বিশেষ বিশেষ খবর
সময়টা ১৯৮০ সালের জানুয়ারি মাসের এক শীতের সন্ধ্যা। জায়গাটা মেদিনীপুরের কাঁথি সাব ডিভিশন সংলগ্ন দীঘার সমুদ্র সৈকত। সেই সময় সাদাকালো টেলিভিশন সবে এসেছে। তবে মেদিনীপুরের এই প্রান্তিক শহরে তখনও ঘরে ঘরে রেডিওর ই রম রমা। কোথাও বার ট্রানজিস্টার রেডিও আবার কোথাও বা বিদ্যুৎ চালিত রেডিও।
তখন সংবাদ পড়তেন নীলিমা সেন এবং প্রবাদ প্রতিম ঘোষক ও বাচিক শিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা বাজলেই ইথার তরঙ্গে তাঁর ভরাট কন্ঠে ভেসে আসতো “আকাশবাণী কোলকাতা খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হোলো ---------।”দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হয়েছেন বহু বছর পেরিয়ে গিয়েছে। আজও সেই কণ্ঠস্বর কানে বাজে আর মনটা নিমিষেই শৈশবের ধূসর অতীতের দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
সেদিন সন্ধ্যায়ও সেই ভরাট কণ্ঠস্বর জানান দিলো “স্থানীয় সংবাদ পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। আজকের বিশেষ বিশেষ খবর হোলো দীঘার সমুদ্র সৈকতে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। তবে জানা গেছে মৃত ব্যক্তির আত্মা নিজেই নিকটবর্তী কাঁথি থানার কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারকে সেই মৃতদেহটির হদিশ দিয়েছে--------। এ ছাড়াও অন্যান্য খবর
গুলো হোলো--------------- ।”
এই ঘটনার পেছনের দিকে একবার তাকানো যাক্। তখন রাত ন’টা বেজে গেছে। কাঁথি থানার আই সি মানে ইনভেস্টিগেশন অফিসার সুব্রত পাইন সবেমাত্র রাউন্ড দিয়ে এসে চেয়ার বসে এক গ্লাস জল খাচ্ছেন।
হঠাৎ ও সামনে একটা লোক এসে বলতে লাগলো
“জানালার গরাদ ধরে ঝুলছিল লোকটা। বললাম পড়ে যাবে তো। লোকটা হাসলো।” বল্লো “পড়ে গেলে যাবো তাতে কি?”আমি বললাম তাতে কী মানে? হাত ফস্কে পড়ে গেলে বাঁচবে তুমি?”শুনে লোকটা বল্লো “বাঁচবো না। তাতে কি?”তখন আমি বিরক্ত হয়ে বললাম সেই থেকে শুধু তাতে কি তাতে কি বলছো কেন তুমি?*
এবার বিরক্ত হ’তেই আমার ঘোড় কেটে যায়। আমি টের পাই ঘুম থেকে উঠে হোটেলের দোতলার ঘরের বিছানায় বসে আছি আর আমার সামনের লোকটা হোটেলের জানালার রড ধরে ঝুলছে। না ঝুলছেনা দাঁড়িয়ে আছে। আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছিলো। কিন্তু আমি উঠতে
পারছিলাম না। তারপর দেখি লোকটা আস্তে আস্তে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে।
এতটা শোনার পর সুব্রত নড়েচড়ে বসলো। সামনের খোলা জাবদা খাতাটা দমাস করে বন্ধ করে দিলো।
এবার সুব্রত একটু চড়া গলায় বলে উঠলো “আপনি রাত ন’টার সময় আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করতে থানায় এসেছেন মশাই? আমাকে এখন রাউন্ডে যেতে হ’বে আর তা ছাড়া কিছু নিরুদ্দেশেরও খোঁজ নিতে হ’বে। এ সময় আপনার এইসব আষাঢ়ে গপ্পো আমি শুধু শুধু কেন শুনতে যাবো? আমার লাভ কি তাতে?”
তখন সামনের লোকটা বললো ”লাভ? মানে আজ তিন দিন হোলো আমি ওই ঘরে আছি। আর প্রতি রাতেই বুঝলেন কিনা ওই লোকটা-----।”
এবার সুব্রত বেশ রেগেই বলে ওঠে “ভাই আপনি থানায় চলে এলেন? কেন মশাই থানা ছাড়া এই আজগুবি গপ্পো শোনানোর জন্য আর কাউকে পেলেন না আপনি?”
লোকটা বলে ওঠে “না মানে বলছিলাম আজও আবার ওই ঘরেই শুতে হবে তো। হোটেলের কাউন্টারে কতো করে বললাম ওরা কিছুতেই ঘর পাল্টে দিলো না। বললো সব ফুল হয়ে আছে। তাই তো ওই ঘরেই বাধ্য হয়ে থাকতে হোলো।
জানেন আমার ডান হাতের ওপর দিকে এই যে মাদুলি দেখছেন এ হচ্ছে পঞ্চাননের মাদুলি। খুউব
জাগ্রত দেবতা। আমার দিদিমা ছোটবেলায় এটা পরিয়ে দেন। এদিকে নিশ্চিন্তি। সাপ বলুন, ভূত বলুন কেউ আমাকে কিচ্ছুটি করতে পারবে না। তবুও আমি ভয় পাই ”
শুনে সুব্রত বলে ওঠে “আবার মাদুলীর গপ্পো,
দিদিমার গপ্পো। মশাই আপনার কি মনে হয় থানাটা ফালতু গাল গপ্পের জায়গা? আপনি দেখছি মশাই ভারী বিদঘুটে। আপনি উঠুন তো দেখি। আমাকে এখনই বেরোতে হবে হাতে একেবারে সময় নেই” বলেই সুব্রত চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
লোকটাও দাঁড়িয়ে পড়ে আর বলে ওঠে “মানে যদি
কিছু না মনে করেন তাহ’লে আপনার সঙ্গে যেতে পারি? মানে, গাড়িতে যেতে যেতে যদি বাকি ঘটনাটা-----*
সুব্রত শব্দ করে চেয়ার টানে। চারদিকে তাকায় একবার। ডায়েরি লেখার জাবদা খাতাটা সে টেনে আনে নিজের দিকে। তারপর খাতার দিকে চোখ রেখেই হাঁক পাড়ে “অনিল দুটো চা। আর আপনি সত্যিই নাছোড়বান্দা লোক মশাই।আমার সাথে যাবেন? সে ঠিক আছে। কিন্তু এখন যাচ্ছি না।
যা বলার চটপট বলে ফেলুন এখন। ও হ্যাঁ আপনার নাম কি?পেশা? কি জন্য এখানে এসেছেন?”
তখন লোকটা উত্তর দেয় “আমি পেশায় সেলস্ অফিসার নাম আকাশ ঘোষ। বৌ বলে বেঁচু বাবু।
কিন্তু ভালো কোম্পানি আমাদের। কাজের সূত্র এখানে মাসে অন্ততঃ একবার আসতেই হয়। দীঘায় এলে বরাবর ওই ‘সুরমা’তেই উঠি। এবারও যখন এলাম ওই ঘরটাই বুক করেছিলাম ফোনে।
সাউথ ফেসিং ঘর বড় বড় জানালা দিয়ে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া আসে। খরচপত্র সব কোম্পানিই দেয়। নিজের খরচায় এলে অবশ্য পারতাম না। জানেন বৌয়ের সঙ্গে ওই ঘরে থাকা হোলো না। ভারী আফসোস তাই। এতো সুন্দর ঘর।”এবার লোকটা কথা থামায়। অনিল চা নিয়ে এসে টেবিলে রাখে। সুব্রত বিরক্ত হয় “থামুন মশাই। আপনি সত্যিই একটা ভোম্বল থানায় এসে কেউ বৌয়ের গল্প করে? নিন এবার চা খান।”
আবারও লোকটা বলে”না আসলে বৌ সাথে থাকলে হয়তো ওই লোকটা মাঝরাতে জানালায় ঝুলত না। আমার না বড্ড ভয় করে একটা ঘরে একদম একা থাকতে। এখন অবশ্য রোজ একা থাকতে থাকতে ভয় কমে গিয়েছে। ওই লোকটা আসছে। জানালায় ঝুলছে। মানে আমার বৌ যদি সাথে থাকতো!বৌ আমার খুব রাগী মানে রীতিমতো জাঁদরেল আর কি! ও যদি---”
লোকটার কথা শুনে সুব্রত হাসছে “নিন্ চা তো জুড়িয়ে গেলো! আপনার বৌ থাকলে এক ধমক দিতো আর ওই লোকটা পালাতো কি তাই তো?”
সুব্রত এই বিদ্রুপে বেজার হয়ে আকাশ হাত গুটিয়ে বলে ওঠে “আমি চা খাবো না। চা খেলে আমার অম্বল হয়।”
এবার সুব্রত মৃদু হেসে বলে ওঠে “মানে আপনি ভোম্বল আর আপনার আছে অম্বল। এবার বলুন তো কতদিন হলো বিয়ে করেছেন আপনি? তখন থেকে শুধু বৌ বৌ করছেন। নেশা কাটেনি মনে হয়।”
এবার আকাশ একটু লজ্জা পায় সে বলে “এই মানে মাত্র দু’মাস হোলো। আমার বৌ-----”
এবার সুব্রত ধমকে ওঠে “আরে থামুন তো মশাই। তারপর কি হোলো বলুন। আপনি কি বৌ এর গল্প শোনাতে আমার কাছে এসেছেন নাকি? জানেন আমাকে ডিউটি করতে হয়। এখন আমি আপনার
বৌ এর গল্প শুনতে পারবো না। বলুন তারপর কি হোলো?”
আকাশ বলল “হ্যাঁ বলছি। লোকটা আবার পরদিন এলো আবার তারপর দিন। মানে সেই রোববার থেকে প্রতিদিন। আজ বুধবার আজও আসবে।”
এবার সুব্রত বলে ওঠে “কেন আসে লোকটা? মানে কি কথা বলে আপনাকে?”
এবার আকাশ বলে “বলেছে তো! খুবই অদ্ভুত একটা কথা তাইতো আমি আপনার কাছে এলাম।”
এবার সুব্রত ঘড়িতে সময় দেখে “হয়েছে হয়েছে, আর ভণিতা করতে হ’বে না। বলে ফেলুন কি কি বলবেন। আমাকে বেরোতে হবে।”
তখন আকাশ বলে ওঠে “আবার প্রথম থেকেই
বলি কেমন। লোকটা আসে ঠিক রাত বারোটায়।
এসে দাঁড়ায় জানালার ওই গরাদ ধরে। আমাকে বলেছে ও নাকি হারিয়ে গিয়েছে। ওকে ওর নিজের লোকেরাই হারিয়ে দিয়েছে। মানে লুকিয়ে দিয়েছে।”
এবার সুব্রত বলে ওঠে “মানে কি এসব কথার? ও হারাবে কেন?”
আকাশ উত্তর দেয় “ও আমাকে বলছিলো তাই। তিন দিনের দিন আমি বললাম গড়াদ ছেড়ে ভেতরে এসো। আমার বিছানায় এসে বোসো।”
কিন্তু ও রাজি হোলো না। বলল “এই বেশ আছি।
তুমি তো জানো না একেবারে হারিয়ে গেলে কেমন লাগে। কেউ দেখতে পায় না। জানতেও পারেনা আমি কোথায় আছি।”আমি ওকে বললাম “তুমি আমার সামনে। এইতো গরাদ ধরে ঝুলছো।
না আমি ভয় পেলাম না বলে দিলাম ওকে এই ক'দিনে ভয় না পাওয়া আমার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তো। আর লোকটাও দেখছি খুব কষ্টে আছে।”
এবার সুব্রত বলে “তারপর? তাড়াতাড়ি শেষ করুন আমি এবার উঠবো।”
এবার আকাশ বলে ওঠে “সেই লোকটা বললো
জানো অদ্ভুত কান্ড আমার বৌ আমার সাথে এসেছিলো। নতুন বৌ নাম অনুপমা। কপালে লাল গোলটিপ নাকে নাকছাবি। ঠিক যেন দীপিকা পাড়ুকোনের মতো নাকছাবি।সেই যে বাজীরাও
মাস্তানি তে পরেছিলো না, হাল্কা নীল রঙের সারোয়ার কামিজ। ভারী সুন্দর দেখতে আমার সাথে এই ঘরে এসেছিলো সেই তো ------”
সুব্রত একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে ওঠে “ওরে বাবা আবারও বৌয়ের গপ্পো। সেই লোকটাও বৌয়ের কথা বলেছে! কি হোলো তাড়াতাড়ি বলুন। নয়তো চলুন সাথে যেতে যেতে বাকিটা শোনা যাবে। উঠুন হ্যাঁ উঠুন জিপে। ঠিকঠাক কথা না বললে কিন্তু তখনই জিপ থেকে নামিয়ে দেবো বলে দিলাম।”
আবারও আকাশ বলে ওঠে “না মানে লোকটা বলছিলো বিয়ের পর ওরা বেড়াতে এলো। ওই সুরমাতেই উঠলো। আর তারপর শুধু বেড়ানো আর সমুদ্র স্নান। হোটেলের ঘরে দু’জনে। মানে মাঝে মাঝে সারাটা দিনই হোটেলের ঘরে। শুধু ভালোবাসা- বাসি।
দু’জন দু’জনকে ভালো করে চিনলো। অনেক অনেক ভালোবাসলো। তারপরও আবার ভালোবাসলো। আরও ভালোবাসলো। তারপর একদিন রাতে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেরিয়ে লোকটা হারিয়ে গেলো।”
এবার সুব্রত বলে ওঠে “হারিয়ে গেলেই হোলো! হারাবে কি করে শুনি।”
আকাশ বলে “ জানালার গরাদ ধরা ঐ লোকটা সেদিন স্পষ্ট বলেছিল আমাকে “সেদিন আমি হারিয়ে গেলাম।”
নিরুদ্দিষ্টের খোঁজে
পুলিশের জিপটা এগিয়ে চলেছে সমুদ্র সৈকতের দিকে।
হঠাৎ সুব্রত ড্রাইভারকে থামতে বললো একটা মোড়ের কাছে এসে। সেই মোড়টা ঘুরলেই সমুদ্র। এবার সুব্রত ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনদিকে তাকায় আকাশের দিকে আর বলে ওঠে “এই যে মশাই আপনি জিপ থেকে নামুন তো দেখি।
আপনাকে বললাম না আমাকে কাজে যেতে হ’বে। ওই সমুদ্রের কাছে যাবো আমি। শুধু শুধু এতক্ষণ ধরে বাজে বকালেন আপনি। আপনার বৌয়ের গপ্পো শুনে শুনে প্রাণ পচে গেছে আমার।
বুঝলেন বৌ কিছু নতুন ব্যাপার নয়। ঠিক ভাজা মাছের মতন। তাজা, মুচমুচে টাটকা টাটকাই স্বাদ পাওয়া যায়। তারপর যাকগে যার বৌ সে বুঝুক।”
আকাশ জিপের পেছনের সিট থেকে বলে ওঠে “জানেন বোঝেনি কিছু বোঝেনি লোকটা। ক’দিন যাবৎ বৌয়ের সাথে থাকলো।বৌকে আদর করলো বৌ ও ওকে আদর করলো।দু’জনে বসে বসে মদ খেলো। তারপর অন্ধকারে বৌয়ের হাত ধরে সমুদ্রের ধারে বালির উপর দিয়ে বেড়াতে বেরোল দু’জনে।
সুব্রত বলে ওঠে “এসব ওই লোকটা বলেছে আপনাকে? কিন্তু তারপর কি হোলো? তাড়াতাড়ি ঝেরে কাশুন তো মশাই।”
আকাশ বলে উঠলো “আমি নামবো এবার। লোকটা আমাকে যেভাবে বলেছে সেভাবেই সবটা আপনাকে বললাম। আরেকটু বাকি আছে। এটুকু বলে দিলেই আমার দায়িত্ব শেষ।”
এবার সুব্রত বলে ওঠে “ও বাবা আরও বাকি আছে বুঝি।
নিন এবার ইতি টানুন তো দেখি আপনার গপ্পো গাছার।”
উত্তরে আকাশ বলে ওঠে “হ্যাঁ
প্রায় শেষের মুখে আরেকটু এগিয়ে যান। হ্যাঁ হ্যাঁ এবার ডানদিকে গিয়ে বাঁ দিকে সোজা চলে যান।”
জিপটা গভীর রাতের অন্ধকারে আবার একটু এগিয়ে যায়। মোড় ঘুরে সমুদ্রের দিকে জিপ এগোয়।
সুব্রত আবার তাকায় আকাশের দিকে আর বলে ওঠে “সবই তো বুঝলাম কিন্তু আর নয়। এবার আমাকে কাজে যেতে হ’বে। বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হোলো আপনার গালগপ্পো শুনে।”
আকাশ বলে ওঠে “নামুন এবার। হ্যাঁ ওই ঝোপটার ঠিক পেছন দিকে। সমুদ্রে ডুবে যাওয়া শরীরটা ভেসে এসে ভিড়েছে ওখানে। ওই লোকটা বলেছিলো আমায় “আমি বড্ড বোকা জানেন। যখন সবটা বুঝলাম আর আমার কিচ্ছু করার ছিলো না। আমার নতুন
বিয়ে করা বৌ আকন্ঠ নেশা কুড়িয়ে আমাকে সমুদ্রে নামিয়ে দিলো। প্রথমে অবশ্য আমার হাত ধরেছিলো। তারপর ছেড়ে দিলো হাত। জানেন কতো চেষ্টা করলাম কিন্তু উঠতে পারলাম না কিছুতেই। যতবার সমুদ্র থেকে উঠতে যাই ততবার সমুদ্রের ঢেউ আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। চেঁচালাম কতো।
কতো কাকুতি মিনতি করলাম তবুও অনুপমা আমাকে নিয়ে গেলো না। ধরলো না জলের মধ্যে ও আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেল সমুদ্রের পাড়ের দিকে। জানেন অনুপমা কিন্তু ভালো সাঁতার জানে। আমি যে সাঁতার জানিনা কি কথাও অনুপমা জানতো। আমার বৌ আমাকে পাড়ে থাকতে দিলো না। আর সমুদ্রের ঢেউ আমাকে পাড়ে ফিরতে দিলো না।”
এবার সুব্রত বলে ওঠে “কি বলছেন কি মশাই? এ তো দেখছি রীতিমতো খুনের কেস্।”এবার সুব্রত উত্তেজনা বেড়ে যায় সে বলে ওঠে “তারপর কি হোলো?”
জিপ থেকে নেমে সামনের দিকে এগোতেগোতে সুব্রত টর্চের আলো ফেলে বললো
“কি হোলো বলুন কোথায় যাবো?”
পেছন থেকে আকাশ বলে ওঠে “আরও একটু এগিয়ে যান ওই যে দেখতে পাচ্ছেন? ঠিক বাঁদিকের ওই কোন বরাবর ওই জায়গায় টর্চের আলো ফেলুন। দেখতে পাচ্ছেন গোলাপি শার্ট। ভালো করে দেখুন আমি তো অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছি। আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। ওটা তো একটা শরীর দলা পাকিয়ে গেছে ঢেউয়ের ঘায়ে। দেখুন মুখটা সামনের দিকে ফেরানো রয়েছে,ওটাই।”
এবার আকাশ করুণ গলায় বলে ওঠে “জানেন ঐ লোকটা আমাকে বলেছিল সেই থেকে আমি হারিয়ে গিয়েছি। খানিক বাদেই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ওনাকি শুনেছিল ওর বৌ এর গলা। ওর বৌ কাউকে ফোনে বলছে কাজ হয়ে গেছে। এবার শুধু নিরুদ্দেশ সংবাদের বন্দোবস্ত করা।”
সুব্রতর ভ্রু কুঁচকে গিয়েছে। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চায় “আবার বলুন লোকটার বৌটা
শেষে কি বললো?”
উত্তরে আকাশ বলে ওঠে “ওই যে বললাম নিরুদ্দেশ সংবাদ।ঠিক আছে, আমার আর কিছুই বলার নেই। সবই তো বুঝিয়ে বললাম আপনাকে স্যার। আপনি এখন এগোন দেখুন সামনেই ওই যে!ওহো আরো একটা কথা বারবার ও বলেছে জানেন তো ও কিন্তু নিরুদ্দেশ হ’তে চায়নি। আপনাকে যেন সেটা জানাই।”
এবার সুব্রত সামনের দিকে এগোতে এগোতে হোঁচট খায়।
তারপর আবারও সামনের দিকে তাকায়। ওর চোখে পড়ে গোটান একটা শরীর পড়ে আছে বালির চড়ায়। মনে হচ্ছে গায়ে গোলাপি শার্ট ই ছিলো। একটু একটু এখনো বোঝা যাচ্ছে সাথে খুব দুর্গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে। সুব্রত নাকে রুমাল চাপা দিয়ে এবার একবার পেছনে ফিরলো। কিন্তু না কেউ তো নেই। কিছু নেই কোথাও। আশ্চর্য চোখের নিমেষে আকাশ গেলো কোথায়? এইতো এতক্ষণ বকবক করছিলো সে। সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার যে!
সমুদ্রের বাতাস হু হু করে বইছে। সুব্রত এক ভাবে একা দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নেই ওর আশেপাশে কোথাও।
এবার থানায় ফিরেই ডায়েরির পাতা ওল্টাতে থাকে সুব্রত। কয়েকটা পাতা ওল্টাতেই চোখে পড়ে। হ্যাঁ হ্যাঁ এই যে রয়েছে নাম আকাশ ঘোষ। শ ওয়ালেশ কোম্পানির সিনিয়র সেলস অফিসার। ডান হাতের উপরের দিকে মাদুলি বাঁধা আছে। দীঘায় স্ত্রীর সাথে এসে নিরুদ্দেশ। থানায় নিরুদ্দেশ ডায়েরী হয়েছে ক’দিন আগের তারিখে। করেছেন আকাশ ঘোষের স্ত্রী কলকাতার টালিগঞ্জ নিবাসী শ্রীমতি অনুপমা ঘোষ। সত্যিই অঘটন আজও ঘটে। সুব্রতর গলাটা একটা অজানা আতঙ্কে তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। জলের বোতল থেকে এক বোতল জল ঢক্ ঢক্ করে গলায় ঢেলে টেবিলে মাথা দিয়ে সে জ্ঞান হারালো।
স্থানীয় সংবাদের অন্তিম পর্বে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরাট কন্ঠ বলে উঠলো “স্থানীয় সংবাদ আজকের মতন এখানেই শেষ হোলো।"