Photo by Jordan Sanchez on Unsplash
আমরা রেলের বাংলোতে থাকতাম, বাংলোটা ব্রিটীশ আমলের ছিল। আগে যারা যারা থাকতো তারা সকলেই ভয় পেতো। আমার জন্ম এই বাংলোতে। আমরা ভাই বোনেরা সকলেই এই বাড়ীতে মানুষ। ছোট থেকেই সবাই খুব ভয় পেতাম এত বড় বাড়ীতে থাকতে। তাই বাবা একটা বড় ঘর রেলের একজনকে ভাড়া দিলেন। ঘরগুলো খুব বড় বড় ছিল। উপরে ডাবল শিলিং ছিল এবং খুব উঁচু উঁচু ছিল যার জন্য গ্রীষ্মকালে খুব ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক ছিল। দেওয়ালগুলো ছিল চুন সুরকির শক্তপোক্ত এবং মোটা মোটা। কোন ঠান্ডা, গরম প্রবেশ করতে পারতো না। নাতিশীতোষ্ণ ছিল।
আমরা কিছুটা বড় হওয়ার পর ভাড়া উঠিয়ে দিয়ে সেজ কাকুকে বাবা নিয়ে আসেন। কাকু এসে শর্টহ্যান্ডে ভর্তি হয়, চাকরীর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। একটা দোকান ঘর ও নেয় এবং ছটা সেলাই মেশিন আস্তে আস্তে বসিয়ে টেলারিংয়ে হাত পাকিয়ে নিজের নাম পাকাপোক্ত করে ফেলে। খুব নামডাক হয় কাকুর। মা ও একটা হাত মেশিন কিনে কাকুর কাছ থেকে কাটা, সেলাই করা সব শিখে ব্লাউজ, সায়া, আমাদের জন্য নানা ডিজাইনের জামা বানানো শুরু করে দেন। আমরা তাই বাইরের কেনা জামা কাপড় না পরে বাড়ীতে মায়ের হাতের তৈরী জামা পরতাম।
কাকু দর্জির কাজ করতে করতে চাকরীর পরীক্ষা ও দিত। দিতে দিতে কাকুর একটা চাকরী হয়ে যায় আসামের এফ সি আইতে (ফার্টিলাইজার)। কাকু আসাম চলে যায়, আর আমরা আবার একা হয়ে যাই কারণ আমরা কাকুকে খুব ভালবাসতাম। কাকুর সাথে মারপিট, খেলাধুলা, আবদার, একসাথে একটেবিলে আটজনের খাওয়া ইত্যাদি করতাম, চলে যাওয়াতে আমরা খুব বিমর্ষ হয়ে পড়ি।
তখন ফোন ছিল না, চিঠিপত্র আদানপ্রদান হতো। আমরা প্রতীক্ষায় থাকতাম কবে কাকুর চিঠি আসবে। আসামের প্রচন্ড শীতে কাকুর পায়ে গ্যাংগ্রীন হবার যোগাড়। বাবা মা চিন্তা করতে লাগলেন, সাবধানে থাকার কথা জানালেন কারণ ঐরকম শীতে যারা অভ্যস্ত নয় তারা সতর্ক না থাকলেই ধরবে। ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলতে থাকে কাকু।
শীত একটু কমার পরে আমাদের আসাম যাওয়া ঠিক হয়। সালটা ছিল '৭১ সাল। আমরা ধানবাদ থেকে রওনা দিলাম মাসীর বাড়ি কোচবিহারের বাণেশ্বরে। সেখানে কদিন থেকে মেজদাকে নিয়ে কামরুপ এক্সপ্রেস ধরলাম আসামের নামরুপের উদ্দেশ্যে যেখানে কাকু থাকে।
ট্রেনের দুপাশে শুধু জঙ্গল। জঙ্গল ছাড়া কিছু দেখার নেই। ট্রেনের যাত্রীরা বলে বাঘ বেরোলে ও বেরোতে পারে অসম্ভব কিছু নেই। আমরা তাই কাচের জানালা দিয়ে রেখেছিলাম, আর ট্রেন ও খুব ঢিমেতালে চলছিল যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে আমরা গন্তব্যস্থলে পৌঁছালাম। কাকু আমাদের নিতে এসেছিল। ছোট শহর , ছোট স্টেশন, চা বাগান। রিক্সা করে আমরা কাকুর কোয়ার্টারে গেলাম। ওখানে সেদ্ধ চাল পাওয়া যেতো না। তাই মা আতপ চাল, আলু, ডিম বসিয়ে দিলেন রাত্রের খাবারের জন্য। সবাই মিলে আনন্দ করেই খেলাম। আমরা সব মিলিয়ে ন'জন।
ঘরের ভিতরে ও ঠান্ডা কারণ কাচের জানালা। কাচগুলো ভেঁপে উঠেছে কুয়াশার জন্যে। রাতটা ঐ ভিজে ভিজে স্যাতস্যাতে ঠান্ডায় কাটাতে হলো।
পরেরদিন নামরুপের রুপ দেখলাম। রাত করে তো কিছুই বোঝা যায়নি। মেজদা বলল 'আমি একটু ঘুরে আসি।'
আমি বললাম, 'আমি ও যাবো, তোমার সাথে।' মেজদা বলল, 'চল।'
কাকুর সাইকেলটা নিয়ে নিজে চাপলো, আমাকে সামনে চাপিয়ে এ মাথা থেকে ও মাথা কয়েক পাক খেয়ে দুজনে ফিরলাম।
সকালের জলখাবার খেয়ে স্নান সেরে সবাই মিলে শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। খুব সুন্দর ছোট শহর। শহরের শেষ প্রান্তে একটা পাহাড় আছে, নাগা পাহাড়। কালো কুচকুচে পিচ ঢালা পরিস্কার রাস্তা। পাহাড়টাকে দেখলে মনে হবে এইতো সামনে আর কিছুটা গেলেই পাহাড়ে চাপতে পারবো। ও বাবা, যত পাহাড়ের কাছে যেতে চাই ততই পাহাড় যায় দূরে। কিছুতেই এত হেঁটে ও পাহাড়কে ছুঁতে পারি না।
কাকু বলে ওরকম মনে হয় এইতো কাছে কিন্তু ওটা দূর আছে। সময় লাগবে, পা ব্যথা হয়ে যাবে। আজকে বাড়ী চ' কাল আরো সকাল সকাল বেরোতে হবে। মা ও হাঁফিয়ে গেছিলেন তাই হেরে গিয়ে সবাই মিলে বাড়ী ফিরলাম।
পরের দিন আমরা ঠিক করলাম আজ পাহাড়ে চাপতেই হবে। সকাল সকাল রওনা দিলাম আমরা সবাই। অনেক হাঁটার পর পা ব্যথা করলে ও আমরা পাহাড়ে চাপলাম। খুব জঙ্গল ছিল না, মাটি দেখা যাচ্ছিল। আমরা গাছের ডাল ধরে ধরে অনেকটা উপরে উঠলাম। আসলে পাহাড়টা ওঠা সহজ ছিল তাই সবাই উঠতে পেরেছিলাম। শৈশবে সেই প্রথম পাহাড়ে চাপা।
আমরা অনেকটা উপরে উঠে দাঁড়ালাম। কাকু বলল, 'এবার চলো নামি।' আমরা বললাম 'আর একটু উপরে চলো না।' কাকু বলল, 'না, আর উপরে যাওয়া ঠিক হবে না, এটা হচ্ছে নাগা পাহাড়। পাহাড়ের ওপারে নাগাল্যান্ড। যদি একটা ও নাগা দেখতে পায় তাহলে আর রক্ষে নেই। একেবারে কুকরী নিয়ে তাড়া করবে, না হয় কচু কাটা করবে।'
যেই আমরা একথা শুনেছি অমনি তাড়াতাড়ি করে কে আগে নামবে তার হিড়িক পড়ে গেল। নীচে নামতেই রোদ গেল চলে। আকাশ নিমেষের মধ্যে সাজুগুজু করে এলো। ওখানে এই আকাশ ভাল, পরক্ষণেই কালো। এই রোদ, এই বৃষ্টি। লোকালয়ে ঢুকতেই নেমে এলো বৃষ্টি। আমরা দৌড়ে দৌড়ে একটা কোয়ার্টারের বারান্দায় সবাই মিলে আশ্রয় নিলাম।
আমার পায়ে কালো পাম্পশু। জুতোটায় জল ঢুকেছে বলে ডান পায়ের জুতোটা যেই খুলেছি মেজদা বলে ওঠে, আরে 'তরে তো জোঁকে ধরছে, দেখি দেখি' করে জুতোটাতে দেখে জোঁকটা পেট ফেটে মরে আছে। সে এন্তার আমার রক্ত খেয়ে শহীদ হয়েছে। পায়ের তলায় পুরো লাল রক্ত। রক্ত দেখে তো আমি ঘাবড়ে গেছিলাম। কোন ব্যথা নেই কিছু নেই অথচ রক্ত। জোঁক কি জিনিস জানিই না তখন। আমি হাঁ হয়ে গেছি।
বৃষ্টির জলে পা ধুয়ে নিলাম, জুতোটা মেজদা ধুয়ে দিল। সবাই আমায় খ্যাপাতে লাগল 'আর যাবি পাহাড়ে।' আমার তখন রক্ত দেখে মুখ শুকিয়ে গেছে। সবাই বলে 'আরে কিছু হয়নি। ওতে কিছু হবে না, ভয়ের কিছু নেই।' সবাই এরপর নিজের নিজের জুতো খুলে পা দেখে নিলো ধরেছে কিনা।
বৃষ্টি কমলে আমরা বাড়ীর পথে হাঁটা লাগালাম ততক্ষণে আবার রোদ। রোদ বৃষ্টির খেলা।
আমরা যেমন শহরের বাড়ীতে চা দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়িত করি গ্রামে তেমনই পান দিয়ে অতিথিকে আপ্যায়িত করে আর অসমীয়ারা অতিথি আপ্যায়িত করে তাম্বুল দিয়ে। তাম্বুল যদি অতিথি না গ্রহণ করে তাহলে খুব অপমানিত বোধ করে। তাম্বুল হলো সুপারী বা সুপুরি। ওরা সুপুরিগুলোকে মাটির নীচে পচায়। পচা তাম্বুলের বিকট গন্ধ, এটা খেলে নেশা হয়, মাথা ঘোরে।
আমরা কাকুর কোয়ার্টারের গেটে দাঁড়িয়ে শহরের মানুষজন দেখছিলাম সেই সময় নাগা পাহাড় থেকে কয়েকজন নাগা সন্ন্যাসী আমাদের গেটের সামনে দিয়ে বাজারে যাওয়ার সময় একটা বাচ্চা কুকুরকে কোলে তুলে নিলো, কাকু বলল, ঐ বাচ্চা কুকুরটাকে খুব পেট ভরিয়ে খাওয়াবে, তারপরে ওটাকে আগুনে পোড়াবে, পুড়ে গেলে পেট থেকে পাকস্থলীটাকে বের করে খাবে।
এদের পরনে ছিল নেংটি। কারোর ছিল কৌপীন, সঙ্গে ছিল কুকরী। কেউ দেখে হাসাহাসি করলে একেবারে ঘ্যাচাং। কোন আইন কানুন ওরা মানে না। ওদের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকে বাঘের কাটা মুন্ডু, বাঘ ছাল।
পরের দিন কাকুর অফিসার মিঃ চালিহা গাড়ী নিয়ে এলেন। আমাদের সবাইকে এফ সি আই অর্থ্যাৎ ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়াতে নিয়ে গেলেন কিন্তু আমাকে, বোনকে আর ভাইকে ফ্যাক্টরীর ভিতর ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বারো বছরের নীচে ফ্যাক্টরীতে ঢোকা নিষেধ।
আমাদের তিনজনকে আর একটা অফিসারের হাতে সঁপে দিয়ে সবাই ভেতরে চলে গেল দেখে আমার সেকি কান্না, আমি ভেতরে যাবো। ওরা ও আমাকে যেতে দেবে না। আমাকে বিভিন্নভাবে ভোলাতে লাগল কিন্তু আমাকে ভোলানো অত সহজ না, আমি ফ্যাক্টরী যাবো।
বোন আর ভাইয়ের হাতে গোটা কয়েক লজেন্স ধরিয়ে দিয়েছে, ব্যস ওরা চুপ। কিন্তু আমার হাতে ও দিতে গেছে যেই , অমনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। একজন অফিসার আমার হাত ধরে বললেন, 'চলো, তোমায় ওদের চাইতে ভাল জিনিস দেখাবো, ফ্যাক্টরীতে কিছু দেখার নেই।'
হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। কাচের শোকেসে কি সব সাজানো, আমি কোনটারই নাম জানি না। উনি বললেন, 'এখান থেকে তোমার যা যা নিতে ইচ্ছে করে নিয়ে যাও, কেউ কিচ্ছু বলবে না।'
আমার তখন রাগে গা জ্বলছে আর চোখ মুছে মুছে দেখছি কি আছে। একটা ও চিনলাম না, বুঝলাম না, দাঁড়িয়ে থাকলাম।
উনি জিজ্ঞেস করলেন, 'কিছু পছন্দ হচ্ছে না? আমি তোমায় বুঝিয়ে দিই।'
উনি একটা কাচ খুলে দু তিনটে প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, 'এটা হলো ইউরিয়া সার, আর এটা হলো অ্যামোনিয়া সার, আর এটা হলো গন্ধক। কটা নেবে নাও।'
আরো প্যাকেট প্যাকেট বের করে দিলেন। আমি মাথা নাড়লাম, লাগবে না।
উনি বললেন, 'এতেই হয়ে যাবে তোমার?'
আমি মাথা নাড়লাম, হয়ে যাবে।
ঐগুলো পেয়ে একটু হলে ও রাগ কমলো। আমায় উনি বাইরে বোন ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলেন। ওরা দিব্যি আছে গার্ডদের কাছে, ওদের কোন কান্না নেই।
আমার আসলে ঐ বয়সেই প্রেষ্টিজটা বেশী ছিল, অপমানবোধটা বেশী ছিল । আমি কি ছোট যে ফ্যাক্টরী দেখতে পারবো না। কৌতূহলটা ও বেশী ছিল।
তারপরে ওরা সব দেখে বেরিয়ে এলো। আমরা সবাই বাড়ী ফিরলাম।
পরেরদিন কাকু আমাদের বাজার নিয়ে গেল। দোকানে সমস্ত জিনিস সুন্দর করে সাজানো। কোন জিনিসই খোলা না, সব ওজন করে মেপে প্ল্যাষ্টিকের প্যাকেটে সিল করে রাখা। যার যেটা দরকার পয়সা দিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে, প্যাকেটে দাম ও লেখা।
ওখান থেকে আমাদেরকে বাসে করে নাহারকাটিয়া নিয়ে গেল। বাসে যেতে যেতে দেখি এক এক জায়গায় আগুন জ্বলছে। কাকু বলল, নীচ থেকে গ্যাস বের করে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনেক জায়গায় এইরকম দৃশ্য চোখে পড়ল। সমানে আগুন জ্বলছে। বৃষ্টি পড়লে ও নাকি নেভে না।
এইসব দেখে বাড়ী ফিরলাম। পরেরদিন আমাদের গৌহাটি যাওয়ার দিন। আমরা লাগেজ নিয়ে নামরুপ থেকে ট্রেনে চাপলাম। কাকু এবং কাকুর বন্ধুরা আমাদের ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো।