Photo by Jyotirmoy Gupta on Unsplash

প্রথম পর্ব

এ কাহিনীর প্রেক্ষাপট স্বাধীনতার পর। ততদিনে দেশভাগ হয়ে গেছে আর বাংলা ভেঙে দ্বিখন্ডিত হয়েছে। পুর্ব বাংলা গেছে পাকিস্তানের সাথে আর পশ্চিমবাংলা হয়েছে ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য।। আমার সাত পুরুষের ভিটেমাটি ছিল সেদিনের সেই পূর্ব বাংলায়। আমাদের সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে প্রাণ বাঁচাতে এপার বাংলায় মাথা ঘোরার সাময়িক বাসস্থান করে নিতে হয়েছে। সাময়িক মানে ভাড়া করা মাথা গোঁজার ঠাঁই আর কি। বাবা মা ঠাকুমা ও দাদা দিদির সাথে সেই ভাড়াবাড়িতেই আমার ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা। সেই সময় ওপার বাংলা থেকে আসা মানুষগুলো বেশিভাগই এপার বাংলার নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নিয়েছিল ঠিক আমাদেরই মতন। আমরা প্রথমে বরাহনগর এর রামলাল আগরওয়াল লেনে ভাড়াবাড়িতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছিলাম। তারপর সময়ের সাথে সাথে আমরা চলে আসি যাদবপুরের বিজয়গড় কলোনিতে।

তখন ওই কলোনিগুলোতেই ছিল উদ্বাস্তু বা রিফিউজিদের আধিপত্য। ওইসব জায়গা গুলোকে ওয়ার্ডে বা অনেক বড় বড় মনীষীদের নামে এই যেমন রবীন্দ্রপল্লী, অরবিন্দ নগর বা কার্টজুনগর এইসব নামে তাদের ঠিকানা করে নিয়েছিলো। আজও মনে আছে সত্যজিৎ রায়ের প্রথম কাল জয়ী সিনেমা পথের পাঁচালী ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে মুক্তি পেয়েছিলো। প্রথম দিকটায় ছবিটা চলে নি তেমন। কিন্তু পরে ওই একই সিনেমা যখন বিদেশ থেকে পুরস্কার নিয়ে আসে তখন এখানেও তার কদর আর চাহিদা দুইই তুঙ্গে চলে যায়। যার রেশ আজও আছে। হায়রে বাঙালি ঘরের ছেলেকে ঘরে কদর দেয় না ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর আর কি! সে যাক। এটা বাঙালির চিরাচরিত বিশেষত্ব কি আর করা যাবে।

আরো মনে পড়ে ট্রাম ভাড়া বেড়েছিল এক পয়সা সেটা ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের সময় আর তার জেরে ছাত্র আন্দোলন চলেছিল প্রায় এক মাস কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠেছিল তখন।

তারপর আরো একবার তখনও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় সেই সময় ভয়াবহ খাদ্য আন্দোলনের কথা মনে হলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। তখন আমরা নেহাতই শিশু সেই খাদ্য আন্দোলনে গুলি চলেছিল আর অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়ে শহীদ হয়েছিলেন তার সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। আমার তখন স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি। আর একটা ঘটনা আজও মনে পড়ে বাড়িতে কাউকে না বোলে সেই বয়সে মানে বছর ছয় সাতেক হবে তখন আমার বয়স,একা একাই চলে গিয়েছিলাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের মেয়ে অনিতা বোসকে দেখতে আর ঘরে ফিরে আসার পর মায়ের হাতে বেশ কয়েকঘা খেতে হয়েছিল পিঠে আর সাথে বকুনি না জানিয়ে যাবার মাশুল আর কি!

আজও কানে ভেসে আসে দিদির কোলে শুয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে "বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই --- "গানটির রেশ। চাঁদের জ্যোৎস্নার চুঁইয়ে পড়া আলোর সাথে মায়াবী সুরের মূর্ছনা। সেই ছোট্টবেলায় আমাদের চাহিদা ছিল খুবই সীমিত আর দুধ আইসক্রিম নিজেদের রাজা ভোজা মনে হতো এরকমই ছিল আমার সেদিনের শৈশব বেলা।

দ্বিতীয় পর্ব

ছোটবেলায় মনে আছে কখনো বছরে একবার অথবা কপাল ভালো থাকলে বছর তিন চার বাদে নতুন ভাড়াবাড়ি পরিবর্তন করা হতো ঠেলাগাড়িতে বাক্স প্যাটরা সাজিয়ে। একরকম যাযাবরের জীবন। বেশিরভাগ মানুষই সেদিন এরকম জীবনে অভ্যস্ত ছিল যারা নিজেদের স্থায়ী বাসস্থান করে উঠতে পারেনি তখনও। এরই মাঝে আমি ভর্তি হলাম বিজয়গড় বাস্তূহারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। স্কুলটার ঠিক পাশেই বড় রাস্তা পেরিয়ে ছিল একটা বড় মাঠ সে মাঠে খেলাধুলো মিটিং নানারকম অনুষ্ঠান চলতো বছর ভর আর বর্ষাকালে সেই মাঠ জলে ভরে যেত। যেন একটা বড় জলাভূমি। সেখানে চলল আমার পড়াশোনা মানে ক্লাস ফোর অব্দি। একটা ঘটনা আজও মনে বড় বাজে। আমরা ঝর্ণা কলমে মানে কলমে কালি ভরে লিখতাম। সেই সময় সবে বেরিয়েছিল টিপ কলম বা আজকাল যাকে বলে বলপেন। আমার খুব ইচ্ছে ছিল ওরকম একটা প্রেম যদি আমার থাকতো তবে বেশ হোতো। বাবাকে সে কথা বলার পর উনি বললেন বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেলে ওটা কিনে দেবেন। কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়ার পরেও সেই পেন আমি পাইনি । ওই পেন গুলো তখন নতুন বাজারে এসেছিল তাই দাম ছিল পাঁচ টাকা। যেটা কিনা আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে বিলাসিতাই বলা যেতে পারে।

আজকালকার বাচ্চারা কথায় কথায় রাইমস্ বলে। আমাদের দাদারা আমাদের শেখাতো বল্ দেখি "কোন গেট খোলে না" উত্তর ছিল "কোলগেট খোলে না"। এরকম অতি সাধারণ সাধাসিধে জীবন ছিল আমাদের। এভাবেই ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম, শীত গ্রীষ্ম বর্ষার সাথে একটু একটু কোরে। ভর্তি হলাম এসে যাদবপুর হাই স্কুল। আমাদের সময়ে হায়ার সেকেন্ডারি ছিল ক্লাস ইলেভেন পর্যন্ত মানে আজকের উচ্চ মাধ্যমিক। আগের ঘটনাগুলো যদিও ঝাপসা কিন্তু এই ঘটনাটা ১৯৬৫ সালের আমার দিদির বিয়ের সময় কার। তখন প্রফুল্ল সেন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী। আবার খাদ্য আন্দোলনের ঢেউ আছে পড়েছিল তখন। সেদিন ছিল কার্ফু সেই কার্ফুর মধ্যেই অতি সাবধানে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হয়েছিল। তারপর আরও এক ব্ল্যাক আউটের কথা মনে আছে। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সেই দিনগুলো। তখন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় পাড়ার মধ্যে দুয়েকজনের বাড়িতে রেডিও থাকতো। যাদের বাড়িতে রেডিও থাকতো তারা মোটামুটি অবস্থাপন্ন বলা যেতে পারে ‌ সেরকমই ছিল আমাদের বাড়িওয়ালা যাকে আমরা ছোট কাকাবাবু বলতাম। উনি ছিলেন পি ডব্লিউ ডি র বড় ঠিকাদার।

তখন ওই অন্ধকারের মধ্যে পাড়ার মানুষ জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের খবর শুনতে আসতো। আর দরাজ গলায় ইথার তরঙ্গে ভেসে আসতো "খবর পড়ছি দেব দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আজকের বিশেষ খবর হোল----"।

আমাদের সময়ে বাড়ি বাড়ি এত ফ্রিজ টিভি বা গ্যাস ছিল না তখন। দিনের রান্না দিনে হতো। ছিল রোজ বাজার যাবার অভ্যেস। বাড়িতে জ্বলতো কয়লা আর ঘুঁটের মাটির উনুন। আর বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকা আর কর্পোরেশনের জল থাকা ছিল উচ্চবিত্তের লক্ষণ। কারণ কলোনির বেশিরভাগ বাড়িতেই সন্ধ্যা হলে, জ্বলতো হ্যারিকেন আর লম্ফ। একদমই সাদা মাতা জীবনধারায় জীবন বয়ে চলত আমাদের। আর টেলিফোন সেতো মহার্ঘ ব্যাপার আড়াপাড়ায় একটা বড় জোর দুটো বাড়ি ছিল যাদের টেলিফোন ছিল। তাদের বড় হত বড় লোক। যারা পাড়ার দুর্গাপুজো য় এক হাজার টাকা অবলীলায় চাঁদা দিত। আর পুজোর বাজেট ছিল বড়জোড় তিন হাজার টাকা। এত স্পন্সরারের রমরমা বা সরকারি অনুদান্ তো ছিল আকাশকুসুম কল্পনা তখন। এই ছিল মোটামুটি আমাদের শৈশবের চালচিত্র।

আজকাল তো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ঘুরে বেড়ায়।অনেকেরই দু তিনটে কোরে থাকে।আ্যনরয়েড ফোন,আই ফোন আরো কতো রকম যে।

আমি ধীরে ধীরে বেড়ে উঠি গল্ফগ্রীনে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ফুটবল মাঠে খেলে উচু উঁচু দেওয়াল টপকিয়ে অথবা দেওয়ালের নীচের গর্ত দিয়ে আমাগুড়ি দিয়ে ঢোকা আজও মনে পড়লে কেমন যেন শিহরণ জাগায়। এইভাবেই অনেক পাওয়া না পাওয়ার নানান ঘটনার স্মৃতির স্মরণী আর আমার ফেলে আসা শৈশব।

তৃতীয় পর্ব

এমনি করেই ধীরে ধীরে শৈশব পেরিয়ে কৈশরে পদার্পণ আমার। তখন আমি বোধ হয় ক্লাস সেভেন এ পড়ি। আমরা কয়েকজন পাড়ার বন্ধু মিলে বালক সংঘ ক্লাব নামে একটা ক্লাব করেছিলাম মনে আছে। পাড়ার বড়রা দুর্গাপুজো,কালীপুজো এসব করতো তবে আমাদের জন্য ছিল বাধা ওরা ছিল পাড়ায় ছোটদের বড় হয়ে ওঠার অধিকার। তখন দশ টাকায় একটা সরস্বতী পুজো হয়ে যে টাকা বেঁচে যেত সেই টাকায় আবার পাড়ার গোপালদার চপের দোকানে ফিষ্টও হয়ে যেত আমাদের। তাও আবার জিএসএ নয় একদম দেশি মুরগি দিয়ে। তখন পোল্ট্রি মুরগি চালু হয়নি আজকের মতন। আর চাঁদা তুলতে গেলেই চাঁদার টাকা থুরি পয়সা পাওয়ার জন্য কতইনা গল্প ফাঁদতে হতো আমাদের নিষ্পাপ মুখ কোরে। আর পুজোর প্যান্ডেল তোর মা দিদিদের শাড়ি দিয়ে।

পুজোর আগের রাত জেগে কারো বাড়ির কলা, কুল, নারকেল, ফুল চুরি করার মধ্যে একটা আলাদা মজা ছিল যেটা আজ বলে বোঝানো যাবে না। এসবের মধ্যে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ক্লাস নাইনের দোরগোড়ায়। আরেকটা কথা না বললেই নয় দুর্গাপুজোর সময় কিছুটা স্বাধীনতা পেয়ে আমরা চলে যেতাম কখনো কখনো শেয়ালদার কাছে সিমলা ব্যায়াম সমিতি,কলেজ স্ট্রিট,সংঘশ্রী, সংঘমিত্রা আর হাজরা এলাকার ঠাকুর দেখতে আর দেরি করে বাড়ি ফেরার জন্য অনেক বকুনি ছিল বাধা বাবার কাছে। সেও সব দিন ছিল। এবার পড়াশুনার কথা কিছু বলা যাক্। ক্লাস এইটে পাশ করে উঠলাম ক্লাস নাইনে সাইন্স নিয়ে চাপটা একটু বেড়েই গেল। কারণ স্কুলের সাথে সাথে আমাকে তিনটে কোচিং ক্লাস সপ্তাহে চার দিন যেতে হতো স্কুলের শুরু হওয়ার আগে ভোর বেলা আর না হোলে বিকেল বেলা স্কুল ছুটির পরে। আর হ্যাঁ আরো একটা কথা না বললেই নয়। যতই টাকা-পয়সার টানাটানি থাক না কেন প্রত্যেক ক্লাসে উঠার পর বাবা নিজের সাথে করে বুকলিষ্ট নিয়ে নতুন বই কিনে দিতেন আর বাটার নতুন সু ছিল প্রত্যেক বছর বাঁধা। নতুন বইয়ের মন মাতানো গন্ধে পড়ায় এমনিতেই মন বসে যেত আমার। আর পুরনো বই কখনো বিক্রি করিনি আমি কাউকে দিয়ে দিতাম কারণ বিদ্যে দাড়ে বাড়ে। এমন সব বিশ্বাসের ভিড় ছিল আমাদের মনে। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে আমি উত্তীর্ণ হলাম ক্লাস ইলেভেনে মানে উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসে। সেটা ১৯৭০ সাল। সেই সময়টা ছিল একটা ভয়ংকর সময় আজও সেইসব স্মৃতি মনে পড়লে মনটা ভার হয়ে আসে। সেই সন্ত্রাসের দিনগুলো আজও তাড়া কোরে বেড়ায় আমাকে। কান পাতলেই অবচেতনে আজও ভেসে আসে বোমা আর পাইপ গানের শব্দ আকাশ বাতাস কাঁপাতো তখন সেই নকশাল আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছিলো কলকাতার আনাচে কানাচে আর অত্যন্ত গ্রাম বাংলায়। ভয়ংকর বিভীষিকার স্মৃতি। আর ওই দলে ছিল সবই কম বয়সি মেধাবী ছাত্রের দল যাদের চোখে ছিল সমাজ পরিবর্তনের একরাশ স্বপ্ন কিন্তু ভিন্ন পথে তাই সাফল্য আসেনি। সেই পথে। হারিয়ে গিয়েছে ওরা অতীতের অতল গহ্ব ঘরে, নানান রকম নতুন নতুন ফোন দিতে বার করেছিল ওরা মানুষকে ভয় দেখাতে। সেটা এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ ঘর থেকে বের হলে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসবে কিনা তা ছিল অনিশ্চিত। এইসব ঘটনার প্রেক্ষাপটেই তৈরি হয়েছিল মৃণাল সেন এর কালজয়ী ছায়াছবি কলকাতা '৭১।

চতুর্থ পর্ব

আমরা যখন ক্লাস ইলেভেনের পরীক্ষা দেবো ঠিক সেই সময় বোধ হয় ১৯৭১ সালের ই আগস্ট মাসে পশ্চিম পাকিস্তানের খানসেনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের ওপর। অত্যাচার করেছিল ওরা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। প্রতিবাদে শেখ মুজিবর রহমান গর্জে উঠেছিলেন আর রোজ রাত্রি ঠিক দশটার সময় শেখ মুজিবরের আহ্বান ভেসে আসতো ইথার তরঙ্গে"দিকে দিকে দুর্গ গড়ে তোল।"আর ভাষণ শেষ হোতো "জয় বাংলা"শ্লোগান দিয়ে। সে এক রোমহর্ষক সময় গেছে। আর তখন তো এতো মিডিয়া পাবলিসি দিচ্ছিল না তাই অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম রবি শংকর চৌধুরী মানে পন্ডিত রবিশঙ্করের উদ্যোগে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের অসহায় নির্যাতিত নিপীড়িত সহায় সম্বলহীন বাঙালির জন্য নিউইয়র্কের মেডিসিন স্কোয়ারে একটি চ্যারিটি শো এর আয়োজন হয়েছিল। সেই সংগীত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর নিজে আলী আকবর খান ও আল্লারাখা ভারত থেকে আর বিটলস্ গ্রুপ থেকে জর্জ হ্যারিসন তখন বিটলস্ গ্রুপ সদ্য ভেঙ্গে গেছে। জর্জ হ্যারিসন সেদিন গেয়েছিলেন বাংলাদেশ নামে একটি গান যা ছিল খুবই হৃদয়গ্রাহী। অল উপস্থিত ছিলেন আমেরিকার প্রবাদ প্রতিম গণসংগীত শিল্পী বব ডিলান এবং আরো অনেক রথী মহারথীরা।

সেই সময় কাতারে কাতারে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বেনাপোল ,পেট্রাপোল নদীয়া এইসব সীমান্ত পথ দিয়ে এপার বাংলায় পালিয়ে আসে শুধু প্রাণটুকু হাতে করে । ফের যেন সেই দেশভাগের অভিশাপের স্মৃতি আবার বয়ে নিয়ে এলো। অবশেষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগে ভারতীয় সেনা প্রত্যাঘাত করে খানসেনাদের পর্জুযস্ত করে বিতাড়িত করে। জন্ম হয় আরেক নতুন রাষ্ট্রের যার নাম আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান। সেই ঘটনার বেশ আজও ভারত বর্ষ বয়ে চলেছে আর অসহায় মানুষগুলো আরো একবার তাদের সাত পুরুষের ভিটেমাটি হারালো। এসবের মধ্যেই আমার বেড়ে ওঠা। রবি ঠাকুরের ভারত তীর্থ আর সৈয়দ মুজতবা আলীর ভারতবর্ষ পড়ে যার বিখ্যাত লাইন আজও মনে ঝংকার তোলে "সেই স্টাডিশন সমানে চলেছে।"

আবার ফিরে আসি আমার কথায়। এতসব ঘটনার মাঝে প্রেম এসে কখন যে বিদায় নিয়েছে টেরও পায়নি। যখন টের পেলাম সেই প্রেম তখন অন্য কারো সাথে ঘর বেঁধেছে। আমার বুঝতে অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে সময়ে না বোঝার দাম আমাকে গুনতে হয়েছে করায় গন্ডায়। সে যাক হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়ে সেদিনের সেই বোমা বন্দুক আর ড্যাগারের ভূ-কুটিকে জয় করে পাস কোরে বেরোলাম। সেই সময় নকশাল আন্দোলন প্রায় স্থিমিত হয়ে এসেছে কারণ নকশাল আন্দোলনের অনেক বড় নেতাই যেমন চারু মজুমদার জঙ্গল সাঁওতাল আর কলকাতার মেধাবী অনেক ছেলে-মেয়ে তৎকালীন বিহারের যদুগোডা থেকে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু তারপর শুরু হয়েছে কংগ্রেস আর সিপিএমের রেষারেষি। ওরা নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নিয়েছিল তখন। আর সেই সময় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায় প্রয়াত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বংশধর।

পঞ্চম পর্ব

এই টাল মাতাল অবস্থার মধ্যেই আমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ কোরে বেরোলাম। তখনো সেই নকশাল আন্দোলনের রেশ চলছে যদিও কিছুটা স্থিমিত তবুও মাঝে মাঝেই মহাপুরুষদের মূর্তির মাথাটা কেটে নেওয়া অথবা ভেঙে দেওয়া এসব চলছে। সে সময় অর্থাৎ ১৯৭১ এর শেষ দিকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি তে চার দিন পুলিশ আর ছাত্রদের গুলি বোমার লড়াইয়ের আওয়াজ আজও কানে বাজে। চার দিন বাদে পুলিশ ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ঢুকতে পেরেছিল। একই রকম অবস্থা ছিল অন্য বড় বড় কলেজ যেমন প্রেসিডেন্সি কলেজ আইআইটি খড়গপুর শিবপুর বি ই কলেজ এসব আর কি। শিক্ষায়তনের পরিবেশ তখন অগ্নিগর্ভ অবস্থায়। বিশেষ করে আবাসিক ইউনিভার্সিটি ও কলেজ গুলোর একই অবস্থা ছিল সারা পশ্চিমবঙ্গে। আর কিছুদিন বাদেই ঘটলো একটা হৃদয়বিদারক ঘটনা যা আজও আমার মনকে নাড়া দেয়।

তখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক গোপাল চন্দ্র সেন উনি ক্যাম্পাসের মধ্যেই থাকতেন। ছাত্র দরদী হিসেবে ডঃ সেনের বেশ সুনাম ছিলো। এরকমও শোনা যায় ছাত্ররা ওনাকে ঘেরাও করেছে সেই দুপুর থেকে কলেজ ক্যান্টিনের মালিক কে ছাত্রদের সংখ্যা জেনে নিয়ে তাদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। ছেলেগুলো যাতে অভুক্ত না থাকে। সেই ছাত্র দরদী অধ্যাপকের সেদিন ১৯৭০ ডিসেম্বর এর শেষ দিকে ওনার অবসরের ঠিক আগের দিন ছিল। অর্থাৎ তার কার্যকালের শেষ সময় সেটা। উনি সেদিন বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিঘীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন তার কোয়াটার্সের দিকে। পথে তারই চার-পাঁচজন ছাত্র তাকে ঘিরে ধরে চাকু দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে সেখানে তেলে চলে যায় তার নশ্বর দেহ। রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যু হয় সেই ছাত্র দরদী অধ্যাপকের। এই ঘটনা যে কোন সুস্থ মানুষের কাছে যেমন লজ্জা তেমনি হৃদয় বিদারক আজও দগডগে ক্ষতের মত হয়ে আছে আমার স্মৃতিতে, হয়তো বা আমার মত অন্য আরও অনেকেরও।পরে জানা গেছে তার প্রিয় ছাত্রদের একজন যে সেই পিতৃপ্রতিম অধ্যাপককে খুন করেছিল বাকি জীবনটা সে থিতু হয়েছিল মার্কিন মুলুকে।

সবকিছুতেই যখন পরিবর্তনের হাওয়া বইছে তখন শিল্প সাহিত্যের জগতেওএকটু একটু করে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এই যেমন বাংলার গান বাজনার জগতে মান্না দে হেমন্ত মূখার্জির ধারা থেকে বেরিয়ে একটু নতুনত্বের স্বাদ এনে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল গৌতম চট্টোপাধ্যায়। বাংলা ব্যান্ডের সেই পথিকৃত। তার ব্যান্ডের নাম ছিল মহীনের ঘোড়াগুলি। আর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রথম গান ছিল " ভেবে দেখেছ কি------"যে গান আজও আলোরন তোলে শ্রোতার দেহ মনে। যদিও সেই সময় অতটা জনপ্রিয় হয়নি সেই গান কারণ তখন মান্না দে, হেমন্ত,কিশোর কুমার এরা সব সদর্পে বাংলার গানের জগতে বিচরণ করছেন। নব্বই এর দশকের পরে যখন বাংলা ব্যান্ডের রমরমা যেমন ক্যাকটাস লক্ষ্মীছাড়া ওদিকে নচিকেতা, কবির সুমন আর অঞ্জন দত্ত বাংলা ব্যান্ডের এক অন্য মাত্রা দিয়েছে তখন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের ওই গানটি খুব জনপ্রিয় হয় বাংলাদেশের জেমসের গলায়। পরে এই গানটি হিন্দি অনুবাদ হয় এবং খুব প্রচারের আলোয় আসে যে গান এই বিংশ শতাব্দীতে আজকের দিনেও সমান জনপ্রিয়।

এসববের মাঝে আমি ভর্তি হলাম অংকে অনার্স নিয়ে শিয়ালদা কলেজে ব্রিটিশ আমলে যার নাম ছিল রিপন কলেজ। রোজ সাউথ লাইনের লোকাল ট্রেনে চেপে শেয়ালদা স্টেশন হয়ে হাঁটা পথে কলেজ জীবন শুরু হল আমার। এভাবে ই একদিন বন্ধুদের সাথে ব্লোপাইপে সিগারেট পুরে ধুম্রপানের অভ্যাস হয়ে গেল কলেজ ষ্ট্রিট পাড়ায় চলতে চলতে। ধীরে ধীরে কখন যে কিশোর থেকে যুবক হয়ে গেলাম আমি নিজেই বুঝতে পারিনি।

একটা ঘটনা আজও মনে আছে একদিন দুপুরের দিকে কলেজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেছে। যাদবপুর স্টেশন থেকে বাড়ির পথে হাঁটছি। এসে পৌঁছলাম এইট বি বাসস্ট্যান্ডের কাছে ওই যেখানে এখন লোকনাথ পেপার আর মেডিকোর দোকান সেই মোড়ে। দেখি একদল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে সোডার বোতল হাতে আর চারিদিক শুনশান। আশেপাশে কেউ নেই। আমি একাই রাস্তায় আর আমার হাতে একটা লাল মলাটের অংকের বই ছিলো সেদিন। ওই ছেলেগুলো ছিল সিপিএম পার্টি তাই লাল বই দেখে ওরা কিচ্ছু বলেনি। কিন্তু আমি যেখানে যাব সেই রাস্তায় যে মোড়টা আছে সেখান থেকে শুরু কংগ্রেস এর এলাকা আর ওরা আবার লাল বই দেখলেই ভাবে এই বুঝি বা সিপিএমের লোক। ভাবছি কি করব এবার আর একটু চিন্তা নিয়েই সামনের দিকে হাঁটছি। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি একজন মাঝ বয়সী ভদ্রমহিলা যাচ্ছেন আমার একটু আগে। তাকে বললাম মাসিমা আমি শুধু আপনার সাথে সামনের মোড় পর্যন্ত যাবো ওদের হাত থেকে বাঁচতে যদি ওরা জানতে চায় তাহলে আপনি আমায় চেনেন এটুকু বললেই হবে। আমার কপাল ভালো তুমি রাজি হয়ে গেলেন আর আমিও বিপদ থেকে রক্ষা পেলাম। ওরা ভাবল উনি বোধ হয় আমার কোন নিকট আত্মীয় হবেন। সেই ছোট্ট ঘটনার কথা আজও মনে আলোড়ন তোলে কারণ একটু এদিক সেদিক সেদিন হলেই দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। যাই হোক সেই ছেলেগুলো আমার বইয়ের দিকে তাকাচ্ছিল কিন্তু ওই ভদ্রমহিলা সাথে থাকায় আর ওরা কিছু বলেনি আমাকে।

আর আমিও নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেছিলাম সেদিন।

ষষ্ঠ পর্ব

সেইসব দিনগুলোতে আমরা তাকিয়ে থাকতাম কবে দুর্গাপুজো আসবে তার দিন গুনে। আর পুজোর এক সপ্তাহ আগে আকাশবাণীর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ গলায় চন্ডীপাঠ শোনা যেটা আজও মহালয়ার ভোরে সমান জনপ্রিয়। সেই সময় পাড়ার ক্লাবগুলোতে মাইকেও সারা পাড়া জাগিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠানে মেতে উঠতো। ভোরবেলা অল ইন্ডিয়া রেডিওর সেই বিখ্যাত প্রভাতী সূর মূর্ছনা শুনে ঘুমের ঘোর কাটতো, যে সুরের জাদুকর ছিলেন পন্ডিত রবিশঙ্কর। সেই সময়ে আমরা ডুয়েট গান শুনলে বাবা খুব বকাবকি করতেন বলতেন ছেলের জাহান্নামে যেতে আর বেশি দেরি নেই। তাই আরতি মান্না বা সন্ধ্যা হেমন্ত অথবা লতা কিশোর কুমার আর মহম্মদ রফির গানগুলো ঠিকমত শোনা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য আড়ালে আবডালে সবই চলত। আর সিনেমা দেখতাম ওই পাড়ার মাঠে উনিশ পয়সার টিকিট অথবা বিনা পয়সায় যখন কোন অনুষ্ঠান হোতো আমাদের বিজয়গর মাঠে। এখন সেখানে বড় হলঘর হয়েছে নাম নিরঞ্জন সদন। কয়েক বছর আগেও ওই মাঠে বড় করে ভারত মাতার পুজো হতো। বিরাট মেলা বসত যাত্রা নাটক আর সব বড় বড় শিল্পীরা আসতেন সংগীত পরিবেশন করতে। আর উদ্বোধনে প্রত্যেকবারই কোন না কোন ভিআইপি আসতেন। এলাকার প্রত্যেক বাড়ি থেকে এক টাকা চাঁদা তোলা হতো। সে পুজো আজও হয় তবে সেই রমরমা আর নেই। আমাদের স্কুল জীবনে সিনেমা দেখা মোটামুটি বারণই ছিল বলা চলে। তাই ওই মাঠের প্রোজেক্টরের সিনেমা অথবা যাত্রা আর নাটক দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। তাও ঐতিহাসিক অথবা ধর্মীয় কাহিনী আর অন্য কাহিনী নৈব নৈব চ। যাই হোক এভাবেই প্রায় দুমাস কেটে গেছে কলেজ জীবনের। একদিন তো একদম কপাল জোড়ে বেঁচে গেছি। সেদিনও কলেজ থেকে ফিরছিলাম রাস্তায় সিআরপিএফ ব্লক করে সবাইকে চেক করছে। কারা কারা চুষ প্যান্ট মানে চাপা প্যান্ট পড়ে আছে আর তাদের প্যান্টের ভেতর বোতল ঢুকিয়ে দিচ্ছে আর প্যান্ট যাচ্ছে ফেঁসে সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আমি বেঁচে গিয়েছিলাম ওই অত্যাচারের হাত থেকে কারণ আমার নরমাল প্যান্ট পরা ছিল তাই আমি ছাড় পেলাম। সিআরপিএফের হাত থেকে। এভাবেই জীবন চলছিল নানা ঘটনা ক্রমের চড়াই উতরাই বেয়ে।

এই ডামাডোলের বাজারে যখন সবাই প্রায় দিশাহীন ভবিষ্যতের আশার আলো প্রায় দেখা যাচ্ছে না ঠিক সেই সময়ে আমার দাদা যিনি কিনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তখন চাকরির সূত্রে গোয়াতে কর্মরত তিনি চিঠি লিখে জানালেন "ওইসব বিএসসি

টিএসসি পড়ে কিচ্ছু হবে না এই দশ টাকা করে পাঠিয়ে দিলাম এটা নিয়ে পাত্রপাঠজয়েন্টের পরীক্ষা দেওয়ার। তৈয়ারি কর।"সেই নির্দেশ পেয়ে কি আর করা আমিও তার পরদিনই চলে গেলাম আরবিআআইতে দশ টাকার জমা করতে জয়েন্টের পরীক্ষার জন্য।

আরেক কান্ড তখন সবে আরবিআই তেই একমাত্র এসকালেটার মানে চলমান সিড়ি চালু হয়েছে। অনেক ভয়ে ভয়ে কোনমতে কাউন্টারে পৌঁছে ফর্ম ফিল্ আপ করে জমা দিয়ে সেই যে কলেজ ছাড়লাম আর অমুখো হইনি। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছি রিস্কটা ঝোঁকের মাথায়একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছিলাম। যাইহোক নো রিস্ক নো গেইন তাই আমি আদা জল খেয়ে জয়েন্টের পরীক্ষার তৈরিতে লেগে পড়লাম। আমি কিন্তু আশাই করিনি আমি চান্স পেয়ে যাবো। বন্ধুরা এসে বললো আমার নাম উঠেছে ফার্স্ট লিস্টে। দাদা এসে ভর্তি করে দিয়ে গেলেন শিবপুর বি ই কলেজে আর জামাইবাবু ছিলেন আমার লোকাল গার্জেন। ভর্তি হলাম সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। অবশ্য ভর্তি হওয়ার সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আমার প্রথম পছন্দের বিভাগ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ সিট পেয়ে গেলাম।

সপ্তম পর্ব

আ্যডমিশন তো হয়ে গেল শিবপুর বি ই কলেজে। বেশ আনন্দই হচ্ছিল আর বেশ কিছুদিন মানে এই মাস দুয়েক ধরে আর কি সেই আনন্দের ছিল যতদিন না হোস্টেলে যাওয়ার ডাক এসেছে। অবশেষে এলো সেই দিন দশই ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল। এক অজানা আনন্দের সাথে একটু ভিডিও ছিল কারণ তখন র‍্যাগিং নামে ব্যাপারটা শোনা হয়ে গিয়েছিল। নানা রকম ব্রহ্মশক ভয় দাঁড়ানো গল্প শুনে একটু উত্তেজনা বা রোমাঞ্চ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক। সে যাক সেই দশই ডিসেম্বর বিকেলের দিকে একটা টিনের ট্রান্ক আর বেডিং

মানে বালিশ,তোষক আর মশারি বেঁধে লোকাল গার্জেন জামাইবাবুর সাথে উঠে পড়লাম ডাবল ডেকার বাস এইট বি বাসের দোতলায় জানালার পাশে যাদবপুর এইটবি স্ট্যান্ড থেকে। সেই বাসস্ট্যান্ডে নাম আজও পরিচিত এইট বি বাস স্ট্যান্ড নামে শুধু সেই এইট বি বাসটাই আজ আর নেই। বাস চলল হাওড়া স্টেশন লাগোয়া হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আপাতত সেটাই প্রথম গন্তব্য।

তারপর হাওড়া পৌঁছে সেখান থেকে ৫৫ নম্বর বাসে চেপে বসলাম যার লাস্ট স্টপেজ বোটানিকাল গার্ডেন বা ছোট করে বি গার্ডেন। কন্ডাক্টর বি গার্ডেন বি গার্ডেন করে যাত্রী ডাকতে ব্যাস্ত। আমার মত আর ও দু চারজন ছিল সেই বাসে কিন্তু কেউই কাউকে চিনতাম না বলে আর কথা হয়নি। তারপর নামলাম কলেজ ফার্স্ট গেট বা সেন্টেনারি গেটে। ওখান থেকে অফিসিয়াল এন্ট্রি করে জানা গেল আমার হোস্টেল হল ডাউনিং হল। প্রথম দর্শনে তো চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার যোগাড় এ তো হোস্টেল নয় এটা যে আস্ত একটা ফোর্ট আর পাশেই থার্ড গেট এক লাফে গেট পেরোলেই রাস্তা আর ওপাশে বোটানিক্যাল গার্ডেন। যাই হোক হলে সেন্ট্রাল উইং এর একটা ঘরে আমার থাকার জায়গা। ঘর তো নয় একটা ছোটখাটো খেলার মাঠ যেন যার চার কোনায় চারটি লোহার রড লাগানো লোহার সিঙ্গেল খাট।

আর হোস্টেলে ছিল দোতলা। তবে ঘরের উচ্চতা প্রায় দেড়তলা সমান আর ওপরে করি বর্গা। দরজা দিয়ে হু হু করে গঙ্গার ঠান্ডা মুক্ত বাতাস ঢ়ুকছে সে এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি।

একে ভরা ডিসেম্বরের সন্ধ্যা আর তার সাথে গঙ্গার হিমেল হাওয়া আর ওপাশে গার্ডেনরিচ, খিদিরপুর বকের আলোর মালা দেখা যাচ্ছে। আর সামনে বিশাল সবুজ লন যার তিনদিক ঘিরে বিরাট ডাউনিং হলের কম্পাউন্ড যার তিনটে উইন ইস্ট, ওয়েস্ট এবং সেন্ট্রাল।

যাইহোক ঘরে পৌঁছে দেবার পর আমার লোকাল গার্জেন বিদায় নিলেন তখন প্রায় রাত হয়ে আসছে। এবার পাশের ঘরে ই পেয়ে গেলাম আমার একই স্কুলের সহপাঠীকে ও আমারই ব্যাচে ভর্তি হয়েছে। মনে একটু জোর পেলাম।এবার আমরা দুই বন্ধু মিলে কিভাবে র‍্যাগিং থেকে বাঁচা যায় সেই চিন্তা করছি। এমন সময় আমাদের স্কুলের আরো এক বন্ধুর নাম মনে পড়ল আমাদের যে আমাদের এক বছর আগে কলেজে ভর্তি হয়েছে মানে এখন সে আমাদের এক বছরের সিনিয়র। খোঁজ করে ওকে পাওয়া গেলে ও এসে আমাদের সাথে দেখা করে বলে গেল কোন চাপ নিস্ না কেউ বলে আমার নাম করবি দেখবি কেউ কিছু করবে না। যাই হোক এরপর রাত সাড়ে আটটা নাগাদ মেসে গিয়ে প্রথম বাড়ির বাইরে ডিনার অনন্য অভিজ্ঞতা আর কি। যদিও প্রথম দিন বলে মেনু বেশ ভালই ছিল হাতে গড়া আটার রুটি আর পাঁঠার মাংসের সাথে আরো দু তিনটে আইটেম। এবার খাওয়া শেষ হলে আমরা দুই বন্ধু সামনের লনে দাঁড়িয়ে উঠবাইন সিগারেট ধরিয়ে খাওয়ার পর যখন সুখ টান দিচ্ছি সেই সময় এক সিনিয়র দাদা যেচে পড়ে আলাপ কোরে একথা সে কথার পর সিনিয়র হোস্টেলে নিয়ে গিয়ে প্রায় ভোর চারটে পর্যন্ত র‍্যাগিং চালিয়েছিল। সেই আমার র‍্যাগিং এর সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা যা আমার মনের মনিকোঠায় আজও ভেসে বেড়ায়।

অষ্টম পর্ব

সেই র‍্যাগিং পিরিয়ড চলেছিল ঠিক দু' সপ্তাহ।

সেই দু'সপ্তাহে আমরা র‍্যাগিং এর কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সেকেন্ড হাফের ক্লাস হয়ে গেলেই বিকেলে হোস্টেলে পৌঁছে টিফিন করে চলে যেতাম সিনেমা দেখতে পারলে ইভিনিং আর নাইট দুটো শো দেখে যখন ফিরতাম তখন গভীর রাত। আগের থেকে মেসে বলে যেতাম আমাদের খাবার চাপা দেওয়া থাকতো। কোন রকমে রাতের খাওয়া সেরে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করা। কিন্তু তাতেও নিস্তার ছিলো না। বড় জানালার তারের জালির বড় বড় ফাঁক দিয়ে লোহার রডের খোঁচা খেয়ে দরজা খুলে দিতেই হতো। আর দরজা খুলেই সেই চেহারা কলেজের সবার দাদা, লাল টি শার্ট আর কালো প্যান্ট আর নিজে দেখতেও বেশ কালো। চোখে হাই পাওয়ার চশমা। দেখলেই কেমন যেন শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। সেই দাদার গর্জন শোনা যেত "সাহস খুব দেখছি যে দরজা খুলিস্ নি কেন এতক্ষন।"আর তারপর নানান আজগুবি প্রশ্ন বান আর না পারলেই অভিনব চিন্তাধারার র‍্যাগিং চালু হত রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত। কখনো আর ডি বর্মনের সুরে "আমি চিনি গো চিনি তোমারে"

অথবা ফর্জ সিনেমার গানের তালে জিতেন্দ্রর ষ্টাইলে টুইষ্ট ড্যান্স আর ফিজিক্সের ওয়ার্ক ডান জিরোর নামে মাথায় ট্রাঙ্ক নিয়ে উঠবস করতে করতে প্যান্ট ছিঁড়ে যাওয়া আরো কত কি যে হতো সেসব আজ মনে পড়লে হাসি পায়। আবার সিনিয়ররা কখনো আমাদের চালাকি ধরে ফেলে সন্ধ্যাবেলায় চলে আসতো র‍্যাগিং করতে। আর আমরাও তখন লুকোচুরি চালাতাম হোস্টেলের ভেতরের জোড়া সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে গিয়ে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থাকতাম র‍্যাগিং এর হাত থেকে বাঁচার তাগিদে।

এরকম দু'সপ্তাহ চলার পর ফ্রেশার্শওয়েলকাম বা নবীন বরণ করে শেষ হতো র‍্যাগিং পিরিয়ড। আর তারপর সিনিয়র দাদারা নিজের ভাইয়ের থেকেও একান্ত আপন হয়ে উঠতো যে কোন আপদে-বিপদে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তো এরকম অনেক ঘটনা আছে এই যেমন একবার আমার প্রচন্ড জ্বর প্রায় বেহুঁশ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম। তখন তো মোবাইলের যুগ ছিল না ‌ তাই অত তাড়াতাড়ি বাড়ির লোককে খবর দেওয়া যেত না। যখন একটু জ্বর কমেছে দেখি মাথার পাশে বসে সেই দাদা যাকে মাঝরাত্তিরে দেখে আমি আতকে উঠেছিলাম সে বসে আমার মাথায় জলপট্টি কোরছে। পরে জেনেছিলাম সেই দাদা সারারাত ধরে জলপট্টি করে গেছে। এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে।

আজও মনে পড়লে কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে। এই কিছুদিন আগে জানলাম সেই আমাদের সবার প্রিয় দাদা, আমাদের ছেড়ে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, ভালো থেকো দাদা তুমি যেখানেই থাকো। আবার কবে কোথায় দেখা হবে কে জানে। সেই দাদা কলেজের সুইমিং চ্যাম্পিয়নও ছিলো বটে।

নবম পর্ব

এবার পুরোদমে হোস্টেল লাইফ শুরু হোলো। ভোর বেলা উঠে সকাল আটটা থেকে ক্লাস শুরু দুপুর বারোটা পর্যন্ত এরপর ঘরে এসে লাঞ্চ করেই আবার দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস করে তবেই ছুটি। তখন আমরা যে যার আমাদের মতো সময় কাটাতাম। কেউ বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঘুরতে যেতো অথবা কেউ মাউথ অর্গানে গানের সুর তুলতো, কিউবা পছন্দের খেলাধুলো অথবা জিন বা সুইমিংপুলে যেতো এইসব আর কি। আর নাইট শো ছিল বাঁধা মোটামুটি সপ্তাহে তিন দিন তো বটেই। তখনো কলেজের কাছাকাছি কোন সিনেমা হল ছিল না অলকা, মায়াপুরী, পার্বতী, ঝর্ণা আর হাওড়া ময়দানের কাছে বঙ্গবাসী। প্রথম দিকে আমরা বাংলা সিনেমাই বেশি দেখতাম তারপর হিন্দি ইংরেজি ও দেখা শুরু করি সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর। যখন আমরা ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলাম তখন সিআরপি এফ পোস্টিং ছিল পার্মানেন্টলি বেশ কিছুদিন। আমাদের জুনিয়র হোস্টেল দুটো মানে ডাউনিং হল আর তের নম্বর হোস্টেল ছিল টিপাড়ায় আরো অনেক সিনিয়র হোস্টেল ছিল ওখানে। আর ছিল বিখ্যাত ওভাল মাঠ। যে মাঠে ফুটবল ক্রিকেট আর সব কম্পিটিশন চলত। ওই ঠিক পাশেই ছিল উল্টো প্যান্ডেল ওটা সিনিয়র হোস্টেল তবে লেডিস হোস্টেলও মুচি পাড়াতেই ছিল। আর সাহেব পাড়ায় ছিল লসের মাঠ আরও সব সিনিয়রহোস্টেলযেমনরিচার্ডসন,পান্ডিয়া,সেনসেনগুপ্ত এইসব হোস্টেল। সব হোস্টেল গুলোই কোন না কোন প্রফেসরের নামে নামাঙ্কিত।

যাইহোক এই ভাবেই কি করে যে একটা বছর কেটে গেল বোঝাই গেল না। আর হ্যাঁ, আরো একটা ব্যাপার না বললে এ কাহিনী অসম্পূর্ণ। থেকে যাবে। তা হোলো শিবরাত্রিতে সিদ্ধির শরবত খাওয়ার কথা। আসলে আমাদের হোস্টেলের যারা ব্যারাক সার্ভেন্ট দাদারা ছিলো তারা বেশিরভাগই উড়িষ্যা, বিহার থেকে আশা আর কয়েকজন বাঙালিও ছিল অবশ্য। ওদের কাছে একটা অন্যতম উৎসব ছিল শিবরাত্রির পুজো। ঐদিন ওরা দারুণ সিদ্ধির শরবত বানাতো। সেই শরবতের স্বাদ এখনো মনে হলে জিভে জল আসে আর মন আনন্দে নেচে ওঠে। সেই শরবত খেয়ে মানে দু গ্লাস খেলেই আর দেখতে হতো না। যে হাসছে সে হাসবে যে মুখ গোমড়া করে আছে সে তাই থাকবে। মানে যে যা করছে সে তাই করবে সারা রাত। সে যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সিনিয়র হোস্টেলে যাওয়ার পরও আমরা কয়েকজন বন্ধু দল বেঁধে শুধু ওই ম্যাজিক শরবত খাওয়ার আকর্ষণে প্রত্যেক বছর ডাউনিং হলে যেতাম আর ব্যারাক সার্ভেন্ট হাসিমুখে আমাদের আপ্যায়ন করতো।

দশম পর্ব

এইসব ঘটনার স্রোতে গা ভাসিয়ে আমি ফার্স্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উত্তীর্ণ হোলাম। আর হোস্টেল ু পরিবর্তন হলো সেটা ছিল ওই মুচিপাড়ারই নয় নম্বর হোস্টেল এখানে তিন বছরের জন্য হলাম। এই হোস্টেলে প্রথমে গ্রাউন্ড ফ্লোরে তারপর ফার্স্ট আর সেকেন্ড ফ্লোরএ তিন বছর মানে ফোর্থইয়ার পর্যন্ত কলেজ জীবন কেটেছে। মানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ জীবন স্মৃতির সিংহভাগই এই হোস্টেলের সাথে জড়িয়ে আছে। এই হোস্টেলটা ছিল সেকেন্ড গেটের একদম কাছে। আর সেকেন্ড গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার ওপারেই ছিল জ্যাঠামশাইয়ের মিষ্টির দোকান। ওই দোকানে আমরা ছুটির দিনে সকালবেলা দলবেঁধে যেতাম মানে অন্তত চার পাঁচ জন মিলে গরম গরম কচুরি জিলীপি আর সিঙ্গারা বা কখনো চপ সহযোগে চা খাওয়ার আকর্ষণে। সেই সুখ স্মৃতি কখনো মুছে যাবে না। সে দেশের যেকোনো জায়গায় অথবা বিদেশে যেখানেই যাই না কেন। ওই হোস্টেলই আমাকে পাশ করার পর কি করব তার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কারণ দু বছর কাটানোর পর যেমন নৌকো থেকে ওপারের আবচা হাতছানি দেখা যায় ঠিক তেমনি। আমরা যখন ফার্স্ট ইয়ারে ডাউনিং হলে ছিলাম তখন মনে হতো এই পাঁচ বছরের অথই সমুদ্র কি কোবে যে পেরিয়ে ওপাড়ে পৌঁছবো কে জানে? একটা ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে আমরা বোধহয় তখন থার্ড ইয়ারে উঠেছি একদিন দেখি একজন বেশ স্বাস্থ্যবান ছেলে হোষ্টৈলের ডাইনিং এ খাচ্ছে আর আমাদের হোস্টেলের বড় ঠাকুর ও তার অন্য সব সাহায্যকারী দাদারা তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম পিন ড্রপ সাইলেন্স আর কি। খাওয়া দাওয়ার পর সে বিদায় নিতেই আমি বললাম কি গো আমাদের তো এরকম খাতির করো না দাদা তোমরা। এই দাদার ব্যাপারখানা কি বলতো। তখন হেড ঠাকুর নগেনদা বলে উঠলো "আরে দা বাবু বলবেন নি উনি কে জানেন উনি এক নম্বর নকশাল পার্টি কোরতো।" পরে জেনেছিলাম সেই সিনিয়র দাদা পার্ক সার্কাসের মোহম্মদ আলী পার্কে দু'খানা রিভবলবার নিয়ে ধরা পড়েছিল এবং কয়েকদিন হাজতবাসও করেছিলো। যখন আমরা তাকে দেখি তখন সে আইআইটি খড়্গপুরে মাস্টার্স করছিলো। পরে সেখানেই সে প্রফেসর হয়েছিল।

এরকম আরো একজন দাদা ছিল তখন ফোর্থ ইয়ারে সেও খুব ভালো ক্যারাটে জানতো। আর যখন নকশাল জমানায় পুলিশ ছাত্রদের লড়াই চলেছিল সে নাকি নির্ভূল নিশানায় বন্দুক চালিয়েছিলো। তার নিক্ নেম ছিলো ক্যাপ্টেন দাস অবশ্যই পাস করে পড়ে সে গ্লাসগো চলে যায়। আজ সেখানেই থিতু হোয়ে গেছে। এরকম আরো বহু জীবনের মোড় ঘুরানোর কাহিনী আছে। আবার চোখে জল নিয়ে আসা কাহিনীও আছে যেমন বিধবা মায়ের এক মেধাবী ছেলে পড়তে এসেছিল কিন্তু ছেলে ভিড়ে যায় সেদিনের নকশাল আন্দোলনে। সে প্রাণ হারায় একদিন বন্দুকের গুলির আঘাতে। সেই মায়ের পরে কিভাবে দিন কেটেছে তা আমার জানা নেই। আর সেই ছেলে শহীদ হয়েছিল তার সমাধি আজও আছে যেখানে যেদিন তার মৃত্যু হয়।আজও সেই দিনে মালা চড়ানো হয় শহীদ স্মরনে আর হয় শ্রদ্ধা নিবেদন। হায়রে প্রাণকারা আন্দোলন।

একাদশ পর্ব

মাঝে মাঝে সেকেন্ড হাফ্ এর ক্লাস শেষ করে আমরা ফার্স্ট গেট বা সেন্টিনারি গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার ওপারে সেন মহাশয়ের মিষ্টির দোকানে ঢু মারতাম আমরা। সেন মহাশয়ের ওটাই আদি দোকান ছিল বলে জানতাম। এখন কলকাতার অনেক জায়গাতেই সেন মহাশয় এর শাখা মিষ্টির দোকান আছে। মহাশয়ের দুইয়ে খুবই খ্যাতি ছিল তখন এবং এখনো আছে মানে সেই ট্র্যাডিশন সমানে ই চলেছে আর কি!

আরো মনে আছে ভোরবেলা শীতের দিনে ফাস্ট গেটের ভাড়ের চায়ের কথা। চা বানানো ছিল দেখার মত আর খেতেও তেমনি। এক মাটির গ্লাস ভর্তি সুগন্ধি চা, আহা কি তার জাদু আজও ভুলতে পারিনি আমি।

এরই মাঝে একটা ঘটনা ঘটে আমি তখন থার্ড ইয়ারের ফাইনাল দেবো। দাড়ি রোজ না হলেও দু'দিনে একদিন কামাতে হয় মানে ভরা যৌবন আর কি। বরোদা থেকে বিরমগাঁও এক্সপ্রেসে হাওড়া ফিরছিলাম গরমে ছুটির শেষে। তখন প্রায় দুদিনের রাস্তা ছিল সেটা। তাই পাশের যাত্রীদের সাথে আলাপ পরিচয় করে সময় পার করা হতো। আমার পাশের সিটে একজন মাঝ বয়সী মানুষ উঠলেন ভিলাই থেকে। ভদ্রলোক বাঙালি বাড়ি শিবপুরের দানেশ শেখ লেনে। একথা সে কথার পর পরিচয় একটু গভীরে গেছে যখন ভদ্রলোক প্রস্তাব দিলেন আমাকে উনার মেয়েকে সাইন্স সাবজেক্ট পড়ানোর জন্য। আমি রাজী হয়ে গেলাম। উনি আমাকে ওনার বাড়ির ঠিকানা আর ডাইরেকশন দিয়ে দিলেন। মনটা যেন এক অজানা আনন্দে উছলে উঠলো। হোস্টেলে পৌঁছে আমার রুম পার্টনারকে বলতে সে খুশিতে নেচে উঠলো। বলল "গুরু আজ ই চলে যা এ সুযোগ হাতছাড়া করলে সারা জীবন পস্তাবি।" আর আমিও পড়ন্ত বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম সাহসে বুক বেঁধে। পৌঁছে গেলাম দানেশ শেখ লেন এ বিগার্ডেনের পাশের গলি দিয়ে। মোড়ের মাথায় দেখি একটা ক্লাবে চার-পাঁচজন ছেলে আড্ডা মারছে। ওদের জিজ্ঞেস করলাম ঠিকানা দেখিয়ে বাড়িটা কোথায়। কারণ তখন তো আর আজকের মত মোবাইল ফোন ছিল না। সাথে সাথে উত্তর এলো "ও চিন্টুদার বাড়ি খুঁজছো? কি ধান্দা ভাই তোমার ওখানে অনেকদিন আগে আমরা ইট পেতে রেখেছি যেখান থেকে এসেছো ভালয় ভালয় সেখানে যাও ভাই। না হলে যা হবে তার জন্য আমাদের দোষ দিও না যেন। কেটেপড় কেটেপড় এক্ষুনি দেখি। আর দ্বিতীয়বার যেন এই পথে না দেখতে পাই তোমাকে।"

এসব শোনার পর বিপদের গন্ধ পেয়ে এক মুহূর্ত দেরি করিনি এক নিঃশ্বাসে সটান হোস্টেলে পৌঁছে তারপর স্বস্তির শ্বাস নিয়েছি প্রেমের স্বপ্ন দেখা সত্যিই তখন উবে গেছে এক ঝটকায়।

দ্বাদশ পর্ব

আমরা যখন থার্ড ইয়ারে সেকেন্ড গেটের সামনে তখন লিপি নামে নতুন একটা সিনেমা হল চালু হলো বোধহয় কলেজের ছেলেদের কথা ভেবেই। কারণ কলেজ পাড়ায় হাঁটা পথে সিনেমা হল হওয়ায় কলেজের ছেলেদের নাইট শো দেখে ফিরে আসতে সময়ও কম লাগতো। আর যখন হাউসফুল থাকতো কলেজের ছেলেদের জন্য এক্সট্রা চেয়ারের ব্যবস্থা করে দিত হল কর্তৃপক্ষ। ওই বাল ের প্রথম সিনেমা ছিলো রৌদ্র ছায়া। আর নায়ক-নায়িকা ছিল উত্তম কুমার ও অঞ্জনা ভৌমিক। ওই হলে দেখা সবচাইতে বড় সিনেমার কথা আজও মনে আছে মানে মুঘল ই আজম্ । জি সিনেমা য়ে তিনবার ইন্টারভেল ছিল আর আমরা তিনবার বেরিয়েছিলাম চা খেতে। আরো একটা ঘটনার কথা মনে আছে সেটা মনোরঞ্জন সিনেমার প্রিমিয়ার স্রোতে শামী কাপুর এসেছিল আর সেদিন শাম্মীকে সামনের থেকে দেখার জন্য প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়েছিল। ওই ভিড়ের মাঝে কেউ অভিনেতার চুল কেউ চেনা পাঞ্জাবি টুকরো এসব ছিড়ে নিয়ে এসে দেখিয়ে কি যে তৃপ্তি পেয়েছিল কে জানে। সেই সময় হোস্টেলে মাসে দুটো আইডি মানে ইনপ্রুভড্ ডিনার আর একটা গ্র্যান্ডফিষ্ট হোতো। সেই দিন গুলোর জন্য আমরা লুকিয়ে থাকতাম একটু ভালো খাবারের আশায়। কেউ কি বাবার গেস্টও নিয়ে আসতো। মাছ মাংসের স্পেশাল আইটেমের সাথে স্পেশাল মিষ্টিও আসতো সেই দিন। এই যেমন বর্ধমানের মিহিদানা সীতাভোগ এইসব আর কি। আর ভুলি বুঝে শেষে থাকতো একটা মিষ্টি পান সাথে একটা কিং সাইজ ট্রিপল ফাইভ সিগারেট্। যে সিগারেট আমরা দেখতাম সেই সময়ের হিন্দি সিনেমার নায়কদের ঠোঁটে।

আমার এখনো মনে আছে মাইকে হিট গান বাজানো হোতো বাংলা হিন্দি দুটোই। আর এরকমই এক গ্র্যান্ডফিষ্টে আমাদের পাশের হোস্টেল আট নম্বরে যা কিনা বর্তমানে ডক্টর ডি এনার্জি হল নামে পরিচিত সেই হোস্টেলে মাউথ পিসে শোলে সিনেমার আমজাদ খানেরসেই বিখ্যাত ডায়লগ সাথে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ তুলেছিল আমাদেরই এক ব্যাচমেট তার নামটা এখন আর মনে নেই। যেমন আমাদের আরো এক ব্যাচমেট যে কিনা ইলেকট্রনিক্স নিয়ে পড়তো, নিকনেম ছিল স্কাই ল্যাব যাকে বই পড়তে খুব কম দেখা যেত। শুনেছি সে নাকি বড় বড় লাইব্রেরীগুলো এই যেমন ব্রিটিশ লাইব্রেরী ন্যাশনাল লাইব্রেরী। আমেরিকান লাইব্রেরী ইত্যাদিতে ঘুরে বেড়াতো। সেই ব্যাচমেটের খোঁজ পাইনি আজও। জানিনা সে এখন কোথায় আছে।

একটা ঘটনা আজও মনে আছে।পরের দিন আমাদের ইলেকট্রিক্যাল অপশনাল সাবজেক্টের পরীক্ষা ছিল। একটা প্রবলেম কিছুতেই সলভ্ করতে পারছিলাম না। আর স্কাইল্যাব রাত দশটার সময় বাড়ি থেকে এসে মেসে ডিনার করেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আমরা পাশের ঘরে একটা প্রবলেম নিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছি। ওকে ডাকা হল একটু গাইগুই কোরে তারপর উঠে ও প্রবলেমটা সলভ করে দিয়েই শুয়ে পড়ল। জিনিয়াস না হলে কি এমনটা কেউ পারে। সেই বন্ধু আমাদের ভালো গান গাইতে পারতো, ভালো ক্যারম খেলতো, ভালো লিখতো, টেবিল টেনিসে ও সে ওস্তাদ ছিল আর ব্রীজটাও ভালোই পারতো। কোথায় যে হারিয়ে গেল কলেজ থেকে পাশ করে বেরোনোর পর কেউ জানে না। জিনিয়াসরা বোধ হয় এরকমই হয়।

ত্রোয়োদশ পর্ব

আরো কিছু ঘটনা আজও দাগ কেটে আছে যেমন দু'পয়সা বাস ভাড়া বেড়ে যাওয়ার ঘটনা। হাওড়া থেকে বি গার্ডেন মানে বোটানিক্যাল গার্ডেন পর্যন্ত বাস ভাড়া ছিল আঠেরো পয়সা। এটা বহুদিন থেকেই চলছিল অন্তত আমি যতদিন থেকে কলেজে এডমিশন নিয়েছিলাম তখন থেকে তো বটেই। কিন্তু হঠাৎ কোরে একদিন দু'পয়সা বেড়ে গেল বাস ভাড়া এবং ওই বাস ভাড়া বেড়ে যাওয়ার কারণে কথা কাটাকাটির জেরে এক বাস কন্ডাক্টর কলেজের এক আবাসিক ছাত্রকে গায়ে হাত দিয়ে বসে আর তার ফল হোলো চার দিন ওই রুটের সব বাস বন্ধ। আর অনেক বাসেরই টায়ার খুলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল এক রকম লঙ্কাকাণ্ডই বটে।

যাই হোক পরে কলেজ কর্তৃপক্ষের মধ্যসত্ত্বায় চার দিন বাদে আবার বাস পরিষেবা স্বাভাবিক হয়েছিল।

আরো একটা ঘটনা মনে আছে তখন ছিল ইমারজেন্সির সময় মিটিং মিছিল একদমই নিষিদ্ধ ছিল সে সময়ে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়। কিন্তু কোন একটা ইস্যুতে আমরা কলেজের ছেলেরা মিছিলে হেঁটেছিলাম। পুলিশ শুধুই দাঁড়িয়ে দেখেছিল। সেই মিছিল গিয়েছিল শালিমার রেল ক্রসিং পর্যন্ত।

আর একবার আমাদের হূজুগ উঠলো হোস্টেলের ছেলেরা মিলে বাস ভাড়া করে শান্তিনিকেতন,মেসেঞ্জোর, তারাপীঠ বেড়াতে যাওয়ার। সেই পঞ্চান্ন নম্বর রুটের একটা বাস ভাড়া করা হয়েছিল। দিন চারেক ঘুরেছিলাম শান্তিনিকেতন,তারাপীঠ আর বক্রেশ্বর দেখা হয়েছিল শুধু মেসেঞ্জোর যাওয়া হয়নি। তারাপীঠে তো আমরা মানে আমি আর আমার রুম পার্টনার কাপালিকের হাতে পড়তে পড়তে কোনরকমে বরাদজোরে রক্ষা পেয়েছিলাম। রাস্তা হারিয়ে রাস্তায় এগারোটার সময় আমরা দিশাহীন হয়ে শ্মশানের দিকে চলে গিয়েছিলাম। সেও ছিল এক রুমোহর্ষক অভিজ্ঞতা। এই বাস জার্নি শেষ করে যেদিন আমরা হোষ্টৈলে পৌঁছালাম সেদিন ছিল রিইউনিয়নের শেষ দিন মানে আধুনিক গানের পাঁচ মিশেলি ফাংশন। আর নিন আর্টিস্ট ছিলেন সেকালের সবচেয়ে দামি কণ্ঠশিল্পী মান্না দে। মনে আছে গোটা পঁচিশেক এর হিন্দী আর বাংলা গান গেয়ে মান্না দে আসর মাতিয়ে দিয়েছিলেন। ওনার সাথে তবলা সঙ্গতে ছিলেন প্রবাদপ্রতিম তবলিয়া রাধাকান্ত নন্দী। আসর একদম জমিয়ে দিয়েছিলেন ওরা।

আমাদের সময়ে চার দিনের ইউনিয়ন হোতো। রবীন্দ্র নজরুল সন্ধ্যা দিয়ে শুরু হোতো। তার পরের দিন উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান সেই সময়ে ভারতের সব দিকপাল উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পীরা আসতেন।তার পরদিন সেই সময়কার কোন সুপারহিট নাটক আর শেষ দিন হিন্দি বাংলা মিলিয়ে পাঁচ মিশেলি বিচিত্রানুষ্ঠান দিয়ে রিইউনিয়ন শেষ হতো। আবার কখনো বা নাটকের বদলে আনন্দ শংকরের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড লেজার অনুষ্ঠানের কথা মনে আছে সেও এক সুন্দর দৃষ্টি নন্দন অভিজ্ঞতা।

আরো মনে আছে প্রত্যেক উচাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান শেষে আমাদের কলেজেরই প্রফেসর সনৎ বিশ্বাসের স্ত্রী জয়া বিশ্বাস এর সেতার বাজানোর কথা। নি পন্ডিত রবিশঙ্করের প্রিয় ছাত্রীদের একজন ছিলেন। আর উনি প্রোগ্রাম শুরু করতেন ঠিক ভোর চারটের সময়। যেন সাক্ষাৎ মা সরস্বতীর আগমন ঘটতো স্টেজে। সেতার হাতে ওনার সেই পবিত্র উপস্থিতি আজও ছবির মত মনে পড়ে।সেই সুরের মূর্ছনা ভোলার নয়। সেই সুরের রেশ আজও কানে লেগে আছে।

চতু্র্দশ পর্ব

দেখতে দেখতে আমার হোস্টেল জীবনের শেষ বছর এসে গেল। মানে এবার আমি পারের কিনারায় পৌঁছে গেছি। জীবনের একটা বড় ধাপ শুধুমাত্র পেরোনোর প্রতীক্ষা মাত্র। ফাইনাল ইয়ারে আমরা সবাই সিঙ্গল সিটেট হোস্টেলে শীফ্ট করলাম আমাদের হোস্টেলের নাম ছিল সেনগুপ্ত হল। এই সিনিয়র হোস্টেল গুলো সবই ছিলো সাহেবপাড়ায়। একমাত্র উলফেনডেন হলটাই ছিলো শুধু মুচিপাড়ায় বিখ্যাত ওভাল গ্রাউন্ডের ঠিক পাশেই। আমার আরও দুজন রুম পার্টনার যাদের মধ্যে একজন না ফেরার দেশে চলে গেছে বেশ কিছুদিন আগেই। সবাই আমরা পাশাপাশি ঘর পেয়ে গেলাম দোতলায়। ওই হোস্টেলের পাশেই ছিল ব্রিটিশ পেইন্টস এর কারখানা। হয়তো আজও আছে। কারখানার শব্দ মাঝে মাঝেই ভেসে আসতো। ধীরে ধীরে একা থাকার আর আত্মনির্ভর হওয়ার অভ্যেস গড়ে উঠেছিলো।

এটাই পরিবর্তনের সূচনা। তোমার আমি সেই সময়ে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের দিকটা একটু তুলে ধরছি।

সেই সময় মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। আর তার সরকারের ছিল সেটা শেষের দিক ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আয়রন লেডি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তখন বিরোধীরা মানে বামফ্রন্ট সহ সব বিরোধী পার্টিরা জনতা দলের ব্যানারে এক ছাতার তলায় জমা হয়েছিল। আর তার নেতা ছিলেন সর্বদোয় আন্দোলনের দিশারী আচার্য বিনোভা ভাবের উত্তরসূরী জয়প্রকাশ নারায়ণ সাথে মোরারজী দেশাই রাজনারায়ণ এরা সব। সেটা ছিল ১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি সময়। তখন ভারতের রাজনীতিতে টালমাটাল অবস্থা। কিছুদিন আগেই ইমারজেন্সি ঘোষণা করে জয়প্রকাশ নারায়ণ কে জেলবন্দী করে অকথ্য অত্যাচার করেছে তার উপর। একটা কিডনি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেই অত্যাচারে ফলে‌। ওঁকে তখন জে পি অথবা লোক নায়ক নামে দেশের মানুষ অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে এক ডাকে চেনে। আবার তখন সংস্কৃতি সৃষ্টির পৃথক স্থান কলকাতার বিভিন্ন নাট্য মঞ্চে সব রথী মহারথীরা বিচরণ করছেন যেমন উৎপল দত্ত,অজিতেশ ব্যানার্জি, শম্ভু মিত্র সহ আরো অনেকে। তাই তীব্র আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে কলকাতার রাজপথে। অবশ্যম্ভবী ভাবেই সেই আন্দোলনের ধাক্কা আমরাও টের পাচ্ছি,

বেশ মনে আছে। আমাদের একজন ব্যাচমেট ছিল যে আজ সিপিএম এর এক বড় তাত্ত্বিক নেতা রাতের ডিনারের পর যখন আমরা শুয়ে পড়েছি হঠাৎ ঘরে ঘরে এসে ডাক দিল।"চল্ লর্ডসে যাবো।"সবাই একসাথে হাতে একটা করে মশারির ষ্ট্যান্ভের লোহার রড নিয়ে আমরা লর্ডসের দিকে হাঁটা দিলাম ওই মধ্যরাতে।

ওরা খবর পেয়েছিলখবর কিছু লোক নাকি গঙ্গার ওপার থেকে এসে কলেজ আক্রমণ করবে। পরের দিন প্রায় ভোর পর্যন্ত আমরা লর্ডসের খোলা মাঠে কাটিয়ে আবার যে যার হোস্টেলের ঘরে ফিরে এলাম। এসে আবার ক্লাসেও এটেন্ড করেছিলাম সেদিন। খবরটা গুজব ছিল না কিন্তু । এক ডাকে প্রায় সব আছে ছাত্রের জমায়েতের খবর পেয়ে ওরা আর কলেজ মুখো হয়নি সেরাতে। এরকম টাল মাটাল দিন কাটাতে কাটাতেই আমরা ফাইনাল এক্সাম দিয়ে দিলাম। শেষ হলো আমাদের পাঁচ বছরের হোস্টেল জীবন।আবার ফিরে এলাম গতানুগতিক জীবনে। সেই চির নবীন যাদবপুরের সেন্ট্রাল রোডের ভাড়া বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে।

পঞ্চদশ পর্ব

মাস তিনেক একটু দম ফেলার সময় পাওয়া গেল। কারণ রেজাল্ট বেরোতে মাস তিনেক মতন লাগবে। তাই একটু পাড়ার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা মেরে চায়ের দোকানে বসে চা খাওয়া ওই বড়রা যা করে আর কি ,এইসব শুরু হলো। বুঝতে পারলাম আমি এখন হঠাৎ করে বড় হয়ে গেছি। এবারে রেজাল্ট বের হোলো। পাস করে গেলাম। এবার ঝাঁপানোর পালা চাকরির খোঁজে। কিন্তু কোথায় কি। মাঝে মাঝে ইন্টারভিউ আসে কলকাতা থেকে দূরে ভিন্ রাজ্যে যেতে হ'বে বলে মন চায় না। আর অনেকদিন বাদে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর পাড়ার পরিবেশ ছেড়ে ভিন্ রাজ্যের বা অন্য জায়গায় চলে যেতে মনও সায় দেয় না। তাই চেষ্টা মানে অ্যাপ্লিকেশন করা চলতেই থাকে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে আর মাঝে মাঝে কলেজের প্লেসমেন্ট থেকেও ইন্টারভিউ অ্যাটেন্ড করে।

মাঝে মাঝে ঢেউয়ের মতো এক একটা ইন্টারভিউ কল আসে কিন্তু চাকরির রূপ পায় না কারণ সেই একই দূরে যেতে হবে যে। কিছু অবশ্য সিলেক্ট না হওয়ার জন্য হবে। কিন্তু আড্ডা জোর কদমে চলে সেই অতি পরিচিত নয় নম্বর ওয়ার্ডের মোড়ে, অনিলদার টেইলারিং এর দোকানে বোসে। এমন আড্ডা মারতাম আমরা যে অনিলদার পার্টিটা আমরা বসে বসে প্রায় ক্ষইয়ে দিয়েছিলাম। আমরা যখন পাশ করে বের হই তখন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর মার্কেট খুব রমরমা ছিলো। আমার অনেক ব্যাচমেটই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল পাশ কোরেই। মাঝে মাঝে দেখা হোতো ওদের সাথে। ভাবতাম কবে আমারও এরকম চাকরির সুখ হবে। আবার মাঝে মাঝে মনে হতো বেশ তো চলছে চলুক না। এরকম একটা দিশাহীন সময়ের মধ্যে পারারই এক মোহময়ীর আকর্ষণ অনুভব করলাম। সে রোজ অনিল দার দোকানের পাশ দিয়ে সেতার হাতে গানের ক্লাসে যেত বিকেলের দিকে। তার যাওয়া আসার পথে চাতক পাখির মত তাকিয়ে থাকার মধ্যে যে নেশা ছিল তা বলে বোঝানো যাবে না আজ। ঠিক যেন সে যখন যেত আমার মনের গীটার ঝংকার তুলতো "মোর বীণা ওঠে কোন সুরে বাজি।-----।"যাইহোক পরে জানা গিয়েছিল সেই মোহময়ী অন্য একজনের বাগদত্তা। যখন সত্যিটা জানতে পারলাম সে এক কঠিন করুন অবস্থা। মনে আছে মনের দুঃখ ভোলার জন্য আমি আর আমার এক বন্ধু দাগার মাঠে সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে পাঁচ টাকার বিয়ার খেয়েছিলাম দাঁত দিয়ে ছিপি খুলে। একদম ব্যর্থ নায়কের মতন। যাই হোক এরকম সাত-আট মাস কাটানোর পর টিটাগরে একটা চাকরি পেয়ে গেলাম। বেকারত্ব ঘুচলো আমার। শেয়ালদা সাউথ থেকে মেইন লাইনে তিন শিফটে ডেইলি প্যাসেঞ্জারী কোরেছি প্রায় এক বছর। এরই মাঝে আমার পিতৃবিয়োগ হোলো। আর তার কিছুদিন বাদেই একটা বহুজাতিক কনস্ট্রাকশন কোম্পানি থেকে ইন্টারভিউ পেলাম। আর সিলেক্ট হয়ে চাকরিও পেয়ে গেলাম প্রথম পোস্টিং ছিল এখনকার পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়ার হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার প্রোজেক্ট সাইটে । ধীরে ধীরে আমার কলকাতার বাস উঠে গেল। আর উরো খৈ এর মতন কখনো দেশে আবার কখনো বিদেশে চাকরি জীবনের সূত্রপাত হোলো তারপর।যার রেশ এবং স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি আমি এক অতি সাধারন মানুষ।

.    .    .

Discus