আজকে 'হ্যাপি ফাদার্স ডে' র মেসেজ পাওয়ার পরে আনন্দ হওয়ার বদলে কিছুটা মনখারাপ হয়ে গেল। ছোট মেয়েটা যে কিনা এক দন্ড আমাকে ছাড়া থাকত না, সে আজ দূরে, দূর থেকেও ভোলে নি, মেসেজ পাঠিয়ে মনে করিয়ে দিল যে সে আজও আমাকে ছাড়া থাকতে পারে না। আজকে 'ফাদার্স ডে'।
সেদিনকার কথা মনে পড়ে গেল। বউয়ের শরীর খারাপ, আমাকে আবার কারখানায় যেতেই হবে। লোকের মুখে শুনি সরকারি কারখানায় ইচ্ছেখুশি মতন চাকরি করা যায়, কিন্তু আমি তো আজ পর্যন্ত একদিনও নিজের ইচ্ছেমত অফিস কামাই করতে পারি নি, আজকেও এই ভোর পাঁচটার সময় বেরোতে হচ্ছে। বউটা শুয়ে আছে। অন্যদিন সে শুয়ে থাকে না। সকালের খাবারদাবার তৈরী করার জন্য তিনটের মধ্যে উঠে পড়ে কিন্তু আজ পারল না। অস্বস্তিতে ছটফট করছে, তবুও বলল, যাও, তুমি যাও, একটু পরেই আমি ভাল হয়ে যাব।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে যেতেই হল, না যাওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। একটু যে খবর নেব, তারও সুবিধা নেই। বাড়িতে ফোন নেই। আশেপাশেও ফোন নেই। উৎকন্ঠা নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখনও দেখি সে আলুথালু অবস্থায় আছে, মাঝে বাড়িতে যে হিন্দুস্থানী মহিলা ঠিকে কাজ করতেন তিনি বউয়ের ঐরকম অবস্থা দেখে কিছু অনুমান করেছিলেন এবং সেদিনের ডালভাতটা রান্না করে দিয়েছিলেন।
কাছাকাছি ডাক্তার নেই। হাসপাতালে যে নিয়ে যাব, বউয়ের সেরকম অবস্থাও নেই। আর এই অবস্থায় নিয়ে গেলে আমাদের এখানে ভর্তি করে নেয়। বউয়ের বড় আপত্তি হাসপাতালে যাওয়ার, কিন্তু কাকে ডাকব? কাছাকাছি তো কেউ নেই। এক হোমিওপ্যাথ ডাক্তার আছে। তাকে ডাকার ইচ্ছে নেই, তবুও তাকেই ডাকতে গেলাম। সে ডাক্তারের কি হাঁকডাক! বাড়িতে আসবেন না। এদিকে তার চেম্বারে কোনো রোগীও নেই আর বিশেষ রোগী হয় বলেও মনে হয় না, তবুও সে গম্ভীর হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকল। অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে তিনি একটা মোটা ফি (fee) দাবী করলেন। আমি রাজী হয়ে গেলাম।
খবরটা জানার পর আনন্দের সাথে উৎকন্ঠা বেড়ে গেল। কী করব? কাকে বলব? এই সময়ে কী করতে হয়? কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব? এখানে, কে ভালো ডাক্তার আছে? এইসব চিন্তা করতে করতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। সে এখনও ছটফট করছে, কিন্তু তারমধ্যেই যেন একটা আনন্দের ছবি দেখতে পারছি তার মুখে।
নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যখন আমরা দু'জনে নিশ্চিত হলাম, তখন আবার হাজারটা চিন্তা হাজির হলো। কী করে আগামী দিনগুলো সামাল দেব। আমাকে তো সকাল, দুপুর, রাত্রে শিফ্টিং ডিউটি করতে হয়। কে থাকবে তার পাশে। আমি এ'সব নিয়ে চিন্তা করলেও বউকে আমার চিন্তার কথা জানাতাম না, কারণ, আমি শুনেছিলাম এই সময় মাকে হাসিখুশী রাখতে হয়, সেইজন্য আমার কর্মক্ষেত্রের ঝামেলার কথা তাকে আর বলতাম না, কিন্তু সমাধানটাও করতে পারছিলাম না। এই অবস্থাতেই দিন কাটছে।
বউ এখন একদম স্বাভাবিক। রান্নাবান্না এবং ঘরের যাবতীয় কাজ করছে সঙ্গে স্কুলেও যাচ্ছে। সারাদিন ক্লাস করিয়ে দুপুর দু'টো নাগাদ বাড়ি ফিরলে কোনোদিন আমাকে বাড়িতে পায় আবার কোনোদিন পায় না। যেদিন আমার নাইট শিফ্ট থাকে সেদিন আমি দরজা খুলে দিই, আবার যেদিন দুপুরে যাই সেদিন কখনও দেখা হয় আবার কখনও আমাদের রাত্রি পৌনে এগারোটার আগে দেখা হয় না। এইভাবে ভালই চলছে কারণ, আমাদের আগন্তুকটা আর কোনো বিরক্ত করছে না।
আস্তে আস্তে শরীর ভারী হচ্ছে। আমার আনন্দের সাথে চিন্তাটাও বেড়ে চলেছে। কখন কী করতে হবে, কাকে ডাকতে হবে, আবার কি সেই দিনের মতন অবস্থা হবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সকালবিকাল একই চিন্তা। রাত্তিরে কারখানায় থাকলেও চিন্তা হয়। যেদিন রাতে বাড়ি থাকি সেদিন কিছুটা স্বস্তি হলেও চিন্তাটা আমায় তাড়া করেই বেড়াচ্ছে।
কালিপুজোর দু'দিন আগে বাবা হওয়ার আনন্দের সাথে সাথে আরও দিশেহারা হয়ে গেলাম। এই ঠান্ডার দিনে ঐ কচি বাচ্চাকে রাখতে গেলে কী কী করতে হবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। শুনেছি বাচ্চাকে তুলোর বালিশ দেওয়া যায় না। তার জন্য গোটা সরষে দিয়ে বালিশ করতে হবে। কিন্তু কত কেজি দিয়ে বালিশ বানাতে হবে? বেশী সরষে দিলে তো বালিশ উঁচু হয়ে যাবে। কচি বাচ্চাটার অসুবিধা হবে না তো? লেপে কতটা তুলো দিতে হবে? ধুনুরি যা বলবে সেইমতন বানাব না আরও বেশী তুলো দিতে বলব? বেশী ভারী হয়ে গেলে বাচ্চাটার অসুবিধা হবে না তো? আবার কম তুলো দিলে এই দুর্গাপুরের ঠান্ডাটা আটকাবে তো? যাই হোক! বাবা যখন হয়েছি, তখন আমাকেই এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে। আনাড়ি বলে এড়িয়ে গেলে তো আর চলবে না!
বাচ্চাটা এখন হাত বাড়িয়ে কোলে ওঠে। এধার ওধার থেকে ডাকলে চোখ ঘুরিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে সাড়া দেয়। মুখে আওয়াজ করে। আমি বাড়িতে আসার পরে সে আর কারোর কোলে যাবে না। মায়ের কোলে তো একদমই যাবে না।
আমরা তিনজনে পাশাপাশি শুয়ে থাকি। সে এখন আমাকে জড়িয়ে ঘুমোয়। সকালের ডিউটির জন্য যখন ভোর সাড়ে তিনটের সময় উঠি তখন সেও উঠে পড়ে। কিছুতেই আর ঘুমোয় না, কিন্তু তখন আর আমার কোলে ওঠার বায়না করে না। মায়ের কোলে থাকে। আবার যখন সকালবেলায় সাতটা নাগাদ ফিরি তখন দেখি মায়ের সাথে আমার জন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে দেখেই হাঁই হাঁই করে চিৎকার করতে থাকে, আবার সেই মেয়েই আমার সাথে সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুমোয় যেদিন আমি দুপুরের শিফ্টে যাই।
আমি বাবা হই নি। আমার মেয়েই আমাকে বাবা করে দিচ্ছে। নানারকম প্রশ্ন করে। অনেক প্রশ্নের উত্তর কী করে দিতে হবে সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। বউকে জিজ্ঞেস করি। তার স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে বলে সে বাচ্চাদের হাবভাবের সাথে বেশ সড়গড়। আমি তার সাহায্য নিয়ে আমার আদরের বাচ্চাটার প্রশ্নের উত্তর দিই।
এখন বুক টেনে টেনে চলাফেরা করে। আমার সাথে বসে টি ভি দেখে। একদিন দেখি হঠাৎ করে রিমোট দিয়ে টি ভি টা অফ করে দিল। আমরা দু'জনে তো অবাক! তাকে তো আমরা শেখাই নি। আমরা বাবা মা বাচ্চার সম্বন্ধে নতুন জিনিস শিখলাম। এরপর আমরা টিভির selection mode পাল্টে দিয়ে, টিভি থেকে on off করতে লাগলাম। সে আর রিমোট দিয়ে কিছু করতে পারছে না দেখে আমরা বাবা মা বেশ হাসছি। মেয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। দিন দুয়েক এইভাবে চলার পর সে আর টিভির ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছে না। আমার চারপাশে বুক টেনে টেনে ঘুরছে, মাঝেমধ্যে রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের সাথে দেখা করে আসছে। আমরাও নিশ্চিন্ত হয়েছি, কিন্তু এরমধ্যে যে সে আমাদের খেয়াল করেছে কীভাবে আমরা টি ভি অন অফ করছি সেটা আমরা বুঝতে পারি নি, বুঝতে পারলাম তখন যখন সে আমার পাশ দিয়ে গিয়ে টি ভি রাখার টেবিলের স্ট্যান্ড ধরে উঠে টি ভির গায়ে লাগানো স্যুইচটা দিয়ে অফ করে দিল। আমি অবাক হয়ে ওর মাকে ডাকলাম। মেয়ের কী হাসি! বিশ্ববিজয়ীনির হাসি! আমার আনন্দ হলেও ভয় পেয়ে গেলাম। এইভাবে কখন যে টি ভি টা ওর ঘাড়ের উপরে পড়বে সেই চিন্তায় আমাদের দুজনের ঘুম উড়ে গেল। মেয়েকে চোখে চোখে রাখতে হল। মেয়ে আমাদের দু'জনকে প্রকৃত বাবা মা হওয়ার ট্রেণিং দিতে শুরু করে দিল।
এখন কথা বলে। অনর্গল কথা বলে। পড়তে শিখছে। এখনও লিখতে শেখে নি। নিজে যা যা শিখছে তার ছেলেমেয়েদের সেইসব শেখাচ্ছে। আমরা খেয়াল করছি। সব ঠিকঠাক বলছে। আমি কী করে মেয়েকে শেখাব সেই চিন্তাটা সমানে করে যাচ্ছি। আমি বাবা হয়েছি ঠিকই কিন্তু কীভাবে পড়াতে হয়, শেখাতে হয় সে ব্যাপারে কিছুই বুঝতে পারছি না, মেয়ের কাছ থেকেই ট্রেণিং পাচ্ছি।
'A' লিখতে শিখে যে কী আনন্দ একটা বাচ্চা পেতে পারে সেটা আমার মেয়েকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। সেই সময় ওর দাদু, ঠাকুমা এসেছেন। এখন নিজের ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিয়ে ঠাকুরদাদা ও ঠাকুমাকে ছাত্র ছাত্রী বানিয়ে সকাল থেকে রাত্তি পর্যন্ত 'A' লেখা শেখাচ্ছে।
স্কুলে যাচ্ছে। ছবি দিয়ে দিয়ে পড়ানোর একটা বইতে টিউব ওয়েলের ছবি দিয়ে জল পড়ছে দেখাচ্ছে। মা মেয়েকে সারাদিন ধরে চেষ্টা করেও বোঝাতে পারেন নি যে টিউব ওয়েল দিয়ে জল পড়ে। যখনই জলের কথা হচ্ছে তখনই সে বাড়ির ট্যাপ দেখিয়ে বলছে, জল এখান দিয়ে পড়ে। আমাদের স্টীল টাউনশিপের চারদিকে কোনো টিউব ওয়েল না থাকায় তাকে দেখাতেই পারলাম না যে জল সেখান থেকেও পড়ে। সে কিছুতেই মানল না টিউব ওয়েল দিয়ে জল পড়ার কথা। আমরা বাবা মা ওকে জন্ম দিয়েছি ঠিকই কিন্তু সেই আমাদের প্রকৃত বাবা মা করে তুলছে।
বড় হয়ে গেল। স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় হোস্টেলে থাকল। ছুটিতে বাড়ি আসে। প্রথমে দু'একবার আমি তাকে নিয়ে এসেছিলাম, তারপর থেকে নিজেই আসা যাওয়া করে।
বাবা মা দু'জনেই বড় বড় অসুখে আক্রান্ত হওয়ার পরে সে পড়াশোনার মধ্যেই তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করল। বাবার জন্য রক্ত জোগাড় করা, নিজের মাষ্টারমশাইকে দিয়ে একটার পর একটা অপারেশন করানো এবং অপারেশনের পরেও প্রফেসরদের পরামর্শ মত বাবার চিকিৎসা করা। মায়ের ব্যাপারেও প্রফেসরদের সাহায্যে চিকিৎসা করাল।
পড়াশোনা শেষ করার আগেই বাবা রিটায়ার করে হাওড়ার শিবপুরে বসবাস করছেন। মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষ রক্ষা আর হলো না। মাতৃবিয়োগ হল।
পড়ার শেষে চাকরি করতে গেল তমলুকের জেলা হাসপাতালে। একা একাই যাতায়াত করত। তারপরে চাকরি করল বেলেঘাটার হাসপাতালে। 'করোনা'র সময়ে সে বেলেঘাটায় ছিল। এরমধ্যে আমার ও তার ঠাকুমার একসাথে 'করোনা' হল। সে তখন বাড়িতে আসতে পারছে না কিন্তু যোগাযোগ করে কলকাতার সেরা ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে আমাদের 'করোনা'র সাথে অন্যান্য অনেক কিছু টেস্ট করার জন্য দু'দিন অন্তর অন্তর লোক পাঠাতে শুরু করল এবং ঐ রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে বেলেঘাটার নামীদামী ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে আমাদের জন্য ওষুধ ও ফলমূল পাঠাতে লাগল। লকডাউন চলছে। তারওপর সেও হাসপাতালে ডিউটি করে চলেছে বলে আসতে পারছে না কিন্তু আমাদের সমানে খোঁজখবর নিয়ে চলেছে। এরমধ্যে একবার পুলিশের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেও আমি তাকে ভয়ে বাড়িতে ঢুকতে দিই নি। সেদিন আমার বুকটা ফেটে গিয়েছিল, কিন্তু বাবা হয়ে আমাদের 'করোনা' বাড়িতে ঢুকতে দিলাম না যদিও জানি যে সে বেলেঘাটা হাসপাতালে আরও বেশী সংক্রামক রোগী নিয়ে কাজ করছে, তবুও তাকে আমি দরজা থেকেই ফিরিয়ে দিলাম। সে ব্যাগভর্তি ফল, খাবার ও ওষুধ দিয়ে চলে গেল।
বিয়ে হল। হায়দ্রাবাদে গেল। সেখানে চাকরি করল। বছর দেড়েক বাদে কোলকাতায় ফিরে আসতে বাধ্য হলো। আমি দাদু হলাম। সে এখন নিজে ডাক্তারির সাথে সাথে ডাক্তার তৈরী করার কাজে ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছে, তাদের পরীক্ষা নিচ্ছে, খাতা দেখছে আবার external examiner হয়েও অন্য কলেজে যাচ্ছে। আমারও খেয়াল রাখছে।
আজকেও ভোলে নি। সত্যিই আমি হ্যাপি ফাদার। ইয়েস্, আই এ্যাম হ্যাপি, রিয়েলি হ্যাপি, মাই ডিয়ার মাদার!