Image by shuhaibaliyar333 from Pixabay
ভোরের আলো জানালা দিয়ে ঢুকে মুখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল অনুমিতার, আকাশ তখন সবে লাল হচ্ছে। এক বছর হতে চলল বাড়ি ছাড়া। ম্যাঙ্গালুরুর 'এ জে ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট'এ স্বপ্ন সফল করতে এসেছে অনুমিতা লাহিড়ী।
-অনু-বেবী, গুড-নিউজ!
হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল আদর্শিনী বিল্লভা, স্থানীয় আদিনিবাসী, বিল্লভা গোষ্ঠীর মেয়ে। পরিচিতির পরেই আদুর সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হয়েছিল অনু।
-আদিবাসী জানি, আদিনিবাসী কারা?
-আমরা না আর্য না দ্রাবিড়। বিল্লভা উপজাতির অস্তিত্ব বহু প্রাচীন। দক্ষিণ-কর্ণাটকের উদুপী, ম্যাঙ্গালোর আর কেরলের কাসারাগোড জুড়ে এই আদিনিবাসীদের অবস্থান।
ইন্সটিটিউটে পৌঁছনোর পরেই এই মেয়েটার স্বতঃস্ফূর্ত ব্যবহারে মোহিত হয়েছিল অনুমিতা।
ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পশ্চিম তটবর্তী 'টুলুনাডু'র মেয়ে আদর্শিনী, যে স্থান 'পরশুরামা-সৃষ্টি' নামেও পরিচিত। লোকগাথা অনুযায়ী ভগবান বিষ্ণুর ষষ্ঠ-অবতার পরশুরাম তাঁর কুঠার ছুঁড়ে ফেলেছিলেন আরব-সাগরের জলে। তট থেকে কুঠার পতনের স্থান পর্যন্ত সাগর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যুক্ত হয়েছিল সমুদ্র তটবর্তী মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। সমুদ্রের তলদেশ থেকে জেগে ওঠার দরুন সেই স্থলভাগ ছিল লবনাক্ত, বসবাসের অযোগ্য। পরশুরামের আহ্বানে নাগ-বাাসুকির পবিত্র নিষ্ঠীবনে(থুথু) সেই ঊষর স্থলভাগ উর্বর হয়েছিল। সেই থেকেই নিয়মিত ভাবে তটবাসীদের পূজা পান নাগ দেবতারা।
-সাতসকালে কী সুখবর পেলেন আদর্শিনী ম্যাম?
-উই উইল বি ভিজিটিং কুর্গ, এজ্যুকেশনাল এক্সকারশন!
এক লাফ দিয়ে উঠে আদু'র গলা জড়িয়ে ধরল অনু।
-মাই ড্রিম-ডেস্টিনেশন, কতদিনের ইচ্ছে!
-আরো মজা আছে, টানা চোখের জাদু চালাল আদু।
-কোডাগু'র সোমওয়ারপেট তালুকাতেও যাব, আমার বন্ধুর দিদির বিয়ে। কূর্গের কোডাভা বিয়ে দেখতে পাবি।
অফ পিরিয়ডে লাইব্রেরিতে গিয়ে লাইব্রেরিয়ানের পরামর্শে ডক্টর ডি.এন.কৃষ্ণাইয়া'র 'হিস্ট্রি অফ কূর্গ' বইটা স্পট রীডিং-এর জন্যে ইশ্যু করিয়ে নিয়ে বসল অনুমিতা।
বিবিধতা এবং বৈচিত্র্যের মাঝেও সুস্পষ্ট ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত ঐক্য। ভারতীয় ইউনিয়নের এই বিস্তীর্ণ ভূমির প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ কিছু স্বাতন্ত্র্য এবং বৈশিষ্ট্যে অনন্য, যা প্রকাশিত হয় তাদের আকৃতি-প্রকৃতিতে, খাদ্য এবং পোশাক পরিচ্ছদে, ভাষা-সাহিত্যে আর তাই প্রতিটি অঞ্চলই উদ্ভাসিত হয় তাদের নিজস্ব মহিমায় তবুও একটি সর্বজনীন সংস্কৃতি ভারতভূমির নানা ধরনের মানুষকে একই সূত্রে বেঁধে রাখে।
'নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান,
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান'
দক্ষিণে কন্যাকুমারী থেকে উত্তরে হিমালয়, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ থেকে পশ্চিমে গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত এই উপমহাদেশ তার নানা বর্ণে গন্ধে, ছন্দে গীতিতে ভারতীয়ের হৃদয়ে দোলা দিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষ তাদের মা, মাতৃভূমি। এই বিস্তীর্ণ ভারতভূমিতে কূর্গ একটি অতি ক্ষুদ্র স্থান যা একসময়ে একটি রাজ্যের মর্যাদাভুক্ত থাকলেও কর্ণাটক প্রদেশের জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ১৯৫৬ সালে এবং বর্তমানে 'কোডাগু' নামে পরিচিত। সেখানকার বিভিন্ন উপজাতিদের সামাজিক রীতিনীতি, পোশাক পরিচ্ছদ, অলঙ্কার আভূষণ অন্যান্য দক্ষিণ ভারতীয়দের থেকে অনেকটাই আলাদা।
অনুমিতার হাতে এল কুর্গের অধিবাসী কে.পি. লোলিথা'র গবেষণা পত্র 'ইউনিক ট্রাইবস অফ কূর্গ' এই নথিটি তাকে কূর্গ কোডাগুতে প্রাপ্ত ও লুপ্ত উপজাতিগুলির সম্বন্ধে সম্যক ধারণা জোগাল। কূর্গের উপজাতিদের সামাজিক জীবনের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাদের রীতিনীতি, আচার ব্যবহার, ঐতিহ্য, কূর্গী বিবাহ প্রথা, সমাজে মহিলাদের স্থান বিষয়ে আলোকপাত করেছেন লোলিথা।
-কিরে বই মুখে আছিস, ক্যান্টিন তোর জন্যে খোলা থাকবে?
ক্যান্টিনের জন্য বেরিয়েই হোঁচট খেয়ে, পায়ের পাতা ধরে বসে পড়ল অনুমিতা।
-আরে, রক্ত বেরোচ্ছে!
-ছাড়, ক্যান্টিনে বরফ লাগিয়ে নেব।
-ওয়েট!
আদর্শিনী দৌড়ে গিয়ে একগোছা গুল্ম নিয়ে এল ।
-কী রে?
-স্থানীয় নাম জানি না, ইংরিজিতে বলে 'ক্লাইম্বিং-হেম্পউইড' রক্ত বন্ধ করে।
দু'হাতে ডলে অনুর ক্ষততে লাগিয়ে দিল আদু।
-আমরা দূর্বাঘাস লাগাই। মা'কে দেখেছি শঙ্খ দিয়ে থেঁতো করে লাগাতে।
-বিল্লভা আদিনিবাসীরা কৃষিনির্ভর, তাই গাছপালার জ্ঞান খুব বেশি।
-সত্যি চমৎকারী ভেষজ! রক্ত বন্ধ হয়ে গেছে।
ভোরবেলাতেই হইচই করে সকলের ঘুম ভাঙাল আদর্শিনী। তাড়াতাড়ি ক্যান্টিন খুলিয়ে, ঘরে ঘরে চা কফি পৌঁছে দিল আদু। মেয়েটার জীবনীশক্তি অবাক করে অনুমিতাকে। সবাই বাসে বসলে ড্রাইভার আংকলকে ইন্সট্রাকশন্স দিল সে।
-আংকল, আমার বেশিরভাগ বন্ধুই ম্যাঙ্গালুরু'র বাইরের। সবথেকে সুন্দর পথে আমাদের কূর্গে নিয়ে যেও প্লীজ।
-জানিস অনু, পাহাড় আর ঘন বনে ঘেরা কর্ণাটকের অন্যতম দর্শনীয় স্থান কূর্গ বহুকাল বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
যাত্রাপথের মনোরম শোভা চোখে আর ক্যামেরায় ভরে রেস্ট হাউসে চেক-ইন করল ছাত্রছাত্রীরা।
এক্সকারশনের সময়ে অপূর্ব সুন্দর নদী, রকমারি ফুল-পাখি, নীল পাহাড়ের সৌন্দর্য নিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করল কূর্গ।
সোমওয়ারপেটের হারাঙ্গী নদীর ধারে গিয়ে বসেছিল আদর্শিনী, পদ্মাবতী আর অনুমিতা।
-পদ্মা, তোমাদের বিয়ের সম্বন্ধে বল। অনু আগ্রহ দেখাল।
-অম্রুথ ভাইয়ার সঙ্গে অনুর পরিচয় করিয়ে দেব, হি উড লাভ টু হেল্প।
-বেশি কিছু বলব না। কূর্গী বিয়ে দেখতে এসেছ, নিজের চোখেই দেখ। দিদির বিয়ের জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পদ্মাবতী।
জোরদার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল অনুমিতার। সে দেখল আদুর স্নান সারা।
-উঠ যাও রাজকুমারী। আজ তো আসল বিয়ে, মূর্থা।
স্নানঘরে ঢুকে গত সন্ধ্যেয় হারাঙ্গী-নদীর ধারের ভ্রমণ মনে পড়ায় অনুর মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল। নদী চিরকালই বড় আকর্ষণ করে অনুকে। ছোটবেলায় বাবা মা'র সঙ্গে দেশের বাড়িতে গেলে, বাড়ির পেছনে বয়ে যাওয়া সরু ধারার নদীটা খুব টানত তাকে। আদুর বন্ধু, পদ্মাবতীর দিদি ভাগ্যলক্ষ্মীর বিয়েতে এসেছে অনু। অচেনা জায়গা, অজানা মানুষের ভিড়ে তো নিজের ইচ্ছেয় তো চলাফেরা করা যাবে না, যদিও তার খুব ইচ্ছে জাগছে গভীর রাতে জোছনায় ভাসা নদীটার রূপ দেখতে।
কোডাভা ধরনে শাড়ি পরে দুই বন্ধু গিয়ে পৌঁছলো বিয়ের মণ্ডপে। পদ্মার দাদা, অম্রুথের হাতে অনুকে সঁপে দেওয়ার সময় আদু বলল -
-অনু, তুমার নাবাবার্সা, কেরলের বিশু, পাঞ্জাবের বয়সাখী, আসামের বিহু আর… অম্রুথের হাতে হাত রেখে সে বলল, 'কোডাভা বিসু ছংগ্রান্দি'র সঙ্গেই আমরা বিল্লভারাও আমাদের বিসু পর্ব সেলিব্রেট করি, ওই এপ্রিলের মাঝামাঝি।
-নাবাবার্সা না রে, নববর্ষ। হেসে বলল অনু।
আদু গেল পদ্মার খোঁজে।
অম্রুথ আর অনুমিতা বসেছিল বিয়ের মণ্ডপে। অম্রুথ শুনেছে অনুমিতা কূর্গের জনজাতি, বিশেষ করে কোডাভা উপজাতি সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী। ভালো লেগেছিল তার, তাদের প্রিয় জন্মভূমি সম্বন্ধে উৎসাহী পুরোপুরি অপর প্রান্তের একটি মেয়ে। অনুমিতার চোখে চোখ রেখে হাসল সে।
অম্রুথের দৃষ্টির মুগ্ধতা শিহরিত করল অনুমিতাকে। দৃষ্টি নত করে সে ভাবল কী আকর্ষণীয় চেহারা অম্রুথের! কূর্গীদের চেহারা সুন্দর হয়, কিন্তু এই পরিবারের মানুষগুলো যেন একটু বেশিই মনমোহক! ভাইবোনদের ব্যবহারও মনে রাখার মতো।
কোডাভা বিয়ের নিয়ম নিয়ে খানিক্ষণ গল্প করে অম্রুথ বলল
-আবার পরে বসব, একটু বিয়ের কাজকর্ম দেখি?
মাথা হেলিয়ে হাসল অনু।
-তোমার কাছে বাংলার গল্প শুনব, কালচারাল এক্সচেঞ্জ আর কি! ইন্সটিটিউটে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সায়ন্তন সিনহা ইজ আ বং। ইজন্ট ইট সেড দ্যাট ওয়ে নাও?
ঝড়ের বেগে উদয় হয়ে অনুর হাত ধরে আদর্শিনী বলল,
-চল চল আগে ভাগ্যলক্ষ্মী দিদির বরের নিয়ম কানুন গুলো দেখে আসি। দিদির তৈরি হতে এখনো সময় লাগবে।
রাঘবেন্দ্র ভাইয়ের হাতে ‘মাদারঙ্গী’(মেহেন্দী) দেখে অবাক হলো আদু, তার বিস্ময় বর্ধিত হলো রাঘবেন্দ্রকে নারকেলের দুধে স্নান সারতে দেখে। আদুর টানা টানা চোখ আরো বড় করে
পরামানিকের দিকে তাকিয়ে সে বলল -কোডাভা বিয়েতেও বরের মাদারঙ্গী অনুষ্ঠান হয়? দুগ্ধ নীরে স্নান করে না তারা? নারিকেলের দুধে 'মঙ্গলা স্নান' তো টুলুভা বিয়ের নিয়ম।
পদ্মাবতী আদুর কাঁধে নিজের মুখ রেখে হেসে বলল, তোকে সার্পরাইজ দেওয়ার জন্য আগে বলিনি আদু, লক্ষ্মী সহোদরার মঙ্গলা হচ্ছে ‘টুলু বিল্লভা’ গোষ্ঠীর রাঘবেন্দ্র’র সঙ্গে। যা বড় একটা লাফ দিল আদু, রাঘব ভাইয়ার কাছে গিয়ে টুলু ভাষাতে অনর্গল বকে যেতে থাকল সে। রাঘবের মুখও হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। জানা গেল একই ইন্সটিটিউটে পড়াশোনা করার সময়েই পরিচিত হয়েছিল রাঘব আর ভাগ্যলক্ষী, মন দেওয়া নেওয়ার কাজ সারা হয়েছিল। বাড়িতে জানাজানি হওয়ার পরে বরের বাড়ির নিয়মানুযায়ী 'ভীল্যা আদিকে' রূপোর থালিতে মঙ্গলময় পান পাতার আদান প্রদান করে মঙ্গলমের দিন স্থির করা হয়েছিল, নিশ্চিতার্থম্'এর মাধ্যমে অর্থাৎ এনগেজমেন্ট।
কোডাভা রীতি অনুযায়ী বর এবং কনের মা'র সঙ্গে দু'জন বিবাহিত নারী (এয়োস্ত্রী) তাদের মাথায় সুগন্ধিত নীর ঢেলে বিবাহ-স্নান সম্পন্ন করলেন। বিবাহের সাজে সজ্জিত হলো তারা।
বোজাকার্থি(সহচরী)'র সাহায্যে বরের মতো একই ভাবে স্নান সেরে নিল ভাগ্যলক্ষ্মী কিন্তু তার স্নানের জলে মেশানো হলো দুগ্ধ। তার আগে তার গাত্র হরিদ্রার ব্যবস্থা করা হলো রাঘবেন্দ্র’র বাড়ির প্রথা অনুযায়ী। মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল দুটি ভিন্ন স্থানের লোকাচার।
সোনালী বুটিদার, সোনালী পাড়ের লাল সিল্কের শাড়ি আর লম্বা হাতা ব্লাউজ পরে 'বালে ইদুভা'র (চুড়ি অনুষ্ঠান) জন্যে তৈরি হলো ভাগ্যলক্ষ্মী। চুড়িওয়ালা এসে তার হাতে রঙ বেরঙের কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দিল যার অন্তত একজোড়া চুড়ি কালো হওয়া চাইই, অশুভকে দূরে রাখতে।
কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে ভাগ্যলক্ষ্মী সহোদরীকে। তার মাথা এবং মুখ ঢেকে দেওয়া হলো লাল ভেল'এ। মাথা গলা হাত কান এবং কোমরে পরানো হলো প্রথাগত সোনার অলঙ্কার, পদযুগল সাজলো রূপোর গয়নায়।
পাত্রীর গলায় তার মা বেঁধে দিলেন 'পাথক'। সোনা, প্রবাল আর কালো পুঁতিতে গড়া। সেই হারে ঝোলানো হয়, চুনি দিয়ে ঘেরা, কেউটে সাপের ফনা খোদিত স্বর্ণমুদ্রার লকেট। এই আশীর্বাদী হার কনের মা তাকে পরান সৌভাগ্য এবং উর্বরতার প্রতীক হিসেবে। পাথক মালে আর জুঁই ফুলের মালাতে সেজে পুরো হলো দিদির বিয়ের সাজ।
রীতি অনুযায়ী 'টমটম' এবং আওয়ার গ্লাস আকারের বাদ্যযন্ত্র 'দুদি' বাজাচ্ছিল পোলেয়া ও মেদা বর্ণের পুরুষেরা, সঙ্গে নারী পুরুষ সকলে মিলেই গাইছিল পারম্পরিক বিবাহ গীত। বিবাহস্থলের বাইরে বাজছিল বিয়ের জন্য নির্দিষ্ট কুর্গী বাজনা 'ভোলাগা', তারও সঙ্গে চলছিল নৃত্য গীত।
বিয়ের মণ্ডপে যাওয়ার পথ সাজানো হয়েছে ন'টি কলাগাছে। 'ওডি কাঠি' দিয়ে 'বালে বিরুদু' প্রথায় এই কলাগাছের কাণ্ড কেটে ফেলার ভার দেওয়া হয়েছে, সম্মানীয় অতিথি বর এবং কনের মামাদের।
তাঁদের পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানিয়ে কলাগাছের কাণ্ড কেটে তাঁদের শক্তির প্রদর্শন করলেন কনে ভাগ্যলক্ষ্মী এবং বর রাঘবেন্দ্র'র দুই মামা। ভোলগা সঙ্গীতের তালে তাঁরা মেতে উঠলেন আনন্দ নৃত্যে।
ভোলগা সঙ্গীতেই অভ্যর্থনা জানানো হলো অতিথি অভ্যাগতদের।
এই নৃত্যের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হলো টুলু নাডুর পরম্পরাগত ‘ইয়ক্শগনা’ নৃত্য। টুলু নাডুর সংস্কৃতি অনুযায়ী এই উদুপি নৃত্য যদিও সারারাত ধরে চলে, দুই সংস্কৃতির মেল মিলাপে অবস্থানুসারে তাতে কাট ছাঁট করা হলো। রাঘবেন্দ্র’র ম্যাঙ্গালুরুর বন্ধু বান্ধবেরা ভীষণ ভাবে জনপ্রিয় লোক নৃত্য 'ডোল্লু কুনিথা নাচের তালে মেতে উঠল। এই নাচে প্রচুর শক্তি ও সক্রিয়তা দরকার, সমগ্র কর্ণাটকের সমস্ত রকমের উৎসবে সামিল করা হয় এই লোক নৃত্য।
মাথায় ছাতা দিয়ে, বোজাকারা (সহচর) আর তার পরিবার পরিজনের সঙ্গে বর বিবাহ মণ্ডপে প্রবেশ করতেই, অভ্যর্থনার অঙ্গ হিসেবে কনের পরিবারের সদস্যরা বর ও তার বোজাকারা'র পা ধুইয়ে দিল এবং তাদের ওপরে পবিত্র তণ্ডুল বর্ষণ করে স্বাগত জানাল। বরের যাত্রাপথে একটি ধবধবে সাদা চাদর বিছিয়ে দিল পরিবারের ধোপা। বরের বাড়ি থেকে আনা 'পোলিয়া'(সুসজ্জিত কলস) বরের বোনের মাথা থেকে নামিয়ে, পবিত্র দীপের নিচে রেখে দিল পদ্মাবতী।
কনের মা, তাঁর হবু জামাতাকে দুধ ভাত ও চিনির মিশ্রণ খাইয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।
বোজাকারার নির্দেশ মতো কনের আসনের দক্ষিণ পাশে রাখা বরের আসনটিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে তার ওপরে চাল ছড়িয়ে দিয়ে মুক্কালিটিকে স্পর্শ করে মাথায় হাত ছোঁয়াল রাঘব। ডান পা এগিয়ে, পূর্ব মুখী হয়ে সে বসল মুক্কালিতে।
একই ভাবে কন্যা এই আচার পালন করল তার বোজাকার্থির সঙ্গে।
বর এবং কনে এসে মুক্কালিতে আসন গ্রহণ করলে, তাদের সর্বপ্রথম আশীর্বাদ করার অধিকার কনের মায়ের। রূপোর রেকাবি থেকে মুঠো ভরে চাল নিয়ে সন্তানদের মস্তকে বর্ষণ করলেন তিনি। কিণ্ডি থেকে দুধ পান করালেন। কনের আঁচলের কোণাতে বেঁধে দিলেন স্বর্ণমুদ্রা। মা বিধবা হলেও এই আচারে তাঁর পূর্ণ অধিকার থাকে।
সকলের আশীর্বাদ সম্পূর্ণ হলে বর বধূ আশীর্বাদ পেল তাদের বোজাকারা এবং বোজাকার্থির।
এইবারে মুক্কালি ছেড়ে উঠে, নির্দেশ মতো তার হবু স্ত্রীয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মাথায় চাল ছিটিয়ে দিল বর। তাকে কিণ্ডি থেকে দুধ পান করিয়ে তার হাতে দিল 'চীলা পানা' লাল সিল্কের ছোট ব্যাগ যাতে অন্তত এক একটি স্বর্ণ রৌপ্য এবং তাম্র মুদ্রা রাখা। স্বামীর সম্পদে স্ত্রী'র সমান অধিকার বোঝাতে এই রীতির প্রবর্তন।
নিজের ডান হাতে হবু স্ত্রীয়ের ডান হাত নিয়ে তাকে আসন থেকে উঠিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করালো রাঘবেন্দ্র। এইবারে তারা জুঁইফুলের মালা বদল করতেই সম্পন্ন হলো 'দম্পথি মূর্থা'।
নববিবাহিতদের ওপরে ফুল আর চাল ছুঁড়তে ব্যস্ত অনুমিতা মাথা ঘুরিয়ে আদর্শিনীকে খুঁজতে গিয়ে তার চোখ মিলল অম্রুথের চোখে।
সাংঘাতিক ভালো অ্যাকাডেমিক রেকর্ড অম্রুথের। আই আই টি গান্ধীনগর থেকে আর্কিওলজীতে ডক্টরেট করে এখন সেখানেই ফ্যাকাল্টী মেম্বার। প্রচুর তথ্য দিয়ে অনুকে সাহায্য করেছে অম্রুথ। হাসল অনুমিতা।
বারে বারেই চোখ গেল অম্রুথের দিকে, অনু দেখল সে একভাবে তাকিয়ে আছে তারই দিকে। অনুর গালে রঙ ধরল।
অনুমিতার জীবনে প্রথম প্রেমিক বই, পড়াশোনার বাইরে আর কিছুই জানে না সে। অসাধারণ সুন্দরী না হলেও তার চেহারা লাবন্যময়। ঘরে ফিরে সে আয়নায় একবার দেখল নিজের দিকে। অম্রুথের চোখ দিয়ে দেখতে চেয়ে, লজ্জা পেল অনুমিতা।
বিবাহের সঙ্গে সঙ্গেই চলতে থাকল উৎসবের ভোজ।
প্রথাগত পানাহারে ছিল কদমবুট্টু (দলা পাকানো ভাত) পাপুট্টু (চালের রুটি) পান্ডি(শুকর) কারি, মুরগীর মাংসের পদ (যাঁরা শূকর খাবেন না তাঁদের জন্য) সাদা ভাত, সবজি এবং মধুরেণসমাপয়েৎ হলো পায়সম্ দিয়ে কিন্তু তারপরেও ছিল কার্থা কফি অথবা কালো কফির সঙ্গে গুড় আর কলা। কলাপাতায় ভোজন পরিবেশন করা হলো। 'পারাঙ্গি মালু' বা বার্ডস আই চিল্লি বিবাহ ভোজের এক অপরিহার্য অঙ্গ। ভোজের শেষে পান, সিগারেট, বিড়ি রাখা থাকে আতিথেয়তার নিদর্শন স্বরূপ।
-বৈদিক যুগে আর্যরা ভারতের উত্তর প্রান্তে এবং দ্রাবিড়রা দক্ষিণে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
হঠাৎ করে অম্রুথ কথা শুরু করতেই চমকে উঠে অনু আগ্রহের সঙ্গে অম্রুথের দিকে তাকাল।
-মহান মহাকাব্য রামায়ণের রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী কিন্তু ইতিহাস বলে সেই তুলনায় কোডাগুর কাহিনী আরও প্রাচীন। কথিত আছে শ্রীরাম লঙ্কায় যাওয়ার পথে এবং সেখান থেকে ফেরার সময় কোডাগু'র ভূমি পবিত্র করেছিলেন। রামায়নের সময় থেকেই কোডাগু'র মানুষ শ্রীরামকে পুজো করে আসছে।
জান অনু, একসময়ে আমাদের কূর্গ ভয়ানকভাবে পিতৃতান্ত্রিক ছিল এখন আর সেই ধরনের রীতি নীতি বিশেষ দেখা যায় না।
কোডাভা উপজাতির মধ্যে বিবাহের ব্যাপারে কয়েকটি অনন্য প্রথা দেখা যায়। কুদাভালি অর্থ একত্রে বসবাস, এই উপজাতির বিবাহ প্রথায় একাধিক রীতি দেখা যায়, অবশ্য সব নিয়মই বদলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
মূর্থা থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত ছিল অনু আর আদু। জোছনায় ভাসা নদীর রূপ দর্শনের ইচ্ছেটা কিন্তু অনুর মন থেকে বিদায় নিল না।
আদর্শিনী ঘুমিয়ে পড়তেই বিছানা ছাড়ল অনুমিতা। অচেনা জায়গায় রাতের বেলা এভাবে নদী খুঁজতে যাওয়া কি ঠিক হবে? কিন্তু নদীটা ভীষণ ভাবে টানছিল তাকে। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো আগু পিছু চিন্তা না করেই বেরিয়ে পড়ল অনু।
পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়, আকাশের গায়ে হাসছে ঝকঝকে রূপোর থালার মতো প্রায় গোল চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। নদীর দিকটা আন্দাজ করে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল সে। ওই তো দেখা দেখা যাচ্ছে রূপোলী আলোর বন্যায় ঝিলমিলে জলের ধারা। জলধারা তাকে এত টানে কেন বুঝেই উঠতে পারে না অনু কিন্তু তার সাঁতার শেখা হয়নি। নিশির ডাকে সাড়া দেওয়া অতৃপ্ত আত্মার মতো চলতে চলতে, অনু কখন যেন নদীর ধারে পৌঁছে গেল। পায়ের তলার ঝুরঝুরে মাটি ভেঙে যেতেই জলে পড়ে গেল সে। পারের কাছে জল বেশি না থাকলেও আচমকা জলে পড়ে যাওয়ার ত্রাসে, বাঁচবার চেষ্টা না করে হাবুডুবু খেতে লাগল অনু।
ঘুম আসছিল না, বাগানের শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপরে পায়চারি করছিল অম্রুথ। গেট খোলার শব্দে তাকিয়ে তার মনে হলো একটা ছায়া সরে গেল। সন্দেহের বশে অম্রুথ সেই ছায়াকে অনুসরণ করল। জ্যোৎস্না মাখা মাঠঘাটের কী অসাধারণ রূপ, কী অপূর্ব সুন্দর তার জন্মভূমি। পৃথিবীর আর কোনো স্থান তাকে এত মায়াতে জড়াতে পারেনি। স্পষ্ট হলো সেই অবয়ব, নারী শরীর। এত রাতে কে বেরলো বাড়ি থেকে? চলার ভঙ্গীটা চেনা লাগল, নদীর পথ ধরেছে সে। আনমনে চলতে চলতে নদীর কাছাকাছি পৌঁছতেই ঝপাং করে শব্দ উঠল জলে। আরে! পড়ে গেল?
একটা মানুষকে জলে হাবুডুবু খেতে দেখে নদীতে ঝাঁপ দিল অম্রুথ আর চুল ধরে টেনে ডুবন্ত শরীরটাকে পারে নিয়ে এল। তাড়াতাড়ি উদ্ধার করে ফেলায় বিশেষ জল খেতে পারেনি। বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে তাকে ঘাসের ওপরে শোওয়াতেই ত্রয়োদশীর জ্যোৎস্নায় তার চেহারা স্পষ্ট হলো, অনুমিতা! জ্ঞান আছে কী না দেখতে তার গালে নরম হাতে কয়েকটা চাপড় মারল অম্রুথ। চোখ খুলেই তার রক্ষাকর্তাকে আঁকড়ে ধরল অনু, তার মাথা এলিয়ে পড়ল অম্রুথের কাঁধে।
কিসের থেকে কী হয়ে গেল, আবেগ তাড়িত অম্রুথ অনুর কপালে তার ঠোঁট ছোঁয়াতেই, অচেনা এক পুরুষের বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে অনুর শরীরটা যেন ভীষণ শীতে কেঁপে উঠল। অনুর কাঁপুনিটা অনুভূত হতেই নিজের শরীরের উষ্ণতায় তাকে ভরিয়ে তুলতে চাইল অম্রুথ।
অনুকে বুকে জড়িয়ে ধরেই উঠে দাঁড়াল সে। মায়াবী চন্দ্রকিরণে অপরূপ হয়ে উঠেছে অনুর রেশমের মতো কোমল মুখ।
-আমাদের কূর্গকে ভালবাস তুমি?
অনুর ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠলেও কিছুই শোনা গেল না।
-তোমার সঙ্গে জীবন কাটাবার প্রতিশ্রুতি দিতে চাই, এই চাঁদকে সাক্ষী রেখে।
অম্রুথের বুকে মুখ লুকলো অনুমিতা।
সোমওয়ারপেট ছেড়ে স্বামী রাঘবেন্দ্র'র সঙ্গে তার পৈত্রিক ভিটে, টুলু নাডুর ছবির মতো গ্রাম নভুরুতে গিয়ে পৌঁছল ভাগ্যলক্ষ্মী।
তার পরনে ছিল পারম্পরিক ন'গজী নওয়ারী শাড়ি।
ভাষা সংস্কৃতি রীতি নীতি এবং জাতিগত ভাবে কোডাগুর সঙ্গে কোনো রকমের মিল নেই সেই স্থানের। একদিকে আরব সাগর, অন্যদিকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মাঝে অবস্থিত টুলু নাডু ভাগ্যলক্ষ্মীর নজর কেড়ে নিল তার সবুজে সবুজ ধানক্ষেত, উঁচু নিচু টিলা বেয়ে নেমে আসা ঝিরঝিরে আর ঝরঝরে ঝর্ণা, নারকেল গাছের সারির সৌন্দর্য দিয়ে। মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট ঘর বাড়িতে ঘেরা গ্রাম।
মুগ্ধ চোখে সব দেখছিল ভাগ্যলক্ষ্মী।
বধূ বাড়ির দরজায় পৌঁছতেই আরতির থালি হাতে বেরিয়ে এলেন রাঘবেন্দ্র'র পিসিমা। তাঁর দীপ-আরতি সম্পূর্ণ হতেই সেই আরতির থালি হাতে নিলেন রাঘবেন্দ্র'র মা। পূজারীর নির্দেশ মতো তার ডান পা দিয়ে চাল ভরা ছোট কলস উল্টে দিয়ে গৃহ প্রবেশ করল লক্ষ্মী। রাঘবেন্দ্র'র বোন আর ভগ্নিপতি বর বধূর হাত ধরে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে তাদের প্রজ্বলিত দীপের চারপাশে প্রদক্ষিণ করালো।
কোডাভা সংস্কৃতির বিবাহে সপ্তপদী অনুষ্ঠিত না হওয়ায় রাঘবেন্দ্র'র বাড়িতে হোম এবং বর কনের সপ্তপদী আয়োজিত হলো। রাঘবেন্দ্র'র বোন তাদের অঞ্জলিবদ্ধ হাতে খই তুলে দিলে তারা সেই খই তিনবার হোমাগ্নিতে আহুতি দিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে পবিত্র অগ্নিকে সাক্ষী রেখে সাত পা এগোল। সপ্তপদীর সময়ে প্রত্যেক পদক্ষেপে লক্ষ্মী তার পা দিয়ে তণ্ডুল পূর্ণ পাত্র উল্টে দিয়ে, স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে বিবাহ প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করল।
প্রথা মতো, শ্বশুরালয়ে স্ত্রীয়ের নতুন নামকরণ করে তার স্বামী। চাল ভরা থালির ওপরে তার আংটি দিয়ে সেই নাম লিখে দিতে, বধূ সেই পাত্র স্বামীর হাত থেকে গ্রহণ করলেই তার নতুন নামকরণ অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হয়।
বিবাহ অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে স্বামীর কাছ থেকে নব বধূ পাঁচটি শাড়ি পেল উপহার স্বরূপ, বিভিন্ন পর্বে পরার জন্য। তার গলায় রাঘবেন্দ্র পরিয়ে দিল পবিত্র মঙ্গলসূত্র।
কয়েকদিন শ্বশুর বাড়ির পরিজনদের সঙ্গে টুলু নাডুর নভুরুতে কাটিয়ে তারা গিয়ে পৌঁছল রাঘবেন্দ্র'র কর্মস্থান, ম্যাঙ্গালুরুতে।
কলকাতায় নিজের বাড়ি ছেড়ে কুর্গে, স্বামী অম্রুথের ওক্কায় যাওয়ার জন্যে রওনা হলো অনুমিতা।
তাদের বিবাহ অনুষ্ঠিত হলো এক অভিনব রীতিতে।
বাঙালি সাজে সেজেছিল অনুমিতা।
অম্রুথ এসেছিল কুপ্যা এবং ধুতি পরে, কোমরে চেলের সঙ্গে বাঁধা ছিল ওডি কাঠি ও পীচে কাঠি। মাথায় টোপর।
প্রদীপের আলোয় বরের মুখ দেখে, দুধে হাত ধুইয়ে, তার মুখে মিষ্টি দিয়ে বরণ করলেন অনুর মা। জামাই দেখে অত্যন্ত খুশি হলো অনুমিতার আত্মীয়-স্বজন।
বাঙালি মতেই সম্পন্ন হলো অম্রুথ অনুমিতার বিয়ে।
অনু তার বাবাকে আগেই বলে দিয়েছিল, কন্যাদান এবং কনকাঞ্জলি'র রীতি পালন করা হবে না। বিয়ের মন্ত্রও তারা দু'জনেই সমানভাবে উচ্চারণ করল। অনুমিতার পিসি, সংস্কৃত অধ্যাপিকা নয়নতারা গোস্বামীর শুদ্ধ সুললিত বিবাহ মন্ত্রের অনুসরণে।
লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে অনুমিতার নতুন ওক্কা'র দ্বারে এসে দাঁড়াল নববিবাহিতেরা। অম্রুথের সঙ্গে ছিল তার বোজাকারা সায়ন্তন, অনুমিতাকে আগলে রাখল তার বোজাকার্থি আদর্শিনী।
গৃহপ্রবেশের আগে, শ্বশুর বাড়িতে নববধূকে দেওয়া হলো 'সাম্মান্দা'(সম্পর্কের অধিকার) এই প্রথার দ্বারা মূর্থাকে প্রতিষ্ঠিত করে বধূকে সম্মান জানানো হয়। বর এবং বধুর পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা পবিত্র প্রদীপকে মাঝখানে রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একসঙ্গে পারম্পরিক সাম্মান্দা সূত্র আবৃত্তি করলেন। এইসময়ে নানা ধরনের হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে দুই পরিবারে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হলো।
অনুমিতার বাবা মায়ের কোডাভা ভাষাতে মন্ত্র আবৃত্তির প্রচেষ্টায় হাসাহাসিটা বেশিই হলো। ওক্কাতে বধূর অধিকার প্রতিষ্ঠা হতেই কনের তরফ থেকে অনুর বাবা, অম্রুথের বাবার হাতে স্বর্ণমুদ্রার প্রতীক হিসেবে বারোটা নুড়ি পাথর দিয়ে কনের অধিকার তুলে দিলেন তার শ্বশুর বাড়ির অভিভাবকদের। অম্রুথের বাবা এগারোটা নুড়ি নিজের কাছে রেখে একটা ফিরিয়ে দিলেন অনুর বাবাকে, কন্যার সঙ্গে তার বাপের বাড়ির সম্পর্ক বজায় রাখতে।
সাম্মান্দা প্রথা পুরো হতেই, অম্রুথের দায়িত্ব এলো তার স্ত্রীকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়ার। সেই সময়েই বাঙালি বিবাহ সংস্কৃতির শয্যা তুলুনির মতই 'বাট্টে থাডপা' রীতিতে, বৌদির স্বামীত্বের দাবিতে কনের রাস্তা আটকাল অম্রুথের পিসতুতো ভাই। স্বর্ণমুদ্রা হাতে আসার পরেই মুক্ত হলো বর বধূ।
খাওয়ার জন্যে সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন অম্রুথের মা।
ভোজনান্তে, বিয়ের বাদ্যের সঙ্গে নৃত্য গীতে মেতে উঠলেন নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে।
অম্রুথের অনুরোধে একক ওড়িসী নৃত্য প্রদর্শন করল নৃত্যপটীয়সী অনুমিতা।
সন্ধ্যাবেলা 'নীর এডপা' অর্থাৎ গঙ্গা পূজে'র আয়োজন করা হলো, বধূকে তার স্বামীর ওক্কার সদস্যপদ দিতে।
বধূর পা থেকে সব গহনা খুলে নিয়ে তার পায়ের আঙুলে রূপোর চুটকি পরিয়ে, বিবাহিতার চিহ্ন হিসেবে বিশেষ বস্ত্র বেঁধে দেওয়া হলো। পবিত্র প্রদীপের সামনে প্রার্থনা করার পরে গঙ্গা পূজে'র জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হলো আঙিনার কূপের কাছে। তাকে সঙ্গ দিল তার বোজাকার্থি এবং শ্বশুর ঘরের মহিলারা, বাজতে থাকল বিয়ের বাদ্যি।
নির্দেশানুসারে, অনুমিতা কুয়োর জলে কিছু চালের দানা ছড়িয়ে দিল।
অনুকে কলা খেতে দিলেন তার শাশুড়ি'মা। অভিভাবিকাদের নির্দেশে তিনটি সুপারি পান পাতার ওপরে রেখে তা সাবধানে ওই কুয়োর জলে অর্পণ করল অনুমিতা।
এর পরে, স্বামী অম্রুথের পীচে কাঠি দিয়ে নারকোল ভেঙে সেই দু'ভাগের নারকোল মালা সে বিসর্জন দিল কূপের জলে। সেখানেও নানা রকমের আদিরসাত্মক হাস্যকৌতুক চলতে থাকল।
পান আর সুপারি চিবোতে চিবোতে কুয়ো থেকে জল তুলে চারটি পাত্র ভরল অনুমিতা।
দুটি জলপূর্ণ পাত্র তার মাথায় রাখা হলো, বাকি দুটি নিল তার দুই ননদ ভাগ্যলক্ষ্মী আর পদ্মাবতী। একজন চলল আগে, একজন পেছনে। মাথায় দুটি জলপূর্ণ কলস নিয়ে নানা রকমের বাধাবিঘ্ন যেমন আত্মীয়াদের প্রশ্নবাণ, যাত্রাপথে রাখা নানাবিধ বস্তু সামগ্রী পেরিয়ে পাকশালাতে প্রবেশ করল অনুমিতা।
জলপূর্ণ কলস মাথায় নিয়ে বাদ্যের তালে তালে এবারে সে গিয়ে পৌঁছল বিবাহ মণ্ডপে, পবিত্র প্রদীপের কাছে। জলের কলস দুটি সে রেখে দিল প্রদীপের নিচে। এই প্রথা পালিত হয় নববধূর ধৈর্য ও সহ্যশক্তির পরীক্ষা নিতে তবে সবটাই মজার ছলে।
'কোম্বারেক কূটুভা' প্রথা পালন করতে অনুমিতার বোজাকার্থি আদর্শিনী, তাকে নিয়ে গেল তার শোওয়ার ঘরে। তার মাথা মুখ উড়নি দিয়ে ঢেকে বসিয়ে দিল শয্যার ওপরে।
অম্রুথকে তার বোজাকারা সায়ন্তন পৌঁছে দিল শয়নকক্ষে।
অনুমিতার ওড়না তুলে, মুখ দেখে তার আঙুলে সোনার আংটি পরিয়ে দিল অম্রুথ।
তৃষিত একজোড়া অধরোষ্ঠের মিলনে সার্থক হলো 'মঙ্গলা'।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার এবং তথ্যসূত্রঃ