মনুষ্য জীবনে গোঁড়ামির কোনো জায়গা নেই। ধর্মেও গোঁড়ামির কথা বলা না হলেও, আমাদের সমাজে ধর্মের নামে ব্যভিচার হয়। এবারের মহাকুম্ভে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনাতে জীবনহানি হওয়ায় যে অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেইসময় নাগা সন্ন্যাসীদের সংগঠন 'শাহি স্নানে'র কর্মসূচী পরিত্যাগ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান না করলেও ঈশ্বর সাধনায় কোনো ব্যাঘাত হয় না। এটাই ধর্মের মূল কথা। হিন্দু ধর্মের মূল কথা।
আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ মহাকুম্ভের ঐশ্বরিক ক্ষমতা দেখার জন্য 'প্রয়াগরাজ' রেল স্টেশনে পা রাখতেই দেখলাম এক জনসমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। নানা ভাষাভাষী মানুষের চারদিকে খাঁকি পোশাকের বহু পুরুষ মহিলা পুলিশের তদারকিতে সুশৃঙ্গলভাবে স্টেশন পেরিয়ে বাইরে এসেও দেখি নিরাপত্তার ভীষণ আঁটোসাঁটো ভাব। আমি সঙ্গমের কাছাকাছি থাকার জায়গা পাই নি। প্রায় চারমাস আগের থেকে চেষ্টাচরিত্ত করেও গঙ্গা নদী ও যমুনার কাছাকাছি কোনো হোটেলে জায়গা না পাওয়ায় হতাশ হয়েছি ঠিকই কিন্তু নিরাশ হই নি। চেষ্টা করে গেছি। অবশেষে এক সহৃদয় প্রতিবেশীর সাহায্যে এখানে নদী থেকে বহুদূরে একটা ছোট বাড়িতে থাকার সুযোগ পাওয়ায় রাজীই হয়ে গেলাম। এই বাড়িতে খাওয়া পাওয়া যাবে না। রান্নাবান্না করারও সুযোগ সুবিধা থাকবে না। এসব সত্ত্বেও মহাকুম্ভের অমোঘ পুণ্য লোভের আশায় এই সুযোগ হাতছাড়া না করে সানন্দে রওনা দিলাম প্রয়াগের উদ্দেশ্যে।
সেই বাড়িতে যেতে গেলে একটা গাড়ি দরকার। কিন্তু লোকের ভিড়ে গাড়ি পেতে বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেলেও সুন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য খুব একটা অসুবিধা হল না। গাড়ি পেয়ে গেলাম। যেতে যেতে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করছি যে আমি যেখানে থাকব সেখান থেকে কী করে সঙ্গমে যাব এবং সঙ্গমের কাছে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে কিনা। ড্রাইভারের বয়সটা আমার মতন হওয়ায় সে বলল, সাব, আপ ইস উমর মে ধক্কামুক্কি মে মত যাইয়ে। ম্যাঁয় ইলাহাবাদ মে রহনে কে বাওজুদ ভি আজ তক কভি ইস ভিড় মে হিস্সা নহীঁ লিয়া, মগর দুসরে টাইম ম্যাঁয় ওঁহা যা কর ডুবকি লগাতা হুঁ। মেরী সোচ বতা কে আপকো নিরাশ নহীঁ করুঙ্গা, লেকিন মেরী বিচার সে, আপকো উঁহা জানা উচিত নহীঁ হোগা। অব বিচার আপকা আপনা।
আমি বললাম, আপ তো সহী বাত হী বোলে, লেকিন মেরী ইচ্ছা হোতী হ্যায় এহ জাননে কি, ক্যাঁয়ো মহাকুম্ভ মে লোগো কো ইতনা জোশ হোতা হ্যায়। কিস কারণ সে লোগো নে তকলিফ উঠা কর কুম্ভ মে আতে হ্যাঁয়। সচমুচ ভগবান বোল কর কুছ হ্যায়? না, কেওল অপনি ভাওনা সে ইধর আকর ডুবকি দেতী হ্যায়?
ভগবান তো হ্যায়, লেকিন ডুবকী সে ভগবান খুশ হোতে কি না এহ মুঝে পতা নহী,
আপ যব খোজ কে লিয়ে আয়ে হো তব মুঝে কুছ বোলনা নহীঁ চাহিয়ে, তব ভি বোল রহা হুঁ কি, আপ সাওধান রহিয়েগা। অপনা খয়াল রখিয়েগা।
আমি আর ড্রাইভারকে কিছু বললাম না। তাকে বললাম না এই স্নানের বৈজ্ঞানিক কারণের কথা। বলি নি যে সৌরমন্ডলে চন্দ্র, সূর্য ও বৃহস্পতির এক সরলরেখায় অবস্থানের সময় যে বিবর্তনের পরিস্থিতি হয় সেই বিবর্তনের ফলে উদ্ভুত শক্তির এক বিরাট অংশ নদীর জলে সঞ্চিত হয় এবং ঐ সময় নদীতে স্নান করলে মানুষের দেহে সেই শক্তি সঞ্চারিত হয় এবং এর ফলে শারীরিক ও মানসিক উন্নতি হয়। সেই উন্নতি ও বিকাশের উপলক্ষেই আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ধর্মের নামে এই শিক্ষা প্রচার করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে এইসময় স্নান করলে 'মোক্ষ লাভ' হবে।
কিছুক্ষণের জন্য আমিও চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লাম। তখনকার মনীষীদের বিদ্যা, বুদ্ধি এবং মহাকাশ গবেষণার দক্ষতা নিয়ে ভাবতে শুরু করি এবং অর্ধকুম্ভ, কুম্ভ, পূর্ণকুম্ভ ও মহাকুম্ভ নিয়ে নিঁখুত গণনার কথা ভাবি। যখন মহাকাশ গবেষণার কোনো যন্ত্রপাতিই ছিল না, তখনকার সাধক বিজ্ঞানীদের বিচক্ষণতায় বিহ্বল হয়ে ভাবলাম যে, সাধু শঙ্করাচার্য যদি সেই বিরল জাগতিক গ্রহ সমন্বয়ের মুহূর্তকে অমর করে না রাখতেন, তাহলে, আমি আজও জানতে পারতাম না যে চন্দ্র, সূর্য ও বৃহস্পতির সরলরেখায় অবস্থানের সময় মহাকুম্ভ হয়। তিনি এই মেলার প্রবর্তন শুধু মানুষের 'মোক্ষ লাভে'র জন্যই করেন নি। তিনি ধর্মীয় উন্মাদনার পাশে সনাতনীয় সংস্কৃতি ও দার্শনিক আলোচনার পরিসরেরও পরিমন্ডল তৈরী করেছিলেন। সেইজন্য আজও এই সময়ে সর্বত্যাগী নাগা সন্ন্যাসীরা তাঁদের দুর্গম গিরিগৃহ ছেড়ে জনসাধারণের মধ্যে উপস্থিত হয়ে জ্ঞান বিতরণের জন্য আসেন এবং মেলার অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন।
সাধুরা দলবদ্ধভাবে বিভিন্ন 'আখড়া'তে থাকেন। 'আখড়া' হচ্ছে সন্ন্যাসীদের সংগঠন। এই আখড়ায় ধর্ম সাধনা থেকে ধর্মতত্ত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। সেই সাধুদের নিজের চোখে দেখা ও তাঁদের জীবনশৈলী নিয়ে বিশ্লেষণ করাটাও আমার এক উদ্দেশ্য। এইসব যখন ভাবছি তখন দেখছি গাড়ি জ্যামে আটকে গেছে। ড্রাইভার এখন আর আমার সাথে কথা বলছেন না। আমিও কুম্ভ মেলা নিয়ে নিজের মনে চিন্তা করছি ও অতীত দিনের মণীষীদের কথা ভাবছি। সাধু শঙ্করাচার্য ৬ষ্ঠ শতকে চন্দ্র, সূর্য আধারিত বিক্রম সংবত পঞ্জিকা অনুসারে এবং সূর্য, চন্দ্র ও বৃহস্পতির সৌরমন্ডলে অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, প্রতি ১২ বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভ মেলার যে আয়োজন করেছিলেন তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যে কতটা নির্ভুল ছিল, তা আজও বোঝা যায়। এবার তো আবার মহাকুম্ভ! ১৪৪ বছর পরপর এই মহাকুম্ভ হয়। এবার এই মহাকুম্ভের সময় আবার সৌরমন্ডলের সাতটি গ্রহ এক সরলরেখায় অবস্থান করবে। প্রথমে দেখা যাবে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, নেপচুন, ইউরেনাসকে এর কয়েকদিন পরে বুধ গ্রহকেও দেখা যাবে এই planate parade এ। ধর্মের আধারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত ও নিঁখুত গণিতের ভারতীয় সৃষ্টিতে আমি অবাকই হচ্ছি না, বিস্মিতও হচ্ছি। এই সম্বন্ধেই জানতে আজ আমি এখানে এসেছি। মহাকুম্ভ ছাড়াও ৩, ৬, ১২ বছর অন্তর যে মেলা আয়োজন করা হয় সেগুলো যথাক্রমে কুম্ভ, অর্ধকুম্ভ, পূর্ণকুম্ভ নামে পরিচিত হয়।
পূর্ণকুম্ভ এবং মহাকুম্ভ হয় শুধু প্রয়াগরাজ ও হরিদ্বারে। কিন্তু কুম্ভ, অর্ধকুম্ভ এই দুই শহর ছাড়াও হয় উজ্জয়ীনি ও নাসিকে। কেন এই চার শহরেই মকর সংক্রান্তির দিন থেকেই কুম্ভমেলা হয়? এর ব্যাখ্যাও সুন্দরভাবে আমাদের মণীষীরা দিয়ে গেছেন। বর্ণনা করেছেন দেবতা ও অসুরদের মধ্যে সমুদ্র মন্থন করে অমৃত লাভের প্রতিযোগিতার কথা। সেই প্রতিযোগিতায় দুই দলের মধ্যে কাড়াকাড়ির জন্য কলস পাত্র থেকে চার ফোঁটা অমৃত ছিটকে পড়ে এই চার শহরের নদীতে, সেইজন্যই এই শহরগুলোতে 'কুম্ভমেলা' হয়।
এ সব চিন্তা করতে করতে অনেকটা রাস্তা হয়ত পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু এখনও আমার ঠিকানায় পৌঁছাই নি বলে ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আর কতদূর?
সে বলল, মিনিট পনেরোর মধ্যে আমার জায়গায় পৌঁছিয়ে যাব।
এরপরে আমি বললাম, এখান থেকে সঙ্গম কতদূরে,
সে বলল, হুজুর, গলত মত সমঝো। উস ধক্কামুক্কি মে ম্যায় নহীঁ জাউঁঙ্গা।
বাড়িআলা আমার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলেন। দোতলা ছোট বাড়িতে যে ঘরটা ঠিক করে রেখেছিলেন সেই ঘরটা দেখিয়ে বললেন, আমি কিন্তু ঘর ভাড়া দিই না, আমার রিশ্তেদার আপনার পড়োশী বলে, এই ঘরটায় আপনার থাকার ব্যবস্থা করেছি। আপনাকে খাবার দিতে পারব না। আপনি বাইরেই খাওয়াদাওয়া করবেন।
মোটামুটি পরিষ্কার ঘরে একটা চৌকি পাতা আছে। তার উপর পাতলা তোশক ও বালিশ। বিছানার চাদরটা একটু পুরনো বলেই মনে হচ্ছে। যাই হোক, ভগবানের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতাবোধ জানাচ্ছি এইজন্য যে, তিনি একটা থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন! এই আস্তানাটা না পেলে তো এখানে আসতেই পারতাম না!
রাতের ক্লান্তি দূর করার জন্য আমাকে এখনই স্নান করতে হবে, কিন্তু তার আগে ভদ্রলোকের কাছ থেকে যতটা সম্ভব মেলা সম্বন্ধে যাতে জানা যায় সেইজন্য, গল্প করতে শুরু করে বুঝতে পারলাম যে এখান থেকে রোজ যাতায়াত করা সম্ভব হবে না, কারণ, সঙ্গমস্থল অনেকটাই দূরে এবং বাসেরও সুবিধা নেই। গাড়ি নিয়ে গিয়েও খুব একটা সুবিধা হবে না, কারণ, রাস্তাঘাট গাড়ি চলাচলের জন্য প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পায়ে হেঁটেই বিভিন্ন ঘাটে ঘুরতে হবে।
স্নান করে প্রথমেই বেরিয়ে পড়লাম কাছাকাছি খাওয়ার দোকান দেখার জন্য। এলাকাটা মনে হচ্ছে সাধারন লোকের বাস। একতলা, দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলো পাশাপাশি বেশ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজনের চালচলনেও উন্মাদনা, উত্তেজনা দেখলাম না। দোকানপাটাও খুবই সাধারণ মানের। এরমধ্যে দেখতে পেলাম একটা কচুরির দোকান। কয়েকটা লাড্ডু জাতীয় মিষ্টির দোকান। ভাত খাওয়ার দোকান চোখে পড়ল না। অল্পকিছু খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। সেখানে লোকেরা এসেছে পুজো দিতে, প্রণাম করতে, আশীর্বাদ চাইতে। আমিও প্রণাম করে এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ করার জন্য এগোতেই তিনি বললেন, আপ নয়া আয়ে হো?
আমি বললাম, হ্যাঁ, মেলার জন্য এসেছি।
এই কথা শুনে তো তিনি আপ্লুত। বললেন, খুব ভালো করেছেন। জীবনে একবার কুম্ভস্নান করলে আপানার আর জন্ম হবে না। পুরোপুরি মুক্ত হয়ে ভগবানের দরবারে পৌঁছে যাবেন। খুব ভালো করেছেন এখানে এসে।
হিন্দী বাংলা মিশিয়ে তিনি আমার সাথে যেভাবে গল্প করছেন সেভাবে যদি গল্প করি, তাহলে, আমার আসার উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে বলে, আমি প্রসঙ্গটা পাল্টে মেলার জায়গায় কীভাবে যাওয়া যায় জিজ্ঞেস করতেই তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। বললেন, এক গাড়ি লে লো। ওহ গাড়ি সে যিতনা দূর যানে সকোগী তো যাও, উসকে বাদ প্যায়দাল সে যানে পড়েগা।
এর কথাটাও বাড়িআলা লোকের সাথে মিলে যেতেই বুঝতে পারলাম যে এখান থেকে যাতায়াতটা মোটেই সুবিধার হবে না।
মানুষকে জিজ্ঞেস করে করে, এক অটো থেকে আর এক অটো পাল্টিয়ে, আমি বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে আসার পরে পুলিশ আর এগোতে না দেওয়ায় আমাকে হাঁটতে হলো। পুলিশ কিছুতেই সোজা রাস্তায় যেতে দিচ্ছে না। জায়গায় জায়গায় বাঁশ, গার্ড রেল ইত্যাদি দিয়ে ব্যারিকেড করে দিয়েছে। পুলিশ আমার মতন তীর্থযাত্রীদের নির্দিষ্ট রাস্তা ও জায়গার মধ্যে দিয়ে যেতে বাধ্য করার জন্য আমি বুঝতেই পারছি না যে কোন জায়গা দিয়ে যাচ্ছি, আর ঠিকমত সঙ্গম ঘাটে পৌঁছতে পারব কিনা। ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে। ধাক্কাধাক্কি হলেও সুশৃঙ্খল জনতা ভক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি কারোর সাথে কথা না বলে তাদের সাথে যাচ্ছি।
মানুষের কি অপরিসীম ভক্তি! ঠান্ডার মধ্যে জনতা যাচ্ছে মোক্ষলাভের জন্য। একটা মাত্র ডুব দিতে! গঙ্গা, যমুনা ও অন্তঃসলিলা সরস্বতী নদীর সঙ্গমে! ঠান্ডাতে শরীর হিম হয়ে গেলেও জনস্রোতের মধ্যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখে আমি কিছুটা বিস্মিত! লোকেরা মাথায় করে নিয়ে যাচ্ছে বিছানা, কাঁধে ঝুলছে আরও দু'চারটে ব্যাগ। মনে হয়, এদের কোনো থাকার জায়গা নেই। এদের দেখে মনেও হচ্ছে না যে তারা কোনো হোটেলে থাকতে পারবে, তবুও ধর্মের টানে, মুক্তির খোঁজে, এলাহাবাদের তীব্র ঠান্ডায় চলেছেন অবিচল বিশ্বাস নিয়ে। আমি একটা পরিবারের দিকেই এতক্ষণ দেখছিলাম। এখন চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখছি যে এই ধরণের কষ্টসহিষ্ণু, ভগবানে অটল বিশ্বাসীর সংখ্যাই বেশী। বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের সাথে আছে তাদের পরিবারের ছোটরাও, এমনকি বেশ কিছু আট দশ বছরের ছেলেমেয়েদেরও দেখছি, 'হর হর মহাদেব', 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দিতে দিতে যাচ্ছে।
দূর থেকে দেখতে পারছি তাঁবুর মাথা। সঙ্গে ভেসে আসছে সংস্কৃত মন্ত্রের মনোমুগ্ধকর বচন। মনের মধ্যে এক পবিত্রভাবের উন্মেষ হলো। মন্ত্রের বিন্দু বিসর্গ বুঝতে না পারলেও, মনে হচ্ছে যেন আমি জীবনে কিছু একটা পেতে চলেছি। সঙ্গমে স্নান করার আকাঙ্খ্যাটা আরও বেড়ে গেল। ঘাটের কাছে গিয়ে পেলাম কিছুটা মুক্ত জায়গা। এখানেও ভিড়। কিন্তু ধাক্কাধাক্কি নেই। পুলিশ তো চারদিকে কটমট করে দেখছে, তার সাথে আছে নানারকম পোশাক পরা উদ্ধারকারীর দল। নদীর জলে আছে লঞ্চ। প্রত্যেকটা লঞ্চে বিভিন্ন রঙের পতাকা উড়ছে দেখে বুঝতে পারলাম তারা জলে পাহারা দিচ্ছে। ওদিকে শীতের মধ্যেও লোকের আবেগ ও ভক্তি দেখে আমার নিজেকে হিন্দু বলে গর্ব হচ্ছে, তার সাথে এই শীতের কামড় ভেঙে আমি যাতে স্নান করতে পারি সে ব্যাপারেও সাহস সঞ্চার করছি। নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সূর্য দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ নিবেদন করে একের পর এক ডুব দিচ্ছে, অন্যদিকে মেলা প্রাঙ্গনে বিভিন্ন তাঁবুতে দোকানিদের পসরার বিকিকিনিও চলছে।
বিরাট বালুকাবেলার পাশে গড়ে উঠেছে আজকের এই মহাকুম্ভের আয়োজন। একদিকে সনাতন ধর্মের বাহক ও রক্ষকদের তাঁবু, অন্যদিকে ভগবান বিশ্বাসী সাধারণ নাগরিক, সঙ্গে অসংখ্য ব্যবসায়িক মানসিকতার লোকের ব্যবসার পাশে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের বিনা পয়সায় খাবার বিতরণ দেখে ধর্মের এক অন্তর্নিহিত রূপ দেখতে পেলাম, এর পাশাপাশি দেখলাম ভন্ড ও তঞ্চকতার এক বিবর্ণ রূপও। সেইসব লোকেদের, যাদের দেখছিলাম পরম বিশ্বাসে, মাথায় বোঝা নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আসছিলেন মোক্ষলাভের আশায়, সেই লোকেরাই ঠকে যাচ্ছে বিভূতি মাখা সাধুদের কথায়। ঐসব সরল লোকদেরকে অবলীলায় ঠকিয়ে টাকা রোজগার করছে একদল অসৎ, ভন্ড ও
হলুদ- চন্দনের প্রলেপ লাগানো নকল সাধু। অন্যদিকে তাঁবুতে দেখতে পারছি আমাদের সনাতনি ধর্মের বাহক ও রক্ষক শৈব, বৈষ্ণব ও উদাসীন মতালম্বীর বিভিন্ন আখড়ার সন্ন্যাসীদের।
এইসব সাধু, সন্তরা সনাতন ভারতের ঐতিহ্য যেমন বহন করে চলেছেন সেরকমভাবেই আজকের দিনেও এই বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন ভক্ত ও বিপথগামী মানুষের মধ্যে। এই কুম্ভমেলাতেই তাঁরা আসেন তাঁদের অর্জিত জ্ঞানে মানুষকে দীক্ষিত করতে এবং ধর্মের সাথে শরীর চর্চা ও সাহসের জ্ঞানে ভক্তদের উদ্বুদ্ধ করে এক সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনের সোপান পাঠ করাতে।
আমি এখনও স্নান করার মত সাহস পাচ্ছি না। প্রচন্ড ঠান্ডায় যখন শীতের পোশাক গা থেকে খুলতেই পারছি না তখন দেখছি অগুনতি পুরুষ, মহিলা এমনকি ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও কী অনায়াসে স্নান করছে! নিজের কাছে নিজেরই লজ্জা হচ্ছে! আমার তো ব্যাগ সঙ্গেই আছে। এর মধ্যেই আছে আমার যাবতীয় পোশাক। স্নান করার সাহস যখন জোগাড় করতে পারছি না তখন নদীতটেই বিচরণ করতে লাগলাম।
এখনও তো 'মকর সংক্রান্তি'র অমৃত স্নান শুরু হয় নি। সব শুভক্ষণই হবে রাত শেষে ভোরের আগমনের ব্রহ্মমুহূর্তে। এখনই যদি স্নান করতে না পারি, তাহলে সেই সময়ে কী করে স্নান করব? ভাবতে ভাবতে মানসিকভাবে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়লেও হতোদ্যম হলাম না, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রোজ রোজ আমার বাড়ি থেকে এখানে এসে কীভাবে ব্রহ্মমুহূর্তের আনন্দ নেব? নদীতীরে ঘোরার ফাঁকে ফাঁকে, কোথাও থাকা যায় কিনা সেটারও খোঁজ করতে লাগলাম।
হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা ঘাটে এসে গেছি। ঘাটগুলো ভারি সুন্দর বানানো হয়েছে। পোশাক ছাড়ার ঘরগুলোও খুব বড় এবং সুন্দর। শুনতে পারলাম, কোটি কোটি পুণ্যার্থীর জন্য এই নদীতীরে উনিশটা স্নানের ঘাট বানানো হয়েছে। এক একটা ঘাটের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই। সবকটা ঘাট পায়ে হেঁটে ঘোরাও যাবে না। পুলিশও যাতায়াত এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে যে একটা ঘাট থেকে আর একটা ঘাটে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড বানানো হয়েছে। ব্যারিকেড দিয়ে ঢোকা ও বেরোনোর রাস্তাও বিভিন্ন রকম। আমার মনে হচ্ছে, ব্রহ্মমুহূর্তের স্নানের সময় হয়ত লোকের ভিড়টা সঙ্গমের ঘাটেই বেশী হবে। দূরের ঘাটে, হয়ত, এইসব ভগবান বিশ্বাসীরা স্নান করতে চাইবেন না। পুলিশও মনে হয় সেটা বুঝেই সুচারু ব্যবস্থাপনা করে ব্যারিকেড দিয়েছে।
এই ঘাট থেকে আবার উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলাম কারণ, সেদিকেই ত্রিবেণী সঙ্গম। সেখানেই আছে সাধুদের তাঁবুগুলো এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্থার কার্যালয়। প্রতি পদে পদে বাধা পাচ্ছি। পুলিশ কিছুতেই সোজা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দিচ্ছে না। ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অনেক ঘুরপথে যাওয়ার মধ্যেই দেখতে পেলাম এক ধর্মীয় সংস্থা বিনা পয়সায় অন্ন বিতরণ করছে। বেশ কিছু ভদ্র পোশাকের পুরুষ, মহিলাদের সেই খাবার খেতে দেখে আমিও হাত বাড়িয়ে খাবার নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে আবার সঙ্গমের দিকে রওনা দিতেই চোখে পড়ল এক অদ্ভুত লালিত্যমাখা, আপেলের মত লাল গায়ের রঙের অতি বৃদ্ধ বৃদ্ধাকে। স্বামী, স্ত্রী কিনা জানি না। সঙ্গে কেউ আছেন কিনা সেটাও বুঝতে পারলাম না। তারা ধুলোর মধ্যে একটা কার্পেট জাতীয় বড় আসনে বসে আছেন এবং একমনে চোখ বুজে ধ্যান করছেন। অপূর্ব এক দৃশ্য! আমি এক সাক্ষাৎ ভগবানরূপী লক্ষ্মী নারায়ণকে দেখছি। স্বর্ণমুকুট খোচিত লাল শাড়ি পরিহিতা চঞ্চলা মাতার শান্ত রূপ ও জগত রক্ষাকারী স্মিতহাস্য বিষ্ণুদেবের করুণাময় রূপ থেকে চোখ ফেরাতেই পারছি না। কতক্ষণ সেইভাবে ছিলাম জানি না। পুলিশ এসে গায়ে টোকা দিতেই স্বপ্ন ভেঙে গেল। সামনে বসে আছেন ধ্যানরতা বৃদ্ধ বৃদ্ধা। দূর থেকে তাদের প্রণাম করে এগিয়ে গেলাম। এখানে না এলে আমি বুঝতেই পারতাম না সনাতন ধর্মের এই মাহাত্ম্যের কথা!
নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়ালাম। কাতারে কাতারে লোকের ভক্তিভরা স্নান দেখছি। কাতারে কাতারে লোকের আকুতি দেখছি। 'মুক্তির আকুতি', 'মোক্ষলাভের আকুতি', 'নির্মোহের আকুতি'। এইসব আকুতির মাঝেও দেখলাম 'লোক ঠকানো' বুদ্ধি। সাধু বেশে সরল মানুষদের থেকে অর্থ শোষণের পদ্ধতি। এক শ্রেণীর জ্যোতিষীদের দেখলাম, ভয় দেখাতে। নানারকম ভয় দেখিয়ে তারা তাবিচ, কবজ, গাছগাছালির শিকড় বাকড় ও পাহাড়ি কিছু চকমকি পাথর বিক্রী করছেন। এদের পুলিশ বাধা দিচ্ছে না।
একটু এগিয়ে যেতেই দেখছি লোকের ভিড়টা অন্য জায়গার থেকে অনেকটাই বেশী। উৎসুক হয়ে দ্রুতপায়ে সেদিকে গিয়ে দেখলাম প্রত্যেকে অপেক্ষা করছে নাগা সন্ন্যাসী দর্শনে। এইসব নাগারা থাকেন সুদূর গিরিগৃহে। সাধনা অন্ত প্রাণ। সর্বত্যাগী সাধুদের বিবস্ত্র হয়ে কঠিন তপস্যায় অর্জিত জ্ঞানে সমৃদ্ধ দীপ্তমান পুরুষদের স্মরণে আসতে চায় এই সঙ্গমে উপস্থিত সব ভক্ত। প্রশাসনও খুব তৎপর, সজাগ। তাঁদের তাঁবুর বাইরে আছে নিশ্ছিদ্র পাহারা। পুলিশের বেষ্টনী। আমি কাছে গিয়ে দেখছি। সামনে বিভিন্ন আখড়ার তাঁবু। সাধুদের আখড়া! হিন্দু ধর্মের এক একটা ধারার বাহক! শৈব মতালম্বী নাগা সন্ন্যাসীরা শরীর চর্চার সাথে আধ্যাত্মিকতার মন্ত্র কে ছড়িয়ে দেন সাধারণের মধ্যে। 'জুনা আখড়া'র শৈব বিশ্বাসী নাগা সাধুরা এই মেলার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। যে কোনো শাহি স্নানের দিন এইসব সাধুরা সর্বাগ্রে সঙ্গমে স্নান করবেন বলে এদের পুলিশি প্রহরায় নির্দিষ্ট ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এই সাধুদের দর্শনের জন্য আগত ভক্তদের ঔৎসুকতা এতটাই বেশী থাকে যে প্রশাসনও খুব সতর্ক থাকে। আমি এখন 'জুনা আখড়া'র সামনে থাকলেও কোনো মহান নাগা সন্ন্যাসী দেখতে পারছি না।
সূর্য প্রায় হেলে পড়েছে। আমাকে এখন ফিরতে হবে। ফিরতে একদমই মন চাইছে না। রাত্রিবেলায় এই মেলার চরিত্র দেখার জন্য মনটা কাঁদলেও আমি এখন পর্যন্ত এমন একটা জায়গা পেলাম না যেখানে থাকতে পারব। ঐ সমস্ত ধার্মিকদের মত কষ্ট করে নদীর পাড়েও থাকতে পারব না। কি যে করি! এতক্ষণ আমি কারোর সাথে কথা না বলে ধর্মের খুঁটিনাটি জানার চেষ্টা করার জন্য সাধারণ নাগরিকদের সাথে কোনোই বাক্যালাপ করি নি। এখন দু'একজনের সাথে আলাপ করছি এবং একটা থাকার জায়গা খোঁজ করছি। কিন্তু তারা যে সব জায়গার কথা বলল, সেখানে গিয়ে দেখি যে তীর্থযাত্রীরা গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছেন। শুয়ে আছেন। সবার চোখেমুখে এক আনন্দের উজ্জ্বলতা! পূণ্যলগ্নে ডুব দেওয়ার তীব্র আকাঙ্খ্যা! আমারও ইচ্ছে 'মকর সংক্রান্তি'তে ডুব দেওয়া, কিন্তু সারারাত এইভাবে গায়ে গা লাগিয়ে থেকে হয়ত ডুব দিলাম, কিন্তু সুস্থ থাকতে পারব কী? আবার বাড়ি ফিরে গেলে তো মাহেন্দ্রক্ষণে আসতেই পারব না! এই তাঁবু থেকে বেরোতেই আলাপ হল এক সাংবাদিকের সাথে। তার কাছে আমার সমস্যার কথা বলায়, কেন জানি না, হয়ত 'বাবা লোকনাথে'র অসীম কৃপায়, তিনি বললেন, আপ মেরা সাথ রহ সকতে হ্যাঁয়। হমারা কোম্পানিকা গেস্ট হাউস মে আপকা ম্যাঁয় বন্দোবস্ত কর সকতা হুঁ। আমি তো হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। তিনি ফোনে কেয়ারটেকারকে বলে দেওয়ায় আমি একটা ঘর পেলাম। ঘরে আরও দু'টো বিছানা আছে। আমি আমার ব্যাগটা রেখে প্রথমে স্নান করে কিছু খেয়ে বারান্দায় বসে ধর্মপরায়ণ জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে সনাতনী হিন্দুদের অতীত সংস্কৃতির প্রতি মনোনিবেশ করার সময় মনে হল, একটু ঘুমিয়ে নিই, কারণ রাত দু'টো, আড়াইটের থেকে শুরু হয়ে যাবে 'মকর সংক্রান্তি'র স্নান। আমাকে স্নান করতেই হবে। যতই শীত করুক, এই সুযোগ আমি কিছুতেই ছাড়ব না। মোবাইল ফোনে এ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
রাতের বেলায় আমার ঘরে কেউ আসে নি। এই সাংবাদিকেরা হয়ত কাজে ব্যস্ত। আমি বেরিয়ে পড়লাম। এত রাত হলেও সরকারের সুন্দর ব্যবস্থার জন্য রাস্তা আলোয় ঝলমল করছে। জনপ্লাবনে রাস্তা ভরে গেছে। পুলিশ ও অন্যান্য সব সরকারি বেসরকারি সাহায্যকারীরা নিষ্ঠা সহকারে যেমন অশীতিপরদের হাত ধরে ভরসা দিচ্ছেন সেরকমভাবেই আমাদেরকে এক একদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছেন, যাতে কোনো এক নির্দিষ্ট ঘাটে অহেতুক ভিড় না হয়। আমি তাদের দেখানো পথে গিয়ে পৌঁছলাম একটা ঘাটে। এবার নামতে হবে। প্রচন্ড ঠান্ডাকে ভুলে গিয়ে খালি গায়ে নেমে পড়লাম। চারদিকে 'হর হর মহাদেব'এর বাণীতে আকাশ বাতাস মুখরিত। নারী পুরুষ নির্বিশেষে হাঁটু জল, কোমর জলে এমনকি বুক জলে নেমে আরাধ্য দেবতার মন্ত্র পড়ছেন এবং ডুব দিচ্ছেন। একের পর এক ডুব দিয়ে নিজেদের পাপস্খলন করছেন। আমি খালি গায়ে হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আছি দেখে দু'জন এগিয়ে এসে হাত ধরে ডুব দিতে সাহায্য করলেন। একটা ডুবেই আমার মনে উৎফুল্লতা বেড়ে গেল। নিজেকে পবিত্র মনে হতে লাগল। আরও দু' তিনটে ডুব দিলাম। শীতও উধাও।
স্নানের পরে নদীর পাড়েই শ্রদ্ধালুদের বিতরণ করা পুরি তরকারি খেয়ে বসে থাকলাম। এখন আর পুলিশের তাড়া নেই। তারাও যেন শ্রদ্ধার সঙ্গে উপভোগ করছে ভারতীয় সংস্কৃতির শাশ্বত রূপ। এত লোকের স্নান উৎসব হচ্ছে নির্বিঘ্নে। কোনোরকম উচ্ছৃঙ্খলতা চোখে পড়ল না। সবাই যেন আত্মীয়! সবাই ভারতীয়! সবাই হিন্দু! সবারই মুখে 'হর হর মহাদেব'। সবাই করছে উত্তরায়ণের পুজো। স্বাগত জানাচ্ছে উষ্ণ উত্তরায়ণকে!
আমি মূল সঙ্গমঘাট থেকে প্রায় দু' কিলোমিটার দূরের ঘাটে স্নান করলাম। আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। স্নান পর্ব হয়েই চলেছে। সূর্যকে সাক্ষী রেখে 'জয় শিব শম্ভু' উচ্চারণে আজকের দিনটাতে আমি এক নতুন জীবনের স্বাদ অনুভব করলাম।
মহাকুম্ভে পবিত্র ছয় অমৃত স্নানের মধ্যে আমি ১৩ই জানুয়ারির পৌষ পূর্ণিমায় স্নান না করতে পারলেও দ্বিতীয় অমৃত স্নান, 'মকর সংক্রান্তি'তে ত্রিবেণী সঙ্গমে স্নান করে বিশেষ তৃপ্ত হলাম এবং পরের মহান 'শাহি স্নান' 'মৌনী অমাবস্যা'য় করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
ভোরের আলো ফুটতেই হাঁটতে শুরু করেছি। পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। চটি দুটো হাতে নিয়ে খালি পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছি। দোকানে লোকজন কেনাকাটা করলেও আমি চোখ রেখেছি শুধুই নদীর দিকে। একদিকে যেমন ঠান্ডার প্রকোপ অন্যদিকে রোদটা চোখের পক্ষে অস্বস্তিকর হওয়ায় একটা রোদচশমা কিনতে বাধ্য হলাম এবং ধর্মীয় স্টলগুলোতে গিয়ে ধর্মের বই নাড়াচাড়া করে অনেকটা সময় কাটালেও কোনো নাগাকে দেখতে পেলাম না।
পরপর বিভিন্ন আখড়ার তাঁবুর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। সব আখড়ার সাধু নাগা নয়। সেখানে অন্য সম্প্রদায়ের সাধুও আছেন। তাঁরা অন্যান্য মতাদর্শের হিন্দু সন্ন্যাসী। এক এক করে দেখতে পারলাম, নিরঞ্জনী, অটল, মহানির্বাণী, আহওয়ান ও জুনা আখড়ার তাঁবু।
জুনা আখড়ার বিবস্ত্র সাধুরা যেমন শিব ভক্ত, সেরকমই 'শ্রী পঞ্চমী নির্বোহী আখড়া'র সাধুরা করেন বিষ্ণুর আরাধনা, আবার আবাহন আখড়ার সাধুরা ভগবানের প্রতীকী হিসাবে হাতে একটা দন্ড নিয়ে ছড়ি যাত্রা করেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণ প্রণীত 'যত মত তত পথ' এর এক অদ্ভুত শিক্ষার সম্মুখীন হলাম।
এরই মধ্যে ঘটে গেল একটা অঘটন। ১৯ শে জানুয়ারির দুপুরবেলাতে আমি মেলা প্রাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে দেখছি। এত বড় মহাযজ্ঞ। নিঁখুত আয়োজন। প্রতিটি ছোট ছোট জিনিসের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রশাসন যেভাবে শ্রদ্ধালুদের প্রতি দায়িত্বসচেতনতার যে পরিচয় দিয়েছে তা এক কথায় অপূর্ব। হঠাৎ চারদিকে সোরগোল হওয়ায় কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলেছে, ভাগিয়ে, ভাগিয়ে, আগ লগ গয়া। আমি যারপরনাই ছুটতে ছুটতে গেস্ট হাউসে আসার পথে দেখছি আকাশ কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেছে। দাউ দাউ করা লেলিহান শিখা দেখে আমি আঁতকে উঠলাম। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীতে ছেয়ে গেল পুরো মেলা প্রাঙ্গন। মনটা বড় ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। যে মন্ডপগুলো দেখে ও প্রশাসনের আয়োজন দেখে এতক্ষণ খুশী ছিলাম, সেই মেলা প্রাঙ্গনে এমন ভয়ঙ্কর আগুন দেখে ব্যথিত হলেও মুহূর্তের মধ্যেই আগুন নিভিয়ে ফেলতে দেখে স্বস্তিও যেমন পেলাম সেইরকম অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এবং দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর প্রশংসাও করতে লাগলাম, কিন্তু একশ আশিটা স্টল পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেল।
রোজ রোজ, সকাল- বিকেল নদীতটে ঘুরে নিজেকে পবিত্র করে চললেও সব থেকে অবাক হলাম ২৫ শে জানুয়ারিতে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে। আমার জীবোদ্দশায় সৌরমন্ডলের অনেক অবিস্মরণীয় ঘটনার সাক্ষীর সাথে আজ যুক্ত হলো 'গ্রহদের মিছিল' এর এই অভাবনীয় ঘটনা। একসাথে ছ'টা গ্রহ পশ্চিম থেকে পূর্ব আকাশে একসারিতে অবস্থান করে এই মহাকুম্ভকে আরও মহিমান্বিত করেছে। আমি দেখছি দক্ষিণ পশ্চিম আকাশে শুক্র, শনি, দক্ষিণ পূর্ব আকাশে বৃহস্পতি, পূর্ব আকাশে মঙ্গলের জ্বলন্ত উপস্থিতি, আর দূর আকাশে বৃহস্পতির উপরে ক্ষীণ আলোয় ইউরেনাস এবং শুক্র, শনির উপরে নেপচুন।
কত কিছু দেখছি এই মেলাতে। সবকিছু দেখলেও আমি অপেক্ষা করছি ২৯ তারিখের 'মৌনী অমাবস্যা'র মাহেন্দ্রক্ষণে স্নান করতে।
এখন আর বেশী ঘোরাঘুরি করি না। ঘরে বসে সাধুদের জীবনপ্রণালী নিয়ে পড়াশোনা করি। মাঝেমধ্যে গিয়ে দেখে আসি অতি সাধারণ ভক্তদের, যাদের সেরকম পড়াশোনা নেই, যারা জানে না ধর্মের প্রবচন, যারা জানে না গ্রহদের মিছিল (planetary parade) এর কথা, কিন্তু দাঁতে দাঁত দিয়ে চেপে রেখে তীব্র ঠান্ডার মধ্যে খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন বসে আছেন ভক্তি নিয়ে। ঠাকুরের সান্নিধ্য পাওয়ার আশায়।
আজ 'মৌনী অমাবস্যা'। রাতের বেলায় আমি চলে গেলাম ঘাটে। সঙ্গম ঘাটে পৌঁছনোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ায় দূরের একটা ঘাটে অপেক্ষা করতে থাকলাম রাত্তিরের শুভক্ষণের জন্য।
মানুষেরা শুয়ে আছেন কম্বল মুড়ি দিয়ে। আমিও বসে আছি শুভক্ষণের জন্য। বারবার ঘড়ি দেখছি। হঠাৎ দেখতে পারছি লোকজন উন্মাদের মতন দৌড়চ্ছে। আমার ঘাট যেটা সঙ্গম থেকে অনেক দূরে সেখানেও লোকে নদীতে না নেমে উল্টোদিকে দৌড়চ্ছে। বুঝতে পারলাম বড়সড় কিছু একটা ঘটে গেছে। আমিও প্রাণপন দৌড়ে নদীর উল্টোদিকে অনেকটা রাস্তায় গিয়ে জানার চেষ্টা করছি কী হয়েছে। সাংবাদিক বন্ধুকে ফোন করছি। সে ফোন ধরছে না। এক একজন লোক এক একরকম কথা বলছে। এর মধ্যে দেখলাম ব্রহ্মমুহূর্তের সময় হয়ে গেছে। নদীর দিকে গুটিগুটি পায়ে গিয়ে দেখি, আমাদের ঘাটে লোকজন নেমে পড়েছে স্নান করতে। আমিও নেমে ডুব দিয়ে উঠে এসে মূল মেলা প্রাঙ্গনের দিকে এগোতেই দেখলাম, পুলিশের অসম্ভব তৎপরতা। একের পর এক এ্যাম্বুলেন্স হুটার বাজাতে বাজাতে চলে যাচ্ছে। গগনভেদী কান্নার আওয়াজে শান্ত পরিবেশে বিষাদের আওয়াজ। মানুষ খোঁড়াচ্ছে। মাটিতে বসে কাঁদছে। লোকে নড়তে চড়তে পারছে না। উদ্ধারকারীর দল স্ট্রেচার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। এক বৃদ্ধা হাপুস নয়নে কেঁদে কেঁদে ছেলের নাম ধরে পাগলের মতন ডাকছেন। এক বাবা নিথর ছেলেটাকে আগলে বসে সাহায্যের জন্য চীৎকার করলেও কেউ তার কাছে আসছেন না। পরপর নারী পুরুষের দেহ পড়ে আছে। ছোট একটা মেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখে তার বাবা মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। সে বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ করে ভিড় এসে এমন করে তাদের উপর পড়ল যে সে বাবা মায়ের থেকে আলাদা হয়ে গেল। কেউ মেয়েটার দিকে তাকাচ্ছে না। উদ্ধারকারীদের এখন প্রধান লক্ষ্য আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। আমাদের ধারেকাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। চারদিকে জামাকাপড়, ব্যাগ, জুতো, চটি, থালা, বাসন, ঘটি, থালা, গ্লাস, কম্বলের ছড়াছড়ি। যা বুঝতে পারলাম, ব্রহ্মমুহূর্তে স্নান করে পাপস্খলনের জন্যই হয়ত বড়সড় হুড়োহুড়ি হয়েছে, যার জন্য এইরকম একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু আসল ঘটনা এখনও জানতে পারি নি। কানে ভেসে আসছে এক এক রকম তত্ত্ব। এখন স্নানপর্ব পুরোপুরি বন্ধ। শুনলাম, এইসব ঘাটে স্নানপর্ব শুরুই হতে পারে নি। আমরা যেহেতু দূরের ঘাটে ছিলাম, সেইজন্য সেখানে স্নান করেছি। এখন হয়ত সেখানেও স্নান করা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কারণ, মাইকে সবাইকে নদীতে নামতে বারণ করা হচ্ছে।
এ্যামৃবুলেন্স আসছে আর যাচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের সবাই পাগলের মতন খুঁজে চলেছে। আমি পুরো হতভম্বিত। কী দেখতে এসেছিলাম, কী সব দেখছি। ছোট মেয়েটা যে কাঁদতে পারছিল না, কিছু বুঝতে পারছিল না, আশা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল তার বাবা মায়ের জন্য, সেও হারিয়ে গেল। আমি আর তাকে দেখতে পারছি না। ক্রমেই যেন কান্নার আওয়াজ বেড়ে চলেছে। প্রশাসনের লোকেরা একদিকে যেমন উদ্ধারকার্য চালাচ্ছে, অন্যদিকে স্নানপর্বের আয়োজনও করে চলেছেন।
আরও একটু এগিয়ে দেখি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! ভাঙা ব্যারিকেডের সামনে পড়ে আছে চাপ চাপ রক্ত। ছেঁড়া জামা কাপড়, পার্স, মোবাইল থেকে, লোটা, কম্বল ও শীতের পোশাক। পুলিশ এখনও জায়গা পরিষ্কার করতে পারে নি। ভাঙা ব্যারিকেডকে ঠিকঠাক করার জন্য লোকেরা কাজ শুরু করে দিয়েছে কারণ, ব্রহ্মযোগের মধ্যে স্নানপর্ব শুরু করতেই হবে।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কী হয়েছে। যে কোনো অমৃত স্নানের মুহূর্তে প্রথম স্নান করার অধিকার 'দিগম্বর' ও :শ্রী দিগম্বর' নাগা সন্ন্যাসীদের। এই দিব্যজ্ঞানী নাগাদের চাক্ষুস করার জন্য ভক্তদের উৎসাহের জন্য প্রশাসনও খুব সজাগ থাকেন। তারা এইসব সাধুদের পাহারা দিয়ে নদীঘাটে যেমন নিয়ে যান সেরকমভাবেই শোভাযাত্রা দেখার জন্য ভক্তদেরকে ব্যারিকেড দিয়ে সুযোগ করে দেন। দর্শক ভক্তরাও তাঁদের পূজিত সাধক দেবতাদের উদ্দেশ্যে সেই ব্যারিকেডের বাইরে থেকেই শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেন। এবার ভিড় এতটাই বেশী হয়ে গেছে যে পেছনের দিকে যেসব ভক্ত ছিলেন তারা তাদের পুণ্য সাধকদের দেখার জন্য উদগ্রীব হওয়ার জন্য যে চাপ সৃষ্টি হয় সেই চাপের ফলে ব্যারিকেড ভেঙে মানুষজন পড়ে যায় এবং পড়ে যাওয়া মানুষের উপর দিয়ে জনসমুদ্রের জোয়ার বয়ে যাওয়ার ফলে এই দূর্ঘটনা হয়েছে। স্নান পর্ব শুরু হওয়ার আগেই এই ভয়ানক দূর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার জন্য আখড়া সংগঠকেরা এই ব্রহ্মমুহূর্তের স্নানপর্ব বাতিল করে দিয়ে হিন্দু ধর্মের আর এক সহনশীলতার দিক উন্মোচন করলেন। হিন্দু ধর্মে কোনো গোঁড়ামির স্থান নেই। ত্যাগই ধর্মের মূল আদর্শ। মানুষের বিপদে দিব্যজ্ঞানী সাধুরা ব্রহ্মমুহূর্তে স্নানের পরিকল্পনা ত্যাগ করে হিন্দু ধর্মের বিশালতার যে শিক্ষা দিলেন সেই শিক্ষায় আমি দীক্ষিত হয়ে নিজেকে নতুন করে শিক্ষিত করলাম।