Image by Gemini AI

বৃষ্টির আর শেষ নেই! পড়ছে তো পড়ছেই! রোজই ভাবি বেরোবো কিন্তু কিছুতেই বেরোতে পারছি না! কাল যতই বৃষ্টি পড়ুক আমি আর ঘরে থাকব না। ঠিক যখন করেছি তখন কোনো বৃষ্টিই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না। সকাল হতেই বেরিয়ে পড়ব।

সারারাত ধরে বৃষ্টি হলো। ভোরের দিকে একটু বৃষ্টি কমতেই বেরিয়ে পড়লাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। এই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে বেরোতে না বেরোতেই এক পশলা মুষলধারা আমাকে ভিজিয়ে দিল। আমি আর রাস্তা থেকে ফিরে আসিনি। বৃষ্টির মধ্যেই এগিয়ে চলেছি। কিন্তু এত জোরে বৃষ্টি হচ্ছে যে আমাকে দোকানের ছাউনিতে দাঁড়াতেই হলো।

পনেরো কুড়ি মিনিট পরেও অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। আমি পুরো ভিজে গেছি। ঝোড়ো হাওয়ার দাপটে জামা প্যান্ট সব ভিজে গেল। আমার ছাতাটাও বারবার উল্টে যাওয়ায় মাথাও ঠিকমতো বাঁচাতে পারলাম না। সকালবেলাতেই ভিজে যাওয়ায় এই ভাদ্রমাসেও কাঁপতে শুরু করেছি, কিন্তু ঠিক যখন করেছি তখন আজকে যাবই যাব।

বৃষ্টি কমলেও একদম থামেনি। এই বৃষ্টিতেই অটো করে হাওড়ায় পৌঁছলাম। সেখান থেকে রওনা দিলাম কুমোরটুলির উদ্দেশ্যে।

কিছুক্ষণের মধ্যে বাস থেকে নেমে পড়ে সামনের এক গলিতে ঢুকতেই চোখ ভরে গেল অপূর্ব সব মূর্তি দেখে! অনিন্দ্যসুন্দর! নিখুঁত কাজ! শিল্পীরা মগ্ন হয়ে নিজেদের কাজ করে চলেছেন! কী একাগ্রতা! কোনোদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই! বৃষ্টির দাপটেও তাদের মধ্যে কোনো বিরক্তি নেই! পরিবারের ছোট বড় সবাই একমনে নিজের নিজের কাজ করে চলেছেন! মুখে কথা নেই! এই সকালে নিজেদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না, কিন্তু প্রত্যেকেই পবিত্র মনে কাজ করে চলেছেন! আমি মুগ্ধ হয়ে শুধু তৈরি হওয়া মূর্তিই দেখছি না, দেখছি তাদের কাজ করার দক্ষতা। প্রত্যেকেই যেন এক একজন নিখুঁত শিল্পী! দক্ষ কুশীলব!

চারদিকে কতরকমের জিনিস! বাঁশের কঞ্চি, নারকেলের দড়ি, সুতলি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের পেরেক, রঙ, নানারকম জামা কাপড় ও আরও কত কী! এত ছোট জায়গায়, রাস্তার সরু গলিতে, যেখান দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে, সেখানেও যে এত ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে কাজ করা যায় সেটা সত্যিই খুব আশ্চর্যের এবং অবাক করার মতো ঘটনা! প্রায় তৈরি হয়ে যাওয়া মূর্তিগুলো যেমন সুন্দরভাবে ঘরে বাইরে সাজানো আছে, সেরকমভাবেই দেখছি মাটির পাহাড়, হাতুড়ি, ছেনি, কাঁচি থেকে ছোট বড় যন্ত্রপাতি এবং হ্যান্ড ড্রিল থেকে স্ট্যান্ড ফ্যান, টেবিল ফ্যান চালানোর জন্য সুইচ বোর্ড ও প্লাগের অত্যন্ত পরিপাটি ব্যবস্থা। রাস্তার পাশেই তাদের ঘর। সেই ঘরও মূর্তিতে ভরা। সেখানে বসেও শিল্পীরা কাজ করছেন। ঘরে একদম জায়গা নেই। সমস্ত ঘর জুড়ে আছে প্রতিমা তৈরির সরঞ্জাম। ঘরভর্তি হয়ে আছে পুজোর জিনিসপত্রে। বাড়ির গৃহিণীকে দেখছি মূর্তি তৈরির ফাঁকে মাঝে মাঝে উঠে যাচ্ছেন। হয়তো গৃহস্থলীর কাজ করছেন। ছোট ছেলেমেয়েদেরকে দেখছি কেউ মাটির দলা নিয়ে ইঁদুর বানাচ্ছে আবার কেউ ছোট পেঁচার চোখ মুখ ঠিক করছে। সবারই লক্ষ্য নিখুঁত কাজ করা। তাদের দাদা-দিদিরা, যাদের বয়স পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে, তারা ছোটদের ভুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছে। কয়েকজন ছোটকে দেখলাম খড় বেঁধে মূর্তি তৈরির প্রাথমিক কাজগুলো করছে। খড়ের পরিমাণ ও বাঁধনগুলো ঠিকমতো না হলে বড়দের কেউ না কেউ এসে সাহায্য করছে। কোনো বকাবকি নেই! কোনো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার মানসিকতাও নেই। সবাই নিজের কাজ চুপচাপ করে চলেছে। সৃষ্টির প্রতি একনিষ্ঠ একাগ্রতায় আমি একেবারে আপ্লুত হয়ে গেলাম।

এতক্ষণ বৃষ্টির ঝামেলা ছিল না। এখন বৃষ্টি হতেই দেখলাম প্রত্যেকে নিজের নিজের জায়গায় যেসব প্লাস্টিক, কাপড় ইত্যাদি রাখা ছিল, সেগুলো ঠিকঠাক করে টেনে দিল এবং তারপরেও যেখানে জলের ছিটে আসছিল সেসব জায়গা থেকে মূর্তি এবং মূর্তি তৈরির প্রকরণ সব সরিয়ে নিল। ঘরের মধ্যে দেখলাম অস্থায়ীভাবে বাঁশ ও কাঠের পাটাতন দিয়ে তাক করা হয়েছে। সেই তাকে কয়েকটা গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীকে তুলে রাখা আছে। মূর্তিগুলো এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, পরে নামিয়ে কাজ করা হবে। কোনো মূর্তির গায়ে কোনো নম্বর বা চিহ্ন দেওয়া না থাকলেও তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম যে তারা সবাই বুঝতে পারছেন কোন দুর্গা ঠাকুরের জন্য কোন কার্তিক বা গণেশকে তৈরি করা হয়েছে। সবাই চুপচাপ! কারোর মুখ থেকে একটা আওয়াজও শুনতে পারলাম না। বৃষ্টির জন্য 'হা হুতাশ' করতেও শুনলাম না! আমারই শুধু মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, 'আবার বৃষ্টি?' প্রত্যেকে আবার নিজের নিজের কাজে মন দিল! শুধু তাই নয়! আমার দিকেও তারা খেয়াল রেখেছে। এই দলে যিনি সব থেকে বয়সে বড়, তিনি আমাকে একটা টুল পর্যন্ত দিলেন বসার জন্য। চা খাব কিনা জিজ্ঞেস করলেন। আমি সত্যিই অবাক হলাম! অভিভূত হলাম! এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার মতো এক আগন্তুক, যে প্রতিমা কিনবে না, তাকেও তারা আতিথেয়তা করছেন। মনটা ভরে গেল! আজও বাঙালি ভদ্র! আজও রুচিশীল! আজও অতিথিপরায়ণ!

এবার আমি নিজে থেকেই টুকটাক কথা বলার উদ্যোগ নিতেই এই দলের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি, যার বয়স আমার থেকে অনেক কম, হয়তো পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হবে, কথা বলতে শুরু করলেন। জানলাম, তারা এখানে বংশ পরম্পরায় মৃৎশিল্পের কাজ করে যাচ্ছেন। এই কুমোরটুলিতেই তাদের পিতৃপুরুষেরা যেভাবে কাজ করতেন, আজও তারা সেই সততা ও নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করেন। তিনি কাজ শিখেছেন তার বাবা, জ্যাঠা, কাকা, দাদুর কাছ থেকে আর এখন তিনি শেখাচ্ছেন তার পরবর্তী প্রজন্মকে। তাদের এখানে বড় বড় কলেজের ডিগ্রিধারী কোনো শিল্পী নেই। অধিকাংশ মৃৎশিল্পীর প্রথাগত ট্রেনিং না থাকলেও তারা তাদের পারিবারিক পরম্পরায় শিক্ষিত হয়ে কুমোরটুলির সুনাম বজায় রেখেছেন, যদিও তিনি এর মধ্যে আক্ষেপ করে বললেন যে আজকের বহির্জগতের রঙিন জীবনের হাতছানিতে তাদের অনেক ছেলেমেয়েই পারিবারিক পরম্পরায় বিমুখ হয়ে শিল্পীসত্তাকে বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না, আবার তাদেরই কিছু বাচ্চারা আনন্দের সঙ্গে নিজেদের প্রথাগত শিল্পের সঙ্গে আধুনিকতার মিলন ঘটিয়ে এক নতুন শিল্প সৃষ্টির দিকেও সচেষ্ট হয়েছে। শুনে ভাল লাগল! ছোট শিল্পীদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা সময় ভাবুক হয়ে গেলাম। আজ যে বাঙালি, একটু লেখাপড়া শিখে, নিজেদের ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য নানান অজুহাতের বশবর্তী হয়, সেখানে এইসব ছেলেমেয়েরা সস্তার জামাকাপড় পরে, গেঞ্জি গায়ে, খালি গায়ে, কাদামাটি ঘেঁটে, মাটিতে বসে, গলির রাস্তায় উপুড় হয়ে মোটা মোটা বাঁশ কেটে বাংলার ঐতিহ্য, কলকাতার সুনাম ও কুমোরটুলির মান মর্যাদার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে যেভাবে একনিষ্ঠ হয়ে কাজ করে চলেছে তাতে আমার আবার নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে গর্ব হলো। বাঙালি হারায়নি। বাঙালি আজও জগতশ্রেষ্ঠ। আজও মৃৎশিল্পে, প্রতিমা নির্মাণে কুমোরটুলি অগ্রগণ্য।

তিনি আরও বললেন, তবে আজকাল প্রতিমা তৈরি করতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সস্তায় ভালো মূর্তি তৈরি করতে চাইলেও পারেন না, কারণ, ভাল মাটি পাওয়া যায় না। পাওয়া গেলেও দাম এত বেশি যে সেই মাটি দিয়ে মূর্তি করলে তার দাম খুব বেড়ে যায়। সেইজন্য তারা সবসময় নতুন নতুন পদ্ধতিতে মূর্তি তৈরি করেন। এই কুমোরটুলির প্রত্যেক শিল্পীই নতুনত্বের সন্ধান করে চলেছেন। আধুনিক প্রযুক্তিরও সাহায্য নিচ্ছেন। যেমন আগে বাবা, ঠাকুর্দারা যেভাবে নরম মাটিকে কাঠ, কয়লার গরম হাওয়া দিয়ে শুকোতেন, আজকাল তারা সেভাবে করেন না। নানারকম ড্রায়ারের সাহায্যে মাটি শুকিয়ে নেন। সেইজন্য রোদের দেখা না গেলেও রঙ করতে অসুবিধা হয় না, তাছাড়া উন্নত মানের রঙ, তার্পিন পাওয়ার জন্য রঙ করাটাও তুলনামূলকভাবে সহজ হয়ে গেছে। তিনি আমার সাথে কথা বললেও কিন্তু কাজ করে চলেছেন, বরং আমারই অস্বস্তি হচ্ছে, ভাবছি, যদি তার কাজের কিছু গণ্ডগোল হয়। আমি কয়েকবার তাকে বললামও যে কথা বলার জন্য যেন তার কাজের ক্ষতি না হয়। তিনি বললেন, আমাদের অসুবিধা হয় না। আমি দেখলাম, আমার সাথে কথা বলতে বলতেই তিনি মা দুর্গার তিনটে চোখই এঁকে ফেললেন।

এবার আমি আলোচনার অভিমুখটা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের তো শুধু দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত থাকলেই হবে না, আগে পরে তো অনেক পুজো আছে, সেই প্রতিমাও তো করতে হবে? তিনি বললেন, দেখুন না, ঐ যে কালী ঠাকুর হচ্ছে! আমরা সব পুজোর ঠাকুরই ঠিক সময়মতো বানাই। কোনো ক্রেতাকে ফিরিয়ে দিই না। তিনি বললেন, শুধু আমিই নই, আমাদের এখানে প্রত্যেক ঘরেই শিল্পীরা দিনরাত কাজ করে ঠিক সময়ে প্রতিমা তৈরি করে ক্রেতাদের দেন।

এরই মধ্যে দেখলাম কয়েকটা লোক শোলা ও রঙিন কাপড়চোপড় নিয়ে আসায় ঐ ভদ্রলোক একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হিসেব নিকেশ বুঝে নিচ্ছেন। আমি দূর থেকেই বুঝতে পারলাম যে ডাকের সাজের জন্যই ঐ শোলাগুলো এসেছে। সামনে যে মূর্তিটা আছে সেইদিকে তাকিয়েই যখন কথা হচ্ছে তখন আমি নিশ্চিত হয়েই জিজ্ঞেস করলাম যে এইগুলো কী এই ঠাকুরটার জন্য এনেছেন? ভদ্রলোক হেসে বললেন, হ্যাঁ। প্রথমে এই ঠাকুরটার কাজ শেষ করার পরেই অন্য ঠাকুরগুলোতে হাত দেব।

তাদের কথার মধ্যে আমি বুঝতে পারলাম যে তারা এই কাজ করা শোলাগুলো নিয়ে এসেছে হাওড়ার জগদীশপুর থেকে। এছাড়াও হাওড়া জেলার শিয়াখালা এবং অন্যান্য জায়গা থেকে দেবদেবীর অস্ত্র, পাটের চুল ও শোলা এবং কাগজ দিয়ে বানানো কদম ফুলের মালা, চাঁদমালা ইত্যাদি আসে বলে তিনি আমাকে জানালেন। বললেন, শুধু হাওড়া থেকেই নয়, চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, হুগলির থেকেও ঠাকুরদের শাড়ি, ধুতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম আনা হয়। বছর বছর এইসব জায়গা থেকেই কাপড়চোপড় কিনে ঠাকুরের কাজ করা হয়।

এখন গলিতে প্রচুর লোকের সমাগম হয়েছে। কাছাকাছি বড় ছোট সবরকম পুজোর কিছু কর্মকর্তা এসেছেন তাদের বায়না করা ঠাকুরের কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য। আমাকে ডিঙিয়ে বহু লোক পরের শিল্পীদের কাছে গিয়ে কথা বলছেন, এছাড়াও বিভিন্ন অর্ডারের জিনিস নিয়ে একের পর এক লোক আসায় গলিতে ভিড় হয়ে গেলেও কিন্তু শিল্পীরা নিজেদের কাজে একেবারে অটুট আছেন। এবার আমি এগিয়ে গেলাম অন্য শিল্পীদের কাজ দেখার জন্য। সব জায়গার চেহারাই একরকম। রাস্তার উপর প্লাস্টিক বেঁধে যেমন কাজ করছেন সেরকমই প্রত্যেকের ঘর এক শিল্প মন্দির! ছোটরা বড়রা মুখ বুজে কাজ করে চলেছে। ক্রেতাদের সাথে কেবল একজনই বয়োজ্যেষ্ঠ লোক কথা বলছেন এবং অর্ডারের জিনিসগুলো বুঝে নিয়ে গুছিয়ে রাখছেন।

ঘণ্টা চারেক এই শিল্পীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে এক সম্পূর্ণ অচেনা কলকাতাকে দেখে, অচেনা মানুষদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, বুঝতে পারলাম, সৃষ্টিশীল বাঙালি হারায়নি, হারিয়ে যেতে পারে না, হারিয়ে যেতে চায় না।

.    .    .

Discus