আর জি কর মেডিকেল কলেজে তরুণী ডাক্তারের মর্মান্তিক খুনে শোকাহত হয়ে যেভাবে বাংলার জুনিয়র ডাক্তারেরা খুনীর বিচারের জন্য প্রতিবাদমুখর হয়েছেন তা আবার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ঐতিহ্যশালী রুচিবান অথচ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বাঙালি সংস্কৃতির কথা। হ্যাঁ, পারে। বাঙালিরা পারে। প্রতিবাদী বাঙালিরা পারে সবার মন জয় করতে। এই সেই বাঙালি যারা অকথা কুকথার আশ্রয় না নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে নিজেদের দাবীর জন্য অটল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে দিনরাত খোলা আকাশের নীচে থেকে শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে। এই সেই বাঙালি যারা পড়াশোনার সাথে সাথে প্রতিবাদ করতে পারে। এই সেই বাঙালি যারা নিঃস্বার্থে কাজ করতে পরে। এরা কোন বাঙালি? এরা উঠতি ডাক্তার। এরা সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করে আরও উচ্চমানের ডাক্তার হওয়ার জন্য স্পেশালাইজেশন করছে। এদের বয়স কত হবে? কত আর হবে?সবেমাত্র যৌবনে পা রেখেছে। তারা প্রত্যেকেই কৃতী সন্তান। প্রত্যেকের মধ্যেই আছে রক্তের তেজ। প্রত্যেকেই দামাল। প্রত্যেকেই উচ্ছ্বাসে ভরপুর। কিন্তু প্রত্যেকে সংযত। এটাই বাংলা। এটাই রবীন্দ্রনাথের বাংলা। এটাই বিবেকানন্দের বাংলা। এই বাঙালিদের মধ্যে 'ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও'য়ের মানসিকতা নেই। এই বাঙালিদের মধ্যে 'ধোঁয়া বনধ চাকা বনধ'য়ের মতন ধ্বংসাত্মক খেলায় মত্ত হওয়ার মত প্রবণতা নেই। এই বাঙালিদের মধ্যে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করে বীরত্ব দেখাবার প্রয়াস নেই। এই বাঙালিদের মধ্যে ঢিল পাটকেল ছুঁড়ে ও বোমাবাজি করে পুলিশকে আহত করার উৎসাহ নেই। এদের মুখের ভাষা অত্যন্ত সংযত। পরিমার্জিত। এরা বলে না 'মেরে দাও কেটে দাও'। এরা কাউকে হুমকি দেয় না কিন্তু এরা প্রতিবাদ করে। এরা অকুতোভয়। এরা এক একজন সোনার টুকরো ছেলেমেয়ে হয়েও খোলা রাস্তায় বসে খাওয়া দাওয়া না করে পুলিশের লৌহ শৃঙ্খলের ভয়কে উপেক্ষা করে জাতীয় সঙ্গীত গায়। এরা সমস্ত বাধা বিপত্তিকে জয় করার মানসিকতা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের সাথে সম্মুখ সমরে নামতে পিছু পা হয় না। এরা পুলিশের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতেও ভয় পায় না। এটাই বাংলা। এটাই বাঙালির সভ্যতা। এটাই বাঙালি মানসিকতা।
গত ৮ ই আগস্টের রাতে একদল উন্মাদ, উন্মত্ত, লোভী, অসচ্চরিত্র মানুষের সংগঠিত অপরাধের শিকার হয়েছে এক তরুণী কর্মরত শিক্ষানবিশ ডাক্তার। এই প্রতিবাদীরা তাদের সহপাঠীনির বন্ধু, কারোর বোন, কারোর দিদি। খবর পাওয়ামাত্রই বাংলার সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের ছেলেমেয়েরা প্রতিবাদে সামিল হয়েছে। তাদের সঙ্গে একতা দেখিয়ে একসাথে যোগ দিয়েছে সমগ্র ভারতের ডাক্তার সমাজ। বিদেশ বিভুঁইয়েও প্রবাসী ভারতীয়রাও গর্জে উঠেছে একসাথে। রাজনীতির দলগুলোও এই সুযোগে পুলিশের সাথে খন্ডযুদ্ধে সামিল হয়ে দফায় দফায় বাংলায় অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করলেও এই ছোট ছোট অল্প বয়সী ডাক্তার ছেলেমেয়েরা কোনোরকম প্ররোচনায় নিজেদের না জড়িয়ে অদমনীয় ও অনমনীয় মনোভাবের পরিচয় দিয়ে হিংসাবর্জিত সুশৃঙ্খল আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে যেমন অগ্রসর হয়েছে সেরকমভাবেই সমাজের প্রতিটি শ্রেণীর মানুষকেও উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে তাদের প্রতিবাদে সামিল হতে। আবার জেগে উঠছে বাংলা। বাংলার ছেলেমেয়েরা রাজনীতির দলগুলোর উন্মত্ত বিশৃঙ্খল মারপিঠ দাঙ্গা হাঙ্গামার রাস্তা বাদ দিয়ে সুস্থ প্রতিবাদের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে দূর্বার আন্দোলন। এ আন্দোলন কোনো ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়। এ আন্দোলন হচ্ছে বাঙালির আত্মগরিমা রক্ষার লড়াই। এই আন্দোলন বাঙালির মানসিক দৃঢ়তার লড়াই। এ আন্দোলন পাহাড় ভাঙার আন্দোলন।
আর জি কর হাসপাতালে ডাক্তার মেয়েটা খুন হবার পরেই বাংলা জেগে উঠেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের প্রতিবাদের সাথে যোগ দিয়েছে আপামর জনসাধারণ। আজ আর তারা একা নেই । আজ সবাই আছে তাদের পাশে।
যে বাংলা দেখেছিল বীরাঙ্গনা মাতঙ্গিনী দেবীকে, যে বাংলা দেখেছিল দৃঢ় মানসিকতার রাণী রাসমনিকে, যে বাংলা দেখেছিল বাঙালির সুচিন্তক কুসুমকুমারী দাশকে, যে বাংলা দেখেছিল বিপ্লবী বীণা দাশের মতন যশশ্বীনিদের, সেই বাংলারই এক অচেনা মুখ, অজানা চরিত্রের অল্পবয়সী একটি মেয়ে রিমঝিমের Reclaim the Night এর আহ্বানে বাংলার আনাচে কানাচে, শহরে গ্রামে, ধর্মীয় সংস্কৃতির কোনোরকম বিভেদরেখা না মেনে এবং কোনো নেতা নেত্রীর আনুগত্য লাভের লোভের আশা না করে দলে দলে ছাত্রী যুবতীদের সাথে প্রৌঢ়ারা একত্রিত হয়েছে ১৪ আগস্টের রাত বারোটার সময় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। জড়ো হয়েছে খুনী ধর্ষকদের শাস্তির দাবীতে। এই মিছিলে ছিল না কোনো নেতার নির্দেশ। এখানে ছিল না কোনো দলীয় সদস্যের হুঙ্কার। এখানে কাউকেই মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য করা হয় নি। সবাই এসেছে নিজের উদ্যোগে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মেয়েদের সাথে ছেলেরাও এসেছে তাদের সঙ্গে একই সুরে সোচ্চার হতে।
রাত বেড়েছে। জনসমুদ্রের ফেনিল ধারায় রাস্তাপ্লাবিত হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে মেয়েরা ভোগ্যপণ্য নয়। মেয়েরা চার দেওয়ালের মধ্যে জীবনধারণের জন্য জন্মগ্রহণ করে নি। তাদেরও স্বাধীনতা আছে। তারাও রাত্তিরে কাজ করতে পারে। তাদের রাতে কাজ করতে দিতে হবে। পরিবেশ ঠিক করতে হবে।
আজকের মিছিলে একটাই ভাষা-- চাই দোষীদের সাজা। চাই নারী স্বাধীনতা।
নিঝুম রাতের বাতাসে শঙ্খধ্বনির নিনাদে দেখা যাচ্ছে হাজারে হাজারে তরুণী যুবতী মাতঙ্গিনী। প্রবীণাদের আশীর্বাদে তেজস্বীনি নবীনারা উদ্বুদ্ধ। আপ্লুত। বঙ্গনারীরা চলেছে বিশ্ববিজয়ে। অসুরী শক্তি দমনে। সঙ্গে আছে তাদের অগুনিত শুভানুধ্যায়ী। আমরা বাঙালি। আমরাও পারি।
একদিকে যখন বাংলা শান্ত মিছিলে দেখতে পারছে এক নবদিগন্তের সূচনা ঠিক সেই সময়েই ১৪ তারিখে রাত বারোটার কিছু পরে দূর্বৃত্তদের এক বিরাট সংখ্যা 'আর জি কর হাসপাতালে' অতর্কিত হামলায় তছনছ করে দিল হাসপাতালের দামী দামী যন্ত্রপাতি, ওষুধপত্র। কিন্তু তারা পারে নি হাসপাতালের কর্তব্যরত স্বাস্থ্যকর্মীদের, বিশেষত, নারীশক্তির প্রতিভূ সিস্টার বোনেদের ভয় দেখাতে। এই বাংলার নারীরা আবার দেখিয়ে দিল, আজও বাঙালী মেয়েরা পারে গুন্ডাদের সামনে বুক চিতিয়ে লড়াই করে মুমূর্ষু রোগী রোগীনিদের অভয় দিতে, তাদের রক্ষা করতে অথচ বাংলার সরকার নারী সুরক্ষার আড়ালে চাইছেন নারী পুরুষে বৈষম্য ও ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে। তাদের আদেশে নারীদের রাতে থাকতে হবে ঘরের মধ্যে। চাকরিস্থানে শুধু পুরুষেরাই কাজ করবে সূর্যাস্তের পরে। এ বড় অপমানের। এই অন্যায় আদেশ মানা যায় না। যখন সুনীতা উইলিয়ামসের মতন বিজ্ঞানী অন্তরীক্ষে নিজের জীবন মরণের সাথে লড়াই করছেন, যখন ভারতীয় নারীরা সেনাবাহিনীতে দক্ষতার সঙ্গে কার্য নির্বাহ করছেন, তখন বাঙালি নারীরা উপদেশ পাচ্ছে পর্দানসীন হতে। এ হতে পারে না। ছেলেমেয়েরা মেনে নিল না। মানলা না বাংলার জনসাধারণ।
রাজনীতিকেরা বড় চঞ্চল হয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে কিছুতেই আন্দোলনের রাশ যাচ্ছে না। তবুও তারা বড় সচেষ্ট। ছোটোখাটো বনধ ডাকছেন। বনধ প্রত্যাখিত হচ্ছে। মিছিল করছে। জনগণ উদ্বুদ্ধ হচ্ছে না। অথচ জনগণ রাস্তায় বসে প্রতিবাদের ছবি আঁকছে। রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা
বসে আছে বি টি রোডের উপর। চক দিয়ে পিচের রাস্তায় প্রকাশ করছে অন্তরের রাগ ও ক্ষোভ। অভূতপূর্ব শিল্পকলা। অভূতপূর্ব প্রতিবাদের ভাষা। যেখানে নেই কোনো অশ্লীলতা। যেখানে নেই কোনো ঢিল ছোড়াছুড়ি। বাংলা দেখছে নবজীবনের প্রারম্ভিক রশ্মি।
Reclaim the Night এর সফলতা দেখে বাংলার ছাত্রসমাজ অরাজনৈতিকভাবে 'নবান্নের' দিকে যে অভিযান করল সেই অভিযানে দেখা গেল কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্বের উপস্থিতি এবং অভিযান পরিণত হলো এক খন্ডযুদ্ধে। ছাত্র পুলিশের যুদ্ধে দু'পক্ষেরই বেশ কিছু লোকজন আহত হল। এ সেই চেনা ছবি যা গত পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে দেখে দেখে বাংলা হয়েছে ক্লান্ত। এই হিংসাত্মক আন্দোলনে বাংলা হয়েছে সর্বশান্ত। এখন বাংলা চায় মুক্তি। বাংলা চায় নবদিগন্তের সূচনা। ঠিক এই সময়েই এগিয়ে এল মেডিকেল ছাত্রছাত্রীদের লালবাজার অভিযান।
সেপ্টেম্বরের দু তারিখ। ছেলেমেয়েরা তাদের বোনটির বিচারের জন্য কয়েকদফা অভিযোগ ও দাবীতে চেয়েছিল দলবদ্ধভাবে লালবাজারের মূল ভবনের কাছাকাছি গিয়ে সেখান থেকে তাদের বাইশ জনের প্রতিনিধি দল ভেতরে গিয়ে পুলিশ আধিকারিকের হাতে 'দাবী সনদ' উপস্থাপন করতে কিন্তু পুলিশ তাদের অনুরোধ প্রত্যাখান করে। পুলিশ এক অভেদ্য 'চিনের প্রাচীর' সম লোহার দেওয়াল দিয়ে ডাক্তারদের গতিরোধ করল। ডাক্তাররা হতাশ হল না। তারা অনুরোধ উপরোধ করল প্রাচীর সরিয়ে তাদের অভিয়ানের গতিমুখ অক্ষুন্ন রাখতে। পুলিশ রাজী হল না। পুলিশ মিছিলকে আটকিয়ে প্রতিনিধিদলকে আহ্বান জানাল আলোচনার জন্য। ডাক্তারেরা রাজী নয়। শুরু হল অবস্থান। ছেলেমেয়েরা বিনা উত্তেজিত হয়ে পাচিলের এপারে রাস্তার উপরে বসে পুলিশকে বারবার অনুরোধ করল তাদের যাওয়ার জন্য। পুলিশও তাদের সিদ্ধান্তে অটল। শুরু হলো ধৈর্যের পরীক্ষা।
সূর্য মাথার ওপর থেকে সরে গেলেও দুপক্ষের অনমনীয় মনোভাব। ছাত্ররা সংযত। তারা দেশাত্মবোধক গান গাইছে এবং তাদের সংগ্রামী মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছে। রাত হয়ে গেলেও ছাত্ররা বিচলিত না হয়ে আরও উৎসাহে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়াল কিন্তু ব্যারিকেড ভাঙা বা টপকানোর কোনো চেষ্টাই করল না। পাচিলের ওপারে শয়ে শয়ে পুলিশ। অনেকে বর্ম পরিহিত। এ এক অদ্ভুত ছবি। নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের সামনে শাসকের রণংদেহী রূপ।
রাতের আকাশে হিম পড়ছে। মানুষের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মে সাহায্য করছে পার্শবর্তী মানুষের মানবিকতা। খুলে দিয়েছে ঘরের দরজা। প্রতিবাদীরা আপনজন। সবাই এখন এক। সবাই একই পরিবারের। সাধারণ মানুষ আর ঘরে থাকতে না পেরে তারাও এসে যোগদান করছে এই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে। কেউ নিয়ে এসেছে অল্পকিছু খাবার, কেউ আবার এসেছে তাদের নিজেদের ব্যান্ড গানের দলকে নিয়ে। তারা গাইছে মনভরানো দেশাত্মবোধক গান। গভীর রাত আরও গভীর হল। গানে গানে ভরে গেল লালবাজারের রাস্তাঘাট। কিছু দোকানদার তাদের দোকান খোলা রেখে দোকানে যা সামান্য কেক, বিস্কুট ও জলের বোতল আছে সেগুলো বিনা পয়সায় দিয়ে দিল এইসব ভাইবোনেদের। পাচিলের উল্টোদিকে পুলিশ বসে আছে চেয়ারে।কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই। শুধু আছে প্রতিবাদী চেহারা। ভোর চারটে। চোখধাঁধানো দৃশ্য। ছাত্র ছাত্রীরা গাইছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। পুলিশ দাঁড়িয়ে পড়েছে। শোষক শাসক এবং শোষিত ডাক্তারের সঙ্গে বহু সহনাগরিক একসাথে দাঁড়িয়ে গাইছে জাতীয় সঙ্গীত। লালবাজারের নিবাসী থেকে উপস্থিত প্রত্যেক নাগরিক দেখল আন্দোলনের এক অপূর্ব চেহারা। ভোর হয়ে গেল। তবুও পুলিশ অনড়। ছাত্ররাও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সকালে এসেছে স্কুলের ছোট ছোট মেয়েরা। তাদের দাদা দিদিদের দিচ্ছে জলের বোতল। দিদিরাও সানন্দে গ্রহন করছে বোনেদের ভালবাসা। আশেপাশের বাড়ি থেকে আসছে চা বিস্কুট ও কিছু খাবার। দেখতে দেখতে অফিস খোলার সময় হয়ে গেছে। আজকে হয়ত অফিসের লোকেরা আগেই চলে এসেছে। না হলে কী করে এত তাড়াতাড়ি খাবার জোগাড় করে তারা শ্রান্ত, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত ভাই বোনেদের হাতে তুলে দিচ্ছে? প্রতিবাদীরাও ডাক্তার হওয়ার বিন্দুমাত্র অহমিকা না করে হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে তাদের শুভানুধ্যায়ীদের অকুন্ঠ ভালবাসা। এটাই বাংলা। নবজাগরণের নব সূচনা।
এরা ডাক্তার। এরা জানে শরীর বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি কথা। সেইজন্য ভোরবেলা নিজেরা যখন চা বিস্কুট খাচ্ছে তখন তারা পুলিশদের দিকেও বাড়িয়ে দিল খাবারের বাটি। যদিও পুলিশদের বাইরের খাবারের উপরে নিষেধাজ্ঞা আছে তবুও কেউ নিল কেউ নিল না। বাংলা দেখল আর এক মনোময় দৃশ্য।
পুলিশকর্তারা এখনও অদমনীয়। বেলা অনেকটাই হয়ে গেছে। ব্যারিকেড খোলে নি। বারবার আলোচনাতেও জট খোলে নি। প্রতিবাদীদের একটাই দাবী। তাদের দলবদ্ধভাবে যেতে দিতে হবে মূল ভবনের কাছাকাছি।
অবশেষে পুলিশের ব্যারিকেড খুলল। খুলে যেতেই মিছিল এগিয়ে চলেছে। আনন্দ হলেও নেই কোনো অহঙ্কারী শ্লোগান। নেই বিজয় উল্লাস। তারা শান্তচিত্তে এগিয়ে চলেছে তাদের গন্তব্যপথে।
পুলিশকর্তাদের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হলেও ডাক্তারেরা তাদের দাবী সনদ জমা দিয়ে ফিরে গেলেন কিন্তু ফিরে যাওয়ার আগে দেখিয়ে দিলেন সমগ্র কলকাতাবাসী তথা বাংলার সমাজকে নিজেদের দায়িত্ববোধের কথা। গত কয়েক ঘন্টা আন্দোলনের ফলে এই জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল জলের বোতল, কেক মোড়ানো পাতলা সেলোফেনের কাগজ, খাবারের উচ্ছিষ্ট কিছু টুকরো, এবং অনেক ছোটখাটো জিনিস। এ ছাড়াও এতগুলো ছেলেমেয়ের পায়ে পায়ে আসা ধুলোবালি, পাথরের টুকরো। যাওয়ার আগে সেইসব ডাক্তারেরা নারকেল ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা ঝাট দিতে শুরু করল। রাস্তার এমাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে ছেলেমেয়েদের হাতে ঝাড়ু এবং তারা অতি মনোযোগ সহকারে রাস্তা পরিষ্কার করছে। জলের বোতল, কাগজের টুকরোগুলো তুলছে ছোট ছোট বস্তায় যেভাবে কাগজ কুড়ানির দল নোংরা তোলে। এ এক অপরূপ দৃশ্য। মুখে তাদের ক্লান্তির ছাপ থাকলেও তারা কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত। কোনো কাজকেই ছোট ভাবে না। তারা উচ্চশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও ঝাঁটা ধরতে একটুও কুন্ঠাবোধ করে নি। সমস্ত জায়গা পরিষ্কার করে পরিবেশ সচেতনতার এক আদর্শ নিদর্শন রেখে গেল যা কিনা আমাদের স্বীকৃত রাজনীতির দলের শেখা উচিত। এই ছেলেমেয়েরা রেখে গেল আন্দোলনের এক নতুন চেহারা।