Photo by Belle Maluf on Unsplash
১৯৮৩ সালের প্রথম শিক্ষকতার পরে ধানবাদের আরো পাঁচটা স্কুলে শিক্ষকতা করেছি ছোট ছোট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে, যেখানে ইংলিশ, হিন্দী মিশিয়ে পড়াতে হতো। সঙ্গে টিউশনি ও করতাম। বেশীরভাগ ছাত্রছাত্রীই ছিল ননবেঙ্গলী। শিখ ও ছিল, ভাল আয় ছিল, তখন স্কুলের মাইনে বেশি ছিল না। যেটুকু পেতাম তাতেই সন্তুষ্ট থাকতাম।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি তখন প্রথম টিউশনি করি। একটা সেভেনের ছাত্রী আর একটা ফাইভের ছাত্র, ভাইবোন, বাড়ীতে এসে পড়তো। কত টাকা দিত? পঁচিশ টাকা। সেটা কত সাল? ১৯৭৩ সাল। সেই-ই প্রথম পড়ানো।
১৯৮৬ সালের শেষের দিকে আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল খুললো। প্রিন্সিপাল অশোক সিং আমাকে বাড়ীতে এসে বললেন তার স্কুলে পড়াতে। আমি তো খুব খুশী। ওনার স্কুলে গিয়ে দেখি মাত্র দশটা বাচ্চা। কোন অন্য শিক্ষক ছিল না।
মাত্র দশটা বাচ্চা দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। ইচ্ছে ছিল না পড়ানোর । তবু শুরু করলাম ঐ কটাকে নিয়ে। একা একাই ঐ কটাকে নিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলাম, মনে হল আমারই স্কুল। এমনভাবে তাদেরকে তৈরী করলাম যে আস্তে আস্তে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো।
আরো দু তিনজন শিক্ষক জুটলো, পড়াতে লাগলো। আমিই সব বই সিলেক্ট করা, সিলেবাস করা, রুটিন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখতে দেখতে ক্লাস ফাইভ পর্য্যন্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো। যে রুমগুলো খালি ছিল ভরাট হয়ে গেল। প্রিন্সিপাল খুব সন্তুষ্ট স্কুলের উন্নতি হচ্ছে দেখে।
১৯৮৭ সাল পেরিয়ে গেল। ১৯৮৮ সাল এলো। বোনের বিয়ে ঠিক হলো ফেব্রুয়ারী মাসে আমাকে রেখে। আমি তাই দেখে রাগে, দুঃখে স্থির করলাম গৃহত্যাগী হবো, ধানবাদ ছাড়বো। দিদি তখন রিষড়ায় থাকে, বলল তুই অন্য কোথাও যাবি না, আমার এখানে চলে আয়।
আমি প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দিলাম স্কুল ছাড়ার কথা। প্রিন্সিপালকে অশোক ভাইয়া করে ডাকতাম। তিনি শুনে তো অবাক, কোথায় যাবেন? কেন যাবেন? হঠাৎ কি হলো?
উনি সোজা আমাদের বাড়ীতে গিয়ে মা বাবার কাছে কান্নাকাটি শুরু করলেন ওকে যেতে দেবেন না। ওর আমি মাইনে বাড়িয়ে দেবো। ও আমার স্কুলের লক্ষ্মী। ওকে আমি ছাড়তে পারবো না।
বাবা বললেন ওকে আটকানো যাবে না। ও কারোর কথাই শুনবে না। ও যখন ঠিক করেছে চলে যাবে, তো যাবেই, খুব জেদী ও।
অশোক ভাইয়া পরপর তিনদিন মা বাবাকে বোঝালেন আমাদের বাড়ীতে গিয়ে গিয়ে কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। আমি বোনের বিয়ের ছ'দিন আগে সব ত্যাগ করে ব্ল্যাকডায়মন্ড ধরলাম, স্কুল, সমস্ত টিউশনি ছেড়ে, সবাইকে ছেড়ে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। কেউ আটকাতে পারেনি একদিকে বাবার চোখের জল আর একদিকে ভাইয়ার চোখের জল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
তখনকার দিনে আমার আয় ছিল দুই আড়াই হাজার। যখন স্কুল এবং ধানবাদ ছাড়লাম স্কুলের স্টুডেন্ট হয়েছিল দেড়শো। সবই আমার পড়ানোর সুবাদে এবং স্কুল পরিচালনার দক্ষতায়। সব কিছু হেলায় ফেলে সোজা ট্রেন ধরে রিষড়ায় দিদির বাড়ী।
বাইশ দিনের মাথায় আমি টিউশনি পেয়ে গেলাম। এক বাড়ীতেই তিনটে ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ব, খুব কম টাকায়। সেই স্ট্রাগল শুরু হলো। পশ্চিমবঙ্গে টিউশনির কোন দাম ছিল না তখন, যত কম দেওয়া যায় শিক্ষককে। কি আর করা, আস্তে আস্তে টিউশনি বাড়লো তা ও দেখি টাকা আর বাড়ে না। বিহারে থাকতে যত আয় করতাম পশ্চিমবঙ্গে থেকে সারাদিন খেটে ও অর্ধেক পেতাম না।
শেষে চাকরীর চেষ্টা করতে লাগলাম রবিবারের আনন্দবাজারে কর্মখালি দেখতে শুরু করলাম। ১৯৮৯ সালে কর্মখালি দেখতে দেখতে একটা চাকরীর খোঁজ পেলাম কিন্তু তখন কলকাতার কিছুই চিনি না, জানি না। আমায় নিয়ে যাবে কে? আমার এক পিসতুতো ভাইকে বললাম আমাকে ইন্টারভিউতে পৌঁছে দিতে। সে ও কলকাতায় চাকরী করে একটা কোম্পানিতে।
স্যানাগগু স্ট্রীট রাস্তার নাম। খুঁজে খুঁজে হয়রান। পুলিশরাই জানে না এই স্ট্রীটটা কোথায়! শেষে ভাই বোন এক দোকানে জিজ্ঞেস করে এই স্ট্রীটের সন্ধান পেয়ে আমাকে ভাই সেখানে পৌঁছে দিয়ে, হাওড়া যাবার বাস বুঝিয়ে দিয়ে নিজে অফিসে চলে যায়।
অফিসটা ব্রেবোর্ন রোডে, বড়বাজারে,
অথচ কেউ এরকম স্ট্রীটের কথা জানেই না, না ওখানকার স্থানীয় মানুষ না থানার পুলিশেরা। অবাক কান্ড!
ইন্টারভিউ হলো আমার। ইন্টারভিউতে পাশ করলাম। ত্রিশজন মহিলা অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক লাগবে অফিসে। মারোয়াড়ী অফিস। আমাকে সঙ্গে সঙ্গেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দিলেন। আমি খুশী মনে অফিস থেকে বেরোলাম কিন্তু পথঘাট চিনি না। কোনদিকে যাবো ভেবে কুলকিনারা পেলাম না। ভাই বাস ধরতে বলেছিল কিন্তু বাসে চাপিনি ভয়ে, যদি অন্য কোথাও নিয়ে চলে যায় সেই ভেবে হাঁটা লাগালাম একটু যাই আর লোককে জিজ্ঞেস করি, এইভাবে জিজ্ঞেস করতে করতে পায়ে ব্যথা নিয়ে হাওড়ায় পৌঁছে আবার লোককে জিজ্ঞেস করি কোন্ ট্রেনে উঠতে কোন্ ট্রেনে উঠবো বুঝতে না পেরে। ট্রেনে উঠে ও শান্তি নেই, ট্রেন আবার কোথায় নিয়ে চলে যাবে কে জানে। সেই আবার জিজ্ঞেস করা, এই করতে করতে একসময় রিষড়ায় পৌঁছালাম, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
এইভাবেই পথঘাট চেনা শুরু হলো। বড়বাজারেই চারটে অফিস চার ভাইয়ের নামে। এদের ট্র্যান্সপোর্টের বিজনেস, ক্যুরিয়ারের বিজনেস পুরো ভারতে। আরো কি সব বিজনেস ছিল। বাস ভাড়া ছিল পঞ্চাশ পয়সা। যেতাম বাসে, ফিরতাম সবাই মিলে হেঁটে। এইভাবে চারমাস করেছিলাম অ্যাকাউন্টস, লেজার বুক লেখা ইত্যাদি এই চার মাসে ভালই শিখে গেছিলাম।
ছাড়লাম একটা খারাপ ব্যাপার জানতে পেরে। প্রতি সপ্তাহে একদিন কোম্পানির মালিক অফিসে আসতেন হিসেব নিকেশ নিতে। আমাদের সুপারভাইজার সহ আরো পাঁচজন মহিলা ঐ অফিসে কাজ করতাম। যখন মালিক আসতেন তখন আমাদের পাশের ঘরে উনি সুপারভাইজারের কাছ থেকে হিসেব নিকেশ নিতেন।
এই হিসেব নিকেশের অন্তরালে অন্য কিছু যে ঘটতো তা একটা সহকর্মীর মুখ থেকে শুনলাম, শুনে তো আমার বুক দুরুদুরু করতে শুরু করে দিল। আর একদিন শুনলাম তার বিনিময়ে মালিক নাকি সুপারভাইজার ম-কে টাকা দেয়। আমি এইসব শুনে অভ্যস্ত ছিলাম না। প্রতিদিন এইসব গল্প শুনতে শুনতে ঘৃণায় গা ঘিনঘিন করতে লাগলো।
বিহারে থাকতে কখনো বেশ্যা কথাটা শুনিনি, এই অফিসে কাজ করার পরিপ্রেক্ষিতে এটার মানে সহকর্মীদের কাছ থেকে অবগত হলাম এবং ম-কে সহকর্মীরা আড়ালে বেশ্যাই বলে। তাকে জমিজমা, ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স সব কিছু মালিক দিয়েছে।
আরো অবাক হলাম যেদিন জ নামে সহকর্মীকে ঐ ঘরে ফাইলপত্র নিয়ে যেতে বলা হলো। কিছুক্ষণ পরেই ধস্তাধস্তির আওয়াজ পেলাম এবং জ কোনরকমে নিজেকে বাঁচিয়ে দৌড়ে অফিস ছেড়ে চলে যায়। ঐ ঘটনার পর আমি এবং আরো দুজন ঠিক করলাম কাল থেকে আর অফিসে আসবো না।
সত্যি সত্যিই পরেরদিন থেকেই আমি বিনা নোটিশে ঐ অফিস ছেড়ে দিই। আমি বিহারে বেড়ে ওঠা মানুষ, খুব সাদাসিধে মানুষ। কখনো এইরকম নোংরা কান্ড কারখানা যে অফিস নামক স্থানে ঘটতে পারে তা জানা ছিল না, মেয়েদের দেহ নিয়ে যে কুশ্রী, বিশ্রী ঘটনা ঘটে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। কলকাতার অফিস নামক স্থান থেকে এত বড় অভিজ্ঞতা আমার জীবনের প্রথম অফিস থেকেই সঞ্চয় করে নিয়ে সতর্ক হয়ে গিয়েছিলাম।
কলকাতা সম্পর্কে তখন থেকেই আমার একটা ধারণা জন্মে গিয়েছিল যে চার দেওয়ালের অফিসে মেয়েদের বিপদ ওৎ পেতে আছে, আড়ালে, আবডালে, খাঁজে, খাঁজে মেয়েরা বিপদগ্রস্ত হতে পারে সুতরাং স্থির করলাম আর অফিস নয় অন্য কাজ খুঁজতে হবে।
বাইরে থেকে যা ভাল দেখায় তার ভিতরে ভাল না ও থাকতে পারে। সব কিছু ভেবে চিন্তেই ছেড়ে দিলাম। আবার অন্য চাকরী খুঁজতে লাগলাম। বালিগঞ্জে অফিস। ওটা ছিল গ্যাসের কাজ, ডেমো দেখানো বাড়ী, বাড়ী গিয়ে। জয়েন করলাম। হাওড়া, কলকাতায় কাজ শুরু হলো। এগারো জনকে নিয়ে একটা টিম। ভালই লাগতো। খুব কঠিন কাজ ছিল না
তখন তিনি মাস বোধহয় কাজের। একদিন কাজ থেকে বাড়ী ফিরে দেখি দিদিরা আমার সামান্য কটা জিনিসপত্র বাইরে রেখে ঘর পাল্টে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমাকে কিছু জানায়নি। তার আগে বাবা দিদির বাড়ী এসে এসে কান্নাকাটি করতেন আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কিন্তু আমি ফিরিনি।
আমি ঐ অবস্থায় খুব অসহায় বোধ করেছিলাম নিজের দিদি এভাবে আমাকে রাস্তায় ফেলে চলে গেল! কোথায় যাবো, কি করবো কিছু ভেবে পেলাম না। যে বাড়ীতে দিদিরা থাকতো ঐ বাড়ীর মালিকের দাদা আমার অসহায় অবস্থা দেখে ওনার শ্বশুরবাড়িতে একটা ভাড়া ঘরের বন্দোবস্ত করে দিলেন।