Image by Sasin Tipchai from Pixabay
শিক্ষক দিবস। সকলের জীবনেই মা বাবা হলেন শিক্ষাগুরু। জীবনের প্রথম শিক্ষক মা, তারপরে বাবা, আমার ও তাই।
আমাদের সময় স্লেটে চক দিয়ে প্রথম অক্ষর 'অ' মায়েরই শেখানো। এছাড়া ও অন্যান্য শিক্ষা তো ছিলই। মায়ের কাছেই আমি ও প্রথম অক্ষর শিখেছিলাম, বাবা ও শেখাতেন রাত্রের দিকে। যত বড় হয়েছি তত মায়ের হাতের মার খাওয়া শুরু হলো, বকুনি শুরু হলো। তখন কয়লার উনুন ছিল, সকালে মা রুটি করতে করতে লেখা এবং পড়া শেখাতেন, না পারলেই বেলনার বারি।
বাবা ক্লাস সেভেন পর্য্যন্ত পড়িয়েছেন ক্লাস এইট থেকে নিজে নিজেই পড়াশোনা করেছি। কোন প্রাইভেট টিউটর ছিল না একেবারে কলেজ পর্য্যন্ত।
পাঁচ বছর বয়সে আমাদের বাংলোর পাশে রেলের একটা প্রাইমারী স্কুল ছিল সেখানে ভর্তি হবার পর প্রথম শিক্ষক ছিলেন নেপাল চন্দ্র মুখার্জি। খুব কড়া ও রাগী শিক্ষক ছিলেন। ধুতি ও ফতুয়া পরতেন। সব ছাত্র ছাত্রীরা তাঁকে ভয় করতো।
ভয় করার কারণ হলো পড়া না পারা, বাড়ীর কাজ না করে স্কুলে যাওয়া। এগুলো না করে গেলেই তাঁর প্রসিদ্ধ মার ছিল বেতের বারি, নীলডাউন, মুরগী হওয়া, উঠবস করা, ইঁট মাথায় নিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি। এই শাস্তিগুলো সবই ছেলেদের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
উনি মেয়েদের গায়ে হাত দিতেন না কখনো। মেয়েদের জন্য শুধু বকুনিই যথেষ্ঠ ছিল। আবার খুব ভাল মেয়েদের গালে বিউটি স্পট দিতেন লাল কালি দিয়ে। ওটা তার বিশেষ উপহার। এই স্পট প্রতিদিন আমি পেতাম তার মানে পড়া করে যেতাম। এইরকম স্পট প্রতিদিন যে মেয়ের গালে থাকতো, বুঝে নিতে হতো সে পড়াশোনা করে স্কুলে গেছে। যার গালে থাকতো না সে পড়া করে যায়নি।
কিন্তু ভাল ছেলেদের গালে স্পট দিতেন না এটা তাঁর নিয়ম ছিল। ছেলেদের বোধহয় স্পট মানায় না সেই হিসেবে হয়তো দিতেন না। এটার উত্তর দেওয়ার এখন কেউ নেই।
পূজোর, গরমের, এবং শীতের ছুটিতে হাতের লেখা তিনটে ভাষায়, বাংলা, হিন্দী, ইংরেজি এবং অঙ্ক বাড়ীর জন্য ত্রিশদিনের দিয়ে দিতেন আর প্রতিদিনের ডায়েরী লিখতে হতো ক্লাস ফোর থেকে। শাস্তির ভয়ে সবাই তাই করতো।
আরো একজন শিক্ষক ছিলেন তাঁর নাম জগৎজ্যোতি চক্রবর্তী। তিনি প্যান্ট, শার্ট পরতেন, রেল থেকে মাইনে পেতেন কিন্তু নেপাল মাষ্টারমশাইয়ের কোন বেতন ছিল না। রেল থেকে কোন বেতন পেতেন না। অবৈতনিক শিক্ষক ছিলেন।
এরপরে ক্ষিতিশবাবুর স্কুলে যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম তখন অনেক শিক্ষিকা পেয়েছি। এই স্কুল প্রাইভেট ছিল, সরকারী ছিল না, শুধু মেয়েদের জন্যে সম্পূর্ণ বাংলা স্কুল।
আমার জন্ম বিহারের ধানবাদের তেঁতুলতলায়। বাবা রেলের উচ্চ পদাধিকারী ছিলেন। আমরা রেলের কোয়ার্টারে থাকতাম। এটা দুই কামরা বিশিষ্ট সাধারণ কোয়ার্টার ছিল না। এটাকে বাংলো বলা হতো বৃটিশ আমলের তৈরি। এতে বিশাল বড় বড় কামরা ছিল, বাথরুম, রান্নাঘর সবই বড় বড় ছিল, বাথরুমে বাথটাব ছিল।
ধানবাদ বিহার হলেও বাংলা স্কুল ছিল, বাঙালি প্রচুর ছিল। স্কুলে আমাদের বাংলার সাথে একটা সাবজেক্ট হিন্দী ছিল, ইংরেজি ও অনিবার্য ছিল। সংস্কৃত ছিল ক্লাস এইট থেকে। মাধ্যমিক পর্য্যন্ত চারটে ভাষাতেই পড়তে হয়েছে।
আমাদের হাইস্কুলের নাম ছিল ধানবাদ প্রাণজীবন একাডেমী (গার্লস)। এই স্কুলের বড়দিদিমণি ছিলেন অর্চনা দত্ত। ফর্সা, লম্বায় প্রায় পাঁচ দশের মতো, সাদা শাড়ি, বড় একটা মাথায় খোঁপা অথচ কত ব্যক্তিত্বময়ী। তিনি বিধবা ছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে সব দিদিমণিরা ফেল। প্রতিটা ছাত্রী তাঁকে শ্রদ্ধা, ভক্তি করতো, ভয় ও পেতো, ভাল ও বাসতো। যে কোন ক্লাসে গেলেই সব চুপ, সব বোবা। অঙ্ক, ইংরেজি এবং অর্থনীতিতে একেবারে প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। আমাদের সময়ে অর্থনীতি ছিল।
এছাড়াও আর সব দিদিমণিরা ও খুব ভাল ছিলেন। নীচু ক্লাসে একজন দিদিমণি ছিলেন তাঁর নাম রুক্মিণী। তাঁকে ও সবাই ভয় পেতো।
প্রাইমারী স্কুলের মতো হাইস্কুলে বেত মারার ব্যাপার ছিল না, চড় চাপড় ও ছিল না কিন্তু কড়া শাসন ছিল, শাস্তির মধ্যে কান ধরে দাঁড়ানো ছিল। এটাই বড় শাস্তি, এতেই মেয়েদের মধ্যে অপমানবোধ জাগতো, অন্য শাস্তি তাই প্রয়োগ হতো না।
আমাদের স্কুলে শিক্ষক দিবসের দিনটা একটা উৎসব ছিল। আমরা উঁচু ক্লাসের দিদিদের কাছ থেকেই শিখেছিলাম। প্রতি বছর এই দিনটাতে যার যার ক্লাস টিচারকে সংবর্ধনা দিতো, ক্লাসটাকে ফুল দিয়ে সাজানো হতো, দিদিমণির টেবিল টাকে সুন্দর টেবিল ক্লথ দিয়ে, ফুলদানিতে ফুল দিয়ে বিশেষভাবে সাজানো হতো। সকাল থেকেই ফুল জোগাড় করার পালা চলতো। ক্লাসের সবাই মিলে চাঁদা তুলে দিদিমণির জন্য মিষ্টি এবং উপহার কিনে টেবিলে গুছিয়ে দিদিমণিকে অফিস রুম থেকে নিয়ে আসা হতো এবং দিদিমণি এলে আমরা তাঁর পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম উনি আশীর্বাদ করতেন, আদর ও করতেন।
এরপরে কলেজে যখন গেলাম একেবারে অন্যরকম। স্কুল এবং কলেজের পার্থক্য অনেক ছিল। কলেজে এই দিবসটাকে স্কুলের মতো মানা হতো না। কলেজে ও প্রচুর শিক্ষিকাদের সমাগম ছিল যেহেতু বালিকা মহাবিদ্যালয় ছিল সেহেতু কোন শিক্ষক ছিল না।
স্কুল, কলেজে সরস্বতী পূজোটা ও ধুমধাম করে হতো। শাড়ী পরার ও ধুম ছিল সেইদিনটায়। যদি ও স্কুলে ক্লাস টেন থেকে শাড়ী ছিল কিন্তু কলেজে কোন ও বাধ্য বাধকতা ছিল না। আমাদের সময়ে স্কুলে টেন, ইলেভেন নিয়ে মাধ্যমিক ছিল আর কলেজে দু বছর ইন্টারমিডিয়েট এবং দু বছর বি.এ ছিল। এই দু বছর বি.এর সাথেই যার ইচ্ছে হতো অনার্স নিয়ে পড়তো।
স্কুল কলেজ ছাড়া ও আমার আর একজন শিক্ষিকা ছিল সে আমার থেকে এক ক্লাস সিনিয়র ছিল তাই তুই করেই বলতাম। সে আমার গীটারের শিক্ষিকা ছিল। দারুণ শিক্ষিকা ছিল তার নাম বকুল। আমাকে ছ'মাসে 'রাগ' তুলিয়ে ছেড়েছিল। এখনো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে খাতাটা আছে গীটার নেই সে কবেই বিনা প্র্যাকটিসে ধ্বংস হয়ে গেছে।
এছাড়াও ১৯৮৩ সাল থেকে নিজে যখন শিক্ষকতা শুরু করি ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে প্রচুর শ্রদ্ধা, সম্মান, ভালবাসা পেয়েছি যা এখনো ভুলতে পারি না। যারা খুব প্রিয় ছিল তাদেরকে গল্প, উপন্যাসে স্থান দিয়েছি। স্কুলের ছাত্র ছাত্রী ছাড়া ও আমার আরো ছাত্রছাত্রী ছিল। খুব কম বয়স থেকেই প্রচুর টিউশনি করেছি। বিহারে শুধু নয়, পশ্চিমবঙ্গে ও। দুই রাজ্যেই স্কুল শিক্ষকতা করেছি, টিউশনি ও করেছি।
তাই শিক্ষক দিবসে আমার জীবনের সমস্ত শিক্ষক শিক্ষিকাদের অগাধ ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে স্মৃতিচারণ করলাম খুবই সংক্ষেপে। তার সঙ্গে শিক্ষকতার জীবনে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের স্মরণ করলাম। তারা আজ অনেক উচ্চশিক্ষিত হয়ে বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত, সংসার ও করছে তাদের প্রতি আমার ভালবাসা রইলো।