Photo by Jacob Morch on Unsplash

ফোন হাতে নিলেই আজকাল একটা জিনিষ খুব নজর কাড়ে - অনলাইন বেগিং। হ্যাঁ , ভিক্ষাবৃত্তির সাথেই তুলনা করলাম বা করতে বাধ্য হলাম।

সকাল -বিকেল বা সারাদিনের যেকোনো সময় কিছু মানুষ (অল্পবয়সী থেকে মধ্যবয়সী)নিজেদের মুখাবয়ব বা সমগ্ৰ শরীর দেখিয়ে রিল বানিয়ে চলেছেন। বাংলা,হিন্দি, ইংরেজি বা যেকোনো ভাষার গানেই তাদের লিপ ওঠানামা করছে এবং অবশ্যই সেই গানের সাথে খাপ খাইয়ে একটা ব্যাকগ্ৰাউন্ড থাকছে। বেশ এই অবধি বুঝলাম ভালো।

এতে নাকি Earn হয় , আরো ভালো।

কিন্তু এই আর্ন বা রোজগারে Gain হয়তো হচ্ছে সাময়িক কিছু অর্থ। কিন্তু সম্পূর্ণ Loss হচ্ছে মানসিকতা, সামাজিকতা, পারিবারিক সংস্কৃতি, রুচি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এক কঠিন বাতাবরণ সৃষ্টি হয়ে চলেছে।

অবক্ষয়ের পথে হাঁটছে সমাজ।

রিল বানানো বা গানে লিপ দেওয়া একেবারেই খারাপ কাজ নয়।গান, সুর, তাল, ছন্দ নিয়েই তো জীবন।

অবশ্যই আমরা নাচ, গান করবো। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এইগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং গর্বের জায়গা বহন করে চলে আসছে বহু বহু যুগ ধরে।

আমরা স্বয়ং শিবকে নটরাজ রূপে জানি। মা সরস্বতী আমাদের কাছে গানের দেবী রূপে পূজিত হন। ধর্ম এবং সংস্কৃতির এই মেলবন্ধন অভিনব বার্তা বহন করে। তবে শুধু ভারতবর্ষে নয়, অন্যান্য দেশে ও পুরা কাল থেকে এসবের চর্চা হয়ে আসছে। নাচ,গান, নাটক,যাত্রা, অভিনয় নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বমহিমায় উজ্জ্বল এবং শ্রেষ্ঠত্বের সিংহাসনে আসীন।

কিন্তু আমরাই খুব খারাপ ভাবে এগুলোর অপব্যবহার করে চলেছি দিনের পর দিন ধরে। নিজ কন্ঠে কেউ যেকোনো সুরেলা গান বা নিজে যে যেমন নাচ জানে ,সেটা ভিডিও করে সে রিল হিসেবে পোস্ট করতেই পারে।এটা কোনো খারাপ ব্যাপার নয়।

কোনো ফুল,গাছ, সমুদ্র, পাহাড় নিজের ছোট্ট কোনো পোষ্য ইত্যাদি দিয়ে একটি সুন্দর গানের মাধ্যমে রিল বানিয়ে পোস্ট করাও যায়। হয়তো এমন কোনো মানুষ আছে যার মন খারাপ বা মাথায় নেগেটিভিটি কিছু চিন্তা ভাবনা আসছে সে ফেসবুক Scroll করতে করতে এই ধরনের কোনো একটা গানের রিল দেখে মনটা ভালো হয়ে গেল,একটু হালকা বোধ করলো। অনেক সময় গান মনে কোনো না কোনো স্মৃতি বহন করে আনে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে একটি যুতসই গান ব্রেন এ Positive Vibes পৌঁছাতে অনবদ্য। তাই সমস্যা কিন্তু রিল বানানোর নয়

অতি কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয় যখন বিশেষ করে নারীরা নিজেদেরকে এই রিলের পন্য হিসেবে ব্যবহার করে।

বেশ সাজগোজ করে , ভুলভাল ঠোঁট নেড়ে কোনো একটা গানের দু'তিন লাইন পোস্ট করা আর তার সাথে কিছু আহাম্মক মানুষ লাইক, কমেন্টের ঝড়

বইয়ে দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। আচ্ছা সবাই তো বোঝে এইসব গান নিজের গাওয়া নয়, তাহলে এই জেগে, ঘুমানো মানুষগুলো সত্যিই জ্ঞান পাপী নয় কি ?

রিল বানাতে গিয়ে অনেকে মারাত্মক এমনকি প্রাণঘাতী দূর্ঘটনার কবলে পড়ার নজির ও রেখেছে।

কিছু জন আবার নিজের ছেলে- মেয়েকেও এসবের মধ্যে জড়িয়ে ফেলে। আর শিশুর অবচেতন মন খুব সহজে এই রঙিন খারাপ ফাঁদে নিজেকে অভ্যস্ত করে নেয়। নিষ্পাপ শিশুরা মনে করে মা -বাবা এমনি করছে, তাহলে তো এটাই ঠিক কাজ ! আর এই ধারনাকেই মনে পোষণ করে তারা বেড়ে উঠছে এবং ভবিষ্যতে তাদের জীবনযাত্রা এমন পথে হাঁটছে যে তখন মা, বাবাদের হাহুতাশ করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না।

এমনিতেই যেকোনো জিনিসের ধর্মই হোলো নিচের দিকে ধাবিত হওয়া আর মন ও তার ব্যতিক্রম নয়। আমরা একটা ভালো জিনিষ গ্ৰহন করতে যতটা সময় নি একটা খারাপ কিছু কিন্তু নিমেষের মধ্যে আমরা আয়ত্তে করে ফেলি আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এই Catching Power টা খুব দ্রুত কাজ করে।

এই বয়সটা তো খেলার,পড়ার, ছবি আঁকার, নাচ,গান শেখার,গল্প শোনার, হেসে -খেলে বড়ো হয়ে ওঠার। সাপ লুডো, পুতুল খেলার বা একটু আধটু ছোটা ভীম, ডোরেমন, ডিজনি ল্যান্ড দেখার।

বিভিন্ন মনীষীদের জীবনী পড়ার। এতো সুন্দর একটি দেশ ভারতবর্ষ, তাকে রোজ একটু একটু করে জানার।

আর এসব বাদ দিয়ে বড়োরা নিজের সন্তানদের হাতে ধরে নিয়ে চলছে উচ্ছন্নের পথে।

টাকা উপার্জন করার অনেক সৎ পথ রয়েছে। কেউ কেউ নিজের সাপেক্ষে যুক্তি সাজাতেই পারে যে খুব খারাপ পোশাক পড়ে বা অন্য রকম ভাবে রিল বানাই না । আবার এও তাঁরা ভাবতে পারে, আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক যা খুশি তাই করতেই পারি।

পোশাক খারাপ/ ভালোর প্রশ্ন নয়।

দৃষ্টিকটু এবং এগিয়ে চলার পথে বাধা এই ধরনের কাজকর্ম গুলো।

নিজের মুখ দেখিয়ে বিনিময়ে কিছু পাওয়া কখনো ভালো কিছু হতে পারে না। ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে, দেশের সামাজিক পরিবেশের সাথে এ ধরনের চিন্তা ভাবনা যায় না।

আর স্বাধীন মানেই যা ইচ্ছে তাই করা যায় না। জঙ্গলের পশুরাও কিন্তু কিছু আদপ কায়দা মেনে চলে।

আর আমরা যে মানুষ, ঈশ্বরের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি !

সত্যি কথা বলতে কি যারা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য রাস্তায়, ট্রেনে ,বাসে বা দ্বারে দ্বারে নিজ নিজ বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়,দু এক কলি গান নিজ কন্ঠে গেয়ে পয়সা উপার্জন করে, তারা এইসকল রিলধারীদের থেকে যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী। তাদের যে আর কোনো উপায় নেই তাই ঐ ভিক্ষাবৃত্তির পথে হাঁটছে। বেঁচে থাকতে গেলে খেতে তো হবেই। কিন্তু যারা শিক্ষিত, আধুনিক, গাড়ী, বাড়ি, টাকা পয়সার অভাব নেই তারা অনলাইন ভিক্ষাবৃত্তির পথে না হেঁটে, সমাজকে এবং নিজেকে কলুষিত না করে কিছু ভালো কাজ বা ভালো ইতিবাচক চিন্তাধারায় নিজেকে নিয়োজিত করুক। এমনিতেই মানুষের জীবন সীমা কম তাই এই পৃথিবীকে দুচোখ ভরে দেখে,জেনে, এমনকিছু করে যাক যাতে পৃথিবীতে তার ও একটা দাগ থেকে যায়। কিছু সৃষ্টি করুক। সময়ের অপব্যবহার না করে নিজের জন্য, মানুষের জন্য সুস্থ, সুন্দর সমাজ গড়ে তুলতে এগিয়ে যাক। রিলের মাধ্যমে শিক্ষনীয় কিছু পোষ্ট করুক। জানার তো কোনো শেষ নেই তাই অজানা, ভালো কিছুর রিল তৈরি হোক।

যদিও ফেসবুক,রিল, ইত্যাদি এসব সাময়িক। কিছুক্ষণ হয়তো তোমাকে মুগ্ধ করে রাখবে কিন্তু এটাই জীবন নয়।

সমাজকে ,নিজেকে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে অবক্ষয়ের পথে নিয়ে যাওয়ার আগে, নিজ নিজ মনে কি একবারও প্রশ্ন জাগে না, আমরা সঠিক না ভুল?

.    .    .

Discus