দশকের সন্ধিক্ষণ। তখনও আমাদের এই পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেসের সরকার রাজ্যের শাসক দল। মাঝে বছর দু’য়েক যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল অজয় মুখার্জির নেতৃত্বে। তারপর আবার মানুদা মানে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের সরকার বীর বিক্রমে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলো সেই সরকার প্রথমে যেটা করেছিল তা হোলো বিরোধী কন্ঠকে স্তব্ধ করার কাজ। আর সেটা তারা বেশ গুছিয়েই শুরু করেছিলো। এই যেমন সিপিএম বা বামপন্থী রাজনীতিকে কোনঠাসা করে দেওয়া।
তারই ফলস্বরূপ পাড়ায় পাড়ায় কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় উঠতি মাস্তানদের দৌরাত্মে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ওদের কারো নাম কাণা অজিত, হাত কাটা জগা অথবা পোড়া স্বপন। এইসব নামকরণের সার্থকতা হল কেউ বোম মারতে গিয়ে হাত ঘুরিয়েছে অথবা কেউ বিপক্ষের কোন বাহুবলীর সাথে হাতাহাতি করতে গিয়ে চোখ হারিয়েছে এইসব আর কি। যাইহোক সেই সময় বিজয়গড় দু'নম্বর ওয়ার্ডে কানা আজিতের বেশ আধিপত্য ছিলো। মাঝে মাঝেই দেখা যেতো গলায় মোটা সোনার চেন পড়ে গলির মুখে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে টাকার বান্ডিল বার করে টাকার নোট গুনছে। এতো নগদ টাকা ওর কাছে কোথাথেকে আসতো সেটা সত্যিই ধোঁয়াশা ছিলো পাড়ার মানুষের কাছে। সিপিএম পার্টির ওপর ছিলো এই কাণা অজিতের জাতক্রোধ। এদিকে ওই পাড়াতেই থাকতো সাত ভাইয়ের এক বোন পর্ণা রায়। পাড়ার লোকেরা ওকে পরি বলেই ডাকতো। পর্ণার বয়স তখন বছর কুড়ি হ’বে। যেমনি রূপে তেমনি গুনে সেই মেয়ে ছিলো পাড়ার সকলেরই প্রিয় পাত্রী। পাড়ার সবাই পর্ণাকে বেশ সম্মানের চোখেই দেখতো। কেনই বা দেখবে না একে তো পড়াশোনায় মেধাবী তাতে আবার ডাক্তারিতে ফোর্থ ইয়ারে পড়ছে এন আর এস মেডিকেল কলেজে। উচ্চ মাধ্যমিকে চারটে লেটার নিয়ে সে বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম দশে স্থান পেয়েছিলো। আর এই পর্ণার উপর কাণা অজিতের শ্যেন দৃষ্টি পড়লো। সে পর্ণার গতিবিধির ওপর নিয়মিত নজর রাখত এবং গায়ে পড়ে পর্ণার সাথে ভাব জমাবার চেষ্টাও করতো। এরকম ভাবেই এক এক করে দিন কেটে যাচ্ছিলো।
পর্ণা কিন্তু কাণা অজিতের দিকে ভুলেও কোনদিনই ফিরে দ্যাখেনি। আর ওকে একদম কেয়ারও করত না সেই মেয়ে। এদিকে পর্ণার
দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে সেই মাস্তান অজিত ওকে পাওয়ার জন্য এক রেখা হয়ে পড়েছিলো।
একদিন পর্ণা কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা অজিত ওর রিক্সা দাঁড় করিয়ে”নীলে গগন কি তলে---”গানটা চিজ দিয়ে গাইতে গাইতে বলে ফেলে
“মেরি জান আই লাভ ইউ তুম কব মেরে হোঙ্গে।” রিক্সা আগলে রেখে একদম সোজা সাপটা প্রেম নিবেদন আর কি! রাস্তায় পাড়ার লোকেরা ছিলো। সবাই যেন সেই ঘটনাটা দেখেও দেখলো না। পর্ণা নিজেকে খুবই অসহায় মনে করছিল সেদিন বিকেলে। তখন ও সাহস করে রিক্সা থেকে নেমে এসে ওকে বলেছিলো”এই রাস্তা ছাড়ুন আপনি”আর অজিতের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিলো “লজ্জায় তো লাল হয়ে গেছো দেখছি। এতো তাড়াতাড়ি কি ছাড়া যায় সোনা তোমাকে!”
শুনে পর্ণার গাল দুটো ঘটনার আকস্মিকতায়
সত্যিই লাল হয়ে গিয়েছিলো সেদিন। তবে সেটা ছিলো লজ্জা নয় রাগের প্রকাশ। এবার পর্ণা
রিক্সা থেকে হঠাৎই নেমে এসে অজিতের গালে কষিয়ে এক চড় মেরে দিয়েছিলো খোলা রাস্তায় পাড়ার মানুষদের সামনে। কাণা অজিতের তাৎক্ষণিক উত্তর ছিলো”কাজটা ভালো করলে না এবার তোমাকে বাড়ি থেকে যদি না তুলে নিয়ে আসি তবে আমার নামও কাণা অজিত নয়। ছেড়ে দিলাম এখন বাড়ি যাও।”
এই খবর পাড়ায় ছড়িয়ে পড়তেই কেউবা পর্নাকে বাহবা দিলো আবার কেউবা ওকে সাবধান করে বললো”বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো নাকি?”কিন্তু পর্ণা নিজের মনে বললো”আত্মরক্ষা যদি বাড়াবাড়ি হয় তা’হলে এরকম বাড়াবাড়ি আমি আবারও করবো।” এই ঘটনায় ওর নিজের উপর আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেলো।
এমন কি পর্ণার দাদারাও ওকে মনোবল যোগালো।
ওরাও সেই সময়কার সিপিএম পার্টির ডাক সাইটে ক্যাডার ছিলো। যাই হোক কাণা অজিতও তক্কে তক্কে ছিলো। এক ভর সন্ধ্যা বেলা সময় সুযোগ বুঝে অজিত তার দলবল নিয়ে পর্ণার বাড়ী ঘিরে ফেললো। প্রথমেই সে পর্ণার সাত ভাইকে বেঁধে ফেললো।পর্ণা অনেক অনুনয় বিনয় কোরে চোখের জলে ভেসে বলেছিলো “আমার দাদাদের ছেড়ে দিন ওরা তো কোন অপরাধ করেনি। অপরাধ তো করেছি আমি, আমাকে যা শাস্তি দেবার দিন আপনি।”একথার উত্তরে অজিত বলেছিলো ” বিয়ে করতে হ’বে আমাকে।”শুনেই পর্ণার দাদারা একসাথে বলে ওঠে”না বোন ও আমাদের মেরে ফেলুক তুই ওকে বিয়ের জন্য রাজী হোস্ না। ও যে তোর জীবনটাকে নরককুণ্ড করে দেবে বোন।”
এই দেখে একটা দা নিয়ে এক পা এক পা করে ধীরে ধীরে অজিত এগিয়ে যায় পর্ণার হাত পা বাঁধা দাদাদের দিকে। তখন পর্ণা
ধরা গলায় বলে ওঠে”ও যদি তোমাদের মেরে ফেলে তারপর তো ও আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। তার চেয়ে আমি ওকে বিয়ে করবো। অন্ততঃ তোমরা তো বেঁচে যাবে।”
এই কথা শুনে অজিত বাতাস কাঁপিয়ে শয়তানের সাফল্যের হাসি হেসে ওঠে। উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয় কাণা অজিতের।পর্ণার সাথে কামাল অজিতের রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়ে যায়। আর শেষ হয়ে যায় মেধাবী পর্ণার ডাক্তার হওয়ার স্বযত্নে লালিত নীল স্বপ্ন।
কথায় বলে সংগ গুনে এবং সময়ের সাথে কয়লাও হীরে হয়ে যায় আবার দস্যু রত্নাকরও মহর্ষি বাল্মিকীতে রূপান্তরিত হন। এরকমই এই জবরদস্তি বিয়ে করে অজিতের আচার ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন আসে অনিচ্ছা সত্ত্বেও পর্ণার একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান জন্মায় বিয়ের
দু’বছরের মাথায়। আর অজিত মাস্তানি র রাস্তা ছেড়ে ধীরে ধীরে সৎ ভাবে ব্যবসার পথে চলে আসে। সে প্রথমে ট্রান্সপোর্টের ব্যবসা শুরু কর এবং তারপর সে চা বাগানের ব্যবসাতেও হাত লাগায় ও ব্যবসায়ী হিসেবে পাড়ায় মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। সুখী না হলেও এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে পর্ণা নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলো। তাকেও অজিত ব্যবসার পার্টনার করেছিলো।পর্ণাই অজিতের সব ব্যবসা পরিচালনা করতো এবং তার মোটামুটি ছিল ব্যবসার শেষ কথা। অজিত পর্ণার মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতো।পর্ণাই ছিলো কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। এর মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গ্যাছে ওদের একমাত্র ছেলে অয়ন এখন উত্তরবঙ্গের একটা নামই কনভেন্ট স্কুলে পড়ে। ওকে হোস্টেলে রাখার ব্যবস্থা করেছে পর্ণা। কারণ ও চায়না ছেলে তার বাবার অতীত জেনে ফেলুক। ওরন ক্লাসে দশের মধ্যে একজন। মাসে একবার পর্ণা চা বাগানে গভর্নিং বডির মিটিং অ্যাটেন্ড করতে গেলে ছেলের সাথে দেখা করে আসে। আর অজিতও এখন এসব ব্যাপার নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায় না। সময় এগিয়ে চলে তার নিজের গতিতে। এর মাঝে কংগ্রেস সরকার পরিবর্তন হয়ে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে যে সরকারের চালিকাশক্তি সিপিএম এবং মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু কিন্তু এই পট পরিবর্তনে অজিতের জীবনযাত্রায় কোন ব্যাঘাত হয় না। কারণ সে ততদিনে ব্যবসায়ী হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গ্যাছে।
তবুও পর্ণার সংসার সুখ ক্ষণস্থায়ী হোলো। সবকিছু যখন নিজের বিদ্যা বুদ্ধি দিয়ে মেয়েটা গুছিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই সময় অজিতেরই সমসাময়িক এক বাহুবলী জেল থেকে জামিনে ছাড়া পায়। হঠাৎ এক রাতে সে পুরণো শত্রুতার প্রতিশোধ নেয় অজিতকে কাছ থেকে গুলি করে কারণ অজিত ততদিনে তার পুরনো জীবন থেকে সরে এসেছিলো। সেই পর্ণা আজও জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ছেলেকে পাশে নিয়ে অজিতের ব্যবসা সামলিয়ে। অবশেষে রাহুমুক্তি হয়েছে পর্ণার জীবন থেকে।