Photo by Matin Hosseini on Unsplash

ভেবেছিলাম হয়ত এবার অন্তত ফোনটা পাব। না, এখনও পর্যন্ত এল না। প্রতি বছরই এই দিনটার জন‍্য অপেক্ষা করে থাকি কিন্তু ফোন না পেয়ে বিমর্ষ হয়ে বসে সবকিছু ভুলে যাওয়ার চেষ্টাও করি। কিন্তু এবার পারছি কোথায়? ভুলতেই পারছি না। ঘুরেফিরে গোল ছোট মুখটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ভেসে উঠছে লাল ফ্রকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা সুন্দর সুডৌল ফর্সা দু'টো হাত। মনে মনে কতবার যে ছূঁয়েছিলাম সেই হাত, কে জানে! আহা কি তৃপ্তি! শয়নে স্বপনে হাতের পরশে হয়েছিলাম তোলপাড়। রোজ রোজ চোখ চলে যেত বারান্দার দিকে। রাতের অন্ধকারে রাস্তার টিমটিমে আলোতে চেষ্টা করতাম দূর থেকে তার চোখে চোখ রাখতে। কখনও আবার ভোরের সূর্য ওঠার আগের লালাভ আকাশে সুন্দর স্নিগ্ধতার মধ‍্যে ছটফট করা মনে প্রলেপের জন‍্য দৃষ্টি থাকত বারান্দার দিকে। যদি একটু দেখা যায়। দেখা যেত না। কে উঠবে, আমার মত এত সকালে? তাও যদি সে জানত যে আমি চাতক পাখির মতন তাকিয়ে থাকি, তাহলে হয়ত উঠে দেখা দিত। সে তো জানতই না আমার মনের কথা! আমিও কোনোদিন সুযোগ পেতাম না ঐ দুটো কথা বলার জন‍্য, কারণ, সে ছিল অতীব সুন্দরী এবং সেইজন‍্যই ওর বাবা মায়ের ভয়। সবসময় কেউ না কেউ তার সঙ্গে থাকত। বহুবার চেষ্টা করেছি। সুযোগই পাই নি।

সে প্রায়ই বারান্দায় আসত। অবশ‍্যই একটু বেলার দিকে। কখনও কখনও চোখাচোখিও হয়েছে। কিছুতেই যেন আশ মেটে না। দেখছি বারান্দায় বসে কাঁসার ডাবু বাটিতে কিছু খাচ্ছে। হয়ত মুড়ি খাচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারছি না, মুড়ি খাচ্ছে না অন‍্য কিছু। মনে হচ্ছে, মুড়িই খাচ্ছে। একমুঠো নিয়ে মুখে পুরছে। আমি দূর থেকেই দেখছি। মুড়ির চেবানো আওয়াজে বুকের ভেতরটা ধরফর করছে। হয়ত হলুদ হলুদ কুসুম বীজ দিয়ে খাচ্ছে। কারণ, তাদের দেশ বাড়ি তো বর্ধমানে। বর্ধমানের লোকেরা কুসুম বীজ দিয়ে মুড়ি খায়। আমিও এখানকার একটা দোকান থেকে কুসুম বীজ কিনে এনেছি। মাঝে মাঝে খাই। মায়ের কাছ থেকে মুড়ি নিয়ে কুসুম বীজ দিয়ে খাচ্ছি আর দেখছি। অসময়ে মুড়ি খাব বলাতে মা অবাক হয়ে গেলেও কিছু বললেন না। বুঝতেও পারলেন না কেন এই অসময়ে মুড়ি নিয়ে বসলাম। অন‍্য সময় যখন আমাকে মুড়ি খেতে দেন তখন আমি খেতে চাই না। আজ মুড়ি চাওয়াতে মা অবাক হলেও খুশিই হলেন। আমাদের বাড়িতে এখনও বেতের ধামাতে মুড়ি খাওয়ার গ্রাম‍্য চল আছে। আমাকে সেই ধামাতে মুড়ির সাথে ডালমুট ও কুসুম বীজ মিশিয়ে দিতেই আমি জানলার পাশে বসে খেতে লাগলাম, কারণ, আমাদের বারান্দাটা আবার উল্টো দিকে। সেখান থেকে তাকে দেখা যায় না। মুড়ি চিবনো। ঝাল ডালমুটের গরম! কুসুম বীজের কোমলতা! সামনে অথচ দূরে যৌবনের ঔদ্ধ‍্যত্ব! মিলেমিশে একাকার! ধামার মুড়ি ধামাতেই আছে! চোখ দুটো তাকেই দেখছে! টুকটুকে মুখে দাঁতের সঞ্চালন! তীব্র আলোড়ন! আজ সেসবই মনে পড়ছে। আশা করেছিলাম হয়ত ফোনটা আসবে। এখনও এল না।

দূরবীন হাতে জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই মুখটা একেবারে সামনে এসে গেল। মুড়ি খাওয়া বন্ধ! ইঁদুরের মতন দাঁতের ঘর্ষণে মুড়ির চিরবিরানি আওয়াজ শুনতে না পারলেও বুঝতে পারছি। গোলাপী ঠোঁট দু'টোতে ঠোঁট চেপে ধরতেই মুখটা সরে গেল। আবার দূরবীনটা ঠিক করে চোখ লাগিয়ে দেখছি। হাত থেকে দূরবীনটাই পড়ে গেল। এখন আর খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না। একেবারে ঝাপসা হয়ে গেল। দূরবীনটা তুলে দেখতে লাগলাম ভেঙে গেল কিনা। ভেঙে গেলে বাবা আর কিনে দেবেন না। বলবেন, এ'বছর তো আর বেড়াতে যাব না! সামনে তোমার জীবনের সব থেকে বড় পরীক্ষা। সেজন‍্য এ'বছর শুধু পড়াশোনা করো। মাটি থেকে তুলে দেখতে লাগলাম সত‍্যি কী ভেঙেছে? আমার মনটাই ভেঙে গেল। এখনও চোখে ঝাপসা দেখছি। তবে মনে হচ্ছে বারান্দাতেই আছে। দূরবীনটা দেখছি।

যাক্ বাবা, ভাঙে নি! চোখে দূরবীন! সামনে লালি। পড়াশোনা লাটে!

আঃ, কী সুন্দর! নিটোল গোল মুখ।

আমার বাবা মা দুজনেই খুব ভালো মানুষ! সহজ, সরল! এটাই আমার সুবিধা! যখন গতবছর মুসৌরীতে গিয়েছিলাম, তখন সবার হাতে দূরবীন দেখে বলেছিলাম কিনে দিতে। কিনে দিয়েছিলেন। কোনোরকম ঝামেলা করেন নি। দূরবীন দিয়ে যখন দূরের হিমালয়ের বরফমাখা চেহারা দেখিয়েছিলাম লাল ডিব্বা থেকে, তখন তো তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। হাতের নাগালে পাহাড়! বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না! ভাবলেন, ছেলে কত জানে! ফিরে এসে পাড়ার সবাইকে বলেছিলেন, জানো গো! আমাদের ছেলে একটা রত্ন! পাহাড় নিয়ে কত্তো পড়াশোনা করেছে! আমি তো বেজায় খুশি! দূরবীন আমার হাতে।

চুলে পাক ধরেছে। কাঁচাপাকা চুল নিয়ে রোজকার মতন রাসবিহারী এ্যাভিন্য়‍্যুর রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এখন আর সেরকম তাপ উত্তাপ নেই। 'প্রিয়গোপাল বিষয়ী' দোকানের ভেতর থেকে আমার নাম ধরে কারোর ডাক শুনে তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠল। দূরবীন মুখ! চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না। এই প্রথম একদম সামনে। একগাল হাসি নিয়ে আমার আরও সামনে এসে দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করলাম, এখানে? একটা কাজে এসেছিলাম। বাড়ি ফেরার আগে কিছু কেনাকাটা করছি। সে জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে? উত্তর দিতে পারলাম না। মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। মুড়ি চেবানো মুখ! ইঁদুর দাঁতগুলো এখনও ধবধবে সাদা। ঠোঁটের লাল তো ঠিকরে বেরোচ্ছে। ফুচকা ফোলানো গালদুটো বুকে হাঁপর চালাচ্ছে। সে আরও কাছাকাছি এসে বলল, তুমি এখানে?

এখন এখানেই থাকি।

বিশেষ কথা বলতে পারলাম না। যাবার আগে আমার ফোন নাম্বার নিয়ে গেল। বলল ফোন করবে। জগদ্ধাত্রী পুজোতে চন্দননগরে ওদের বাড়ি যেতে বলল। সে ফোন করবে।

আমি ওর নম্বর নিতে ভুলে গেলাম।

কোনোবারই ফোন আসে না। আশাহত হয়েও ভুলে যাই। এবার যাচ্ছি চন্দননগর। ফোন আসে নি। গাড়ি কিন্তু চলছে। চলেই যাচ্ছে।

.    .    .

Discus