Photo by Adrian Ordonez on Unsplash

রোশনের দুনিয়া সেদিন পুরো উল্টে গেল,যেদিন তার মা,তার নিজের মা,তাকে তুলে জলের হাঁড়িতে ফেলে দিল।

তাহলে শুরু থেকেই শুরু করা যাক।

রোশন একজন মোটামুটি কাজ করে খাওয়া ছেলে। ও বিভিন্ন জিনিসপত্র ডেলিভারি দেয়।প্রধানত নিজের এলাকায় দিলেও,মাঝে মাঝে ওকে জিন আর পরীদের মহল্লায় দিতে হয়। তা অবশ্য সবসময় নয়।যখন ওর মায়ের ওষুধের খরচ বেড়ে যায়, আর কিছু উপায় থাকে না,শুধু তখনই।

ওর এখানে কাজ করতে যে কোনো সমস্যা আছে তা নয়,তবে ওদের অনেক ঝামেলা।হিন্দু জিন -পরীরা হালাল ট্যাগ দেখলেই ওকে মারতে ছুটে আসে,মুসলমানদের দেখলেই ওর কেমন ভয় ভয় লাগে।ওদের চোখে সুরমা,গায়ে আতরের গন্ধ, হাতে তসবিহ।বাপরে সে কী ভয়ঙ্কর!আর ওদের কসাইগুলো,বাপরে!এখনই খুন করে ফেলবে যেন।

তবে একটা ভালো জিনিস এতে,টাকা অনেক পাওয়া যায়। মানে এমনি পার্সেল ডেলিভারি করলে যা পাওয়া যায়,তার দশগুণ মেলে ওখানে গেলে।কিন্তু খুনও হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। হয়েওছে কয়েকজন।

এমনিতে কোম্পানি বাবা বাছা করে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ করাবে।যেই মরে গেলে তারা চেনেই না তোমাকে।এমনকি লাশ নিয়ে আসারও লোক পাওয়া যাবে না। কে যাবে ওখানে প্রাণ দিতে!

অবশ্য কোম্পানির কী দোষ!

সরকার ওখানে কোনো মানুষকে ডেলিভারি দিতেই মানা করেছে।কিন্তু ওরা যেহেতু খুব টাকা দেয়,তাই লাভের ব্যাপারটাও তো আছে?

কোম্পানি তো লাভ করতেই এসেছে?

এইরকম একটা মহল্লা থাকাও দরকার,নইলে ওদের মতো ছেলেদের পকেটে টান পড়লে যাবে কোথায়?

এরকম একদিন মাসের শেষ।

একটা অনলাইন জুয়া খেলার অ্যাপে হাত খালি করে বসে আছে।তখন মনে হল,ডেলিভারি অ্যাপটা খুলে দেখি তো!

দেখল অর্ডার আছে;বেশ ভালো টাকা অফার করছে।

ও তাড়াতাড়ি বাইকটা বের করেই ছুটল রিয়াজের রেস্টুরেন্টে।সেখান থেকে কাবাবটা নিয়েই একেবারে পরী মহল্লায়। দশ মিনিটের মধ্যে ডেলিভারি দিতে হবে।পথে একটা বাচ্চা ছেলেকে খুব জোর ধাক্কা দিয়েছে।মরেই গেছে বোধহয় বাচ্চাটা।

সে যাই হোক,আগে ডেলিভারি দিয়ে তারপর দেখা যাবে।

দরজা খুলল একটা পরী।বয়স কম,তবে ওদের বয়স তো আর মানুষের মতো নয়।যাকে দেখে মনে হচ্ছে তেইশ কী চব্বিশ বছরের,সে হয়তো দেখবে দুশো তেইশ কি চব্বিশ বছরের।তাতে কিছু এসে যায় না।

এটাও একটা কারণ পরী মহল্লায় ডেলিভারি দিতে আসার।

দরজা খুলেই বলল,"দিন,দিন,দিন।খুব খিদে পেয়েছে।আর একটু দেরি করলেই পেট চুঁইয়ে যেত একেবারে।আপনার কিউআর কোডটা দিন,পে করে দিচ্ছি।"

রোশন মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দেয়।এত সুন্দর যে কিছু থাকতে পারে এই পৃথিবীতে,সে ভাবতেও পারেনি।

এমন সময় পেছন থেকে ওর মাথায় একটা জোরে আঘাত লাগতে ও চমকে সম্বিৎ ফিরে পেল।ও সামনে ফিরে দেখে ততক্ষণে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। ও আবার পেছনে ফিরতেই দেখতে পেল,দুজন বিশালকায় জিন লড়াই করছে।তাদের একজনের লাঠির এক প্রান্তের একটু তার মাথায় লেগেছিল।

 ও ওখানে আর না দাঁড়িয়ে বাইক নিয়ে চম্পট দিল।

বাজারে এসে ডাক্তার খানায় মাথা ব্যান্ডেজ করে বেরিয়েই ও নিজের মোবাইল চেক করল। নাহ্,পেমেন্ট হয়ে গেছে যাইহোক।

আবার কিছুদিন পর ও গেল ওই পাড়ায়।প্রথমে ভেবেছিল যাবে না,কিন্তু পকেটে টাকা না থাকলে সব প্রতিজ্ঞা ভেঙে যায়,তাই যেতেই হল।তাছাড়া টাকাও দিচ্ছে লোভনীয় অংকের।সেদিনের ওর ঘটনার পর কেউ যেতে চাইছে না আর।ওর অবশ্য আরও একটা কারণ আছে।

ও গিয়ে বেল বাজাতেই আবার সেই মেয়েটাই দরজা খুলল।আজ তার মুখে একটা সলজ্জ হাসি।কেউ যেন একগাছ ফুল ওর মাথায় ফেলল উপর থেকে,হালকা হালকা বাতাস বয়ে গেল,সব থেমে গেল,একটা পাখি সুমধুর স্বরে ডেকে উঠল।এমন সময় বাঁশির মতো সুন্দর একটা স্বর বলে উঠল,"কী হল,দিন পার্সেলটা!"

ওর স্বপ্ন ভেঙে গেল।খুব বেশি রোমান্টিক সিনেমা দেখছে ও।এই শারুক্ষানটা যত নষ্টের গোড়া।ও পার্সেলটা কোনমতে দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এল।এর মধ্যেই ও দেখেছে, পরী মেয়েটা মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছিল।

ও ভুলে গিয়ে একটা জিনকে ধাক্কা মারল।ভাগ্যিস জিনটা ছিল ভালো,তাই কিছু বলল না। ও "সরি'' বলে এগোতেই একটা ষাঁড়কে ধাক্কা মারল।সে কিন্তু এত দিলদরিয়া নয়।শিং ঘুরে গুঁতিয়ে নর্দমায় ফেলে দিল।এই শালা হিন্দু জিনগুলো,কাজ নেই,শিবের ষাঁড় ছেড়ে দিয়েছে রাস্তায়।এতই যদি শখ,ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখ না!

ঘরে গিয়ে গায়ের নোংরা ধুয়ে ও যখন গোসলখানা থেকে বেরোলো,মা ভাত বেড়ে দিয়েছে।বেশ একথালা ভাত খুব তৃপ্তির সঙ্গে খেল।সবকিছু যেন আজকে বেশি ভালো লাগছে,ভাত যেন অমৃত,উচ্ছের চচ্চড়ি তো কহতব্য নয়।মায়ের কি রান্নার হাত খুলে গেছে?মাকে একটা ফাইভ স্টার হোটেল খুলে দিতে হবে।মাকে সেকথা বলতেই ঝাড়ি খেল।কিন্তু তাতেও ওর একটুও রাগ হল না।আজকে রাগ করতে নেই।

সেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরে দেখল মায়ের খুব শরীর খারাপ।অসীমকে ডেকে তার গাড়ি নিয়ে ছুটল হাসপাতালে।ডাক্তার বললেন অবস্থা খুব খারাপ, এক্ষুনি সার্জারি করতে হবে।টাকা পয়সার ব্যবস্থা পরে করলেও হবে,এখন তিনটে রক্ত লাগবে।

মায়ের রক্তের গ্রুপ এবি পজিটিভ।একটু বিরল। ও জানে ব্লাড ব্যাংকে পাওয়া যাবে না।তাই আনন্তদাকে ফোন করল ও।

"হ্যাঁ অনন্তদা?

অন্যদিকের শব্দ শোনা গেল না।কিন্তু বোঝা গেল লোকটা ওকে চিনতে পারেনি।কারণ তার পরেই ওকে পরিচয় দিতে হল,"অনন্তদা আমি রোশন,সেই গোলাপডাঙ্গার মাঠে ক্রিকেট খেলতাম,ভালো লেগ স্পিন করতাম।

এবারে লোকটা চিনতে পারল।

"হ্যাঁ দাদা,মায়ের রক্ত লাগবে।"

আবার অন্যদিকের লোকটি কথা বলল।রোশন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,"হ্যাঁ,এবি পজিটিভ।"

"..."

"আচ্ছা ঠিক আছে।"

মায়ের অবস্থার কিন্তু উন্নতি হল না।হাসপাতালের অবস্থা ভালো না।হিন্দু আর মুসলিম জিনগুলো প্রায়ই লড়াই করে,তখন হাসপাতালের দেওয়ালের ইঁটগুলো খুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে একে অপরকে মরে।কয়েকজন মানুষ প্রতিবাদ করেছিল ভয়ে ভয়ে,মৃদুস্বরে;কিন্তু ওরা তাদের এমনভাবে মেরেছিল,মরেই গিয়েছিল বেচারারা।পিষে কিমা করে দিয়েছিল।কোদালে করে তুলে নিয়ে গিয়ে সৎকার করতে হয়েছিল।

সেই হাসপাতালে আর কী চিকিৎসা হবে!

পরদিন দুপুর দুটো একুশে মা মারা গেলেন।রক্তগুলো জোগাড় করা হয়েছিল,কিন্তু কিচ্ছু কাজে লাগল না।ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে যখন ও রিফান্ড চাইল,ওরা বলল,ওদের নাকি পলিসি, কোনো টাকা ফেরত দেওয়া হবে না।ও রাগে ছুটে গিয়েছিল ভেতরে।এক মুহুর্তে রক্তের পাউচগুলো বের করে ছিঁড়ে রক্ত ছড়িয়ে দিয়েছিল মেঝেতে।

আধঘন্টা পর পুলিশ ধরে নিয়ে গেল ওকে। ও বারবার মিনতি করেছিল,"স্যার আমার মাকে সৎকার করতে দিন।"

কিন্তু একজন বাদে সব পুলিশ ওকে ফেলে ভারী ভারী জুতোগুলো দিয়ে বেধড়ক মেরেছিল।মারতে মারতে বলছিল,"হারামজাদা,সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করার খুব শখ না!তোর মাকে শেয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খাক।জিনের বাচ্চারা আচার করুক।দেখব তোর কত রাগ! কী করতে পারিস?"

আধঘন্টা ধরে মেরে যখন ওরা ছাড়ল, ওর মাথা ফেটে গিয়েছিল,ওর ঠোঁট কেটে রক্ত ঝরছিল,একটা হাত ভেঙে হাড় মাংস ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছিল।যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে,একজন পুলিশ এসে একটা পারিজাত গাছের পাতা ছিঁড়ে তাতে জিনের গোবর দলে ওর ক্ষতগুলোতে লাগিয়ে দিল।

তারপর যখন যন্ত্রণা কমলে ও একটু শান্ত হল,পুলিশটা বলল,"বাবা,এত মাথা গরম করলে চলে?আমরা তো হুকুমের গোলাম,এটা তো আমাদের কর্তব্য। কী করব বল?"

"ঠিকই তো!ওদের কী দোষ!"

পরের দিন ও প্রায় সুস্থ হয়ে গেল।শুধু একটু ব্যাথা রয়েছে।পুলিশ ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে লকাপে রেখেছে।কালকে আদালতে চালান দেবে। দশ বারো রকমের ধারায় মামলা এনেছে ওর নামে।

লকাপে বসে বসে ভাবল,মুমতাজ ওর অপেক্ষায় থাকবে।ফালতু ফালতু কাবাব অর্ডার করে কতোগুলো টাকা নষ্ট করবে।ভাবতেই ওর ঠোঁটের কোণে হাসি এল।

সন্ধ্যার সময় সেই পুলিশটা এসে জানাল,ওর মায়ের শরীর জিনেরা নিয়ে গেছে আচার করবে বলে।তবে ভালো অংকের টাকা দিয়ে গেছে। ও জেল থেকে বেরোলে আর টাকার চিন্তা করতে হবে না।

ওর একটু দুঃখ হল,কিন্তু তার থেকে বেশি নিশ্চিন্ত হল।

ও জেল থেকে বেরোনোর পর মুমতাজের সাথে দেখা হল।সে যেন আরো সুন্দরী হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো চোখ গুলো মেলে হাজারো প্রশ্ন করছে যেন।তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ওর কানে বাজল,"এতদিন কোথায় ছিলে?"

ও হাত বাড়িয়ে মুমতাজের মুখটা ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এল।

ঠিক তখনই প্রচণ্ড ব্যথায় কঁকিয়ে উঠল ও।ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ।দেখল বড়বাবুর মুখ ওর মুখের কাছে।ওর পেটটায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে।ও দেখল আশেপাশের পুলিশগুলো খুব হাসছে।"হারামজাদা,কালকে মা মরে গেল,তখন বলছিল,স্যার একটু সময় দিন সৎকার করতে।আর রাত ঘুরতে না ঘুরতেই বাই একেবারে মাথায় উঠে গেছে।হারামজাদা,বেজন্মার জাত!"বলেই আর একটা লাথি কষালেন ওর অন্ডকোষে।

"মাগো ",বলে ও সিমেন্টের স্ল্যাবটার উপর থেকে পড়ে গেল এবারে।

বড়বাবু আবার বললেন,"উঠ শালা,হারামজাদা।"

ও চেষ্টা করেও উঠতে পারল না।তিনি আবার সজোরে একটা লাথি কষালেন কোমরে।ও যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল আবার।

আদালতের বিচারে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট,ডিউটিরত পুলিশের উপর হামলা,খুনের চেষ্টা,গরীব মানুষ হওয়া,বাতাসে বিনাপয়সায় নিঃশ্বাস নেওয়া(ও বলার চেষ্টা করেছিল যে, ও জানে না এটা অন্যায়।কিন্ত আইন 'জানি না '- কে মানে না।) ইত্যাদি অপরাধে তেত্রিশ বছরের ভার্চুয়াল সশ্রম কারাবাসের হুকুম দিল।

ভার্চুয়াল কারাবাসের নাম শুনতেই ওর শিরদাঁড়া দিয়ে কেউ একজন যেন হিমশীতল তরবারি আমূল গেঁথে দিল। ও থরথর করে কাঁপতে লাগল,মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেল,শেষমেশ প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলল।আদালত মলের তীব্র গন্ধ ভরে উঠল,সবাই নাকে রুমাল চাপা দিলেন। জিনেরা এমন দুর্গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না।

ও বছর তিনেক আগে কেলে পাঁচুর মুখে ভার্চুয়াল কারাবাসের কথা শুনেছিল।ওতে নাকি অজ্ঞান করে মাথায় কিসব যন্ত্র লাগিয়ে দেয়।তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে একটা কৃত্রিম কারাবাসের স্মৃতি এবং যন্ত্রণা মস্তিষ্কের মধ্যে রোপণ করে দেওয়া হয়।সে স্মৃতি এবং যন্ত্রণা এত সত্য,বাস্তব এবং তীব্র হয়,যে মানুষ সব ভুলে যায়,কিন্তু ওই কারাবাস ভোলে না।পাঁচু ওকে বলেছিল,"ভাইরে,আর যাই করিস,ভার্চুয়াল কারাবাস যেন না করতে হয়।"

পাঁচু একমাসের কারাবাসেই এত ভয় পেয়েছিল,ওর তো তেত্রিশ বছর!ও মরেই যাবে বোধহয়।

ও যখন বেরোল,দুপুর দুটো বাজে।মোটে তিনঘন্টা কেটেছে রায়ের পর।কিন্তু ওর কাছে সেটা তেত্রিশ বছর।ঘড়ির কাঁটাও বলছে তিনঘন্টা কেটেছে,কিন্তু ও যে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরছে, তা যদি ও ঘড়ির কাঁটা আর ক্যালেন্ডারের পাতাকে দেখাতে পারত!

ও ভেবেছিল কয়েকদিন কাজ করবে না।কিন্তু পরের দিন যখন আবার পেটের খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল।নিজের আইডিটা খুলল,দেখল ডেলিভারি চার্জ প্রায় দ্বিগুণ দিচ্ছে।একটু বেশিই ঝুঁকি যদিও,কিন্তু টাকা তো দিচ্ছে!

ওর কাছে মায়ের লাশ বিক্রি বাবদ বেশ বড় অংকের টাকা আছে।চাইলেই একটা ব্যবসা ও শুরু করতে পারে।কিন্তু আরো কিছু টাকা জমলে ব্যকআপ থাকবে,নিশ্চিন্তে ব্যবসা করতে পারবে।

ওর নজর পড়ল একটি বিশেষ অর্ডারের দিকে-মুমতাজ পারভিন,কাবাব অর্ডার করেছে। ও তাড়াতাড়ি একসেপ্ট করল।তারপর তাড়াতাড়ি রিয়াজের দোকান থেকে অর্ডারটা নিয়ে দৌড়ে গেল পরী মহল্লায় দিকে।

মুমতাজ উদ্বিগ্ন হয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।তাকে আসতে দেখে সে বাচ্চা ছেলের মতো নেচে উঠল।আর হাসতেই চারিদিক আলো হয়ে গেল। ও হাত নাড়ল মুমতাজকে ,সেও নাড়ল।

কাছে যেতেই সে সলজ্জ মুখে বলল,"কোথায় ছিলেন এতদিন?"

রোশন কিছু বলল না।

মুমতাজ আবার জিজ্ঞেস করল,"কী হল,কোথায় ছিলেন এতদিন?"

সে বেশ উদাসীনতার সাথে বলল,"সে অনেক কথা।"

মুমতাজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল,"বলা যাবে না?"

-"যাবে,তবে এখানে দাঁড়িয়ে বললে মার খাওয়ার সম্ভাবনা আছে।আমার এইটুকু শরীরে অতবড় জিন যদি একটা থাবড়া মারে,গেছি আর কি!আপনি তো দরজা লাগিয়ে চম্পট দেবেন।"

মুমতাজ লজ্জা পেল,মুচকি হেসে বলল,"সেদিন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কিন্তু আর পাব না,যাব না আর।"

তারপর খুব মৃদু স্বরে প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,"আপনি থাকলে।"

রোশনের মন নেচে উঠল খুশিতে।কিন্তু তা চেপে সে বলল,"এখানে বলা যাবে না।যদি আজ সন্ধ্যায় হজরতগঞ্জ পার্কে আসেন,বলতে পারি।"

"আচ্ছা",মুমতাজ দাঁড়িয়ে রইল।

রোশন -"আসি " বলে, চলে এল।পেছন ফিরে একবার দেখল,মুমতাজ তখনও তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ও মুখ ঘুরিয়েই দেখল একটা ষাঁড় ওর পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ ব্রেক কষতেই মুখ থুবড়ে গিয়ে পড়ল গোবরের উপর।

সন্ধ্যায় হজরতগঞ্জ পার্কের বেঞ্চে বসে ও পা দোলাচ্ছিল।একটা বাচ্চা বাদাম ভাজা বিক্রি করছিল। ও তাকে ডেকে দু ঠোঙা বাদাম নিল।দাম দেওয়ার সময় একটু বড়লোকি করল।জিনেরা যেমন করে,গোটা নোট দিয়ে বলে,"কিপ দ্য চেঞ্জ।"

ও বলল,"বাকিটা রেখে দে।"

ছেলেটা খুব খুশি হয়ে গেল।এরকম বিকেল খুব কম আসে।আকাশ মেঘে ঢেকে আসছিল,সব পরিষ্কার হয়ে ঝলমল করতে লাগল চারিদিক,পাখিরা হঠাৎ খুব খুশি হয়ে গান গেয়ে উঠল।

ঠিক এমন সময় যেন রাজেন্দ্রাণীর বেশে ওর সামনে এসে দাঁড়াল মুমতাজ। ও তাকে দেখে প্রায় অচেতন,ওর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল,মুমতাজ হেসে ওর কাঁধে ঠেলা দিল,"অ্যাই!"

ও একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,"এই, বসো বসো।"

তারপর এরকম মাস খানেক দেখাশোনা চলল প্রায়ই। কখনো পার্কে, কখনো কোনো রেস্তোরাঁয়,মুভি থিয়েটার ইত্যাদি সমস্ত সম্ভব এবং অসম্ভব জায়গায়।

মুমতাজ ওকে একবার ছোট করে একটা ফেলে দেওয়া চায়ের কাপের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ঢুকেছিল।এমন জায়গায় নাকি কেউ সন্দেহ করবে না।

কিন্তু যা হল,তার থেকে লোকের সন্দেহ হওয়া ভালো ছিল।চায়ের কাপটা সদ্য ফেলে দেওয়া।ওরা বসার কিছুক্ষণের মধ্যে একদল পিঁপড়ে এসে হাজির হল।খুব স্বাভাবিক ঘটনা।কিন্তু ওদের কাছে সেটাই কেয়ামতের মতো ব্যাপার হল।পিঁপড়েদের ঠেলায় ওরা না পারে চুপচাপ বসতে,না পারে পালাতে।তার মধ্যে একটা অতি উৎসাহী পিঁপড়ে এসে ওদের কামড় দেওয়ার চেষ্টা করল।মুমতাজ আগুনের ফুঁ দিয়ে ওদের তাড়াল।কিন্তু এরপর ওরা মরিয়া হয়ে উঠল।ওরা দুজন কোণঠাসা,এই পিঁপড়েরা ওদের ছিঁড়ে ফালাফালা করে ফেলবে,এমন সময় সারা পৃথিবী দুলে উঠল।

কিছুক্ষণ ওরা বুঝতেই পারল না কী হয়েছে।তারপর সবকিছু শান্ত হতে ওরা বুঝল,কেউ একজন কাপটাতে লাথি মেরেছিল।যাক,বেঁচে থাকুক বেচারা।

এরপর কিছুদিন খুব আনন্দে কাটল।

তারপর হঠাৎ একদিন ও ডেলিভারি দিতে যাচ্ছে,অজ্ঞান হয়ে রাস্তার মাঝে পড়ে গেল।উল্টো দিক থেকে একটা ডাম্পার আসছিল,সে ঠিক সময়মতো ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে যায়।তেমন চোট লাগেনি,কিন্তু ডাক্তার বললেন,শরীরে রক্ত খুব কম।খাওয়া-দাওয়ার পরিবর্তন করতে হবে।আপাতত ওষুধ দিচ্ছে,কিন্তু তা এইমুহুর্তের জন্য।

এরকম তো হয়। খাবার ঠিকঠাক খাওয়া হয় না,নিয়মকানুন কিছু নেই, হবে না তো কি?

কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর আবার একই কান্ড।ডাক্তার বললেন,"রক্ত তো আরো কমে গেছে।ওষুধ কি খাচ্ছেন না?"

ও 'খাচ্ছে',বলতে,ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন,"ওষুধ খেলে তো এতদিন স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার কথা।আচ্ছা আর এক সপ্তাহ খান,আশা করি ঠিক হয়ে যাবে।"

কিন্তু একসপ্তাহ যাওয়ার আগেই বিপত্তি।ওই ঘটনার ঠিক তিনদিন পর আবার সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ও অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল।ডাক্তার ওকে বিছানা ছেড়ে উঠতে মানা করলেন।

তাতে অবস্থার উন্নতি হল আশ্চর্যজনকভাবে।কিন্তু ওর মন খারাপ।মুমতাজের সাথে দেখা হয়নি এই কদিন।এক সপ্তাহ হতে চলল।

পরের দিন মুমতাজ হাজির হল। ও যতটা অবাক হল,খুশি হল তার থেকে বেশি।ছুটে গিয়ে মুমতাজকে জড়িয়ে ধরে বলল,"তুমি জানো,তোমাকে কত মিস করেছি?"বলেই সারা গাল চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল।

মুমতাজ,"এই ছাড়ো,ছাড়ো,"বলে কপট লজ্জা ও রাগের ভাণ করতে লাগল।কিন্তু তাতে প্রশ্রয় ছিল বেশি।

ওরা অনেক গল্প করল।মুমতাজ চলে যেতেই ওর মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।

এরপর একদিন ছাড়া ছাড়াই মুমতাজ আসতে লাগল।আবার ওর শরীর খারাপ হতে লাগল।অবশ্য ও এসব খেয়াল করল না।

এরপর শরীর আরো খারাপ হলে ডাক্তার ডাকা হল।ডাক্তার সব দেখে শুনে বেশ চিন্তিত হলেন।তিনি যেটা সন্দেহ করছিলেন সেটাই নয় তো!

তিনি জিজ্ঞেস করলেন,"কোনো পরীর সাথে তোমার মেলামেশা আছে?"

রোশন প্রথমে বলতে চাইল না।তারপর ডাক্তার একটু ধমক দিতে বলল,"হ্যাঁ ,আছে।কিন্তু একথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?"

ডাক্তার ও কথার উত্তর না দিয়ে বললেন,"তোমাকে এক্ষণি ওর সাথে ঘোরা বন্ধ করতে হবে।"

-"কিন্তু কেন?ওর সাথে ঘোরার সাথে আমার শরীর খারাপের কী সম্পর্ক?"

-"সম্পর্ক আছে,আর সেজন্যই বলছি।কথা শোনো,নইলে বাঁচবে না।"বলে ডাক্তার চলে গেলেন,আর দাঁড়ালেন না।

রোশন উভয়সংকটে পড়ল।সে ভাবল,ডাক্তারকে না জানালেই চলবে।ডাক্তার কী আর জানতে পারবে?

ওদের মেলামেশা চলতে লাগল।আর রোশনের অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল।এবারে ওর চেহারা অস্থিচর্মসার হয়ে গেল।কিন্তু ও খুব খুশি।

জমানো পুঁজি আর মায়ের লাশ বিক্রি করে যা পেয়েছিল,সব চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেছে।ডাক্তার বলেছে,ও যদি মুমতাজের সাথে মেলামেশা বন্ধ না করে,আর একমাস বাঁচবে।"যত্তসব বোগাস কথাবার্তা!মরবে তো মরবে।"

এখন ও মাকে দেখতে পাচ্ছে সারাক্ষণ। দিনেরবেলায় বা জেগে অস্পষ্ট,ধোঁয়া ধোঁয়া।কিন্তু যত রাত বাড়ে তত স্পষ্ট হতে থাকে,ঘুমালে জীবন্ত হয়ে ওঠে।মায়ের চোখে একটা অদ্ভুত বেদনা থাকে,যেন বলেন,"বাবা,এত অপদার্থ তুই?আমার সৎকার তো করতে পারলি না,তার উপর আমার লাশটাও বিক্রি করে দিলি?এতই টাকার অভাব তোর? ছি!"

এই ' ছি ' বলার সময় থুতুটা প্রতিবারে তার মুখে এসে পড়ে।

যতদিন যাচ্ছে মায়ের ভর্ৎসনা আরো তীব্র,আর ভয়ংকর হচ্ছে।ও আত্মগ্লানিতে আর ঘুমাতে পারে না।ও পাগল হয়ে যেতে লাগল।মুমতাজ এখন দিনে দুবার করে আসে।সে আসলেই শুধু ও একটু ভালো থাকে।কিন্তু ও জানে,ওর হাতে এক সপ্তাহের বেশি সময় নেই।

এর পরদিন থেকে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল শরীরে।ওর শরীরের চামড়া কেমন শক্ত আর উজ্জ্বল হচ্ছে।ওর হাত আর পা দুটো দুভাগে ভাগ হচ্ছে।ওর গলার আওয়াজ, মুখের গঠন সব পাল্টে যেতে লাগল আর পরের কয়েকদিনে।

এক সপ্তাহের পর ও পুরো একটা আট পাওয়ালা পোকায় রূপান্তরিত হয়ে গেল।

সেদিন ওর বস আর কোম্পানির মালিক দেখা করতে এলেন ওর সাথে। ও নিজের শরীর আর রূপ নিয়ে খুব অপ্রস্তুত হল,দরজা খুলতে চাইল না প্রথমে।কিন্তু,ওদিক থেকে ক্রমাগত আশ্বাসের বন্যা আর টোকার বৃষ্টিতে বাধ্য হয়ে দরজা খুলতে হল।

ও আবার আশ্চর্য হল।যেন এই কদিন সারা পৃথিবী ওর স্নায়ু,দেহ,মন সবকিছুর চরম পরীক্ষা নিচ্ছেন।

ও নিজের মনে মনেই ভাবল,"ঈশ্বর আমার কী অপরাধ,কেন আমার এমন পরীক্ষা নিচ্ছেন?"

কিন্তু ঈশ্বর শুনলেন না।ঈশ্বর বলে কেউ কোনোদিন ছিল কি?ওর সন্দেহ হতে লাগল।ওর বিস্ময়ের আরো বাকি ছিল।

ও যাদের মানুষ বলে জানত,ওর বস আর মালিক,ওরা দুজনেই আসলে জিন।মানুষের রূপ ধরে ছিল। ও জানতে পারল, ও যে ব্যবসা করার স্বপ্ন দেখছিল,হাজার চেষ্টা করলেও সফল হত না।কারণ,তার জন্য জিন হওয়া প্রথম শর্ত।ও সেসব শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না।কিন্তু ততদিনে ও কাঁদার ক্ষমতা হারিয়েছে।ও আরও দেখল,অবাক হতে চেয়েও হতে পারল না।ওর অবস্থা দেখে ওরা খুব দুঃখ প্রকাশ করলেন।আর কিই বা করতে পারেন ওরা!

ওকে অনেক ফল আর কিছু সাপ্লিমেন্ট দিয়ে ওরা চলে গেল।

সন্ধ্যায় মুমতাজ এল।ও হঠাৎ বলল,"আচ্ছা মুমতাজ,একটা কথা জিজ্ঞেস করব,সত্যি বলবে?"

মুমতাজ একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলল,"কী বলো।"

"মিথ্যা বলবে না কিন্তু।মৃত্যুপথযাত্রীকে এটুকু দয়া করো।"

"আচ্ছা বলব,বলো।"

"তুমি কি আমাকে সত্যি ভালবাসতে?বিয়ে করতে আমায়?"

মুমতাজ একটুক্ষণ চুপ রইল।তারপর হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বলল,"আচ্ছা তুমি শুনতে চাও,তাই বলছি। হ্যাঁ ভালবাসতাম।তবে তুমি যেভাবে ভাবছ,সেভাবে নয়।"

"তাহলে?"

"এই ধরো তুমি কুকুর পুষলে,তাকে কি তুমি ভালোবাসো না?"

"ওইরকম ভালবাসতে তুমি আমায়?কুকুর ছিলাম আমি?"

"ঠিক কুকুর নয়।তবে ওরকমই ধরো।মানুষ আর পরীর কখনো বিয়ে হয় কি?তুমি অলীক কল্পনা করছিলে।"

"তুমি আমাকে ঠকালে!....."আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল,কিন্তু ওর কন্ঠ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে গেল।আর কিছু বলতে পারল না।

"আমি ঠকাইনি তোমাকে।কোনোদিন চাইনি।তুমি যদি বেশি বেশি ভেবে থাকো,সেটা কি আমার দোষ?"

রাগে দুঃখে রোশন পাগলপ্রায় হয়ে গেল।ওর মনে হল,এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে মুমতাজের মাথাটা দেওয়ালে ছুঁড়ে মারে।মাথাটা ফেটে গেলে পায়ের জুতো দিয়ে সেটাকে পিষে ফেলে,যতক্ষণ না সব মেঝের সাথে মিশে যায়।

বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে,সমস্ত শক্তি জোগাড় করে বলল,"আচ্ছা,আর একটা কথা।ডাক্তার আমায় বলেছিল তোমার সাথে না মেলামেশা করতে।তাহলে নাকি আমি বেঁচে যেতাম।কেন বলো তো?মিথ্যা বোলো না কিন্তু!"

মুমতাজ আবার খানিকক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ বসে রইল।তারপর ওরকমভাবে বসে থেকেই বলল,"আমি রক্ত খেতাম তোমার।"তারপর মুখ তুলে খুব অস্থির,অসহায় ভঙ্গিতে বলতে লাগল,"কোনো উপায় ছিল না বিশ্বাস করো।তোমার রক্ত না খেলে আমি বাঁচতাম না।আমার এই সৌন্দর্য রক্ত না খেলে থাকে না।আমরা যে পাঁচশ,হাজার,দুহাজার বছর বাঁচি, তা ওই মনুষ্য রক্তের দৌলতেই।আমি প্রথমে খেতে চাইনি,কিন্তু এই রূপের নেশা যে কি মারাত্মক,তুমি জানতে পারবে না কোনোদিন।আর সেজন্য তোমাকে হিংসা করি না।"বলেই মুমতাজ ওর পা ধরে কাঁদতে লাগল।

রোশন সমস্ত ঘৃণা গলায় এনে বলল,"তুমি এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে চলে যাও।আমার উপরে এইটুকু দয়া করো।চলে যাও।"

মুমতাজ কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল।

ঠিক সেই সময় মায়ের মূর্তিটা শরীর ধারণ করল।ওর শরীরের দুপ্রান্ত দুই আঙ্গুলে ধরে ঘরের কোণে থাকা একটা জলের হাঁড়িতে ফেলে দিল।ওর একটা অদ্ভুত দমবন্ধতা অনুভব হল।এখন জল ওর নাক নয়,শরীরের পাশের ট্রাকিয়াগুলোর মুখ রুদ্ধ করেছে। আস্তে আস্তে ওর শ্বাস বোধ হয়ে আসতে লাগল।জ্ঞান হারানোর আগেও ও দেখল,ওর মা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে।ওর দিকে আঙুল দেখিয়ে সে কী উল্লাস!

.    .    .

Discus