিয়েট বলে দিলো আমাদের নাচ কোরতে হবে না তবে ছাড়ও নেই ঐ বন্ধুটিকে নির্দেশ দেওয়া হোলো পাশের ঘরের সিনিয়র দাদার মশারীর একটা কোনা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে যতক্ষণ সে ঘুমোয় আরআমাকে বলা হোলো তুই সীমলা চলে মা। মানে টেবিলের তলা আর কি। আমরা তো প্রাণ ফিরে পেলাম যাক্ বাবা নাচানাচির হাত থেকে তো অন্তত রেহাই পাওয়া গেল।যদিও সীমলায় মশার উপদ্রব ভীষণই ছিলো। তবুও নাচের কাছে এতো নস্যি ছাড়া আর কি।

যাই হোক সীমলায় রোসে বোসে আর দূজনের অবস্থা দেখে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেই রাতে ওদের দিয়ে রাধাকেষ্ট থেকে শুরু কোরে অতি আধুনিক টুইষ্ট নাচ তাও আবার দাদাদের সিটি সংগতের সাথে সেযে কি হৃদয় বিদারক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাক্ এই ভাবে যখন ভোর চারটে বেজে গেছে মুজরো শেষ হোলো। এবার এক দাদা বলে উঠলো আরে তুই যে সীমলেয় ছিলি ভুলেই মেরে দিয়েছিরে।জোর বেঁচে গেলি নাচের হাত থেকে। মনে মনে বলি কি বরাত জোর এ যাত্রা বেঁচে গেলাম আমার পূন্যাত্মা পূর্ব পূরুষদের আশীর্বাদে।

পরে সেই সিনিয়র দাদাই যে আমাদেরকে হষ্টেলে পৌঁছে দিয়ে গেলো।কি সিনসিয়ারটি আর কি গুরু দায়িত্বজ্ঞান! সত্যিই কুর্নিশ কোরতে হয় ওই দাদাদের। কে জানে কোথায় আছে সেইসব সুবর্ণ হৃদয় মহান আত্মা মহামানবেরা।

এই ছবিটি ছিল কলেজ জীবনের প্রথম রাতের সালতামামি।

র‍্যাগিং এর মাঝে

কলেজ জীবনে প্রথম রাতে রিচার্ডসন হোস্টেলের ঐ ঘটনার পর আমরা আরো সাবধান হোয়ে গিয়েছিলাম। বিকেল বেলা সেকেন্ড হাফের ক্লাসের পর আমরা টিফিন কোরেই গঙ্গার ঘাট অথবা বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরতে চলে যেতাম রুমে থাকা আ্যভয়েড কোরতে।আর যদি বা কখনো সিনিয়র দাদাদের আওয়াজ পেতাম হোষ্টেলের ভেতরের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ছাদে লুকিয়ে থাকতাম যতক্ষণ না ওরা চলে যায়।তার ওপর ওই কদিন আটটা এগারোটার নাইট শো ছিল বাধা। সাতটার সময় হোষ্টেল থেকে বেরিয়ে আমরা তিন চারজন মিলে চলে যেতাম সিনেমা হলে।তথনও লিপী সিনেমা হল তৈরী হয়নি।আমরা এই অলকা,মায়াপু্যী আর বঙ্গবাসী পর্যন্তই ছিল আমাদের গতিবিধি।

তাতেও নিষ্কৃতি ছিল না। আমরা রাত করে হোষ্টেলে পৌঁছে ঢ়েকে রাখা খাবার খেয়ে কোনো রকমে ডিনা্র শেষ কোরে ঘুমের জোগাড় করতাম।

এতোকিছু কোরেও ছাড় পাওয়া যেতো না দাদাদের র‍্যাগিং এর হাত থেকে। আসলে অতি পুরোণো আমলের ওই ঘরগুলোতে একটা করে বেশবড় জালদেওয়া জানালা ছিলো।আর মশারী খাটিয়ে অতরাতে শুয়ে পড়ার পর ঘুমের আমেজ যখন সবেমাত্র এসেছে সামনে্র দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ আর সুগম্ভীর নির্দেশ দরোজা খোল দরোজা খুলে বেড়িয়ে আয়। কিন্তু আমরাতো ঘুমের ভান কোরে শুয়ে আছি কোন আওয়াজ করছিনা। বেশিক্ষণ না মিনিট পনেরো এরকম চলার পর পেছনের জানালা দিয়ে লোহার স্টিক ঢুকিয়ে মশারী তুলে পায়ের তলায় রাম খোঁচা।আর কি এবার খুলছি খুলছি বোলে তারাতারি দরোজা খুলেই দেখি ওই রাতের অন্ধকারে এক নিকস কালো সিনিয়র দাদা লাল টি শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সাথে আরো কয়েকজন দাদাকে নিয়ে।পরে জেনেছিলাম ওকে সবাই দাদা বোলে ডাকে। সুইমিং চ্যাম্পিয়ান ওই দাদা। প্রথমেই প্রশ্ন কিরে খুব চালাক না এতক্ষণ ঘুমের ভান করা হচ্ছিল। নে এবার লাইন কোরে দাঁড়িয়ে পড় দেখি।

আমাদের য়ধ্যে একজনের বূকের লোমে একটু পাক ধরেছিল ওই দাদা ওর নাম জানতে চাইলে ও ওর নাম যেই না বলেছে সবাই তো হেসেই কুটিপাটি।ওরা বললো "বুইলি আজ থেকে তোর নাম হোলো দাদু"। এক এক কোরে সবাইকার নামকরণ হোলো।সেই থেকে নিক্ নেম চালু হোয়ে গেলো ওই দাদাদের সুললিত বচন। আর তার পরও অনেক কিছু এই যেমন মাথায় বাক্স নিয়ে ওঠবোস করা মানে ওয়ার্ক ডান জিরো, আলমারির ওপর থেকে দাদাদের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি। কিন্তু বাক্স নিয়ে ওঠবোস করতে গিয়ে আমাদের এক ব্যাচমেটের প্যান্ট ফেটে যাওয়ার পর সেরাতের মতো ছাড়া পেলাম আমরা। তারপরও কিছু লুকোচুরি কিছু ধরাপরে যাওয়া এভাবে দুহপ্তা কাটার পর ফ্রেসারস ওয়েলকাম হোয়ে যাওয়ার পর র‍্যাগিং পর্বের ইতি। সেই র‍্যাগার দাদাই পরে নিজের ভাইয়ের থেকেও আপন ছিলো।মে কোন অসময়ে খবর পেলেই এসে ত্রাতার ভূমিকায় পেয়েছি সেই লৌহ কঠিন দাদাকে।

সেই নিক নেম আজও আমাদের অলন্কার বন্ধুরা আজও দেখা হোলে নিকনেম এই ডাকি। এখানেই দাড়ি টানছি র‍্যাগিং কাহিনীর।

শিবপুরের শিবরাত্তির

প্রথম বর্ষে যখন আমরা ডাউনিং হোস্টেলে থাকতাম যেমন আমরা সেন্ট্রালে ছিলাম।তার আবার দুটো ভাগ ছিলো।এক একটা ভাগকে উইং বলা হোত।প্রত্যেক উইং এর একজন কোরে ব্যারাক সার্ভেন্ট ছিলো।যেমন আমাদের ছিলো গিরিদা।সে আমাদের সকালের জলখাবার বিকেলের টিফিন আর তখন তখন চা এর ফরমাইশ মেটাতো।আর এদের অনেক গুণের মধ্যে একটা বড় গুণ ছিল যে ওরা খুব ভালো inসিদ্ধি বানাতে পারতো।

আর শিবপুরে শিবরাত্রিতে শিবপূজো খুব ধুমধাম করেই পালিত হোতো।প্রত্যেক সিনেমা হলে রাত্রিবেলা ননষ্টপ তিনটে শো চলত শিবরাত্রি যেন নিদ্রাহীন কাটে।আর কলেজের বাইরে শুনেছি ক্ষীরের শিবঠাকুরও পুজো হোতো।সে যাই হোক প্রথম বর্ষে আমাদের গিরিদারা যে শিবপূজো করে সেখানে মানে ডাউনিং এর মধ্যেই আমরা অনেকেই গিয়েছিলাম।আর গিরিদাদের অনুরোধ রাখতে অন্তত দুগ্লাস সেই সিদ্ধির শরবৎ পান কোরে ছিলাম আহা যেন অমৃত।সেই সূধার স্বাদ আজও মনে পড়লে শিহরণ জাগায়।আমরা জনাছয়েক ছিলাম দলে। অনেকেই ছিলো। তাদের মধ্যে "ভ্যানের"নামটা আজও মনে পড়ে।ও আজ আর আমাদের মাঝে নেই।ও ছিলো বেশ লম্বা আর পা দুটোও বেশ লম্বা তাই ওর চটি জোরাও ছিলো তুলনায় বেশ বড়।আর সেই সময় হোষ্টেল সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন কামদাবাবু। উনি দোতলার একটা দিকে ফ্যামিলী নিয়ে থাকতেন উনি আমাদের ক্লাসও নিতেন।সেই স্যারও কয়েক বছর আগে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃত লোকে পাড়ি দিয়েছেন।

এদিকে সিদ্ধির সরবৎ খাওয়ার সময়তো বোঝা যায়নি কিন্তু ঘন্টাখানেক বাদে নেশা চড়ে গেছে।এ নেশা একদম নিরামিষ নেশা কোন গন্ধটন্ধ নেই। কিন্তু যা মনে হবে তার করেই ছাড়বে।তখন আমাদের মাথায় চাপলো যে আজ রাত্তিরে কামদাবাবুর দরোজায় লাথি মারতে হবে। তখন রাত বেশ গভীর। তারপর আর কি ভাবনা রূপ দিয়ে আমাদের মধ্যে একজন সজোরে লাথি মারলো কিন্তু দরোজা তো ভেতর থেকে বন্ধ খুলবে কি কোরে? কিন্তু আমাদের মাথায় তখন রোখ চেপে গেছে দরজা খুলতেই হবে সিদ্ধির নেশা যে ইতিমধ্যেই চড়ে গ্যাছে।আর নিজেদের সিংহ শাবকবলে মনে হচ্ছে আর কি। আবারও আর একজন সজোরে লাথি মারলো তাও দরজা খুললো না। এদিকে দুদুবার দরোজায় শব্দ শুনে স্যার কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিলেন।উনি ভেতর থেকে আলতো কোরে ছিটকানি নামিয়ে রেখে ছিলেন ব্যাপারটা কি ঘটছে দেখার জন্য।

আর তৃতীয় বার দরজায় লাথি মারতে এগিয়ে এলো আমাদের ভ্যান। সজোরে লাথি পরতেই দরোজা গেল খুলে।আর ভ্যান তো ঘরের ভেতরেই ঢ়ুকে গেলো। এতক্ষণে আমাদের সিদ্ধির নেশা উবে গেছে। আমরা সবাই কোনরকমে পড়ি কি মরি করে দৌড়ে যে যার ঘরে ‌এসে হাপছেড়ে বাঁচলাম। কিন্তু বিপদ হ্যেলো অন্যযায়গায়। তাড়াতাড়ি পালাতে গিয়ে ভ্যানের এক পায়ের হাওয়াই চটি স্যারের ঘরে রয়ে গিয়েছিল।

পরদিন ছিল রবিবার সকাল হতেই স্যার আমাদের উইং এর সবাইকে ডেকে আগের দিন রাতের ঘটনা যলে কারা কারা দলে ছিল জানতে চাইলেন।সব্বাই চুপ একদম পিনভ্রপ সাইলেন্স সব সিংহ শাবকদের বুক তো দুরু দুরু কাঁপছে তখন। পাঁচ মিনিট নীরবতার পর স্যার বললেন আমি জানি একজনকে সেও কালকের রাতের ওই দলে ছিলো। এবার উনি রহস্য ফাঁস কোরে সেই খোয়া যাওয়া হাওয়াই ঢটিটা দেখিয়ে এটাতো ওর বলে ভ্যানের নাম নিলেন।ব্যাস তারপর আর আমাদের স্বীকার না করে আর উপায় ছিলো না।স্যারও আমাদের সাবধান করে ছেড়ে দিয়ে ছিলেন।কোন সিরিয়াস ষ্টেপ নেন নি।সেও এক দিন ছিলো।

বাস ভাড়া

একপয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ানোর জন্য ১৯৫৩ সালের ছাত্র আন্দোলন আজও বাঙালির স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছে। শোনা যায় সেই ছাত্রআন্দোলন চলেছিল প্রায় একমাস। কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল সেই সময়।আজ আমি মে ঘটনার কথা আলোচনা করতে চলেছি সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শুধু আমার মতো বি ই কলেজ ক্যাম্পাসের কিছু আবাসিক ছাত্র। সেই সময় যদ্দুর মনে পরে আমার থার্ড ইয়ার চলছে।

সেই সময় শিবপুর বি ই কলেজ যেতে হলে হাওড়া স্টেশন অথবা যে কোন যায়গা থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে এসে হাওড়া স্টেশন থেকে একমাত্র পরিবহন ছিল ৫৫ নম্বর বাস। সেই বাস আজও চলছে হাওড়া স্টেশন থেকে লাষ্ট ষ্টপেজ বি গার্ডেন অব্দি। বি গার্ডেন এর ঠিক দুই ষ্টপ আগে ছিল ফার্ষ্টগেট আর তার পরেই সেকেন্ড গেট ষ্টপেজ।আর ওই বাসটার কন্ডাকটার হাওড়া বাসষ্ট্যান্ড থেকে হাঁক পারতো বিক্কলেজ বিক্কলেজ বোলে।ওই বাসটিতে বেশীরভাগ যাত্রীই থাকতো বি ই কলেজের। ভাড়া ছিলো ১৮ পয়সা। সেবার হঠাৎ করে দুপয়সা বাড়িয়ে কুড়ি পয়সা করে দিল। সেদিন সকালের বাসে কলেজের এক ষ্টুডেন্ট আসছিল। শালিমার রেল ক্রসিংয়ে বাস কন্ডাক্টর ছেলেটির কাছে ভাড়া চায়। ছেলেটি যথারীতি গুনে গুনে আঠেরো পয়সা এগিয়ে দেয় কিন্তু বাস কন্ডাক্টর বলে ভাড়া বেড়ে গেছে কুড়ি পয়সা দিতে হবে।ওই সময়ে দু পয়সার মূল্য অনেক বিশেষ কোরে আমাদের মতো ছেলেদের কাছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই দুজনের বাতবিতন্ডা শুরু হোয়ে গেলো।আর তার মাঝে বাস কন্ডাক্টর ছেলেটির গায়ে হাত তুলে দিলো।আর যায় কোথায় ছেলেটি কলেজ ফার্ষ্ট গেটে নেমে ব্যাপারটা বলতেই এক্কেবারে লন্কাকান্ড আর কাকে বলে।ওই রুটের সব বাস পুরো চারদিন বন্ধ ছিলো। তারপর কলেজ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে আবার সবকিছু স্বাভাবিক হয়।

আজও মনে কোরলে সেই সব ঘটনাগুলো মেন চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। সময় তার নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছে।

হুজুগে হোস্টেল লাইফ

সালটা যদ্দুর মনে পড়ে ১৯৭৫ সাল।আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং এর থার্ড ইয়ারে পড়ি।মাসটা ছিলো ডিসেম্বর। হঠাৎই ঠিক হোলো বাস ভাড়া কোরে বক্রেশ্বর, তারাপীঠ হোয়ে শান্তিনিকেতন ঘুরে আসার।এক শনিবার রাতে আমরা হৈ হৈ কোরে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।জনাপন্চাশ মতো ছিলাম মনে পড়ে।বক্রেশ্বর ঠিক সময়েই পৌঁছেছিলাম।প্রায় ঘন্টা তিনেক পরে আমরা তারাপীঠের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

তারাপীঠ পৌঁছতে বেশ রাত হোয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের ছেলেরা সব নাছোড়বান্দা তারা মায়ের পূজো দিয়েই তারপর নড়বে। কিন্তু অতো রাতে পান্ডা পুরোহিত সবাই যে যার বাড়ী চলে গেছে। বুঝলাম সময় লাগবে। কাছেই তারাপীঠের বিখ্যাত শ্মশান দেখা যাচ্ছে।আমি আর আমার এক রুমপার্টনার স্বপন তালুকদার(চার বছর আগে সে না ফেরার দেশে চলে গ্যাছে) ঠিক করলাম আমরা শ্মশান দেখতে যাবো।

পাশেই শ্মশান বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেললাম।একে শ্মশান তার উপর সেদিন ছিলো অমাবস্যা। তখন ঘড়িতে দেখলাম বাত বারোটা বাজে। এদিকে কাছেই কোথাও তান্ত্রিক মন্ত্র উচ্চারণের আওয়াজ কানে আসছিলো। সামনে লম্বা লম্বা তাল ,লাল আর অর্জুন গাছ দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরেই ধূনীর আগুন জ্বালিয়ে কোনো সাধুবাবা তন্ত্র সাধনার বন্দোবস্ত কোরছেন।সব মিলিয়ে যেন একটা দম বন্ধ বন্ধ করে দেওয়া পরিবেশ। মাঝে মাঝেই রাতের পাখির চিল চিৎকারের আওয়াজও কানে আসছিলো।তার মাঝে আমরা ফেরার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। সত্যিই ভীষণ ভয়ার্ত আর দমবন্ধ করা এক অদ্ভুত পরিবেশ।

এরকম সময় একদল গ্র্রামের মানুষ মড়া পূড়িয়ে ফিরছিলো। ওরা আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করল আমরা শ্মশানে কি করছি এতো রাতে। আমরা সব বলার পর বলল এইসময় তারাপীঠ মহাশ্মশান ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তান্ত্রিক সাধুরা তন্ত্র সাধনার জন্য মানুষ খোঁজে। তারপর ওদের দেখানো রাস্তায় আমরা আবার মন্দিরে ফিরে এলাম। ততক্ষণে পূরোহিত এসে গেছে। আমরাও তারা মায়ের পূজো দিয়ে শান্তিনিকেতনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সেই রাতের কথা মনে হোলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়।

নিক্ নেম

বি ই কলেজের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বহুদিন ধরেই যখন থেকে র‍্যাগিং শুরু হয়েছিলো সেই সময় থেকেই এই নিকনেম দেওয়ার প্রথখ চালু ছিলো। পঞ্চাশ বছর আগেই দেখেছি ছাত্র তো বটেই এমনকি প্রফেসরদেরও নিকনেম দেওয়া হোতো। শুধু মা, বাবা বাদে সব রকম নামই যেমন মাসি মেসো, খুড়ো ,ভাইপো ,ভাইটু , জ্যাঠা,দাদু এই ধরনের নিক নেম বেশি প্রচলিত ছিল।

তারপর ছিল আসল নামের সাথে বিশেষণ যোগ করে চারু মাসি অথবা কেউ হয়তো একটু ডাকা বুকো ছিলো তার নাম ছিল বস্ আবার দেখতে ভালো এবং ধোপদুরস্থ পোশাক পড়ে সর্বদা ফিটফাট থাকা ছেলেটির নিকনেম ছিলো জামাই। আবার হয়তো কেউ গুনগুন করে দেবানন্দের কোন হিট সিনেমার গান গাইতো আমরা আজও তাকে গাগা বলেই ডাকি।তবে মোটা নিক নেমটা কমন প্রায় প্রতিটা ব্যাচেই পাওয়া যাবে। কিন্তু স্কাইল্যাব, দৈত্য ,কাজু,ঈগল, বাছুর,লগা,জগা, পটকা,পাতি,পান্ডে থেকে পাড়ে সিআরপি,মগু,বৈচি,বালী এইসব নামগুলো ছিলো টিপিকাল নিক্ নেম। কেউ সবসময় হাসিমুখে থাকতো তার নিক্ নেম আজও হাসু। কারও আবার নিকনেম আছে তার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে যেমন তকাদা। কিংবা হারাধন থেকে হারা সাধন থেকে সাধু এইরকম আর কি। কেউ আবার আলফা আর কেউবা ভাবুক নিক্ নেমে খ্যাত ছিলো।

কলেজের সিনিয়র জুনিয়র এমনকি জানাশোনা অনেকেই নিক্ নেমে তাদের ডাকতে অভ্যস্ত হয়ে যেতো। আজও সেইসব বন্ধুরা নিকনেমে ডাকলে শান্তভাবে প্রত্যুত্তর দেয় একদমই মেজাজ খারাপ না করে। তবে ব্যতিক্রম আছে যেমন কারো নিক্ নেম কেঁদো সেই নামে জনসমক্ষে ডাকা সে নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না। তাই সে নিজের অদ্ভুত ছদ্মনাম রেখেছিলো। ১৯৯৭ ব্যাচের একজন আবাসিকের নাম জানতে চাইলে সে বলতো পরিচয় গুপ্ত। ওর ব্যাচমেটরা ওকে পরিচয় নামেই ডাকতো। অনেকদিন বাদে সবাই জানতে পেরেছিলো ওটা ওর আসল নাম নয়। তারও নিকনেম ছিলো কেঁদো,যার আসল নাম ছিল অমিত কুমার দে। এবার আসি প্রফেসরদের নিকনেম নিয়ে কিছু তথ্য নিয়ে।যেমন আমাদের মেকানিক্যাল এর এইচওডি র নাম ছিল প্রফেসর ভূপাল দত্ত। ছাত্ররা ওর নিকনেম দিয়েছিলো ‘ভূপস’। আবার হাইড্রলিক্স এর প্রফেসরের নাম ছিলো আনারকলি থিওরি অফ মেশিনস এর প্রোফসরের নাম ছিল ডিং ডং, ফার্স্ট ইয়ারের ড্রয়িং টিচারের নাম ছিল ভুলু। কার্পেন্ট্রি ওয়ার্কশপের প্রফেসরের নাম ছিল উড বর্মন ওরফে উডু এবং এরকম আরও বহু।

তবে সব থেকে মজার নাম ছিল প্লেসমেন্ট ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর পাইপ বিশ্বাস কারণ সরহময় ওনার ঠোঁটে একটা পাই প ঝুলতে দেখা যেতো। ওনার আসল নাম ছিলো সনৎ বিশ্বাস।

এরকমভাবে অনেক স্যারদের নাম শুধু আধ্যাক্ষর দিয়ে ছিলো যেমন টি.এম,ডি.বি ইত্যাদি। টি .এম নামের ফুল ফর্ম ছিলো তপেন মৌলিক ও ডি. বি নামের ফুল ফর্ম ছিলপ্রিন্সিপাল দুর্গা ব্যানার্জি।

একবার ডি.বি এবং পাইপ বিশ্বাসের কিছু কথোপতন চুপিসারেএকজন ছাত্র শুনে ফেলেছিলো। এক বিকেলে ওরা দু’জন কলেজের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন সেই সময় হঠাৎই প্রিন্সিপাল স্যার প্রফেসর বিশ্বাসকে বলে বসলেন”দেখো সনৎ আমাদের কলেজের ছেলেগুলো আইআইটির ছেলেদের থেকে কোন অংশে কম নয়। শুধু একটাই ওদের অসুবিধা ওরা ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ নয়। তাই ওরা চাকরির ইন্টারভিউতে মার খেয়ে যায়। সনৎ তুমি যদি ওদের জন্য স্পোকেন ইংলিশের একটা এক ঘণ্টার ক্লাসের ব্যবস্থা করে দিতে পারো তাহলে ওদের ইংরেজিতে কথা বলার জড়তা কেটে যাবে।” শুনেই সেদিন পাইপ বিশ্বাসের স্বতঃস্ফূর্ত উত্তর ছিলো “স্যার ওসব স্পোকেন ইংলিশ ক্লাস টেলাস করে কিসসু হবে না। ওদের সব্বাইকে এক ঘন্টার জন্য একটা করে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে দেখবেন স্যার।”

উত্তর শুনে সেই পড়ন্ত বিকেলে প্রিন্সিপাল স্যার বেশ কিছুক্ষণ পাইপ বিশ্বাস স্যারের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন সেও এক সময় ছিলো।

মুচিপাড়া ও সাহেবপাড়া

সেই ১৮৫৬ সালে কলকাতা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং এ। ১৮৮০ সালে সেই প্রতিষ্ঠানটি স্থানান্তরিত হয় বর্তমানের শিবপুর ক্যাম্পাসে। তখন ওটা বিশপ কলেজের প্রাঙ্গণে সরকারি কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তী সময়ে সেই নাম পরিবর্তন করে হয় বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। সেই সময় দেশে ব্রিটিশ শাসন চলছিলো।

তখন দেশের মানুষ ওই কলেজে পড়ার প্রায় সুযোগই পেতো না আর পেলেও সেই সংখ্যাটা ছিলো হাতে গোনা কয়েকজন। সেই সময় হোস্টেল বলতে ছিলো ওই ডাউনিং হল। এই দাওনিং অল যা কিনা এক সময় গঙ্গার ধারে ব্রিটিশ সেনার পড়ছিল তার নামকরণ হয়েছিল ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা ১০ নম্বর ডাউনিং ষ্ট্রিটকে অনুকরণ করে। যেটা আজও ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানের ঠিকানা।

প্রথমদিকে একমাত্র সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ছিলো বলে ছাত্র সংখ্যাও কম ছিলো। তাই ওই একটা ছাত্রদের হোস্টেলেই স্থান- সংকুলান হয়ে যেতো তখন। কিন্তু ১৯২১ সালে যখন সেই কলেজ বেঙ্গলি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে আত্মপ্রকাশ করে স্বভাবতই তখন প্রযুক্তির অন্য সব বিভাগও ধীরে ধীরে চালু হয় যেমন ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল ইত্যাদি। তখন ডাউনিং এর আশেপাশে আরও নতুন হোস্টেল নির্মাণ হয়। আর সেই সময় দেশীয় ছাত্ররাও ওই কলেজে পড়ার সুযোগ পেতে থাকে। এবং তাদের জন্য নতুন হোস্টেল নির্মাণ হ’তে থাকে। তখন সাহেব ছাত্ররা আর ওখানে থাকতো না তাদের জন্য কলেজ বিল্ডিং এর লাগোয়া লর্ডস সংলগ্ন রিচার্ডসন, ম্যাকডোনাল্ড এবং ওভাল সংলগ্ন উল্ফেনডেন হোস্টেলে আবাসনের ব্যবস্থা করা হতো।

দেশীয় ছাত্ররা তখন থাকতো ডাউনিং, তেরো নম্বর আর সাত,আট,নয় এবং পরে নির্মিত অন্য সব হোস্টেলে। সেই কারণে তখন থেকে দেশীয় ছাত্ররা যে এলাকায় বেশী থাকতো সেই এলাকাকে নাম দেওয়া হয়েছিল মুচিপাড়া এবং কলেজ ভবনের আশপাশের এলাকার নাম দেওয়ূ হয়েছিলো সাহেবপাড়া। তবে পরবর্তীতে মানে সত্তরের দশক পর্যন্ত বেশিরভাগ জুনিয়ররা ফোর্থ ইয়ারএবং পরবর্তীতে থার্ড ইয়ার পর্যন্ত ছাত্ররা ঐসব হোস্টেলের আবাসিক ছিল। আর ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রদের জন্য সিনিয়র হোস্টেল যেমন টিচারসন, ম্যাকডোনাল্ড, সেন, সেনগুপ্ত এইসব হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা হোতো। শুধু পান্ডিয়া হোস্টেলে পোস্ট গ্রাজুয়েট মানে এমটেক কোর্স চালু হওয়ার পর সিনিয়র মোস্ট ছাত্রদের য়আবাসনের ব্যবস্থা ছিলো এবং বর্তমানে পান্ডিয়া হোস্টেলটি এবং পুরনো লেডিস হোস্টেল নিবেদিতা নামে মেয়েদের আবাসনের জন্য লেরি হোস্টেলে রূপান্তরিত করা হয়েছে। ব্যতিক্রম হয়েছে শুধু ঐতিহাসিক ডাউনিং হলের ক্ষেত্রে। সেই ঐতিহাসিক হোস্টেলটি বর্তমানে বন্ধ হয়ে হেরিটে যে উন্নীত হয়েছে আর তেরো নম্বর হোস্টেলও বেশ কিছুদিন হোলো পোস্ট গ্রাজুয়েট হোস্টেলে রূপান্তর করা হয়েছে। মুচিপাড়ার যেসব হোস্টেল গুলো শুধু নম্বর দিয়ে চেনা যেতো সেইসব হোস্টেল গুলোর মধ্যে ৭ নম্বর হয়েছে ডক্টর এসপি .সেন হল, ৮ নম্বর হয়েছে ডক্টর ডি .ব্যানার্জি হল এবং ৯ নম্বর ওরফে হিক্স (HIX) নামকরণ হয়েছে আজ ডঃ বি .সেন হল নামে।

মুজিপাড়ার সেই ওভার মাঠ আজও আছে এবং সেই মাঠের কাছেই ছিল পুরনো লেডিস হোস্টেল এবং মাঠের ঠিক বিপরীতে আজও উল্ফেনডেন হল ডাউন মেমোরি লেন বেয়ে পুরনো সেই দিনের কথা মনে করায়। একই রকম ভাবে সাহেবপাড়ার মাঠ লর্ডস আজও স্বমহিমায় নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এসবই ইংল্যান্ডের আদলে ব্রিটিশদের নামকরণ করা। কলেজে রাস্তায় যেতে যেতে নজরে পরে শতবর্ষ পেরনো সাহেবদের কবরখানা। আর অনেক দূর থেকে দেখা যায় বি ই কলেজের সেই বিখ্যাত ঘড়ি, যা আজও বি ই কলেজের সোনালী অতীতের প্রতীক হয়ে সগর্বে বর্তমান সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ভবিষ্যতের বার্তা বহন করে চলেছে এক সুনির্দিষ্ট দিশার লক্ষ্যে।

সেকাল ও একাল

সেকাল মানে যখন বি ই কলেজ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে পরিচিত ছিলো তখন ফি বছর রি ইউনিয়ন অথবা পুনর্মিলন উৎসব হোতো। সেই রি ইউনিয়নের অনুষ্ঠানে দেশ বিদেশে থেকে সিনিয়ররা অংশগ্রহণ করতো। আক্ষরিক অর্থেই তা ছিলো পুনর্মিলন উৎসব। সেই রি ইউনিয়ন হোতো প্রত্যেক বছর জানুয়ারির ২৩ থেকে ২৬ তারিখ পর্যন্ত আর চলতো টানা চার দিন ধরে। প্রতিদিনই নতুন নতুন অনুষ্ঠান থাকত যেমন রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হোতো। দ্বিতীয় দিন হোতো গ্লোবাল বিজনেস মিঠ ও উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান সেই অনুষ্ঠানে ঘন্টা দু’য়েক বিজনেস মিটের পর রাত আটটা নাগাদ শুরু হোতো সারা রাত্রি ধরে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। সেই আসরে বহু নামী উচ্চাঙ্গশিল্পীর অনুষ্ঠানই আমরা দেখেছি যেমন এ .টি কানন মালবিকা কানন পন্ডিত শিবকুমার শর্মার শততন্ত্রী বীনা আল্লারাখার তবলা উদয় শঙ্কর গ্রুপের তিমির বরণ ইত্যাদি। তৃতীয় দিন থাকতো সেই সময়ের জনপ্রিয় নাটক কখনও অনুপ কুমার আবার কখনও অরুন মুখোপাধ্যায়, নান্দীকার এর গ্রুপ সেই সব নাটক যেমন হঠাৎ নবাব,মারীচ সংবাদ কিংবা তিন পয়সার পালা পারফর্ম করতো।আর সেই রিইউনিয়ন শেষ হোতো আধুনিক বাংলা ও হিন্দী গানের অনুষ্ঠান দিয়ে। সেই অনুষ্ঠানে একবার মান্না দে ও এসেছিলেন সাথে তবলা সংগদ করেছিলেন বিখ্যাত তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দী। আমরা যখন ফোর্থ ইয়ারে পড়ি।

সেকালে মানে সত্তরের দশকে মান্না দে ছিলেন সবচাইতে দামি শিল্পী। হেমন্ত, মানবেন্দ্র, নির্মলেন্দু আরতি মুখার্জি, শ্রাবন্তী মজুমদার এবং আনন্দ শংকরের লাইট এন্ড সাউন্ড শো দেখেছি কলেজ রিং উনিয়নে। তবে আজও চোখে ভাসে উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান যার প্রত্যেকটি তে শেষ শিল্পী ছিলেন প্রফেসর সনৎ বিশ্বাস এর স্ত্রী জয়া বিশ্বাস যিনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রিয় ছাত্রীদের অন্যতম ছিলেন। জয়া বিশ্বাস মঞ্চে এসে সেতার হাতে বসলে মনে হতো স্বয়ং মা সরস্বতী যেন আমাদের সামনে সেতার বাজাচ্ছেন। ওর প্রোগ্রাম শেষ হ’তে হ’তে পুবের আকাশে সূর্যোদয় হোতো। ওনার সেতার আমাদের মোহিত করে রাখত সেই সময়।

আর জুন মাসে সামার ভ্যাকেশনের পর হোতো এক দিনের সোস্যাল বা বেকা র(BECA)।সেই সোস্যাল এ দু’একজন নামী শিল্পী আসতেন যেমন হেমন্ত, মানবেন্দ্র, নির্মলা মিশ্র আর একটা নাটকের অনুষ্ঠান হোতো।সেই সোস্যাল এই দেখেছিলাম মুন্সী প্রেম চাঁদ এর বিখ্যাত নাটক ‘কফন’। এই রি ইউনিয়ন ও সোস্যাল দুটো অনুষ্ঠানই লর্ডস মাঠে প্যান্ডেল বেঁধে বেশ ধুমধাম করেই আয়োজন করা হোতো।

সেই চার দিনের রিইউনিযন আজও চালু আছে তবে সেটা প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি - মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয়। তবে সেকালের রি ইউনিয়নের সেই জৌলুস আজ আর নেই। সেই বি ইউনিয়নের বর্তমান নামকরণ হয়েছে রেবেকা (REBECA) যার ফুল ফর্ম হোলো রিইউনিয়ন অফ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কালচারাল অ্যানুয়ালস। তবে একালে মানে ২০০৪ সাল থেকে যখন বি ই কলেজ বেসুর(BESU) তকমা পেয়েছে তারপর পর ২০০৫ সাল থেকে প্রত্যেক বছর ২৯ শে ডিসেম্বর গাবেসু (GAABESU) বা গ্লোবাল আ্যলামনি অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি একটা গ্লোবাল মিট এর আয়োজন করে। এটাকে বড়সড়ো একটা পিকনিকও কাম মেলাও বলা যেতে পারে। এই অনুষ্ঠানটি একদিনের তবে আজকাল গাবেরসু র অনুষ্ঠানেও গান-বাজনার আয়োজন থাকে।

বর্তমানে বেশ অনেক বছর ধরেই প্রত্যেক ইয়ারের পাস আউট আ্যলামনিরা নিজেদের ব্যাচের গেট টুগেদারের আয়োজন করে লর্ডসের ঠিক পাশেই। এটাও একদিনেরই একটা অনুষ্ঠান এবং এই অনুষ্ঠানও মূলতঃ যার যার নিজের ব্যাচমেটদের দেখা সাক্ষাৎ এবং দিনভর রকমারি খাওয়া দাওয়াই আসল উদ্দেশ্য। এই অনুষ্ঠানে আবার ফ্যামিলি মেম্বার এবং গেস্টরাও অংশগ্রহণ করতে পারে। এই ব্যাচওয়াইস মিট সাধারণতঃ ডিসেম্বর মাস জুড়ে হয়ে থাকে। তবে সেকালে সারা বছর জুড়েই কিছু না কিছু অনুষ্ঠান হোতো। ইর একালে সেমিস্টার সিস্টেমের জন্য পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে সেকালের মত আনন্দ উৎসব অনেকটাই কমে গেছে আর এভাবেই সেকাল ও একাল নিজেদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সময় প্রবাহের সাথে এগিয়ে চলেছে। সময় যে কখনই আনতে জানেনা সময় চলমান শুধুই ভবিষ্যতের দিকে এ যাওয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য পেছন ফিরে তাকানোর ফুরসৎ নেই যে তার।

উপসংহার

১৮৫৬ সালে স্থাপিত একশো আটষট্টি বছরের সুপ্রাচীন এই প্রযুক্তির পীঠস্থান পশ্চিমবাংলা এবং ভারতবর্ষের মুখ উজ্জ্বল করে চলেছে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে সফল প্রযুক্তিবিদদের সাথে বাংলা সংস্কৃতির বিভিন্ন বিভাগ যেমন সাহিত্য, নাটক, কাব্য, সংগীত এইসব নানা অঙ্গনে স্বনামধন্য সব প্রতিভাধরদের বিকাশ হয়েছে। প্রযুক্তির এই পীঠস্থান বহু প্রতিভা ধরকেই দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে তাদের নিজের নিজের কর্ম ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে অনুপ্রাণিত করেছে। এইসব প্রাক্তনীদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে স্যার রাজেন্ মুখার্জি এবং স্যার বীরেন মুখার্জির কথা।

স্যার রাজেন মুখার্জি ছিলেন ইস্কোর সহ প্রতিষ্ঠাতা এবং সেই একই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন স্যার বীরেন মুখার্জি। তারপর সংস্কৃতির পুরোধাদের মধ্যে ছিলেন সাহিত্যে নারায়ণ সান্যাল, কবিতায় যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও বিনয় মজুমদার, নাটকে বাদল সরকার জীবনমুখী সংগীতের পুরোধা মহীনের ঘোড়াগুলির অগ্রজ গৌতম চট্টোপাধ্যায় এবং সদ্যপ্রয়াত অরুণ চক্রবর্তী আধুনিক সংগীত জগতে বাংলা গান কে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিলেন।

এমনকি রাজনীতিতেও কিছু প্রাক্তনীর নাম উল্লেখ করতে হয়। যেমন ডঃ শংকর সেন যিনি সত্তরের দশকে ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের এইচ ও ডি ছিলেন এবং পরে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ডঃ শংকর সেন জ্যোতি বসুর মন্ত্রিসভায় বিদ্যুৎ মন্ত্রী হয়ে তার দশ বছরের সময়কালে পশ্চিমবাংলার বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে আধুনিকীকরণ এবং বেশ কিছু নতুন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। যার ফলস্বরূপ পশ্চিম বাংলা আজও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে স্বনির্ভর।

সময়ের সাথে সাথে বি ই কলেজেরও বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। যেমন এই প্রতিষ্ঠানটি প্রথমে ছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটির অ্যাফিলিয়েটেড় একটি প্রতিষ্ঠান। তারপর হয়েছে ডিমড্ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি স্বশাসিত সংস্থা আইআইএসটি। সময়ের সাথে বিবর্তন এবং পরিবর্তন আসে। সেটাই প্রমাণিত সত্য। সেদিনের বি ই কলেজ ও তার ব্যতিক্রম নয়। কালের চাকা ঘুরছে সাথে সাথে সময়ও যে‌ এগিয়ে চলেছে।

.    .    .

Discus