গাড়িটা বেসমেন্টে কোনোরকমে ঢুকিয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে লিফ্টের ভেতর সেঁধিয়ে দিল দিতিপ্রিয়া। কয়েক মূহুর্তে পৌঁছে গেল তেরোতলার সাজানো ফ্ল্যাটে।আজ বড় ধকল গেল ওর। মনটাও বশে নেই । মুড সুইং করছে খুব।ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিল বিছানায়।
জীবনের অনেক কিছু সাফল্যের মধ্যেও কোথাও একটা গহ্বর তৈরী হয় । মানুষের মন বড় অদ্ভূত সেই গহ্বরের অন্ধকার তাকে টেনে নিয়ে যায়। লখিন্দরের বাসরঘরের কালনাগিনির মত সেই গহ্বরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে অবসাদের ছোবল, তাকে অবসন্ন করে দেয়। ডাক্তার দিতিপ্রিয়া দাশগুপ্তের তা অজানা নয়। তবুও সে সবসময় ঠিক ধরতে পারে না, সামলাতে পারে না। কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দেয় নিজেকে তার ফলস্বরুপ ব্যক্তিগত অনেক ছোটোখাটো ব্যাপার মাথা থেকে বেরিয়ে যায় আজকাল । সারাদিন ধরে সবার সম্ভ্রমের একটা বর্ম তাকে ঘিরে রাখে। অনেকদিন সে হয়তো উপভোগ করে এসেছে, আর ভাল লাগে না। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে আজকাল। অথচ সাধারন মানুষের যা কাঙ্খিত সবই সে অর্জন করেছে নিজ গুনে, মেধা,অধ্যাবসায় আর পরিশ্রমে। তবুও কেন যে এত মনের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়?
এই তো সেদিন ডা: দিতিপ্রিয়া দাশগুপ্ত মুম্বাইয়ের বড় হসপিটালের শিশুরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হয়ে যোগদান করলেন। তাও দেখতে দেখতে কয়েকমাস হয়ে গেল। হঠাৎই সুযোগটা এসে যাওয়ার পর মনস্থির করতে পারছিলেননা। এতগুলো বছরের পরিশ্রম লড়াই অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত দিতিপ্রিয়া এখন একজন নামকরা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ।নিজেকে আরো বৃহত্তরক্ষেত্রে মেলে ধরতে ইচ্ছে হওয়াটাই স্বাভাবিক কিন্তু পারিবারিক কিছু পিছুটান টেনে ধরে রাখে মাঝে মাঝে। এই ক্ষেত্রে পরিবারের তুমুল সমর্থন সে পেয়েছে। বিশেষ করে কিশোর পুত্রের। "কাম অন্ মাম্মা, বি প্যাক্টিক্যাল। আমার স্টাডি নিয়ে তোমার কোনোও চিন্তা করতে হবে না। আই আ্যম ম্যাচূওরড্ এনাফ নাও। তাছাড়া দিম্মা আছে। দাদুন আছে। তুমি কাজটা জয়েন কর। কিছুদিন কর ভাল না লাগলে ছেড়ে দেবে। না হলে আক্ষেপ থাকবে। তোমার একটা ডিজায়ার তো ছিলই। আর এখন দূর বলে কিছু আছে নাকি? আমরা এক বাড়িতে থেকে কতটা সময় একে অপরকে দিতে পারি বল?" এ কথাতো ঠিকই কেরিয়ারের শুরুতে কিছু ত্যাগ করেইছিল তবে সে ত্যাগ বলতে নারাজ কারন তার কাছে বেশি ইম্পট্যান্ট ছিল শিশুপুত্রকে কিছুটা হলেও কোয়ালিটি টাইম দেওয়া। সে জন্যে কেরিয়ার জলান্জলি দেয়নি ঠিকই শুধু কিছুটা ব্যালেন্স করেছিল। এই ব্যাপারে খুব একটা টাগ অফ ওয়ার হয়নি পরিবারে।।
দিতিপ্রিয়ার দেখভালের জন্য সারাদিনরাত ওর সঙ্গে থাকেন পদ্মাবাঈ, হসপিটাল থেকেই ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তিনি টিভি দেখতে দেখতে ঢুলছিলেন। হঠাৎই খেয়াল হল ম্যাডামের কোনো সাড়া শব্দ নেই অনেকক্ষন। বেডরুমে ঢুকে দেখলেন বিছানায় নিঃসাড়ে পড়ে আছেন ম্যাডাম। কয়েক মূহুর্ত মাত্র। ডাকাডাকিতে সাড়া না পেয়ে তড়িঘড়ি হসপিটাল এমার্জেন্সিতে ফোন করে দিল পদ্মাবাঈ।
* * * *
আস্তে আস্তে অনুভূতি ফিরছে তার। । কোন সূদুরের একটা ডাক শুনতে পাচ্ছে যেন সে 'দিতুন' 'দিতুন'। কিছু ঠাওহর করতে পাচ্ছে না। দুচোখে নেমে আসছে শান্তির চাপহীন ঘুম। কতদিন পর একটা চেনা নাম কোন অতীতের কবর খুঁড়ে কে তুলে এনে তার কানের ভেতর দিয়ে মর্মে ধুকিয়ে দিল যেন।
রাতের কোনো এক সময় ঘুমটা ভেঙে গেল । বুঝতে পারলো হসপিটালের কেবিনে বন্দি । পাশে এ্যটেন্ডেন্ট।একজন নার্স ঘুরে তাকিয়ে ওকে অবাক করে দিয়ে বাংলায় জানতে চাইলেন এখন একটু ভাল ফিল করছেন ডক্টর দাশগুপ্তা? জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে বললেন "ডোন্ট ওরি ...হাইপোগ্লাইসেমিয়া" দিতিপ্রিয়ার মনে পড়লো আগেরদিনই নতুন সুগারের মেডিসিন স্টার্ট করেছে। আর আজ হসপিটালে একটা বাচ্চার খুব ক্রিটিক্যাল কন্ডিশন নিয়ে ব্যস্তছিল, আটটা নাগাদ তার ক্রাইশিস ওভার হওয়ার পর নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফিরেছিল। তেমন খাওয়াদাওয়া করেনি। কাজের ফাঁকে বেমালুম ভুলে গেছে। তাই সাডেনলি সুগার ড্রপ করে গিয়েছিল। । বাড়ি থেকে ফোন এল। কথা বলে আশ্বস্ত করল। তড়িঘড়ি তাদের ছুটে আসার কোনও প্রয়োজন নেই। “ওকে টেক রেস্ট এ্যন্ড। বলতে বলতে সিস্টারও কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
দিতিপ্রিয়ার কানে বাজছে 'দিতুন'। এই নামে ওকে ডাকতেন ওর দিদুন আর দিদুনের কাছে শুনে আর একজন শম্পাদিদি। এক লহমা ফিরে গেল ওর সেই ছোটবেলায়, হসপিটালের কোয়ার্টার। দিতিপ্রিয়া, বাবা, মা আর দিদুনের ছোট সংসার। পূর্নিমা মাসি যাকে ছাড়া ওদের তখন একদিন ও কেমন অচল লাগতো। ডাক্তার বাবা আর শিক্ষিকা মা তো পূর্ণিমামাসির ওপর ওই একরত্তি মেয়ে আর ষাটোর্ধ দিদুন সহ সংসারের দায়িত্ব অর্পন করে যে যার কর্মক্ষেত্রে বিচরন করতেন। একদিন পূর্নিমা মাসি না এলে তখন সবার মধ্যে যা অস্থিরতা শুরু হত মনে হত বিশ্ব টালমাটাল। পূর্নিমা মাসিরই মেয়ে ছিল শম্পাদিদি। সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে চলে আসতো পূর্নিমা মাসি এই কোয়ার্টার পাড়ায়, শম্পাদিদি স্কুল থেকে ওদের বাড়ি চলে আসতো। দুপুর-বিকাল কাটিয়ে সন্ধ্যার পর পূর্নিমা মাসি শম্পাদিদি ওদের পাড়ার আরো কয়েকজন মাসি দিদির সঙ্গে গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যেত। ওদের ওই বাড়ি ফেরাটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতো দিতুন। কি ভাল লাগতো সারাদিন পর ওদের ওই কলতান করতে করতে দলবদ্ধ ঘরে ফেরা। একবার কোনোও এক পরীক্ষায় অঙ্কে একটু কম নাম্বার পেয়েছিল। খুব মনখারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল। পূর্নিমার বড় চাঁদ আকাশে। ওরা সেদিন যখন বাড়ি ফিরছিল তার সেদিন মনে হয়েছিল ওদের সঙ্গে হইহই করতে করতে চলে যায় ওই দূর চাঁদের দেশে। ওদের বাড়ি যেন চাঁদের দেশে, যেখানে কোনো পরীক্ষা নেই তাই নেই কোনো টেনশন। শুধু হাসি মজা আর আনন্দ।
* * * *
সিস্টার বাঙলায় কথা বলছিলেন, তার মানে কি শম্পাদিদি?শম্পাদিদির যে বেশ মেধা আছে দিদুন বেশ কয়েকবার বলেছে মনে পড়ছে। দিতিপ্রিয়া আ্যটেন্ডেন্টকে বলল সিস্টারকে ডেকে আনতে। সিস্টার কেবিনে ঢুকতেই ওর চোখের চাহনিতেই মাঝখানের বত্রিশ বছরের লম্বা সময়ের প্রাচীর টপকে দিতিপ্রিয়ার মনের আয়নায় ভেসে উঠল সেই কলা বিনুনি করা ফ্রক পড়া কিশোরীর ঢলঢল মুখের অবয়ব। অনেক পরিবর্তনেও পাল্টায়নি সেই চোখ। চিনতে ভুল হল না ওর শম্পাদিদিকে। উত্তেজনায় গলা কেঁপে গেল খানিক। “শম্পাদিদি? তুমি?” হাতটা বাড়িয়ে দেয় দিতিপ্রিয়া। শম্পাদিদি পরম স্নেহে ওর হাত টা ধরে বলল "রিল্যাক্স” । নিজের বাড়ি কাছের লোকের থেকে এই দূরদেশে হসপিটালের কেবিনে শুয়ে কি এক অনাবিল আবেগে চোখ টা তার বুজে এল। কোথাথেকে শুরু করবে সে বুঝতে পারছে না। ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে কিছু কথা বলার আগেই শম্পাদিদি বললো “এখন কোনো কথা নয়, কাল কথা হবে, এতগুলো বছরের অনেক গল্প জমে আছে তো! এখন ঘুমাও’
চোখ বুজে শুয়ে আছে দিতিপ্রিয়া। মনে পড়ছে কত কথা। বাবার বদলিতে ওরা চলে আসে কলকাতা, অতীতের কোলে গচ্ছিত রেখে আসে শম্পাদিদি, ছোটোবেলার স্কুল, বন্ধুদের,সেই মফস্বল শহর, ওর শৈশব। প্রথমদিকের মনখারাপ কাটিয়ে নতুনস্কুল পড়াশোনা নিয়ে মেতে ওঠে। হারিয়ে যায় পূর্নিমা মাসি শম্পাদিদি। ওরাও কোনোদিন যোগাযোগ করেনি আর আজ থেকে ৩০-৩২ বছর আগে যোগাযোগের যন্ত্র তো মানুষের হাতের মুঠোয় ঢুকে পড়েনি।
জীবন বড়ই অদ্ভুত!
সকালে একবার শম্পাদিদি দেখা করে গেল, ডিউটি শেষে। ওর ফোন নাম্বার নিয়ে গেল। বিকালে দিতিপ্রিয়ার ছুটির সময় ঠিক করলো ওর ডিপার্টমেন্ট একবার ও ঘুরে যাবে। যদিও সকাল থেকে মনিটর করেছে মোবাইলে ডিপার্টমেন্টের ডক্টররা দেখাও করে গেছে তবু একবার ঘুরে যাবেই ঠিক করলো। একটানা কাজ বেশ কিছুটা ক্লান্তিও জমেছে। তাই পরের দিনটা একটু ব্রেক নেবে। শম্পাদিদিকে ঠিকানা দিয়েছে। সন্ধ্যাবেলাা সে দিতিপ্রিয়ার ফ্ল্যাটে যাবে। শম্পাদিদির বিষয়ে কিছুই এখনো জানা হয়নি। খুব কৌতুহল হচ্ছে।অথচ এতগুলো বছর মনের কোন গহ্বরে তলিয়ে গিয়েছিল ওরা, জীবনের ট্র্যাকে দৌড়তে দৌড়তে রেসের সময় স্টার্টিং পয়েন্ট নিয়ে ভাবলে চলে?স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোই মুখ্য তখন, বাকি সব গৌণ। প্রথম প্রথম খুবই খারাপ লাগতো বিশেষ করে দিদুনের, কিন্তু তারপর সবই নিজের ছন্দে এগিয়ে চলে। একদিন সময়ের নিয়মে দিদুন ও হারিয়ে গেল। দিতিপ্রিয়া পড়াশোনা, কেরিয়ার,বিবাহ, সংসারের চেনা আবর্তে ঢুকে পড়ল। পূর্ণিমা মাসিরা হারিয়েই গিয়েছিল ওদের জীবন থেকে।
* * * *
শম্পা ওর দুকামরার ফ্ল্যাটে একরকম লাফাতে লাফাতে ঢুকল। মা কে গিয়েই খবরটা দেওয়ার জন্য মনটা ছট্ফট্ করছে। ওর জীবনও চলছে হার্ডলস্ রেসে। এগিয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা হার্ডলস্ পেরিয়ে। এখন বুঝতে পারে আজকের সিস্টার শম্পা রায় যে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে সেই মনের জোরটা একদিন গড়ে দিয়েছিলেন দিতুনের দিদুন। ছোটো বেলাতেই শুনে ছিল তিনি ছিলেন স্কুলের বড় দিদিমনি। বিয়ের দুবছরের মধ্যে স্বামী মারা যাওয়ায় কারোর করুণার পাত্র যাতে না হতে হয় সেই ভেবে অনেক লড়াই করে চাকরি যোগাড় করে একমাাত্র ছেলেকে মানুষ করেছিলেন। অদ্ভূত তেজ ছিল তাঁর। রিটায়ার করার সময় বড়দিদিমনি হয়েছিলেন। পূর্নিমা মাসি কেও শম্পার হাত ধরে একদিনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল ওর বাবার হঠাৎ এক্সিডেন্টে মৃত্যুর পর। দিদিমা আর মামারা ওদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিল। একটু ঠিকঠাক সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে মা কে কাজ খুঁজতেই হয়েছিল। ধীরে ধীরে একদিন ওদের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল ওরা।দিদুনের কড়া হুকুম ছিল পূর্ণিমা মাসিকে মেয়ে স্কুল থেকে যেন ওনাদের বাড়িতেই চলে আসে। দিদুনের কাছেই তো তার পড়াশোনা, স্বপ্ন দেখা শুরু। ওর মনটা গড়ে দিয়েছিল ওই ভদ্রমহিলা। মা যে পরিশ্রম ওর জন্য করছে তার মর্যাদা রাখতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। “পথটা হয়তো কঠিন অনেক লড়াই তবু তুই চেষ্টা করিস তোর মত উপায় একটা বেরোবেই।“
একদিন হঠাৎই ছন্দপতন। দিতুনের বাবার বদলি হয়ে গেল। ওরা একদিন রাস্তার ধূলো উড়িয়ে গাড়িতে করে হূশ করে বেরিয়ে গেল। শম্পার তখন ক্লাস এইট। কিন্তু ততদিনে স্কুলের চাপ বেড়েছিল। ও তখন পড়তে আসতো দিদুনের কাছে। ওদের যাওয়ার পর কষ্ট হয়েছল খুব।মাঝে মাঝে দিদুনের জন্য আড়ালে অনেক চোখের জল ফেলেছে কেই বা তার খবর রাখে? তখন দিদুনের কাছে শোনা রবীন্দ্রনাথের গানের কথা ছিল ওর নিভৃত মনের উজ্জ্বীবনের একমাত্র প্রলেপ । 'বিষাদের অশ্রূজলে নীরবের মর্মতলে গোপনে উঠুক ফলে হৃদয়ের নূতনবাণী। যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা।নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোর রেখা।"
* * * *
জীবনে এরকম কত সুন্দর যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, কত সুন্দর কত সম্ভাবনার যে অঙ্কুররোদগম হয় তার জন্য, তার প্রভাব কত সুদূরপ্রসারি হয় এই মহাবিশ্বে তার হিসেব কে রাখে আর সে গল্প কে বা শুনতে চায়? কত মানুষ নিঃশব্দে কত বিপ্লব ঘটায় তার কি সত্যি কোনো মূল্যায়ন হয়?
* * * *
দিতিপ্রিয়ার বাসায় ও ঠিক ৭টার সময় পৌঁছে গেল। দিতিপ্রিয়ার উষ্ণ অভ্যর্থনা ওকে মুগ্ধ করলো। পদ্মাবাঈ স্যন্ডুইচ আর চা দিয়ে গেলেন।
ওরা শুরু করলো ওদের ভিন্ন পথের কতকথা ।
দিনে দিনে পড়ার চাপ আর খরচ বাড়তে লাগল। এদিকে ওদের পাড়ায় লোকজন কম কথা শোনায়নি মাকে। কত লোক তখনই বিয়ে দেওয়ার জন্য পীড়াপিড়ি শুরু করে দিল। মামাতো বোনেদের বিয়ে তখন হয়ে গেছে। ওদের ঘরের লোক পড়াশোনা করে হবে টা কি? উপযুক্ত পাত্র জুটবে না জুটলেও ওর পছন্দ হবে না। মেয়ের বিয়ে দেওয়া মুশকিল হবে।একা মা সমাজের আগাছা থেকে কি করে ওকে বাঁচাবে মায়ের কিছু হলে কি হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাবার ভিটে থেকে তো বিতাড়িত। কোনোদিন যায়নি কেউ খোঁজও করেনি। কিছু সে আশাও করেনি। মায়ের পরিশ্রমে মা মেয়ের চলে যেতো যা কিছু জীবনের ফাঁক ভালোবাসায় আর স্বপ্ন দেখে পূরন করে দিত। একদিন মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলো। ফার্স্ট ডিভিসন ওকে একটি বিশেষ মর্যাদা দিল শেষ পর্যন্ত। স্কুলের কয়েকজন দিদির অকৃপন ভালবাসা,স্নেহ, যথযথ গাইডেন্সে উচ্চমাধ্যমিক ভালোভাবেই পাশ করল।
উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোতে যখন দিশাহারা কি পড়বে কি পড়া উচিত মা কতদিন টানতে পারবে? তখনই কোয়ার্টারের একজন সিস্টার ওকে বলেছিল নার্সিং পড়বি? 'তুই তো ভাল নাম্বার পেয়েছিস যদি রাজি থাকিস তবে ফর্ম তোলার ব্যবস্থা করে দেবো। যদি চান্স পাস মা কে ছেড়ে থাকতে পারবি তো?খুব কড়াকড়ি কিন্তু। ইচ্ছে মত বাড়ি আসতে পারবি না। " হেসে বলেছিল আগে তো চান্স পাই। ডাক্তার নার্সদের পাড়ায় বড় হওয়া। এই মেডিকেল প্রফেসনে থাকা তো স্বপ্ন। জীবনের কিছুটা পথ অনেক লড়াই করে এক দিন ভাল রেজাল্ট করেই নার্সিং এর প্রফেসনে প্রবেশ করলো। সে এক অপার আনন্দ।
* * * *
কয়েক বছর এদিক ওদিক সার্ভিস দিয়ে একদিন বড় হসপিটালে চাকরিও পেয়ে গেল। মনে মনে কত খুঁজেছে দিতিপ্রিয়াদের। যদি দেখা পায় ওর ধারনা ছিল দিতুন ঠিক ডাক্তার হবে বাবার মত। তারপর একদিন তার ও সংসার হল। প্রথম কয়েক বছর ভাল কাটল। জীবনে এল এক কন্যা সন্তান। নিমেষে দিন কাটছিলো। হঠাৎই নেমে এল বিপর্যয়। মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়লো। অনেক ছোটাছুটি করে এই রোগের বিশেষ পরিচিত হসপিটাল মুম্বাই নিয়ে যাওয়াই ঠিক করল। একসময় ঐ অতদূর ছোটাছুটি আর সামাল দেওয়া দু্ষ্কর হয়ে পড়ল।একদিকে অর্থনেতিক চাপ ব্যয় বহূল চিকিৎসা আবার নিজের চাকরি, সংসার ওর নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়। এদিকে ওখানে মায়ের ট্রিটমেন্ট ভালই সাড়া পেয়েছে। শেষ জীবনে কোথায় একটু ভাল রাখবে মা কে সেটাও পারল না। তাই ঠিক করলো চিকিৎসার কোনও খামতি রাখবে না ফলাফল যাই হোক না কেন। এইটুকুই তো সে করতেই পারে। এই সময়ে মুম্বাই থাকা কালীন এই দিতিপ্রিয়ার হসপিটালে চাকরির যোগাযোগ আর যোগদান। এবার শুরু হল মানসিক টানাপোড়েন। স্বামী তো আসবে না কলকাতার চাকরি ছেড়ে! এ তো আর বউ নয়। এদিকে মেয়ে কে এখানে একা আনবে কার ভরসায়? আর ছোটোবেলায় পিতৃহীনা সে নিজে, বাবার আদরের দুলালি কে কি করে আলাদা করে? তার এই চাকরির খাতিরে তার থেকে বেশী মেয়ে তো ঠাকুমা, পিসি, বাবার সঙ্গে বেশী সময় কাটিয়েছে, সে ঠিক মানিয়ে নেবে। কিন্তু মায়ের মন তো!
মাও খুব ভেঙে পড়লেন। একে তো অসুখের মানসিক চাপ তার সঙ্গে মায়ের ধারনা তাঁর চিকিৎসার জন্য মেয়ে সব ছেড়ে মুম্বাই থাকবে। সে খুব রূঢ় ভাবেই মা কে বললো "তাহলে তুমি বাড়ি ফিরে যাও কিন্তু শুনে রাখো মুম্বাইয়ের চাকরি আমি জয়েন করবই। এত কষ্ট করে পাওয়া এত ভাল অফার আমি হারাবো না।" শ্বশুরবাড়িতে একবগ্গা স্বার্থপর তকমা জুটলো তার। কেউ বোঝার চেষ্টাই করল না। এমনকি জীবনসঙ্গীও না। তবুও সে সিদ্ধান্তে অবিচল থাকলো। ও জানে সবাই ভুল বুঝলে তার কন্যা ঠিক বুঝবে। মেয়ের সঙ্গে মানসিক নিবিড় সম্পর্ক কখনো ও ফাঁক রাখেনি, টু ওয়ে কমিউনিকেশন সব সময় চালু রেখেছে তাই খনিকের রাগ অভিমান দুঃখ কষ্ট অঙ্কুরেই বিনাশ হয়েছে।
অগত্যা মনের সঙ্গে লড়াই করে মুম্বাই চলে এল পাকাপাকিভাবে। মায়ের কোনো ওজর আপত্তি দমাতে পারলো না। তবে আশার কথা যত ভুল বোঝাবুঝি মন কষাকষি দূরত্ব থাকুক না কেন ওদের সবার সম্পর্ক এখনো অটুট।
নিজেদের গল্পে ও স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ঘন্টা দুই পার। উঠতে হবে দিতুন বলেছিল ডিনার করে যেতে ও আজ রাজী হল না। অন্য একদিনের জন্য বকেয়া রেখে দিল।
* * * *
সপ্তাহ খানেক পর একদিন দিতিপ্রিয়া পূর্ণিমা মাসিকে দেখতে গেল। সময় আর রোগের সঙ্গে চলতে চলতে পূর্ণিমা মাসির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কেমোথেরাপির দরুন ছোট করে ছাঁটা চুল প্রথম সাক্ষাৎএ মনের কোথায় একটা ধাক্কা দেয় সে যত সে ডাক্তার হোক না কেন। নিজেকে সামলে নিল সে। "আমি জানতুম তুমি একদিন বড় ডাক্তার হবে। কোনো দিন আবার দেখা হবে ভাবিনি। খুব তোমায় দেখতে ইচ্ছে করত।" পরম মমতায় তার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে বললো "তোমার জন্য একটু খাবার বানিয়েছি। তুমি একটূ খাবে তো? " 'কি বলছো খাব না।" কতযুগ পর! কতদিন পর সে পূর্ণিমা মাসির হাতে করা খাবার খাচ্ছে। যেন এইমাত্র স্কুল থেকে এসে বারান্দায় বেতের মোড়ায় বসে টিফিন করছে। দিদুন টবের গাছগুলোর পরিচর্যা করছে। তার চোখদুটো দূরের রাস্তায় যেখান দিয়ে মা একটু পরেই স্কুল থেকে আসবে। হঠাৎ যখন রাস্তার বাঁকে মা কে দেখা যাবে ও দাঁড়িয়ে হাত নাড়ত। ঐ মুহূর্তে মনে হত এক অনন্ত অপেক্ষার অবসান।
মানুষ বোধহয় এইভাবেই সারাজীবন মনের সিন্দুকে গুছিয়ে রাখে তার শৈশব। কখনো কখনো নেড়েচেড়ে দেখে নেয়। "আমাকে একটু দেখে বল তো আর কদিন? মনে আছে আমি, শম্পা আর তোমার দিদুন ছিল তোমার প্রথম রূগি। কতদিন বাবার বাতিল স্টেথো ঝুলিয়ে তুমি আমাদের চিকিৎসা করেছো। তবে তুমি বলতে বড় হলে তুমি শুধু ছোটদের দেখবে।" ও হেসে ফেলল।
"ওরকম করে কি বলা যায় গো। তুমি অসুস্থ বলে এসব ভাবছো কিন্তু আজ সবার জীবন বড় ভঙ্গুর। সাবধানে নিয়ম মেনে থাক। আমি তো দেখলাম সব রিপোর্ট, ওরিড হওয়ার কিছু নেই।" "না রে মা নাতনিটার জন্য খুব মনখারাপ লাগে। মনে হয় অপরাধ করছি, ওর মা কে ওর থেকে দূরে করে দিয়েছি"।
"এরকম ভেবো না। আজকালকার ছেলেমেয়েরা খুব ম্যাচিওরড্। ওরা ট্রু সিচুয়েসান এ্যডজাস্ট করে নেয় কিন্তু মন ভোলানো ছলনা বা অতি পসেসিভনেস মানতে পারে না। তবে এটা সত্যি ওদের জাজ করা খুব মুশকিল আজকাল। " "কি যে বল বুঝি না বাবা।"
'”তোমাদের দেখে যে কি ভাল লাগছে। বাবা মাও খুব খুশি। শম্পাদিদির জন্য আরো খুশি।" "
“শম্পা যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য তোমাদের পরিবার আর কয়েকজনের মানুষের অবদান অনেক। “
"এভাবে বোলো না। শম্পা দিদি যা করেছে নিজে করেছে। ওর পরিশ্রম নিষ্ঠা মেধা খাটো কোরো না। ও কারোর দয়ায় এই জায়গায় আসেনি। দিদুন এই কথাটাই বলতো নিজেকেই করে নিতে হবে নিজের পথ। অন্যরা দিশা দিতে পারে বড়জোর পথটা তোমায় নিজেই বানাতে হবে। দেখবে বড় আনন্দের সেই পথ, সে যেমনি হোক না কেন।"
* * * *
বেশ কিছু দিন নিজেদের পেশার তাগিদে দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে শম্পা দিদির দেখা হয়নি। তারপর কদিন সে দেশেও ছিল না।একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার এ্যটেন্ড করতে বিদেশ গিয়েছিল। পূজোর মুখে ফিরল। এবারের পূজোয় কলকাতা থাকা হবে না। তবে ছেলে ও ছেলের বাবা আসছে। একটু ফুরসত পেলে একদিন দুদিন লোনাভালা ঘুরে আসবে ভাবছে।
হসপিটালে হঠাৎই শম্পাদিদির সঙ্গে দেখা।
"আরে কবে এলে?"
"আজ সকালে। গাড়ি তে ওঠো। ”
"মার খুব ইচ্ছা আছে পূজার সময় বাড়ি যায়, আর আমিও পাচ্ছিনা মেয়েটার জন্য খুবই মনখারাপ লাগছে তাই ভাবছি পূজোয় কদিন ঘুরে আসি। মায়ের চেকআপ হল ঠিক আছে। ডাক্তার পারমিশন দিয়েছে। ছুটি ও পেয়েছি। লক্ষী গূজোর পর চলে আসছি।"
''বাহ্! খুব ভালো।“
"আমার কলকাতা যাওয়া হবে না তবে ছেলে ও ছেলের বাবা আসছে"
" ডিসেম্বর এ আ্যনুয়াল হয়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসব। এখানেই ভর্তি করব। এখন মেয়ের বাবার ইচ্ছেও তাই। ওনার কোম্পানি নাগপুরের কাছে একটা প্রোজেক্ট পেয়েছে। কোম্পানি ওনাকে সুপারভাইজার করে পাঠাচ্ছে।
"গ্রেট! "।
* * * *
আজ ষষ্ঠী। দেবীর বোধন। শম্পাদিদিরা এখন রওনা হয়ে গেছে সেই দিতুনের শৈশবের দেশে। দিতুন অপেক্ষা করছে ওর পরিবারের জন্য।
এমনি করেই হয়তো মা দুর্গা বিরাজ করেন মেয়েদের মনের মণিকোঠায়, উদ্বুদ্ধ করেন জীবনের সকল কর্মে, সকল লড়াইয়ে, শিক্ষা আর জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয় তাদের জীবন যে আলো একে অপরকে পথ দেখায়।
এই কটা দিন ওরা মেতে উঠুক নিজেদের মত করে শারদোৎসবে।
* * * *
একেক জনের জীবন যেন ভিন্ন পথের রেলগাড়ি। কোনো এক স্টেশনে জীবনের পথ ভাগ হয়ে গিয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার বিছিয়ে দেওয়া লাইনে কিছুটা পথ ছোটার পর ওদের আবার সাক্ষাৎ হয়েছে বড় এক জাংশানে। হয়তো এখান থেকেই ওদের জীবন আবার মোড় নেবে অন্যদিকে। জীবন চলবে সমান্তরাল ভাবে নিজের পথে।