বিবেকানন্দ ও ভারত দর্শন সম্বন্ধে বলতে যাওয়া আর অত্লান্ত মহাসাগরের সামনে দাঁড়িয়ে মহাসাগরের গভীরতা মাপার মতোই দুঃসাহস ছাড়া আর কিছু নয়। তাই এই প্রবন্ধটিকে কিছুটা গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করার মতো চেষ্টাও বলা যেতে পারে।
এই প্রসঙ্গে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের নাম যিনি বলেছিলেন “বিবেকানন্দের কথা যখন ভাবি তখন মনে পড়ে দেশের জন্য ব্যাথা কি কখনো শরীরেরই হয়? যদি কখনো কারোর হয় তখন বিবেকানন্দকে বোঝা যাইতে পারে তার আগে নয়।”গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন শান্তিনিকেতনে আছেন আর ফ্রান্স থেকে এসেছেন রোমা রোলাঁ তখন মহাত্মা গান্ধীজীর কাছে।
রোমা রোলাঁ সেই সময় গান্ধীজিকে জিজ্ঞেস করেন তিনি ভারত বর্ষ সম্বন্ধে একটি বই লিখবেন। তিনি পুরো ভারতবর্ষের চিত্র অর্থাৎ ভারতবর্ষের ধর্ম শিল্প সাহিত্য
সংস্কৃতি এবং আরও অনেক কিছু সম্বন্ধে জানতে চাইলেন গান্ধীজীর কাছে। কারণ তাঁর বিবেচনায় ভারতবর্ষ শুধুই এক ভৌগোলিক ভূখণ্ড মাত্র ছিলোনা। গান্ধীজী রোমা রোলাঁ কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন রোমা রোলাঁকে
কবিগুরু বলেছিলেন “যদি তুমি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তাহলে বিবেকানন্দকে জানো কারণ তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক নেতিবাচক কিছুই নেই।” কি শ্রদ্ধার প্রকাশ পরস্পরের প্রতি। একজন গুণী ই আরেকজন গুণীকে এইভাবে উপলব্ধি করতে পারে। ঠিক সেই কারণেই আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের বিবেকানন্দ সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করার আগে আমাদের ভাবতে হবে যে আমরা তাঁর মূল্যায়ন করার প্রকৃত যোগ্যতা অর্জন করেছি কিনা। আমাদের ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে শুধুমাত্র ভাবনার বশবর্তী হলেই হবে না
কারণ বিবেকানন্দ শুধুই পড়ার বিষয় নন তিনি অনুভব ও উপলব্ধির বিষয়ও বটে। নিবন্ধ মানে কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি নন। বিবেকানন্দ মানে সীমাহীন বিশাল জ্ঞান। বিবেকানন্দ মানে এক জলন্ত আদর্শ। তিনি মূর্তিমান ধর্ম। ধর্ম জগতের তিনি মূর্তিমান প্রেম। এই জগতে যা কিছু ভালো তারই সমাহার হচ্ছেন বিবেকানন্দ। তাই তিনি যুগ নায়ক আর তিনিই যুব নায়ক। ভারতবর্ষের গৌরবময় অতীতের শিক্ষায় বর্তমানকে উদ্ভাসিত করে সোনালী ভবিষ্যতের দিশারী। সারা পৃথিবী তাই তাঁর জন্মদিন বারোই জানুয়ারিকে যুব দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কেননা যুবক-যুবতীদের মনের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর একমাত্র তাঁর কাছেই খুব সহজ ভাষায় পাওয়া যায়। একমাত্র তিনিইসমস্ত ধর্মগুরুদের, মনীষীদের শ্রদ্ধা ভরে তাদের সম্বন্ধে তাঁর বাণী দিয়ে গেছেন। যদি আমরা তাঁর দৃষ্টি দিয়ে দেখি তাহলে সকলের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমাদের বহুগুণ বেড়ে যাবে। স্বামী বিবেকানন্দ সেই সময়কার ব্রিটিশ অধিকৃত বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে ভারতবর্ষের কথা বলেছেন সেটা ছিলো পরাধীন ভারতবর্ষে যা ছিলো ইংরেজদের অধীন। ছোটো থেকে বড় সকলেরই জানা আছে ইংরেজরা কি রকম নির্মম ছিলো। আর আমাদের দেশকে যখন সেই ইংরেজরাই পরাধীন করে রেখেছে বিবেকানন্দ তখন তাঁর
দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন “পরাধীন দেশের কোন ধর্ম নেই।”তখন কোনো অন্য সংগঠন ছিল না ধর্ম প্রচারের জন্য আর থাকলেও তারা ম্রীয়মান হয়ে পড়েছিলো। সেই সময় তিনি বুঝেছিলেন এখন ধর্মের দরকার নেই। সবার আগে দরকার শক্তির। সেজন্যই তিনি আগুনঝরা বাণী দিলেন। যে বাণী পড়ে ও শুনে বিপ্লবীরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো এবং তাঁদের জীবন
দেশের জন্য উৎসর্গ করেছিলো। তাঁরা সবাই ছিলেন হীরের টুকরো ছেলে। কেউই সাধারণ ঘরের সন্তান ছিলেন না। শহীদ ক্ষুদিরাম বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার সকলে নিজের ভক সুখ ত্যাগ করে স্বামীজীর বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজদের সাথে লড়াই করেছিলেন বিষমাত্রিকাকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে।
স্বামীজী বলেছিলেন এখন শক্তির দরকার। রজোগুন দরকার কারণ ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। গোটা দেশ তামসিকতায় আচ্ছন্ন। তখন তাকে ধর্মের কথা শোনানো যায় না। তাই তিনি বলেছিলেন“আগামী পঞ্চাশ বছর অন্যান্য অকেজো দেবতারা উড়ে যাক্ একমাত্র দেবতা হোক আমাদের মাতৃভূমি ভারতবর্ষ।”তাই তিনি কি খেতেন, কি করতেন কাদের সাথে মিশতেন এসব বড় কথা নয় বড় কথা হোলো তিনি মাছ খেয়ে মাংস খেয়ে ধূমপান করে যে অবস্থায় পৌঁছেছিলেন আর কেউ সেই অবস্থায় পৌঁছেছিলেন কিনা সেটাই বড় কথা। আর তিনি হিসাব করেও ভারতবর্ষের জন্য যে অবদানটি রেখে গেছেন সেটি আর কেউ রাখতে পেরেছেন কিনা সেটা জানা নেই। স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সেই অগ্নিময়ী বাণী আমরা কখনোই পেতাম না। ভারতবর্ষের সেই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় লর্ড রোনান্ডসে নামে একজন অত্যাচারী গভর্নর ছিলেন। তিনি যখন বিপ্লবীদের ব্যাগ তল্লাশী করতেন তখন সেই ব্যাগের মধ্যে পেতেন কোনো আগ্নেয়াস্ত্র বা বোমা কিছুই নয়। এদের ব্যাগ তল্লাশী করে পাওয়া যেতো মাত্র দুটি বই ও একটি ছবি। বই দুটি হোলো
শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ও স্বামীজীর বাণী এবং সাথে স্বামী বিবেকানন্দের
তেজোদীপ্ত ছবি।
তাঁর স্বদেশমন্ত্র যারা পড়েছেন বা জানেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন সেই স্বদেশ মন্ত্রটি কোন সংস্কৃত শ্লোক নয়। তিনি বলেছেন“হে বীর সাহস অবলম্বন করো মুচি, মেথর, অজ্ঞ তোমার রক্ত তোমার ভাই।”বলেছিলেন “ওঠো জাগো লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমোনা।”আর বলেছিলেন“সাধনায় সিদ্ধি লাভ কিংবা শরীর পাতন।”তিনি কেবল বলেই ক্ষান্ত হননি। তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন দেশ এবং দেশবাসীকে আর তাঁর মতো করে ভারতবর্ষকে ভালবাসতে আর কেউ পেরেছেন বলে জানা নেই। তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেছেন দরিদ্রকে আর আর্ত ও পিড়িত মানুষের সেবার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন রামকৃষ্ণ মিশন যার আদর্শ হোলো “আত্মানাং মোক্ষার্থঙ জগদ্ধিতায়চ।”
আগে জীবন দর্শন ছিলো নিজের মুক্তি। সেটা হলেই মোক্ষলাভ হয়ে গেলো। স্বামীজীও কি পারতেন না নিজের মুক্তির জন্য হিমালয়ের কোন গিরিগুহায় গিয়ে সাধনা করতে? কিন্তু তিনি যান নি অথবা বলা ভালো যেতে পারেননি। তাই একদিন যখন তিনি ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণকে জানালেন যে শুকদেবের মতো দিনরাত তিনি নির্বিকল্প সমাধিতে ডুবে থাকতে চান। তখন ঠাকুর তাঁকে বললেন “তাঁকে যে শুধু নিজের মুক্তি চাইলেই হবে না তাঁকে হতে হবে বিশাল বটগাছের মতন যার ছায়ায় এসে পৃথিবীর মানুষ শান্তি লাভ করবে।” এই কথা বললেও ঠাকুরের কৃপায় কাশীপুরের উদ্যান বাটিতেই তিনি একদিন সাধন মার্গের সর্বোচ্চ উপলব্ধি নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেছিলেন। সমাধি ভাঙলে ঠাকুর তাঁকে বলেছিলেন এই উপলব্ধির চাবি তিনি তাঁর নিজের কাছেই রেখে দিলেন। বিশ্বসংসারের প্রতি তাঁর কর্তব্য যখন শেষ হ’বে তখনই তিনি নিজের হাতে এই উপলব্ধির দুয়ার আবার খুলে দেবেন। কাশীপুরেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন একটি কাগজে লিখে দেন “নরেন শিক্ষা দেবে।”এর অন্তর্নিহিত অর্থ ছিলো ভারতের যে শাশ্বত আধ্যাত্মিক চেতনা তিনি নিজের জীবনে রূপায়িত করেছেন স্বামীজীই তা জগতে প্রচার করবেন তখন অবশ্য তিনি বিবেকানন্দ হননি তাঁকে ঠাকুর “নরেন” নামেই ডাকতেন। তাই যখন নরেন্দ্রনাথ আপত্তি জানান তখন ঠাকুর বলেছিলেন “তোর হাড় করবে।”অর্থাত স্বামীজীকেই করতে হ’বে।
এই নির্বিকল্প সমাধিকেই ঈশ্বর লাভ বলা হয়ে থাকে। তিনি ১৮৯৬ সালে টেসলারকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন “সমস্ত ভারতীয় আমার ভাই, সমস্ত ভারতীয় আমার জীবন,
ভারতের দেবদেবীরা আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শৈশবের দোলনা, আমার যৌবনের আনন্দ উদ্যান, ভারতের মৃত্তিকা আমার পবিত্র স্বর্গ আমার বার্ধক্যের বারাণসী।” এর আগে এরকম কথা কেউ বলেছেন কিনা তা জানা নেই। ১৮৯৭ তাহলে স্বামীজী বিশ্বজয়ী হয়ে দেশে ফিরেছেন। মার্কিন মুলুকে গিয়ে যখন তিনি ভারতের কথা বললেন আর বিশ্বজয়ী হ’লেন সেটা কাদের জন্য ছিলো? শুধুমাত্র তিনি কি হিন্দুদের জন্যই গেছেন না সব ধর্ম নির্বিশেষে আপামর ভারতবাসীর জন্য গেছেন? এই ইতিহাস তো আমাদের অজানা নয়। তিনি সেখানে গিয়েছেন এবং
বিশ্ব বিজয় করেছেন ও ভারতবর্ষে ফিরে এসেছেন। বিদেশে তাঁকে নরম মখমলের বিছানায় শুতে দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেই বিছানায় তিনি শুতে পারেননি। কারণ দেশের মানুষের কথা ভেবে তাঁর দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়েছে ভিজে গেছে তাঁর বালিশ। এরকম মহাপ্রাণ বিরলের থেকেও বিরল। পৃথিবীতে সকলেই তো ধর্মের বাণী শুনেছেন ধর্মগুরু হয়ে। অবশ্যই শ্রদ্ধেয় তাঁরাও। তাঁদেরকেও আমি শ্রদ্ধা জানাই। তবুও স্বামীজী সেই সব ধর্মগুরুদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি শুধুমাত্র ধর্মগুরুই নন তিনি যে একাধারে আমাদের আচার্য, শিক্ষক, অভিভাবক, পথপ্রদর্শক এবং বন্ধু। সবার উপরে তিনি এক উজ্জ্বল আদর্শ। মানবজাতির পরম সুহৃদ যে তিনিই। তাঁর আগে ছিলো ধর্মের জন্য মানুষ তিনিই বললেন মানুষের জন্যই ধর্ম। তাই তাঁর কথায়“যে ধর্ম বিধবার অশ্রু মোছাতে পারেনা, যে ধর্ম গরীবের মুখে একমুঠো অন্য তুলে দিতে পারে না সেই ধর্ম বা ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করিনা।”কারুর প্রচন্ড খিদে পেলে কি তাকে কোন ধর্মগ্রন্থ তুলে দেওয়া হবে
ক্ষুধা বৃত্তির জন্য? না তাকে পেট ভরে খেতে দেওয়া হবে? ভারতবর্ষে যে ক্ষিদেটা জাঁকিয়ে বসেছিলো সেই ক্ষিদেটাই বিবেকানন্দ অনুভব করেছিলেন ত্যাগের বস্ত্র পড়ে। তিনি অতবড়ো রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে এসেছিলেন। সারা ভারতবর্ষ তিনি পায়ে হেঁটে ছিলেন দেশের মানুষকে জানার উদ্দেশ্যে সেই কারণেই তিনি ভারত আত্মা তিনিই যে ভারত পথিক। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম উদাহরণ বিরল। তিনি আমেরিকা গেলেন ভারতের জন্য খাদ্য আনতে। কেননা ধর্ম এখানে প্রচুর আছে। এখানে খাদ্য নেই, শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই। সেই কারণেই তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন রামকৃষ্ণ মিশন। সবাই দীক্ষিত হয়ে মিশনে যোগ দেবে বলে তিনি তা করেননি। কারণ রামকৃষ্ণ মিশন কোনো দল বা সম্প্রদায় নয়। বাবুরাম- মহারাজের কথায় “ভালোবাসায় সমগ্র জগত জয় করাই হোলো রামকৃষ্ণ মিশনের মিশন।”
কেউ জ্ঞানের পথ দিয়ে কেউ যোগের পথ দিয়ে আবার কেউ কর্ম ও ভক্তির পথ দিয়ে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। তিনি কোনও একটি নির্দিষ্ট পথ বলে দেননি। কারণ একজনের পক্ষে যেটি ভালো অন্যজনের কাছে তা ভালো নাও হতে পারে। সেটিকে স্বামীজী উল্লেখ না করে সবার জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন “যে পথেই তুমি যাও না কেন সেই ঈশ্বরকেই লাভ করবে।”আগের বিশ্বাস ছিলো শুধুই নিজের মুক্তি আর নিজে সাধনা করো নিজে মুক্তি লাভ করো। স্বামীজী নতুন দর্শন আনলেন “শুধুমাত্র নিজের মুক্তি হলেই হবে না সাথে সাথে জগতের কল্যাণও চাই। ভারতবর্ষে অগণিত অসহায় মানুষের বাস। কি করে তারা সেই পরম লক্ষ্যে পৌঁছবে। এমন অবস্থায় স্বামীজী এমন এক ব্যবস্থা করলেন যাতে তাদেরকেও ধর্মপথে নিয়ে যাওয়া যায়। তিনি ধর্মকে ব্যক্তি মুক্ত করে দিলেন। তিনি বললেন বেদান্তের কথা যে বেদান্ত বলে প্রতিটি মানুষ এবং প্রতিটি প্রাণীর ভেতর বিরাজ করছে সেই একই ব্রহ্ম। সেই
ব্রহ্মেরই অবতার যাঁকে আমরা কৃষ্ণ বলছি, বুদ্ধ বলছি, যীশু বলছি আবার রামকৃষ্ণ, শিব এবং কালী ইত্যাদিও বলছি। তাই এই নিয়ে কেন এতো বিভেদ হ’বে? রাম কে যিনি উপলব্ধি করেছেন তিনি তো কৃষ্ণকেও উপলব্ধি করবেন কারণ এঁরা কেউই আলাদা নন। ঠাকুরের কথায় “যে এক করতে পেরেছে সে ই ধন্য।” তাইতো তিনি বলেছেন “যত মত তত পথ।”
তাই উদাহরণ স্বরূপ বলা হয় একটা গাড়িতে রাম যাচ্ছেন কৃষ্ণ যাচ্ছেন বুদ্ধ যাচ্ছেন যীশু যাচ্ছেন আর একটা গাড়িতে হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতি যাচ্ছে। দেখা যাবে যে গাড়িতে রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ ও যীশু আছেন সেই গাড়িতে কোন আওয়াজ নেই। আর যে গাড়িতে হিন্দু,মুসলমান,খ্রিস্টান ও অন্যান্যরা আছেন সেখানে তারা সবাই গণ্ডগোল করছেন। কারণ আগের বাড়িতে যাঁরা আছেন তাঁরা জানেন যে তাঁরা সকলেই এক। তাই আমরা যদি ধর্মের দর্শনকে ঠিকঠাক উপলব্ধি করতে না পারি তবে ধর্ম শুধু কথার কচকচানি ই হয়ে থাকবে তাতে লাভের লাভ কিছুই হ’বে না। ঈশ্বরকে দর্শন করতে হ’বে,অনুভব করতে হবে এবং তাকে ভালবাসতে হ’বে। ঠাকুর বলেছেন “যো সো করে তাঁকে লাভ করতে হ’বে, তুমি যেমন করেই হোক ঈশ্বরকে ভালোবাসো।”
আসল কথা হোলো যে ব্যক্তি
ঈশ্বরকে ভালোবাসে ঠাকুর তাঁর কাছে ছুটে যান। যিনি রাম কে ভালবাসেন তাকেও দক্ষিণেশ্বরে আলিঙ্গন করেছেন আবার যিনি কৃষ্ণকে ভালবাসেন তাকেও তিনি বুকে টেনে নিয়েছেন। সেই কারণেই তিনি সর্বধর্ম সমন্বয় সাধন করেছেন। তিনি এই সমস্ত কিছু নিজের জীবনে করে দেখিয়েছেন। তিনি সব রকম সাধনা করলেন এবং তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। এইরকম সর্বমতে পথ চলা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনও দেখা যায়নি। তিনি সাধনা করলেন এবং সাধনা করে সকলের জন্য বললেন
“যত মত তত পথ।”তার মর্মার্থ হোলো যে তোমাকে কারোর পথ অনুসরণ করতে হবে না। তুমি যে পথে আছো সেই পথটিকেই যদি ঠিকঠাক পালন করতে পারো তাহ’লে তুমি ঠিকই পৌঁছে যাবে সেই একই ঈশ্বরের কাছে। পাশেই দক্ষিণেশ্বরে স্বামী বিবেকানন্দ শুনলেন “শিব জ্ঞানে জীব সেবা।”
বর্তমান সময় দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণ মিশন মানুষকে কম্বল দান করছে। এসব শুধুই দয়া ভাব নয় এটা মানুষকে নারায়ণ জ্ঞানে সেবা। আগে মন্দিরে শুধু ধর্ম ছিলো যা শুধুমাত্র মন্দিরেই সীমাবদ্ধ ছিলো। স্বামীজী মন্দির থেকে সেই ধর্মকেই টেনে ছড়িয়ে দিলেন সর্বস্তরে। হয়তো একজন মুচি জুতো সেলাই করছে সে মন্দিরে না এসেও যদি সে ঈশ্বরের কাজ বলে শ্রদ্ধার সাথে তার নিজের কাজ করে করে যায় তাহ’লে সে একই জিনিস উপলব্ধি করতে পারবে। যখন কোন মানুষকে সেবা দেওয়া হয় এবং নারায়ণ জ্ঞানের সেই সেবাটি করা হয় তখন সেই সেবাটিই হয়ে যাবে সেবা যোগ। তাই বেদান্ত কে স্বামীজি সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
ভজনালয়ে, বিদ্যালয় ও বিভিন্ন যে সমস্ত কর্মক্ষেত্র রয়েছে সেখানেও। ধর্ম শুধুমাত্র মন্দির, মসজিদ আর গির্জাতেই সীমাবদ্ধ রইলো না স্বামীজী তাকে ছড়িয়ে দিলেন সর্বস্তরের মানুষের কাছে। তাইতো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “বিবেকানন্দ প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মিলন ঘটিয়েছেন।”স্বামীজী ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের মিলন ঘটিয়েছেন।। তিনি ধর্ম বলতে কোন নির্দিষ্ট দল বা মতকে বোঝান নি। তিনি বলতেন “ধর্ম কোলকাতা থেকে কেদারনাথ গমন নয় ধর্ম হোলো হিংসা থেকে অহিংসার পথ অনুসরণ করা।” আমাদের মধ্যে যে খারাপ গুণ গুলো আছে যেমন হিংসা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মায়া, মোহ, স্বার্থপরতা এগুলো সরে যাবে। ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে ক্ষমা, দয়া, পবিত্রতা, নিঃস্বার্থপরতা, সত্যবাদিতা এগুলি জন্ম নেবে। আর যে মানুষটির মধ্যে এগুলো জন্ম নেবে সেই মানুষটি দেব মানব হয়ে যাবে। তাই তিনি বলেছেন “আমার মূল কথাটি হোলো এই দেবত্বকে প্রচার করা। মানুষের মধ্যে জন্ম থেকে যে দেবত্ব আছে তারই বিকাশ হোলো ধর্ম। তাই তার বিকাশ যে পথেই হোক সেই পথই গ্রহণীয়। সেই কারণেই বিবেকানন্দকে ছাড়া ভারতবর্ষের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্প কিছুই বোঝা যাবে না ধর্ম তো একদমই নয়।
আরেক দেশনায়ক নেতাজী সুভাষচন্দ্র বলেছেন
“বিবেকানন্দ সম্বন্ধে কিছু লিখতে বা বলতে গেলে আমি আত্মহারা হয়ে যাই। খুব কম লোকের পক্ষেই এমনকি তাঁর সংস্পর্শে যাঁরা ছিলেন তাঁদের পক্ষেও তাঁর সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা বা তাঁকে গভীরভাবে বুঝতে পারা অসম্ভব বলিয়াই মনে করি।”
সুগভীর জটিল ও ঋষিসুলভ ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর বক্তৃতা ও রচনা ছিলো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। অথচ তিনি ত্যাগে বেহিসেবি, কর্মে বিরামহীন, প্রেমে সীমাহীন এবং তাঁর জ্ঞান ছিল যেমনই গভীর তেমনই বহুমুখী। জগতে এরূপ ব্যক্তিত্ব বাস্তবিকই বিরল।”সুভাষচন্দ্র আরও বলেছেন “ স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন পৌরুষ সম্পন্ন এক পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মনে প্রানে সংগ্রামী। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা বলে গেলেও এই মহাপুরুষের বিষয়ে কিছুই বলা হ’বে না। তিনি ছিলেন এমনই মহৎ এক ব্যক্তিত্ব এমনই ছিলো তাঁর চরিত্র। যেমন মহান তেমনই গভীর। তাঁর বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে, তিনিই
আধ্যাত্মিক সাধনার উচ্চতম স্তরের যোগ্য। সত্যের সঙ্গে ছিলো তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।”
আবেগ মথিত হয়ে নেতাজি বলেছিলেন “শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের নিকট আমি যে কতখানি ঋণী তাহা আমি কি করিয়া প্রকাশ করিবো?”তাহাদের পূণ্য প্রভাবেই আমার জীবনের প্রথম উন্মেষ। সিস্টার নিবেদিতার মতো আমিও মনে করি যে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ এক অখন্ড ব্যক্তিত্বের দুই রূপ। চরিত্র গঠনের জন্য রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ব্যতীত আমি কল্পনাও করতে পারিনা।” স্বামীজী আমাদের নেতাজীকে তৈরি করে গেছেন। ঠিক সেই কারণেই বিবেকানন্দ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গেলে সবার আগে আমাদের নিজেদের চরিত্রবান করে তুলতে হ’বে। সবশেষে স্বামীজীর দু’টি বাণী দিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানছি গঙ্গা জলে গঙ্গা পুজো করে।
“যখন আমাদের মধ্যে অহংকার থাকে না,
তখনই আমরা সব থেকে ভালো কাজ করতে পারি,
অপরকে আমাদের ভাবে সবচেয়ে বেশি অভিভূত করতে পারি।”
এবং
“ধর্ম এমন একটি ভাব যাহা পশুকে মনুষ্যত্বের ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।”