Photo by Church of the King on Unsplash
ঘরের ভাড়া ছিল ষাট টাকা। ছোট বেড়ার ঘর। একটা চৌকী পাতা ওদেরই, আর ঘুঁটে মজুদ করে রাখা তার মধ্যে হাজার হাজার আরশোলার বাসা। কি সাংঘাতিক সেই ঘর। অসহায় অবস্থা, এছাড়া উপায় ছিল না। নাই মামার চাইতে কানা মামা ভাল এই ভেবে থাকতে শুরু করলাম। মশারী, বিছানা, বালিশ, থালা, বাসন, স্টোভ যতটুকু প্রয়োজন কিনে আনলাম। একার সংসার শুরু হলো। কঠিন জীবনযাত্রা।
সেই বছর টিভিতে মহাভারত শুরু হয়েছে। যে বাড়ীতে টিভি সেই বাড়ীতে মহাভারত দেখার জন্য ভীড় লেগেই যেতো। রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেতো।
আমাদের কাজ আরো দু'মাস চললো হাওড়া, কলকাতায়। নভেম্বর মাস নাগাদ আমাদের দুটো টিমকে বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করে অফিস থেকে। মহারাষ্ট্র, গুজরাট স্থান নির্বাচন করা হলো।
বাইশ জনের দুটো টিম, ছেলেমেয়ে সহ টিমলিডার দুজন রওনা দিলাম বাইরের উদ্দেশ্যে। বাইরের মাইনে ভাল, খাওয়া, থাকা, ট্রেনের টিকিট রিজার্ভেশন সব কোম্পানির। সেই প্রথম কোম্পানির কাজে বাইরে যাত্রা। বাইশজন ইয়ং গ্রুপ। রিজার্ভেশন কামরায় প্রচন্ড আনন্দ করতে করতে বোম্বেতে এসে পৌঁছালাম।
এইখান থেকে দুটো টিম ভাগ হয়ে গেল। একদল নাসিকে আর একদল থানেতে। আমি নাসিকের দলে। বোম্বে থেকে আমরা এগারোজন দোতলা ট্রেনে চাপলাম। এর আগে ধানবাদ থেকে ব্ল্যাকডায়মন্ডে দোতলা ট্রেনে চেপেছিলাম।
আমাদের ট্রেন টানেলের ভিতর দিয়ে ঢোকে আবার বেরোয়। সেই প্রথম টানেল কি জিনিস জানলাম। পাহাড় কেটে কেটে তার ভিতর দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। ট্রেন ভিতর দিয়ে যাবার সময় পুরো অন্ধকার হয়ে যায় যেন মনে হয় অন্য জগতে এসে পড়েছি কিংবা অন্ধ কূপের ভিতর প্রবেশ করেছি।
এইভাবে বেশ কয়েকটা টানেল পার করতে করতে একসময় আমরা এগারোজন নাসিকে এসে পৌঁছালাম। সে এক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর শহর। রাম সীতার স্থান, সব রুপকথার মতো।
আমরা একটা ধর্মশালায় উঠলাম। পরেরদিন আমাদের ছুটি ছিল শহরটা কেমন, শহরের মানুষজন কেমন বোঝার জন্য , ঘুরে ফিরে দেখার জন্য। আমরা গোদাবরী নদীর তীরে গেলাম, ড্যাম দেখলাম, রামকুন্ড, সীতাকুন্ডতে স্নান করলাম। কিছুতেই আমি নামবো না সবাই মিলে ধরে আমায় রামকুন্ডে নামালো। আমি সাঁতার জানি না, জলকে ও ভয় তাই কোথাও গিয়ে নদী বা পুকুরে বা সমুদ্রে স্নান করি না।
এখানে এদের পাল্লায় পড়ে ডুব দিতে হলো। ফেরার পথে ভিজে কাপড়ে সবাই ধর্মশালায় ফিরলাম। ততক্ষণে আমার ঠান্ডা লেগে গেছে। রাত্রেবেলায় কয়েক মিনিট শোওয়ার পর হঠাৎ করে আমার শ্বাসকষ্ট হয়, আগে কখনো এরকম হয়নি।
সবাই তো ভয় পেয়ে যায় আমার এই অবস্থা দেখে। কিছুতেই শুতে পারছি না, বসতে পারছি না। সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। কিছুতেই কমছে না। রাত করে নতুন জায়গায় ডাক্তার কোথায়? ভোরের অপেক্ষা করতে হবে।
একজন বলল, "আমার কাছে হোমিওপ্যাথি ওষুধ আছে খাবে দিদি?"
আমি বললাম, "দে, যদি কমে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না কিভাবে কমবে।"
হোমিওপ্যাথি ওষুধ খেয়ে রাতটা কোনরকমে কাটালাম বসে বসে। কেউ আমার জন্য ঘুমোতে পারেনি সেই রাতে। ভোর হতেই দুজন ওষুধ আনতে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা দোকান খুলিয়ে আমার শ্বাসকষ্টের জন্য ওষুধ এনে দিল। আমি খেলাম। প্রায় দশ পনেরো মিনিটেই শ্বাসকষ্ট কমতে ওরা বাঁচলো, আমি ও বাঁচলাম। ওদের মুখ চোখের যা অবস্থা হয়েছিল তা আর কহতব্য নয়। সবার মুখে হাসি ফুটলো।
এরপরে যে যার মতো রেডি হয়ে দশটার সময় এগারোজন মিলে কাজে বেরোলাম। কাজ স্মুদলি চলতে থাকলো। সবাই সবাইকে হেল্প করতে লাগলো। সব বাড়ী বাড়ী গিয়ে রান্নাঘরে ডেমোনস্ট্রেশন দেখানো, দেখানোর পর বাড়ীর গিন্নীরা খুব খুশী, খুশী হয়ে মিষ্টি খাওয়ানো, বেশ ভাল লাগছিল।
এক একটা বাড়ী যেন রাজপ্রাসাদ। সুন্দর সুন্দর বাড়ী, সাজানো গোজানো, বাগান, দোলনা, প্রতিটা বাড়ীতেই দোলনা। দোলনা ছাড়া বাড়ী নেই। মারাঠী ভাষা বোঝার উপায় নেই। তবে আমাদের সাথে হিন্দীতেই কথাবার্তা হচ্ছিল। বাংলার 'ব' ও জানে না, হিন্দী ছাড়া উপায় ও নেই।
ওখানে রাত হয় দেরীতে আটটা বেজে যায় সূর্য ডুবতে তাই আমরা ও সাড়ে সাতটা পর্য্যন্ত কাজ করে তারপর একসাথে সবাই ফিরতাম। তখন মোবাইল বলতে কিছু ছিল না। এস টি ডি বুথ থেকে ফোন করতে হতো দরকার পড়লে। প্রতিদিন কলকাতার অফিসে ও ফোন করে আমাদের টিম লিডারকে এখানকার কাজের অবস্থা জানাতে হতো। সেটা সাধারণ ফোন কল না এস টি ডি করে জানাতে হতো, অনেক বিল উঠতো, সব কোম্পানী বহন করতো।
সাতদিন কাজ করার পর আমাদের একদিন ছুটি। ছুটির দিন আমরা বাসে করে পুরো নাসিক ঘুরলাম , পাহাড়ে চড়লাম, ফটো তুললাম, পঞ্চবটীতে গেলাম, রাম সীতার মন্দির দেখলাম। সুন্দর পরিস্কার, পরিচ্ছন্ন শহর। নাতিশীতোষ্ণ শহর। খুব বেশী ঠান্ডা নেই। আমরা নভেম্বরের মধ্যেতে এসেছিলাম। দেড় মাস ছিলাম। তার মধ্যে সুরাট, বরোদা, কল্যাণ, মনমাড ইত্যাদি আরো কয়েকটা জায়গায় কাজ করেছি। সব ভাই বোনের মতো, একই পরিবার যেন।
একদিন বোম্বেতে ঘুরেছি। সমুদ্র সেই প্রথম দেখলাম। শিবাজী পার্ক, নামকরা একটা মসজিদ আরো সব কি কি দেখেছিলাম, ঋষি কাপুরের সাদা গাড়ী দেখে সবাই কি উৎফুল্লিত।
আমরা যখন কল্যাণে কাজ করছি তখন আমাদের অন্য যে টিমটা থানেতে কাজ করছিল ওদের দুজন আমাদের এখানে বেড়াতে এলো, খেয়ে দেয়ে ঘুরে ফিরে গন্তব্যস্থলে ফিরে গেল এবং আমাদের টিমটাকে ওদের ওখানে যাবার নিমন্ত্রণ করে গেল।
কিন্তু আমরা কেউই যাইনি। কয়েকদিন পর আমাদের টিম লিডার জানালো, "আজ থানে থেকে ঐ টিম আমাদের এখানে আসবে, ওরা আমাদের খাওয়াবে। কেউ আগের থেকে খেয়ে নেবে না।"
কেউ কোন প্রশ্ন করলো না দেখে আমি ও কোন প্রশ্ন করলাম না। হঠাৎ কি কারণে খাওয়া দাওয়া কিছুই মাথায় ঢুকলো না। বিনা পয়সায় একদিন না হয় খাওয়ালোই তাতে কি আছে, খাবো।
বারোটায় সবাই আমাদের কল্যাণে এসে হাজির। আমাদেরকে একজন এসে জানালো, ওরা এসে গেছে। কল্যাণে আমাদের হোটেলের কাছাকাছি একটা রেষ্টুরেন্টে ওরা বুক করে রেখেছিল। আগে যেদিন এসেছিল, সেইদিন, আমি এসবের কিছুই জানতাম না। কেউ বলেনি।
পায়ে হাঁটা পথ। হেঁটে হেঁটে আমাদের গ্রুপটা রেষ্টুরেন্টে গেলাম। গিয়ে দেখি ওরা সবাই রেষ্টুরেন্টে হৈ হৈ করছে। আমাদের সবাইকে দেখে আরো সেটা বেড়ে গেল। বিশেষ করে আমাকে নিয়ে সবার একটু বেশি মাত্রায় উদ্দীপনা। কেন, কেজানে।
মাঝে মধ্যেই কেউ কেউ ফিসফিস করতে ব্যস্ত, সবার চোখ মুখে একটা বেশি বেশি আনন্দ। আমি সব খেয়াল করছিলাম বসে বসে। কেন এত ফিসফিস? কি বলছে ওরা, আমাকে বাদ দিয়ে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
ওদের গ্রুপে আমার একটা বন্ধু ছিল, ট্রেনেই আলাপ। নাম দেবাশীষ সেনগুপ্ত। ও নিজেই আলাপ করেছিল। খুব মিশুকে, স্মার্ট এবং ভদ্র।
ঐ দেবাশীষ আমার পাশেই বসেছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি, "এই আয়োজনটা কিসের জন্য। ওরা উঠে গিয়ে ফিসফিস করছে, ব্যাপারটা কি?"
ও বলে, "আরে ব্যাপার কিছুই না, আমাদের ইচ্ছে হলো আনন্দ করতে তাই। একটা দিন কি আনন্দ করতে পারি না, বল তুই?"
ততক্ষণে সব টেবিলে খাবার সার্ভ হচ্ছে, আমারটা এলো শেষে। অঢেল খাবার। সবার থালায় একবার চোখ বুলিয়ে দেবাশীষকে জিজ্ঞেস করলাম, "কি ব্যাপার আমারটা স্পেশাল কেন?"
"আরে কিছু না, তুই খা না" সবার মুখে, চোখে মিটমিটে হাসি।
"আমি এত সব খাবো না, শুধু শুধু নষ্ট হবে, এগুলো সরিয়ে ফেল।"
"আরে আজকে খেতেই হবে। একটা কিছু ফেলা যাবে না, চল, শুরু কর।" অমনি সবাই সুর তুললো, "চল কবিতা শুরু কর।"
সবাই খাওয়া শুরু করে দিলাম। আমার কোন 'না' গ্রাহ্য হলো না। পেট পুরে খেলাম। সবার খাওয়া কমপ্লিট। হাত, মুখ ধুয়ে বসেছি।
দেবাশীষ এবার আমার কানে কানে বলে, "কেমন খেলি? পেট ভরেছে তো?"
আমি বললাম, "এইরকমভাবে খাবার নষ্ট করার কোন মানে হয় বল?"
দেবাশীষ আবার কানে কানে বলল, "পাকা দেখার খাওয়া কী কম হবে? কেমন লাগলো বল?"
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, "কার পাকা দেখা?"
দেবাশীষ বলে "আজকের এই অনুষ্ঠানটা সম্পূর্ণ তোর জন্য করা হয়েছে।"
আমি আঁতকে উঠলাম, "কেন? আমার জন্যে কেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না, পরিস্কার করে বল।"
ততক্ষণে সব হো হো করে হাসছে। "তোর আজ পাকা দেখা" দেবাশীষ বলে।
"এক থাপ্পড় খাবি" বলে পিঠে দিলাম। "ধুর, কি সব আবোল তাবোল বলছিস তখন থেকে।"
"তাহলে শোন ঐদিকে তাকা ঐ টেবিলে ঐ ছেলেটার নাম অভিজিৎ। ও তোকে ভালবাসে। তোর পছন্দ হয়?"
"কি বলছিস তুই? আমাকে ও চেনে নাকি যে ভালবাসে? হুঁ চুপ করতো তুই।"
ছেলেটাকে দেখলাম উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। দেখতে ভাল, খুব শান্ত, কম কথা বলে।
আমি বললাম, "এই কাজ করা ছেলে চলবে না। ওকে জিজ্ঞেস কর কোন বছরে মাধ্যমিক দিয়েছে।"
দেবাশীষ বলে, "ও আমাদেরই সাতাত্তরের ব্যাচ।"
"চলবে না। আমার চাইতে ছোট চলবে না। তার উপর সরকারী চাকরী ছাড়া চলবে না।"
আমার 'না' শুনে সবার এত আনন্দ বেলুনের মতো চুপসে গেল। খুব খারাপ লাগছিল অথচ আমি নিরুপায়।
দেবাশীষ আর একবার শেষ চেষ্টা করলো, বলল, "কবিতা তুই একটু ভেবে দ্যাখ, এরকম ভাল ছেলে পাওয়া খুব মুস্কিল।"
আমি খুব গোঁয়ার, একবার না বললে সেটা আর হ্যা করানোর সাধ্যি ছিল না তখন। যেটা হ্যা তো হ্যা, না তো না।
দেবাশীষের অনেক চেষ্টাতে ও না হ্যা হয়নি। সেদিন ওরা মন খারাপ নিয়ে গন্তব্যস্থলে ফিরেছিল। আমরা ও হোটেলে ফিরেছিলাম। আমাকে আগে থাকতে যদি কেউ ব্যাপারটা জানাতো তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতে দিতাম না। কিন্তু কেউ একবার ও জানালো না। খুব খারাপ লাগছিল আমার। এত আয়োজন সব বৃথা হয়ে গেল, তার জন্য আমি দায়ী ছিলাম না। এরকম না জানিয়ে আয়োজন করা উচিত হয়নি।