আমরা পরেরদিন গৌহাটি স্টেশনে পৌঁছালাম। স্টেশনে নেমে গাড়ী নেওয়া হলো কামাক্ষ্যা মন্দির যাবার উদ্দেশ্যে। গাড়ী আমাদের নিয়ে গোল করে ঘুরতে ঘুরতে পাহাড়ের উপর উঠতে লাগলো।
এইভাবে গোল করে গাড়ী করে যে পাহাড়ে ওঠা যায় এতেই আমি বিস্মিত। এই প্রথম এভাবে পাহাড়ে উঠলাম।
আমাদেরকে নিয়ে গাড়ী একেবারে উপরে উঠে গেল। আমরা গাড়ী থেকে নেমে কামাক্ষ্যা মন্দিরে হেঁটে পৌঁছালাম।
অনেক পান্ডারা আমাদের ঘিরে ধরলো। বাবা একজনকে ঠিকঠাক করে নিয়ে ওনার পেছন পেছন মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
ভিতরে প্রচন্ড অন্ধকার, পিচ্ছিল সিঁড়ি। দুধ আর জলে পিচ্ছিল অবস্থা। পড়ে যাওয়ার উপক্রম। যে কেউ পড়ে যেতে পারে।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে গর্ভগৃহে প্রবেশ করলাম। মা পুজো দিলেন। আর মেজদিকে কুমারী পুজো করা হলো।
আমরা সবাই তিন পাক প্রদক্ষিণ করতে করতে ভিতরটা দেখছিলাম। মন্দিরটা কষ্টি পাথর দিয়ে গড়া। বহু পুরনো। টিমটিম করে একটা লাইট জ্বলছে একটা দেওয়ালে। যার আলো সব জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না।
আমরা সবাই ভেতর থেকে উপরে উঠে এলাম। বাইরেটায় বলি দেওয়ার জন্য স্বস্তিক চিহ্ন দেওয়া হাড়িকাঠ রাখা তাতে লাল জবা ফুলের মালা।
ওখান থেকে পুরোহিত ওনার রুমে নিয়ে গেলেন। নাম, ঠিকানা নিলেন যাতে পোষ্টে ফুল, প্রসাদী পৌঁছায়। বছরে একবার পাঠাবেন আষাঢ় মাসে, পুরোহিতের নাম বুলবুল পান্ডা।
ওখান থেকে আমরা সবাই হেঁটে হেঁটে আর একটা মন্দির ভুবনেশ্বরী মন্দির দেখে, উপর থেকে ব্রহ্মপুত্র নদীকে দেখলাম। নীচে ঘর বাড়ীগুলোকে মনে হচ্ছিল দেশলাইয়ের বাক্স, এত ছোট ছোট।
পাহাড়ী মেয়েরা ছেলেরা স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুল যাচ্ছে। পাহাড়ে ওরা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে। কোন ব্যাপারই না।
আমরা আস্তে আস্তে নীচে গাড়ীর কাছে এসে বাঁচলাম। গাড়ী এবার আমাদের নিয়ে আবার বৃত্তাকার পথে তরতর করে নামতে লাগলো।
কামাক্ষ্যা মন্দির দেখা হলো কিন্তু কি ঠাকুর কিছুই তখন বুঝিনি। প্রশ্ন ও জাগেনি। উত্তর পেলে ও তখন বুঝতাম না।
তবে হাঁড়িকাঠটা দেখে বুঝেছিলাম এখানে কি হয় আর মনে মনে এরা যে খুব নিষ্ঠুর সেটা বুঝেছিলাম।
আমরা গৌহাটি থেকে কামরুপ ধরলাম। মেজদা নিউ কোচবিহার নেমে বাড়ীর পথে চলে গেল। আর আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে।
আসাম এরপরে আরো দুবার গেছি। এই আসাম পর্বে আর একবারের অভিজ্ঞতার কথা এখানে লিখে দিলাম।
১৯৭৪ সালে দ্বিতীয়বার আসাম যাই। তখন আমি ক্লাস টেনে পড়ি। কাকুর বিয়েতে, যে কাকুর বাড়ীতে গেছিলাম সেই সেজ কাকুর বিয়েতে।
কাকুর বিয়ে আসামে ঠিক হয়েছে। বাবা মাকে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে দিল। আমাদের ধানবাদে হবু কাকীমার এক আত্মীয় থাকতেন, আমরা আবার তাদের দাদু দিদা ডাকতাম।
আমাদের ধানবাদের বাংলোতে কাকুর বিয়ের কথা পাকা হয়। কাকুর সাথে কাকুর হবু শ্বশুরমশাই এসেছিলেন আর ঐ দাদু দিদা আর কাকুর প্রিয় বন্ধু অনাথবন্ধু এবং আমার বাবা মা। যতদূর সম্ভব আমাদের ঠাকুর্দা বর্দ্ধমান থেকে এসেছিলেন। পাকা কথা হলো, বিয়ের ডেট ফাইনাল হলো।
আমাদের আনন্দ আর ধরে না আবার আসাম যাবো এবার বরযাত্রী হয়ে। কতজন বরযাত্রী যেতে পারবে, কতজন বউভাতে থাকবে, কতজনকে নেমন্তন্ন করা হবে, কার কতজন বন্ধু, সমস্ত হিসাব নিকাশ চলতে লাগলো কয়েকদিন ধরে। তারপরে কার্ড ছাপতে দেওয়া হলো।
দিনটা ছিল ১৯৭৪ সালের ১৫ই জানুয়ারী। দ্যাখ্ দ্যাখ্ করে বিয়ের তারিখ এগিয়ে এলো। আমাদের রিজার্ভেশন ১১ তারিখ। আমরা সবাইকে নিয়ে ধানবাদ থেকে হাওড়া পৌঁছে কামরুপ ধরলাম।
কামরুপে যে যেমন সীট পেয়েছিল সেরকমই বসলো। আমার দিদি মেজদি বাড়ীতেই ছিল। ওরা বিয়েতে যেতে পারেনি।
আমাদের একটা কুপের মধ্যে রিজার্ভেশন ছিল। নিউ কোচবিহারে ট্রেন ঢুকতেই মেজদারা এসে এক হাঁড়ি খিঁচুড়ি দিয়ে গেল আমাদের খাওয়ার জন্য।
গৌহাটি থেকে আমাদের কুপেতে লোক উঠলো। দুজন বন্ধু আর তাদের একজনের বৌদি আর ভাইপো। পূর্ণ হলো কুপেটা।
তিন রাত ট্রেনে তার পরদিন সন্ধ্যের সময় নামরুপ। বারো তারিখ ওরা ওঠার পর ওদের সাথে মা বাবার আলাপ হলো। একজনের নাম রঞ্জন আর তার বন্ধু অঞ্জন। সঙ্গে রঞ্জনের বৌদি ও ভাইপো। ওরা যাচ্ছে তিনশুকিয়া বিয়ে বাড়ী। আমরা আগে নামবো নামরুপে। তিনশুকিয়া পড়বে দুটো স্টেশন পরে। ওরা নামবে তিনশুকিয়া।
আমি আর বোন দেড় বছরের ছোট বড়, লোকেরা বলে যমজ। একই জামা কাপড় পরি, একই হাইট, একইরকম চুল। কে বড় বোঝা যায় না। শুধু গায়ের রংয়ের তফাৎ। আমি ফর্সা, বোন শ্যামবর্ণ। এরা ও তাই জিজ্ঞেস করলো ওরা কি যমজ? মা বললেন, না দেড় বছরের ছোট বড়।
ওমা সেকি! মনে হচ্ছে নাতো। বৌদির সাথে মায়ের এইসব গল্প হতে লাগলো। মাঝে মধ্যে রঞ্জন টিপ্পনী কাটে। আমার পেছনে লেগেই থাকলো। অন্ধকারে জানালার দিকে তাকানো ছাড়া কোন কাজ ছিল না তাই দেখে বলে, 'অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে?' তার মানে জানালার দিকে না তাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে আর ও মিটিমিটি হাসবে। কথা বলার যথেষ্ঠ চেষ্টা চালিয়ে গেছে কিন্তু মা বাবা সঙ্গে থাকার জন্য বেশীদুর এগোতে পারেনি। আর আমি ও ছিলাম খুব লাজুক এবং গম্ভীর। বাথরুম গেলে পেছন পেছন যেতো, তাকিয়ে থাকতো, খালি মিটিমিটি হাসতো। অঞ্জন ছেলেটা গম্ভীর ছিল।
এইভাবে বারোর রাত, তেরোর রাত চলে গেল। চোদ্দ এলো। নামরুপে ট্রেন দু মিনিট দাঁড়াবে। সন্ধ্যে হবার আগেই ছটপট শুরু হয়ে গেছে, আমাদের ট্রেন ঢুকবে। জিনিসপত্র নিয়ে দরজার কাছে এগোচ্ছি পেছন থেকে বারবার আস্তে আস্তে রঞ্জন জিজ্ঞেস করছে ঠিকানাটা? ঠিকানাটা? কিন্তু মা বাবার জন্য বলা যায়নি।
এমনিতে ও লাজুক ছিলাম। বয়স ও কম ছিল, বুদ্ধি ও কম ছিল, সবে চোদ্দ বছর বয়স।
আমরা নামরুপে নামলাম। ওদের চোখে জল, পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছছে। ওদের কান্না দেখে আমরা তিন ভাইবোন ও কেঁদে ফেলেছি। যতক্ষণ ট্রেন দেখা গেছে ততক্ষণ ওরা দরজায় দাঁড়িয়ে, আমরা ও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে।
আমি তখনো বুঝিনি রঞ্জনকে আমি ভালবেসে ফেলবো বা ভাললাগা থেকে ভালবাসায় রুপান্তরিত হবে। সেই দেখাটাই আমার জীবনের কাল হবে এটা আমি ভাবিনি, তাকে যে আমায় সারাজীবন মনের গভীরে বহন করে যেতে হবে বুঝিনি। এই বয়সে এসে ও জানুয়ারী মাসের চোদ্দ তারিখ স্মৃতি নিজে থেকেই এসে যায়, কাউকে স্মরণ করাতে হয় না। মস্তিষ্ক একটা কম্পিউটার, সমস্ত মেমোরি চিপস্ গুলো সযত্নে রক্ষিত থাকে ওতে। তখনো বাস্তবে কম্পিউটার বা মোবাইল আবিষ্কার হয়নি। তাহলে আর আমার এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।
রঞ্জন এতটাই আকর্ষণীয় ছিল যে জীবনে ভুলতেই পারলাম না বা অন্য কাউকেই মনে ধরলো না। কত বড় সর্বনাশ হয়ে গেল সেই তিনটে দিনে, তা বলে বোঝাতে পারবোনা। একা নিরবে, সংগোপনে এখনো বয়ে বেড়াচ্ছি। আমার সব লেখার মধ্যেই তার আবির্ভাব ঘটে যায়।
আমরা কাকুর বাড়ী সবাই মিলে পৌঁছালাম। কনকনে ঠাণ্ডা। পরের দিন বিয়ে, পয়লা মাঘ, পনেরোই জানুয়ারী। বিয়ের দিন সকাল থেকে বৃষ্টি। কাকুর অফিসারের গাড়ীতে করে বর যাবে, আমরা যাবো পাশে। সব্বাই ঠান্ডায় কাঁপছি। এত ঠান্ডা। বৃষ্টি পড়ে আরো ঠান্ডা বেড়ে গেছে।
কয়েকটা গাড়ীই বরযাত্রীদের জন্যে। বাবা বরকর্তা। তিনশুকিয়া রওনা দিলাম, পাত্রীর মামার বাড়ী থেকে বিয়ের আয়োজন। আমরা পৌঁছাতেই সেকি সমাদর। বিপুল আয়োজন।
একেই ঠান্ডা তার উপর কাকু নার্ভাস হয়ে আরো বেশী করে কাঁপতে লাগলো।বিয়ের সময় চেপে ধরে থাকতে হলো। বিয়ে সাড়া হলো। এলাহী খাবার আয়োজন। বিশাল বিশাল পাবদা মাছের কথা মনে আছে। নরম গদীর বিছানায় আমাদের জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা। এত আতিথেয়তা বিয়ে বাড়ীতে কখনো দেখিনি। কাকীমণির মামা হচ্ছেন নামকরা ডাক্তার তিনশুকিয়ার।
পরের দিন বাসী বিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি সাড়া হওয়ার পর সন্ধ্যের সময় আমাদের ট্রেন। বিদায় পর্ব চোখের জলে সাড়া হবার পর রওনা হলাম আমরা লাগেজ সহ। সবাই নতুন বউ শুদ্ধু ট্রেনে চাপিয়ে বিদায় নিলো। আমাদের ট্রেন তিনশুকিয়া ছাড়লো।
আবার সেই তিন রাত ধরে ধানবাদ ফেরা। আমাদের বাড়ীতে তখন আত্মীয় স্বজন সব এসে পড়েছে। একদিন বাদ দিয়ে বউভাত হলো। খুব ধুমধামের সাথে বউভাত সম্পন্ন হয়েছিল।
আমরা যখন প্রথম নামরুপ যাই ১৯৭১ সালে তখন পৌষ পার্বণের পিঠে কাকুর প্রতিবেশীরা আমাদের খাইয়েছিল। কালো তিলের পাটিসাপটা এছাড়াও আরো সব ছিল। আমার মা আর দিদিরা ওদের কাছ থেকে মেখলা কেমন করে পরতে হয় শিখে নিয়েছিল।