Image by Apurba Chakraborty
আগস্ট মাসের শেষ বৃহস্পতিবার কাঁটায় কাঁটায় রাত বারোটায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম ব্যাঙ্গালোর থেকে মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী মন্দিরের পথে। ব্যাঙ্গালোর থেকে ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পথ ধরল আমাদের সারথী রমেশ। রমেশ জন্মসূত্রে মারাঠি। তবে বেশ কয়েক বছর ব্যাঙ্গালোরে বসবাস করার সুবাদে কন্নড় ভাষাটাও ভালোই রপ্ত করে নিয়েছে সে।
গভীর রাতে জাতীয় সড়কের দু'পাশ অন্ধকার চাদরে ঢাকা। মাঝে মাঝে জনবসতির মাঝ দিয়ে গাড়ি নিজের গতিতে ছুটে চলেছে আপন দিশায়। তবে যাত্রা শুরু করার পর রাত দুটো নাগাদ আমাদের বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। পরপর পাঁচটি এক্সিডেন্টের কারণে। পুলিশ এসে রাস্তা পরিষ্কার করার পর একটু এগিয়ে গিয়ে চোখে পড়লো দুটো মালবাহী ট্রাক ও তিনটি গাড়ি রাস্তার ধারে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। যাইহোক পথে আর তেমন কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটেনি। আধো ঘুম আর আধো জাগরণে ভোর সাড়ে সাতটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম মীনাক্ষী মন্দিরের সদর দরজায়।
এবার এই মন্দিরের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একবার ফিরে দেখা যাক। এই মন্দিরটিকে অরুলমিগু মীনাক্ষী আম্মান থিরুক্কোভিল নামেও অভীহিত করা হয়ে থাকে। এই হিন্দু মন্দিরটি চেন্নাই এর মাদুরাই শহরে ভাইজেই নদীর দক্ষিণ তীরে তৈরি হয়েছিল ছয় শকাব্দে। এই মন্দিরটি মীনাক্ষী দেবীকে (যে কিনা পার্বতী দিন এক অন্যরূপ) উৎসর্গ করা হয়েছে। এই মন্দিরটির
অবস্থান মন্দির শহর মাদুরাইয়ের ঠিক কেন্দ্রস্থলে। এই মন্দিরের দেবতা সুন্দরেশ্বর ভগবান শিবেরই রূপ। এই মন্দিরটি প্রায় এক একর জমির উপর নির্মিত। এক হাজারটি সদৃশ্য পৌরাণিক কারু কাজে শোভিত পাথরের স্তম্ভের উপর এই বিস্ময় মন্দিরটি দাঁড়িয়ে আছে। পান্ডিয়ান সম্রাট সদ্যাভামন কুলশেখরণের রাজত্বকালে ১১৯০ থেকে ১২০৫ শকাব্দের মাঝের সময়ে মন্দিরের মূল অংশ অর্থাৎ তিন মালা গোপুরম মন্দির,সুন্দরেশ্বর মন্দিরের মূল প্রবেশদ্বার ও মাঝের মীনাক্ষী দেবীর মন্দির এবং পার্শ্ববর্তী অংশ নির্মিত হয়। এই মন্দিরটি আবার ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে মালিক কাফুরের বাহিনী লুঠ ও ধ্বংস করে। ফলে ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে আবার এই মন্দিরটি তিরুমালা নায়েকের দ্বারা সংস্কার করা হয়। এই সময় মন্দিরের উচ্চতা চল্লিশ পঞ্চাশ মিটার বাড়ানো হয়। এই মন্দিরটি হিন্দুদের কাছে একটি আকর্ষণীয় তীর্থ বলেও মনে করা হয়ে থাকে।
এই মন্দিরে লক্ষ্মী, বংশীধারী কৃষ্ণ, রুক্মিণী, ব্রহ্মা, সরস্বতী, গণেশ ও বহু পুরানিক দেবদেবীর মূর্তি চোখে পড়ে। যাইহোক মন্দিরের পুরোটা ঘুরে দেখতে আমাদের প্রায় ঘন্টা দুয়েক লেগে গিয়েছিলো কারণ বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছিল লাইনে দাঁড়িয়ে। অবশ্য মন্দির পরিক্রমণেও বেশ খানিকটা সময়ই কেটে গ্যাছে আমাদের। মন্দিরের মাঝে একটা ছোট হ্রদ ও চোখে পড়েছিল যেখানে কিছু কচ্ছপ দেখা যায়। এপ্রিল মে মাসে এই মন্দিরে টিরুকালায়নাম দশ দিনের উৎসবে লক্ষাধিক দর্শনার্থীর সমাগম হয়। তামিল কাহিনী তিরুভিলাইতা পুরাণে
বলা হয়েছে সম্রাট মলয়াধ্বজ পান্ডিয়ান এবং রানী কাঞ্চনমালাই পুত্র সন্তানের বাসনা নিয়ে একটি যজ্ঞের আয়োজন করেন। এই যজ্ঞের হোমাগ্নি থেকে পুত্রের পরিবর্তে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয় যে জন্মের মুহূর্তেই ছিলো তিন বছর বয়সের এবং তাঁর ছিল তিনটি স্তন। ভগবান শিবের কৃপায় এবং হস্তক্ষেপে সেই দম্পতি কন্যা সন্তানটিকে উত্তর দিতে পালন করেন এবং বলা হয় যখন তার স্বামীকে সাক্ষাৎ করবে তখন তৃতীয় স্তনটি ঝরে যাবে। ইতিমধ্যে সেই কন্যা বড় হয়ে ওঠে এবং রাজা তাকে সিংহাসনের উত্তরসূরী ঘোষণা করেন। শ্রীকন্যার সাথে শিবের সাক্ষাৎ হয়। সেই ভবিষ্যৎবাণী সত্য হয় এবং সেই কন্যাই আসলে মীনাক্ষী।
আমরা মন্দির প্রদক্ষিণ এবং ধর্ষণ করে রাস্তায় প্রাতরাশ করে ৩৮ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে এগিয়ে চললাম রামেশ্বরমের উদ্দেশ্যে। একটু বাদেই গাড়ি ছুটলো ৮৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে রামেশ্বরমের দিশায়।
জাতীয় সড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে কখনো এখশ বা কখনো আশি কিলোমিটার বেগে। তবে আশির নিচে কখনই নয়। আমি উইন্ডো স্ক্রীন দিয়ে দুপাশের রাস্তার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী দু’চোখ ভরে দেখছি। অবশ্য দেখার মধ্যে ছিলো মাঝে মাঝে টিলা পাহাড় বা ফাঁকা জমি আর কখনো নারকেল গাছের সারি এইসব আর কি। যাই হোক আমরা প্রায় রামেশ্বরম এর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। আর মাত্র পন্চাশ কিলোমিটার দূরেই রামেশ্বরম মন্দির। হঠাৎ চোখে পড়ল সমুদ্রের ধার দিয়ে রেল লাইন আর সেই রেল লাইনের উপর একটি ব্রীজ যখন জাহাজ পারাপার করে সেই ব্রীজটি খুলে যায়। আমার জাহাজ চলে গেলে সস্থানে ফিরে আসে। অজস্র নৌকো আর লঞ্চ দেখলাম ভেঙে চলেছে নীল সমুদ্রের বুকে। এই ব্রীজটির নামহোলো পমবন ব্রীজ।
এই রাস্তাটির নাম আন্নাই ইন্দিরা গান্ধী রোড। দেখলাম বহু পর্যটক রাস্তার ধারে রেলিং এর কাছে গিয়ে এই ব্রীজের সাথে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। আবার অনেকে শুধু দর্শনেই তৃপ্ত। ওই জায়গাটা প্রেরণের পর রাস্তার একপাশে নজরে এলো এক বিশাল ঘেরা কম্পাউন্ড আর ভেতরে অনেকটা জায়গা জুড়ে গেরুয়া রঙের দোতলা দালান বাড়ি আর বিশাল প্রবেশদ্বার। সেই প্রবেশদ্বারে বড় বড় ইংরেজি হরফে লেখা রামকৃষ্ণ মঠ। দেখে সত্যিই যেন হতবাক হয়ে গেলাম যে এইরকম একটা পান্ডব বর্জিত জায়গায়ও রামকৃষ্ণ মঠ কমিশনের আশ্রম আছে এই ভেবে। যেখানে অন্ততঃ কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটারের মধ্যে কোন জনবসতি নেই বললেই চলে। কিভাবে কি যে হয় সত্যিই ভাববার বিষয় বৈকি!
যাহোক প্রায় তিন ঘন্টা পেরানোর পর আমরা হোটেলে পৌঁছলাম। নাম রাঘবেন্দ্র হোটেল। এক কিলোমিটারের মধ্যেই হাঁটা পথে রামেশ্বরম মন্দিরের পূর্ব বা প্রধান প্রবেশদ্বার। অর্থাৎ রামেশ্বরম মন্দিরে দিকের সাথী সামঞ্জস্য রেখে উত্তর ,দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম এই চারটি প্রবেশদ্বার আছে। পূর্ব প্রবেশদ্বারকে প্রধান প্রবেশদ্বার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। হোটেলে পুজোতে পুজোতে আমাদের দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিলো। সবাই পথশ্রমে ক্লান্ত হওয়ায় ঘন্টা তিনেক বিশ্রাম নিতে গিয়ে কখন যে সন্ধ্যা নেমে এসেছে বুঝতেও পারিনি। যাইহোক একটু বিশ্রামের পর আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিলো ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বৈজ্ঞানিক আব্দুল কালামের বাড়ি।
আব্দুল কালামের শৈশব থেকে জীবনের অনেকটা সময়ই রামেশ্বর মেয়ে কেটেছে। এমনকি তার শৈশবের পড়াশোনাও রামেশ্বর মন্দির ট্রাস্ট পরিচালিত একটি স্কুলে শুরু হয়েছিলো। একদমই সাদামাটা একটি দোতলা বাড়ি। দেখেই বোঝা যায় আব্দুল কালাম অমৃত লোকে যাত্রা করার পর তার স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটি মিউজিয়ামের মর্যাদা পেয়েছে এবং বাড়িটিতে কিছুটা চাকচিক্য এসেছে তাঁর প্রয়াত হওয়ার পরে। দোতলার যে ঘরগুলো উনি ব্যবহার করতেন সেখানে তার সব শংসাপত্র এবং দেশকে তার অবদানের কথা সাজিয়ে রাখা আছে দর্শনার্থীদের প্রদর্শনের জন্য। এই প্রচার বিমুখ সাদাসিধে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ মানুষটির সম্বন্ধে বহু অজানা তথ্য এখানে আসাতে জানা হোলো আমার।
এবার পথে ওই বাড়ির কাছে একটি ছোট্ট অতি সাধারণ মসজিদ চোখে পড়ল যেখানে তিনি প্রার্থনা করতেন। সত্যিই ওই মাপের একজন মানুষের জীবনযাত্রা যে এতটা সাধারণ ছিল এটা আজকের দিনে কল্পনারও অতীত।
এরপর একটু এদিক সেদিক ঘুরে আমরা আবার হোটেলে ফিরে এলাম রাতে ডিনারের সাথে যবণিকা পড়ল এই ভ্রমণ কাহিনীর প্রথম রাতের কথার।
দ্বিতীয় দিন ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সকাল আটটা বেজে গেলো। এরপর প্রাতঃরাশ সারতে উঠলেন তিন তলার ডাইনিং হলে যাওয়া হোলো। ওখানে ওখানে জানলা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়। আর দেখা যায় রামেশ্বরম্ মন্দিরের উত্তর প্রবেশদ্বার। প্রাতঃরাশ সেরে আমরা রওনা দিলাম প্রথমে লক্ষণ তীর্থমের উদ্দেশ্যে। এই মন্দিরটি দ্রাবিড়িয়ান স্থাপত্যে নির্মিত। মন্দিরের মধ্যে রাম লক্ষণ ও সীতাদেবীর মূর্তি রয়েছে। মন্দিরের চারিপাশে একটি ছোট পরীখা আছে। বলা হয় লক্ষণ এখানে একটি শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করে সেই পরীক্ষার জলে স্নান করে পূজা-অর্চনা করেছিলেন। ভক্তরা আজও বিশ্বাস করে থাকেন যে এই পবিত্র পরিখার জলে স্নান করে পাপ স্খালন হয়।
এরপর আমরা রওনা দিলাম পঞ্চমুখী হনুমানের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। আসতে বলে এই পঞ্চমুখী হনুমানের পাঁচটি মুখ হল ভগবান বজরংবলী, নরশীমা,আদিবরাহ,হায়াগ্রীভা এবং গারুদা। এই মন্দিরেও রাম ,লক্ষণ ,সীতা এবং হনুমানের মূর্তি স্থাপিত আছে। মন্দিরের বাইরে জলে ভাসমান পাথর বা শিলা রাখা আছে। যে পাথর বাঁশিলা দিয়ে রাম সমুদ্রের বুকে সেতু নির্মাণ করেছিলেন শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে। এই দুটো মন দিয়ে খুবই কাছাকাছি দু’কিলোমিটারের মধ্যেই হবে।
এরপর আমরা ভিলোন্ডির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। এটা রামেশ্বর মন্দির থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূর। ভিলোন্ডি তীর্থম হোলো সমুদ্রের লবণাক্ত জলের একধারে মিষ্টি পানীয় জলের উৎস। রামায়ণের বর্ণিত আছে রামচন্দ্র যখন সীতা মাতাকে উদ্ধার করে শ্রীলঙ্কা থেকে ভারতের সমুদ্র সৈকতে পৌঁছন কারণ মাতা সীতার খুব জল পিপাসা পেয়েছিল। তৃষ্ণার্ত সীতা মাতার জন্য পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে ভগবান শ্রীরাম তাঁর ধনুকটি ওই জায়গায় ডুবিয়ে দেন যার ফলে সমুদ্রের ওই বিশেষ জায়গা থেকে মিষ্টি জলের উৎসের সন্ধান পাওয়া যায়। সীতা মাতারও তৃষ্ণা নিবারণ হয়। আজও সমুদ্রের একধারে সৈকতের কাছে সেই মিষ্টি পানীয় জলের উৎসটি স্বমহিমায় বর্তমান। আমরাও সেই মিষ্টি জলের স্বাদ প্রাণভরে উপভোগ করেছি। একটা জেটির শেষমাথায় সমুদ্রের বুকে এই জলের উৎসটি। জেটিতে ওঠার আগে একটি শিবের মন্দিরও এখানে চোখে পড়ে।
এরপর আমাদের গন্তব্য হল ধনুষ কোডি সমুদ্র সৈকত। ভিলোন্ডি থেকে ধনুষকোডি সমুদ্র সৈকত প্রায় কুড়ি কিলোমিটার মতো হ’বে। রাস্তার দু’পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সমুদ্র। আর আশেপাশে বসতি বলতে কিছুই নেই প্রায়। শুধু মাঝে মাঝে দু একটা অস্থায়ী দোকান ঘর চোখে পড়ে। সে এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। রাস্তার পাশে মাঝে মাঝে নারকেল গাছের সারি। প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে আমরা পৌঁছলাম ধনুশ কোডি সমুদ্র সৈকতে প্রচুর দর্শনার্থীর ভিড় চোখে পড়লো। কিছু বিদেশী পর্যটকও ছিলো। ধনুষ কোডি মানে হচ্ছে ধনুকের শেষ প্রান্ত।
যা কিনা ভগবান শ্রীরাম এবং হিন্দুদের পবিত্র রামায়ণ সম্পর্কিত। ধনুষকোডি হোলো ভারতের শেষ সীমা। ধনুষকোডি রাম সেতু থেকে শ্রীলংকার দূরত্ব মাত্র পনেরো কিলোমিটার। সৈকত থেকে রাম সেতুটি পরিষ্কার নজরে আসে।ধনুষকোডি শহরটি সমুদ্র পরিবেষ্টিত। শহরের একপাশে বঙ্গোপসাগর আর এক পাশে ভারত মহাসাগর। সত্যিই এক অদ্ভুত অনুভূতিও বিরল অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রায় উত্তাল সমুদ্রের উদ্যাম পাগল হাওয়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে আবার আমরা রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্য রামর পথমের উদ্দেশ্যে। রামর পথম ধনুষকোডি সমুদ্র সৈকত থেকে প্রায় ঘন্টাদেড়েকের ক দূরত্ব। রামর পথমের ঐতিহাসিক বিশেষত্ব হলো এখানে এসে শ্রীরামচন্দ্র শ্রীলংকা যাওয়ার পথের পরিকল্পনা এবং বিশ্রাম করেছিলেন। এই রামর পথম মন্দিরে রামের পাদুকার পুজো করা হয়ে থাকে। এই মন্দিরটি দোতলা। তবে সিঁড়িগুলো বেশ উঁচু। মন্দির ঘিরে রয়েছেগন্ধমাদন পর্বত। যে পর্বত থেকে হনুমানজি ভগবান লক্ষণকে শক্তিশেল থেকে বাঁচানোর জন্য বিশল্যকরণী গাছ নিয়ে এসেছিলেন। ভগবান শ্রীরামের পাদুকা এই মন্দিরে সবচেয়ে উঁচুতে সংরক্ষিত আছে আজও। এই মন্দিরের উপর থেকে পুরো রামেশ্বরম শহর ও মন্দির পরিষ্কার নজরে আসে। যদিও মন্দিরটি তুলনায় খুব একটা বড় নয় মোটেই। ভক্তরা এখানে চৈত্র মাসের রামনবমী তিথিতে পরম্পরা মেনে সামিল হয় দেশ ও বিদেশের ভিন্ন ভিন্ন প্রান্ত থেকে। এরপর আবার আমাদের হোটেলে ফিরে আসা।
তৃতীয় দিনটি ছিলো রবিবারের সকাল।খুব ভোরে উঠে স্নান করে মন্দির ও জ্যোর্তিলিঙ্গ দর্শনের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে বেরিয়ে পড়লাম।
এবার মন্দির সমন্ধে দু’চার কথা বলা যাক্। এটি একটি হিন্দু মন্দির মূল নাম রামনাথস্বামী মন্দির। এই মন্দিরটি হিন্দুদের আরাধ্য দেবতাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই মন্দিরটি ভারতের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম একটি পবিত্র মন্দির। রামচন্দ্র যখন সীতা মাতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য সমুদ্রে সেতুবন্ধন করেছিলেন শ্রীলঙ্কায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, তখন রোজই যখন সেতু নির্মাণ হচ্ছে এবং রামচন্দ্র নিশ্চিন্ত হচ্ছেন ঠিক পরের দিনই শ্রীলংকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন তখন তিনি লক্ষ্য করলেন প্রত্যেকদিন রাতের বেলা সেতু নির্মাণ প্রায় শেষ হওয়ার পর রাবণের সেনাবাহিনী এসে সেই সম্পূর্ণ হওয়া সেতু ভেঙে দিয়ে যেতো। তখন বিভীষণ শ্রী রামচন্দ্রকে পরামর্শ দিলেন সেতুর উপর শিবলিঙ্গ বানিয়ে সেই শিবলিঙ্গের পূজো করতে। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে কারণ রাবণের উপাস্য দেবতা হলেন দেবাদিদেব মহাদেব।
শ্রী রামচন্দ্র বিভীষণের পরামর্শ মেনে শিবলিঙ্গ স্থাপন করলেন সেই সম্পূর্ণ সেতুর ঠিক মাঝখানে। এবার সমস্যা হল পুজো করার জন্য ব্রাহ্মণের প্রয়োজন যে। কারণ শ্রী রামচন্দ্র যে ক্ষত্রিয় বংশজাত। জানা গেলো রাবণ ব্রাহ্মণ বংশ জাত। তাই তাকেই আমন্ত্রণ করে শ্রী রামচন্দ্র সেই শিবলিঙ্গের অভিষেক করে ছিলেন। মিটেগেল সব সমস্যা। রামচন্দ্র এবং তার সেনা শ্রীলংকা আক্রমণ করে রাবণকে পড়াস্ত এবং বধ করে সীতা মাতাকে উদ্ধার করেছিলেন এ কথা তো সবারই জানা।
এই রামেশ্বরম হল পবিত্র চার ধামের একটি। এই মন্দিরটি দ্বাদশ শতকে পান্ডিয়ান রাজবংশের দ্বারা সম্প্রসারিত হয়। এই মন্দিরের মূল অংশের সংস্কার হয় জয়ভীরা সিনকায়ারিয়ান এবং তার উত্তরসূরী গুনভীরা সিনকায়ারিয়ান এর রাজত্বকালে। যারা ছিলো জাফনা রাজবংশের সম্রাট। এই মন্দিরটিতেই আছে ভারতের সব হিন্দু মন্দির গুলোর মধ্যে দীর্ঘতম করিডোর। এই মন্দির নির্মাণ করেন রাজা মূথুর মালিঙ্গা সেতুপতি। এই মন্দিরটিকে শৈব,বৈষ্ণব এবং ব্রাহ্মণদের একটি অতি পবিত্র তীর্থ হিসেবে মানা হয়ে থাকে।
মালিককাফুর চৌদ্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পান্ডিয়ান রাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে এবং সেখানে আলিয়া আল-দিন নামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। রামেশ্বরম মন্দির থেকে বহু স্বর্ণ ও অলংকার লুট করেন এবং এই মন্দিরটির অনেকটাই ধ্বংস সাধন
করেছিলেন তিনি। শোনা যায় আজ যে মন্দিরটি আমরা দেখছি সেটি সতেরো শকাব্দে নির্মিত হয়েছিলো। বিষ্ণুর সপ্তম অবতার শ্রীরামচন্দ্র শিবের আরাধনা করেন এবং মাতা সীতা ও লক্ষণকে সাথে নিয়ে এখানে শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা করেন ব্রহ্ম হত্যার পাপ থেকে মুক্তি পেতে।কারণ রাবণ ছিলেন অর্ধেক ব্রাহ্মণ যার পিতা ছিলেন ঋষি বিশ্বশ্রবা এবং মাতা নিকষা রাক্ষসী। ঋষি বিশ্বশ্রবা সপ্ত ঋষিদের একজন। ঋষি মুণিদের উপদেশ মেনে শ্রীরামচন্দ্র হনুমানজিকে আদেশ দেন হিমালয় থেকে শিবলিঙ্গ নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু হনুমানজি ফিরে আসতে দেরি করছেন দেখে মা সীতা সমুদ্র সৈকতের বালি দিয়ে শিবলিঙ্গ তৈরি করেন সেটিও গর্ভগৃহে স্থান পেয়েছে। এই কাহিনী বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডে বর্ণিত আছে।
রামেশ্বরম অনেক বিশিষ্ট তীর্থ এবং মন্দিরের সমন্বয়।রামেশ্বরম মন্দিরে জ্যোর্তিলিঙ্গ দর্শনের আগে অগ্নি তীর্থম দর্শন এবং স্নানের প্রথাও পরম্পরায় চলে আসছে। অগ্নি শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় আগুনকে বোঝায় এবং তীর্থং শব্দটির অর্থ হোলো পবিত্র জল। প্রাচীন গ্রন্থ এবং পৌরাণিক কাহিনীতে উল্লেখিত এই তীর্থস্থানটি হিন্দু ভক্তদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান। তারা এখানে পবিত্র জলে স্নান করে তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন। এটি মন্দিরের একমাত্র তীর্থম যা মন্দিরের প্রাঙ্গণের পূর্ব সৈকত কোণে অবস্থিত। স্কন্দ পুরাণ,নারদ পুরাণ এবং সেতু পুরাণে এই তীর্থটির উল্লেখ রয়েছে। রামেশ্বরম ভ্রমণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলা হয় এই অগ্নি তীর্থমকে। ভক্তরা প্রথমে এই পবিত্র জলে স্নান করে এবং তারপর রামেশ্বরমে তাদের তীর্থযাত্রা শুরু করে। যদিও সারা বছরই ভক্তরা এই তীর্থস্থানে যান তবে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার দিনে এখানে স্নান করা সবচেয়ে শুভ বলে মনে করা হয়।
এই অগ্নি তীর্থম শ্রীলঙ্কা থেকে শ্রীরামের প্রত্যাবর্তনের পর শ্রী রামচন্দ্র ও সীতা মাতার কাহিনী এই অগ্নি তীর্থমের সাথে জড়িত। দেবী সীতাকে রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করার পর শ্রী রাম অযোধ্যা রাজ্যে ফেরার রাস্তায় এই পথেই গিয়েছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে লঙ্কা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর ভগবান শ্রীরাম মা সীতার সতীত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন যে কারণে সীতামাতা অগ্নিপরীক্ষা দেন জ্বলন্ত অগ্নিকূন্ডে প্রবেশ করে। তাঁর উপর উত্থাপিত সন্দেহের কথা শুনে দেবী সীতা ভগবান লক্ষণকে এই স্থানে আগুন জ্বালাতে বলেছিলেন এবং সেই আগুনে প্রবেশ করে তিনি তার পবিত্রতার প্রমাণ করতে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকূন্ডের মাঝে বসেছিলেন। আগুনের মাঝে বসে থাকা সত্ত্বেও তিনি আহত হননি। আগুন তাঁর কেশাগ্রও ষ্পর্শ করতে পারেনি।অগ্নিদেব মাতা সীতাকে স্পর্শ করার পাপ ধুয়ে ফেলতে এই স্থানটিতে সমুদ্রে স্নান করেছিলেন এবং নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করে। তাই এই স্থানটিকে অগ্নি তীর্থম বলা হয়ে থাকে। বিশ্বাস করা হয় যে অগ্নি তীর্থম এর পবিত্র জলে স্নান করে ভক্তরা তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারেন। এটি ভক্তদের দ্বারা তাদের পূর্বপুরুষদের শান্তি ও মোক্ষের জন্য প্রার্থনা ও তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর পর আচার অনুষ্ঠান করার জন্যও ব্যবহার করা হয়।
এরপর আছে বাইশ কোডি বা বাইশ কুন্ডে স্নান। এই বাইশ সংখ্যার মাহাত্ম হোলো রামের তূণীরের বাইশটি তীর। পুরাণে আছে যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তাঁর জ্ঞাতিভাই,বয়োজ্যেষ্ঠ ও গুরু স্থানীয় দের এবং শ্রীকৃষ্ণ তাঁর নিজের মামা কংসকে হত্যার পাপের কর্মফল থেকে এই বাইশ কুন্ডের জলে স্নান করে প্রায়শ্চিত্ত ও মুক্তিলাভ করেছিলেন।এই বাইশ কোডি বা কুন্ডের জল কোথাও গরম আবার কোথাও ঠান্ডা। এই বাইশটি কুন্ডের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে এবং এই কুন্ড গুলো ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।তবে অগ্নি তীর্থম আর বাইশ কুন্ডে স্নান করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই বলে আমি প্রায় আধঘন্টা হেঁটে জ্যোর্তিলিঙ্গ দর্শন করেছি এবং পাশে থাকা সীতা মাতার নির্মিত ছোট শিবলিঙ্গটিও চাক্ষুষ করেছি। ঠিক পাশেই আছে পার্বতী মায়ের মন্দির। সেই মন্দির দর্শন করে মহালাড্ডু প্রসাদ নিয়ে প্রায় ঘন্টা দু’য়েক বাদে আবার হোটেলে ফিরে এসে প্রাতঃরাশ সেরে ঠিক দুপুর বারোটায় বেরিয়ে পড়লাম ত্রিচি হয়ে ব্যাঙ্গালোরের পথে।