Image by chatgpt

শিক্ষার বিষয়ে মার্গারেটের অভিজ্ঞতাপূর্ণ বক্তৃতাগুলো যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক ছিলো।

জর্জ বার্নার্ড শ’, হাক্সলি প্রভৃতি নামী

লেখক ও বৈজ্ঞানিকেরা সেই সময় মাঝেমধ্যে সেসেমি ক্লাবে বক্তৃতা দিতেন। তাঁদের সাথে পরিচয় ও আলোচনার সুযোগ মার্গারেটের চিন্তাশক্তি বিকশিত করতে সাহায্য করেছিলো। তাই কিছুদিনের মধ্যেই ক্লাবে ও সমাজে তাঁর একটা বিশেষ জায়গা হয়ে গেলো। শিক্ষা ক্ষেত্রে সাফল্য তাঁর সুনাম আরও বাড়িয়েছিলো। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নানা প্রবন্ধ তাঁকে লেখিকা হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছিলো। তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব, তেজস্বিতা, বুদ্ধিমত্তা, রচনাশক্তি ও বাগ্মিতা লন্ডনের সমাজে তাঁকে কেবল সুপরিচিতই নয়, সুপ্রতিষ্ঠিতও করেছিলো। সাধারণ নরনারীর যা জীবনের লক্ষ্য সেই চিরাচরিত পথ মার্গারেট কৃতিত্বের সাথে দুর্বার গতিতে অতিক্রম করেছেন। তাঁর কাছে তখন জীবনের যাত্রাপথ মনে হয়েছে সরল ও বিস্তৃত। নিত্যনতুন আলোচনার চিন্তার অভিনবত্ব এবং পণ্ডিত বিদ্বজনদের সাহচর্যে মার্গারেটের কল্পনা ও ইচ্ছাশক্তি তাকে চুম্বকের মতো ক্রমাগত আকর্ষণ করেছে অন্য এক লোকে। অবলীলায় তিনি এগিয়ে চলেছেন এক যোদ্ধার মতো সুদৃঢ় পদক্ষেপে, সব রকম বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করার এক দুর্জয় প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

এরকমই এক সময়ে ১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাসে লন্ডনে এক পারিবারিক আসরে মার্গারেট স্বামী বিবেকানন্দের কাছে বেদান্ত দর্শনের

ব্যাখ্যা শোনেন। স্বামীজীর ধর্মব্যাখ্যা ও তাঁর ব্যক্তিত্বে মার্গারেট মুগ্ধ ও অভিভূত হন। এই কারণে তিনি স্বামীজীর প্রত্যেকটি বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তরের ক্লাসে উপস্থিত থাকতেন। পরবর্তীতে বিবেকানন্দকেই তিনি নিজের গুরু বলে বরণ করে নেন।‌

স্বামীজীর সাথে পরিচয়ের আগে বাহ্যিক জীবনে মার্গারেট যে প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য অর্জন করেছিলেন তা তাঁর মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি। কারণ সংশয় ও দ্বন্দ্ব তাঁর

অন্তররাজ্যে সঞ্চারিত হয়েছিলো। শৈশবে ধর্মের উপর তাঁর যে সহজ বিশ্বাস ও অনুরাগ ছিলো, যৌবনের প্রখর বিচারবুদ্ধি এবং সংশয়ের কাছে তার হার হয়েছিলো।

হ্যালিফ্যাক্স বিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাঁর মনে ধর্ম সম্বন্ধে প্রথম প্রশ্ন জাগে। চার্চের আনুষ্ঠানিক কর্মের উপর গুরুত্ববোধ ও নিষ্ঠা

মার্গারেটকে একটি জিনিস শিখিয়েছিলো—তা হলো প্রচলিত ঐতিহ্যের মূল্যবোধ। ফলস্বরূপ পরবর্তীতে হিন্দু ধর্মের বিশাল সর্বজনীন বেদান্ততত্ত্ব যেমন তাঁর যুক্তিগ্রাহ্য মনকে তৃপ্ত করেছিলো, তেমনি দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বিচিত্র এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোও তাঁর মনে আবেগের সৃষ্টি করতো। কারণ যুক্তি তখনও প্রবল হয়ে সহজ বিশ্বাস ও আবেগকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

যুক্তি দিয়ে বিচার করতে গিয়ে খ্রিস্টান মতবাদের সত্যতা সম্বন্ধে তাঁর মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তাঁর মনে হয়েছিলো বহু বিশ্বাস ও আচার সবই মিথ্যে এবং অসঙ্গত। তাই আনুষ্ঠানিক খ্রিস্টান ধর্মের উপর তাঁর শ্রদ্ধা ক্রমেই শিথিল হতে শুরু করে। তবে মার্গারেটের সংশয় আস্তিক্যবুদ্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সেই সময় পাশ্চাত্য দেশের বহু পণ্ডিত ব্যক্তির নাস্তিকতাবাদ ও সংশয়পূর্ণ চিন্তাধারায় তিনি নিজেকে সামিল করেননি। তাঁর কাছে ধর্ম ছিলো জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ—তাকে অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এই দৃশ্যমান জগতের আড়ালে এক অতীন্দ্রিয় সত্তার অস্তিত্ব সব সংশয়ের উপরে। তবুও কি তার আসল স্বরূপ, যা জানতে পারলে আপাত বিরোধী বিভিন্ন মতবাদগুলির মধ্যে একটি সমন্বয় সাধন সম্ভব?

এরপর তিনি গির্জায় যাওয়া ছেড়ে দেন। প্রাণহীন শুকনো আচার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সত্যের সন্ধান করতে যাওয়া বিড়ম্বনাই বৈকি। তবুও কখনো কখনো মানসিক যন্ত্রণার তীব্রতা ও নৈরাশ্য যখন তাঁর হৃদয়কে অবসাদে ভরিয়ে দিতো, তখন নেহাতই অভ্যেসবশে তিনি আবার গির্জায় ছুটে যেতেন। ভাবতেন এইসব অনুষ্ঠানে একাত্ম হয়ে মনের ভার লাঘব করবেন। কিন্তু সবই তাঁর কাছে বৃথা আড়ম্বর মাত্র মনে হতো। এভাবেই সাত-আটটা বছর কেটে গেলো, আর মার্গারেটের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠলো এই সংশয়ের ঘাত-প্রতিঘাতে। এর মাঝে তিনি বহু বই পড়েছেন, অনেক জ্ঞানী মানুষের সাথে আলোচনা করেছেন। সেই সময়ের দার্শনিক মতবাদগুলোর উপর চিন্তা ও গবেষণা করেছেন। কিন্তু সবই ছিলো এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র।

হঠাৎ তাঁর মনে হলো বিজ্ঞান হয়তো তাকে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দিতে পারে। কেননা বিজ্ঞান বাস্তবতা ও সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। সেখানে ভাবুকতা বা কল্পনা দিয়ে সত্য খোঁজার প্রচেষ্টা নেই। শুরু হলো তাঁর বিজ্ঞানের সাধনা। কিন্তু এর ফলে দেখা দিল প্রচলিত ধর্মমতে অসঙ্গতি। তিনি তো ধর্মকে ছাড়তে চান না—তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা ধর্ম তাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠা পাক, এর মধ্যে যেন কোনো বিরোধ না থাকে। তখন মার্গারেটের মনে হলো তিনি যেন চলেছেন এক কূল থেকে আরেক কূলের দিকে। এ যেন দিশাহীন এক দিশার সন্ধান। এখন কে তাঁকে এই সংশয়ভরা বিস্তীর্ণ ক্ষুব্ধ সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে পথের দিকনির্দেশ দেবে?

এইরকম এক টালমাটাল সময়ে তাঁর হাতে এসে পড়ল গৌতম বুদ্ধের জীবনী “Light of Asia”. আগ্রহের সাথে তিনি বইটি পড়তে শুরু করলেন। এবার হয়তো আসল তত্ত্বের উদ্ঘাটন হবে। তবুও আশা পূরণ হলো না। কিন্তু বুদ্ধের জীবন তাঁকে আকৃষ্ট করলো। তিনি সাগ্রহে বৌদ্ধধর্ম অধ্যয়ন করতে লাগলেন। তবুও আশা পূরণ হলো না। তবে এই ধারণা দূর হলো যে মুক্তির স্বরূপ সম্বন্ধে গৌতম বুদ্ধের বাণী খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের মুক্তিব্যাখ্যাকে অনেকটাই যুক্তিগ্রাহ্য।

প্রচলিত ধর্মানুসারে ঈশ্বরকে জগৎপিতা রূপে উপাসনা করার প্রতি বিশ্বাস যখন নষ্ট হলো, তখন মার্গারেট ভাবলেন—এর বাস্তব সত্যতা না থাকলেও ধারণা বা কল্পনা হিসেবে একটি মূল্য থাকতে পারে। তাই সেই মূল্য নির্ধারণে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু সব চেষ্টাই অসফল হলো। ইউরোপীয় দার্শনিক চিন্তাধারায় সত্যের প্রত্যক্ষ সন্ধান নেই। হাক্সলি, টিন্ডাল, স্পেন্সার প্রভৃতি মনীষিরা স্বীকার করেছেন যে মানবতা কোনো ঊর্ধ্বশক্তি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত প্রকৃতির ক্রমবিবর্তন ঠিক তার মূল কারণ নয়। সৃষ্টির আদি কারণ সম্বন্ধে তাঁদের অভিমত—এটি মনোবুদ্ধির ধরাছোঁয়ার বাইরে। নাস্তিকতাবাদ তাঁরা এড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু প্রকৃত সত্তার আওয়াজ দিতে তাঁরা অক্ষম। সেই কারণে তাঁদের অসংখ্য মতবাদের ঘূর্ণিপাকে সত্য কেবলই জটিল আকার নিয়েছে। এর পরে আধ্যাত্মিক জীবনের এই টানাপড়েনে মার্গারেট ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়লেন। শুধু ভেতরে ভেতরে একরাশ শূন্যতা অনুভব করতে লাগলেন তিনি। সব যুক্তি ও তর্কের অতীত দূর্জেয় সত্য কি তাঁর কাছে সেই রহস্যের জট কোনোদিন খুলবে? তিনি ভাবতে লাগলেন—এই জগতে এমন কেউ কি নেই যিনি ধর্মকে প্রত্যক্ষ রূপ দিতে পারেন?

তাঁর জীবনের এই পরম সন্ধিক্ষণে স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব হয়। যে জীবনদেবতার উদার অভ্যুদয় মার্গারেটকে সব সংশয়, দ্বিধা ও দ্বন্দ্বের থেকে মুক্ত করে এক অনন্তলোকে দিশা দেখিয়েছিলো। যে দিশার সন্ধানে তিনি এতদিন দিশাহীন ছিলেন। শুধু মার্গারেটই কেন, সেই সময়কার পাশ্চাত্য দুনিয়ার যে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় একটা অনিশ্চিত উৎকণ্ঠার মধ্যে কালাতিপাত করছিলেন, স্বামী বিবেকানন্দের শুভাগমন তাঁদের কাছেও শান্তির বার্তা বয়ে এনেছিলো।

সেই সংশয়মুক্তির শুভক্ষণ সম্বন্ধে মার্গারেট লিখেছেন—

“আমাদের অনেকের নিকটেই স্বামী বিবেকানন্দের বাণী তৃষ্ণার্তের নিকট সুশীতল পানীয়ের ন্যায় উপস্থিত হইয়াছিলো। ধর্ম সম্বন্ধে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চয়তা এবং হতাশা বিগত অর্ধশতাব্দী ধরিয়া ইউরোপের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে বিপর্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে। গত কয়েক বছর হইতে আমাদের অনেকেই এই বিষয়ে বিশেষ সচেতন হইয়াছেন। খ্রিস্টীয় অনুশাসনে আস্থা

রাখা আমাদের পক্ষে ছিলো অসম্ভব, আবার এখনকার ন্যায় আমাদের নিকট এরূপ কোনও অস্ত্র ছিলো না যাহার সাহায্যে মতরূপ আবরণ ছিন্ন করিয়া ধর্মের অন্তর্নিহিত প্রকৃত তত্ত্বের মর্ম উদ্ঘাটন করা যাইতো। স্মীয় প্রত্যক্ষ উপলব্ধ জ্ঞান সম্বন্ধে এই সমস্ত ব্যক্তিগণের যে সন্দেহ ছিল বেদান্ত তাহা সমর্থন করিয়া দার্শনিক ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছে। অন্ধকারে যাহারা

দিগ্ভ্রান্ত হইয়াছিলো তাহারা আলোক দেখিতে পাইয়াছে।”

১৮৯৫ সালে স্বামী বিবেকানন্দ লন্ডনে পৌঁছলেন। হিন্দু যোগী হিসেবে খুব তাড়াতাড়িই তিনি সব জায়গায় পরিচিত হয়ে উঠলেন। লেডি মার্জেসন একদিন তাঁর বৈঠকখানাঘরে এই হিন্দু যোগীকে আমন্ত্রণ করেছিলেন কিছু বলার জন্য। সেই সঙ্গে তিনি কিছু কাছের বন্ধুদেরও নিমন্ত্রণ করেছিলেন। মার্গারেট ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম।

যারা তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁরা জানতেন

আধ্যাত্মবাদ মার্গারেটের জীবনে একটি বিশেষ জায়গার অধিকার করে রয়েছে, ও জগতের সত্যাসত্য নির্ণয়ের অক্ষমতায় তিনি হতাশ এবং ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। লর্ড রিপনের এক দূরসম্পর্কীয় ভাই মার্গারেটকে বলেছিলেন—“এই হিন্দু সন্ন্যাসী হয়তোবা তাঁকে সত্যান্বেষণের পথে সাহায্য করতে পারেন। লেডি মার্জেসনের আমন্ত্রণ কি তিনি গ্রহণ করবেন?”

মার্গারেটের মন বললো—এতে ক্ষতি কি? এ পর্যন্ত বহু মতবাদ ও ব্যাখ্যা তিনি ধৈর্য নিয়ে শুনেছেন অন্তরাত্মার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য। সেই কারণে শুধুই কৌতূহলবশতঃ তিনি সেই হিন্দু সন্ন্যাসীকে দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলেন। মার্গারেটের কাছে তখনও অজানা ছিল যে সত্য প্রকাশের শুভলগ্ন এসে গেছে, যার প্রতীক্ষায় তিনি ব্যাকুল ও উদভ্রান্ত।

সেদিনটা ছিলো নভেম্বর মাসের এক রবিবারের মনোরম দুপুর।

ওয়েস্ট এন্ডের একটি বৈঠকখানাঘরে উপস্থিতদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়—মেরে কেটে গোটা পনেরো কিংবা ষোলো হবে।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁদের দিকে মুখ করে বসে আছেন। স্বামীজীর পেছনে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে ঘরের উষ্ণতা বজায় রাখার জন্য। এটি ছিলো নিতান্তই একটি ঘরোয়া ক্লাস। মার্গারেটও উপস্থিত হয়েছেন ঠিক সময়ে। স্বামীজীর এই প্রথম দর্শন তাঁর মনে বিশেষভাবে রেখাপাত করেছিলো। পরবর্তীতে মার্গারেটের মনে হতো—এটা তাঁর পরম সৌভাগ্য যে স্বামীজীকে প্রথম দর্শনের সময় ও পারিপার্শ্বিকতা দুইয়ের সাথে প্রাচ্য জীবনধারার একটা সাদৃশ্য ছিলো। স্বামীজীর পরনে ছিলো গৈরিক পরিচ্ছদ। তাঁর আকৃতি এবং বীরত্বব্যাঞ্জক প্রবল ব্যক্তিত্বপূর্ণ বিস্তৃত দুটি চোখ ও প্রশান্ত মুখমণ্ডলে এক দিব্য শিশুর সরলতা।

সেদিন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে সেই ভারতীয় সন্ন্যাসী প্রায়ই সংস্কৃত শ্লোক সুর করে আবৃত্তি করেছিলেন। মার্গারেটকে সেই সুরের মূর্ছনা ইংল্যান্ডের গির্জাগুলোতে প্রচলিত গ্রিগরি প্রবর্তিত সুরের কথা মনে করায়। কিন্তু এই সুর ছিলো সম্পূর্ণ আলাদা। স্বামীজী মাঝে মাঝেই “শিব, শিব” বলে উঠছিলেন।

সমস্ত পরিস্থিতিই নতুন। পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার সাথে কোনোভাবেই মিল নেই, তবুও মনকে গভীরভাবে

একটা চুম্বকীয় আবেশে আকর্ষণ করে। কথা প্রসঙ্গে স্বামীজী সেদিন বলেছিলেন—প্রাচ্য-প্রতিচ্যের মাঝে আদর্শ বিনিময়ের সময় এসে গেছে, আর সেই মেলবন্ধনের লক্ষ্যেই তাঁর পাশ্চাত্যে আসা। সনাতন ধর্মের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছিলেন—“ভিন্ন ভিন্ন রূপে সেই এক অদ্বিতীয় সত্তার বিভিন্ন বিকাশ।” স্বামীজী যখন বললেন—হিন্দুরা বিশ্বাস করেন শরীর ও মন এক তৃতীয় শক্তির দ্বারা পরিচালিত—তখন মার্গারেট বিশেষ করে আকর্ষিত হলেন। তাঁর মনে হলো—এ এক নতুন তত্ত্ব। বিশ্বাসের পরিবর্তে “প্রত্যক্ষ অনুভূতি” শব্দটি ব্যবহারে স্বামীজীর আগ্রহ দেখেছিলেন সেদিন মার্গারেট। সেদিন বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়েও আলোচনা হয়েছিলো। উপস্থিত শ্রোতারা সবাই গভীর আগ্রহে স্বামীজীর ব্যাখ্যা শুনছিলেন। স্বামীজী সেদিন অনর্গল বলে যাচ্ছিলেন। আসলে সবার মনেই এক অপরিচিত হিন্দু সন্ন্যাসী কী এমন নতুন তত্ত্ব উদঘাটন করবেন সেই বিষয়ে সংশয় ছিলো—কারণ উপস্থিত সকলের মনেই একটি উদাসীনতা ও গর্বের ভাব ছিলো। কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মতো তারা সবাই স্বামীজীর কথা শুনছিলেন। মনে হচ্ছিলো—তিনি যেন কোনো এক দূরদেশের বার্তা বহন করে এনেছেন। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে সেদিন বলেছিলেন—“মানুষ ভ্রম হইতে সত্যে অগ্রসর হয় না; সত্য হইতে সত্যেই অগ্রসর হইয়া থাকে। সকল ধর্মই সমভাবে সত্য এবং সেই কারণেই তাহার পক্ষে কোনও অবতারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করা অসম্ভব। কারণ অবতারগণ সকলেই সেই এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মের প্রকাশ মাত্র।”

সবশেষে তিনি গীতার সর্বশ্রেষ্ঠ শ্লোকটি আবৃত্তি করেছিলেন—

“যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্‌।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ
দুষ্কৃতাম্‌।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি
যুগে যুগে।”

বক্তৃতা শেষ হলো। সন্ন্যাসীর গম্ভীর উদাত্ত কণ্ঠস্বর ঘরের মধ্যে প্রতিধ্বনি হতে লাগলো। সেদিন এই হিন্দু সন্ন্যাসীকে যাঁরা দেখতে এসেছিলেন তাঁদের কারও ধর্মে তেমন বিশ্বাস ছিলো না। আসলে সেদিন এমন ব্যক্তিত্বদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিলো যারা সহজে কোনও ধর্মমতে আস্থা রাখার বিরোধী। ধর্মচর্চার ব্যাপারে যে কিছু সত্য থাকতে পারে সে বিষয়ে তাঁদের বিশ্বাস জন্মানো খুবই কঠিন বৈকি। তাই তাঁরা সেদিন সভাস্থল ছাড়ার আগে অভিযোগ করে গেলেন যে সন্ন্যাসীর কথার মধ্যে নতুনত্ব কিছুই নাই। অবশ্য পরে মার্গারেটের মনে হয়েছিলো—এই যে নতুন ভাবধারাকে গ্রহণ করার এমনকি যাচাই করে দেখারও আগ্রহের অভাব, এর মূলে রয়েছে অযথা বিচারবোধের গর্ব—মানে সব সময়ই সতর্কতা অবলম্বন করা, যাতে

অবিবেচনার কারণে বিশ্বাস যেন মনকে অধিকার না করে। আসলে এত সহজে বক্তার কথাগুলি সম্বন্ধে নিঃসংশয় অভিমত প্রকাশ করা চলে না। তাই সেদিন ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসীর ব্যক্তিত্ব মার্গারেটকে আকর্ষণ করেছিলো। মার্গারেট উপলব্ধি করলেন—এই প্রাচ্য সন্ন্যাসীর বাণীর মধ্যে এমন কিছু আছে যা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। স্বামীজীর সাথে সাক্ষাতের পর মার্গারেট ঘরে ফিরে আসেন এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তাঁর প্রতিদিনকার অভ্যস্ত জীবন চলতে থাকে। কিন্তু তিনি ভারতীয় হিন্দু সন্ন্যাসীকে কিছুতেই ভুলতে পারেন না—উল্টে তাঁর মনে সেই সন্ন্যাসীর কথাগুলির প্রভাব দেখা গেল। এরপর তিনি স্বামীজীর বক্তৃতা শোনার জন্য আরও দু’টি সভায় উপস্থিত ছিলেন।

আসলে স্বামীজীর কথার মর্মার্থ মার্গারেট বহুদিন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর মধ্যে তখন যে তত্ত্ববোধের অভাব ছিলো তার জন্য পরে মার্গারেটের অনুশোচনার শেষ ছিলো না। কারণ মার্গারেটের প্রখর বিচারবুদ্ধি যে কোনো বিষয় গ্রহণ করার পক্ষে বিশেষ বাঁধার সৃষ্টি করতো। তাই স্বামীজীর সব মতগুলিকেই তিনি বেশ কিছুদিন সন্দেহের চোখে দেখতেন। আসলে স্বামীজী যে বাণী প্রচার করতেন তার ভিত্তি ছিলো উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। এর ফলে এর মধ্যে যে দৃঢ়তা ও বিশ্বাস ছিলো—তার প্রভাব মার্গারেটকে অভিভূত করেছিলো। ঠিক সেই কারণেই তিনি স্বামীজীর কথাগুলির মহিমা যুক্তি দিয়ে খর্ব করার চেষ্টা করতেন।

স্বামীজীর লন্ডনে অবস্থানকালীন তাঁর ক্লাসগুলোতে যোগদান করার সময় মার্গারেট বিরুদ্ধ যুক্তির অবতারণায় অগ্রণী ভূমিকা নিতেন। তাঁর মুখে “কিন্তু” ও “কেন”—এই দুটো শব্দ লেগেই থাকতো। তবুও যুক্তি প্রদর্শন আর সন্দেহ উত্থাপন করে স্বামীজীর মতগুলোকে খণ্ডন এবং বর্জন করার যত চেষ্টাই তিনি করে থাকুন না কেন, তাঁদের প্রভাব থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি কখনও। যে অসাধারণ চরিত্র ও ব্যক্তিত্ববলে স্বামীজী জগৎজয় করেছিলেন—তার দুর্নিবার প্রভাব অতিক্রম করার ক্ষমতা বিদুষী ও বিচারবুদ্ধিসম্পন্না মার্গারেটের ছিলো না। তাই ইংল্যান্ড ছাড়ার আগেই তিনি স্বামী বিবেকানন্দকে আচার্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই কারণে মার্গারেট বলেছেন—

“তিনি যে বীরোচিত উপাদানে গঠিত ছিলেন, তাহা আমি হৃদয়ঙ্গম করিয়া ছিলাম এবং তাঁহার স্বজাতি-প্রেমের নিকট আমি সম্পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করিতে চাহিয়াছিলাম। কিন্তু এই যে আমার আনুগত্য স্বীকার—ইহা শুধু তাঁহার চরিত্রের নিকটেই।”

তিনি বুঝেছিলেন—স্বামীজীর প্রচারিত তত্ত্বগুলির মধ্যে কোনও অসংলগ্নতা নেই। দৃঢ়তার সাথে সত্যকে প্রচার করাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো।

আর ঠিক সেই কারণেই তাঁর কাছে মার্গারেটের শিষ্যত্ব গ্রহণ।

স্বামীজীর আলোচনার বিষয়গুলি হাতে-কলমে প্রমাণিত না করা পর্যন্ত মার্গারেট সেগুলো চরম সত্য বলে গ্রহণ করেননি।

স্বামীজীর উদার ধর্মবিষয়ক শিক্ষা, যা অন্যান্য ধর্মব্যাখ্যাদাতাদের সাথে তাঁর মৌলিক পার্থক্য প্রমাণ করে। তাঁর ভাবগুলির মধ্যে যে যুক্তিবিচার ছিলো তার নতুনত্ব ও গূঢ়তত্ত্ব। সবশেষে মার্গারেট অনুভব করলেন যে মানবপ্রকৃতির মধ্যে যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে সুন্দর—ধর্মের নামে স্বামীজী তাকেই আবাহন করেছেন।

তাঁর এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার জন্যই তো মার্গারেট উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন।

.    .    .

Discus