ইতিহাসের কোনো কাহিনীই যেমন পরম সত্য নয় তেমনিই মহাভারতের কাহিনীর বিস্তারও শুরু থেকে অন্তিম পর্ব পর্যন্ত আমাদের যুক্তিবাদী মনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। মহাভারতের ঘটনাবলীর সিংহভাগই যুক্তির জালে সাজানো। তবুও কিছু ঘটনা প্রশ্ন জাগায় যুক্তিবাদী মানুষের মনে। সেই সব প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা লেখকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াসে বারোটি বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনার মধ্য দিয়ে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঠিক আঠেরো দিন স্থায়ী হয়েছিল। সেই যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ নামেও পরিচিত। সেই যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল অধর্মকে বিনাশ করে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করা। সে যুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন কেন্দ্রীয় চরিত্র। যাকে কেন্দ্র করে সে যুদ্ধের প্রতিটি ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। আর শেষ পর্যন্ত ন্যায় আর ধর্ম প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন পাঞ্চজন্যের গগনবিদারী নির্ঘোষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন সেই সময় মহা ধনুর্ধর
অর্জুন ভাববিহবল হয়ে পড়েন। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কাতর হয়ে বলেন "হে সখা আমি পারবো না আমার এইসব আত্মীয়দের হত্যা করতে।তাদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক।"সেই সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের ভাব বিহ্বলতা দূর করে বাস্তবের কঠিন মাটিতে নেমে যুদ্ধের প্রাঙ্গণে মনস্থির করে অংশ নিতে যে সব কথা বলেছিলেন সে সবই আজ
শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতার বাণী হয়ে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সেই সব গুঢ তত্ত্বজ্ঞান আজও গীতার বাণী হয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দিশারী হয়ে আছে। কুরুক্ষেত্রের কুরু পান্ডবদের ধর্মযুদ্ধ তে আজ শুধুই ইতিহাস। ইতিহাস কখনো গুজব ছড়ায় না তার এক ভিত্তি থাকে। আর থাকে যুক্তি গ্রাহ্য প্রমাণ। এক্ষেত্রে সব প্রমাণ আজও বর্তমান। যেমন যে অক্ষয়বটের নীচে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার বাণী শুনিয়েছিলেন সেই গাছটি গীতা বৃক্ষ নামে কুরুক্ষেত্রে ওই অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে একান্তে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
যে দ্বৈপায়ন হ্রধের গভীরে শেষ কৌরব দুর্যোধন আত্মরক্ষার জন্য লুকিয়ে ছিলেন সেই জলাশয় আজও আছে। আরো আছে ব্রহ্মসরোবর যে সরোবরের পাড়ে সূর্যাস্তের সময় কান পাতলে আজও শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্যের যুদ্ধবিরতির ঘোষণা অনুভব করা যায়। তাই যখন গীতাজ্ঞান কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন যা শুনে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের রক্তের সম্পর্ক আর আত্মীয়ের সঠিক সংজ্ঞা সম্বন্ধে মোহভঙ্গ হয়, আর তিনি তুলে নেন গান্ডীব। টংকার ওঠে গান্ডীবে। শুরু হয় কুরুক্ষেত্রের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অধর্মকে নাশ কোরে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার অদম্য প্রয়াসে।
গীতার সংস্কৃত অর্থ হল "গীত"অথবা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ নিঃসৃত পবিত্র শ্লোক।
শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা তাই সনাতন হিন্দু ধর্মের এক শাশ্বত পবিত্র গ্রন্থ। যে গ্রন্থে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ নিঃসৃত উপদেশ মা শ্লোকের আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেখানে শ্রীকৃষ্ণ বলেন "জীবের উৎপত্তির কারণও আমি আবার বিনাশের হেতুও আমি।"
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতার উপদেশ শুনিয়ে অর্জুনকে বিশ্বরূপ দর্শণ করিয়েছিলেন। যা কিনা ছিলো সাক্ষাৎ নারায়ণের রূপ। মহাভারত মহাকাব্যে উল্লেখিত আছে দুজন মাত্র ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আসল রূপ দেখেছিলেন।
প্রথমজন ছিলেন মধ্যম পান্ডব ভীমের প্রপৌত্র ঘটোৎকচ পুত্র বার্বারিক। আর দ্বিতীয় জন ছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাঙ্গনে তৃতীয় পাণ্ডব মহাধনুর্ধর অর্জুন। শ্রীকৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন না শুধুই সখা অর্জুনের রথের সারথী হয়ে যুদ্ধে অংশ নেবেন। তিনি সময়োপযোগী উপদেশ এবং পরামর্শ দিয়ে পান্ডবদের পথ নির্দেশ কোরে গিয়েছেন অবিরত।
এই আঠেরো দিনের যুদ্ধ ঘটোৎকচ পুত্র বার্বারিক শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে নীরব সাক্ষী হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই যখন যুদ্ধ শেষ হয় পান্ডবদের জয়ে সেই সময় পান্ডবদের মধ্যে তর্ক বাধে বিশেষ কোরে যুধিষ্ঠির ভীম আর অর্জুনের মধ্যে যে কে বড় যোদ্ধা এই নিয়ে তখন তারা সবাই শ্রীকৃষ্ণের কাছে সমাধান খুঁজতে আসে। শ্রীকৃষ্ণ চিরাচরিত স্মিত হাসি হেসে বলেন "আমি আর কি বোলবো বলো? তোমরা বরং ঐ বার্বারিককে জিজ্ঞেস কর।ও খুব কাছ থেকে এই যুদ্ধের প্রতিটি পলের অবিসম্বাদি সাক্ষী। তাই বার্বারিকই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার শ্রেষ্ঠ বিচারক।"
আর যখন পাণ্ডব ভাইয়েরা বার্বারিককে জিজ্ঞাসা করে তখন বার্বারিক উত্তরে বলে "আমি তো শুধুই নারায়ণের সুদর্শন চক্র দেখেছি আর দেখেছি মহামায়ার লেলিহান জিহ্বা রে আয় জিহ্বা ছিল কেবল রক্তপিপাসু। এছাড়া এই যুদ্ধে আমি আর কাউকেই দেখিনি।"তখন পাণ্ডবরা বুঝতে পারে যুদ্ধের আসল নায়ক কে। এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে খাটু শ্যাম আজও আছে রাজস্থানের শিখর জেলায় পাহাড়ের ওপর মন্দিরে। খাটু শ্যাম আজও পূর্ণার্থীদের আকর্ষণ করে। এসবই আজ ইতিহাস আর পুরাণের কথা। তবুও সাক্ষ্য প্রমাণ আজও কথা বলে। তাই যে গীতাজ্ঞান
যা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শুনিয়েছিলেন সেই গীতার প্রারম্ভিক একটি শ্লোক দিয়ে ইতি টানছি এই বিশ্লেষণের
"ওঁ পার্থায় প্রতিবোধিতাং ভগবতা নারায়ণেন স্বয়ম,
ব্যাসেন গ্রথিতাং পুরাণ- মুনিনা মধ্যে মহাভারতম,
অদ্বৈতামৃতবর্ষিণীম্ ভগবতীমষ্টাদশাধ্যায়িনীম্।
অম্ব!ত্বামনুসন্দধামি ভগবদ্ গীতে ভবদ্বেষিণীম্।। "
এই গীতার বাণী অমৃত তুল্য। যার প্রতিটি শ্লোক সব শাস্ত্রের শিরোভূষণ এবং সব সম্প্রদায়ভুক্ত মানবজাতির নমস্য। যা কিনা অনন্তকাল এই সনাতন ধর্মের স্তম্ভস্বরূপ। পতিত পাবন বৈষ্ণবদের প্রাণ প্রিয়। এই গীতাই শাশ্বত আর ভগবান শুদ্ধা ভক্তির পথ প্রদর্শক।
এই গীতা জ্ঞানী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মহাভারত মহাকাব্যে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে ভাববিহ্বল মোহান্ধ সখা অর্জুনকে যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে শুনিয়েছি
মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের পরেই কর্ণ অর্জুন দুটি চরিত্র যারা মহর্ষি ব্যাসদেবের রচিত মহাভারত মহাকাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র গুলোর অন্যতম। কর্ণ জন্মের ক্ষণ থেকেই এক উপেক্ষিত অবহেলিত চরিত্র যার জন্ম হয়েছিল রাজকুমারী কুন্তীর কুমারী অবস্থায় ঋষি দুর্বাসার আশীর্বাদে সূর্যদেবের আবাহনে। আর সমাজের কাছে মুখ রক্ষার জন্য কুমারী মা কুন্তী চোখের জল বুকে চেপে ভাসিয়ে
দিয়েছিলেন নাম গোত্রহীন সেই সদ্যোজাতকে নদীর জলে। কিন্তু ভুলতে পারেননি মাতা কুন্তী সারা জীবন সেই কথা। সেই শিশুর জীবন হোলো অবহেলা আর উপেক্ষায় ভরা। তাই কর্ণ এক জীবন সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক যে কিনা বঞ্চিত সেই অবোধ কাল থেকেই তার জন্মের প্রথম মৌলিক অধিকার মাতৃস্নেহ থেকে। যদিও সে পালিত হয় অধীরথ ও রাধার কাছে পিতৃ মাতৃ স্নেহে। এখানেই সে বেড়ে ওঠে আর কর্ণ নাম সেই অধীরথেরই দেওয়া। তার কাছে ছিল শুধু একটাই আশীর্বাদ সেটা সূর্যদেবের কাছ থেকে জন্মসূত্রে পাওয়া কবচকুণ্ডল যা তাকে অজেয় করে তুলেছিল ভবিষ্যতে। কর্ণের পালক পিতা ছিল রথের কারিগর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আর সেই কারণেই সে দ্রোণাচার্যের আশ্রমে ধনুর্বিদ্যা লাভের সুযোগ পেয়েছিলো কৌরব রাজপুত্রদের সাথে এক আসনে বসে।
সেই ঝণের পরিশোধ করেছিলেন কর্ণ আজীবন দুর্যোধনের সমস্ত অন্যায়ের সমর্থন কোরে।
এবার আসি অর্জুনের কথায়। অর্জুন পেয়েছিলো মাতৃ ও পিতৃ পরিচয় । তার পরিচিতি তৃতীয় পান্ডব নামে। সে রাজপুত্রের সমস্ত সুযোগ পেয়ে বেড়ে উঠেছিলো সময়ের সাথে এবং দ্রোণাচার্যের অতি প্রিয় শিষ্য ছিলো সে। অর্জুনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যিনি একাধারে ছিলেন অর্জুনের সখা এবং সব কাজের দিশারী। তাই অর্জুন সবদিক থেকেই হয়েছিলেন গরিমান্বিত। ঋষি দুর্বাসার আশীর্বাদে সূর্যের কৃপা দৃষ্টিতে যেমন কর্ণের জন্ম ঠিক তেমনি পান্ডুর সাথে বিবাহের পর দেবরাজ ইন্দ্রের আবাহনে অর্জুনের জন্ম। ইন্দ্র যেমন মেঘ এবং বৃষ্টির অধীশ্বর তেমনি সূর্য অন্ধকার দূর কোরে আলো প্রকাশের অধিশ্বর। তাই কর্ণ অর্জুনের মধ্যে চরিত্রের বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। যেটা তাদের একরকম জন্মগত ও স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আবার দেখি কর্ণ দানবীর কিন্তু অর্জুন বাস্তববাদী। যুদ্ধে পরাক্রমে দুজনেই প্রায় সমান সমান। এত কিছুর পরেও অর্জুন বারবার রক্ষা পেয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কূট কৌশলে। যখন কুন্তী কর্ণকে অনুরোধ করেন কর্ণ যেন অর্জুনকে বধ না করেন। কর্ণ কথা দিয়েছিলেন ছিলেন মাতা কুন্তীকে যে তার ছয় পুত্রের মধ্যে পাঁচ পুত্র জীবিত থাকবে। শুধু অর্জুন আর তার মধ্যে কে বেঁচে থাকবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অঙ্গনে সেই অঙ্গীকার তিনি করেননি কিন্তু মাতা কুন্তীর কাছে।আর কুন্তীর শত অনুরোধেও তিনি দূর্যোধনের সঙ্গ ছাড়তে রাজি হননি। এতটাই ছিলো কর্ণের কৃতজ্ঞতা বোধ আর চারিত্রিক দৃঢ়তা।
আজীবন ধর্মের পথে থাকা কর্ণ শুধু নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য প্রিয় বন্ধু দুর্যোধনের সব পাপ কর্মের সাথী হয়েছিলেন। যেমন শঠ শকুণীর চালে পাশা খেলায় যখন যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় হেরে যান আর যুধিষ্ঠির শেষ দান দ্রৌপদীকেও বাজী রেখে হেরে যান তখন কর্ণ দুর্যোধনকে সঙ্গ দিয়েছিলেন সেই পরাজিত পান্ডবদের চরম অপমানে উৎফুল্ল হয়েছিলেন তিনি।এমনকি দ্রৌপদীকে কটুক্তি করতেও পিছপা হননি মহাবীর কর্ণ। মোহে অন্ধ হয়ে বন্ধু দুর্যোধনের সব অপরাধকেই সমর্থন করে গেছেন কর্ণ। এটাকেই বোধ হয় বলে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। আর তার ফলও তিনি জীবদ্দশায় পেয়েছেন অধর্মের সাথী হয়ে।
আর যখন কৃষ্ণ দেখলেন কর্ণকে পরাস্ত করা প্রায় অসম্ভব কাজ তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুরোধে দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে কর্ণের কাছ থেকে হরণ করেছিলেন কবচ কুন্ডল। যা ছিল সূর্যের আশীর্বাদ কর্ণের প্রাণশক্তি। কর্ণের জানা ছিল সবই তবুও তিনি নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ফেলতে পিছুপা হন নি। তাই তিনি পরিচিত আজও দানবীর কর্ণ নামে। কর্ণের এরকম আরও অনেক কাহিনী আছে মহাভারতে।
কিন্তু অর্জুনের দানের উদাহরণ তেমন নেই বললেই চলে। যে জন্য কর্ণ দানবীর কর্ণ নামেই বিখ্যাত হয়েছেন আজও। আরও একটা কাহিনী আছে দান নিয়ে।অর্জুনের মনে মনে খুব ইচ্ছে যে তিনি ও দানবীর বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রিয় সখা অর্জুনের মনের কথা বুঝতে পেরে এক দান যজ্ঞের আয়োজন করেন। যেখানে অর্জুন এবং কর্ণ দুজনেই উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ প্রথমে অর্জুনকে দান বিতরণের সুযোগ দেন। অর্জুন বাস্তববাদী তাই সে সবাইকে নির্দেশ দিল এক এক করে এসে তার হাত থেকে দান গ্রহণ করতে। অর্জুনের দান পর্ব শেষ হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ণকে বললেন এবার তোমার পালা। কর্ণ শুধু বললেন এসবই তো তোমাদের তাই তোমরা তোমাদের ইচ্ছা মতো দানের সামগ্রী গ্রহণ করো। তারপর দানযজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন এখন বুঝতে পারলে পার্থ কেন কর্ণকে দানবীর কর্ণ বলা হয়? এটাই তফাৎ পার্থ তোমার আর কর্ণের। আবার দেখাযায় কর্ণ মানসিক দৃঢ়তায় ভরা এক অনমনীয় চরিত্র আর অর্জুন মাঝে মাঝেই ভাব বিহবল হয়ে পারেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরুতেই অর্জুন ভাববিহ্বল হয়ে কৃষ্ণকে বলেন "এরা সবাই আমার আত্নীয় আমার জ্ঞাতি আমি পারবোনা আমার সব আত্মীয়দের সাথে এই যুদ্ধ করতে।"গান্ডীব রেখে কপিধ্বজ রথ থেকে নেমে আসেন অর্জুন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখ থেকে গীতার বাণী ধ্বনিত হয়। অবশেষে তিনিই অর্জুনকে যখন বোঝান "হে পার্থ তুমি তো নিমিত্ত মাত্র "। দর্শন করান বিশ্বরূপ বলেন "যা ঘটছে তা অবশ্যম্ভাবী আমারই ইশারায় সব ঘটছে"। কেটে যায় অর্জুনের ভাব বিহ্বলতা। আবার গান্ডিব ধারন করেন তিনি। এমনকি অর্জুনের অপত্য স্নেহকেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। অভিমন্যু বধের গুঢ কারণও সেই একই কথা বলে।
পরিশেষে বলি কর্ণ আর অর্জুন মহাভারতের এই দুই কেন্দ্রীয় চরিত্র শুধুই বৈপরীতে ভরা।
মহাভারতের ব্যাপ্তি এতটাই যে বলা হয় ” জানি ভারতে তা নেই মহাভারতে“। আর এই মহাকাব্যের দার্শনিক গুঢতা কেবল ভারতের পৌরাণিক আখ্যানই নয় বরং এটিকে সমস্ত হিন্দুধর্ম এবং বৈদিক দর্শন ও সাহিত্যের সারসংক্ষেপও বলা যেতে পারে। “মহাভারত” নামটির উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত কাহিনী হোলো যে দেবতারা তুলা যন্ত্রের একদিকে চারটি বেদ রাখেন ও অন্যদিকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস প্রচারিত ভারত গ্রন্থটি রাখলে দেখা যায় ভারত গ্রন্থটির ভার চারটি বেদের চেয়েও অনেক বেশি। সেই কারণে ভারত গ্রন্থের বিশালতা দেখে দেবতা ও ঋষিগণ এর নামকরণ করেন “মহাভারত”, আবার একে পঞ্চম বেদও বলা হয়ে থাকে। ইহ জগতের সমস্ত শ্রেষ্ঠ বস্তুর সঙ্গে একে তুলনা করে বলা হয়েছে ”মহত্ত্বাদ ভআরতবত্ত্বআচ্চ মহাভারত মুচ্চতে।”অর্থাৎ যে বস্তুটি মহাভারতের কাহিনীতে পাওয়া যায় না তা ভারতবর্ষে তথা পুরো সংসারে পাওয়া যাবে না।
মহাভারতের বর্ণিত হয়েছে মহর্ষি বেদব্যাস হিমালয়ের এক পবিত্র গুহায় তপস্যা করবার পর মহাভারতের সম্পূর্ণ ঘটনাটি স্মরণ করেন এবং মনে মনেই এর রচনা করেন। ব্যাসদেবের ইচ্ছা হয় এই মহান কাহিনী সিদ্ধিদাতা গণেশ লিপিবদ্ধ করেন। গণেশ গ্রন্থটি লিখতে সম্মত হলেন কিন্তু তিনি শর্ত দিলেন যে একবার লেখা শুরু করলে তার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাসদেবের আবৃত্তি একটি বারও থামতে পারবে না।
তখন ব্যাস দেবও পাল্টা একটি শর্ত দিলেন যে গণেশ মে শ্লোকটি লিখবেন তার মর্মার্থ না বুঝে লিখতে পারবেন না। ভগবান গনেশ ও সেই প্রস্তাব স্বীকার করলেন। এইভাবে ব্যাসদেব মাঝে মাঝেই কিছু কঠিন শ্লোক রচনা করে ফেলতেন। আর যার ফলে গণেশকে সেই শ্লওকটইর অর্থ বুঝতে সময় লাগতো এবং সেই অবসরে ব্যাসদেব পরবর্তী নতুন শ্লোক গুলো রচনা করে ফেলতেন। এইভাবে মহাভারত রচনা করতে প্রায় তিন বছর লেগে যায়। মহর্ষি ব্যাসদেব প্রথমে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মের জয় সুচক উপাখ্যান যুক্ত এক লক্ষ শ্লোক সমন্বিত আদ্যজয় গ্রন্থ রচনা করেন। সবার শেষে তিনি ষাটলক্ষ শ্লোক সমন্বিত অন্য একটি গ্রন্থ রচনা করেন যে গ্রন্থের তিরিশ লক্ষ শ্লোক দিবো লোকে, পনেরো লক্ষ শ্লোক পিতৃ লোকে, চৌদ্দ লক্ষ শ্লোক রক্ষোযক্ষ লোকে স্থান পেয়েছে এবং অবশিষ্ট মাত্র এক লক্ষ শ্লোক এই মনুষ্যলোকে
“মহাভারত“ নামে সমাদৃত হয়েছে। মহাভারতের মূল উপজীব্য বিষয় হোলো কৌরব ও পান্ডবদের গৃহ বিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগের ও পরের ঘটনা প্রবাহ। তবে এই আখ্যানভাগের বাইরেও দর্শন ও ভক্তির অধিকাংশ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে। যেমন ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চার পুরুষার্থ সংক্রান্ত একটি আলোচনা সংযোজিত হয়েছে এই গ্রন্থে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মহাভারত রচয়িতা ব্যাস দেব।
অনেক গবেষক এই মহাকাব্যের ঐতিহাসিক বিকাশ ও রচনাকালীন স্তরগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন।
এখন যে গ্রন্থটি পাওয়া যায় তার প্রাচীনতম অংশটি মোটামুটি চারশ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ গুপ্ত যুগে রচিত হয়। মহাভারতের মূল পাঠ তার বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করে গুপ্ত যুগের প্রথম অংশে
মহাভারত কথাটির অর্থ হোলো ভরত বংশের মহান উপাখ্যান। পরে ব্যাসদেবের শীষ্য বৈশম্পায়ন সেই গ্রন্থকে বৃদ্ধি করে চব্বিশ হাজার শ্লোক বিশিষ্ট “মহাভারত“ গ্রন্থ রচনা করেন। পরে অপর এক শিষ্য উগ্রশ্রবা সৌতি ভারত গ্রন্থকে বৃদ্ধি করে এক লাখ শ্লোক বিশিষ্ট “মহাভারত”গ্রন্থ রচনা করেন বর্তমান মহাভারতে এক লক্ষ শ্লোক ও দীর্ঘ গদ্যাংশ রয়েছে। এই মহাকাব্যটির আয়তন ইলিয়াড ও ওডিসি কাব্য দুইটির মিলিত আয়তনের দশগুণ এবং রামায়ণের চারগুণ।
মহাভারত রচনা সম্পূর্ণ হওয়ার পর ব্যাসদেব এই মহাকাব্য তার সুপুত্র শুকদেবকে দিয়ে অধ্যায়ন করান এবং পরে শিষ্য পরম্পরায় গ্রন্থটি বৈশম্পায়ন, পৈল, জৈমিনি,অসিত-দেবল প্রভৃতি ঋষি দ্বারা পঠিত হয়।বৈশম্পায়ন এই কাহিনীটি প্রথম মনস্যদের মধ্যে ভরত নামে প্রচার করেন। অর্জুনের প্রপৌত্র মহারাজ জন্মেজয়ের মহাযজ্ঞে
ঋষি বৈশম্পায়ন ওই কাহিনী জন্মেজয় সহ সৌতি এবং মুনি ঋষিদের শোনান।
একসময় সম্রাট পরীক্ষিত তক্ষক নাগের দংশনে মারা গেলে ক্রোধের বসে পরিক্ষিত পুত্র জন্মেজয় বিশ্বের সমস্ত সাপেদের ধ্বংস করবার পর নিয়ে সর্পযজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু তক্ষকের অনুরোধে আস্তিক মুণি এই যজ্ঞ পন্ড করে দেন।
জন্মেজয়ের অনুতাপ হয় ও পাপ খন্ডন করতে অশ্ব ্মেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন। কিন্তু কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ করা অনর্থের কারণ মনে করে দেবরাজ ইন্দ্র ছল করে এই যজ্ঞও নষ্ট করেন ও জন্মেজয়ের ওপর ব্রহ্মহত্যার পাপ পড়ে। এই মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে তিনি ব্যাসদেবের পরামর্শ মত ঋষি বৈশম্পায়নের কাছ থেকে পবিত্র মহাভারতের কাহিনী শ্রবণ করে পাপমুক্ত হন। পরে ওই যজ্ঞে উপস্থিত গল্পকথক উগ্রশ্রবা সৌতি
কাহিনীটি শুনে তা নৈমিষারণ্যে যজ্ঞরত শৌনক ও অন্যান্য মুনিদের শোনান। আর এই ভাবেই মহাভারতের কাহিনী প্রচারিত হয়।
মহাভারতের শ্লোক দিয়েই ইতি টানছি এই প্রবন্ধের...
“তৃংশচ্ছাসহস্রন্তু দেবলোকে প্রতিষ্ঠিতম্।
পঞ্চদশ প্রক্তম রক্ষো যক্ষে চতুর্দশ।
একং শতসহস্রন্তু মানুষেষু প্রতিষ্ঠিতম্।।
মহাভারতে উল্লেখিত আছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যাপক অস্রশস্ত্র ব্যবহৃত হোতো। যেমন তরবারি, বল্লম, গদা, ধনুক এবং তীর আর আরো বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল সেই ধর্মযুদ্ধে।
মহাভারতে শুধু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধই নয় নানা পর্বে নানা যুদ্ধ হয়েছিল। আর সব যুদ্ধেই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছিল। আর এমন সব অস্ত্রের প্রয়োগ হয়েছিল যা বিশ্ব-ত্রাস সৃষ্টিকারী।
সেইসব অস্তের প্রয়োগের ফলে মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের এই পৃথিবী। আঠেরো দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একশ ষাট কোটি মানুষ
প্রাণ হারিয়েছিলেন। শুধুই তীর, ধনুক, গদা ও বর্ষার আঘাতে কি সত্যিই এত সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের ধারণা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে এমন সব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল যা কিনা আজকের পারমাণবিক অস্ত্রের মতনই ভয়াবহ।
ঐ যুদ্ধে আজকের দিনের বিশালের মতন ও কিছু ছোঁড়া হয়েছিল নিশ্চয়ই। যুদ্ধের বর্ণনায় এমন সব অস্ত্রের কথা বলা হয়েছে, যার মারণ ক্ষমতা পরমাণু অস্ত্রের মতনই। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন দীর্ঘ তপস্যা করে এইসব দৈব অস্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন।
এইসব দৈবাস্ত্র লাভের জন্য অর্জুনকে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল। সেই সব অস্ত্রের
মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হোলো ব্রহ্মাস্ত্র। মহাভারত ও পৌরাণিক নানান কাহিনীতে ব্রহ্মাস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। এই অস্ত্র যে বিধ্বংসী এবং তা যে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালাতে পারে তাও বারে বারে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ প্রথম থেকেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যাতে ব্রহ্মাস্ত প্রয়োগ না হয় তার চেষ্টা করে গেছেন। ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগের নিয়ম ছিলো শুধুমাত্র অশুভ শক্তির বিনাশের জন্যই।
ব্রহ্মাস্তের থেকেও শক্তিশালী ছিলো ব্রহ্মশীর্ষ অস্ত্র। সেই অস্ত্রের ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার মুখ থেকে নির্গত শক্তির সমতুল্য। আর এই অস্ত্র প্রয়োগে যে বিপুল ধ্বংসলীলা হতে পারে তা আধুনিক বিজ্ঞানের হাইড্রোজেন বোমার সমতুল বলেই বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করে থাকেন। এই অস্ত্রের প্রয়োগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এরপর আছে নারায়ণী অস্ত্র। এই অস্ত ্র বিশেষ যোগ্যতা বলে নারায়ণের কাছ থেকে লাভ করা যায়। এই কথাই বর্ণিত আছে মহাভারতে। এই অস্ত্র হাজার হাজার মিসাইল এর মারণ ক্ষমতার সমান বলে মনে করা হয়। তবে এই অস্ত্র একবারই হোক করা যেতো এবং তা থাকতো বিশেষ কারো কাছে। কারণ সবার পক্ষে এই অস্ত্র ব্যবহারের যোগ্যতা লাভ সম্ভব ছিলো না। এরপর আছে ব্রহ্মানন অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্রহ্মার পঞ্চম আনন্ অর্থাৎ মুখের সদৃশ। এই অস্ত্র গোটা বিশ্ব সংসারকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে এবং সেই ভাবেই তৈরি এই অস্ত্র। আর এই অস্ত্র প্রয়োগেরও নানান নীতি ও নৈতিকতা আছে। তাই এই অস্ত্র সমস্ত যোদ্ধাদের পক্ষে লাভ করা অসম্ভব ছিলো।
আরও আছে, ভার্পব অস্ত্র। এই অস্ত্রের মরণ ক্ষমতাও ব্রহ্মশীর্ষ অস্ত্রের মতনই। আর এই অস্ত্রের ব্যবহারেও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এই অস্ত্র ব্রহ্মাস্ত্র ও ব্রহ্মশীর্ষ কষ্ট কেউ ধ্বংস করার ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলো। সমুদ্রের জল ফুটন্ত হয়ে উঠতো এই অস্ত্রের ব্যবহারে।
এরপর ছিল পাসপোতো অস্ত্র। এই অস্ত্র লাভ করার আগে অর্জুনকে যুদ্ধ করতে হয়েছিলো দেবাদিদের শিবের সঙ্গে। শিব অর্জুনের বিরুদ্ধে প্রসন্ন হয়ে তাকে পাশুপত অস্ত্র দান করেছিলেন।
এই অস্ত্র চোখের বৃষ্টির মাধ্যমে প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল। তবে কোনো দুর্বল যোদ্ধার উপর এই অস্ত্র প্রয়োগ করার নিয়ম ছিলো না।
কথিত আছে মহাভারতের যুদ্ধের পরে এই সমস্ত বিধ্বংসী অস্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এমনকি মহাবীর অর্জুন পর্যন্ত সমস্ত শস্ত্র বিদ্যা হারিয়ে ফেলেন।
মহাভারতের যুদ্ধের কাহিনীর সূত্রপাত হয় রাজ সিংহাসনের অধিকার নিয়ে। একটি সত্য পালনের জন্য শান্তনুর পুত্র দেবব্রত আজীবন অবিবাহিত ছিলেন। ইনি সিংহাসনেও বসেননি। এইরকম দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কারণে তার নাম হয়েছিলো ভীষ্ম। ভীষ্ম রাজ্ সিংহাসন ত্যাগ করায় তারই কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্র বীর্য রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারই দুই পুত্রের নাম ছিলো ধৃতরাষ্ট্র এবং পান্ডু। ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন জন্মান্ধ। তাই বিচিত্র বীর্যের পর ছোট ভাই পান্ডু সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু পান্ডুর অকাল মৃত্যুর কারণে রাজা হন
ধৃতরাষ্ট্র এরপর প্রশ্ন উঠে কি হবে পরবর্তী রাজা পান্ডুর পুত্র না ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র। এই প্রশ্ন ঘিরে পারিবারিক বিবাদ ও নানা ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রূপ পায়। এবং যুদ্ধে জয়ী হয় পাণ্ডব পক্ষ। রাজদন্দ লাভ করেন জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠির। সেই যুদ্ধে ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন সহ একশত পুত্রের জীবনাবসান হয়। ধৃতরাষ্ট্র শোকে পাথর হয়ে যান। এই যুদ্ধ ভাই হয়েছিল ঠিক আঠেরো দিন। আঠেরোতম দিনে দুর্যোধনের মৃত্যুতে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। সেই যুদ্ধে আঠেরো অক্ষৌহিনী সৈন্য প্রাণ দেয়।
অতীত আছে যে বছরে যুদ্ধ হয়েছিল সেই বছর ত্রিশ দিনের মধ্যে তিনটি সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। গ্রহণকে জ্যোতি ষ শাস্ত্রে অশুভ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শুরুর ঠিক আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভাববিহবল অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তাই গীতা জ্ঞান হিসেবে হিন্দুদের পবিত্র গ্রন্থ ভাগবদ গীতা নামে আজও সমাদৃত। যা সনাতন ধর্মের শাশ্বত গ্রন্থ হিসেবে পবিত্র বলে স্বীকৃত। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে গীতা উপদেশের দ্বারা নির্দেশ দেন অপমানজনক পুরুষত্বহীনতার কাছে নতি শিকার না করতে এবং তার আত্মীয় গৌরবদের সাথে যুদ্ধ করতে। তিনি তাকে এটাও মনে করিয়ে দেন যে এটি ধার্মিকতা এবং অধার্মিকতার মধ্যে একটি যুদ্ধ এবং তিনি বলেন অর্জুনের কর্তব্য হোলো যে অধার্মিকতা বা পাপের কারণ কে সমর্থন যারা করে তাদের বিনাশ করা। কৃষ্ণ পাল। ঐশ্বরিক রূপ প্রকাশ করেন এবং ব্যাখ্যা করেন যে তিনি প্রতি যুগে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন যখন মন্দ বা দুষ্টু শক্তি মাথা তোলে।
দেহই হোলো কুরুক্ষেত্রের রূপ সেই দেহে পঞ্চ ইন্দ্রিয় হলো পাণ্ডবদের প্রতিভূ যারা প্রতি মুহূর্তে ভালো এবং মন্দ বোধের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে।
যখন মন্দ জয়ী হয় তখন মানুষের পতন অবস্বাম্ভাবী। আর মহাভারতের যুদ্ধ যে কুরুক্ষেত্রের ভুমিতে হয়েছিল এটা আমাদের সবারই জানা। এবং প্রচন্ড যুদ্ধে প্রাণ গিয়েছিল বেশিরভাগ যোদ্ধারই। কৌরব ও পাণ্ডবদের এই যুদ্ধে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের প্রাণ যায়। আর মহাভারতের যুদ্ধ কোথায় হবে সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল শ্রী কৃষ্ণের ওপরে। দুর্যোধন ও তার সাথীদের পাপ কাজে অতিষ্ঠ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ঠিক করেছিলেন যে এই যুদ্ধেই অধর্মের বিনাশ কোরে তিনি ধর্মের প্রতিষ্ঠা করবেন। তাই যেকোনো মূল্যেই এই যুদ্ধে গৌরবদের বিনাশ করা তাকেনিশ্চিত করতেই হোতো।
শ্রীকৃষ্ণের ও মনে হয়েছিল যে যুদ্ধে কৌরব পাণ্ডব পক্ষের একের পর এক সদস্যকে একে অন্যের দ্বারা হতো হতে দেখে দুই পক্ষ না সন্ধির পথে হাটে। প্রচন্ড রক্তপাত ও সংঘর্ষ দেখে ভাইয়ে ভাইয়ে হারানো প্রীতি আবার না ফিরে আসে। তাইতা যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেই কারণে যুদ্ধের জন্য তিনি এমন প্রান্তর চেয়েছিলেন যেখানে ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের প্রাণনাশের পরম্পরা আছে। ভাইয়ের আঘাতে ভাইয়ের বুক থেকে বেরোনো রক্তের দাগের কলঙ্ক কৌরব পাণ্ডবদের মধ্যে প্রীতি ভাব জাগাতে পারবে না এমন প্রান্তর। চেয়েছিলেন তিনি। তাই তিনি বিভিন্ন স্থানে লোক পাঠিয়েছিলেন খোঁজ নিতে। তারই এক অনুচর এসে তাকে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরের ইতিহাস জানান। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে একবার এক বড় দাদা তার ছোট ভাইকে দেখে চাষের ক্ষেতে বাঁধ দিতে বলে। না হলে সব জল তার জমিতে ঢুকে যাচ্ছিল। ছোট ভাই বাদ দিতে অস্বীকার করলে দাদা রেগে গিয়ে ভাইকে মেরে তার মৃতদেহ টেনে নিয়ে গিয়ে জলের মুখে আটকে বাঁধ দেয়। এই ঘটনার কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ স্থির করেন যে সেখানেই হবে মহাভারতের যুদ্ধ। এসবই মহাভারতের যুদ্ধের বিভিন্ন আঙ্গিক।
মহাভারতের মূল উপজীব্য বিষয় হোলো কৌরব ও পান্ডবদের গৃহ বিবাদ এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে এবং পরের ঘটনা প্রবাহ। আর এই আখ্যান বাঘের বাইরেও দর্শনে ভক্তির বেশিরভাগ উপাদানই এই মহাকাব্যে সংযোজিত হয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মহাভারতের রচয়িতা মহর্ষি, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাস। আবার এই মহাকাব্যের ঐতিহাসিক বিকাশ ও রচনাকালী ন স্তরগুলো নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে। বর্তমানে মহাভারত মহাকাব্য মোটামুটি চারশ খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ গুপ্তযুগে রচিত হয়। মহাভারতের মূল পাঠ তার বর্তমান রূপটি পরিগ্রহ করে গুপ্ত যুগের প্রথমাংশে। মহাভারত কথাটির অর্থ হলো ভারতবর্ষের মহান উপাখ্যান। তাই মহাভারত যেমন একাধারে মহাকাব্য তেমনি মহাভারতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও অনস্বীকার্য।
আর মহসি ব্যাসদেব মহাভারত মহাকাব্যটি রচনা করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ঘটে যাওয়ার পরে।
কুরুক্ষেত্র সহ আরো প্রমাণ আজও আছে। যদিও মহাভারতের সময়কাল নিয়ে বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন মত প্রকাশ করে থাকেন। সেই বিখ্যাত ভারতীয় গণিতজ্ঞ ও মহাকাশবিদ বরাহমিহীদের সময় থেকে ভারতীয় গবেষক বিএন আচার, এম এস রাজারাম, কে সদানন্দ প্রমুখ পর্যন্ত। যেহেতু মহাভারত গ্রন্থে লিপিবদ্ধ সেক্ষেত্রে কিছু ঘটনা অলৌকিক বা অতিরঞ্জিত হয়ে থাকতেই পারে। তবে পুরোটাই যে কল্পকাহিনী এমনটা কিন্তু বলার সুযোগ একেবারেই নেই। তাই এক কথায় বলা যায় মহাভারত একটি ইতিহাস নির্ভর মহাকাব্য। আসলে প্রাচীন ভারতে কোন ইতিহাসবিদ ছিলেন না আর সেই কারণে অতীতের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা বা ইতিহাস কি বিষয় সেটাই ভারতবর্ষের মানুষের কাছে অজানাই ছিলো। যে কারণে প্রাচীন ভারতের যেসব ইতিহাস পাওয়া যায় তার সমস্তই রাজাদের কীর্তির বা তাদের নিয়ে লেখা প্রশস্তি মূলক গ্রন্থ থেকে পাওয়া।
মহাভারত কে অনেক সময় কুমারের লেখা ইলিয়ড ও ওডিসির মত ফিকশন বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খুলনকার্য ও তার বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মহাভারত ও তার সময় কালের পক্ষে জোরালো যুক্তি পাওয়া যায়। স্বয়ং মহাভারতকার বেদ ব্যাস তার রচনাকে ইতিহাস বলেছেন। এখানে ইতিহাসের অর্থ হোলো
এইসব ঘটনা ঘটেছিলো। তাই যদি মহাভারত শুধুই কল্পনা হত তাহলে বেদম্বেষ থেকে মহাকাব্য বা কথা বলে উল্লেখ করতেন।
কথিত আছে, মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদ ব্যাস যে কাহিনী রচনা করেন তার নাম জয় বা জয় সংহিতা এবং তা নাকি ছিল আট হাজার আটশো শ্লোক সম্বলিত। কৃষ্ণ দুই পালনের অন্যতম শিষ্য বৈশম্পায়ন যখন পরীক্ষিতের পুত্র রাজা জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে এই কাহিনীর বর্ণনা করেন তখন উপাখ্যানযুক্ত হয়ে এই কাহিনীর শ্লোক সংখ্যা হয় চব্বিশ হাজার এবং কাহিনী নাম হয় ভারত। পরবর্তী প্রজন্মে কথক অগ্রস্রবা যখন শৌণক ও অন্যান্য মুনিদের কাছে এই কাহিনীর বর্ণনা করেন তখন কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে গ্রন্থের শ্লোক সংখ্যা এক লাখের বেশি হয়ে যায় তাই বর্তমান মহাভারতের কোনটি মূল কাহিনী এবং কোনগুলি প্রক্ষিপ্ত অংশ তা আজও নির্ধারিত হয়নি।
মহারাষ্ট্রের পুনের ”দি ভান্ডার কার ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট“এর গবেষকরা ১৯১৯ থেকে ১৯৬৩ এর মধ্যে দেশে ও বিদেশে রক্ষিত বিভিন্ন পুঁথি বিশ্লেষণ করে উনিশ খন্ডে তেরো হাজার পৃষ্ঠা সম্বলিত মহাভারতের একটি সংস্করণ প্রস্তুত করেন। বাইশে সেপ্টেম্বর ১৯৬৩ সালে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাননীয় সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন এই সংস্করণটি প্রকাশ করেন।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ” ইহা কোন ব্যক্তিবিশেষের রচিত ইতিহাস নহে। যা একটি জাতির স্বরচিত ইতিহাস ।“সুতরাং মহাভারতের ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে আছে তা রবীন্দ্রনাথের উক্তি থেকেই প্রতিয়মান হয়।
মহাভারতের অবশ্যই ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে এবং তার যুক্তি ও প্রমাণও আছে সেই ছোটো বয়স থেকে পুরাণের গল্পগুলি এমনভাবে আমরা শুনে এসেছি যে ভারতের সুপ্রাচীন অতীত সম্পর্কে আমাদের ধারণা শুধুমাত্র মুনি,ঋষি, রাজা, মন্ত্রী, রাক্ষস, অসুর, বন বালক-বালিকা, আশ্রম আর রাজপ্রাসাদ জাতীয় গল্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে আমরা সাধারণ ভারতীয়রা অন্য কিছু যেন ভাবতেই পারি না। আমরা শুধু জেনে থাকি আমাদের দেশের ভূগোল ও সংস্কৃতি বহু বহু প্রাচীন। আমাদের সভ্যতা অনাদিকাদের পুরাণ আর ইতিহাসের মিশ্রণের আবর্তে এভাবেই ঘুরপাক খেতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি আমরা। এই কারণেই ভারত ইতিহাসের আদি পর্যায় কে ”ইতিহাস-পুরাণম“আখ্যা দেওয়াও হয়ে থাকে।
ঐতিহাসিকতার বিবিকে মহাভারতের ঘটনাবলীর কাল নির্ণয় করা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কবে ঘটেছিল এই ঘটনাগুলি? কিসের ভিত্তিতে এই কাল নির্ণয় করা হবে? এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলিতে মনে রাখতে হবে আলাদা আলাদা সময়ে ইতিহাসের রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ভিন্নতর হয়ে থাকে।
প্রসঙ্গত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার কৃষ্ণচরিত্রে পৌরাণিক বংশলতিকা অনুযায়ী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়কাল নিরূপণ করেছেন ১৪৩০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ। আসলে লোককথায় মানুষের মুখে মুখে এমন কিছু গল্প উড়ে বেড়ায় যা আসলে মিথ। সেই মিথ এমনভাবেই ইতিহাসের ঘটনা ক্রমের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে যে তাকে আলাদা করাই প্রায় কঠিন কাজ। এই মিথকে কেন্দ্র করেই মধ্যযুগের রচিত কিছু পুস্তকে ইন্দ্রপ্রস্থের উল্লেখ আছে। যেমন এই মিথকে কেন্দ্র করেই রাবণের
আকাশ চারি রথের গল্প শোনা যায়। আর চতুর্দশ শতকের পাথরের লেখা মালায় ইন্দ্রপ্রস্থের উল্লেখও সেই মিথ কেন্দ্রিক।
কিছু পৌরাণিক কাহিনীর মতে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গান্ধার রাজ্যের রাজা সুবলের কন্যা ছিলেন গান্ধারী। তার প্রকৃত নাম জানা যায় না। পিতার নামে সুবল কন্যা এবং তার জন্মস্থান গান্ধারের নাম অনুসারে গান্ধারী নামে পরিচিত ছিলেন। আর মন পরিপূর্ণ ছিল মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায়। তোমার কি অবস্থায় দেবাদীদের মহাদেবের কাছে শত পুত্র লাভের বর প্রার্থনা করেছিলেন। ভীষ্ম পিতামহ এর সাথে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের জন্য গান্ধারাজের কাছে প্রস্তাব পাঠান।
গান্ধারীকে হস্তিনাপুরে পাঠান এবং সেখানেই তার সাথে ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহ সম্পন্ন হয়। স্বামীর অন্ধত্বের কারণে গান্ধারী সব সময় চোখে একখণ্ড কাপড় বেঁধে রাখতেন। একদিন মহর্ষি বেদব্যাস ক্ষুধার্ত হয়ে হস্তিনাপুরীতে এলে গান্ধারিতার যতই চিত্ত সেবা করে ঋষিকে সন্তুষ্ট করেন। পরিতুষ্ট মাউশি তাকে বর দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গান্ধারী তার কাছে শত পুত্র লাভের বর প্রার্থনা করে তা লাভ করেন।
গর্ভবতী হওয়ার পর দুই বছরেও তার সন্তান প্রসব না হয় এবং পান্ডুর প্রথম পুত্র যুধিষ্ঠিরের জন্ম হওয়ায় গান্ধারী ঈশ্বর নিজের উদরে আঘাত করতে থাকেন। ফলে ইনি একটি লৌহ কঠিন মাংসপিণ্ড ওসব করেন। তখন তিনি ক্ষোভে দুঃখে
সেই মাংসপিণ্ড ফেলে দিতে উদ্যোগী হোলে ব্যাসদের সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে এই কর্ম থেকে নিবৃত করেন। পরে ব্যাসদেবের উপদেশ এক শতটি ঘৃতপূর্ণ কুন্ডু স্থাপন করে শীতল জলে সেই মাংসপিণ্ডটি ধৌত করেন। ফলে মাংসপিণ্ডটি একশো এক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ওরে আরো একটি কুণ্ড স্থাপন করে এই একশত একটি খন্ড রেখে দেওয়া হয়। এক বৎসর পর এই মাংসপিণ্ড থেকে প্রথমে দূর্যোধন ও এক বছর এক মাসের মধ্যে অন্যান্য নিরানব্বইটি পুত্র ও একটি কন্যার জন্ম হয়। সেই কন্যার নাম ছিল দুঃশলা। সেই দুঃশলার পরে হিন্দুরা আজ জয় দ্রথের সাথে বিবাহ হয়।
গন্ধরাজ সুবলের মৃত্যুর পর গান্ধারের শাসনভার শকুনির হাতে আসে। রাজা সুমনের পরিবার নষ্টের জন্য ভীষ্মকে দায়ী মনে করতেন শকুনি। তাই প্রতিশোধ তোলার জন্য গৌরব পান্ডবদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ও যুদ্ধ বাঁধিয়ে হস্তিনাপুর নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করেন শকুনি। তাই নিজের শতপুত্র হারানোর পর ক্ষুব্ধ গান্ধারী শকুনি কে অভিশাপ দেন যেমন শকুনি তার শত পুত্রকে হত্যা করিয়েছে। সেই রকম তার রাজ্য কখনও শান্তি থাকবে না। সেই অভিশাপের ফল আজও বয়ে বেড়াচ্ছে সেদিনের গান্ধার মানে আজকের আফগানিস্তান। সে দেশকে আজও অস্থিরতার প্রতীক হিসেবেই দেখা হয়। মানে সেই দেশ গান্ধীর অভিশাপ থেকে এখনও মুক্তি পায়নি।
কবে গান্ধারীর অন্ধ মাতৃস্নেহে অন্ধ হয়ে তিনি দুর্যোধনের সব দোষই ক্ষমার চোখে দেখেছেন। আর ফলস্বরূপ দুর্যোধন দুঃশাসন অপরাধের পর অপরাধ করে গেছেন। গান্ধার ীর হৃদয় ছিল অ্পত্য স্নেহে ভরা। তাই যেমন তিনি কাপড় দিয়ে নিজের চোখ বেঁধে রাখতেন তেমনি দুর্যোধনের সব দোষী তিনি মাফ করে দিতেন। তাই তার অন্ধ মাতৃস্নেহও কৌরবদের সবংশে ধ্বংস হওয়ার আসল কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। আজও অনেক মা আছেন। যারা গান্ধারির মতো আচরণ করে থাকেন। কেউ কেউ জীবদ্দশায় সেই অন্ধ অপরত্য স্নেহের ফল ভোগ করেন এবং কষ্ট পান।
তাই গান্ধারীরা আজও আছে। এই সমাজে যারা অকথ্য স্নেহে অন্ধ থাকেন।
তবে গান্ধারীর কিছু ন্যায় বোধও ছিল। কপট কৌশলে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির কে পরাজিত ও দ্রৌপদীকে ভরা রাজসভায় অপমানিত করার পর গান্ধারী একাধিকবার অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে দুর্যোধনকে পরিত্যাগের জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু পুত্র স্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সেই অনুরোধে কোন ফল হয় না। মেজু পুত্রের অন্যায় আচরণ তিনি মার্জনা করতে পারেন নি। একমাত্র দুর্যোধনের হাতেই যে গুরুকুল ধ্বংস হবে তা তিনি পূর্বেই জ্ঞাত হন। উন্মুক্ত পান্ডবদের অর্ধ রাজ্য দিতে গান্ধারী যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসের পর যখন পান্ডবেরা কৃষ্ণকে হস্তিনাপুরে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন তখন গান্ধারী রা সবাই এসে দুর্যোধনকে সন্ধি উপদেশ দিয়ে তিরস্কার করে বলেন যে ধর্মহীন ঐশ্বর্য প্রাপ্তির চেষ্টার পরিনাম মৃত্যু ডেকে আনে। দূর্যোধন মাতৃবাক্য অবজ্ঞা করে সভাগৃহ ত্যাগ করেন।
দ্রৌপদী মহাভারত মহাকাব্যের এক কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র। তিনি দ্রুপদ রাজার কন্যা বলে তার নাম দ্রৌপদী। আবার তিনি পান্চালী ও যাজ্ঞসেনী নামেও পরিচিতা। তিনি তার ধর্ম শীলতা, সাহসিকতা ও বহু অতীতের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে অন্য কোন নারী তার মত জীবন্ত রূপে চিত্রিত হননি।
দ্রৌপদী নারী শক্তির মূর্ত প্রতীক এবং সাংগঠনিক ক্ষমতায় ভরপুর যে নারী পুরুষকে পরিচালনা করতে সক্ষম। একেবারেই অবলা নন তিনি। জয়দ্রথ এবং কীচককে ধাক্কা দিয়ে ভূতলশায়ী করেছিলেন দ্রৌপদী। তিনি তেজস্বিনী ,স্পষ্টবাদী, তীক্ষ্ণ বাক্যে নিষ্ক্রিয় পুরুষদের উত্তেজিত করার স্বভাবজাত গুণের অধিকারী ছিলেন। তাকে ভাগ্য বিরম্বনায় অনেক কঠিন সময়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো বারবার।
তুমি কিন্তু নিজের সহনশীলতার গুনে সেই উদ্ভূত পরিস্থিতি কাটি য়ে উঠেছেন বিভিন্ন সময়ে। তাই দ্রৌপদী মোটেও শুধুই ট্রাজিক চরিত্র নন। দ্রৌপদীর জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা হোলো হস্তিনাপুর রাজসভায় শকুনির ষড়যন্ত্রে যুধিষ্ঠিরেরপাশা খেলা। দুজন দ্বারা আয়োজিত পাশা খেলায় জ্যেষ্ঠ পান্ডব যুধিষ্ঠির তার রাজ্য সম্পত্তি এমনকি অনুজ ভাইদের এবং পত্নী দ্রৌপদীকেও বাজি রেখে হেরে যান। প্রতিহিংসা পরায়ণ কৌরবরা এবং সঙ্গে কর ও প্রকাশ্য রাজসভায় দ্রৌপদীকে অপমান করেন। দ্বিতীয় কৌরব দুঃশাসন হস্তিনাপুরের ভরা রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের চেষ্টা করে। শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে
দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা পায়। এখানে দ্রৌপদী চরিত্রটি সত্যিই ট্রাজিক। যার মহাবীর পাঁচ স্বামীও তাকে এই অপমানের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি যখন দ্রৌপদী সবার কাছে কাতর আরতিতে সম্মান রক্ষার আবেদন করেছিলেন। সেই পাশা খেলার হারের কারণে দ্রৌপদী ও পাণ্ডবরা বারো বৎসর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসে নির্বাসনে কাটাতে হয়। এই সময় দ্রৌপদী নানা ভাগ্যবিরম্বনার সম্মুখীন হন। গত বাস শেষ হওয়ার পর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হয়। পরিশেষে সব ভাগ্যবিরম্বনা অতিক্রম করে তিনি সম্রাজ্ঞী রূপে প্রতিষ্ঠিত হন।
দ্রৌপদী প্রাতস্মরণীয় পঞ্চকন্যাদের অন্যতম। তার জীবন গাঁথা বিভিন্ন শিল্পকলা, অভিনয় এবং বিভিন্ন সাহিত্যে নারীদের অনুপ্রেরণাও বটে। দ্রৌপদীর দায়িত্ববোধ এমনই ছিল যে তিনি প্রতিদিন অভুক্ত থেকে দেখতেন সকলের হাড়াদি সমাপ্ত হয়েছে কিনা। সম্রাজ্ঞী রূপে দ্রৌপদী অত্যন্ত ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করতেন। তার ব্যস্ত জীবনের বর্ণনা মহাভারতের বন পর্বে সত্যভামার সাথে তার কথোপকথন থেকে জানা যায়। তিনি সকলের আগে জাগতেন এবং সকলের শেষে নিদ্রা যেতেন। তিনি অন্তঃপুর পরিচালনা করতেন এবং প্রাসাদের সব দাস-দাসী কি করে সেসব সংবাদ রাখতেন। এমনকি প্রাসাদের গোপালক, পর্যন্ত সবারই সংবাদ রাখতেন। পাণ্ডবরা সমস্ত পশুদের ভার দ্রৌপদীকে দিয়ে অন্য কাজ করতেন। সাম্রাজ্যের সব ব্যয় সম্পর্কে একমাত্র দ্রৌপদীই জানতেন। রাজ কোষাগারের সমস্ত বিষয় তিনি জানতেন। দ্রৌপদী সব কিছু ত্যাগ করে নিজের কর্তব্যের ভার বহন করতেন দিনরাত এক করে দিয়ে।
বনবাসের শেষ বছরে একদিন জয়দ্রথ কাম্য বনে উপস্থিত হন। তিনি বিবাহের জন্য শাল্ব রাজ্যে যাচ্ছিলেন। সেখানে দ্রৌপদীকে দেখে মুগ্ধ হন। সে সময় পান্ডুবড়া ধৌম্য পুরোহিতকে দ্রৌপদীর পাহারায় রেখে শিকারে যান। জয়দ্রথ আশ্রমে আসলে দ্রৌপদী তাকে পাদ্যঅর্ঘ্য দিয়ে যথাযোগ্য সম্মান করেন। তিনি ছিলেন ধুর দুঃশলার স্বামী। কিন্তু জয়দ্রথ তাকে বলপূর্বক যে রথে তোলার চেষ্টা করলে দ্রৌপদী তাকে ধাক্কা দিয়ে ভূপাদিত করে সাহায্যের জন্য ধৌম্যকে ডাকতে থাকেন। ধৌম্য জয়দ্রথকে নিবৃত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তারপর পান্ডবরা এসে পরলে মধ্যম পান্ডব ভীম সেন জয়দ্রথকে যথাযোগ্য শাস্তি দেন।
একই রকম ঘটনা ঘটেছিল অজ্ঞাতবাস পর্বে। যেখানে মহাভারতের বিরাট পর্বে দেখা যায় দ্রৌপদী সেখানে সৈরিন্ধ্রী নামে বিরাট পত্নী সুদেষ্ণার সহচরী ছিলেন। সেই সময় মহারাজ বিরাটের শ্যালক কীচক দ্রৌপদীকে দেখে ফেলেন এবং মুগ্ধ হয়ে তার বোন সুদেষ্ণার কাছে দ্রৌপদীকে কামনা করেন। দ্রৌপদীকে নিজের বাসনার কথা বললে দ্রৌপদী তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। তবুও কীচক লোভ সম্বরণ করতে পারে না সে দ্রৌপদীর হাত ধরে ফেলে এবং তার কেশ আকর্ষণ করে। মহারাজবিরাটের কাছে বিচার চাইলে তিনিও কর্ণপাত করেন না দ্রৌপদীর কাতর আবেদনে। আবারো তাড়াতাড়ি যাবে আসরে অবতীর্ণ হন মধ্যম পান্ডব ভীম সেন।
দ্রৌপদীর জীবনের আরও এক ঘটনা হোলো যখন দ্রৌপদীর পাঁচ ঘুমন্ত সন্তানকে দ্রোণপুত্র অশ্বথামা পাণ্ডব মনে করে হত্যা করে। তাই দুপুরের চরিত্র যেমন ট্যাজিক তেমনই সেই ট্রাজেডিকে তিনি নিজে গুনে অতিক্রম করার দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। আর যখনই তিনি বিপদে পড়েছেন সখা কৃষ্ণকে স্মরণ করেছেন তিনি প্রতিটি বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করে গেছেন পরিত্রাতা হয়ে।
কুন্তীভোজ রাজার কন্যা কুন্তী। তিনি তরুণী সুন্দরী এবং তেজেরও প্রতীক। অপরদিকে গান্ধারী হলেন গান্ধার রাজ দুহিতা। যৌবনে কুন্তীর বিবাহ হয় পান্ডুর সাথে। কিন্তু পান্ডু ছিলেন চিররুগ্ন এবং বংশ রক্ষায় অক্ষম। তাই ঋষি দুর্বাসার থেকে প্রাপ্ত আশীর্বাদে কুন্তী দেবতাদের আবাহন করে একে একে যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুনকে পুত্ররূপে লাভ করেন এবং কুমারী অবস্থায় লাভ করেন কর্ণকে। যারা যথাক্রমে ধর্ম,পবন, ইন্দ্র ও সূর্য দেবতাদের আশীর্বাদ ধন্য। পান্ডু পরে আবার মাদ্রীকেও বিবাহ করেন।
কুন্তীকে অনুসরণ করে মাদ্রীও অশ্বিনীকুমার ভাতৃদ্বয়কে আবাহন করে নকুল ও সহদেবকে পুত্র রূপে লাভ করেন। কিছুকাল পরে পান্ডুর মৃত্যু হয় এবং মাদ্রী সহমৃতা হলে বিধবা কুন্তী একাই পঞ্চপান্ডবের মা হয়েছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এবং নিজের তিন পুত্রের থেকে তিনি নকুল ও সহদেবকে বেশি স্নেহ করতেন। এখানেই কুন্তীর বিশেষত্ব। আর তিনি কোনদিন কপটতার আশ্রয় নেননি। অন্যদিকে গান্ধারীর বিবাহ হয় জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে। স্বামীর অন্ধত্বের জন্য তিনিও চোখে কাপড় বেঁধে রাখতেন। তিনি ধীরে ধীরে আবিষ্কার করলেন যে তার স্বামীর অন্ধত্ব আরো অনেক গভীর এবং অনেক বড় মাপের যে অন্ধত্ব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক। আর এর মধ্যে ভ্রান্ত বোধ নেই আছে শুধু আত্মপ্রতারণা।
কৌরবদের চরিত্র, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কার্য পদ্ধতি সব জেনেও শুধুমাত্র নিজের পুত্র বলে তাদের সব অপরাধ সমর্থন করা অন্যায় এবং এই অপরাধ গুলি সংখ্যায় যেমন বেশি কালপরিসরে তেমনই বিস্তৃত। তাই গান্ধারী নীতি বোধের প্রেরণায় বারবার বলেছেন পুত্র পক্ষ ত্যাগ করে পান্ডবদের ন্যায্য প্রাপ্য সিংহাসন তাদের ফিরিয়ে দিতে। কারণ তারা ন্যায়নিষ্ঠ। কৌরবরা দীর্ঘকাল ধরে পরপর মিথ্যাচরণ ও অন্যায় করেছেন তাই সিংহাসনে তাদের অধিকার থাকতে পারে না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের চক্ষুই শুধু অন্ধ ছিল না তার নীতিবোধ বলেও কিছুই ছিলো না। ছিল না কোন আধ্যাত্মিক বোধের দৃষ্টি। শুধু অন্ধত্বের দোহাই দিয়ে প্রকৃত পাপের দায় থেকে তাই তার কোন মুক্তি নেই। ধৃতরাষ্ট্র স্বামী তিনি অন্ধ তাই গান্ধারী স্বেচ্ছান্ধতায় নিজের চোখ দুটি বেঁধে রাখতেন। কিন্তু তার নৈতিক দৃষ্টি ছিল স্পষ্ট ও উজ্জ্বল। তাই সমস্ত বিবাহিত জীবনটা তাকে অন্তর্দগ্ধ হতে হয়েছিল। এখানেই গান্ধারী চরিত্রের অসহায়তা আর কুন্তী ঠিক তার বিপরীত। যিনি সারা জীবন ন্যায় আর সত্যের পথে হেঁটেছিলেন যতই বিপরীত পরিস্থিতি আসুক না কেন।
যেকোনো কাহিনীতেই একটু অতিরঞ্জন বা ব্যতিক্রম থাকে মহাকাব্য মহাভারত ও সেই রকম অসংলগ্নতা বা অতিরঞ্জন মুক্ত নয়।
তার প্রথম উদাহরণ হলেন কুন্তী। দুর্বাসার আশীর্বাদে সূর্যদেব, ধর্মদেব, পবনদের এবং দেবরাজ ইন্দ্রকে আবাহন করে কুমারি অবস্থায় মহাবীর কর্ণ এবং পান্ডুর সাথে বিবাহের পর যুধিষ্ঠির, ভীম এবং অর্জুনকে পুত্ররূপে লাভ করেছিলেন। দ্বিতীয় উদাহরণ গান্ধারী যিনি কিনা ব্যাসদেবের আশীর্বাদে একশ পুত্র এবং এক কন্যার জননী হয়েছিলেন। মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী এরা সব একটি মাংসপিণ্ড থেকে জন্ম নিয়েছিলো। যারা দুর্যোধন, দুঃশাসন এবং কুরুবংশ নামে কুখ্যাত হয়ে আছে আজও ইতিহাসের পাতায়। এমনকি পান্ডুর দ্বিতীয়া স্ত্রী মাদ্র্রীর পুত্র নকুল এবং সহদেব যারা অশ্বিনী কুমারদের আশীর্বাদ ধন্য বলে বর্ণিত আছে মহাকাব্য মহাভারতে।
তারপর পাশা খেলার কথা যেভাবে উল্লেখিত আছে সেটাও কিছুটা অতিরঞ্জিত বা অসংলগ্নতারই উদাহরণ। কারণ যুধিষ্ঠির তার সত্যবাদিতা এবং ধর্মপথে চলার জন্য একটা উদাহরণস্বরূপ। শোনা যায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তিনি একবারই একটা কথা একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন দ্রোণাচার্যকে নিধন করার জন্য। তিনি কিভাবে পাশা খেলায় রাজ্যপাট হারিয়ে নিজের ভাইদের এবং সহধর্মিনী দ্রৌপদীকে বাজী রেখেছিলেন যা কিনা অধর্মের পথে চলারই সামিল। যুক্তিবাদ বলে এই ঘটনাও অসংলগ্নতাই নামান্তর মাত্র। যে ঘটনা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারণ হিসেবে বর্ণিত আছে মহাকাব্যে। আরও আছে যেমন শস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য যিনি কৌরব এবং পাণ্ডবদের প্রধান গুরু তার এত দৈন্যদশা কেন হবে। মহাভারতে বর্ণিত আছে দ্রোণাচার্যপুত্র অশ্বত্থামা দুধ খেতে চাইলে তাকে চালের জল খেতে দেওয়া হোতো। সত্যিই এর পেছনে কি যুক্তি আছে তা আজও অজানা।
এরপর পান্ডবরা যখন নির্বাসন এবং অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা উল্লেখ করা হয়েছে ।এবং যার স্থপতি ছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা সেই ইন্দ্রপ্রস্থের এমন সব অতিরঞ্জিত বর্ণনা যেমন দুর্যোধনের জল ভেবে মেঝেতে কাপড় বাঁচিয়ে চলা যুক্তিবাদী মনে বিশ্বাস করা একটু কঠিনই বটে।
সবশেষে আসি লোহার ভীমের কথায়। যেখানে বলা হয়েছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয় করার পর যখন পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আশীর্বাদ নিতে এলো তখন সে এতই ক্রোধান্বিত ছিল বিশেষ করে ভীমের উপর যে কিনা অনৈতিকভাবে তার প্রিয় পুত্র দুর্যোধনকে গদা যুদ্ধে বিনাশ করেছিলো। তাই সে যখন সবার প্রথমে ভীমকে আলিঙ্গন করতে আগ্রহ প্রকাশ করে তখন শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে এক লোহার ভীম বানিয়ে তার দিকে এগিয়ে দেওয়া হয়। এবং ধৃতরাষ্ট্র সেই লোহার ভীমকে চুর চুর করে দেন। প্রথম কথা লোহা কখনও চুর চুর হয় না এবং ধৃতরাষ্ট্রের মতো একজন বয়ো বৃদ্ধের পক্ষে তা করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে।
এইসব অসংলগ্নতা বা অতিরঞ্জন কে উপেক্ষা করে মহাভারতকে এক মহাআখ্যানে বিভূষিত করাই শ্রেয়। যে মহাভারত শ্রীমদভাগবত গীতার উপদেশ সমৃদ্ধ। যা আজও শাশ্বত সনাতন এবং আননুকরণীয়। কিছু কল্পনা এবং ঘটনার পরম্পরাই তাই মহাকাব্য কে সমৃদ্ধ করেছে।
মহাভারত একটি সত্যি ঘটনা। মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল আনুমানিক ৩১০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সবচেয়ে বড় কথা হোলো যেসব স্থানের কথা মহাভারত মহাকাব্যে বর্ণিত আছে সব স্থানগুলোই পড়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় উত্তরপ্রদেশে এবং দিল্লিতে আজও হস্তিনাপুর এবং ইন্দ্রপ্রস্থ বর্তমান।এমনকি দ্বারকাও গুজরাটের উপকূলবর্তী এলাকায় সাগর পাড়ে অবস্থিত। কোন কোন গবেষক সমুদ্রের তলায়
দ্বারকা শহরের সন্ধান পেয়েছেন। সেই গবেষকরা ভগ্নাবশেষের মাঝে সেই দ্বারকা শহরের প্রমাণও পেয়েছেন যার আনুমানিক বয়স পাঁচ হাজার থেকে তিন হাজার দু’শ বছরের মতন। এবং এই ভাবেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা নগরী আজও বর্তমান।
মহাভারতের আসল ভিত্তিই হোলো সত্যতা এবং নিশ্চয়তা। জ্যোতি বিদ্যায় সময় মাপার হিসেবে মহাভারতের সময়কাল আনুমানিক ৩১০০
খ্রিষ্ট পূর্ব। মহাভারতের উল্লেখিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ প্রাঙ্গণ আজও উত্তর ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে বর্তমান। আবার ভদ্রকালীর মন্দির, ব্রহ্মু সরোবর এবং সেই মহা বটগাছ যা কিনা গীতা বৃক্ষ নামে খ্যাত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ প্রাঙ্গণের কাছে স্বমহিমায় আজও আছে। এমনকি সেই দ্বৈপায়ন হ্রদ যার গভীরে দুর্যোধন নিজেকে বাঁচাতে লুকিয়ে ছিলেন পান্ডবদের কাছে যুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর আজও আছে। এসবই পান্ডব ও কৌরবদের মধ্যে যুদ্ধের সামগ্রিক ঘটনা প্রবাহের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এসবই প্রমাণ হিসেবে কাব্যকার বেদব্যাস নিখুঁত পারদর্শিতায় নাটকীয়তার মোড়কে বর্ণনা করেছেন। এটি একটি বহু নন্দিত চিত্রনাট্যও বটে।
সর্বদা আমাদের মনে রাখা উচিত মহাভারত হোলো দেবতা ও মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া। এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে বাস্তবতা অনস্বীকার্য। এখানে আবার বিপরীত ধর্মী ঘটনারও উল্লেখ আছে। যেমন ভীমের পৌত্র বার্বারিক পুরো আঠেরো দিনের মহাভারতের যুদ্ধের সাক্ষী ছিলেন ধরবিহীন অবস্থায়। কারণ শ্রীকৃষ্ণ তার মূল্যটিকে একটি পাহাড়ের উপরে স্থাপন করেছিলেন। যদিও এটা আপাত অবিশ্বাস্য তবুও এই ঘটনা মহাভারতের ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলোরই একটি যা আজকের জীববিজ্ঞান সমর্থন করে না। যদিও ব্যতিক্রমী ঘটনার স্বপক্ষেও যুক্তির জাল অবশ্যই বোনা হয়েছে। কিন্তু সেই জায়গা আজও আছে রাজস্থানের শিকড় জেলায় টিলার উপরে খাটুরশ্যাম মন্দির নামে বিখ্যাত হয়ে।
মহাভারতের কাহিনী শুধুই যে দেবতাদের অলৌকিক লীলায় ঠাসা তাকিন্তু একেবারেই নয়।
তবুও গান্ধারী, ভীষ্ম ইত্যাদি মহাভারতের যারা মূল চরিত্র এবং বহুচর্চিত তাদের অলৌকিক ক্রিয়া কান্ডের জন্য সেই সব ঘটনাও যুক্তিবাদী মনে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি করে। যে কেউ মহাভারতের কাহিনী বিন্যাসে যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু সবসময়ই মনে রাখতে হবেযে মহাভারত রচিত হয়েছিল যুক্তি গ্রাহ্য অনুমানের ওপর ভিত্তি করে যেখানে লক্ষ্য ছিল আধ্যাত্মবাদ। তার ওপর অনেক পার্শ্ব ঘটনাও আছে যা কিনা মহাকাব্যটিকে মহিমান্বিত করে তুলেছে। মহাভারতের মূল উদ্দেশ্য হলো যে কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ যেন ধর্ম আর সত্যের পথে অনুসরণ করে। কোন অবস্থাতেই সে যেন ন্যায়-নীতির থেকে ভ্রষ্ট না হয়। মহাভারতই এক সম্পূর্ণ গ্রন্থনা যেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে ঠিক এবং ভুলের ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এবং বলা হয়েছে ঠিক এবং ভুল সত্যিই তখনই যখন তারা ধর্মের পথ অনুসরণ করে।
তাই মহাভারতের কাহিনী সত্য হোক আর নাই হোক তবুও এই মহাকাব্যের কাহিনীর ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে, যুক্তির উপর ভর করে যা আমাদের বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সঠিক দিশারীর কাজ করে থাকে।
হয়তো মহাভারতের ঘটনাক্রম সেইভাবে ঘটেনি যেভাবে আমরা আজ জানি। একথাও নিশ্চিত যে মহাভারত হচ্ছে একটি অভিযোজিত সংস্করণ যা সত্য ঘটনার উপর পর আদারিত। জ্যোতিরবিদ্যার সময়কাল এই পবিত্র মহাকাব্যের বৈধতার প্রমাণ করে। এই মহাকাব্যের কাহিনী গুলো সবই বাস্তবসম্মত।মানুষ কি চিন্তা করে এবং কিভাবে মানুষ শোষিত হয় সবই মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে।
তাই মহাভারতের কাহিনী মানুষের চক্রান্ত হিসেবেও উদাহরণ বলা যায়। যেখানে শ্রীকৃষ্ণের চরিত্রটিকে ভগবানের অবতার করে পুরো মহাকাব্যে বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও কিছু যুক্তিবাদী মানুষের কাছে বাস্তব জীবনে এরকম চরিত্র একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। যাদের কাছে মহাভারত শুধুই অলীক কল্পকাহিনী মাত্র।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় প্রকাশ করেছেন যে তিনিই সমস্ত সত্তার উৎস। অর্থাৎ এটা তাঁরই মনের রূপ যা থেকে সাতজন মহাঋষি, চারজন মুণি এবং চৌদ্দ মনুর আবির্ভাবের কারণ। এই পৃথিবীর সব মরণশীল মানুষ যারা অধঃপতিত হয় এবং বিশেষ চরিত্রের মানবের উত্থানের কারণও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। এইসব বিষয়েই ব্যাখ্যা করা হয়েছে শ্রীমৎ ভাগবদ গীতার সারাংশের দশম অধ্যায়ে।
ভাগবদ গীতা তাই দক্ষতার উৎস যা অজ্ঞতার আধার দূর করে মানব জাতিকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করে। কেবলমাত্র আত্ম উপলব্ধি মানুষকে সত্যিকারের সুখ অনুভব করাতে পারে এই পরিবর্তনশীল বিশ্ব সংসারে। আমরা সবাই
নিজস্ব আভ্যন্তরীণ শক্তির অধিকারী এবং জীবন পথের যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে সামর্থ্য রাখি। শ্রীমৎ ভাগবত গীতার মহাকাব্য মহাভারতের একটি অংশ যা মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস আরোপিত করেছেন। তিনি বেদব্যাস নামেও সুপরিচিত।
কথিত আছে যে মহাভারতের যুদ্ধ সমাপ্তির পর মহর্ষি বেদব্যাস মুখে মুখে সমস্ত কাহিনী বিবৃত করেছেন এবং ভগবান শ্রী গনেশ হিন্দু ধর্মের এই পবিত্র মহাকাব্য লিপিবদ্ধ করেছেন। শ্রীমৎ ভাগবত গীতা মহাভারতেরই একটি অংশ। শ্রীমৎ ভাগবত গীতা অনুসারে আমরা এই দেহের মালিক নই কিন্তু আমাদের পরিচয় শুধুই আত্মা। আমরা সবাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপরিহার্য ঐশ্বরিক খন্ডিত অংশ মাত্র। যাকে পুরুষোত্তম নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ হলেন জীবন পথের প্রতি পদে পদে এগিয়ে যাওয়ার মহান দার্শনিক এবং দিশারী। ভাগবত গীতার সারার্থ হল যখন শ্রীকৃষ্ণ বলেন ”যারা খুবই কর্মঠ আর যারা একদমই অলস দুজনেই যোগ সাধনার উচ্চমার্গের পৌঁছাতে পারে না। কেবল যারা সংগ্রামের রাস্তায় হাটে তারাই এই রহস্য ভেদ করতে সক্ষম হয়।“
গীতা একটি অপরিহার্য আধ্যাত্মিক পুথি যা একই সাথে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের উত্তরও বটে। গীতা প্রতিকী রূপে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাঙ্গনে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথন। এবং ভাববিহবল অর্জুনের বাস্তবসম্মত প্রশ্নের সব উত্তরও শ্রীকৃষ্ণ দিয়েছিলেন তাঁর মোহ ভঙ্গের উদ্দেশ্যে। যা গীতা উপদেশ নামে খ্যাত হয়েছে। গীতার দর্শন একেবারে সহজ ভাষায় বাঁচা এবং জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বর্ণিত হয়েছে। গীতা শব্দের অর্থ গীত। তাই শ্রীমৎ ভাগবত গীতাকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গীতও বলা হয়ে থাকে। গিতা একটি রহস্য ঘেরা গ্রন্থনা যা প্রকৃতির এবং মানবতার কথা বলে, সত্যের দিশা দেখায় এবং কর্মের পথে চলতে উপদেশ দেয়। যা একমাত্র জ্ঞান এবং আত্মতৃপ্তির সন্ধান দিতে সক্ষম। গীতা বিভিন্ন যোগের সন্ধান দেয় যেমন কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, জ্ঞানযোগ যা মানবিকতার উন্মেষ ঘটাতে উদ্বুদ্ধ করে এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে।
মানুষের মনের আবেগ এবং আত্মীয়তার সম্পর্কের অর্থ বুঝতে পথ দেখায়। অর্থাৎ মানুষকে আত্মোপপলব্ধি ঘটিয়ে তার আসল পরিচয় জানতে আলো দেখায়। অর্থাৎ জীবনের আসল উদ্দেশ্য কি এবং মানুষের অস্তিত্বের আসল সংজ্ঞা কি এবং লক্ষ্যের দিকে পৌঁছে দেয়।
বহুবাদ জীবি দর্শন চারটি মৌলিক নীতির দর্শন
১ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেতনার বিকাশ হলে মানুষ উন্নীত হয় স্বসত্তার জাগরণে।
২ মানুষ দ্বৈত সত্তার অধিকারী। গীতার বাণী অনুযায়ী সবকিছুই বস্তুবাদ যাকে অন্য কথায় প্রকৃতিও বলা হয়ে থাকে এবং আধ্যাত্মিক চেতনায় উন্নীত হলে তাকে পুরুষকার বলে অভিহিত করা হয়।
৩ পার্থিব জীবন শুধুই আধ্যাত্মিক ভিত্তি যা নিসর্গলোকে উন্নীত করে।
৪ মানুষ পরমাত্মার মৌলিক ভিত্তি জানতে সক্ষম ধর্মের পথে। এই পৃথিবী শাস্তি প্রদানের স্থান নয়।
এই পৃথিবীতে মানুষ এগিয়ে চলে প্রকৃতির সন্ধানে
আত্ম উপলব্ধির মাধ্যমে। আর যোগ এক রহস্য গেরা বিশেষ জ্ঞান আর নীতিবাদের সমাহার এবং সশস্ত্র যা আদ্ধাত্তবাদের সারমর্ম বুঝতে শেখায়।
শ্রীমৎ ভাগবত গীতার পাঁচটি মূল বিষয় হোলো
১ ঈশ্বর-একম অদ্বিতীয়ম প্রভু।
২ জীব-জীবন্ত সত্তা।
৩ প্রকৃতি-বস্তুবাদ।
৪ কাল-অনাদি আদি অনন্ত।
৫ কর্ম-কার্যকলাপ।
সবশেষে গীতার নৈতিক ব্যাখ্যা হলো গীতা উপদেশ কঠোর সংযমের সাথে অনুসরণ করতে হবে, সমস্ত দেহ ও মনে এমনকি নিজস্ব ব্যবহারে ও অপরের সাথে লেনদেনের সময়েও। বাস্তবিক কঠোরতার অর্থ হলো অর্থহীন কাজ এবং আমিষ খাদ্য গ্রহণ করা সম্মেলন করতে হবে মানসিক কঠোরতার অর্থ হল ক্রোধ এবং লোভ সম্বরন করা। অন্যদের সাথে এমন ব্যবহার করা যাবে না যা নিজের সাথে করা যায় না।
ভাগবত গীতার বৈশিষ্ট্য হল গীতা উপদেশ আত্ম উপলব্ধি এবং জ্ঞানের সাধনা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভে উদ্বুদ্ধ করে। গীতার শিক্ষা হলো মৌলিক বুদ্ধির বিকাশ ঘটিয়ে বস্তুবাদী পৃথিবীর অনিত্যতা বুঝতে এবং শাশ্বত আত্মার সাথে পরিচয় করানো।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গীতার বাণী দিয়ে এই বিশ্লেষণের ইতি টানছি.
“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানি্র্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মনং সৃজআমহ্যম্।।
পরিত্রাণায় সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।”