যখন স্কুলে পড়তাম আমরা রান্নাবাটি খেলতাম এছাড়া ও নানারকম ইনডোর, আউটডোর গেম খেলতাম। তার মধ্যে একটা বিশেষ খেলা খেলতাম সেটা হলো টিচার টিচার খেলা। এই সব খেলাগুলো আমার বন্ধুদের সাথে আমাদের বাড়ীতেই খেলতাম। বেশীরভাগই ইনডোর গেম খেলতাম। আউটডোর মাঝে মধ্যে বাড়ীর পাশে বিপিএস প্রাঙ্গনে গিয়ে আমার ছেলে বন্ধুদের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম।
শৈশবে বেশীরভাগই মেয়েদেরই শখ থাকে বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার। তাই হয়তো আমি এবং আমার বন্ধুরা সবাই মিলে শিক্ষক শিক্ষক, পড়া পড়া খেলা খেলতাম। আমাদের ওটাই তখন ভাল লাগতো।
তার উপর এত এত দিদিমণিদের সান্নিধ্যে এসেছি যাদের এই খেলার মধ্যে নকল করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়ে গেছিল। যে দিদিমণিদের বিশেষভাবে মনে ধরতো তাকে তো নকল করতামই এছাড়াও নিজস্ব ঢঙ্গে ও আমরা শিক্ষকতার অভিনয় করতাম বা খেলতাম। পড়ানো, বোঝানো, পড়া না পারলে শাস্তি দেওয়া, পড়া পারলে আদর বা পিঠ চাপড়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি আমাদের শিক্ষকতার খেলার অঙ্গ ছিল। সবই তখন মিথ্যেই ছিল তবু ঐ খেলাটাই খেলতে ভালবাসতাম।
বেশীরভাগ মানুষেরই শিশুকালটা খুবই আনন্দের এবং উপভোগের হয় বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েদের। সাধারণত বেশীরভাগ উচ্চবিত্ত ঘরের মেয়েরা শৈশবটা খেলাধুলার মধ্যে যাপিত করে না তাদের পারিবারিক বা সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার কারণে বা বৈভবের কারণে, স্বাভাবিক হতে পারে না। নিম্নবিত্ত মেয়েরা তবু মানিয়ে গুনিয়ে নিতে পারে, খেলে।
আমাদের সময়ে আমরা শৈশবটাকে বেশ ভালভাবেই উপভোগ করেছি যার জন্য বয়সকালে শৈশবের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার একটা সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা মনের মধ্যে চলতেই থাকে কিন্তু শৈশব কখনো যে ফিরে আসে না তা ভেবে দুঃখ প্রকাশ ও করে থাকি। শৈশবকে সব মানুষেরই ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। এমন কোন মানুষ নেই যার শৈশবের কথা মনে পড়ে না বা ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না অথচ উপায় নেই।
যখন লেখাপড়ার গন্ডী পেরিয়ে সাবালিকা হলাম তখন সত্যি করেই শিক্ষিকা হবার বাসনা জাগ্রত হলো। সেটা হবে ১৯৮৩ সাল। আমার ছোটবেলার খেলার সাথী ছবি এসে বললো, চ, তোকে আমাদের স্কুলে নিয়ে যাই। ও তখন একটা প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষকতা করছে।
আমাকে সে ওর স্কুলে নিয়ে গেল। স্কুলের নাম মাউন্ট ব্রেটিয়া স্কুল। সেইদিনই আমাকে প্রিন্সিপাল স্যার ক্লাস করতে বললেন এবং লোয়ার কেজিতে পাঠিয়ে দিলেন। সেদিন ছিল ট্রায়াল। উনি দূর থেকে মাঝেমধ্যেই ফলো করতে লাগলেন।
সেই প্রথম শিক্ষকতা। পুরো ক্লাস জূড়ে গুড়গুড়ি ছেলেমেয়ে। কেউ কোলের উপর উঠে বসছে, কেউ আদর করছে, কেউ বায়না করছে আমাকে A টা লিখে দাও না, পারছি না মিস, কেউ বলে আমার হিস পেয়েছে, সব মিলিয়ে আমার হিমসিম খাওয়ার অবস্থা। তবু খুব ভাল লাগছিল ওদের শিশুসুলভ আচরণ, আবদার, আদরগুলো। সেই প্রথম আমার অভিজ্ঞতা এবং হাতেখড়ি।
পরেরদিন থেকেই আমাকে জয়েন করতে বললেন উনি সন্তুষ্ট হয়েই, তবে ইংলিশে কথা বলা শিখে নিতে হবে, বাংলা বলা যাবে না। প্রথম দিনেই আমাকে সতর্ক করে দিলেন। স্পোকেন ইংলিশ আমি জানতাম না, হিন্দীতে ও আমি তেমন সড়গড় ছিলাম না, ওটা ছিল ধানবাদ, আমার জন্মভুমি।
আমি শিক্ষকতায় পাশ করলে কি হবে ইংলিশ বলা কিছুতেই রপ্ত করতে পারিনি, কোনরকমে দেড় মাস ঐ স্কুলে শিক্ষকতা করে শুধুমাত্র স্পোকেন ইংলিশের জন্য ছেড়ে দিলাম। এরপরে বহু স্কুলে কাজ করেছি, বহু জায়গায় কিন্তু প্রথম স্কুলের বাচ্চাদের কখনো ভুলতে পারিনি। এক একটা বাচ্চা যেন আমার এক একটা পাঁজড়। ওদের ভালবাসা আমাকে সর্বক্ষণ মনে করিয়ে দেয়, আমি ও ওদের এতটাই ভালবেসেছিলাম যে আমার মঙ্গলগ্রহ গল্পের মধ্যে ঠাঁই দিয়েছিলাম। একটা বাচ্চার কথা খুব মনে পড়ে, 'জানো মিস আমার মাথায় না শকুন হয়েছে।' আমার এখনো ঐ বাচ্চাটার কথা ভাবলে খুব হাসি পায়, নিজের মনেই হাসি। আরো ভাবি সেই '৮৩ সালের বাচ্চাগুলো আজ এই '২৪ য়ে কত বড় হয়ে গেছে। সংসার, সন্তানাদি নিয়ে নিশ্চয়ই ভালভাবে জীবন কাটাচ্ছে, জানি না কজন ইঞ্জিনিয়ার, কজন ডাক্তার, কজন বিজ্ঞানী হয়েছে, আমি তো নির্দ্বিধায় ওদেরকে আমার গল্পে বিজ্ঞানী বানিয়ে ফেলেছি ওরা যাই-ই হয়ে থাকুক না কেন।