Image by HeungSoon from Pixabay

"এই অঙ্কিতা দেখ তোমার গায়ে একটা কি সুন্দর হলুদ প্রজাপতি বসেছে।" কৃষাণু তর্জনী তুলে কাঁধের দিকে অঙ্কিতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

অঙ্কিতা : আরে তোমার গায়ের উপরেও তো একটা হলুদ প্রজাপতি! তোমার গায়ের প্রজাপতির রঙটা চুনে হলুদ।ডানায় কোনো কারুকার্য নেই। আর আমার গায়ের প্রজাপতির রঙটা গাঢ় হলুদ। আর এর ডানায় কালো কারুকার্য আছে।

কৃষাণু: দুটো জোড়া মনে হয়।

অঙ্কিতা: হ্যাঁ। আমারো তাই মনে হচ্ছে! তবে তোমার গায়ের প্রজাপতিটা সম্ভবত স্ত্রী প্রজাপতি আর আমার গায়ের উপর যেটা বসেছে সেটা পুরুষ প্রজাপতি হতে পারে।

কৃষাণু: অমনি না। যেটা তোমার গায়ে যেটা বসেছে সেটাই পুরুষ আর আমার গায়ে বসেছে বলে এই প্রজাপতিটাই স্ত্রী হয়ে গেল। হতেই পারে না। আমারটাই পুরুষ।

অঙ্কিতা: আরে তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আমি মিন করে কিছু বলতে চাই নি। আসলে আমার গায়ের উপর যেটা বসেছে সেটা বেশি সুন্দর। কীট, পতঙ্গ, পশু পাখিদের মধ্যে পুরুষ জাতটা হলো সুন্দর। তাই বললাম।

কৃষাণু: তোমার বায়োলজি জ্ঞানের পরিধি বিশাল ম্যাডাম। আমি ফিঙ্গার ক্রস করলাম।

অঙ্কিতা: জানো প্রজাপতি গায়ে বসলে কি হয়?

কৃষাণু: কি হয়?

অঙ্কিতা: প্রজাপতি গায়ে বসলে বিয়ের ফুল ফোটে।

কৃষাণু: তাই নাকি। তা প্রজাপতির সঙ্গে বিয়ের কি সম্পর্ক?

অঙ্কিতা: একে বলে প্রজাপতি নির্বন্ধ। দেখনি বিয়ের কার্ডের উপর লেখা থাকে শ্রী শ্রী প্রজাপতেয় নমঃ।

কৃষাণু: বাবা! কি জ্ঞান তোমার ম্যাডাম। তোমার ‌জ্ঞানকে কুর্ণিশ জানাই।তা‌ বিয়টা কার আগে হবে? তোমার না আমার?

অঙ্কিতা: তার মানে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও না?

কৃষাণু: আমি একথা কখন বললাম?

অঙ্কিতা: এই তো বললে কার বিয়ে আগে হবে? তোমার না আমার? তুমি যদি আমাকে বিয়ে করতে চাইতে তাহলে কখনোই একথা বলতে না। বলতে আমাদের দুজনের বিয়েটা কবে হবে?

কৃষাণু: না ভাবছি তোমার মতো জ্ঞানীকে বিয়ে করে মাঝপথে ফেঁসে না যাই।

অঙ্কিতা: খুব না!

এই বলে বাইক চালক কৃষাণুর পিছনে বসা অঙ্কিতা তাকে এমন ঝাঁকুনি দিল যে বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একেবারে গাড্ডায় পড়ে গেল। বর্ষায় রাস্তাঘাটের যা অবস্থা! ভীষন পিচ্ছিল হয়ে আছে। একটু বেসামাল হয়েছো কি মরেছো! তবে কৃষাণু আর অঙ্কিতার বিশেষ কোনো আঘাত লাগেনি। অঙ্কিতার মাথাটা অল্প ফুলেছে তবে রক্তারক্তি হয়নি। আর কৃষাণুর হাত পা অল্পবিস্তর কেটে গেছে এই যা। বায়লজির ছাত্রী হিসেবে অঙ্কিতা বরাবরই একটু সাবধানি প্রকৃতির। কৃষাণুর কাটা জায়গাগুলো থেকে রক্তপাত হচ্ছে দেখে সেই জায়গাগুলো নিজের ওড়না ছিঁড়ে বেঁধে দিল। কৃষাণু হাঁ হাঁ করে উঠলেও অঙ্কিতা সেই দিকে কর্ণপাত করলো না।

অঙ্কিতা: তোমার থেকে আমার ওড়নার দাম বেশি নয়। ইনফেকশনের হাত থেকে বাঁচতে এটা করা জরুরি ছিল। চল দেখি আশেপাশে কোনো অষুধের দোকান অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে কিনা ?

কৃষাণু: কেন কি হবে?

অঙ্কিতা: আবার জিজ্ঞাসা করছ? ফার্স্ট এইড না করলে জায়গাটা ইনফেকটেড হয়ে যেতে পারে। একটা টেটভ্যাক ইনজেকশন নিতে হবে।

কৃষাণু: ও বাবা! ইনজেকশন! তুমি তো জানো অঙ্কি আমার ছোটবেলা থেকে ইনজেকশনে খুব ভয়। তাছাড়া ইঞ্জিনিয়ার লোকেদের এরকম হাত পা আকছার কাটে। আমরা হলাম লেবার শ্রেণীর মানুষ। অত বাবুআনা নেই।

অঙ্কিতা: ওহ্! যাস্ট সাট আপ কৃষ! ছেলেমানুষী রাখ। চলো এগিয়ে দেখি কাউকে জিজ্ঞেস করে কেউ কিছু বলতে পারে নাকি?

কৃষাণু: এই অজ পাড়া গাঁয়ে তুমি কোথায় এখন ওষুধের দোকান অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুঁজবে। দেখে তো মনে হচ্ছে এটা একটা পান্ডব বর্জিত এলাকা।

অঙ্কিতা: পাড়া গাঁ তো কি হয়েছে? এখানকার মানুষেরা কি অসুস্থ হয় না। তখন তারা প্রথমে কোথায় যায়। কোনো ওষুধের দোকান অথবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যায়। এখানে নিশ্চই কোন ব্যবস্থা আছে। খোঁজ করলেই পাবো। নাও নাও! ওঠো ! আর দেরি কোরো না। সন্ধ্যের আগে এই এলাকা আমাদের ছাড়তে হবে।

কৃষাণু: লঙ ড্রাইভের ইচ্ছেটা কার বেশি হয়? তোমার না আমার? নাও এবার ঠেলা সামলাও!

অঙ্কিতা: ঘাট হয়েছে আমার! এই আমি দুকান মুলছি! আর কোনদিন লঙ ড্রাইভের ইচ্ছে প্রকাশ করব না! এবার খুশি তো?

কৃষাণু কোনো কথা না বলে অঙ্কিতাকে এক হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এসে অঙ্কিতার গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট দুটোকে নিজের ঠোঁটে ঢুকিয়ে নিল। ধরে রাখল অনেক ক্ষন। অঙ্কিতা অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল।

অঙ্কিতা: কি যে করনা! এটা একটা পাবলিক প্লেস! খোলা রাস্তায় এভাবে.....

অঙ্কিতাকে কথা শেষ করতে দিল না কৃষাণু আবারো একটা হ্যাঁচকা টানে তাকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগল। অঙ্কিতার গায়ে ওড়না না থাকায় সালোয়ারের সামনের হুক গুলো খুলে মুখ রাখল তার দ্বিবিভাজিকায়। অঙ্কিতা এবার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কৃষাণুর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। দ্রুত হাতে আটকে ফেলল সালোয়ারের হুক গুলো।

অঙ্কিতা: তোমার চিন্তা শক্তি সব লোপ পেয়ে গেছে‌? বাইক থেকে পড়ে গিয়ে পাগল হয়ে গেলে নাকি?

কৃষাণু: পাগলামির তুমি এখনো কিছু দেখনি!যেদিন দেখাব সেদিন বুঝবে!

অঙ্কিতা: খুব দূষ্টু হয়েছ! যখন তখন‌ লিমিট ক্রস করছ!

কৃষাণু: বিয়েতে যত দেরি করবে তত লিমিট ক্রস করব। এখনি মুখ বন্ধ না করলে এই রাস্তাটাকেই বেড রুম করে নেব।

অঙ্কিতা: নাহ্! তোমার কাছে আর বসে থাকা যাবে না! কখন যে কি করে বসবে!

অঙ্কিতা কৃষাণুর পাশ থেকে উঠে পড়ে গায়ের ধূলো ঝাড়তে লাগল। ঠিক সেই সময় একটা সাইকেল আরোহীকে যেতে দেখে অঙ্কিতা তাকে সব কথা বলে।

ছেলেটি জানায়,

"এখানে স্বাস্থ‍্যকেন্দ্র আছে বটে তবে সে বহুকাল তালাবন্ধ। কেউ এই পান্ডব বর্জিত এলাকায় আসতে চায় না। আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে আপনাদের একজনের কাছে নিয়ে যেতে পারি। আমরা আপদে বিপদে তার কাছেই যাই।"

অঙ্কিতা রাজি হতে ছেলেটি পথ দেখিয়ে তাদের যেখানে নিয়ে গেল সেটা মাঠের মাঝখানে একটা ছোট খাটো ঘর। ভেতরে চেয়ার টেবিল পাতা। আর চিকিৎসার জন্য সামান্য কিছু সরঞ্জাম। চেয়ারে বসে যিনি ঝিমোচ্ছেন তিনি সম্ভবতঃ ডাক্তার। অর্থাৎ হাতুড়ে চিকিৎসক। অঙ্কিতারা ঘরে প্রবেশ করতেই সে আড়মোড়া ভাঙে। ওদের চেহারা পোশাক আশাক দেখে লোকটা আন্দাজ করে ফেলে যে তারা শহরের মানুষ।

"এই অধমের কাছে কি মনে করে? বলুন কি করতে পারি আপনাদের জন্য?" হাতুড়ে ডাক্তারের কটাক্ষ করে।

অঙ্কিতার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে হাতুড়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেধে দেয়। কিন্তু টেটভ্যাক ইনজেকশন দেওয়ার সময় ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের জায়গায় মান্ধাতার আমলের সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন দিতে শুরু করে।

অঙ্কিতা: আপনারা ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করেন না?

হাতুড়ে ডাক্তার: এটা অজ পাড়া গাঁ ম্যাডাম! এখানে ওসব চল নেই। আপনি চিন্তা করবেন না !আমার সিরিঞ্জ স্টেরিলাইজ করা অর্থাৎ সম্পূর্ণ জীবানুমুক্ত।

অঙ্কিতার মনটা তবু খচখচ করতে থাকে।

"নাহ্! সত্যি আর এসব জায়গায় লঙ ড্রাইভে আসা যাবে না।"

বেশ কিছুদিন ধরে কৃষাণুর শরীর ভালো যাচ্ছে না। দিন দিন অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে আবার এপেন্ডিসের যন্ত্রনা শুরু হয়েছে। এ জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাজ নয়, অগত্যা ডাক্তার একজন নামী শল্য চিকিৎসকের কাছে কৃষাণুকে পাঠিয়ে দেন। সার্জেন তাকে আপারেশনের আগে সার্জিক্যাল প্রোফাইল টেস্টের জন্য বেশ কিছু টেস্ট লিখে দেন। রিপোর্ট আসার পর ডাক্তার টেস্টের রিপোর্ট দেখতে দেখত এক জায়গায় থমকে যান।

সার্জেন: আপনি কি বোহেমিয়ান জীবন যাপন করেন?

কৃষাণু: কোই না তো। আপনি একথা কেন জিজ্ঞেস করছেন? ব্লাড টেস্টের রিপোর্টে কি কিছু খারাপ আছে?

সার্জেন: সে কথায় পরে আসছি। তার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিন। আপনি কি কোনোদিন রক্ত দেবার প্রয়োজন হয়েছিল?

কৃষাণু: না। তবে বেশ কিছুদিন ধরে আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না।

সার্জেন: কতদিন ধরে?

কৃষাণু: সঠিক বলতে পারবো না।

সার্জেন: মনে করে বলুন তো অসুস্থ বোধ করার কিছুদিন আগে আপনার সঙ্গে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা?

কৃষাণু: বিশেষ কিছু না। কয়েক মাস আগে আমি বাইক নিয়ে গ্ৰামের দিকে লঙ ড্রাইভে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার ছোট একটা অ‍্যাকসিডেন্ট হয়। ওখানে তেমন কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। একজন হাতুড়ে গোছের ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা করে ছেড়ে দেয়।

সার্জেন: কি ধরনের প্রাথমিক চিকিৎসা?

কৃষাণু: ওই ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেধে দিয়ে টেটভ্যাক ইনজেকশন দিয়ে দেয়।

সার্জেন: ইনজেকশন! ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার করেছিল?

কৃষাণু: না, পুরোনো সিরিঞ্জ। ওখানে ডিসপোজেবল সিরিঞ্জের নাকি চলে নেই।

সার্জেন: ও মাই গড! এখনো কোন যুগে পড়ে আছে আমাদের দেশের এইসব এলাকা! ভাবলে অবাক হতে হয়। আপনি বিবাহিত?

কৃষাণু: না।

সার্জেন: গার্লফ্রেন্ড?

কৃষাণু: আছে।

সার্জেন: কতদিনের সম্পর্ক?

কৃষাণু: স্কুল জীবন থেকে।

সার্জেন: শারীরিক সম্পর্ক?

কৃষাণু: আছে। তবে কোনোদিনও মাত্রা ছাড়ায় নি।

সার্জেন: হুম! ঐ অক্সিডেন্টের পর আপনারা আর কোনদিন একে অপরের কাছাকাছি এসেছেন?

কৃষাণু: ওর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎকারই হয়নি। কাছাকাছি আসা তো দূরের কথা। ও ওর স্নাতকোত্তর স্তরের ফাইনাল পরীক্ষা নিয়ে আর আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ওই ফোনে যেটুকু কথা হয়!

সার্জেন: আপনার গার্লফ্রেন্ডের জন্য আমি কয়েকটা ব্লাড টেস্ট লিখে দিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করিয়ে আমার কাছে রিপোর্টগুলো নিয়ে আসবেন। ইটস আর্জেন্ট! আর আপনিও অন্য কয়েকটি প্যাথোলজি সেন্টারে গিয়ে এই টেস্টগুলো করিয়ে নেবেন। আপনার গার্লফ্রেন্ডের নাম, বয়স বলুন?

কৃষাণু: অঙ্কিতা! অঙ্কিতা রায় ! বয়স, আন্দাজ তেইশ হবে! কেন? কি হয়েছে ডক্টর?

সার্জেন: আপনার এইচআইভি রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। তবে এখনি ভেঙে পড়বেন না। আরো অন্য জায়গায় ব্লাড টেস্ট করিয়ে যদি দেখা যায় সব রিপোর্ট একই আসছে। তাহলে সেক্ষেত্রে কোনো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে আমাকে আপনার অ‍্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন করতে হবে।

কৃষাণু: কি করে এটা সম্ভব ডক্টর? আমি তো ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছি না!

সার্জেন: আমি সঠিক কারণ এখনো বলতে পারছি না। আগে সমস্ত রিপোর্ট হাতে আসুক তবে নিশ্চিত করে বলতে পারব। তবে যতদূর মনে হয়, গ্ৰামের কোয়াক ডাক্তার আপনাকে ইনজেক্ট করার সময় যে সিরিঞ্জ ব্যবহার করেছিল তার থেকেই এই রোগের জীবাণু আপনার শরীরে ঢুকেছে। ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহার না করলে এই সম্ভাবনা থাকে।

কৃষাণু মনে মনে ভেঙে পড়ে। অঙ্কিতাকে সব জানাতে সে প্রথমে খুব কান্নাকাটি করে। কিন্তু অঙ্কিতা খুব শক্ত মনের মেয়ে। ও কৃষাণুকে ক্রমাগত সাহস যোগাতে থাকে। দুর্ভাগ্যবশত কৃষানণুর সমস্ত জায়গায় ব্লাড টেস্টের রিপোর্টৈ এইচআইভি পজিটিভ আসে। কিন্তু অঙ্কিতার নেগেটিভ আসে। আর কোনো সন্দেহই রইলো না যে এই রোগের জীবাণু কোথা থেকে এসেছে। অঙ্কিতা কৃষাণুর এই পরিনতির জন্য নিজের হঠকারিতা কেই দায়ী করে। সার্জন খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে কৃষাণুর অপারেশন নির্বিঘ্নে সারেন।

বর্তমানে সেই বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে কৃষাণুর চিকিৎসা চলছে। এতকিছুর মধ্যেও কৃষাণু আর অঙ্কিতার সম্পর্কে এতটুকু চিড় খায়নি বরং আরো গাঢ় হয়েছে। দুজনে স্থির করেছে সারাজীবন অবিবাহিত থেকে একে অপরের পাশে এইভাবে থেকে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। কৃষাণু তার বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান উপরন্তু হার্টের রোগী। সেই কারণে কৃষাণু তাঁর কাছে নিজের অসুস্থতার কথা গোপন রেখেছিল। মায়ের আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকের পর মা খানিক সুস্থ হয়েই কৃষাণুকে বিয়ের জন্য জোরাজুরি করতে লাগলো। নিরুপায় হয়ে কৃষাণু ঠিক করে মাকে সমস্ত জানিয়ে দেবে। এ বিষয়ে অঙ্কিতার কাছে পরামর্শ চায় কৃষাণু।

অঙ্কিতা: এই ভুল একদম কোরো না কৃষ। আন্টি তোমার অসুস্থ্যতার খবর শুনলে তৎক্ষণাৎ হার্টফেল করবেন। এটা কি তুমি চাও?

কৃষাণু: তাহলে আমি কি করব অঙ্কি? মাকে তুমি চেনো না! মার ভয়ঙ্কর জেদ! যদি কিছু স্থির করে তাহলে সেটা করেই ছাড়বে।

অঙ্কিতা: অত ভেবো না। চল তোমার ডাক্তারের কাছে যাই। দেখি উনি আমাদের কি দিশা দেখান?

পরেরদিন অঙ্কিতা আর কৃষাণু ডাক্তারের চেম্বারে গেল।

অঙ্কিতা: মে আই কামিং ডক্টর?

ডাক্তার: কাম ইন্। সিট ডাউন প্লিজ।

অঙ্কিতা: থ্যাঙ্কস।

ডাক্তার কৃষাণুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-“মিঃ মিত্র শরীর ঠিক আছে তো। কোনো সমস্যা?”

কৃষাণু : শারীরিক নয়, মানসিক সমস্যা। আপনার সাহায্য চাই।

ডাক্তার: বলুন কি করতে পারি?

অঙ্কিতা আর কৃষাণু ডাক্তারের কাছে সমস্ত বলার পর ডাক্তার বলেন,

-"মা যখন চাইছেন তখন আপনারা অবশ্যই বিয়ে করতে পারেন। কিন্তু স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন আপনাদের থাকবে না। আপনাদের সারাজীবন বিবাহিত হয়েও সন্ন্যাসীর মতো কামকে জয় করতে হবে। না হলে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্ৰহন করতে হবে । সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম কিন্তু একেবারে যে নেই তা নয়। তবে সন্তানের আশা ত্যাগ করতে হবে। কারণ পরবর্তী প্রজন্মের রক্ত এই রোগের জীবাণু বহন করবেই।"

কৃষাণু: না আমি কিছুতেই অঙ্কিতাকে আমার অভিশপ্ত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে ওর ক্ষতি করতে চাই না।

ডাক্তার: একটা উপায় আছে। যদি আপনারা রাজি থাকেন তাহলে এমন একজন পাত্রী নির্বাচন করুন যিনি এই রোগের জীবাণু বহন করছেন। তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তবে সন্তানের জন্ম দেওয়ার কথা মনেও আনবেন না।

কৃষাণু আর অঙ্কিতা দু'জনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। ডাক্তারের চেম্বারে নীরবতা নেমে আসে। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল অঙ্কিতাই।

অঙ্কিতা: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, আমাদের দিশা দেখানোর জন্য। আজ উঠি। হ্যাভ এ নাইস ডে! সি ইউ এগেইন!

দুজনে চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে এসে পাশাপাশি মনমরা হয়ে হাঁটতে থাকে। অঙ্কিতা খুবই বাস্তববাদী আর বুদ্ধিমতী মেয়ে। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সে বলে উঠলো, -"আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে তোমার একটা প্রোফাইল খুললে কেমন হয়। সেখানে তোমার সমস্ত ডিইটেল থাকবে। তোমার অসুস্থ্যতার কথাও থাকবে।"

কৃষাণু: তুমি এসব কি বলছো? যা বলছো ভেবে বলছো তো? মাথা ঠিক আছে তোমার? আমরা একে অপরকে কথা দিয়েছিলাম, সারাজীবন দুজনে দুজনার পাশে থাকবো।

অঙ্কিতা: মাথা আমার ঠিকই আছে কৃষ! বরং তখন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যখন আমরা একে অপরকে সারাজীবন অবিবাহিত থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম সমাজে বসবাস করে এইরকম সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। আমি কাল সারারাত অনেক ভেবেছি। তুমি বিয়ে করবে কৃষ! তোমার মায়ের জন্য করবে!আমাদের সম্পর্ক চিরস্থায়ী!কারোর ক্ষমতা নেই একে ভেঙে ফেলার!স্বয়ং ভগবানেরও না!শুধু বহিরাঙ্গে বদলে যাবে সম্পর্কের রসায়ন। অন্তরালে আমাদের দুজনের ভালোবাসা ফল্গুধারার মতো প্রবাহিত হতে থাকবে।

কৃষাণু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে অঙ্কিতা বলল, "আর কোনো আপত্তি নয়। ব্যাপারটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমাকে কিছু করতে হবে না। ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে তোমার নামে প্রোফাইল খোলা হলেও সেখানে আমার কন্ট্যাক্ট নাম্বার আর ইমেইল আইডি থাকবে। আগে আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব।"

অঙ্কিতার চেষ্টায় সঠিক পাত্রী নির্বাচিত হয়ে যায়। নাম সঞ্চারী। বয়স অঙ্কিতার মতোই হবে। একবার সঞ্চারীর রক্তের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কয়েক বোতল রক্ত নিতে হয় তাকে। তারি মধ্যে কোনো একটা প্যাকে ছিল এইচআইভি ভাইরাস। পরবর্তীকালে পা ভাঙার জন্য সার্জারির আগে টেস্ট করতে গিয়ে ধরা পড়ে। সঞ্চারীও কৃষাণুর মতো নিজের অসুস্থতার কথা লুকিয়ে রেখেছিল পরিজনদের কাছ থেকে। কারণ চাকরি সূত্রে সে তখন প্রবাসে ছিল। সম্প্রতি দেশে ফেরার পর তাকেও বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়া হচ্ছিল। এ হেন পরিস্থিতিতে ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে কৃষাণুর প্রোফাইল তার কাছে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো।

‌বিয়ের দিন স্থির হয়ে যায়। স্বভাবতই খুশি উভয়ের বাড়ির লোকেরা। বিয়ের সমস্ত আয়োজন অঙ্কিতা একা হাতে করে ভীষণ রকমের শান্ত আর নির্লিপ্ত ভাবে। সঠিক দিনে কৃষাণু আর সঞ্চারীর চার হাত এক হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের দিন কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না অঙ্কিতাকে।

বউভাতের দিন অঙ্কিতার কাছ থেকে কৃষাণু একটা ফুলের বোকে আর একটা চিঠি পায়। পরে নিভৃতে পড়বে ভেবে কৃষাণু সেটা যত্ন করে পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দেয়। বউভাতের অনুষ্ঠান মিটে গেলে সবাই মিলে কৃষাণুকে ঠেলে ঠুলে ফুলসজ্জার ঘরে দিয়ে আসে।

সঞ্চারীর সঙ্গে তেমন আলাপ হয়নি কৃষাণুর। সবসময় অঙ্কিতা তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে যেত। আজ অঙ্কিতার অভাব বেশি করে অনুভূত হতে থাকে কৃষাণুর। আজকের দিনটা একদিন সে অঙ্কিতার জন্য ভেবেছিলো। সব ঠিকঠাক চললে সঞ্চারীর জায়গায় অঙ্কিতার বধূবেশে তার জন্য অপেক্ষা করার কথা ছিল। অবশ্য সঞ্চারী বেশ স্মার্ট ! কৃষাণু ইতস্তত করছে দেখে নিজেই একথা সেকথায় নিজের আর কৃষাণুর মধ্যকার সমস্ত জড়তা কাটিয়ে দিল। ফুলসজ্জার রাতে নববধূকে কিছু উপহার দেওয়া নিয়ম। অঙ্কিতাই পছন্দ করে সঞ্চারীর জন্য একটা আংটি কিনে এনেছিল। কৃষাণু সেই আংটিটা সঞ্চারীর আঙ্গুলে পরিয়ে দিল। তার সঙ্গে দিল আরো একটা অভিনব উপহার। ফিমেল কনডম। সঞ্চারীও স্মার্ট কম নয়। সেও কৃষাণুর দিকে মেল কনডমের প্যাকেট এগিয়ে দিল। দুজনে দুজনার আচরণে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে হঠাৎ সঞ্চারী মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য পকেট থেকে রুমাল বার করতে গিয়ে অঙ্কিতার চিঠিটা পড়ে গেল। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করে কৃষাণু।

প্রিয়তম কৃষ,

তোমাকে একটা কথা বলি বলি করেও বলা হয়নি। তোমার প্রোফাইল ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে রেজিষ্ট্রার করার পর আমি বিদেশের ইউনিভার্সিটিতে বায়োলজির উপর গবেষণার জন্য আবেদন করেছিলাম। সেই আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। আজ রাতের উড়ানে আমি ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাচ্ছি। কলকাতায় কবে ফিরতে পারব জানি না। অনেক ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এম এ পাশ করার পর থেকে বাড়িতে আমার উপরেও ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ বাড়ছিল। প্রধানত বিয়ে এড়ানোর জন্য আমার এই বিদেশ যাত্রা। তাছাড়া আমার উপস্থিতিতে তোমাদের দাম্পত্য জীবন সুখের হবে না। সঞ্চারী বুদ্ধিমতী। ও ঠিক একদিন বুঝতে পারত তোমার আমার সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্ত্বের নয় , তার থেকেও বেশি কিছু। ওর জীবনে কোনো অতীত নেই। তুমিই ওর বর্তমান, তুমিই ওর ভবিষ্যৎ। ওকে ওর প্রাপ্য সম্মান, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করো না। জানি কাজটা সহজ নয়। কারণ তোমার মনে আমার আসন চিরস্থায়ী। তোমার হৃদয়ে আমার পাশে ওকেও একটু জায়গা দেওয়ার চেষ্টা কোরো।মেয়েটার অনেক কষ্ট। কোনোদিন সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না। সরাজীবন ওকে একটা দুরারোগ্য ব্যাধির ভার বহন করে যেতে হবে। ওর কষ্ট তুমি না বুঝলে আর কেইই বা বুঝবে? পরবর্তীকালে অবশ্য তোমরা একটা বাচ্চা দত্তক নেওয়ার কথা ভাবতে পার। আমি যখন কলকাতায় ফিরব তখন যেন তোমাদের সুখী পরিবার হিসেবে দেখি। ভালো থেকো কৃষ। নিজের আর সঞ্চারীর শরীরের যত্ন নিও।আর একটা অনুরোধ চিঠিটা পড়া হয়ে গেলে ছিঁড়ে ফেলো।

ইতি তোমার চিরদিনের অঙ্কি।

সঞ্চারী কাঁদতে কাঁদতে কখন একসময় ঘুমিয়ে পড়েছে জানতে পারেনি কৃষাণু । কারণ সে তখন অঙ্কিতার চিঠি পড়ায় মত্ত ছিলো। চিঠি শেষ করে বাষ্পায়িত চোখে জানালার বাইরে তাকায় কৃষাণু। তখন রাত শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। ভোরের নরম আলোয় একটা হলুদ প্রজাপতিকে উড়তে দেখে কৃষাণু। আজ আর জোড়ায় দেখা যায় না তাকে। সঙ্গীবিহীন একাকী দিকভ্রান্তের মতো উড়ে চলেছে সে...

.    .    .

Discus