আজ একটি জীবনের গল্প শোনাতে ইচ্ছে করছে। চাকরির সুবাদে প্রাত্যহিক লোকাল ট্রেনে শহরে যাওয়া আমার রোজ নামচা।
আমি যে এই রোজ রোজ ট্রেন বাস ঠেঙিয়ে অফিস করি, এই প্রাত্যহিক যাত্রাপথে আমি বেঁচে থাকার রসদ খুঁজি কত যে মনি মানিক্য খুঁজে পাই যা আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। এইসব ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা থেকেই চিরন্তন ভারতবর্ষের জীবন দর্শন হয়।
কত রকম মানুষের সঙ্গে নিত্য ওঠাবসা। কখনও কখনও তাদের সুখ দুঃখের জীবন লিপি র সঙ্গেও আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়া। এভাবেই কত বন্ধুত্ব। চেনা জানার গন্ডি বাড়তে থাকে। কেউ কেউ সাময়িক আবার কেউ কেউ দীর্ঘদিনের পথের সঙ্গী। দেখেছি একেক রকম সখ্যতায়, বৈরিতার, আত্মশ্লাঘায়, ইর্ষানিত সম্পর্কের দোলাচলে জীবন চলে সহযাত্রীদের। একেক জনের জীবন কাহিনীর খোলা পাতার পাথক আমি। নিজেকে সমৃদ্ধ করি জীবনের বাস্তবিক অনু গল্প, সম্পূর্ণ বা ধারবাহিক উপন্যাস আস্বাদন করে।
তারই মধ্যে কিছু কিছু ঘটনা খুব মন ছুঁয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে কি এখনকারর ভাষায় এক পজিটিভ ভাইব আসে মনে। সব সময় এই যে একটা হতাশা ছড়ায় কেউ কেউ যে কিছু হবে না । মূল্যবোধের অবক্ষয় চারদিকে। তবুও কিছু ঘটনা জীবনের প্রতি বিশ্বাস জাগায়। মানুষের জীবন দর্শন, বিশ্বাস, কোথাও হারায়নি। আমরা শুধু দেখার চোখ হারিয়ে ফেলেছি। এক তৈরী করে দেওয়া দুনিয়ার ঝলমলে রঙীন আলো ধাঁধিয়ে দেয় আমাদের চোখ বোধহয়।
---------
বেশ কয়েক বছর আগে আমার বাড়ি ফেরার সময় একটি বাচ্চা কে নিয়ে তার মা সারাদিন কারখানায় কাজ করে বাড়ি ফিরত আর বাচ্চা টি ট্রেনে বসে পড়াশোনা করতো। মায়ের কারখানার পাশে একটা স্কুলে তাকে ভর্তি করে দিয়েছিল। বাড়িতে তাকে দেখার কেউ নেই। সে সক্কাল বেলায় মায়ের সঙ্গে কাজের জায়গা চলে যেত। রাতে বাড়ি ফিরত। প্রতি দিন মায়ের সাথে ট্রেনে উঠে টিফিন খেয়ে বই খুলে পড়াশোনা করত। কি ভাল লাগতো মা ছেলের এই জীবন। এই লড়াই। বাচ্চাটির টির প্রতি একটা মমত্ব তৈরি হয়েছিল।
একদিনের এক ছোট্ট ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল। আমার পাশে এক সুসজ্জ্বিতা মহিলা তার উজ্জ্বল ছেলেকে নিয়ে এসে বসলেন। দামি চকলেট ছেলেটির হাতে। উল্টো দিকে সেই কারখানায় কাজ করে আসা মায়ের কোল ঘেঁষে মলিন পোষাকে মায়াময় স্বপ্নালু চোখের ছেলেটি বসে টিফিন খাচ্ছে। আমার পাশে বসা উজ্জ্বল ছেলেটির হাতে দামি আধ খাওয়া চকলেট। সে যেই চকলেট টি শেষ করার অপারগতা দেখাল ওমনি তার সহৃদয় মা সেই আধ খাওয়া চকোলেটটি মলিন ছেলেটি কে দিতে উদ্যত হল। সঙ্গে সঙ্গে সারাদিন কারখানায় কাজ করে আসা ক্লান্ত মায়ের চোখ যেন জ্বলে উঠল।
" ওকে দেবেন না ও খাবে না।" তার এই প্রত্যাখ্যান কোথাও হয়তো ইগো তে লাগল সেই শিক্ষিতা মায়ের। উনি বললেন '
"ঠিক আছে ওটা নিতে হবে না" ব্যাগ থেকে একটা গোটা চকোলেট বার করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
"না দিদি ওকে দেবেন না, ওর চকলেট আছে। আপনি রেখে দিন আপনার ছেলের জন্য।"
এই বলে ব্যাগ থেকে বার করে ছেলের হাতে দিলেন তার কষ্টার্জিত টাকায় কেনা আপাত দৃষ্টিতে সস্তার চকলেট। কি তৃপ্তি তে মজা করে বাচ্চাটি চকলেট খেতে লাগল। একবারে একা এক সাধারন মা, নানা প্রতিকূলতা যাঁর নিত্য সঙ্গী, তাঁর আত্মসম্মান ও দৃঢ়তা আমার মন ছুঁয়ে গেল। মনে মনে বললাম আত্মসম্মানবোধের যে শিক্ষা তাঁর সন্তানকে দিলেন তা কি বই পড়ে বা শুধু মুখে বলে দেওয়া যায়??
ওদের স্টেশন আসতে ওরা নেমে গেল। মাঠের আল বরাবর হাত ধরে এগিয়ে চলেছে তারা গ্রামের কোনও এক প্রান্তের মাটির কুটিরে,, জ্যোৎস্নার আলোয় অন্ধকার চিরে দীপ্ত তাদের পথচলা।
আজ কেন বলছি হঠাৎ এই আপাত সাধারন ঘটনা। কারন সেই মহিলা আজ আবার আমার ট্রেনের সহযাত্রী, বেশ কয়েক বছর পর।
মাঝখানে অবশ্য ওই মহিলা একাই যেতেন। কারন ততদিনে পার হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর। ছেলেটি হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে বাড়ির কাছে। তারপর আমার ও ফেরার সময় ট্রেনের পরিবর্তন হয়। বেশ কয়েক বছর অদেখা।
জানতে চাইলাম "ছেলে কি করছে? "
" আজ চলে গেল। চাকরি নিয়ে। ওকে ট্রেনে তুলতে এসেছিলাম"
"আরে এত বড় হয়ে গেল!"
হ্যাঁ সেই ছেলেটি তারপর একদিন পলিটেকনিক পাশ করে গেছে। ভাল রেজাল্ট করেছে। ভারতের এক নামকরা ইস্সাত সংস্থার জুনিয়র ইঞ্জিনীয়ারের চাকরি নিয়ে চলেছে ভারতের কোনও এক স্টীল প্ল্যান্টে।
আজ মায়ের চোখে জল। কম বয়সে বাপ মরা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে যে মা সব প্রতিকূলতা দূর করেছে সততা, শ্রম ও আত্মসম্মান কে হাতিয়ার করে। আজ ছেলেকে পৌঁছে দিলেন জীবনের সাফল্যের প্রথম ধাপে তে। একদিন তাদের জীবন সংগ্রামের দিনগুলোর সাক্ষী ছিলাম আর আজ তাদের সবচেয়ে আনন্দের দিনও প্রত্যক্ষ করায় এক অদ্ভূত অনুভূতি হল যেটা ভাষায় প্রকাশ আমার কাছে অসম্ভব।
মায়ের মন ছেলের নতুন জীবন ভিন্ন পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত।
বললাম "আপনি তো জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কার পেলেন। আজও মন খারাপ আর দুশ্চিন্তা করবেন!"
-------------
এই ছোট ছোট সাফল্যের পেছনের লড়াইটা যারা দেখেছে তারাই জানে এই এক একটা হার্ডল টপকে জীবনের স্বপ্নকে পূরণ করে জীবনকে উন্নীত করতে পারাই হল জীবনের সেরা পুরষ্কার।
এই সব নাম না জানা কোটি কোটি মানুষ সারা ভারত জুড়ে ছড়িয়ে আছে যারা এই দেশ কে এগিয়ে নিয়ে চলছে এখনও নিজের মূল্যবোধকে আঁকড়ে নিজের সংসারের জোয়াল টেনে, তারাই আত্মনির্ভর গনতান্ত্রিক ভারতবর্ষ গড়ার আসল কারিগর।
"জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা"