Photo by Steven Coffey on Unsplash

কৈশোর কাল থেকেই ছেলেদের দৃষ্টি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হই। আমি যখন‌ ক্লাস এইটে পড়ি তখন থেকে।

ধানবাদে আমাদের রেলের বাংলো ছিল, বাবা পূর্ব রেলের ধানবাদ ডিভিশনের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। আমাদের বাংলো থেকে স্কুল পায়ে হাঁটা পথ ছিল। বাংলোর পাশে একটা অনেক বড় রেলের মাঠ ছিল, ওটা পেরিয়ে ওপারের কোয়ার্টারের বন্ধুরা একত্র হয়ে স্কুল যেতাম।

স্কুলের নাম ছিল ধানবাদ প্রাণজীবন‌ একাডেমী গার্লস স্কুল, এই নাম থাকলে ও সবাই ক্ষিতীশবাবুর স্কুল বললেই চিনতো, কারণ তিনিই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের সময়ে স্কুলটা প্রাইভেট ছিল পরে সরকারী হয়েছিল। সেইরকমই একই নামে বয়েস স্কুল ও ছিল, সেটা অনেক দূরে ছিল ।

বয়েস স্কুলের একটা ক্লাস নাইনে পড়া ছেলে আমার পেছনে লাগলো। সে ছিল খুব ডানপিটে এবং আমাদের রেল কলোনীর পাঁচিলের বাইরে ওদের নিজেদের বাড়ী ছিল। সেখান থেকে সে রোজ আসতো, আমাদের কোয়ার্টারের চারপাশে পাক খেতো এবং আমার নাম ধরে ডাকাডাকি করতো। এতে আমার প্রচন্ড রাগ ধরতো, কিছু বলতাম না বা আমার বাড়ীর লোকেরা ও কিছু বলতো না।

ক্লাস ফাইভ পর্য্যন্ত আমি রেলের স্কুলেই পড়তাম, স্কুলটা বাংলোর পাশেই ছিল। আমার বোন ও ঐ স্কুলে এক ক্লাস নীচুতে পড়তো। ওর ও যখন ক্লাস ফাইভ পড়া হয়ে গেল হাইস্কুলে গেল অর্থ্যাৎ একই স্কুলে। ও একটু নরম টাইপের ছিল আর আমি একটু ডাকাবুকো ছিলাম তাই ওকে সঙ্গে করে স্কুল নিয়ে যেতে হতো। না নিয়ে গেলে কিংবা আগে আগে চলে গেলে মায়ের বকুনি খেতে হতো। সঙ্গে করে না নিয়ে গেলে ও বাড়ীতে মায়ের কাছে আমার নামে নালিশ করতো আর আমি বকুনি খেতাম।

এইখানে একটা এই সম্বন্ধীয় আমার কবিতা দিলাম।

ইস্কুলে যেতাম‌
তেঁতুলতলার মাঠ পেরিয়ে
কারা যায়‌ ঐ।
আমি আর বোন যাই‌
হাতে থাকে বই।।

পেছনে থাকে মায়ের চোখ
যেন‌ প্রহরারত বাঘ।
বোনকে ফেলে গেলেই
ক্যাক করে ধরবে ছাগ।।

এক একদিন থাকে না মা
লম্বা পায়ে হাঁটি।
ও থাকে পেছনে পরে
মনে হয় মারি যেন‌ চাঁটি।।

পিঁপড়ের মত হাঁটে সে
যেন‌ পা ব্যথা করে।
টেনে টেনে নিতে হয়‌
হাঁটতেই পারে না সে জোরে।।

মহা মুস্কিল ওকে নিয়ে
এক একদিন যাই‌ পালিয়ে।
পেছন ফিরে বলি ওকে
তাড়াতাড়ি আয়‌ না পা চালিয়ে।।

ঘন্টা পড়ে যাবে‌ ইস্কুলে
কি রাগ ধরতো আমার।
কিছুতেই পারতো না সে
এরকমই হাঁটা তার।।

তবে পৌঁছতো সে
কচ্ছপের গতিতে।
ঘন্টা পরার দু'মিনিট আগে
প্রাণজীবন একাডেমীতে।।

ছোট থেকেই এইভাবে কাঁধের উপর দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

একদিন দুজনে স্কুল থেকে ফিরছি মাঠের মাঝ বরাবর এসেছি অমনি মাঠের রেলিংয়ের পাশ থেকে কবিতা কবিতা ডাক শুনেই মাথা গেল গরম হয়ে তক্ষুনি আমার হাতের বইপত্রগুলো বোনের হাতে দিয়ে 'আজ আমি মেরেই ফেলবো ইডিয়টটাকে' বলে ছুটলাম সেই ছেলেটার পেছনে আর যেই‌ দেখেছে আমি রেগে ওর দিকে তেড়ে যাচ্ছি‌ অমনি সে পাঁচিল টপকে পগারপার। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঐরকম ডানপিটে ছেলে ও আমার ভয়ে পালালো। এদিকে প্রেম করার শখ হয়েছে, সামনাসামনি কথা বলার মুরোদ নেই।

আর কি করি বাড়ী ফিরলাম। বোন ততক্ষণে বাড়ী ফিরে গিয়ে আমার কীর্তির কথা মাকে জানিয়ে দিয়েছে তবে মা কিছু বলেনি কারণ আমার যে‌ সাহস আছে সেটা বুঝে নিশ্চিন্ত হয়েছিল।

আর একদিন আমার এক বন্ধুর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। আমার হাতে দীপিকা চিঠিটা দিতে দিতে বলে ঐ 'কে' নামধারী ডানপিটে ছেলেটা এটা দিয়ে বলল তোকে দিয়ে দিতে। আমি তো শুনে রেগে কাঁই , বললাম "তুই এটা নিলি কেন"? দীপিকা বলল "ও দিল তোকে দেবার জন্য , আমি কিজানি।" আমি বললাম, "তোকে জানতে হবে না, তুই যার‌ কাছ থেকে এনেছিস তাকেই ফেরৎ দিয়ে দিবি, ঠিক আছে? আর কোনদিন ও এসব আনবি না বুঝেছিস?"

এরপরে ঐ 'কে' নামধারী ছেলেটি আরো কীর্তি করেছিল রাগে। ও যাই‌-ই করতো আমি ওর জ্যাঠতুতো দাদাকে নালিশ করতাম। জ্যাঠা আর জ্যাঠতুতো দাদার রেলের পাঁচিলের উপর একটা দোকান ছিল ওখান থেকে আমরা লজেন্স, বিস্কুট কিনতাম। ওরা আমাদেরকে খুব ভালবাসতো, যেই আমি কের বিরুদ্ধে নালিশ করতাম গোপালদা বাড়ী গিয়ে ভাইকে শাসন করতো। করলে কি হবে দুদিন পর আবার যে‌ কে সেই, আবার নাম ধরে ডাকাডাকি।

আগেকার দিনে এখনকার মতো টয়লেট ব্যাবস্থা ছিল না। তখন ভারত ছিল অনুন্নত, শৌচাগার ব্যাবস্থা খুব খারাপ এবং দৃষ্টিকটু ছিল। জন্ম থেকেই এই ব্যাবস্থা। বাড়ী, কোয়ার্টারে খাটা পায়খানা ছিল। রেলের মাইনে করা মেথর এসে প্রতিদিন পরিস্কার করে যেতো।

একদিন ঐ কে নামক ছেলেটি এবং তার এক বন্ধু বা চামচা ঐ টিনের মালপত্র আমাদের উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। সকালে বাবা মা ঘুম থেকে উঠে দেখে এই কীর্তি। পরে বাবা মাকেই সেইসব পরিস্কার করতে হয়।

পরে আর কিছু করেনি এটা করেই বোধহয় শান্তি পেয়েছিল সে। আর আমায় কোনরকম ডিসটার্ব করেনি সেই কীর্তিমান প্রথম প্রেমিক। খুব ভাল করেই বুঝে গেছিল একে কোনভাবেই বাগানো যাবে‌ না।

ক্লাস নাইনে যখন‌ পড়ি তখন ক্ষিতীশবাবুর নাতি লাগলো পেছনে। স্কুলের পাশেই ক্ষিতীশবাবুর যৌথ পরিবারের বাস। ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনী সহ বিশাল বাড়ি, বিশাল সংসার। তারই নাতি। নাম তার বি। এই বি কিন্তু কের মতো ছিল না। কোন ডাকাডাকির মধ্যে ছিল না, এ আবার তার উল্টো। একজন গোপনে আর একজন প্রকাশ্যে। একজন সকলকে জানিয়ে ঢাকঢোল পেটানো প্রেমিক, আর একজন গোপনে, নিভৃতের প্রেমিক। কে এবং বি দুজন দুই প্রকৃতির। একজন ডানপিটে আর একজন শান্ত প্রকৃতির। তবে বি প্রেমিক শান্ত হলে কি হবে তার ভাই আবার ঢাক পেটানোয় সিদ্ধহস্ত। আমাকে স্কুলের কাছাকাছি আসতে দেখলেই তার বৌদি, বৌদি ডাক শুরু হয়ে‌ যেতো। আমি নাকি তার বৌদি। আগে বুঝতে পারতাম না বৌদি করে কাকে ডাকে সে। পরে আমার বন্ধুদের মুখ থেকে শুনলাম আমাকে উদ্দেশ্য করেই সে বৌদি ডাকে।

এদিকে তার দাদাকে আমি ঠিক মতো চিনলামই না, বৌদি হয়ে গেলাম। আমাদের স্কুলে ও তাদের এক খুড়তুতো বোন পড়তো এক দু ক্লাস নীচুতে, ওকে ও দেখি আমার ব্যাপারে খুব আগ্রহী, কথা বলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো।

অর্থ্যাৎ স্কুল জীবনটা বেশ রসেবশে কেটেছে এদের ভালবাসার ঠ্যালায়। বেশ উপভোগ করতাম যে‌ সকলেই আমায় ভালবাসে ভেবে, দিদিমণিরা, আমার সিনিয়র দিদিরা, আমার বন্ধুরা, আমার থেকে নীচু ক্লাসের বোনেরা প্রত্যেকের কাছেই জনপ্রিয় ছিলাম কিছু ভাল কাজ না করে ও। শুধুমাত্র দেখতে শুনতে, ব্যবহারে মিষ্টি ছিলাম বলে। সবাই ফাঁক পেলেই গাল টিপে দিতো।

আমি ক্লাস সিক্সে পড়তে পড়তেই কবিতা লেখা শুরু করেছিলাম অথচ কেউ ঘূণাক্ষরে ও টের পায়নি। প্রচন্ড শান্ত ও বোকা প্রকৃতির ছিলাম। কোন তর্ক বিতর্ক, ঝগড়ার ব্যাপারে থাকতাম না। কোন শত্রু বলে কেউ ছিল না। আড়ি কি জিনিস জানতাম না।

একদিন বি প্রেমিকের বোন টিফিনের সময় আমাকে এসে জানালো "তোমাকে আমার দাদা ডেকেছে", আমি জিজ্ঞেস করলাম "কেন"? ও বলল "এমনি তোমার সাথে কথা বলবে, চলো না" বলে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় আর কি। আমার বন্ধুরা তাই দেখে বলে "যাস না, যাস না।" রীনা বলে যাস‌ না, কোন্ ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেবে, তখন কি হবে।" আমার বন্ধুদের মস্তিষ্কগুলো আমার চাইতে উন্নতমানের ছিল তাই, নাহলে আমি তো যাবার‌ জন্য একটু পা বাড়িয়ে ছিলাম। গেলে অবশ্য কি হতো জানি না। বন্ধুরা আমায় তখন খুব গার্ড করতো।

যাই‌ হোক কে এবং বি দুই প্রেমিকের অস্তিত্ব ছিল কিন্তু সামনে আসার কখনো সাহস পায়নি। একটু গম্ভীর প্রকৃতির ছিলাম বলে হয়তো।

.    .    .

Discus