Image by Med Ahabchane from Pixabay
জগতে আয়না আবিস্কারের পরই মানুষ আসলের একটা প্রতিচ্ছবি পায়। এই আসলের প্রতিচ্ছবিই বোধয় মানুষকে নকল তৈরিতে উদবুদ্ধ করে। তবে আসল নকলের জটিল ধাঁধায় আমরা প্রায় সকলেই দিশেহারা। কোনটি আসল আর কোনটি নকল এ যেন লখনৌর ভূল্ভূলাইয়ার গোলক ধাঁধা। এই আসল খোঁজার চক্করে রাজা সলোমনের বুদ্ধিমত্তার তারিফ যে বিশ্বের তাবড় পণ্ডিতেরা করে ছিলেন তা বলাই বাহুল্য। তিনি আসল নকল ফুলের যাচাই করতে গিয়ে জানালা খুলে দেন। ওপারের মৌমাছির দল দলে দলে খোলা জানালার ভেতর দিয়ে এসে আসল ফুলের ওপর মধু খেতে বসে।এই ঘটনা প্রাকৃতিক যাচাই পদ্ধাতি হলেও মানব বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠ উধাহরন। ইংরেজীতে যাকে বলে self automated অর্থাৎ যেখানে মানুষের কোন হাত নেই, যেমন বীজ থেকে চারা গজানো।পৃথিবীর আবর্তনের ফলে ৠতুর পরিবর্তন অথবা পৃথিবীর অক্ষ রেখার উত্তর ত্ত দক্ষিণে হেলে পরা । আজকাল নকল ফুলের প্রাকৃতিক যাচাই করতে গেলে জানালা খুলে রাখলেও মৌমাছি ঢুকবে না।মৌমাছির বদলে যা ঢুকবে তার জন্য মচ্ছর ধূপ অনেকক্ষণ জ্বালানোর প্রয়োজন হোয়ে পরতে পারে। তবে খানিক মিষ্টত্ত যাচাই করা বোধয় শহরের বুকে বহুতলেও খুব কঠিন হবে বলে মনে হয়না।খানিক চিনি ছড়িয়ে রাখলে তা কিছুক্ষণের মধ্যেই লাল কিংবা কালোতে পরিণত হবে এ কথা সবারই জানা।ভাববার অবকাশ থাকলে ভাবুনতো জাদু আসল না জেনেও মানুষ কেমন আসল খোঁজে?
একটি মানুষকে একটি বাক্সের ভেতর পুড়ে তার সর্বাঙ্গে বর্শা ফুটিয়ে দেওয়া হল তারপরও মানুষটা হাঁসতে হাঁসতে বাক্স থেকে বেরিয়ে এলো। এই জাদুর পেছনে যে একটা কৌশল আছে তা জেনেও মানুষ বোকা সাজতে জাদু দেখতে ভিড় করে! দোকানের গায়ে লেখা থাকে ‘অমুক দত্ত’ কিংবা ‘অমুক কাঞ্জিলাল’ ব্রাকেটে আসল। তারমানে বাজারে নকলের প্রবেশ ঘটেছে। সেই নকল যে আসলের খুবি কাছাকাছি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। যদি বস্তুর স্বরূপ আর কার্যকারিতা একই হয় তবে আসলের প্রয়োজন কি? নকল আর আসলের পারির পাল্লায় আসল যে ভারি এটা মনে হয় বোঝার দোরকরই পরে না। তবে বিক্রেতাদের একটা সামাজিক দায়িত্ব থা্কে ত, সেই দায়ে তারা বিজ্ঞাপনে বলে দেন ‘নকল হইতে সাবধান’। এখন এই বিজ্ঞাপন দেখে ক্রেতারা আরও গোলক ধাঁধায় প্রবেশ করেন।যেমন জয়নগরের মোয়া। মোয়া কেবল জয়নগরের হলেই আসল নয়। কনকচূড় ধানের খই এর সাথে নলেনগুড় মিশিয়ে যে মোয়া হয় সেই মোয়াই জয়নগরের মোয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই কনকচূড় ধান দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর অঞ্ছলেই হয়। কাজেই জয়নগরের মোয়া হলেই হবেনা, আসল জয়নগরের মোয়া হতে গেলে কনকচূড় ধানের হতে হবে। ইলিশ যেমন পদ্মার ইলিশ। লোকে বলে পদ্মার ইলিশই আসল ইলিশ। এখানে আসল বোঝাতে ইলিশের বিশেষ স্বতন্ত্রতা বোঝায়। ইলিশ সমুদ্রের নোনা জলের মাছ হলেও নদীর মিষ্টি জলে যখন তারা প্রবেশ করে তখন তাদের মেদ বৃদ্ধি হয় তাতে ইলিশের স্বাদ বারে। সেই ইলিশ তখন আসল ইলিশ হয়ে ওঠে। ইংরেজিতে real estate মানে real property। এই রিয়েল এস্টেট বোলতে ভূসম্পত্তির কথাই বোঝায়। এর থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় ভূসম্পত্তি বাদে বাকি সম্পত্তি সত্য কিংবা আসল নয়।কথিত আছে সোনা আধা, মাটি পুরো খাঁটি অর্থাৎ আসল। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের একটা গল্প থেকে আসল নকলের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
মোল্লা সাহেব এক গোসোলাগারে গোসলে গেছিলেন। সেই গোসলাগারে এক ব্যাক্তি তার শরীরে তেল মর্দনের প্রস্তাব দেন। মোল্লা সাহেব তাতে রাজি হন, লোকটি দুচার মিনিট মর্দনের পর তার কাছে পারিশ্রমিক চান। মোল্লা পকেট থেকে একটি স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে গোসলে চলে জান। লোকটি হতবাক।মাত্র কয়েক মিনিটের মর্দনের পারিশ্রমিক স্বর্ণ মুদ্রা! পরের দিন মোল্লা সাহেব আবার আসেন গোসল করতে। এইবার লোকটি এক ঘণ্টার ওপরে মর্দন করেন। পারিশ্রমিক চাইলে মোল্লা পকেট থেকে একটি তাম্র মুদ্রা বের করে দেন। লোকটি ত অবাক। এক ঘণ্টার মর্দনের জন্য তাম্র মুদ্রা আর মাত্র কয়েক মিনিট মর্দনের জন্য স্বর্ণমুদ্রা! তখন মোল্লা লোকটিকে বলেন এটি আগের দিনের পারিশ্রমিক। আর আজকের টা? সেটা তো আগের দিনই দেওয়া হোয়ে গেছে। এই বোলে মোল্লা গোসলে চলে যান।
আজকাল নকলের নাম পালটে গেছে, যদিও সেটা ইংরেজিতে। fake শব্দের অর্থ যেমন মিথ্যে তেমনই fake, false এর জায়গা দখল করে নিয়েছে। cultured pearl যেমন আসল মুক্ত নয় তবে মুক্ত। যুক্তির বিচারে এই কথা সত্যি যে আসলকে ঘিরেই নকল এর সৃষ্টি। সোজা কথায় আসল না থাকলে নকলের কোন অস্তিত্বই থাকেনা।ঈশ্বর না থাকলে কি শয়তানের প্রয়োজন পড়ত? আসল প্রকৃতিরই দান। প্রকৃতিই মানুষের চোখে রঙ ধরিয়েছে। মানুষের রুচির সৃষ্টি করেছে।কল্পনার জাল বুনে মানুষকে আসলের অনুকরণ করতে শিখি্যেছে। এই ভাবে অনুকরণ করতে করতে নিতান্ত ব্যাবসায়িক লাভের জন্য মানুষ ভেজালের সৃষ্টি করে ফেলেছে, যার বিশেষ উদাহরন দালদা। মিষ্টত্ব যেমন প্রাকৃতিক স্বাদ, এর অনুকরণে মানুষ বানিয়ে ফেললো চিনি, স্যাকারিন। মিশরের মমী, আসলকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা। এই ভাবেই আসলের নকল সৃষ্টি হতে থাকল। সুতরাং বোঝা যায় যে মানুষের কল্পনা আসলেরই প্রতিরুপ। কল্পনার সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতেই হয়। লেখকেরা চরিত্র সৃষ্টি করে লেখেন ‘’ সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র” বাস্তবে সেই চরিত্রের অস্তিত্ত্ব আছে, সমাজে কোথাও লুকিয়ে থাকে।এই ভাবেই সৃষ্টি হয়েছে কল্প বিজ্ঞান। কল্প বিজ্ঞানের হাত ধরেই সৃষ্টি হয়েছিল Frankenstein, ল্যাবরেটরিতে মানুষ তৈরি করতে গিয়ে দানব তৈরি হোয়ে গেছিল। বিজ্ঞানে ক্লোনিং করা সম্ভব হয়েছে। সম্ভবত ১৯৯৬ সালে প্রথম স্তন্যপায়ী ‘ ডলি’ একটি ভ্যারার জন্ম হয়েছে একটি কোষ থেকে। ‘ডলি’ সর্বাঙ্গে তার পূর্ব পুরুষের গুণাবলি বহন করে চলেছে। যে গুণাবলি গুলো মানুষের প্রয়োজন। যেমন ‘ডলির’ গায়ের উন্নত মানের লোম। ক্লোনিঙের মাধ্যমে এমন কোটি কোটি ‘ডলি’ তৈরি করা সম্ভব। এমনকি পছন্দের মানুষও তৈরি করা সম্ভব!
সেক্সপিয়ারের ‘comedy of error’ অবলম্বনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘ভ্রান্তি বিলাশ’ রচনা করেন। যেখানে দু জোড়া যমজদের নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার বৈচিএে এক বিরল কমেডি। বাবু ও চাকর জোরা যমজ হওয়াতে আসল চিনতে নগরবাসীর হেনস্থা আমাদের সকলেরই জানা। সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে যান্ত্রিক উন্নয়ন (Technological up gradation) মানব জাতীর উন্নয়নের এক বিশেষ সূচক।এই যান্ত্রিক উন্নয়নের হাত ধরেই নকল মস্তিষ্কের সূচনা।হাঁ, AI অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কথাই বলছি। একটা নকল মস্তিষ্কের প্রয়োজন কি? মানুষ কিন্তু নকলকে অপছন্দ করে না। নকল মস্তিস্ক মুহূর্তের মধ্যে অনেক কঠিন সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। এমন কি নতুন গান কিংবা সূর সৃষ্টি করতে পারে। কঠিন অপারেশনও সঠিক ভাবে করতে পারে। তবে এইসব ক্রিয়া কর্মের পেছনে মূল রসদ ডেটা।আসল মস্তিষ্ক কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে ডেটা নির্ভর নয়।ক্রমান্নয়ে পরীক্ষার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, সেই অভিজ্ঞতা ডেটা বটে কিন্তু তার পেছনে চৈতন্যই মানুষের আসল মস্তিষ্কের প্রধান হাতিয়ার। যদি পৃথিবীর আদি অবস্থার কথা চিন্তা করি তবে ভাবাই জেতে পারে মানুষ কি ভাবে একটি গোলাকার বস্তু যে গড়িয়ে জেতে পারে সেটা আবিষ্কার করল।সেই থেকে সৃষ্টি হল চাকা। চাকা থেকে গতি এল।এই সৃষ্টির পেছনে ডেটা কাজ করেনি কোন দিনও। কারন তখন ডেটা ছিলই না মানুষের ঝুলিতে। কেবলমাত্র চৈতন্যই ছিল সম্বল, তার সাথে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। চিন্তায় আসে মানুষ কি লজ্জা নিবারনের জন্য পোশাক পরেছিল?নাকি জলবায়ুর পরিবর্তন থেকে নিজেকে বাঁচানোর তাগিদে পোশাকের প্রয়োজন হয়েছিল? লজ্জা নিবারণের জন্য পোশাকের প্রয়োজন হয়েছিল বল্লে ধরে নিতে হবে মানুষের চৈতন্যের শুরু ঘটেছিল সেই সময় থেকেই। বুদ্ধির তুলনায় চৈতন্যই বেশি শক্তিশালি ছিল। এখন চৈতন্যের হ্রাস ঘটেছে। তাই বুঝি মানুষকে ডেটা নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। মানুষ এখন নিশ্চিত (Deterministic) হতে চায়।সম্ভাব্যকে (probabilistic) নিশ্চয়তায় রুপান্তরের প্রচেষ্টাকে সম্ভাষণ করে মানুষ।ডেটা নির্ভর মস্তিষ্ক মানুষের আসল মস্তিস্ককে বোকা বানিয়ে দেবেনা ত? তবেইত নকলের জয় ধ্বজা আসলের ওপর কায়েম হবে।