Photo by Joshua Rawson-Harris on Unsplash

কথায় বলে একজন পুরুষকে শিক্ষা দেওয়া মানে সে শুধু নিজেই শিক্ষিত হোলো। আর একজন নারীকে শিক্ষা দেওয়ার অর্থ হোলো পুরো পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা। ঠিক সেই কারণে বিখ্যাত ফরাসি বীর নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছেন ”আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।”

এ কথা কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় ও অনুরনিত হয় “এ বিশ্বে যা কিছু চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।”এই বিখ্যাত উক্তি স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বাদে আজও এক প্রমাণিত সত্য।

এবার ফিরে দেখা যাক দুশো বছর আগে প্রাক স্বাধীনতা যুগে রাজা রামমোহনের পূর্ববর্তী সময়ের সারণীতে। যে সময় নারীরা ছিলো অসূর্যম্পর্ষা। নারীরা থাকতেন পর্দানশীন। এমনকি প্রগতিশীলতার প্রতীক রানী রাসমণিকেও সেই সময় দেখা যেতো চিকের আড়াল থেকে সাক্ষাৎকার করতে। রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে বন্ধ হয়েছিল কুখ্যাত সতীদাহ প্রথা। যে সতীদাহ প্রথা পরম্পরা মেনে যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছিল আমাদের সমাজে। এই প্রথার পুরোধা ছিল মুষ্টিমেয় কিছু তথাকথিত টিকিধারী সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণপন্ডিত সমাজ।

এই স্রোতের বিপরীতে গিয়ে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদ বিল পাস করে আমাদের সমাজে এক নবযুগের সূচনা করেছিলেন। তাঁরই হাত ধরে নারীরা সেদিন পেয়েছিলো বাঁচার অধিকার। ঠিক তারপর পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে স্ত্রী শিক্ষা এবং বাল্যবিবাহ প্রথার শুরু হয়েছিলো। এরপর আমাদের সমাজ নবযুগ থেকে নবজাগরণে উন্নীত হলো। তারপর আরো বহু মনীষীর আবির্ভাবে আমাদের সমাজ অলঙ্কৃত ও ধন্য হয়েছে তাদের স্পর্শে। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ, ডিরোজিও থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সময়টাকে বাঙালি সমাজের রেনেসাঁ বলেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে। কারণ সেই সময় সমাজটা ছিলো পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবেই দেখা হোতো। এই নবজাগরণের কালে সমাজের মানবতাবাদের উন্মেষ হয় এবং নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির যুগের শুভ সূচনা হয়। যে পথে নারীরা জীবনের বিভিন্ন আঙ্গিকে নিজেদের সাফল্যের প্রমাণ রেখেছেন। শিক্ষা জাতি গঠনের শুধু মূল ভিত্তিই নয় শিক্ষার মাধ্যমে একটি জাতি উন্নতির দিশায় এগিয়ে যায়। একটি সমাজে বসবাসরত বিভিন্ন শ্রেণী ও নারী পুরুষের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে পড়লে সেই সমাজ অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বাংলার সেকালের নারী সমাজ শিক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছিলো। বাইরের পরিবর্তিত দুনিয়ার সাথে তাদের কোন পরিচয়ই ছিলো না। নারী জাগরণের অগ্রদূত কাদম্বিনী বসু গাঙ্গুলী এবং বেগম রোকেয়া নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার থেকে আলোর পথের দিশা দেখালেন। সেকালের সেই মহীয়সী নারীদের শিক্ষা এবং প্রগতির প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নারী সমাজ এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলো। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে একালে নারী সমাজ শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছে। একালের নারী সমাজ অন্ধ অনুকরণ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সত্তা ও একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠার নিরন্তর সংগ্রাম করেই চলেছে। একালের নারী এই সংগ্রামে অনেকটাই জয়ী। 

শিক্ষার আলো এ কালের নারীকে সেই পথে এগিয়ে যেতে উজ্জীবিত করেছে। শিক্ষাই তাঁদের পৌঁছে দিচ্ছে সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে। সংবিধান মেনে শিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। তবে নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে কিছু বাধা ও প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। এখনও নারী নির্যাতন বন্ধ হয়নি। তাঁদের পথ চলা আজও সুগম হয়নি। ঘরে বাইরে একালের নারীরা আজও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে বারবার।

নারী নির্যাতনের ঘটনা আজও অহরহ ঘটেই চলেছে সমাজের নানা স্তরে। কান পাতলেই নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হয়। তবুও এই নারী প্রগতির যুগে যখন দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে একালের নারীরা সামিল সে সাহিত্য, ক্রীড়া, বিজ্ঞান, রাষ্ট্র শাসন যে ক্ষেত্রেই হোক না কেন। কিন্তু বর্তমানে আর জি কর মেডিকেল কলেজের এক স্নাতকোত্তর ছাত্রীকে কর্তব্যরত অবস্থায় ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা পুরো দেশকে আন্দোলিত করে দিয়েছে। এমনকি পৃথিবীর অনেক দেশও এই ঘটনায় নিন্দায় মুখর হয়ে উঠেছে। হয়তো এভাবেই সমাজ দুর্নীতি ও অপরাধ মুক্ত হবে। আবার যেন সমাজ ভেসেছে সেই দেড়শ বছর আগের নবজাগরণের ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসে। ওই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে সমাজের আবাল বৃদ্ধ বনিতা আজ রাস্তায় নামছে প্রতিদিন। 

এই পথেই আবার একালের নারী স্বমহিমায় আবারও প্রতিষ্ঠা পাবে এই আশা নিয়েই নতুন ভোরের নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় আছে একালের নারী ও আধুনিক সমাজ। এক ক্লেদমুক্ত স্বচ্ছ সমাজের বার্তা দিয়ে সাথে জর্জ উইলিয়াম কার্বিস এর ঐতিহাসিক উক্তি “সভ্যতার পরীক্ষা হোলো নারীর মূল্যায়ন” দিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানছি।

.    .    .

Discus