উনবিংশ শতকে বাংলা যখন রেনেসাঁ জোয়ারে উত্তাল ঠিক সেই যুগসন্ধিক্ষণে স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাব এক নতুন পথের দিশারী হয়ে। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের আগে ঊনবিংশ শতকের প্রথম পর্বে সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা রদ করে আইনে রূপায়িত করেছিলেন। আর পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কি শিক্ষা ও বিধবা বিবাহ প্রথার প্রচলন করে বঙ্গসমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তাঁদের সাথে সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যোগ্য সঙ্গত গিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যাঁদের সুযোগ্য
উত্তরসূরি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও আরও বহু রথী মহারথীরা। আর ধর্মের আঙ্গিনায় সংস্কারের পুরোধা ছিলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। যিনি ধর্মের পথে থেকে সমাজ সংস্কারের ও পথিকৃৎ ছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেব ছিলেন স্বামীজীর জীবনের ধ্রুবতারা এবং তার চলার পথের প্রধান চালিকাশক্তি। রেনেসাঁর অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব। দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির ছিল রেনেসাঁর অন্যতম রঙ্গমঞ্চ। এই রঙ্গমঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন রানী রাসমণি দেবী। রানী রাসমণি ছিলেন
নারী শিক্ষা এবং আত্মনির্ভর নারীবাদ প্রতিষ্ঠার অন্যতম পথিকৃৎ এক অনন্যা মহীয়সী রমণী।
কেশব চন্দ্র সেন, গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে ছিলেন না শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্ষিত সেই সংস্কারের
পথের পথিক। এদেরই পূর্বসূরী ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। যিনি একক প্রচেষ্টায় রেনেসাঁ যুগের সূচনায় সমাজের সবচাইতে নির্মম “সতীদাহ” প্রথা যে কোথায় জীবিত পত্নীকে মৃত স্বামীর সাথে সমাজের গণ্যমান্যদের
উপস্থিতিতে উৎসবের আবহে সাজানো চিতার আগুনে সহমরনে যেতে বাধ্য করা হোতো। এই রেনেসাঁর প্রভাব বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ অর্থাৎ প্রাক স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত লক্ষ্য করা যায়।
যে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, সংগীত ও সংস্কৃতির নানান আঙ্গিকে রথী মহারথীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি চোখে পড়ে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন
কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়,বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এবং নাট্যমঞ্চে অহীন্দ্র চৌধুরী, নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ী, সংগীতের পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে এবং চিকিৎসা ক্ষেত্রে রাধাগোবিন্দ কর (যিনি বর্তমান আরজি কর হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা), ডাক্তার নীলরতন সরকার প্রমুখ। সেই রেনেসাঁর জোয়ার ই প্লাবিত করেছিল বিপ্লবীদের হাত ধরে দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার শৃংখল মোচনে। ক্ষুদিরাম বসু,মাস্টারদা সূর্যসেন, রাসবিহারী বসু, বাঘাযতীন,বিনয়, বাদল,দীনেশ, ঋষি অরবিন্দ
ঘোষ, বারীন ঘোষ, উল্লাস কর দত্তদের হাত ধরে সেই সময় স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো।
আছি আন্দোলন পরিপূর্ণতা পেয়েছিল বিদেশের মাটিতে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ্
ফৌজ গঠন করে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রাথমিক অনুপ্রেরণাও ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
রেনেসাঁ যুগে সবাইকে ছাপিয়ে আজও ভাস্বর হয়ে আছেন বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। যিনি শুধুই হিন্দুধর্মের উজার করেননি তিনি একাধারে ছিলেন বিশ্ব মানবতা, নারী স্বাধীনতা, নারী শিক্ষা, জাতীয় চরিত্র গঠন এবং হিন্দুত্ববাদের পুরোধা।
তাঁর মূল মন্ত্রই ছিলো “নিজের ভেতর থেকে জাগ্রত হও। অন্য কেউ তোমাকে শিক্ষা দিতে পারবেনা।”এবং “শক্তি হোলো জীবন, দুর্বলতা হোলো মৃত্যু। সম্প্রসারণ হোলো জীবন ঘৃণা হোলো মৃত্যু।”তাই তো তিনি আজীবন শিবজ্ঞানে জীব সেবা করে গেছেন।। যিনি বলে গেছেন “রিপোর্ট দেখে পিছুপা হ’বে না বিপদকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মোকাবিলা করতে হ’বে। পালিয়ে গেলিই বিপদ তোমার পিছু নেবে।”স্বামীজি স্বপ্ন ছিল স্বনির্ভর ভারত। স্বনির্ভর ভারত গড়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো চরিত্র গঠন। কারণ চারিত্রিক দৃঢ়তাই হল সমৃদ্ধির মূল মন্ত্র।
সেই পুরা কাল থেকে ভারতবর্ষের সবচাইতে চিত্তাকর্ষক বিষয় হোলো সমৃদ্ধ পরম্পরা এবং অনন্য সংস্কৃতি যার সার অর্থই হোলো বিবিধের মাঝে মিলনের বার্তা। এই দিদিদের মাঝে মিলনের মাধ্যম হোলো বর্ণময় উৎসব। ভারতবর্ষ হোলো ব্যতিক্রমী একতিকরণের এক অনন্য উদাহরণ।
তাইতো কবিগুরু তাঁর ভারত তীর্থ কবিতায় উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন
“হে মোর চিত্ত পূণ্য তীর্থে
জাগো রে ধীরে -
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।”
তারপর তিনিই শুনিয়েছেন
“কেহ নাহি জানে কার আহবানে
কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য
হেথায় দ্রাবিড়,চীন
শক হূনদল পাঠান মোগল
একদেহে হল লীন।”
আবার অতুলপ্রসাদ সেনের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে
কালজয়ী গান
“নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান
দেখিয়া ভারতের মহা জাতির উত্থান
জগজন মানিবে বিস্ময়
জগজন মানিবে বিস্ময়।”
আতুল প্রসাদ সেনের এই কালজয়ী গানটির মূল বোধকে অনুসরণ করে প্রতিটি ভারতীয় অতীতেও গর্ববোধ করে এসেছে, বর্তমানেও করে চলেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।
তাইতো যখনই বৈচিত্রময় ভারতের আকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে আমরা ভারতীয়রা
“হাতে হাত রেখে মিলি একসাথে
আমরা আনিব নতুন ভোর”
এই সংকল্পে ব্রতী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণায়
উজ্জীবিত হয়ে উঠি।
সেই অতুলপ্রসাদ সেনই লিখেছিলেন
“বল বল বল সবে শত বীনা বেনু রবে
ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
ধর্মে মহান হ’বে কর্মে মহান হ’বে
নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতন এ পূরবে।”
অতুলপ্রসাদ সেনের এই স্বপ্ন স্বামীজিই প্রথম সাকার করেছিলেন শিকাগো ধর্ম মহাসভায় শ্রেষ্ঠ বর্জন করে। ভারতবর্ষের এই বহু ভাষা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং নানা ধর্মের সমন্বয় ভারত বর্ষকে এক সার্থক সামাজিক সংস্কৃতিতে উন্নীত করেছে সেই সুপ্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে। আর ঠিক এই কারণেই ভারতবর্ষকে ভিনদেশী সাম্রাজ্যবাদীরা
“সোনে কি চিড়িয়া” বলেও অভিহিত করেছে।
“বিবিধের মাঝে মিলন”সারা বিশ্বের শান্তি এবং একতার বাণী পরম্পরা গত ভাবে সগর্বে প্রচার করে চলেছে। যার মুলে আছে শাশ্বত এবং তুলনাহীন বেদ, উপনিষদ, পুরাণ এবং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের জ্ঞানের আলোর মার্গ দর্শন। প্রাচীন ভারতবর্ষের এই শাশ্বত পরম্পরা এবং আদর্শ ও নৈতিকতার প্রতিনিধি হয়েই স্বামী বিবেকানন্দ এক স্বনির্ভর এবং প্রগতিশীল ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন একটা জাতি কখনোই উন্নতি করতে পারে না যদি না সেই দেশের আপামর দেশবাসীর যথাযথ চরিত্র গঠন হয়। আর সেই চরিত্র গঠন তখনই সম্ভব হ’বে যখন সেই জাতি শারীরিকভাবে শক্তিশালী হ’বে। শারীরিক শক্তি অর্জন না হ’লে মানসিক ভাবে সৎ হওয়া একান্তই অসম্ভব। তাই স্বামীজি, শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের জন্য ব্যায়াম, ফুটবল খেলা, কাবাডি ও কুস্তির উপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ঠিক এই কারণে তাঁর জীবনের প্রথম কলকাতা মেট্রোপলিটন স্কুলের “হেড মাস্টার” এর চাকরি থেকে তাঁকেই শাস্তি স্বরূপ বরখাস্ত হ’তে হয়েছিলো।
হয়তো এই ঘটনা না ঘটলে নরেন্দ্র দত্ত থেকে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠতে পারতেন না। বিধাতা পুরুষ সবই পূর্ব নির্ধারণ করে রাখেন বৈকি। স্বামীজীর শাশ্বত বাণী “ওঠো জাগো লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না।”এক অমোঘ বার্তা বহন করে সমাজে আজও এবং এক অবিসম্বাদী প্রভাব বিস্তার করে দেশবাসীর মননে চিন্তনে। স্বামীজীর মানবজাতির উদ্দেশ্যে এই আহ্বান সময়ের সীমানা পেরিয়ে অসীমের পথ ধরে আপামর দেশবাসীর আধ্যাত্মিক শক্তি, আত্মপোলব্ধি এবং ধীশক্তিকে পরিবর্তনশীল সময়ের সাথে সাথে ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উজ্জীবিত করে। স্বামীজীর এই অমক মন্ত্রই হোলো তাঁর শিক্ষা যা আজও মান্নান হিসেবে স্বীকৃত বর্তমান বিশ্ব মানবতার কাছে। জীবন্ত সমস্ত বিশ্বকে ভারতের মাহাত্ম, ঔদার্য এবং প্রগতিশীলতাকে বোঝার অনুপ্রেরণা যোগায়।
স্বামীজী ছিলেন একজন আপাদমস্তক কর্মযোগী। তিনিই দার্শনিক এবং উপদেষ্টা হয়ে পথনির্দেশ দিয়ে সমাজে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তাই তাঁকে যুব পুরুষ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তাঁর ভাবাদর্শ আজকের এই একবিংশ শতাব্দীতেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
জীবৎকালে স্বামীজী ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি এবং দেহত্যাগের পরে তিনি আজও বর্তমান প্রজন্মের কাছে এক অনুপ্রেরণার উৎস।
স্বামীজী জাতীয়তাবাদের পবিত্র প্রদীপ প্রজ্বলিত করেছিলেন এবং পাশ্চাত্যের কাছে ভারত বর্ষকে ১৮৯৩ সালে ১১ই থেকে ২৭শে সেপ্টেম্বর চিকাগোর “ধর্ম মহাসভায় উপস্থাপন করেছিলেন এবং সারা বিশ্ব সেদিন মোহিত হয়েছিল প্রাচ্যের এই সন্ন্যাসীর জ্ঞানগর্ভ ধার্মিক বিশ্লেষণ ও সুদীর্ঘ ভাষণে। সেদিন শ্রোতারা এতটাই মোহিত হয়েছিলো যে স্বামীজীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর দশ মিনিট ধরে সঢ়ভা ঘরে করতালির ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব এবং শাশ্বত দর্শনের বার্তা সেদিন সমুদ্র, নদী, পাহাড়, উপত্যকা ও সমতল ভূমি অতিক্রম করে মানুষের মনে এক অনেক অনেক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। তাদের কাছে বৈচিত্রময় ভারতবর্ষ এবং প্রাচীন আধ্যাত্মিকতাবাদের উত্তরাধিকারের বন্ধ দুয়ার খুলে গিয়েছিলো।
সেই সময় যখন ভারত বর্ষ বৃটিশের কাছে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ তখন ভারতের মানুষ ব্রিটিশের অসহনীয় অত্যাচার এবং দারিদ্র্যের জ্বালায় জর্জরিত, স্বামীজীই প্রথম মানুষ যিনি ত্রাতা হয়ে স্বনির্ভর ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং আত্মবিশ্বাস হারানো ভারতবাসীকে আত্মনির্ভরতার পথে এগিয়ে যাওয়ার দিশায় উজ্জীবিত করেছিলেন। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন এই ভারতই একদিন সারা বিশ্বে অগ্রণীর ভূমিকা নেবে। তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলেছিলেন “আজ এই ঊনবিংশ শতক অবশ্যই তোমাদের কিন্তু আগামী একবিংশ শতক হবে ভারতবর্ষের শতক।”স্বামীজীর এই বার্তা ভারতকে গভীর ঘুম ভাঙ্গিয়ে জাগিয়ে তুলেছে জাগিয়ে তুলেছে ভারতের যৌবনকে। আজ সেই ভারতই কয়েক যোজন এগিয়ে গিয়েছে প্রগতিশীলতার পথে অবশ্যই ধর্মের পথে থেকে। এটাই আজকের জাতীয় রেনেসাঁ। আজকের ভারত অগ্রগতির ভারত। আজকের ভারত যৌবনের জয় গান গেয়ে স্বমহিমায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার অর্জন করেছে। এটা খাদ্যাভ্যাস থেকে আর্থিক উন্নয়ন যাই হোক না কেন। ভারতবর্ষে এখন মূল্যায়নে, সচেতনতায়, কর্মক্ষেত্রে, নীতি নির্ধারণে এবং দীর্ঘমেয়াদী ইতিবাচক পরিবর্তনের পথে দ্রুত লয়ে এগিয়ে চলেছে। বর্তমান বিশ্বে ভারত বর্ষ এখন নীতি নির্ধারণ ও জাতীয় সম্পদের সূচকের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারিত্ব অর্জন করেছে। আর এসবই ভারতবর্ষকে সার্বিক বিকাশের পথে উল্কার গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দেশবাসীর কাছে এসবই আজ পরিবর্তন এবং বিকাশের ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করেছে যা স্বামীজীর ভবিষ্যৎ বাণীকে সত্য প্রতিপন্ন করেছে।
স্বামীজীর দূরদৃষ্টি অথবা স্বপ্নের মূল মন্ত্রই ছিলো আত্মনির্ভর ভারত। আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভারত মাথা উঁচু করে স্বনির্ভরতার কথা বলে। আর আজকের ভারতের এই আত্মনির্ভরতা সমস্ত বিশ্বকে সাথে নিয়েই প্রগতির পথে এগিয়ে চলার পাথেয়। যা বিশ্বায়নের বাণী বহন করে সমস্ত বিশ্ববাসীর আস্থা, সহযোগিতা, সুস্বাস্থ্য এবং রূপায়ণে বহু বৈচিত্রের দাবি করে। কিন্তু সব কিছুরই মূল লক্ষ্য একটাই ভারতবাসীকে আত্মনির্ভরতায় ভর করে বিকাশের পথে প্রগতির দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আর এই স্বনির্ভর তার পথের পাথেয় হোলো ভারতবর্ষের গরুবান্বিত অতীত এবং পরম্পরা, যার উৎস ও প্রেরনা হোলো বেদ, উপনিষদ, পুরাণ এবং কালজয়ী মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের জ্ঞানের বিস্তৃতি।
যার বিস্তৃতি আকাশের মতোই সীমাহীন এবং সাগরের মতোই গভীর।
ঠিক সেই কারণেই বর্তমান স্বনির্ভর ভারতকে গৌরবান্বিত অতীতের ঋণ স্বীকার করে পূর্ব যাদের কাছে মাথা নোয়াতে হ’বে। তা হ’লেই বিশ্বের অন্য জাতির কাছে আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভারতবর্ষ তার শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার দাবি করতে সক্ষম হ’বে। তাইতো স্বামীজী বলেছেন
“নব্যভারত পাশ্চাত্য সভ্যতাকে সাদরে গ্রহণ করেছে এবং আমরা পাশ্চাত্যের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক এবং আচার ব্যবহার অনুকরণ করে মনে করি এই পথেই আমাদের পাশ্চাত্যের মতো বিরহ এবং শক্তিশালী হব সেটাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড়ো ভুল। কারণ আমাদের প্রাচীন ভারতের শিক্ষার সার কথাই হোলো সীমারেখা যার মূলমন্ত্রই হোলো “অপরের সংস্কৃতি কখনো নিজের হ’তে পারে না যতক্ষণ না নিজে তা নিজের মতো করে অর্জন করে এবং উপলব্ধি করে।”
মোদ্দা কথা হোলো পাশ্চাত্যের ভবধারার অন্ধ অনুকরণ না করে ওদের ভালো গুণ এবং দর্শন ও ভাবনাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করলে তবেই আমাদের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হ’বে। এরপর স্বামীজীর স্বপ্ন ছিলো ভারতবাসীকে শিক্ষিত করে তোলা কারণ শিক্ষার পথই হলো একটা জাতিকে গড়ে তোলার পথের দিক নির্দেশ। যে শিক্ষা শুধুমাত্র চাকরি করে জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন হ’বে না পড়ন্ত যে শিক্ষার মূল মন্ত্র হ’বে জীবনসংগ্রামে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। এই শিক্ষা দেশবাসীকে চরিত্র গঠন ও মানসিক শক্তির বিকাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই মেধা প্রসারিত হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মনির্ভরতার অনুপ্রেরণা যোগাবে।
আমি যে স্বপ্নের ভারত হোলো হিন্দুত্ব হবে সমস্ত জাতি, বিশ্বাস, বর্ণ ও ধর্মের উর্ধ্বে। স্বামীজী উপলব্ধি করেছিলেন ভারতের সুপ্ত অসীম সম্ভাবনাকে। যার ভিত্তিই হোলো নিজস্ব মূল্যবোধ এবং পরম্পরা। আধ্যাত্মবোধ মানুষকে শিক্ষা দেয় যে ভগবান প্রত্যেক জীবের মধ্যেই বাস করেন।তাই কোন জীবকেই আঘাত করা উচিত নয়। সশ্রদ্ধ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সাধারণত্বের মাঝে একতার পথেই এগিয়ে চলেছে শতাব্দীর পথ ধরে আর সেই পথে কোনো নিপীড়ন অথবা নির্যাতনের লেশমাত্র নেই। ভারতকে বিশ্ব বিজয় করার জন্য মহান ভারত দর্শন, অহিংসা এবং কর্মের পথে এগিয়ে যেতে হ’বে। স্বামীজী তাই আধুনিক ভারতের এক মহান প্রতিষ্ঠাতা হয়ে জাতীয় আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
স্বামীজীর স্বপ্ন ছিলো দেশীয় যুবাদের সক্ষম করে গড়ে তোলা। কারণ যুবকরাই তাদের বৈপ্লবিক চিন্তাধারা, তাদের শক্তি, তাদের ক্রিয়াকলাপ এবং মানুষের অধিকারের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ক্ষমতা থাকে যা তাদের পথে আসা সমস্ত বাঁধা বিপত্তি এবং কুক্ষিগত শক্তিকে জয় করতে উজ্জীবিত করে ও পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগায়। তাই যুবকরাই হোলো তৃণমূল স্তরে যোগাযোগের সবচাইতে আদর্শ মাধ্যম। তারা সহজেই সাধারণ মানুষকে সজাগ করতে পারে আর এটাই হোলো ব্যক্তি উন্নয়নের মূল কথা। স্বামীজী কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করতেন এই উন্নয়ন তখনই সম্ভব যখন আমাদের দেশের যৌবনের আদর্শ হ’বে নির্ভীক, দয়ালু, হিতৈষী এবং চারিত্রিক দৃঢ়তা। স্বামীজী চেয়েছিলেন দেশের যুবকরা হ’বে লৌহ কঠিন পেশী ও স্নায়ুর অধিকারী যা তাদের সুদৃঢ ় মানসিক বিকাশ ঘটাবে। স্বামীজীর স্বপ্ন ছিলো ভারতবর্ষ তার আধ্যাত্মবাদ দিয়ে বিজ্ঞান, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলির দিগন্ত বিস্তৃত করে গড়ে তুলবে। রামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে তাঁর স্তব্ধ গ্রহণ বিরলের থেকে বিরল একটি বিষয় যখন উনিশ শতকের শেষে শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বয়ং স্বামীজীর সাধন পথের দিশারী। এই পথনির্দেশ স্বামীজীকে দার্শনিক এবং ধর্মীয় অগ্রণী হিসেবে সমস্ত পৃথিবীর কাছে স্বীকৃতি দিয়েছে। স্বামীজী তাঁর সমস্ত জীবন ভারতবর্ষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন এবং তিনিই ভারতবাসীকে তার নিজের ক্ষমতা এবং সামর্থ্য উপলব্ধি করতে শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ সেই সময় আমাদের পাশ্চাত্য সভ্যতার উপর মোহ ও ভারতীয় জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব ও দেশীয় চিন্তাধারার অতি অনীহা এসবই স্বামীজি জাতির প্রতি তাঁর দর্শন এবং জ্ঞানগর্ভ আন্তরিক আহবানে একক প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে দূর করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাঁর সহজাত ঐশ্বরিক ক্ষমতার সাহায্যে।
আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা স্বামীজীর সেই ভবিষ্যৎবাণীর সার্থকতা অনুভব করি যখন তিনি বার্তা দিয়েছিলেন যে “ভারতই হ’বে আধ্যাত্মিক ভাবধারা এবং মানবতার বার্তা প্রচারের পথের দিশারী।”এখন অন্য সমস্ত দেশ যখন যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য অস্ত্র বাড়াতে ব্যস্ত তখন স্বামীজীর সেই দূরদর্শিতার ভাবনা আমাদের মনকে আন্দোলিত করে। স্বামীজী আজীবন
মনঃসংযোগ করেছিলেন “মানুষ নির্মাণে”। তাঁর এই ভাবেই ভারত আবার জাগ্রত হয়ে বিশ্ব সংসারে নিজের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবে এবং স্বনির্ভর হ’বে। এইভাবে শাশ্বত ভারতমাতা আবার নিজের হারানো সিংহাসন ফিরে পাবে যা সর্বকালের গৌরব গাঁথা হয়ে থাকবে এবং গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করবে। যে ভারতবর্ষকে একসময় আখ্যা দেওয়া হয়েছিলো ক্রীতদাসত্ব, সাপুড়ে এবং কালো জাদুর দেশ বলে আর যে দেশের মানুষের মনে ছিলো শুধুই অঙ্গ-বিশ্বাসের প্রাধান্য ও যে দেশকে কয়েকশো বছর ধরে শাসন করেছে বহিরাগত লুণ্ঠনকারীরা।
ঠিক সেই কারণেই আমাদের হাতে হাত রেখে শক্তিশালী এবং শান্তিপূর্ণ ভারত গড়ার লক্ষ্যে পৌঁছনোর একনিষ্ঠ সাধনায় ব্রতী হ’তে হ’বে।
স্বামীজীর দূরদৃষ্টি ছিলো এক স্বাস্থ্যবান ভারতবর্ষেরও যে ভারত প্রাধান্য দেবে যোগের, যে ভারতের খাদ্যাভ্যাস হ’বে স্বাস্থ্যসম্মত, আয়ুর্বেদ হ’বে যে ভারতের চূড়ান্ত মন্ত্রগুপ্তি এবং আরোগ্যের মূল কথা। তিনি স্বপ্ন দেখতেন প্রত্যেকটি ভারতীয় যেন চিকিৎসার সুবিধা লাভ করতে পারে। যেখানে একজন অন্যজনের হিতার্থে অঙ্গদান করে উৎসাহিত করবে এক মহৎ আদর্শ স্থাপনের লক্ষ্যে। যোগ যেখানে যুবকদের কাছে ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে তাদের মনোবল এবং প্রেরণায় উজ্জীবিত করবে। ও জাগিয়ে তুলবে তাদের বীররস আর আর তাদের করে তুলবে কর্মঠ। স্বামীজীই প্রথম শরীর শিক্ষা ও শারীরিক বিকাশের সাথে সাথে মানসিক উৎকর্ষতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন সময়ের দাবি মেনে লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কায়মনোবাক্যে নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যেতে হ’বে যতক্ষণ না অভীষ্ট পূরণ হয়।
আমার স্বামীজী নারীকে শক্তির উৎস হিসেবে দেখেছেন। নারীরা যে সমাজের বোঝা নয় সেই বার্তা তিনিই দিয়ে গেছেন। যেখানে তিনি আত্মনির্ভরতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্বের কথা বলেছেন। স্বামীজীর কন্ঠে তাই ধনিত হয়েছে কর্মক্ষেত্রে যেন পুরুষ আর নারীর মধ্যে কোনো লিঙ্গ বৈষম্য না থাকে। তিনি বলেছেন এমন সমাজ গড়তে হ’বে যেখানে নারীর সুরক্ষা সযত্নে রক্ষিত হ’বে এবং তারা যেন গভীর রাত্রেও নির্ভয়ে পথে চলতে পারে। দুর্নীতি নিয়েও স্বামীজী
বলেছেন এমন সমাজ গড়তে হ’বে যে সমাজে কোনো মানুষকে উৎকোচ দিতে বাধ্য করা হ’বেনা। দুর্নীতির সাথে যুক্ত মানুষদের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালে যেন দ্রুত ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করা হয় যাতে দুর্নীতিকে সমূলে বিনাশ করা সম্ভব হয়। তিনি বিচারালয়ের দির্ঘসূত্রিতা দূর করে উন্নত এবং স্বচ্ছ প্রশাসন প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন। তিনিই প্রথম ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বিশ্বভাতৃত্বের বাণী প্রচার করেছিলেন।
স্বামীজীর এই স্বপ্নের মূল কথাই ছিল ভারতকে খাদ্যে স্বনির্ভর হতে হ’বে যে ভারতে একজন মানুষের অনাহার ও দারিদ্র্যের জ্বালায় মৃত্যুর শিকার হ’তে হ’বে না। স্বামীজীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো একজন প্রগতিশীল চিন্তাবিদের দূরদর্শিতা যা ছিলো আত্মসচেতন এবং বিকাশ শীল জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের উন্মেষ। তাঁর এই দূরদর্শিতা শুধুই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিপূর্ণ।
এই কারণেই দেশের অনির্ভরতা এবং মানুষের আত্মসম্মানবোধকে উজ্জীবিত করতে স্বামীজীর আজীবন সংগ্রাম আজও প্রত্যেকটি ভারতবাসীর কাছে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছে। এসবই স্বামীজীর দূরদর্শিতা এবং স্বনির্ভর ভারতের স্বপ্ন দেখার গোপন চাবিকাঠি ও এটাই ছিল তাঁর পবিত্র লক্ষ্য পূরণের পাথেয়। স্বামীজীর সেই দূরদর্শিতার প্রভাব আজও ক্রমবর্ধমান এবং আগামীদিনের পুঁজি।