Image by Samitinjay V from Pixabay

ভূমিকা

‘সব সত্যি’ হলো আমার মনের স্মৃতি কোঠায় সযত্নে গচ্ছিত কয়েকটি সত্যি ঘটনার সংকলন। এই কাহিনীগুলোতে কল্পনার ছোঁয়া একেবারেই নেই। আমার দেখা এবং জানা বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা পাঠকের সাথে ভাগ করে নেওয়াই এই বইটি প্রকাশের মূল প্রেরণা।

‘সব সত্যি’ পাঠক মহলে সমাদৃত হ’লে আমার প্রচেষ্টা সফল হ’বে।

ভরা কোটাল

অবসাদের শিকার

দুর্গাপুর শিল্প নগরী ১৯৫০ এর শুরুতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বাংলার রূপকার ডঃবিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্ন পরিকল্পনার একটি বাস্তব এবং সার্থক রূপ। এই শিল্প নগরীটি দামোদর নদীর তীরে ও বৃহত্তম কয়লা খনি অঞ্চল রানীগঞ্জ ধানবাদের কাছেই গড়ে উঠেছে। তবে দুর্গাপুর ভারতবর্ষে বিখ্যাত হয়েছে মূলতঃ দুর্গাপুর ইস্পাত ও দুর্গাপুর মিশ্র ইস্পাত কারখানার সৌজন্যে। এই দুই কারখানা সংক্ষেপে যা ডিএসপিও এএস পি নামেই স্থানীয় মানুষদের মধ্যে বহুল পরিচিত। এই দুর্গাপুর উপনগরীটি কলকাতা শহর থেকে সড়ক পথে প্রায় একশ পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরে। এছাড়াও দুর্গাপুর একটি সুপরিকল্পিত উপনগরী হিসেবেই ভারতবর্ষের শিল্প মানচিত্রে সুপরিচিত।

দুর্গাপুরের মানুষদের চিকিৎসার চাহিদার জন্য বহু বড় হাসপাতাল গড়ে উঠেছে এখানে। এর মধ্যে বিধান নগর উপ-বিভাগীয় হাসপাতাল, দ্য মিশন হাসপাতাল ও দুর্গাপুর হাসপাতাল হল দুর্গাপুরের বিশিষ্ট হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুর্গাপুর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার একটি সুসজ্জিত শিল্প শহর। দুর্গাপুরের সাথে বাঁকুড়া জেলার যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা হোলো দামোদর নদীর উপর নির্মিত ডিভিসি র একটি সেতু। এই কাহিনীর প্রেক্ষাপট ১৯৮০ র এক বিকেলে। সেদিন ছিলো দামোদরে ভরা কোটাল।সুব্রত চৌধুরী মানে যার ডাকনাম ঝন্টু বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই ডিভিসির ব্রীজের কাছে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছিলো। ঝন্টুদের বাড়ি ওই ব্রীজ থেকে মাইল খানেক দূরে। তাই সে প্রায় প্রতিদিন বিকেলেই ওই ব্রীজের কাছে দাঁড়িয়ে খোলা হাওয়ায় নিজের প্রাণশক্তি একটু চাঙ্গা করে নেয় আর কি! ঝন্টু

বি.কম পাস কোরে এখনও চাকরির খোঁজ করে চলেছে। কিন্তু শিকে

ছেড়েনি আজও। তবুও চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় ওর ক্লান্তি ছিলো না কোনো। ঝন্টু দেখতে শুনতে সুপুরুষও বটে। তবে ও বিকেলের পাড়ার ঠেকে আড্ডায় বসা একদমই পছন্দ করেনা। একটু একান্তে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ঝন্টুর বাবা ডিএসপিতে একাউন্টেন্ট এর চাকরি করেন। এখনও চাকরি আছে তার বেশ কয়েক বছর। কোম্পানির কোয়ার্টার্সেই ওরা থাকে। ছেলে হিসেবে ঝন্টুকে মধ্যমেধার বলা যেতে পারে।

ঝন্টু নিজের মনে সিগারেট খাচ্ছিলো আর ভরা কোটালে দামোদরের রুদ্ররূপ উপভোগ করছিলো। দমকা হাওয়া ওর চোখে মুখে এসে ঝাপটা মেরে দিচ্ছিল। হঠাৎ কাছেই উল্টোদিকে চোখ পড়তেই ওর চোখ পরলো একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে সেতুর ওপর থেকে দামোদরের বুকে ঝাঁপ মারার চেষ্টা করছে। একদম শেষ মুহূর্তে ঝন্টুর চোখে পড়েছিল তাই রক্ষে।

ও এক দৌড়ে গিয়ে

দিগ্বিদিক্ জ্ঞান শূন্য হয়ে ওই মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে ব্রিজের রেলিং এর কাছ থেকে সরিয়ে এনে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে ফেরালো আবার নতুন জীবনের পথে। পরে ঝন্টুকে সেই মেয়ে মানে ডক্টর নম্রতা বিশ্বাস বলেছিলো তার অবসাদের করুণ কাহিনী যা তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছিলো। সেবারের মত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো নম্রতা।

নম্রতার আত্মহত্যার নেপথ্য কাহিনী

মনোবিজ্ঞানীদের মতে মানুষ আত্মহত্যা করতে যায় যখন সে আসনীয় মর্মান্তিক কোন অসহনীয় পরিস্থিতির শিকার হয়। না হ’লে এই অমূল্য জীবনের সুখ কেই বা ছেড়ে চলে যেতে চায়?

নম্রতার আত্মহত্যার নেপথ্য কাহিনীও ছিলো তার মনের মানুষের ঠকানোর কথা। নম্রতা কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস করে ইন্টার্নশিপ শেষ করে দুর্গাপুর সরকারি হাসপাতালে পোস্টিং পায়। দুর্গাপুরে দিন তার ভালোই কাটছিল কলকাতার গড্ডালিকা প্রবাহ থেকে বেরিয়ে মুক্তির আস্বাদ পেয়েছিলো সে দুর্গাপুরে পোস্টিং পেয়ে। এটা মফঃস্বল শহর হ’লেও এখানে শহরের সবরকম সুযোগ সুবিধাই আছে। সবচেয়ে বড় কথা দুর্গাপুরের খোলামেলা পরিবেশে এসে নিজেকে সে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মানিয়ে নিয়েছিলো।

এখানে এসে ওই হসপিটালেই কর্মরত ওর থেকে বছর তিনেকের সিনিয়র এক ডাক্তারের সাথে নম্রতার ঘনিষ্ঠতা হয়। আলাপ থেকে ভালো লাগা তারপর ওদের দু’জনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক কখন যে প্রেমে রূপ নেয় তা ওরা নিজেরাও টের পায়নি। ছেলেটির নাম শুভ্র জ্যোতি দাশগুপ্ত। সে এম বি বি এস এর পর এম এস ও করেছে। বেশ ভালোই কাটছিল ওদের দু’জনের সময়ের গতির সাথে তাল মিলিয়ে। প্রায়ই ওদের দুজনকে একসাথে দেখা যেতো। এমনকি নম্রতার বাবা-মা পর্যন্ত ওদের এই সম্পর্ককে মান্যতা দিয়েছিলো। কিন্তু নিয়তি অন্য কিছু লিখে রেখেছিলো নম্রতার জন্য। একদিন হঠাৎই সে ডঃ শুভ জ্যোতির স্টাফ কোয়ার্টারসে যায় ছুটির দিনে এক দুপুর বেলা কিছু একটা দরকারে। জানলার ফাঁক দিয়ে নম্রতার নজরে আসে হসপিটালেরই এক সুন্দরী নার্স মধুছন্দা দে-র সাথে তার একান্ত কাছের মানুষ শুভ্র ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে। এক ছুটে সেদিন সে তার নিজের

কোয়ার্টার্সে ফিরে এসেছিলো। বেশ কয়েকটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে একা ঘরে অচেতন হয়ে পড়েছিলো সেদিন নম্রতা। তবে তখন সেই শুভ্রই তাকে সময় মতো উদ্ধার করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে বাঁচিয়ে তুলেছিলো। সে যাত্রা নিশ্চিত মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে বেঁচে যায় নম্রতা।

তবুও বিধি বাম

যাহোক এই ঘটনার পর নম্রতা আর শুভ্রর ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক আবার জোড়া লাগতে শুরু করে। আবারও দেখা যেতে থাকে ওদের দু’জনকে রাস্তায় অথবা মার্কেটপ্লেসে কিংবা কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে।

আবার নম্রতা সবকিছু ভুলে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছিলো। আর ওকে মৃত্যুর থাবা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য একটু কৃতজ্ঞও ছিল নম্রতা শুভ্রর কাছে। পুরনো স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছিলো ওদের জীবনে। ওদের শুভানুধ্যায়ীরা অনেকেই এই পুনর্মিলন দেখে স্বস্তিও পেয়েছিলো। তাদেরই পরামর্শ মেনে একটা শুভ দিন দেখে ওরা দু’জনে ম্যারেজ রেজিস্টারকে ডেকে আইনি বিয়েটাও সেরে ফেললো একদিন। যদিও ওরা ঠিক করেছিল আরো একটু থিতু হয়ে সামাজিক বিয়েটা সেরে নেবে বছর মাস ছ’য়েক বাদে। তারপর দু’জনে মিলে একটা বড় বাড়ি নিয়ে গুছিয়ে সংসার করবে।

তবু এবারও যে বিধি বাম। এবারও সেই আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো তবে শুভ্রর সাথে এবার অন্য একটি উঠতি বয়সের উদ্ভিন্নযৌবনা আধুনিক নার্সের সাথে ঘনিষ্ঠতার খবর ছড়িয়ে পড়ল টাউনশিপে। এমনিতেই এই সব টাউনশিপ গুলোতে লোকসংখ্যা একটু সীমিতই থাকে। তাই এই ধরনের একটা মুখরোচক খবর হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা দেরি হোলো না। না এবার নম্রতা আর খবরের সত্যতা যাচাই করলো না। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে দামোদরের উপরের ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেবে। সেই লক্ষ্যেই সেদিন সে শেষ বিকেলে সে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ভরা কোটালের সময় দামোদর নদেরর বুকে। কিন্তু না এবারও জীবন ফিরে পেলো সে সুব্রত ওরফে ঝন্টুর হঠাৎ উপস্থিতির কারণে। এই ঘটনার পর ঝন্টু মাঝে মাঝেই নম্রতার কোয়ার্টারে যেতো। কারণ ঝন্টুর হাতে তখন অফুরন্ত সময়। মাঝে মাঝে তার শুধু চাকরির অ্যাপ্লিকেশন করা ছাড়া আর কোন কাজই তো নেই আর।

বয়ে চলে জীবন প্রবাহ

সময়ের সাথে সাথে জীবন প্রবাহও নিজের গতিতে আপন ছন্দে বয়ে চলে। দিব্যি চলে যাচ্ছিল ঝন্টুর জীবন মুক্ত বিহঙ্গের মতন। এখন যেন এক অদৃশ্য সূতোর ডোরে বাঁধা পড়েছে সে। প্রায় রোজই নম্রতার খোঁজ নিতে গিয়ে কখন যে দু’জন দু’জনকে ভালোবেসে ফেলেছে ওরাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। এমনিতে ঝন্টু নম্রতার থেকে বছর দু’য়েকের ছোট কিন্তু প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি লম্বা এবং একটু সুদর্শনও বটে। এক কথায় হ্যান্ডসাম্ বলা যায় ওকে। আর নম্রতা একটু শ্যামলা হলেও ওর চেহারাতেও অন্যরকম একটা আকর্ষণ ছিলো। বিশেষতঃ ওর দীঘল চোখ দুটোর এক মায়াবী মোহ।

ডঃ শুভ্র জ্যোতি কিন্তু আড়ালে ওদের সব খবরই রাখতো। এবার ঝন্টুর বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা-মায়ের কান ভাঙালো সে। এর ফল হোলো সাংঘাতিক। একে তো ঝন্টুর কোন রোজগার নেই তার ওপর ছেলে আবার তার থেকে বয়সে বড় কোন মেয়ের পাল্লায় পড়েছে এইসব জানতে পেরে ঝন্টু বাড়ি ফিরতেই ওকে সাবধান করে দিলেন ওর বাবা। বললেন “ওই মেয়ের সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখলে ও বাড়িতে থাকার অধিকার হারাবে।” কিন্তু ঝন্টুর মাথায় তখন জেদ চেপে বসেছে। সে কোনোমতেই আর অসহায় নম্রতাকে একা ছাড়তে রাজি ছিলো না। তাই ঝন্টু বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও নম্র তাকে সব বুঝিয়ে বললো। নম্রতা ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলো কঠোর বাস্তবের কথা ভেবে। কিন্তু ঝন্টু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় ছিলো সেদিন। আর কি করা কোন উপায় না দেখে নম্রতা ওকে ওর কাছে থাকার ব্যাপারে রাজী হয়ে যায়। চলতে থাকে নম্রতার হাসপাতালের ডিউটি আর ঝন্টুর চাকরির চেষ্টা। নাম্রতার মাইনেতে ওদের দু’জনের মোটামুটি চলে যাচ্ছিলো। ঝন্টু অনেক চেষ্টার পর একটা প্রাইমারি স্কুলের চাকরি পেয়ে যায় মাস দু’য়েক বাদে। এবার একটু খুশির মুখ দেখলো ওরা দু’জনে।

ক্ষণিকের সুখ

এখন ওরা দু’জনেই চাকরি করে। ঝন্টু চাকরি পাওয়াতে ঝন্টুর থেকেও খুশি হয়েছিল নম্রতা। তাই ঝন্টু চাকরি পাওয়ার খুশিতে যখন নম্রতা একটা ছোটখাটো গেট টুগেদারের ব্যবস্থা কোরলো তখন ওদের অনেক বন্ধু আর হিতৈষীরা পরামর্শ দিয়েছিলো আর দেরী না করে ওদের চার হাত এক কোরে নিতে। সেইমতো একটা ভালো দিন দেখে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করে রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা সেরেই ফেললো ওরা। শেষে ওদের সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি পেলো।

বেশ আনন্দেই কেটেছিল বিয়ের পর প্রথম বছরটা ওদের। তারপর নম্রতার কোল আলো করে ওদের সংসারে ঋজু এলো। দেখতে দেখতে চারটে বছর কিভাবে যে স্বপ্নের মতন কেটে গেল ওরা টেরও পারেনি। ঋজুর যখন পাঁচ বছর বয়স ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো ওরা। ঝন্টু স্কুলে যাওয়ার সময় ঋজুকে ওর স্কুলে পৌঁছে দিতো আর নম্রতা হাসপাতালের ডিউটি থেকে ফেরার পথে ঋজুকে বাড়ি নিয়ে আসতো। অবশ্য নম্রতার শিফটের ডিউটি পড়লে এই ব্যবস্থার একটু অ্যাডজাস্ট করতে হোতো ওদের। পড়াশোনায় ঋজু বেশ ভালোই হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সব জিনিস ধরতে পারে ঋজু। ও মোটামুটি প্রথম দশের মধ্যেই থাকে ক্লাসে।

একটু সুখের মুখ দেখেছে ওরা দু’জনে। ঋজু এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে কিন্তু ওদের সুখের সময় যে এভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে যাবে তা কে জানতো? আশির দশকে তখন সবেমাত্র রান্নার গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয়েছে। তবে মফঃস্বল এলাকায় বেশিরভাগ মানুষই পাম্প করা কেরোসিন ষ্টোভেই রান্না করতো ধোঁয়া এড়াবার জন্য। ওরাও তার ব্যাতিক্রম ছিলো না। একদিন রাতে নম্রতা রোজকার মতন স্টোভে রান্না করছিলো। হঠাৎ বিকট্ শব্দে বার্ষ্ট করেছিলো ষ্টোভ। থার্ড ডিগ্রী বার্ণ হয়েছিলো নম্রতার। যমে মানুষে টানাটানি করেও পনেরো দিনের মাথায় নম্রতা শেষ বিদায় নিল পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ঝজুর দায়িত্ব ঝন্টুর হাতে সঁপে।

সেই থেকে ঝন্টুর জীবনে শুধু একটাই লক্ষ্য ঋজুকে মানুষের মতো মানুষ করে তোলা। ঝন্টু এখন একা এক অসম জীবন সংগ্রাম লড়ে চলেছে যদিও ওর এই বিপদের সময় ওর বাবা-মা আবার ওকে আর ঝজুকে ফিরিয়ে নিয়ে গ্যাছে ওদের নিজেদের বাড়িতে। এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ক্ষণস্থায়ী সুখের সত্যতা আর জীবনের অনিশ্চয়তার কথা। সব শেষে নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে বলে এই কাহিনীর ইতি টানছি।

সাহেব
গোড়ার কথা

ছেলেটার নাম সাহেব। ওরা মানে ওর বাবা-মা আর এক ভাই ও বোনকে নিয়ে হাবড়ার গোবরডাঙ্গা তে ওদের বাড়ি। সাহেবের বাবার সাথে আমার বেশ কিছু বছরের জানাশোনা। সাহেবের কোন ডাকনাম নেই, ওর একটাই নাম।

ছোটবেলা দেখতে ফর্সা ছিল বলে ওই নাম রাখা হয়েছে। একথা ওর বাবা মানে অমল বাবুর কাছেই শুনেছি আমি। অমল বাবু সেই ছোট্টবেলায় ১৯৭১ সালের খান সেনাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে সাতপুরুষের ভিটেমাটি হারিয়ে পেট্রাপোল সীমান্ত পেরিয়ে গোবরডাঙ্গায় এসে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই বানিয়ে ছিলেন। বেশি দূর পড়াশোনা করেননি উনি। ছোট বয়স থেকেই রুটি রুজির তাগিদে অনেক রকম কাজই করেছেন যাতে দু’পয়সা উপার্জন করে সংসার চালিয়ে নেওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত অমলবাবু নার্সারীর দেখভালের কাজে থিতু হয়েছেন। আমার সাথে যখন আলাপ অমল বাবু তখন যাদবপুরের কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সে কাজ করতেন ঠিকা হিসেবে। সে যাই হোক এবার আসি এবার আসি সাহেবের কথায়।

সময়ের সাথে সাথে সাহেবও বড় হয়ে উঠছিল। তবে সেও পড়াশোনার থেকে রোজগারের দিকেই বেশি উৎসাহী ছিলো। এরকম অবস্থায় মাধ্যমিক পড়তে পড়তেই সে কাজে লেগে পরে। বেশ তাড়াতাড়িই সাফল্যও আসে। সাহেব আবার বাবার ওর বাবার মতো ধরাবাঁধা কাজ করত না।

ও কাজের ঠিকা নিয়ে অল্প পুঁজিতে বইমেলা অথবা কোন বড় প্রোগ্রামের সৌন্দর্যায়নের কাজ নিতো। বেশ ভালই আয় হোতো তাতে। আর অবসর সময়ে স্কুটার চালিয়ে বাড়ির কাছের যমুনা নদীর পাড়ে চলে যেতো বিকেলের দিকে হাওয়া খেতে। এই যমুনা নদী বর্ষাকালে ভরে যায় তাছাড়া বছরের বেশিরভাগ সময়ই হেঁটেই পার হওয়া যায়।

যমুনা নদী আসলে ইছামতলী একটা শাখা নদী আর কি!

হাওয়া খেতে গিয়েই পথেও আলাপ হয়েছিল ওই এলাকারই মেয়ে মিঠুর সাথে। মিঠু তখন বিয়ে অনার্স পড়ে ইতিহাস নিয়ে। ওদের এলাকাটা পরে গাইঘাটার মধ্যে। ওখানে তখনও একটা মেয়ে কলেজে পড়ছে এটা একটা বড় ব্যাপারই ছিলো।

যাই হোক সাহেবের থেকে বয়সে মিঠু বেশ কিছুটাই ছোটো। রাস্তায় মাঝে মাঝে দেখা হোতো।

সেই থেকেই আলাপ ও পরিচয়। মাঝে মাঝে সাহেব যদি বাড়িতেও যেতো। তাই ভালোবাসা হ’তে দেরি হয়নি ওদের।

আর সাহেবের রোজগার পাতিও বেশ ভালোই তখন। ওদেরই সম্পর্ক দুই পরিবার থেকেই মেনে নিয়েছিলো। তাই যা হয় আর কি কাজের থেকে একটু অবসর পেলেই মিঠুকে স্কুটারের পেছনে বসিয়ে কখনও পেট্রাপোলের কাছে বা কখনো ইছামতির ধারে আর মাঝে মাঝেই সোদপুর অথবা বারাসতের কোনো ভালো রেস্টুরেন্টে চলে যেতো সাহেব। মিঠুর তখন ফাইনাল ইয়ার চলছে। সাহেবের পড়াশোনা অতটা না হ’লেও রুচিবোধ ছিলো ষোলো আনা।

বিষ্ণুপুরের বিভীষিকা

সাহেব জীবনের চড়াই-উৎরাই বেয়ে এগিয়ে চলেছিল সামনের দিকে। একটাইলক্ষ্য মিঠু গ্রাজুয়েশনটা করলে ওর সাথে সংসার পাতা।

সাহেব আর মিঠু দুজনেই তাদের লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিলো। এর মাঝেই সাহেব বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের একটা রিসর্টে সৌন্দর্যায়নের একটা কাজ পেলো। দু’জন লোককে সাথে নিয়ে

সাহেব পৌঁছে গেলো কাজের জায়গায়। কাজও শুরু হলো জোর কদমে। কিন্তু মালিক ওদের যে ফাঁকি দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেটা সাহেব বুঝতে পারেনি। কারণ মালিকের উদ্দেশ্য ছিল ওদের স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়া। সাহেব বুঝতে পেরে যখন মালিক কে বলল ওদের পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিতে তখন সেই মালিক রীতিমতো শ্মশানে দিয়ে বলল “যাবে কিন্তু তোমাদের লাশ।”

এবার সাহেব বুঝতে পারলো বিপদের মাত্রা কতটা ভয়ংকর। কারণ মালিকের সাথে সমাজের উপর তলার মানুষদের খুবই দহরম মহরম ছিলো। রাজনৈতিক নেতা,মন্ত্রী থেকে পুলিশের সবাই ছিলো তার হাতের মুঠোয়। ভাই সাহেব ও সাজিদের নিয়ে ওখান থেকে পালাবার ছক করলো। আর সেই মতো একদিন কাক ভোরে রিসর্টের দেয়াল টপকে ফার্স্ট বাস ধরে শেয়ালদা হয়ে ট্রেনে চেপে বাড়ি পৌঁছে গেলো। এদিকে সেই মালিক ওদের পালানোর কথা জানতে পেরে ওদের নামে চুরির অভিযোগ করে থানায় এফ আই আর করেছিলো। সাহেবের এক আত্মীয় তখন হাবরা থানায় কর্মরত ছিলো। সাহেব বাড়ি পৌঁছেই ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে সেই আত্মীয়কে জানিয়েছিলো বলে পুলিশের হয়রানীর হাত থেকে সেদিন কোন রকমে নিস্তার পেয়েছিলো

সেই মিথ্যে চুরির অভিযোগ থাকে।

মৃত্যুর দোরগোড়ায়

কোনক্রমে সেবার সাহেব বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে পেয়েছিলো। তারপর আবার ওর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে এসেছিলো। এই ঘটনার পর কেটে গেছে প্রায় বছর দেড়েক। ইতিমধ্যে মিঠুও বিএ পাস করেছে। এবার ওদের বিয়ের প্রস্তুতি চলছে দু’বাড়িতেই। খুশির হাওয়া বইছে দুই পরিবারে। এরই মাঝে একদিন সকালে ঘটলো সেই মারণ ঘটনা। সেদিন সকালে সাহেব বেরিয়েছিল কাজে স্কুটারে চেপে। বাড়িতে কি কিছু দূরেই স্কুটারের ব্রেক ফেল করে। সাহেব ছিটকে পড়ে সামনের রাস্তায়। ততক্ষণে ওর মাথা পেটে দু’ফাঁক হয়ে গেছে। আর সারা শরীরে আঘাত। রাস্তা রক্তে ভেসে গ্যাছে। ওই অবস্থায় ওকে বারাসাত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ডাক্তার বলে বাঁচার আশা নেই বললেই চলে। বাড়ির সবাই উৎকণ্ঠার প্রহর গুনতে থাকে। সেদিন সাহেব যাচ্ছিল জগমোহন ডালমিয়ার বাড়ির বাগানের কাজ করতে। ডাল মিয়া সাহেব তখন ক্রিকেট দুনিয়ার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তাছাড়াও শিল্পপতি হিসেবেও সেই সময় উনি সারা ভারতে সুপরিচিত। সাহেব সেদিন কাজে যায়নি কেন বিকেলের দিকে সাহেবের মোবাইল ফোনে উনি ফোন করেন। রিপন ছিল তখন ওর ছোট ভাইয় গৌরবের কাছে। ও রকম সবকিছু জানায় ডালমিয়া সাহেবকে। উনি এক ঘণ্টার মধ্যে সব ব্যবস্থা করে বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সে সাহেবকে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করে দ্যান। শুরু হয় একটা জীবন নিয়ে জমে মানুষে টানাটানির পালা। প্রায় পাঁচ দিন সাহেব অচেতন ছিলো। তারপর ধীরে ধীরে ওর জ্ঞান ফিরে আসতে শুরু করে। কিন্তু কাউকে চিনতে পারেনা ও তখন। মিঠু কিন্তু দিনরাত হাসপাতালেই কাটিয়েছে তখন একলাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে। এমনকি ওই অবস্থায় ও মিঠুকেও পর্যন্ত চিনতে পারছিলো না। কি অবস্থায় মিঠুর বাবা-মা ওকে বারবার বুঝিয়েছে অন্য কোন ভালো ছেলে দেখে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু সেদিন মিঠু ছিলো এক রোখা। শেষ পর্যন্ত ওর যেদিন জিৎ হয়েছিলো। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রায় মাসতিনেক বাদে আবার ধীরে ধীরে নিজের স্বাভাবিক সত্তা ফিরে পায় সাহেব।

এই ঘটনার বছরখানেক পরে ধুমধাম করে মিঠুর ব্যবসায়ী বাবা সাহেবের সাথে শুভদিনে শুভক্ষণে ওর বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদের চার হাত এক হয়। এখন ওদের জমজ এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। তবে ওই ঘটনার পর সাহেব বাড়িতে থেকেই একটা প্রিন্টিং এর ব্যবসা করে এখন। এসে গেলে এগিয়ে চলেছে সাহেব আর মিঠুর সুখের সংসার।

পুসিদি

টালমাটাল সময়

সেটা সত্তরের দশক। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে বছর বিশেক আগে। তখনও দেশভাগের দগদগে স্মৃতি মানুষের মনে মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে যায়।

সেই সময়টা ছিলো নেহাৎই আমাদের ছেলেবেলা। আমার বেড়ে ওঠা দক্ষিণ কলকাতার শহরতলী অঞ্চলে। সাত পুরুষের ভিটেমাটি হারিয়ে সেই সময় আমাদের বাবা দাদারা কলকাতার শহরতলীর কাছে যাদবপুর গড়িয়া আর কিছু মানুষ আবার বর্ডার লাগোয়া বনগাঁ, সোদপুর,বারাসাত এসব জায়গায় থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে তখন। প্রত্যেকটা দিনই ছিলো তখন নতুন নতুন লড়াইয়ের মিছিল। সেই সময় প্রায়ই কানে আসতো একটা স্লোগান

” লড়াই লড়াই লড়াই চাই লড়াই করেই বাঁচতে চাই।” আজও সেই স্লোগান শোনা যায় কিন্তু সেই স্লোগানের ধার আজ অনেকটাই ফিকে হয়ে গ্যাছে কারণ মানুষ লড়াই করতে করতে আজ পায়ের তলায় শক্তজমির অধিকার অর্জন করে ফেলেছে।

তাই যে স্লোগান ছিল সেদিন জীবনের চাওয়া পাওয়া এবং অধিকারের প্রকাশ সেটা আজ নেহাৎই রাজনৈতিক রং লেগে আমাদের মনে মোটেও আলোড়ন তোলে না আর। আজ সেসব কেমন যেন কানে সয়ে গ্যাছে আর কি! আর সেই সময় মনে আছে দেয়ালে নানান ধরনের স্লোগান লেখা থাকতো এই যেমন ”বন্দুকের নলই শক্তির উৎস”,”সত্তরের দশককে মুক্তির দশকের পরিণত করুন”,”বুর্জোয়া নিপাত্ যাক” “চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”অথবা “লাঙ্গল যার জমি তার” এইসব আরকি। আর তখনই প্রথম শুনেছিলাম বুর্জোয়া পেটি বুর্জোয়া এইসব কিছু অতি ভারী ভারী শব্দ। যে সব কথার অর্থ সত্যিই হৃদয়ঙ্গম হোতো না সেই ধূসর অতীতের আমার সীমিত কিশোর বুদ্ধিতে। তবে বুক কেঁপে উঠতো মাঝে মাঝে পাইপ গানের গুলি আর দেশী বোমার (মানে চলতি ভাষায় যাকে পেটো বলা হতো) আওয়াজে। সে সময় যারা আমাদের থেকে একটু বড় মনে সদ্য যুবক আর কি তাদের কেউ কেউ ওই দলে নাম লিখিয়ে ছিলো। তাদের বোধহয় অতি সংগ্রামী বলাই ভালো। মাঝে মাঝেই কানে আসতো তখন মনীষীদের মূর্তি ভাঙ্গা অথবা মুণ্ডহীন করার খবর। সেই সময় ভাবতাম এসবের অর্থ কি?

পাড়ার দাদারা বলতো এইসবই হোলো গিয়ে প্রতিকী আসলে ওরা নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন দ্যাখে যে সমাজে থাকবে না কোন অসামঞ্জস্য কোন অর্থনৈতিক বৈষম্য। এক কথায় ওরা দেখতো বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে বদলানোর স্বপ্ন। ওদের মধ্যে বেশিরভাগই মেধাবী ছাত্র ছিলো। সেই অতিবাম আন্দোলনের নাম ছিল নকশাল আন্দোলন। যে আন্দোলন সত্তরের দশক জুড়ে সারা পশ্চিমবাংলায় উথাল পাতাল মাতিয়ে দিয়েছিল। যদিও পরে অনেক প্রাণের বিনিময়ে সেই আন্দোলনের ধার অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। সমাজ ব্যবস্থার কিন্তু একচুলও পরিবর্তন হয়নি। শুধু বদলেছিল সেই সব ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ যাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ একবারে নিশ্চিত ছিল। ভবিষ্যৎ হারিয়ে গিয়েছিল তাদেরই ব্যর্থতার কালো অন্ধকারে। কারোর হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড আবার কেউবা পুলিশের এনকাউন্টারে প্রাণ হারিয়েছিল কিংবা বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলো সেইসব স্বপ্নের ফেরিওলা ছেলেমেয়েগুলোর অনেকেই। পুসিদি

এদের মতোই একজন ছিল আমাদের পাড়ায়।

আধুনিকতার আড়ালে

পুসিদি ছিলো সেই সময় আমাদের পাড়ার বেশ ডাকাবুকো মেয়ে। পুসিদি নামেই তাকে পাড়ার সবাই ডাকতো।পুসিদির ভালো নাম আজ আর মনে নেই। তবে বেশিরভাগ সময়ই তাকে বাড়ির বাইরে সময় কাটাতে দেখেছি। সেই সময়ের সাপেক্ষে পুসিদি ছিলো যথেষ্টই আধুনিকা। মানে সেই সত্তরের দশকে পুসি দিকে দেখেছি অবলীলায় খোলামেলা পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়াতে এবং সমবয়সী ছেলে বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে আড্ডা মারতে। তবে বাচ্চুদার সাথে পশুদিন একটু আলাদাই সম্পর্ক মানে প্রেম ভালবাসার ব্যাপার ছিল আরকি! বাচ্চুদা আমাদের পাশের পাড়াতেই থাকতো। বেশ লম্বা ফর্সা আর হ্যান্ডসাম চেহারা ছিল বাচ্চুদার। আজকাল যাদের বাহুবলী বলা হয় সেরকম আরকি! বাচ্চুদা সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলো। পাইবা চুদাকে পাড়ার সবাই বেশ সমীহ করেই চলত। এমনও দেখেছি সবাই একসাথে আড্ডা মারছে পাড়ার মোড়ে হঠাৎ পুসিদি এসে হাজির হোলো। দেখা গেল বাচ্চু দেওয়া উপস্থিতি হঠাৎ করে দুজনে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গ্যাছে। কিছুক্ষণ বাদে দেখা গেলো ওদের দু’জনকে পাড়ার গোপাল দার রেস্টুরেন্টের পর্দাঘেরা কেবিনের ভেতর থেকে হাতে হাত দিয়ে বেরিয়ে আসতে। পুসিদি সেই অর্থে ডানা কাটা পরী না হলেও দেখতে বেশ

সুশ্রীই ছিলো। ওরাও আমাদের পাড়ার কাছাকাছিই থাকতো। ওদের দুজনেরই মধ্যবিত্ত পরিবার। আবার ওদের মধ্যে ঝগড়াও দেখেছি তাও রাস্তার ওপরেই। একবার দোলে দিন-দুপুরে দেখেছিলাম বাচ্চুদাকে পুসিদির গালে খোলা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে ঠাস্ ঠাস্ করে চড় মারতে।

তারপর থেকেই ওদের সম্পর্কের অবনতি হ’তে দেখেছি। পরে কানাঘুষো শুনেছি পুসিদি ছিল ধর্মতলা অঞ্চলের কোন বড় হোটেলের ক্যাবারে ডান্সার। ভালই রোজগার হোতো শুনতাম। কারণ সেই সময় পুসিদি ট্যাক্সি করে যাতায়াত করতো।

তবে পাড়ার অন্য মানুষদের সাথে পুসিদির বাড়ির একটু দূরত্ব ছিলো যদ্দুর দেখেছি। অনেক পরে জেনেছি নেছি পুসিদির রোজগারের একটা সিংহ ভাগই চলে যেত নকশাল আন্দোলনের ফান্ডে। শুনে বিশ্বাসই হয়নি যে পুসিদির মত অত উগ্র আধুনিকা একজন মেয়ে নকশাল আন্দোলনের মতো এক উগ্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলো।

কিন্তু এটাই ছিলো বাস্তব সত্য। কারণ একদিন ভোরবেলা দেখলাম পুলিশ ঘিরেছে পুসিদিদের বাড়ি। পুসিদি ছাড়া ওদের বাড়িতে থাকতেন ওর বয়স্ক বাবা,মা। তবে পুষিদিকে পুলিশ সেদিন ধরতে পারেনি। আগেই গোপন সূত্রে খবর পেয়ে পুসিদি সেদিন পালিয়ে গিয়েছিলো। ওর বাবা আর মাকে জেরা করে পুলিশকে সেদিন খালি হাতেই চলে যেতে হয়েছিলো। আর সেদিনই আমরা পাড়ার প্রতিবেশীরা জানতে পারলাম যে পুসিদি নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত। তারপর থেকে পাড়ার সেই ডাকাবুকো মেয়ে পুসিদিকে আর কোনোদিন পাড়ায় দেখা যায়নি যেন কর্পূরের মত নেই উবে গিয়েছিলো সে। তবে বাচ্চুদা ছিলো পাড়াতেই। এই ঘটনার পর তাকেও একটু মন মড়াই দেখতাম। হয়তো বাচ্চুদার কাছেও আসল ব্যাপারটা গোপনই ছিলো।

অশান্ত একাত্তর

সেটা একাত্তর সাল। যে সময়ের ঘটনা প্রবাহ নিয়ে প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন তার কালজয়ী ছায়াছবি “কলকাতা ‘৭১” উপহার দিয়ে বাঙালির মননে আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। আমরা সেই সময় হাইস্কুলের শেষ ধাপে। মাঝে মাঝেই স্কুলে হানা দিতো সেই দামাল ছেলের দল। স্লোগান দিতে দিতে আসতো ওরা। স্কুলের সামনে পথসভার মতো করে আগুন ঝরানো বক্তব্য রাখতো ওদের মতে সমসাময়িক বূর্জোয়া সমাজব্যবস্থাকে বদলানোর দাবী নিয়ে। ওরা খুব বেশি হলে তিন থেকে চারজন আসতো কিন্তু কাঁপিয়ে দিয়ে চলে যেতো। সেযে কি উদ্বেগের দিন চলেছিলো সারা বাংলা জুড়ে সেসব ভুক্তভোগীরাই জানে। সেই আন্দোলনের শুরু হয়েছিল উত্তর বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম নকশালবাড়ি থেকে। সেই থেকেই সেই আন্দোলন সারা ভারতে নকশালবাড়ি আন্দোলন নামেই পরিচিতি পেয়েছিলো।

সেই আন্দোলনের প্রধানমুখ ছিলেন চারু মজুমদার। যিনি নিজে ছিলেন এক বর্ধিষ্ণু জমিদার বংশের ছেলে। কি অসম বৈপরীত্য। তারপর ধীরে ধীরে সেই আন্দোলনে আরও অনেকেই সামিল হয়েছিলেন সাঁওতাল পরগনা থেকে কলকাতা। শহরের অলিতে গলিতে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই আন্দোলনের বীজ। ওদের লক্ষ্য ছিল গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা। আর সেটাই করেছিলো ওরা। সেই সময় ওই দলে অনেক মেধাবী ছেলেই নতুন স্বপ্নপূরণের লক্ষ্য নিয়ে যোগ দিয়েছিলো। কারণ ওই বয়সে বাস্তববোধ একটু কমই থাকে মানুষের। তাই হবে হয়তো বা।

যাইহোক সে সময় হঠাৎ কাগজে চোখে পড়ল যদুগোদা মানে সেই সময়ে বিহারের পাহাড়

জঙ্গল ঘেরা একটা দুর্গম এলাকায় বাংলার প্রায় সত্তর আশি জন ছেলে মেয়ে একসাথে ধরা পড়েছে আর তাদের মধ্যে পুসিদিও ছিলো আর ছিল আমাদেরই পাড়ার সেই সময়ের মেধাবী ছেলে শৈবালদা। যে ছিলো ডাবল এম এ পাশ এবং শৈবালার পরিবারও ছিলো বেশ বর্ধিষ্ণু এবং সচ্ছল। কিন্তু সেই অলীক স্বপ্নের বলি হয়েছিলো শৈবালদা ও।

শুনেছি পুলিশের এনকাউন্টারে গোটা কুড়িজনের মৃত্যুও হয়েছিল যদুগোদার সেই পুলিশ এনকাউন্টারে। আর সেটা ছিলো কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের শাসনকাল। ধরা পড়ার পর ওদের সবাইকেই পুলিশের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিলো। যদিও বেশ কিছুদিন পর ছাড়া পেয়েছিল সেই শৈবালদা। কিন্তু তখন আর সে কর্মক্ষম ছিলো না পুলিশি নিপীড়নের ফলে। তবে পুসিদির আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি সেই ঘটনার পর। একাত্তরের শেষে সেই দিশাহীন স্বপ্নের হুজুগে আন্দোলন ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে বাহাত্তরের গোড়ার দিকে। শান্তি ফিরে আসে পশ্চিমবাংলায়। যে আন্দোলনের আঁচ শুধু পশ্চিম বাংলায় ই নয় পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহার, উড়িষ্যা এমনকি মধ্যপ্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। কিন্তু সেই লক্ষ্যভ্রষ্ট আন্দোলনের শিকার হয়েছিলো সেদিন বিপথে যাওয়া পথভ্রষ্ট পশ্চিমবাংলার যুবসমাজ। সেদিনের সেই আন্দোলনের জোয়ারে পশ্চিমবাংলার বেশ কিছু মেধাকে অকারণেই অকালে বলি হতে হয়েছিলো। সে এক অপূরণীয় ক্ষতির এক অন্ধকার ইতিহাস বৈকি।

মেধাবী প্রবাল

উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি

প্রবাল দত্ত খন্ন্যান হুগলীর ছেলে। বরাবরই মেধাবী ছেলে ছিল এই প্রবাল। স্কুলের পরীক্ষায় বরাবরই প্রথম দশের মধ্যে থাকতো সে। ১৯৭২এ ইঞ্জিনিয়ারিং এর জয়েন্ট এন্ট্রান্সে মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান পেয়ে সসম্মানে ইলেকট্রনিক্স ও টেলিকমিউনিকেশনস নিয়ে তৎকালীন শিবপুর বি ই কলেজের ভর্তি হয়েছিল সেই প্রবাল মানে প্রবাল বসু। সেই সময় জুনিয়র হোস্টেল ছিল দু’টো। একটা ডাউনিং ও অন্য হোষ্টেল টী হোলো হোষ্টেল নাম্বার তেরো। ডাউনিং হোস্টেলে অনেক ছেলে থাকতো। কারণ এই হোষ্টেলটী ছিলো ব্রিটিশ আমলের এক দুর্গ এবং অনেকটা জায়গা নিয়ে, তাই বহু ছেলের এখানে থাকার ব্যবস্থা ছিলো। তিনটে উইন ছিল ওই ডাউনিং হোস্টেলের। সেন্ট্রাল,ইস্ট ও ওয়েস্ট। আজ সেই ডাউনিং হোস্টেল এক হেরিটেজ। সেই হোস্টেল কম্পাউন্ডের মাঝে ছিল বিশাল এক সবুজ লন। এটা খোলা আর সেদিক দিয়ে গঙ্গা ঠান্ডা হাওয়া ও করে শরীর জুড়োত আমাদের।

সেই সময় আমাদের পরীক্ষার সিস্টেম ছিল পিরিওডিকাল। বছরে দু’বার পরীক্ষা হতো।,

প্রথমটা ছ’মাসের মাথায় আর ফাইনাল হোতো এক বছরের মাথায়। সেই পরীক্ষার পরই হোতো পরে ডিয়ারে প্রমোশন। পোস্ট পিরিয়ডিক্যাল যেমন তেমন করে দিলেও আমরা সবাই ফাইনাল পিরিয়ডিক্যালটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতাম। আমরা যখন ফাইনাল পরীক্ষার মাস খানেক আগে মন লাগিয়ে পড়াশোনা করতাম তখন দেখতাম প্রবালকে খুবই হালকাভাবে নিতে সেই ফাইনাল পরীক্ষা। কারণ আমাদেরই অনেক ব্যাচমেট ওকে বুঝিয়েছিল তুই এত মেধাবী তুই না পড়লেও পাস করে যাবি, ভালো নম্বর পেয়ে। আসলে সেইসব বন্ধুরা যে ওর কতটা ক্ষতি করছিল প্রবাল সেটা ধরতেই পারেনি।ওদের পাল্লায় পড়ে প্রবাল যাকে বলে সব দিক দিয়েই অধঃপতনের দিশায় ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিলো। সেই সময় থেকেই হরেক রকম নেশার দিকের আসক্ত হয়ে পড়ে প্রবাল। বিশেষ করে গাঁজা।

আমরা যখন পরীক্ষার প্রিপারেশনে ব্যস্ত ওকে এখন দেখতাম বিন্দাস ঘুরে বেড়াতে, প্রেম করতে ও নেশা করতে। মানে পড়াশোনা বাদ দিয়ে সবকিছুই করতো প্রবাল। এমনি করেই কোন রকমে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ করে আমাদের সাথে সেকেন্ড ইয়ারে প্রমোশন পেয়েছিলো প্রবাল। তারপর আমাদের সাথেই নয় নম্বর হোস্টেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে চলে এলো প্রবাল। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেও প্রবালের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং ও তখন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো। মাঝে মাঝে খন্যানে মানে ওর হুগলির বাড়িতে চলে যেতো। ওখানে একটি মেয়ের প্রেমেও তখন হাবুডুবু খাচ্ছে প্রবাল। আর তার সে যখন হোস্টেলে যখন থাকতো তখন উশৃংখল জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলো সে। আর এর ফল হাতে নাতে পেয়েছিল সে প্রথমবার সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করে। কিন্তু আমাদের ব্যাচমেট থাকার দরুন প্রবালের ওঠাবসা সবই ছিল আমাদের সাথে। আমরা যখন থার্ড ইয়ারে উঠে গেছি তখনও প্রবাল সেকেন্ড ইয়ারের দ্বিতীয়বার ফাইনাল দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

প্রবালের বিগড়ে যাওয়া

তবে একটা কথা না বললেই নয়, কেন জানিনা প্রবাল কিন্তু আমাদের সব ব্যাচমেটদের কাছেই অত্যন্ত প্রিয় ছিলো। আমরা সবাই ওকে একটা অন্য নজরে দেখতাম। থার্ড ইয়ারে আমরা ওকে স্টাডি রুমে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। কারণ ওই ঘরেই শুধু ফ্যান ছিলো। তাও যদি ওর পড়াশোনার দিকে একটু মন লাগে সেই জন্য আর কি! কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। প্রবালকে আমরা ঘরের ভেতর বন্ধ করে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিতাম যাতে ও একটু পড়াশুনোয় মন দেয়। কারণ সেটাই ছিল ওর শেষ সুযোগ। কারণ এবার ফেল করলে ওকে সি এন আর করে দেয়া হবে যে। আমরা বন্ধুরা চেষ্টা করলে কি হবে? প্রবল ঘরের ভেতর মন দিয়ে পড়ার বইয়ের বদলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ পড়তো।

আর মাঝে মাঝেই জানালার বাইরে কার্নিশ বেয়ে সে হাওয়া হয়ে যেতো। কারণ ইতিমধ্যেই সে আমাদের কলেজের ভেতরে মর্ডান স্কুলের ক্লাস টেনএ পড়া একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলো। তাকে নিয়ে সে চলে যেতো কখনও বট্যানিকাল গার্ডেনে অথবা কোনো সিনেমা হলে ইভিনিং শো দেখতে। অর্থাৎ আমাদের কোনো কথাতেই সে কর্ণপাত করত না তখন। আমরাও হাল ছেড়ে দিয়ে বুঝেছিলাম যে প্রবল পুরোপুরিই বিগড়ে গ্যাছে। আর ফলো পাওয়া গেল হাতে হাতে তৃতীয় বার সেকেন্ড ইয়ারে ডাহা ফেল করলো। কলেজ থেকে সিএন আর হয়ে সে চলে গেল বাড়ী। আমাদের কারুর সাথেই তারপর প্রবালের আর কোন যোগাযোগই ছিলো না।

কারণ ওর বাড়িও ছিল হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত জায়গা খন্ন্যানে। তবে প্রবালের কথা ভেবে আবাসিক জীবনে যেমন আমরা কষ্ট পেতাম আজও একই রকম কষ্ট অনুভব করি ওর কথা মনে পড়লে।

প্রবালের রি অ্যাডমিশন

এদিকে আমরা ফাইনাল ইয়ারে উত্তীর্ণ হয়ে যে যার মতন চাকরি করছি এবং সেই সূত্রে এদিক সেদিক ছড়িয়ে গিয়েছি সবাই। কারো সাথে আর তেমন যোগাযোগ নেই তখন। কারণ সেই সময় আজকের মতন মোবাইল ফোন ফেসবুক অথবা হোয়াটসঅ্যাপের এর চল ছিলো না। দুনিয়াটা আক্ষরিক অর্থেই বড় ছিলো। আজকের মত হাতের মুঠোয় ছিলো না।

যতদুর মনে পড়ে সেটা ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি হবে। আমি তখন হলদিয়াতে একটা প্রজেক্টে কর্মরত। মাসে একবার কলকাতা আসা হোতোই। আর যাদবপুরে আমার বেড়ে ওঠা। যাদবপুরে আমার দিদির বাড়িতে এসে উঠতাম তখন। দিন দু’য়েক থেকে আবার চলে যেতাম আমার কর্মস্থল হলদিয়াতে। আর যাদবপুর এলেই যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ভেতর ঘুরতে যেতাম আমি। সেখানেই হঠাৎ মাইকে ফুটবল খেলার ধারা ভাষ্যে প্রবালের নাম শুনে একদিন চমকে উঠেছিলাম আমি। কৌতূহলবশতঃ কাছে গিয়ে দেখি এই প্রবালই যে আমাদের ব্যাচমেট প্রবাল। দেখলাম ওর চেহারা অনেকটা রোগা হয়ে গ্যাছে। অনিয়মের চাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। যাইহোক কিছুক্ষণ কথা হলো ওর সাথে জানতে পারলাম প্রেমিকা ওকে ছেড়ে চলে গেছে। তারপর বছর দু’য়েক বাদে কলকাতা ইউনিভার্সিটির এক প্রভাবশালী কর্তার হস্তক্ষেপ ও রিঅ্যাডমিশন পেয়েছে বি ই কলেজে। কারণ তখনও বি ই কলেজ কলকাতা ইউনিভার্সিটির পরিচালনাধীন ছিলো। আমার সাথে যখন ওর দেখা হয়েছিল তখন ও ফোর্থ ইয়ারে। এই ক্ষণিক দেখার পর আর কোনদিনই দেখা হয়নি ওর সাথে। যদিও মাঝে মাঝেই কলেজের অনেকের সাথেই দেখা হতো বা ওদের খবরাখবর পেতাম কিন্তু প্রবালের সাথে যোগাযোগ একদমই ছিল না এবং ওর কোনো খবরও পাইনি আমি। ও যেন হারিয়ে গিয়েছিল একরকম। এই ক’দিন আগে কলেজের এক বন্ধুর কাছে খবর পেলাম প্রবাল বছর দশেক আগে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অমৃত লোকের দিশায়। তবে জেনে ভালো লেগেছে যে ওর একমাত্র ছেলে আজ নিউইয়র্কে এক সফল নিউরোলজিস্ট। এটাই বোধহয় জিনের পরম্পরা। প্রবালের মেধার ধারা এগিয়ে চলেছে সময়ের ধারা বেয়ে।

তারাপীঠ এর বিজনদা

আজকের এই আত্মপ্রচারের সময়ের স্রোতে বিজনদার মতন এই রকম প্রচার বিমুখ এবং নিজেকে আড়ালে রাখা মানুষ হাতে গোনা কয়েকজনকে দেখেছি আমি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বছরে না হলেও অন্ততঃ বার দু’য়েক আমি তারাপীঠে গিয়েছি। তবে ১৯৭৬ সালের সেই মধ্যরাতে তারাপীঠ মহাশ্মশানের স্মৃতি আজও শিহরণের ঠান্ডার স্রোত বয়ে যায় আর গায়ে কাঁটা দেয়। আজকের এখন সেই মহাশ্মশানকে আমোদের জায়গা হিসেবেই মানুষ মনে করে থাকে। দেখা যায় একদিকে বাউলরা একতারা বাজিয়ে সুর জুড়েছে যে যার নিজের ঘরানা মেনে। কারো সুর শ্রুতিমধুর আবার কারো বা অতি উগ্র। দ্বারকা নদীর এক পাড়ে মা তারার মন্দির আর অপর পারে এই মহাশ্মশান। শোনা যায় এই মহাশ্মশানই ছিল মাতৃ সাধক বামদেবের সাধন স্থল। যাই হোক আমি যেদিন পৌঁছেছিলাম সেদিন ছিল ভরা অমাবস্যার রাত এবং মঙ্গলবার। শাস্ত্রমতে অমাবস্যা যদি শনি অথবা মঙ্গলবারে পরে তা’হলে সেটা নাকি খুবই জাগ্রত হয়। আমার সাথে একজন ছিলেন তিনি আমাকে গাইড করে দ্বারকা নদীর সাঁকো পার হয়ে সেই মহাশ্মশানের পথে নিয়ে গেলেন। এদিক সেদিক ঘুরে মনে হচ্ছিল আমরা শ্মশান নয় শান বাঁধানো কোন সুসজ্জিত বাগানে হেটে বেড়াচ্ছে। এতটাই

সৌন্দর্যায়ন হয়েছে সেই মহাশ্মশানের। আমরা প্রথমে গেলাম বামদেবের সমাধিস্থলে। সেখানে বামদেবের সমাধিতে ধুপ মোমবাতি জ্বালিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বেরোনোর পর আমার সঙ্গী বললেন এসেছেন যখন চলুন ওই মাটির ঘরটায় ওখানেই বামদেব সাধনা করতেন। আর ওখানে যে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড আছে সেই আগুন কখনই নেভেনি। আমিও রাজি হয়ে গেলাম এবং পায়ে পায়ে পৌঁছে গেলাম সেই অতি পুরোণো মাটির ঘরটাতে। সত্যিই সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা বৈকি। সেই ধোঁয়াশা ঘরে জলন্ত ধূনির সামনে নিবিষ্ট মনে তারা মায়ের পুজোর ব্যবস্থায় ব্যস্ত টকটকে লাল ধুতি এবং উত্তরীয় পরিধানে একজন মাঝবয়সী মানুষ। আমার সঙ্গী পরিচয় করে দিলেন ওনার নাম বিজনদা। সেই আমার প্রথম পরিচয় বিজনদার সাথে।

অমাবস্যার পূজো

একথা সে কথার পর উনি বললেন আজকের আমাবস্যা খুবই আগ্রত। তখন আমারও মনে ইচ্ছে হলো আমি ওই শুভদিনে মায়ের পূজো দিই।

বলতেই উনি বললেন এখন সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে আর আজকের দিনে একটা জবা ফুল আর একটা বেলপাতা ও পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার তখন রুপ চেপে গেছে আমি বললাম এই আমি বসলাম আপনি দাদা পুজোর ব্যবস্থা করুন। তখন “বিজনদা বললেন দেখছি কি করা যায়।”উনি মোবাইলে ফোন করে সব ব্যবস্থা করতে শুরু করলেন। এইসব ব্যবস্থাপনার মাঝে বিজন দার ব্যক্তিগত কিছু কথা জানা গেল। এই যেমন উনি থাকেন দমদমে এবং অকৃতদার। ওঁর আর দু’ভাই ও আছেন দমদমে। বিজন দার পড়াশোনা বি এ পর্যন্ত। তারপর থেকেই তিনি বছরে ছ’ মাস তারাপীঠের এই বামদেবের ঘরে থাকেন।

বিজনদা তন্ত্র সাধনা করলেও সেই অর্থে ওনার ব্যবহার যথেষ্ট মার্জিত ছোটবেলায় অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছে বিজনদাদের। কারণ বিজনদার বাবা এজি বেঙ্গল এ খুবই কমমাইনের চাকরি করতেন। এমনকি ওনার বড় এক দাদা সে সময় বি ই কলেজে ভর্তি হয়েও দু বছরের মাথায় কলেজ ছাড়তে বাধ্য হন শুধু অভাবের তাড়নায়। যদিও পড়ে বিজনদার সেই দাদা জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তবুও সেইসব স্মৃতি বিজনদাকে আজও তাড়িয়ে বেড়ায়। তাই যখন উনি শুনলেন আমি বি ই কলেজ থেকে পাস করেছি উনি একটু ভাবুক হয়ে উঠলেন। এসব কথাবার্তার ফাঁকে যে কখন পুজোর জিনিষ এসে গেল আমি বুঝতেও পারিনি। যাইহোক অমাবস্যার যজ্ঞের জিনিষপত্র এলো এবং শান্তি মতো যগ্য সম্পন্ন হয়ে গেল। তবে এটুকু দেখেছি যে বিজন দা তান্ত্রিকদের মতো আর আচার-আচরণ করলেও তিনি একজন নিঃস্বার্থ পরোপকারী মানুষ। কারণ আমার অমাবস্যার পূজো সম্পন্ন হওয়ার ঠিক পরেই প্রায় আট দশজনের একটা দল ওই ঘরে এসে উপস্থিত হয় এবং বিজনদার থেকে সবাই পরামর্শ চাইতে থাকে। তাদের সবার বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। কিন্তু নির্লিপ্ততার সাথে একটুও বিরক্ত না হয়ে সবার সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন। আজকের দিনে এরকমটা বেশ বিরল। যাইহোক রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ আমি হোটেলে ফিরে এলাম। এরপর যতবারই তারাপীঠ গিয়েছি বিজনদার সাথে দেখা হয়েছে আর উনি একই রকম ব্যবহার করেছেন। তবে শুনেছি বছর তিনেক আগে উনি চির শান্তির দেশে চলে গেছেন। বিজনদার মত মানুষেরা সবসময়ই পর্দার আড়ালে থাকতেই ভালোবাসেন।

র্যাগিং

গোড়ার কথা

সময়টা ছিলো ঠিক যখন পশ্চিমবাংলায় নকশালবাড়ি আন্দোলন স্তিমীত হয়ে গেছে তার

ঠিক পরের বছর। কিছুটা হলেও ভয়ের রেশ ছিল তখনও।

যাইহোক ওরই মাঝে জয়েন্টে কোয়ালিফাই কোরে শিবপুর বি ই কলেজের আ্যডমিশন পেলাম। ডিসেম্বরের এক শীতের সন্ধ্যায় বাক্স প্যাটরা নিয়ে

কলেজ হোস্টেলে পা রাখলাম লোকাল গার্জেনের সাথে। হোস্টেলের নাম ডাউনিং হল। হোস্টেল না বলে এটাকে একটা দুর্গ বলাই চলে। আসলে ব্রিটিশ আমলে এটা একটা দূর্গই ছিল। কি উঁচু ঘরগুলো আজকালকার দোতলা বাড়ির থেকেও উঁচু। ভেতরে মেন একটা ছোটখাটো খেলার মাঠ। ঘরের চার কোনায় আমরা চারজন আবাসিক। মাথার উপর শব্দ কোরে ঘুরছে ব্রিটিশ আমলের দুই পাখার সিলিং ফ্যান আর তার ওপরে পূরোনো আমলের কড়িবর্গা।

পাশের ঘরেই আমার একই স্কুলের সহপাঠী সেও ভর্তি হয়েছে। এটাই আমাদের বড় হওয়ার পরে বাড়ির বাইরে প্রথম রাত কাটানো। আমরা দুজন মেসে ডিনার করে একখানা উডবাইন সিগারেট ধরিয়ে সামনের লনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া খুবই উপভোগ করছিলাম। একটু বাদেই একজন সিনিয়র দাদা এসে বলল কিরে কি করছিস তোরা আমরা বললাম এইতো এবার ঘুমোতে যাব রাত তো হলো সে বলল আরে এখন তো সবে সন্ধ্যে হলো এখন কি ঘুমোতে যাবি তোরা?

সিনিয়র দাদা বলল চল্ তোদের কলেজটা একবার ঘুরে দেখাই কোথায় কি আছে তোদের তো জানতে হবে নাকি। শুরু হলো দাদার সাথে পথ চলা প্রথমে একটা মাঠ পরল দাদা বলল এটা ওভাল তারপর বলল ওই দেখ্ কলেজ বিল্ডিং। তারপর বলল ওই দেখ্সেন্টেনারি গেট, বড়ঘড়ী।

ওই দেখ্ কবরখানা এখানে অনেক সাহেবের কবর আছে। তারপর বলল তোরা যে দিকটায় আছিস সেটা মুচিপাড়া আর এটা সাহেবপাড়া এবার আরো একটা মাঠ দেখিয়ে বলল এটার নাম হোলো লর্ডস বুঝলি।একটু বাদেই আমরা একটা হোস্টেলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ওই সিনিয়র দাদা বলল এই হোস্টেলটার নাম কি জানিস্? এটার নাম হোলো রিচার্ডসন হল। এবার হোস্টেলের গেটের সামনে পৌঁছেই সিনিয়র দাদাটির চোখমুখ পাল্টে গেল কিছু বিশেষণ যোগ করে বলল ঢোক্ এবার। ভেতরে দেখি আরো তিন চার জন সিনিয়র দাদা আমাদের জন্য ওত পেতে বসে আছে আর আমাদের মতো আরও দুজন ফ্রেসার। ব্যাস শুরু হয়েগেল র্যাগিং।

পুরোদমে র্যাগিং

রিচার্ডসন হোস্টেলের দোতলার একটা ঘরে আমাদের দুজনকে ঢ়ুকিয়ে দিয়ে ওই সিনিয়র দাদাটি বললো এই নে আরো দুটো নতুন মোর্গা

দিয়ে গেলাম।

এবার শুরু হলো পরিচয়পর্ব।নাম কি,কোন্ স্কুল কোথায় থাকা হয় এইসব আর কি।কিন্ত অতিসাধারণ এইসব প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়েও কেমন যেনো ভয়ভয় কোরছিলো।কারণ

ওই সিনিয়র দাদাদের আঢার আচরণে কেমন যেন আধুনিক তান্ত্রিক তান্ত্রিক লাগছিলো। ওদের সেই কথা বলার ষ্টাইল মুখের এক্সপ্রেশন আর ভাষার থ্রোয়িং অতিসহজেই বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ছিলো আমার মতো ওই চারজন সদ্য আগত মোর্গারূপী ফ্রেসারের। আমার সহপাঠী বন্ধুটি বোধহয় কোন অভিজ্ঞ পরামর্শ দাতার কাছ থেকে আগের থেকেই কিছুটা আঁচ কোরতে পেরেছিলো

কি হোতে পারে। তাই ও ডান পায়ে একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে রেখে ছিলো আগে থেকেই।

এসব তো ছিলো ট্রেলার এবার শুরু হলো পিকচার।

দাদারা বল্লো "তোরা চারজন জোরায় জোড়ায় মূজরো করবি বুইলি"। সাথে সাথে আমার স্কুলের সহপাঠীটি বলে উঠলো "আমার না ডান পায়ে ফুটবল খেলতে গিয়ে মোচড় লেগেছে এই দিন দুয়েক আগে ঠিকমতো হাঁটতেই পারছিনা কি ব্যাথা যে করে। এইতো ব্যান্ডেজ বাঁধা আছে"।

এক দাদার দয়ার শরীর ইমিডিয়েট বলে দিলো আমাদের নাচ কোরতে হবে না তবে ছাড়ও নেই ঐ বন্ধুটিকে নির্দেশ দেওয়া হোলো পাশের ঘরের সিনিয়র দাদার মশারীর একটা কোনা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে যতক্ষণ সে ঘুমোয় আরআমাকে বলা হোলো তুই সীমলা চলে মা। মানে টেবিলের তলা আর কি। আমরা তো প্রাণ ফিরে পেলাম যাক্ বাবা নাচানাচির হাত থেকে তো অন্তত রেহাই পাওয়া গেল।যদিও সীমলায় মশার উপদ্রব ভীষণই ছিলো। তবুও নাচের কাছে এতো নস্যি ছাড়া আর কি।

যাই হোক সীমলায় রোসে বোসে আর দূজনের অবস্থা দেখে সত্যিই খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেই রাতে ওদের দিয়ে রাধাকেষ্ট থেকে শুরু কোরে অতি আধুনিক টুইষ্ট নাচ তাও আবার দাদাদের সিটি সংগতের সাথে সেযে কি হৃদয় বিদারক তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

যাক্ এই ভাবে যখন ভোর চারটে বেজে গেছে মুজরো শেষ হোলো। এবার এক দাদা বলে উঠলো আরে তুই যে সীমলেয় ছিলি ভুলেই মেরে দিয়েছিরে।জোর বেঁচে গেলি নাচের হাত থেকে। মনে মনে বলি কি বরাত জোর এ যাত্রা বেঁচে গেলাম আমার পূন্যাত্মা পূর্ব পূরুষদের আশীর্বাদে।

পরে সেই সিনিয়র দাদাই যে আমাদেরকে হষ্টেলে পৌঁছে দিয়ে গেলো।কি সিনসিয়ারটি আর কি গুরু দায়িত্বজ্ঞান! সত্যিই কুর্নিশ কোরতে হয় ওই দাদাদের। কে জানে কোথায় আছে সেইসব সুবর্ণ হৃদয় মহান আত্মা মহামানবেরা।

এই ছবিটি ছিল কলেজ জীবনের প্রথম রাতের সালতামামি।

মধুরেন সমাপয়েত

কলেজ জীবনে প্রথম রাতে রিচার্ডসন হোস্টেলের

ঐ ঘটনার পর আমরা আরো সাবধান হোয়ে গিয়েছিলাম। বিকেল বেলা সেকেন্ড হাফের ক্লাসের পর আমরা টিফিন কোরেই গঙ্গার ঘাট অথবা বোটানিক্যাল গার্ডেন ঘুরতে চলে যেতাম রুমে থাকা আ্যভয়েড কোরতে।আর যদি বা কখনো সিনিয়র দাদাদের আওয়াজ পেতাম হোষ্টেলের ভেতরের ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে ছাদে লুকিয়ে থাকতাম যতক্ষণ না ওরা চলে যায়।তার ওপর ওই কদিন আটটা এগারোটার নাইট শো ছিল বাধা। সাতটার সময় হোষ্টেল থেকে বেরিয়ে আমরা তিন চারজন মিলে চলে যেতাম সিনেমা হলে।তথনও লিপী সিনেমা হল তৈরী হয়নি।আমরা এই অলকা,মায়াপু্যী আর

বঙ্গবাসী পর্যন্তই ছিল আমাদের গতিবিধি।

তাতেও নিষ্কৃতি ছিল না। আমরা রাত করে হোষ্টেলে পৌঁছে ঢ়েকে রাখা খাবার খেয়ে কোনো রকমে ডিনা্র শেষ কোরে ঘুমের জোগাড় করতাম।

এতোকিছু কোরেও ছাড় পাওয়া যেতো না দাদাদের র্যাগিং এর হাত থেকে। আসলে অতি পুরোণো আমলের ওই ঘরগুলোতে একটা করে বেশবড় জালদেওয়া জানালা ছিলো।আর মশারী

খাটিয়ে অতরাতে শুয়ে পড়ার পর ঘুমের আমেজ যখন সবেমাত্র এসেছে সামনে্র দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ আর সুগম্ভীর নির্দেশ দরোজা খোল দরোজা খুলে বেড়িয়ে আয়। কিন্তু আমরাতো ঘুমের ভান কোরে শুয়ে আছি কোন আওয়াজ করছিনা। বেশিক্ষণ না মিনিট পনেরো এরকম চলার পর পেছনের জানালা দিয়ে লোহার

স্টিক ঢুকিয়ে মশারী তুলে পায়ের তলায় রাম খোঁচা।আর কি এবার খুলছি খুলছি বোলে তারাতারি দরোজা খুলেই দেখি ওই রাতের অন্ধকারে এক নিকস কালো সিনিয়র দাদা লাল টি শার্ট আর কালো প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে সাথে আরো কয়েকজন দাদাকে নিয়ে।পরে জেনেছিলাম ওকে সবাই দাদা বোলে ডাকে। সুইমিং চ্যাম্পিয়ান ওই দাদা। প্রথমেই প্রশ্ন

কিরে খুব চালাক না এতক্ষণ ঘুমের ভান করা হচ্ছিল। নে এবার লাইন কোরে দাঁড়িয়ে পড় দেখি।

আমাদের য়ধ্যে একজনের বূকের লোমে একটু পাক ধরেছিল ওই দাদা ওর নাম জানতে চাইলে

ও ওর নাম যেই না বলেছে সবাই তো হেসেই কুটিপাটি।ওরা বললো "বুইলি আজ থেকে তোর নাম হোলো দাদু"। এক এক কোরে সবাইকার নামকরণ হোলো।সেই থেকে নিক্ নেম চালু হোয়ে

গেলো ওই দাদাদের সুললিত বচন। আর তার

পরও অনেক কিছু এই যেমন মাথায় বাক্স নিয়ে ওঠবোস করা মানে ওয়ার্ক ডান জিরো,

আলমারির ওপর থেকে দাদাদের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি। কিন্তু বাক্স নিয়ে ওঠবোস করতে গিয়ে আমাদের এক ব্যাচমেটের প্যান্ট ফেটে যাওয়ার পর সেরাতের মতো ছাড়া পেলাম আমরা। তারপরও কিছু লুকোচুরি কিছু ধরাপরে যাওয়া এভাবে দুহপ্তা কাটার পর ফ্রেসারস ওয়েলকাম হোয়ে যাওয়ার পর র্যাগিং পর্বের

ইতি। সেই র্যাগার দাদাই পরে নিজের ভাইয়ের থেকেও আপন ছিলো।মে কোন অসময়ে খবর পেলেই এসে ত্রাতার ভূমিকায় পেয়েছি সেই লৌহ কঠিন দাদাকে।

সেই নিক নেম আজও আমাদের অলন্কার বন্ধুরা আজও দেখা হোলে নিকনেম এই ডাকি। এখানেই দাড়ি টানছি র্যাগিং কাহিনীর।

ভুঁইফোড়
স্বাধীনতা ঠিক পরে

সেটা ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকের সময়। দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। বেশ কিছু উদ্দেশ্যহীন ভুঁইফোর মানুষ ওপার বাংলা থেকে সর্বস্ব খুইয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে উপস্থিত হয়েছে। ওদের একমাত্র লক্ষ্য যেভাবেই হোক জীবনে উঠে দাঁড়াতে হ’বে।

সে পথ কখনই মসৃন ছিলো না। সেই সময় সারাটা দিন ছিল জীবন সংগ্রামের এক চলমান নাট্য মঞ্চ। কালে কালে ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো বসতি সেই শহরতলীর পরিবেশে। সন্ধ্যা হ’লে বেশিরভাগ বাড়িতেই ছিলো লম্ফ, হ্যারিকেন অথবা খুব বেশি হলে হ্যাজাকের আলো। সে এক প্রায়ান্ধকার আরণ্যক অভিজ্ঞতা। কিছুদিন বাদে গড়ে উঠলো কলোনী কমিটি। বেশিরভাগ কলোনী কমিটিগুলোই মহাপুরুষদের নামে

নামাঙ্কিত ছিলো। যেমন

নেতাজি নগর, অরবিন্দ নগর, কাটজুনগর বা বিজয়গড় এইরকম আর কি। আর যে কলোনী কমিটি গুলোর নাম দেওয়া যায়নি সেগুলোকে এক একটা ওয়ার্ডের নম্বরে পরিচিতি দেওয়া হয়েছিলো। আজ স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর বাদেও সেই নামান্কন অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে।

তখন বাংলার সংস্কৃতি ও কৃষ্টির আকাশে কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন নাটকে উৎপল দত্ত, সুর ও বানীতে সলিল চৌধুরী, সংগীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র। চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটক, ছবি বিশ্বাস, বিকাশ রায়, আর সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন তখন উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, সাবিত্রী চ্যাটার্জি এরা সবে উদীয়মান।

এইসব বিরল প্রতিভাধর শিল্পীরা গণনাট্য সংস্থা বা পি এল টি গঠন করেন। শুরু হয় বাংলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিরলস চর্চা। বিখ্যাত সংগীতশিল্পী মান্না দে এবং কিশোর কুমার ও ওই সময়েরই উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু তাঁরা তখন মুম্বাই ফিল্মী দুনিয়ায়

স্বমহিমায় ভাস্বর। তবুও মাঝে মাঝে কৃষ্টির তাগিদে কলকাতার সংস্কৃতি জগতে উপস্থিত হয়ে নতুন সৃষ্টির তুফান তুলে গেছেন ওরা।

এতো গেলো স্বাধীনোত্তোর

প্রেক্ষাপটের চালচিত্রের এক সারাংশ। সেকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্যই ছিলো বেশি।

একটি দক্ষিণ পন্থা এবং অন্যটি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর বামপন্থা। যদিও ছোট আঞ্চলিক পার্টিও অনেক ছিলো যেমন ফরওয়ার্ড ব্লক, রিভোলিউশনারি সোস্যালিস্ট পার্টি ইত্যাদি। 

ঠিক সেই

.    .    .

Discus