Raja Rammohan Roy image credit by wikipedia
‘স্মরণীয় যারা’লেখার ভাবনা এসেছে যেসব মনীষীদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং আত্মত্যাগের ফসল হিসাবে বাঙালি ও সমস্ত দেশবাসী নতুন পথের দিশা পেয়েছে তাঁদেরই স্মরণ করা এবং বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাদের কথা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে। যাঁদের অবদান সমাজ সংস্কার, কাব্য ,সাহিত্য এবং মানবতার সেবায় ও শিল্পের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে আজও শাশ্বত হয়ে আছে তাঁদের কথা আমরা স্মরণ করি শুধুমাত্র বিশেষ কিছু দিনে। তাঁদের অবিস্মরণীয় অবদান ও ক্লান্তিহীন নিঃশর্ত আত্মত্যাগের কথা বর্তমান যুগের অত্যাধুনিক প্রগতি এবং উন্নয়নের ধারায় প্রাত্যহিক জীবন সংগ্রামের প্রবাহে ধূসর অতীতের গোধূলির আড়ালে ঢ়াকা পড়ে আছে। তাঁদেরই স্মরণ করতে এটি লেখকের একটি ছোট্ট প্রচেষ্টা মাত্র।
সেই সূদূর অতীতে বাঙালির নবজাগরণের যুগে বিভিন্ন আঙ্গিকে ছয়জন মহীরুহকে স্বরণের মধ্য দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোই এই সংকলনের মূল উদ্দেশ্য। পরিশেষে সাহিত্য সংস্কৃতিতে বাঙালির নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে
তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করি।
‘ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে,
তারা বলে গেলো ক্ষমা করো সবে বলে গেলো
ভালোবাসো-
অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো।
বরণীয় তাঁরা, স্মরণীয় তাঁরা, তবুও বাহির দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাঁদের ব্যর্থ নমস্কারে।’
রাজা রামমোহন রায়
বাংলার নবজাগরণ যা বাঙালি রেনেসাঁ নামেও বিশেষ পরিচিত। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে রেনেসাঁ
অথবা নবজাগরণ হোলো একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধি ভিত্তিক শৈল্পিক আন্দোলন। এই নবজাগরণ বা রেনেসাঁ আঠেরো শতকের শেষ থেকে কুড়ি শতকের গোড়ার দিকে আলোড়ন তুলেছিল। প্রায় দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাংলার নবজাগরণ বাঙালি সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এমনকি এই পরিবর্তন ভারতীয় উপমহাদেশে উপনিবেশবাদী ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি গুলো উদারতাবাদ ও আধুনিকতার একটি স্বতন্ত্র লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গিয়েছে।
যদিও রাজা রামমোহন রায়ের সমাজ সংস্কার ১৮৩৩ কাল পর্যন্ত সীমিত তবুও বাংলার নবজাগরণে সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় একজন অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিলো হিন্দু জাতীয়তাবাদ। আঠেরো শতকের শেষ দিকে এই নবজাগরণ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য
অংশও ছড়িয়ে পড়েছিলো।
এবার আসা যাক রাজা রামমোহন রায়ের কথায়। রামমোহন রায়ের জন্ম হুগলি জেলার থানা স্কুলের রাধানগরে ২২শে মে ১৭৭২ সালে। তার মৃত্যু হয় ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে স্ট্যাপলেন, ব্রিস্টল (ইংল্যান্ডে)। তিনি ১৮২৮ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি সামাজিক ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন ব্রাহ্ম সভার এক অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাকে রাজা উপাধি দিয়েছিলেন। জনপ্রশাসন,রাজনীতি,ধর্ম ও শিক্ষার পরিসারে তাঁর প্রভাব ছিল খুবই স্পষ্ট।
তিনিই সতীদাহ প্রথা এবং বাল্যবিবাহ প্রথা বাতিল আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন।
১৭৭২ সালের ২২ শে মে হুগলি জেলার খানাকুলে রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে রামমোহনের জন্ম হয়েছিলো। তার পিতা ছিলেন রামকান্ত এবং মাতা ফুল ঠাকুরানী দেবী। তিনি সংস্কৃত,ফারসি ও ইংরেজি ভাষায় মহাপণ্ডিত ছিলেন এবং তিনি আরবি ল্যাটিন গ্রীক ভাষায়ও যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থান ভ্রমণ করেছিলেন।
তিনি কাশী এবং পাটনায় কিছুকাল অতিবাহিত করেন। নেপালেও গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর সাথে
নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের যোগাযোগ হয়। পন্ডিত নন্দকুমার এর সাহচর্যে রামমোহন সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন। তারফলে তাঁর বেদান্তের প্রতি অনুরাগ জন্মায়।ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় পন্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারই তাঁর মূল সহযোগী ছিলেন।
তরুণ বয়সে তিনি কলকাতার ই এক মহাজনের কাছে কাজ করতেন তবে ১৭৯৬ সাল থেকে তিনি অর্থ উপার্জন শুরু করেন। এরপর ১৮ ০৩ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। তখন কর্মসূত্রে তাঁর কলকাতা আসা-যাওয়া লেগেই থাকতো। ইংরেজদের সাথে কাজের সুবাদে তিনি ইংরেজি ভাষাটা ভালো করে রপ্ত করে নিয়েছিলেন। এরপর ১৮১৫ সালে তিনি কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন এবং তখন থেকেই প্রকাশ্যে তাঁর সংস্কার প্রচেষ্টার শুরু করেন। তিনি কলকাতায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ব্যবসায়ী বাবু রাজচন্দ্র দাস এদের নিয়ে সমাজ সংস্কারে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং বাল্যবিবাহ ও সতীদাহ প্রথা এসব সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন।
এরপর তিনি ব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদান্ত সূত্র ও তার সমর্থনে উপনিষদ গুলোর বাংলা অনুবাদ করেন। ১৮ ১৫ থেকে ১৮১৯ সালের মাঝে প্রকাশিত হয় বেদান্ত গ্রন্থ, বেদান্ত সার
কেনোপনিষদ,ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ,
মান্ডুকোপনিষদ ও মুন্ডকোপনিষদ। সেই সময় বাংলার রক্ষণশীল ব্যক্তিরা তাঁর এই কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশের পরই ব্রাহ্মসমাজের নাম ও রূপ দেন। ইংরেজ সাহেবদের জন্য তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন।
দিলাম তো ও উপনিষদ গুলো প্রকাশের সময়কালেই তিনি সতীদাহ প্রথার মতন সামাজিক কুসংস্কারকে শাস্তিও এবং নীতি বিগর্হিত প্রমাণ করে লিখেছিলেন ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’। এর প্রতিবাদে বেরিয়েছিল
দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তক প্রকাশ করেছিলেন। আর তারপরই আইন করে সহমরণ রীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। তবুও গোঁড়া ব্রাহ্মণরা চালিয়ে যাচ্ছিল যাতে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে বিষয়টি পুনর্বিবেচিত হয়। তাই তাদের এই প্রচেষ্টায় বাধা দেওয়ার জন্য রামমোহন বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এই ব্যাপারে প্লিজ দ্বারকানাথ ঠাকুর তাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিলেন। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর তাঁর দাবি ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য ১৮৩০ সালে তাঁকে বিলেত পাঠান এবং তাঁকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ভারতে সামাজিক ও শিক্ষাগত সংস্কার প্রচারের জন্য ব্রাহ্মসভা এবং একতাবাদি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সামাজিক কুসংস্কার গুলো ছিলো সতীদাহ,বহুবিবাহ, বাল্যবিবাহ এবং বর্ণ বৈষম্য প্রথা। তিনি নারীদের জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনের প্রণেতা ছিলেন। তিনি ১৮২৮ সালে ব্রাহ্মসভা স্থাপন করেন এবং সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংস্কারবাদী বাঙালি ব্রাহ্মণদের একটি আন্দোলন সংগঠিত করেন। তাঁর এই প্রতিবাদী চরিত্রের জন্য তাঁকে বারবার প্রাণঘাতী হামলারও মুখোমুখি হ’তে হয়েছিল সেই সময়। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা সমাজ সংস্কারের একটি বাস্তব সম্মত হাতিয়ার। ১৮ ১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় তিনি কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় যে শিক্ষায় পাশ্চাত্য শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি সমর্থন করেছিলেন। তার সবচাইতে জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল ‘সংবাদ কৌমুদী’।
১৮৩০ সালের ১৯ শে নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। রাজা রামমোহন ১৮৩১ সালের ৮ ই এপ্রিল লিভারপুলে পৌঁছেছিলেন। ১৮৩২ সালের শেষ দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সে গিয়েছিলেন এবং সেখানে ফরাসি সম্রাট লুই ফিলিপ তাকে সম্বর্ধনা প্রদান করেন। ফ্রান্স থেকে ফিরে এসে তিনি
ব্রিস্টলে বসবাস করতে শুরু করেন। ১৮৩৩ সালে তিনি ম্যানেনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হন ও প্রায় আট দিনের জ্বরে ভুগে ২৭শে সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তার মৃত্যুর দশ বছর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে “আনসার ভেল” নামক স্থানে সমাধিস্থ করেছিলেন। তারপর বহুকাল বাদে ১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে তাঁর একটি মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়।
উনিশ শতকের শুরুর দিক অথবা পুরো উনিশ শতক জুড়েই এই বাংলায় চলমান বুদ্ধি বৃত্তিক একটি জাগরণ যা আদতেই ইউরোপীয় ধারার একটি নবজাগরণ ছিল। আধুনিক পণ্ডিতরা আজও বিশ্বাস করে থাকেন যে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে বাংলায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিত্বরা জীবন ও বিশ্বাসের বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠেন ও প্রশ্ন তুলতে শেখেন এবং বলা হয়ে থাকে এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বাংলার সমকালীন জীবনধারাকে বস্তুতান্ত্রিকভাবে বিশেষ প্রভাবিত করে। ও বিভিন্ন প্রতিবাদ মূলক আন্দোলন, নানা সংগঠন সমাজ ও সমিতি গঠন, ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন এবং নতুন শৈলীর বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি ও রাজনৈতিক চেতনা সহ আরও উদীয়মান অন্যান্য সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়কে এই নবজাগরণের ইতিবাচক লক্ষণ বলে যুক্তি দেখানো হয়েছে।
নবজাগরণ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে এসব বিষয়ের মূলে ছিলো ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে নবার্জিত বিভিন্ন ইউরোপীয় জ্ঞান। বিশেষ করে দর্শন,ইতিহাস,বিজ্ঞান ও সাহিত্য প্রভাবিত হয়েছিল সেই নবজাগরণ কালে। এই নবজাগরণে শুধুমাত্র বাংলার হিন্দু সমাজে উঁচুস্তরের সামান্য অংশ তাৎক্ষণিক ভাবে প্রভাবিত হলেও শেষ পর্যন্ত মুসলিম সমাজ ও অন্য সমাজের মধ্যেও প্রসার লাভ করেছিলো।
সেই শতকের শেষ পাদে নবজাগরণ আমাদের উপমহাদেশের অন্যসব প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে। এই নবজাগরণকে রেনেসাঁস হিসাবে ও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে।
নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়, এইচ এল ভি ডিরোজিও, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাদের অনুসারী অক্ষয় কুমার দত্ত, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ অগ্রগণ্য ছিলেন। এই নবজাগরণে নিবেদিত মনীষীরা যেসব পাশ্চাত্য চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন তা ছিল যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ, উপযোগবাদ, বিজ্ঞানবাদ, ব্যক্তিবাদ, দৃষ্টিবাদ, ডারউইনবাদ, সমাজবাদ ও জাতীয়তাবাদে উৎসর্গীগিত। ওই সময় এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল, শ্রীরামপুরের ব্যাপটিষ্ট মিশন, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ, হিন্দু কলেজ, ক্যালকাটা ইস্কুল বুক সোসাইটি, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন প্রতিষ্ঠানগুলি বাংলার নবজাগরণে তাৎপর্যপূর্ণ প্রামাণ্য উদাহরণ বহন করে।
এই নবজাগরণে তেমন সমাজ সংস্কারের পুরোধা ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত তেমনি ধর্ম এবং মানবতার পথিকৃৎ ছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ এবং রানী রাসমণি। আর সাহিত্যের নবজোয়ার এনেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বাংলা সাহিত্য ঋদ্ধ হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং কাজী নজরুল ইসলামের কাব্য,সাহিত্য এবং সংগীতের মূর্ছনায়।
এবার মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথায় আসি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত যিনি বাংলা সাহিত্যে মধু কবি হিসেবে বহুল পরিচিত তিনি ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন রাজনন্দন দত্ত ও জাহ্নবী দেবীর একমাত্র সন্তান।
রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানী আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। মধুসূদনের যখন ১৩ বছর বয়স সেই সময় থেকেই তার কলকাতায় বাস শুরু হয়।
মা জাহ্নবী দেবীর কাছেই তার রামায়ণ,মহাভারত এবং পুরাণের প্রথম পাঠ। তারপর সাগরদাড়ির পাশের গ্রামের শেখ পুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়। ইমামের কাছে তিনি বাংলা,ফরাসি ও আরবি পাঠের শিক্ষা নিয়েছিলেন। তেরো বছর বয়সে কলকাতায় এসে স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদানীন্তন হিন্দু কলেজে(যা বর্তমানে প্রেসিডেন্সি কলেজ ) ভর্তি হন। তিনি যথেষ্ট মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাই খুব তাড়াতাড়িই তিনি কলেজের অধ্যক্ষ ডি এল রিচার্ডসনের প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। রিচার্ডসন মধুসূদনের মনে কাব্য প্রীতির বীজ রোপন করেছিলেন। ওই কলেজেরই প্রাক্তন অধ্যাপক ডিরোজিওর স্বদেশ অনুরাগের স্মৃতিও তাঁকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। সেই সময় তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌর দাস বসাক, প্যারীচরণ সরকার প্রমুখ নবজাগরণের বিশিষ্ট পথিকৃত বৃন্দ। মধুসূদন মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাশা মনে গেঁথে নিয়েছিলেন।
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তারপর সেই বছরই ৯ই ফেব্রুয়ারী তিনি মিশণ রোতে অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চ এ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন। তাকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি এবং তিনি তার মাইকেল নামকরণ করেন। এবং তিনি পরিচিত হন মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামে। তার এই ধর্মান্তর সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। তাঁর পিতা রাজনারায়ণ তাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পর মধুসূদন শিবপুরের বিশপস কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এখানেই তিনি গ্রিক,লাতিন, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। বিশপস কলেজেই কয়েকজন মাদ্রাজি ছাত্রের সঙ্গে মধুসূদনের বন্ধুত্ব হয়েছিল। রিশপস কলেজের পাঠ শেষ করে যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে তিনি বিফল হন তখন সেই মাদ্রাজি বন্ধুদের সাথে ভাগ্যান্বেষণে মধুসূদন মাদ্রাজে চলে যান। শোনা যায় আত্মীয়-স্বজনের অজ্ঞাতুসারে নিজের পাঠ্যপুস্তক বিক্রি করে সেই টাকায় তিনি মাদ্রাজে চলে যান। শুরু হয় মধুসূদনের কঠিন জীবন সংগ্রাম।
তবে মধুসূদন মাদ্রাজে ও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি। তিনি স্থানীয় খ্রিষ্টান ও ইংরেজদের সহায়তায় একটি স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের চাকরি পান। তবে বেতন ছিল অতি সামান্য তাই ব্যয় সংকুলান হোতো না তার। ঠিক এই সময়েই তিনি ইংরেজি পত্রপত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। মাদ্রাজ ক্রনিকল পত্রিকায় ছদ্মনামে তার কবিতার প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু অর্থভাবে অচিরেই সেই পত্রিকাটিকে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তিনি। এই নিদারুণ অর্থ কষ্টের মধ্যেই তিনি দ্য ক্যাপটিভ লেডি নামে তার প্রথম কাব্যটি রচনা করেন। কবি এবং দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসাবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বাংলা ভাষায় সনেট এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকবি বিশেষনে আজও দীপ্তমান। বাংলা সাহিত্যে এভাবেই নবজাগরণ বা রেনেসাঁর পুরোধা হয়ে ওঠেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
হিন্দু কলেজের অধ্যয়নের সময়ই মধুসূদনের প্রতিভার বিকাশ ঘটে।১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলেজের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ইংরেজি নাট্য বিষয়ক প্রস্তাব আবৃত্তি করে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।।
সেই সময় তার সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ যারা পরবর্তী সময়ে স্বস্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন এবং এরাও বাংলায় নবজাগরণের বাহক হিসেবেই স্বনাম খ্যাত। তাঁদের মধ্যে মধুসূদন উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কলেজের পরীক্ষায় তিনি বরাবর স্বর্ণপদক পেতেন। কলেজে ছাত্র অবস্থায় নারী শিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। কলেজে ছাত্র অবস্থায় তিনি কাব্য চর্চা শুরু করেন এবং তখন তার কবিতা জ্ঞানান্বেষণ, বেঙ্গল স্পেক্টেটার, লিটারেরি ব্লসম কমেট প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
আর তখন থেকেই তিনি বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন এবং তাঁর ধারণা ছিল বিলেতে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া সম্ভব। তাই পিতা তার বিবাহ ঠিক করলে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং সেই সময় থেকে তিনি নামের পূর্বে মাইকেল শব্দটি যুক্ত করেন। কিন্তু হিন্দু কলেজে খ্রিস্টানদের অর্ধন নিষিদ্ধ থাকায় তাকে কলেজ ত্যাগ করে বিশপস কলেজে ভর্তি হতে হয়। বিশপস কলেজ থেকে অধ্যায়ন সমাপ্ত করে তিনি মাদ্রাজে গমন করেন। মাদ্রাজ অবস্থানকালী তাঁর Timothy Pen Poem ছদ্মনামে দ্যা কেপটিভ লেডি এবং ভিশনস অফ দা পাস্ট প্রকাশিত হয়। ও হিন্দি এটার সঙ্গে তার প্রথম ও দ্বিতীয় বিবাহ এই মাদ্রাজেই সংঘটিত হয়। মাদ্রাজে বসেই তিনি হিব্রু, ফরাসি,জার্মান, ইতালিয়ান,তামিল ও তেলেগু ভাষা শিক্ষা করেন। ইতিমধ্যে মধুসূদনের পিতা-মাতা দুজনেরই মৃত্যু হয়।
পিতার মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী এমিলিয়া হেনরিয়েটাকে নিয়ে১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা আসেন। সেখানে প্রথমে তিনি পুলিশ কোর্টের কেরানি এবং পরে দোভাষীর কাজ করেন। এ সময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে তিনি প্রচুর অর্থোপার্জন করেন। তার বন্ধুবান্ধবরা এ সময় তাকে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করতে অনুরোধ করেন। তিনি নিজেও বিলেত থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর ভেতর থেকে এইরকমই একটি তাগিদ অনুভব করেন। পন্ডিত রামনারায়ণ তর্ক রত্নের রত্নাবলী নাটকটি তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে বাংলা নাট্য সাহিত্যে উপযুক্ত নাটকের অভাব অনুভব করেন এবং বাংলা নাটক রচনার সংকল্প গ্রহণ করেন। এই সূত্রেই তিনি পাইকপাড়ার রাজাদের বেলগাছিয়া থিয়েটারের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এমনই এক পরিস্থিতিতে নাট্যকার হিসেবেই মধুসূদনের বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে পদার্পণ ঘটে। তিনি মহাভারতের দেবযানী-যজাতি কাহিনী অবলম্বনে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে পাশ্চাত্য রীতিতে রচনা করেন শর্মিষ্ঠা নাটক এবং এই একই অর্থে মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে নাটকের নবজাগরণের দিশারী। পরের বছর সমসাময়িক সমাজকে ব্যঙ্গ করে তিনি রচনা করেন দুটি প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ের রো’। যা আজকের দিনেও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। প্রথমটিতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত ইয়ং বেঙ্গলিদের মাদকাসক্তি, উশৃংখলতা ও অনাচারকে কটাক্ষ করেন এবং দ্বিতীয়টিতে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের আচার সর্বস্ব সমাজ পতিদের গোপন লম্পট্য তুলে ধরেন। এই ক্ষেত্রে মধুসূদন প্রতীক্ষিতের ভূমিকা পালন করেন। এই প্রহসন দুটির কাহিনী, সংলাপ ও চরিত্রের বিচারে আজও অতুলনীয়। মধুসূদনের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি যা কিছু রচনা করেছেন তাতেই নতুনত্ব এনেছেন। তিনি প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ বাংলা সাহিত্যে সার্থকভাবে প্রয়োগ করেন। তখনকার বাংলা সাহিত্যে রচনার শৈলীগত এবং বিষয় ভাবনা গত যে আড়ষ্টতা ছিল মধুসূদনটা অসাধারণ প্রতিভা ও দক্ষতা গুনে দূরীভূত করেন। ১৮ ৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গ্রিক পুরাণ থেকে কাহিনী নিয়ে রচনা করেন পদ্মাবতী নাটক। এই নাটকেই তিনি পরীক্ষামূলকভাবে ইংরেজি কাব্যের অনুকরণে অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রচলন তিনিই করেন এবং এইভাবে তিনি বাংলা কাব্যকে ছন্দের বন্ধন থেকে মুক্তি দেন। বাংলা কাব্যে অমৃতাক্ষর ছন্দ ব্যবহারের এই সফলতা মধুসূদনকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে এবং এই ছন্দে ওই একই বছর তিনি তিলোত্তমা সম্ভব কাব্যটি রচনা করেন। পরের বছর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রামায়ণের কাহিনী নিয়ে সেই একই ছন্দে তিনি রচনা করেন মেঘনাদবধ কাব্য। এটি তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। এটি বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক মহাকাব্য। এই কাব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্যে মহাকবির মর্যাদা লাভ করেন এবং আজও বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের বিষয় তিনি অমর হয়ে আছেন।
এই ভাবেই তার আবিষ্কৃত অমিত্রাক্ষর ছন্দ বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি রামায়ণে বর্ণিত অধর্মাচারী, অত্যাচারী ও পাপী রাবণকে একজন দেশপ্রেমিক বীর যোদ্ধা ও বিশাল শক্তির আধার হিসেবে চিহ্নিত করে উনিশ শতকে বাঙালির নবজাগরণের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা লাভ করেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতবাসীর চিরাচরিত বিশ্বাসের মূলে আঘাত হেনে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের গাঁথায় তা এক কথায় অতুলনীয়। মধুসূদনের কাব্যে এক ধরনের নারী বিদ্রোহের সুর লক্ষ্য করা যায়। তুমি তাঁর কাব্যের নায়িকাদের মধ্য দিয়ে যেন যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত অবহেলিত আত্ম সুখ-দুঃখ প্রকাশে অনভ্যস্ত ও ভীত ভারতীয় নারীরা হঠাৎ আত্ম সচেতন হয়ে জেগে ওঠে। তারা পুরুষের কাছে নিজেদের ভালো-মন্দ সুখ-দুঃখ ও কামনা বাসনা প্রকাশে হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। তাঁর বীরাঙ্গনা পত্র কাব্যের নায়িকাদের দিকে তাকালে এ কথার সত্যতা উপলব্ধ হয়। নারী চরিত্রে এরকম দৃঢ়তার প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে আর কারো রচনায় দেখা যায় না। মধুসূদনের
এসময়ের অপর দুটি রচনা হোলো কৃষ্ণকুমারী ও ব্রজাঙ্গনা। প্রথমটি রাজপুত উপাখ্যান অবলম্বনে একটি বিয়োগান্ত নাটক এবং দ্বিতীয়টি রাধা কৃষ্ণ বিষয়ক গীতিকাব্য। এই পড়বে তিনি দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। তিনি কিছুদিন হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাটি সম্পাদনাও করেন।
১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই জুন মধুসূদন ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে বিলেত গমন করেন এবং গ্রেজ ইন এ যোগদান করেন। সেখান থেকে তিনি ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্যারিস হয়ে ভার্সাই নগরীতে যান এবং সেখানে তিনি প্রায় দু’বছর ছিলেন। ভাষায় কি অবস্থানকালীন তার জীবনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এখানে বসেই তিনি ইতালীয় কবি পেত্রাকের অনুকরণে বাংলায় সনেট লিখতে শুরু করেন বাংলা ভাষায় সেটি হল এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। কারণ এর আগে বাংলা ভাষায় সনেটের প্রচলন ছিলো না। আর তারপরই তিনি যেন মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে নতুনভাবে এবং একান্ত আপন করে দেখতে ও বুঝতে পারেন। যার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে তার ‘বঙ্গভাষা’ ও 'কপোতাক্ষ নদ’এইসব সনেট ধর্মী কবিতার মাধ্যমে। তার এই সনেট গুলি ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে চতুর্দশপদী কবিতাবলী নামে প্রকাশিত হয়। ভার্সাই নগরীতে দু'বছর থাকার পর তিনি ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে আবার ইংল্যান্ডে যান ও ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে গ্রেজ ইন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করেন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৫ই জানুয়ারী দেশে ফিরে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসায় যোগদান করেছিলেন। কিন্তু ওকালতিতে সুবিধে করতে না পারার দরুণ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে মাসিক এক হাজার টাকা বেতনে হাইকোর্টের অনুবাদ বিভাগে যোগাযোগ করেন। দু'বছর পর এ চাকরি ছেড়ে তিনি আবারও আইন ব্যবসা শুরু করেন। এবার তিনি সাফল্যের মুখ দেখতে পান। অমিতব্যয়িতার কারণে তিনি বিনগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই অমিতব্যায়িতা ছিলো তাঁর স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। এই একই কারণে তিনি বিলেতে অবস্থানকালেও বিপদগ্রস্ত হয়েছিলেন এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আনুকূল্যে সেবার উদ্ধার পান। জীবনের এই টানা পূরণের মধ্য দিয়েও মধুসূদন তার কাব্য এবং সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রাখেন। হোমারের ইলিয়াড অবলম্বনে
১৮৭১ সালে তিনি রচনা করেন হেক্টরবধ। তার সর্বশেষ রচনা হোলো মায়াকানন নাটক। বাংলা ভাষায় তাঁর বারোটি গ্রন্থ এবং ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত পাঁচটি গ্রন্থ আছে।
মধুসূদন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন যুবক প্রবর্তক কবি। তিনি তার কাব্য এবং সাহিত্যে বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন সংস্কৃত মহাকাব্য ও পুরাণ থেকে। পাশ্চাত্য সাহিত্যের আদর্শ অনুযায়ী সমসাময়িক ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির জীবন দর্শন ও রুচির উপযোগী করে তিনি তা কাব্যে রূপায়িত করেন এবং তার মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যে এক নবজাগরণ বা নবযুগের ধারার সূচনা হয়। তাই উনিশ শতকের বাঙালির নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যিনি তার অনন্য সাধারণ প্রতিভার সাহচর্যে বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধন তিনি করেন এরই ফলস্বরূপ তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আজও অমর হয়ে আছেন। সেই কারণেই তিনি বাংলা সাহিত্যে মধু কবি নামে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে ভাস্বর হয়ে আছেন।
তবে বাংলার এই মহান প্রতিভার শেষ জীবন অত্যন্ত দুঃখ দারিদ্রের মধ্যে অতিবাহিত হয়েছে। ঋণেরদায় অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তার জীবন হয়ে উঠেছিলো দুর্বিসহ। শেষ জীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন।। কি হোম থিয়েটার মৃত্যুর ঠিক তিনদিন পরে ১৮ ৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুন বাংলার এই মহাকবি ক পদ্ধতি অবস্থায় জেনারেল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলা সাহিত্য জগতের সেই মহাকবির মর্মস্পর্শী কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানছি।
“দাড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে!
তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধিস্থলে(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম।)
মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন! যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ তীরে জন্মভূমি, জন্মদাতা
দত্ত মহামতি।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন উনিশ শতকের এক বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক। বঙ্কিমচন্দ্রের কর্মকাণ্ডের সময় কাল প্রায় পুরো বাংলার নবজাগরণের ক্রান্তিকাল জুড়ে। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তাঁর অসীম অবদানের জন্য তিনি বাংলা সাহিত্যের আকাশের অমূলত্ব লাভ করেছেন। বাংলায় যখন সংস্কৃত কাব্য সাহিত্যের আধিপত চলছে। সেই সময় বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম আধুনিক বাংলা সাহিত্য রচয়িতা দের তালিকায় প্রথম ঔপন্যাসিক। আবার গীতার ব্যাখ্যাদাতা হিসেবেও
তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ব্যবহার জীবনে পেয়েছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর অর্থাৎ এক কথায় ব্রিটিশ রাজের কর্মচারী। সেই তিনিই আবার বাংলা ভাষার আদি সাহিত্য পত্র বঙ্গ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। কমলাকান্ত ছদ্মনামেও তিনি সমাধিক বিখ্যাত। তাঁকে বাংলা উপন্যাসের জনক বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। তিনি বাংলা সাহিত্যের সাহিত্য সম্রাট নামে আজও প্রণম্য।
বঙ্কিমচন্দ্র ২৬ শে জুন 1838 সালের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তবে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের আদি নিবাস ছিলো হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। তাঁর পূর্বপুরুষ রামজীবন চট্টোপাধ্যায় কাঁঠালপাড়ার রুরুদেব ঘোষালের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। রামজীবনের পুত্র অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাথামহের সম্পত্তি লাভ করে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই তিনি বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র হলেন সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মায়ের নাম ছিলো দুর্গা সুন্দরী দেবী। তার অন্য দুই ভাইয়ের নাম শ্যামাচরণ এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ছিলেন তৎকালীন মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর এবং তারও সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ হয়েছিল বিখ্যাত ‘পালামৌ ভ্রমণ’ লিখে। এটিকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সফল ভ্রমণ কাহিনী হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। এই গ্রন্থটি সর্বপ্রথম বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রমথনাথ বসুর ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিলো।
জন্মের পর প্রথম বছর ছ’য়েখ তিনি কাঁঠালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে তার হাতেখড়ি হয়। কিছু বয়সেই তিনি অসামান্য মেধার পরিচয় দেন। তাঁর ছোট ভাই পূর্ণচন্দ্রের কথায় “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিল।” অবশ্য গ্রামের পাঠশালায় তিনি কোনদিনই যাননি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তার গৃহ শিক্ষক ছিলেন। তবে রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে তিনি যে বিশেষ উপকৃত হননি, সেটা তাঁর একটি লেখায় প্রকাশ করেছেন এই ভাবে “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হাত হইতে মুক্তি লাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।”
১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর তার কর্মস্থল মেদিনীপুর আসার পরই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এফ টিভের পরামর্শে যাদব চন্দ্র শিশু বঙ্কিমচন্দ্রকে তার স্কুলে ভর্তি করে দেন এবং সেখানেও তিনি অতি স্বল্প সময়ের মধ্যে নিজকৃতিত্বের প্রমাণ রাখেন। জানাযায় বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিভ সাহেব তাকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হন কিন্তু যাদব চন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি সেই কাজে বিরত থাকেন। ১৮৪৭ সালে টিভ সাহেব ঢ়াকায় বদলি হয়ে গেলে
সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় বছরের দেড়ে ক ইংরেজি শিক্ষার পার্ট নিয়ে ছিলেন। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র আবারও কাঁঠালপাড়ায় ফিরে আসেন এবং এই সময় তিনি শ্রীরাম ন্যায় বাগেশের কাছে বাংলা ও সংস্কৃতির পাঠ গ্রহণ করেন। ইনি খুব ভালো আবৃত্তিকারু ছিলেন।
এর কিছুদিন পর ১৮৪৯ সালেই তিনি হুগলি কলেজে (যা বর্তমানে হুগলি মহসীন কলেজ) ভর্তি হন। কলেজে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজে পড়ার সময় ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে বঙ্কিমচন্দ্র মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। সেই বৎসরই সংবাদ প্রভা করে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন তিনি। হুগলি কলেজে পড়াশোনার সময়ই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে
গদ্য পদ্ম রচনা শুরু করেন। পরবর্তীতে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজে থাকাকালীন ১৮৫৬ সালে তিনি সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেছিলেন। এই বছরই তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রবেশিকা পরীক্ষার সূচনা করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্টাস পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে ১৮৫৯ সালে প্রথমবারের মতো বি এ পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট ১০ জন ছাত্র প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র দু’জন বঙ্কিমচন্দ্র এবং যদুনাথ বসু।
এরপর তিনিও পিতৃপদাঙ্ক অনুসরণ করে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। কখনও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ডেপুটি কালেক্টর পদে। সারা জীবন তিনি নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন। ব্রিটিশ সরকার স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্যা মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। কিন্তু তিনি সফল সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং বাংলা তথা অবিভক্ত ভারতের নবজাগরণের মুখ হিসেবেই আজও ভাস্বর হয়ে আছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিবাহ হয় ১৮৪৯ সালের তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র এগারো বছর। নারায়ণপুর গ্রামের মোহিনী নামের এক পাঁচ বছরের বালিকার সাথে তার বিবাহ হয়েছিলো। কিন্তু চাকরি জীবনের শুরুতে যশোরে থাকাকালীন ১৮৫৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এবং তারপর তিনি ১৮৬০ সালের জুন মাসে হালিশহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীকে বিবাহ করেছিলেন। জানা যায় তার এই দ্বিতীয় স্ত্রী খুবই সুন্দরী ছিলেন।
জানা যায় একবার বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী রাজলক্ষী দেবীকে নিয়ে ট্রেনে সওয়ারী হয়ে
চাকরি সূত্রে ভ্রমণ করছিলেন। সেই সময়কার প্রথা অনুযায়ী রাজলক্ষী দেবী নিজের মুখ ঘোমটায় ঢ়েকে রেখেছিলেন। উল্টো দিকের আসনে বসা একটি উঠতি বয়সের ছেলে বেশ কিছুক্ষন যাবৎ রাজলক্ষী দেবীর দিকে বিশেষ দৃষ্টিপাত করে চলেছিলো। বঙ্কিমচন্দ্র বেশ কিছুক্ষণ ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পর হাসতে হাসতে সেই সহযাত্রীটির সাথে আলাপ জমালেন এবং এ কথা সে কথার পর সে কত টাকা মাসে রোজগার করে তা জানতে চাইলেন। এ উত্তরে সগর্বে বলেছিল মশাই আমার মাস মাহিনা বারো টাকা।”
তখন মৃদু হেসে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন “শোনো হে ছোকরা, আমি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মাস গেলে আমার রোজগার একশো পঁচিশ টাকা। এবং তার উপর লেখালেখি করে রয়্যালটি বাবদ আরো প্রায় শ’দরেক টাকা আমার রোজগার অর্থাৎ আমার মাসকাবাড়ি মোট রোজগার প্রায় তিনশত টাকা। আর আমি সেই সব টাকাই আমার শ্রীমতির পায়ে অর্পণ করি। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাঁর মনের নাগাল পাইনি। দেখো চেষ্টা করে তুমি পাও কিনা!”
এরকম রসিকতা শুনে সেদিন সেই ছেলেটি লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থেকে পরের স্টেশনেই নেমে গিয়েছিলো। এরকমই ছিল ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ প্রহসন রচয়িতার রসবোধ।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম জাতীয়তাবোধকে উজ্জীবিত করেন তাঁর ১৮৮২ সালে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় রচিত ত আনন্দমঠ উপন্যাসের মাধ্যমে। এই উপন্যাসের তার লেখা ‘বন্দেমাতরম’ বর্তমানে জাতীয় স্তোত্র হিসেবে বন্দিত। এরপর তিনি রচনা করেছিলেন দুর্গেশনন্দিনী যা ছিল প্রথম সার্থক বাংলা উপন্যাস। তিনি মোট
পনেরোটি উপন্যাস লিখেছিলেন এবং এর মধ্যে একটি ইংরেজি ভাষার উপন্যাস ও ছিলো। বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরেই বাংলা ভাষা সাহিত্যের অঙ্গনে সত্যিকারের মর্যাদা পেয়েছিলো। তাঁর উপন্যাস নতুন আর প্রেক্ষাপট হল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ। সেই সময়ের প্রথা ও সংস্কার বিরোধী আন্দোলন,হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থান, হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাবধারায় সংঘাত, প্রগতিশীল ভাবধারার অভাব ও সমাজতান্ত্রিক ভাব ধরার প্রাধান্য এসবই হোলো উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে আর্থসামাজিক পটভূমিকা। এবং সেই পট ভূমিকাই ছিলো বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস রচনার প্রেক্ষাপট। তাই তাঁর রচনা “বঙ্কিম শৈলী”অথবা
“বঙ্কিম রীতি”নামে পরিচিত।
তাঁর রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে আনন্দমঠ, দুর্গেশ নন্দিনী, কমলাকান্তের দপ্তর, কপালকুণ্ডলা, দেবী চৌধুরানী কৃষ্ণকান্তের উইল, ইন্দিরা, বিষবৃক্ষ, রাজসিংহ, চন্দ্রশেখর বিশেষ উল্লেখযোগ্য যা আজকের আধুনিক যুগেও সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। তাই তাঁর রচিত উপন্যাস গুলি আজও নতুন যুগের সাহিত্যের বিচারে স্বমহিমায় সাধারণ পাঠকের কাছে সমানভাবে সমিহ আদায় করে থাকে।
এইসব উপন্যাস গুলোর কোনটা সামাজিক প্রেক্ষাপটে আবার কোনোটা জাতীয় আন্দোলনের নিরিখে কিংবা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আবার প্রহসনের মাধ্যমে কোন জটিল সামাজিক সমস্যার অতি সরলীকরণ ও বটে। তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসের বিষয় সেই সময়ের উদ্ভূত পরিস্থিতির এক বাস্তব ধর্মী দলিল যা বর্তমান সমাজে এই কুড়ির শতকেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সেই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রকে সাহিত্য সম্রাট এবং ঋষি বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
“বন্দেমাতরম”রচনার নেপথ্য কাহিনী
সে প্রায় দেড়শবছর আগেকার কথা।পশ্চিমবঙ্গের
বহরমপুরের ব্যারাক স্কোয়ার মাঠে একটি বিরোধই বঙ্কিমচন্দ্রকে এই দেশপ্রেম মূলক গান”বন্দে মাতরম”রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলো।
সময়টা ছিল ১৮৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর বহরমপুর ক্যান্টনমেন্টের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল ডাফিনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যদের মধ্যে
সেদিন একটি ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেদিন গোধূলি বেলায় তৎকালীন মুর্শিদাবাদ জেলার ডেপুটি কালেক্টর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজস্ব পালকিতে বাড়ি ফিরছিলেন। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র জানতেন না যে পালকি বহনকারীরা সময় বাঁচানোর জন্য মাঠের মধ্য দিয়ে কোণাকুণি ভাবে যাবে যা সেদিনের সেই ক্রিকেট খেলার মাঝে ব্যাঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। খেলায় ব্যাঘাতের কারণে কর্নেল ডাফিন
বঙ্কিমচন্দ্রের পালকি থামিয়ে তাঁকে টেনে নামিয়ে চারপাঁচটি ঘুসি মারেন ও অভব্য ভাষায় অপমানও করেন। কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সামনেই এই ঘটনাটি ঘটে। যাদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্সিপাল রবার্ট হ্যান্ড, রেভারেন্ড বার্লো, বিচারক বেন ব্রিজ এবং লালগোলার তৎকালীন রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়, দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য এবং তাছাড়াও কয়েকজন ব্রিটিশ ও দেশীয় ব্যক্তিত্ব।
এই ঘটনার জেরে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ বঙ্কিমচন্দ্র ঠিক পরের দিনই আদালতে মামলা দায়ের করেন ১৬ই ডিসেম্বর ১৮৭৩ সালে কর্নেল ডাফিনের বিরুদ্ধে
জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিস্টার উইন্টারের আদালতে।
এই অপমান বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছিলো সেদিন। আদালতে সাক্ষীদের ডাকা হয় তবে বেশিরভাগ ব্রিটিশ কর্মকর্তাই ঘটনাটি অস্বীকার করেন। শুধু প্রিন্সিপাল রবার্ট হ্যান্ড, রাজাযোগীন্দ্র নারায়ণ রায় ও দুর্গাচরণ ভট্টাচার্য বঙ্কিমচন্দ্রের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। এরপর ১২ই জানুয়ারি ১৮৭৪ এ পরবর্তী শুনানির তারিখ পড়ে। সেদিন আদালতে কর্নেল ডাফিনকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করা হয়। সেদিন সকালে অগণিত ভারতীয় ও ইউরোপীয় দর্শক আদালতে ভিড় করেন। শুনানির সময় বিচারক বেনব্রিজ ম্যাজিস্ট্রেটকে নিজের চেম্বারে ডেকে নেন এবং বঙ্কিমচন্দ্রকে মামলা প্রত্যাহার করতে অনুরোধ করেন। প্রথমে তিনি রাজি হননি কিন্তু পরে শর্ত দেন যে কর্নেল ডাফিনকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে। শেষ পর্যন্ত কোর্টরুমে কর্নেল ডাফিন হাতজোড় করে ক্ষমা চান। এই দৃশ্য দেখে সেদিন উপস্থিত ভারতীয়রা হাততালি দেয়, হাসছো নাকি এবং “হো হো”স্লোগান দেয়।
আদালতে এই ঘটনার পর ব্রিটিশ কর্মকর্তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এমনকি গোপনে বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রাণে মেরে ফেলার পরিকল্পনাও করেন। এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্রের জীবন তখন চরম সংকটের মুখে। এই খবর জানতে পেরে লাল গোলার রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায় বঙ্কিমচন্দ্রকে লালগোলায় আমন্ত্রণ জানান।১৮৭৪ সালের জানুয়ারিতে বঙ্কিমচন্দ্র লালগোলায় চলে যান। সেখানে তিনি জগদ্ধাত্রী,দুর্গা ও কালীর মন্দির দর্শন করেন। সেই মন্দির প্রাঙ্গণে বসেই তিনি ভাবতে থাকেন কিভাবে একটি ‘মন্ত্র’ দিয়ে সমস্ত ভারতবাসীকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। ১৮৭৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি মাঘী পূর্ণিমার রাতে তিনি “বন্দে মাতরম” শব্দবন্ধ রচনা করেন। এই শব্দবন্ধ সঞ্জীবনী মন্ত্র হয়ে আপামর ভারতবাসীর মনে দেশপ্রেমের বহ্নিশিখা এবং ব্রিটিশদের শিহরণ জাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো।
লালগোলার রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়ের ওই তিন মাতৃ মন্দিরে প্রত্যহ সন্ধ্যায় মাতৃ আরাধনা বঙ্কিমচন্দ্রকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিকায় তার কালজয়ী উপন্যাস “আনন্দমঠ” রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিলো।১৮৮২ সালে “আনন্দমঠ” পূর্ণাঙ্গ বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়। এরই ফলস্বরূপ “আনন্দমঠ”প্রকাশের পর থেকেই ব্রিটিশরা বঙ্কিমচন্দ্রের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে যাদের উপন্যাসের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করেন। এই মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৮৮৫-৮৬ সালে তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। আজ এই একবিংশ শতকে দেড়শ বছর পরেও“বন্দেমাতরম”আমাদের দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে করে তোলে। এই ঘটনাই অপমানের প্রেক্ষাপটে ন্যায় বিচারের লড়াই ও স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং আন্তরিক আকাঙ্ক্ষা “বন্দেমাতরম” মন্ত্র রচনার মূল অনুপ্রেরণা। এই শাশ্বত মন্ত্র আজও আপামর ভারতবাসীর হৃদয়কে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
তাঁর এই জীবনে স্বাস্থ্য ততটা ভালো ছিলো না। বহুমূত্র রোগ বেড়ে যায় ১৮৯৪ এর মার্চ মাসে। এই রোগেই শেষে তাঁর মৃত্যু হয় ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ছাপ্পান্ন বছর। বাংলার রেনেসাঁর সিংহভাগ সময়ই বঙ্কিমচন্দ্রের উজ্জল উপস্থিতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন একজন বিশিষ্ট কবি,নাট্যকার এবং সংগীত স্রষ্টা। ডি এল রায় নামেও তিনি সমাধিক প্রসিদ্ধ। তিনি প্রায় পাঁচশ গান রচনা করেন। তাঁর রচিত গান বাংলা সংগীত জগতে দ্বীজেন্দ্র গীতি নামে আজও যথেষ্ট জনপ্রিয়। তাঁর রচিত বিখ্যাত গান “ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা” এবং “বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমারদেশ”সেকালের মতন এই একবিংশ শতাব্দীতেও সমান জনপ্রিয়। তিনি বহু নাটক ও রচনা করেন। চার শ্রেণীতে তার নাট্ক গুলো বিন্যস্ত। এই চার শ্রেণী গুলো হোলো
প্রহসন, কাব্য নাট্য, ইতিহাস ভিত্তিক নাটক ও তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট। তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলির মধ্যে আর্যগগাথা এবং
মন্দ্র যথেষ্টই জনপ্রিয় হয়েছিলো। তাঁর একঘরে,
কল্কি অবতার, বিরহ, সীতা, তারাবাঈ, দুর্গা দাস, রানা প্রতাপ সিংহ, মেবার পতন, নূরজাহান, শাজাহান, চন্দ্রগুপ্ত, সিংহল বিজয় ইত্যাদি, বিখ্যাত নাটক গুলির অন্যতম।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ১৮৬৩ সালের ১৯শে জুলাই
জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কার্তিকেয় চন্দ্র রায় এবং মাতা ছিলেন প্রসন্নময়ী দেবী। তাঁর পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবংশের দেওয়ান এবং নিজেও ছিলেন একজন বিশিষ্ট খেয়াল গায়ক ও সাহিত্যিক। তাই সে বাড়িতে বহু গুণীজনের আনাগোনা লেগেই থাকতো। এই বিরাগ্ধ পরিবেশ তাই বালক দ্বিজেন্দ্রলালের প্রতিভার বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়েছিলো। দ্বিজেন্দ্রলালের দুই দাদা রাজেন্দ্রলাল এবং হরেন্দ্রলাল ও এক বৌদি মোহিনী দেবীও ছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্য শ্রষ্টা। জন্ম সময়কালের নিরীখে তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক।
তিনি ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন এবং এফএ পাস করেন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে। এরপর তিনি হুগলি কলেজ থেকে বি এ এবং ১৮৮৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ (বর্তমানের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে এম এ পাস করেন। তিনি এরপর ছাপরার রেভেলগঞ্জ মুখার্জি সেমিনারিতে
শিক্ষকতা করার পর সরকারি বৃত্তি নিয়েই ইংল্যান্ডে যান কৃষি বিদ্যা শিক্ষা করার জন্য। তিনি রয়েল এগ্রিকালচারাল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল সোসাইটি থেকে কৃষিবিদ্যায় এফ আর এ এস এবং এম আর এসি ও এম আরএ স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৮৮৬ সালে ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়কালে প্রকাশিত হয় তাঁর একমাত্র ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ Lyrics of Ind. সেই বছরই দেশে ফিরে এসে তিনি সরকারি কাজে নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি তিন বছর বিদেশে থাকার পর প্রায়শ্চিত্ত করতে অসম্মত হ’লে তাঁকে নারায়ণ সামাজিক উৎপীড়ন সহ্য করতে হয় সংস্কারাচ্ছন্ন তৎকালীন হিন্দু সমাজ দ্বারা। ভারতবর্ষে ফিরে তিনি জরিপ ও কর মূল্যায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ও মধ্যপ্রদেশে সরকারি দপ্তরে যোগ দেন। তিনি পরে দিনাজপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিয়োগ পান। ১৮৮৭ সালে তিনি প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আন্দুলিয়া নিবাসী প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা সুরবালা দেবীকে বিবাহ করেন। ১৮৯০ সালে বর্ধমান এস্টেটের সুজামুতা পরগনায় সেটেলমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত অবস্থায় কৃষকদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে তাঁর সাথে অবিভক্ত বাংলার ইংরেজ গভর্নরের বিবাদ ঘটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি ১৯১৩ সালে
সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
দ্বিজেন্দ্রলালের দুই অগ্রজই ছিলেন লেখক ও পত্রিকা সম্পাদক। তাঁর গৃহে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখের আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। এইরকম পরিবেশে কৈশোর কালেই তিনি কবিতা আলোচনা শুরু করেন। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় পূর্ণিমা সম্মেলন নামে একটি সাহিত্য সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৩ সালে তিনি
ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। সেই অল্প বয়স থেকেই কাব্য রচনা প্রতি তাঁর ছিলো দুর্বার আকর্ষণ। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থ এবং নাটক
সাহিত্যে তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে। ভারতীয়দের পাঠান ও মুঘল সম্রাটদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার মর্মস্পর্শী লড়াইয়ের বর্ণনা বারে বারে তাঁর নাটক গুলিতে প্রকাশ পেয়েছে। সাথে সাথে হাস্যরসেও তিনি অসামান্য পাড়াঙ্গমতার ছাপ রেখে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথের থেকে মাত্র দু ‘বছরের ছোট ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। দুই ব্যক্তিত্বের জীবনেও ছিল আশ্চর্য মিল। দু’জনেই তাঁরা ছিলেন উচ্চ বংশের সন্তান। দু’জনেই সম্পন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পড়াশোনা করতে দু’জনেই বিলেত যান। দু’জনেই ছিলেন সুপুরুষ এবং সুকণ্ঠের অধিকারী। দু’জনেরই অকালে স্ত্রী বিয়োগ হয়েছিলো। তাঁর পুত্র দিলীপ কুমার রায়ের কথায়
দ্বিজেন্দ্রলাল বলতেন “বাঙালি আমাকে কিংবা রবি বাবুকে ভুলে যাবে না আর কেন যাবেনা জানিস? এইজন্যে যে আমরা রেখে যাবো বাঙালির প্রাণের জিনিস। সুরে বাঁধা গান।”
দিলীপ কুমার রায় প্রেসিডেন্সি কলেজে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী ছিলেন এবং পরবর্তীতে তিনিও নেতাজীর সাথে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষার জন্য। দিলী কুমার রায় সুভাষচন্দ্র বসুর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
প্রথমদিকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিলো। একে অন্যের গান গাইতেন। একসাথে অংশ নিতেন অনুষ্ঠানে বা সমাবেশে। হঠাৎই জমা হয় তিক্ততার কালো মেঘ। মধু সম্পর্ক হয়ে ওঠে অম্ল। রবীন্দ্রনাথ উদারতা দেখালো কখনো সহজ হ’তে পারেননি দ্বিজেন্দ্রলাল নিজে।
একবার দ্বিজেন্দ্রলাল সরকারি কাজে দিন কয়েকের জন্য পুরী গিয়েছিলেন। সেই খবর পৌঁছয় কটকে বাসরত সুভাষচন্দ্রের পিতা জানকীনাথ বসুর কাছে। তিনি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের খুবই নিকট বন্ধু। জানকীনাথ তখন কটকের নামকরা সরকারি আইনজীবী। দ্বিজেন্দ্রলাল এর খোঁজ পেয়ে তিনি পুরীতে খবর পাঠালেন যে কাজ শেষ করে দ্বিজেন্দ্রলাল যেন কটকে তাঁর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। সেইমতো কাজ শেষ হ’লে দ্বিজেন্দ্রলাল ছেলে দিলীপ কুমারকে সাথে নিয়ে জানকীনাথ বসুর আতিথ্য গ্রহণ করেন। কিন্তু কথায় কথায় তিনি জানতে পারেন যে ঠিক তার পরের দিন বন্ধু পুত্র বালক সুভাষ চন্দ্রের জন্মদিন। কি উপহার দেওয়া যায় এই ভাবতে ভাবতে সে রাতেই লিখে ফেললেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান “ধনধান্যে পুষ্পে ভরা”এই গানটি। পরের দিন ভোরে সুভাষচন্দ্রকে নিজের কাছে ডেকে ছেলে দিলীপ কুমারের সাথে আলাপ করালেন তিনি। তারপর বালক সুভাষচন্দ্রকে বললেন তোমার জন্মদিনে এই গানহোলো আমার উপহার। এই গানটি তিনি সকলকে গেয়েও শুনেয়েছিলেন সেদিন। এই না হলে উপহার যে গান শুনলে আপামর বাঙালি আজও আবিষ্ট হয়ে সুরের খেয়ায় ভেসে বেড়ায়।
সালটা হ’বে ১৮৮৬ কি ১৮ ৮৭ বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পেলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব। ১৮৯০ তে পোস্টিং পেলেন বর্ধমান রাজার অধীনে সুজমুঠা পরগনায় এবং হাতে পেলেন সেটেলমেন্টের দায়িত্বও। সেই চাকরি পাওয়ার বছর খানেক বাদেই ২৪ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কন্যা এগারো বছরের সুর বালা দেবীকে। তাঁর নিজের এমন এক গুরুতর সংসারী সময়ে দরিদ্র কৃষকদের খাজনা তিনি কমিয়ে দিলেন। ঝগড়া জয়ধ্বনি দিয়ে তার নাম দিয়ে ছিলো “দয়াল রায়”।
এদিকে এই ঘটনায় তার নামে ব্রিটিশ সরকারের কাছে অভিযোগ করেছিল বর্ধমানের মহারাজার এক বিশেষ কর্মচারী। তখন ছোট লাট বিষয়টি দেখতে সশরীরে চলে আসেন। তিনি দ্বিজেন্দ্রলাল কে সেদিন প্রশ্ন করেছিলেন “সরকারের অনুমতি না নিয়ে কেন আপনি এরকম কাজ করলেন?”
তখন ছোট লাটের এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিজেন্দ্রলাল তার মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন “আপনি কিছু জানেন না, যা হয়েছে আইন মেনে হয়েছে এবং আইনের বিষয়ে আপনার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।” তার এই কথায় সাংঘাতিক গন্ডগোল বেঁধে গেল এবং বিষয় গড়ালো আদালত পর্যন্ত।
সেযাত্রা তাঁর কোনরকমে চাকরি বাঁচলেও তারপর থেকে তাঁর পদোন্নতি আটকে গেছে এবং ঘটেছে বহুবার বদলি। এই ঘটনায় তিনি ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন “জেনে বুঝে নিজের পায়ে আঘাত করলেও সমস্ত বঙ্গদেশ জুড়ে একটা উপকার তো করা গিয়েছিল…।”
শিশু থেকে বালক বয়সের মধ্যে বিভিন্ন লাল রায় দু’বারন ঘোড়ো কর শারীরিক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন যাকে এক কথায় বলে ফাঁড়াকাটা।
জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে তিনি একবার ঢাক্তির কোল থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন। এরপরে তাঁর মুখ সামান্য বেঁকে গিয়েছিলো। আর বালক বয়সে ম্যালেরিয়া জ্বরে এমন অবস্থা হয়েছিলো যে ডাক্তার তাঁর জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। আর একবার ঢেঁকির উপর পড়ে গিয়ে তাঁর একটি হাত ভেঙে যায়। এছাড়া তাঁর সম্পূর্ণ ছাত্র জীবনে তিনি অনেকবার ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কৈশোর বয়সেই তিনি একশোটি গান রচনা করে ফেলেছিলেন। কৃষ্ণনগরে পড়াশোনা শুরু করে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে দশ টাকা বৃত্তিতে প্রবেশিকা পরীক্ষা ও হুগলি কলেজ থেকে বি এ পাস করেন তিনি। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। তিনি সেবার প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। কলেজের পাঠ সম্পূর্ণ করে ছাপরায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন তিনি। তারপর বাড়ির সকলের অমতে সরকারি অনুদানে তিনি চলে যান বিলেতে কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে।
তবে বিলেতে গেলেও দ্বিজেন্দ্রলাল ভুলে যাননি নিজের জাতিসত্তা। তাই তিনি লন্ডনে গিয়েও বাঙালি তথা ভারতীয় পোশাক পরেই লন্ডনের রাজপথে হেঁটেছেন। লন্ডন থেকে তিনি কৃষিবিদ্যায় তিনটি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ১৮৮৬ সালে লন্ডন ছিলো কালাপানি। সেই কালাপানি পার হয়ে দেশে ফেরার পরে তৎকালীন হিন্দু সমাজ তাকে যাতিচ্যুত করলে তিনি বিন্দুমাত্র পাত্তা দেননি। যদিও পরে “এক ঘরে”নামক একটি বইতে তিনি সেই সময়কার সামাজিক কুসংস্কারকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি যখন লন্ডনে তখন দেশে তাঁর বাবা ও মা দু’জনেরই মৃত্যু হয়েছিলো। তাই দেশে ফিরে দ্বিজেন্দ্রলাল প্রায় চলে গেলেন মধ্যপ্রদেশ সেখানে জরি প ও রাজস্ব নীতির ট্রেনিং নাম তিনি এবং সরকারি ডেপুটি চাকরিতে ও নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে দিনাজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন তিনি।
দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তিনি বহু প্রেমের কবিতা ও গান লিখেছেন। হাসির গান ও রচনা করেছেন তিনি। ১৯০৩ সালে তাঁর স্ত্রী সুরবালা দেবীর প্রসব অবস্থায় মৃত্যু হয়। ছেলে দিলীপ কুমার এবং মেয়ে মায়াকে নিয়ে বাকি জীবনটা সাহিত্যচর্চা করেই কাটিয়ে দেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। প্রিয়তমা পত্নীর মৃত্যুতে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এসেছিলো। ছেলে দিলীপ কুমার ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু। পরবর্তীতে দিলীপ কুমার সম্পূর্ণ সন্ন্যাস জীবন যাপন করতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে ভবশঙ্করের সাথে ১৯১৬ সালে তাঁর একমাত্র কন্যা মায়ার বিবাহ হয়।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ঐতিহাসিক স্বদেশী আন্দোলনে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক ও স্বদেশী গান আগুনে ঘি ঢ়ালার মতন কাজ করেছিলো। তিনি সাংস্কৃতিকভাবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কিছু ব্যঙ্গগান রচনা করেছিলেন। স্বার্থপর রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত দেশপ্রেমীদের উদ্দেশ্য করে তাঁর ব্যঙ্গ রসাত্মক গান “নন্দলাল” ও “আষাঢ়ে”। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় তিনি “বঙ্গ আমার জননী আমার” গানটি রচনা করেছিলেন। ১৯০৭ সালে দুর্গাপুজোর এক অষ্টমীর দিনে এই গানটি সুর দিয়ে গাওয়ার সময় আবেগের তাড়নায় তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। প্রেমের, নাটকের, হাসির এবং স্বদেশী গান মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো গান লিখেছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্য প্রভা “পূর্ণিমা মিলন”। “ভারত বর্ষ” পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা, প্রথম তাঁরই মাথায় আসে। যদিও নিজে সেই পত্রিকার প্রথম প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি তিনি। রবীন্দ্র যুগেও বাংলা গানে ভিন্ন ধারা ও আধুনিক গান রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হ’লেন একজন সার্থক রূপকার। নাটক রচনা ও পরিচালনায় তাঁর অসামান্য অবদান থাকলেও তিনি সংগীতকার হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। প্রথমদিকে তাঁর গান “ দ্বিজুবাবুর গান”নামে পরিচিতি পেলেও পরবর্তীতে তা “দ্বিজেন্দ্রগীতি” নামে জনপ্রিয় হয়।
১৯১৩ সালের ১৭ই মে তারিখে কলকাতায় মাত্র উনপন্চাশ বছর বয়সে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবনাবসান ঘটে। নবজাগরণ যুগের এই মনীষীও
আজ ধূসর অতীতের বিস্তৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছেন আজকের প্রজন্মের কাছে। তিনি এক অতীত স্মৃতি হয়েই আছেন বর্তমান প্রজন্মের কাছে।
একান্ন সতী পীঠের অন্যতম কলকাতার মহাতীর্থ কালীঘাটের মা কালীর মন্দির থেকে কিছু দূরে দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার পূর্ব তীরে রানী রাসমণি স্থাপিত মা ভবতারিণীর মন্দির হিন্দু নবরত্ন মন্দিরের অন্যতম। এই মন্দিরটি ১৮৫৫ সালের ৩১ শে মে জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার দিন সেকালের জানবাজারের জমিদার বাবু রাজ চন্দ্র দাসের অর্ধাঙ্গিনী রানী রাসমণি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলার নবজাগরণের সময় কালে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে সেকালের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে দিকপালরা পরবর্তীতে একত্র করেছিলেন। এই মন্দির প্রাঙ্গণকে তাদের মিলন ক্ষেত্র হিসেবেও আখ্যায়িত করা যেতে পারে। তাদের পুরোধা ছিলেন পরম পুরুষ ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ এবং কেশব চন্দ্র সেন যিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রধান সংগঠক এবং বাংলার নবজাগরণ আন্দোলনের বিশিষ্ট সব মুখ।পরে তিনি যুগ পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের অনুসারী হয়ে হিন্দু ধর্মে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। এইসব বিশিষ্টজনদের মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিলো এই রানী রাসমণি প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর মন্দির চত্বর। প্রথমে এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত ছিলেন পন্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় যখন রানী রাসমণি স্বপ্ন আদিষ্ট হয়ে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। তখন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ছোট ভাই গদাধর চট্টোপাধ্যায় (যিনি পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ পরমহংস নামে খ্যাত হন) ছিলেন এই মন্দিরে পূজার্চনায় তাঁর সহযোগী। রামকুমারের দেহত্যাগের পর ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ প্রধান পুরোহিতের কাজে নিয়োজিত হন এবং এই দক্ষিণেশ্বরের মন্দির ছিল তাঁর সাধন স্থল। এই দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গন নবজাগরণ আন্দোলনের মহাত্ম্যপূর্ণ বহু ঘটনার
এক নীরব সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে।
রানী রাসমণি ১৭৯৩ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বর নদিয়া জেলার হালিশহরের কাছে কোনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কলকাতার জানবাজারের বাসিন্দা এবং বিখ্যাত মানব দরদী জমিদার বাবু রাজ চন্দ্র দাসের অর্ধাঙ্গিনী। রানী রাসমণি, নিজেও সমাজ সংস্কারক এবং
মানব দরদী জমিদার ছিলেন। রানী রাসমণি তাঁর বহুজন হিতৈষী কাজের জন্য সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত একটি সড়ক পথ নির্মাণ করেছিলেন। তিনি কলকাতার অধিবাসীদের গঙ্গাস্নানের সুবিধার জন্য কলকাতার বিখ্যাত বাবুঘাট, আহিড়ী টোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট নির্মাণ করেন। সেই সব নিদর্শন আজও স্বমহিমায় তাঁর কথা স্মরণ করায়। এমনকি ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরী ( যা বর্তমানে ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) ও হিন্দু কলেজ (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি প্রভূত অর্থ সাহায্য করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিলো হরে কৃষ্ণ দাস ও মাতা ছিলেন রামপ্রিয়া। তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারান। মাত্র এগারো বছর বয়সে কলকাতার জান বাজারের ধনী মাহিষ্য জমিদার বাবু রাজ চন্দ্র দাসের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। তিনি অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। নবজাগরণ কালে সতীদাহ প্রথা বিলোপ এবং অন্যান্য সমাজ সংস্কার আন্দোলনে বাবু রাজ চন্দ্র দাসের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শে বিশ্বাসী এবং ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের একজন। অবশ্য সেকালে এলিট সমাজের বহু বাঙ্গালীই ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
১৮৩৬ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সহস্তে তাঁর জমিদারির কর্তব্য ও দায়িত্ব তুলে নেন এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। পুঁথিগত বিদ্যা তাঁর ছিলো না। এই জমিদারি পরিচালনা এবং দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠুভাবে সব দায়িত্ব সমাধা করতে তার প্রধান সহযোগী ছিলেন তাঁর সেজো মেয়ের জামাই মথুরামোহন বিশ্বাস। তবে ব্যক্তিগত জীবনে রানী রাসমণি এক সাধারণ ধার্মিক বাঙালি হিন্দু বিধবার মতনই সরল জীবন যাপন করতেন।
একবার ইংরেজ সরকার গঙ্গায় জেলাদের মাছ ধরার উপর জলকর আরোপ করে। নিরুপায় হয়ে জেলেরা রানী রাসমনির শরণাপন্ন হ’লে তিনি ইংরেজ সরকারকে দশ হাজার টাকা কর দিয়ে ঘুসুড়ি থেকে মেটিয়াবুরুজ এলাকার সমস্ত গঙ্গা নদী নিজের অধিকারে নিয়ে নেন এবং লোহার শিকল টানিয়ে সমস্ত জাহাজ ও নৌকা চলাচল বন্ধ করে দেন। আর এতে ইংরেজ সরকার আপত্তি জানালে রানী রাসমণি বলেন যে জাহাজ চলাচল করলে মাছ অন্য জায়গায় চলে যাবে। ফলে জেলেদের ক্ষতি হবে এবং এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইংরেজ সরকার রানী রাসমনির
দশ হাজার টাকা ফেরত দেয় ও জল কর তুলে নেয়।
আর একবার এক নীলকর সাহেব মকিমপুর পরগনায় প্রজাদের উপর উৎপীড়ন শুরু করলে রানী রাসমণি তা বন্ধ করে দেন। তিনি এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে ষ্টোনার খাল খনন করেন এবং এতে মধুমতি নদীর সঙ্গে নবগঙ্গার সংযোগ ঘটে।
সোনাই, বেলেঘাটা ও ভবানীপুরে তিনি বাজার স্থাপন করেন।
ধর্মচর্চার জন্য দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির
তিনিই নির্মাণ করেন এবং এই ঘটনার প্রেক্ষাপট
হল এই যে ১৮৪৭ সালে রানী রাসমণি ঠিক করেন তিনি কাশীতে গিয়ে মা অন্নপূর্ণা ও বিশ্বনাথের পুজো দেবেন। আর সেই কারণে চব্বিশটি নৌকা,দাস-দাসী, রসদ আর্যজন সবকিছুই তৈরি ছিলো। কিন্তু যার তার ঠিক আগের দিন রাতের শেষ প্রহরে জগজ্জননী মা ভবতারিণী রানী রাসমণিকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বল্লেন “রানী কাশী যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। তুই এই গঙ্গা নদীর তীরে আমার মন্দির তৈরি করে পুজো কর আমি এখানেই পূজো গ্রহণ করব।” সেই কারণেই রানী রাসমণি দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গার পূর্ব তীরে ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মা ভবতারিণীর মন্দির। সেই দিনটা ছিল বৃহস্পতিবার জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার পূণ্য তিথি। রানী রাসমণি সেই সময় এক লক্ষেরও বেশি টাকা খরচ করে রুপোর রথ নির্মাণ করে তাঁর গৃহদেবতা রঘুবীরকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় শোভাযাত্রা বের করেছিলেন। রানী রাসমণি প্রচলিত সেই রথযাত্রা আজও রথের দিনে দক্ষিণেশ্বরে মহাসমরে পালিত হয়। রথে আরোহন করা জগন্নাথ দেব পুরো দক্ষিণেশ্বর প্রদক্ষিণ করেন।
রানী রাসমনির জানবাজারের বাড়ির দুর্গাপুজোও কলকাতার বিখ্যাত পুজোর মর্যাদা পেয়েছে। মহালয়ার পর থেকেই পুজোর তোরজোড় শুরু হয়ে যায় এখানে। ষষ্ঠীর দিন দেবীর গায়ে গয়না অলংকার পরিয়ে দেবীর বরণ হয়। আর ওই দিনেই কলাবৌ স্নানকে ঘিরে ব্রিটিশ সাহেবের সাথে রানী রাসমনির কলহ বেঁধেছিলো। রানীর প্রধান পুরোহিত সেই ষষ্ঠীর ভোরে এসে রানীকে জানান যে কলাবৌ প্রানের সময় ঢাকঢোল এর শব্দে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় মামলা ঠুকেছেন এক ব্রিটিশ সাহেব। পরেরদিন আরও লোক লস্কর
এবং বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে রানী গঙ্গাস্নানে মহিলাদের পাঠান। আর তাতে আরও ক্ষুব্ধ হন সেই ইংরেজ সাহেব। ফলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানাও হয় রানীর। এরই প্রতিশোধ নিতে বাবুরোডের দু’পাশে বাঁশের খুঁটি পুঁতে গাড়ি ঘোড়া যাওয়ার পথ আটকে দেন রানী রাসমণি। তবে অবশেষে রানীর সাথে আপোষে মীমাংসা করে নেন সেই ইংরেজ সাহেব।
এরকমই একরোখা ছিলেন রানী রাসমণি। তিনি মেয়েদের স্বনির্ভরতা, নারী শিক্ষার প্রসারে অনেক সামাজিক প্রকল্পেরও সূচনা করেছিলেন। এমনকি পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও তিনি হামেশাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। এবং সমাজে মহিলাদের উন্নয়নের জন্য তাঁর পরামর্শ নিতেন এই মহীয়সী রানী রাসমণি।
কালীঘাটের বাড়িতে ১৮৬১সালের ১৯ শে ফেব্রুয়ারি রানী রাসমণি ৬৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ কেওড়াতলা মহাশ্মশানে চন্দন কাঠে দাহ করা হয়। রানী মা সাধারণ মানুষের প্রতি দয়া মায়া থাকার জন্য “লোকমাতা”সম্মান লাভ করেন। রানী রাসমনির মৃত্যুর পর তাঁর জন্ম শতবার্ষিকীতে ভারত সরকার তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে তাঁর স্মরণে ডাকটিকিট প্রকাশ করে। কলকাতার কার্জন পার্কে রানী রাসমনির জন্মের দু’শো বছর পূর্তিতে তাঁর একটি মর্মর মূর্তি স্থাপিত হয়। তার একটি মূর্তি এবং স্মৃতিসৌধ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের ভেতরেও রয়েছে।
নারী স্বনির্ভরতা এবং শিক্ষার প্রসারে রানী রাসমনির অবদানকে মনে রেখে আজও শ্রদ্ধায় আমাদের মাথা নত হয়ে আসে। কিন্তু প্রশ্ন হোলো আমরা কি তাঁর মতো স্বভাবজাত আদর্শ প্রতিষ্ঠার এক নিরলশ প্রতিবাদী চরিত্রকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে কি বর্তমান প্রজন্ম? ক’জনই বা তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে বর্তমান সমাজ সংস্কারের প্রেক্ষাপটে। মহা কালের ধারায় তাঁর গৌরব গাঁথা ও আজীবন|