Photo by Sonika Agarwal on Unsplash

“অন্তহীন এক রাত্রির নাম শ্যামা যার ভিতরে জায়মান অনন্ত সকাল। কোথাও কোনও ঘর নেই তাঁর, এই পৃথিবীই পথ/ তাঁর পায়ের নীচে, ক্রমাগত, শব পালটে হয়ে যায় শিব!”

কালী কালের দেবতা, সে কাল খন্ডিত কাল।খন্ডিত কালের মূর্তি বড় ভয়ঙ্কর, কিন্তু কাল(মহাকাল) যেখানে অখন্ড, অনন্ত; সেখানে সে প্রশান্ত। খন্ডিত কালের মূর্তি (কালী) যেমন বিক্ষুব্ধ, মহাকালের মূর্তি (শিব) তেমনি সমাহিত| কিন্তু যে মুহূর্তে অস্থির, অশান্ত খন্ডিত কাল মহাকালের ওপর দিয়েই পদচারণা করেছেন; সেই মুহূর্তে লজ্জায় জিভ কেটেছেন।

সৃষ্টি থেকে লয় সমস্তই 'কলন' অর্থাৎ গ্রাস বা কালগ্রস্ত করেন বলেই তিনি জগৎ-সংহারক 'মহাকাল' নামে কীর্তিত। আবার মহাপ্রলয় কালে সেই মহাকালকেও যিনি গ্রাস করেন বা নিজ অঙ্গে লয় করে নেন, তিনিই 'করাল-বদনা কালী'। আদ্যাপরাশক্তির আদি রূপ হলো কালী; তিনি সংহারকর্ত্রী এবং শক্তির দেবী-তিনিই দশমহাবিদ্যার প্রথমা এবং দনুজদলনীরূপে খ্যাতা। দেবী নিত্যা।তিনি সর্বত্রই বিরাজমানা। তিনি সত্যস্বরূপিনী । সত্য উলঙ্গ, তাই দেবীর আদিরূপ উলঙ্গিনী। তদুপরি কাল থেকে কালীর উৎপত্তি,তাই অনন্তকে বা সর্বব্যাপী ব্রহ্মকে কোন জাগতিক বস্ত্রের আবরণে আবৃত করা যায় না। দেবী তাই নগ্নিকা বা দিগম্বরী। মনে করা হয়, সৃষ্টির আদিতে যখন ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়নি, যখন জন্ম হয়নি ত্রিদেবেরও, তখন কোথাও ছিল না সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রের আলোক রশ্মি, ঠিক তখনই সমগ্র চরাচরে বিচরণ করতো নিকষ কালো অন্ধকার। এই অন্ধকার দেবী কালীর প্রতিভূ। তাই তন্ত্রশাস্ত্রে তিনিই পরমব্রহ্ম। 'কালী' এই শব্দ উচ্চারণ করলে 'কাল-ই' বা 'কাল-ঈ' বোঝায় । অনাদি কাল থেকে মহাকালের অন্তর্গত খন্ডকালের মধ্যে সংসারের নিত্য সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় কার্য্য যা অহরহঃ অবিরত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেটাই যিনি 'ঈ' বা ঈক্ষণ করছেন তিনিই কাল -ঈ - আদ্যা শক্তির সংহারকারী রূপ- সাধকের ধ্যেয়।

আলোকবিজ্ঞানের মতে কালো কোন পৃথক রং নয়, সকল রংয়ের মিশ্রণ বা সব রং একত্রে শোষিত হলে কালো দেখায়। তাই অনন্ত মহাকাশ কৃষ্ণ বর্ণের এবং কালো রং হলো অনন্তের প্রতীক। দেবী কালীও অনন্তের প্রতীক। তিনি প্রলয়কালে সমস্ত জগৎ নিজের মধ্যে বিলীন করে নেন; তাই তিনি কৃষ্ণবর্ণা । তিনি ব্রহ্মময়ী- গুণাতীতা হয়েও গুণময়ী। তাঁর করাল মুখমণ্ডলে ঘোরদংষ্ট্রা সংহারকারিণী শক্তির প্রকাশ। অপরদিকে তাঁর পীযূষ পয়োধর যুগল মাতৃত্বময়ী মোক্ষদায়িকা রূপের প্রকাশ অর্থাৎ তিনি একদিকে দুষ্টের তমোময় নিয়তি ও অন্যদিকে শরণাগতের পালনকারিণী মা|

দেবী লাল জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছেন; এই রূপের তাৎপর্য হল লাল জিহ্বা রজঃগুণের প্রতীক আর সাদা দাঁত হলো সত্ব গুণের প্রতীক । লাল জিহ্বাকে সাদা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরার অর্থ হলো সত্ব গুণ দ্বারা রজঃগুণকে (অহংকার, হিংসা ইত্যাদি) দমন করা অর্থাৎ এই রূপের দ্বারা তিনি সমগ্র জগতকে আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দিচ্ছেন |

দেবীর তিন চোখ তিনটি আলোর প্রতীক- চন্দ্র, সূর্য ও অগ্নি। অজ্ঞান, অন্ধকার বিধ্বংসী তিনশক্তির প্রকাশ তিন চোখে; দেবী অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে প্রত্যক্ষ করেন|

কেশ বা চুল হল মায়া শক্তির প্রতীক। তিনি স্বয়ং মহামায়া আর তাঁর উন্মুক্ত কেশরাশি হল সেই মায়াপাশ। তিনি মায়ার বন্ধন মুক্ত। কোমরের নিচ পর্যন্ত তাঁর কেশ উন্মুক্ত যা দিয়ে তাঁর পশ্চাৎ ভাগ আবৃত অর্থাৎ তাঁকে কেউ অতিক্রম করতে পারে না।

দেবীর চার হাত উপর ও নিচে; উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত অর্থাৎ তিনি সর্বত্র বিরাজিতা| তিনি চতুর্ভুজে খড়্গ-মুন্ড-বরাভয়ধারিণী | ওই বৈপরীত্যের অর্থ হল দেবীই সৃষ্টি-স্থিতি বিনাশকারিণী। তাঁর হাতের খড়্গ মানুষের অহং ছিন্ন করার প্রতীক-সমস্ত জাগতিক মোহজাল ছিন্ন করে | সেই খড়্গের আঁকা চোখ প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের প্রতীক। সাধকের মুক্তির পূর্বে এই জ্ঞান রূপ অসির দ্বারা তিনি মুক্তিকামীর অষ্টপাশ ছেদন করেন|

দেবীর এক হাতে নরমুণ্ড । মুণ্ডই আদিবর্ণ ওঙ্কার, এই ওঙ্কারেই জগতের উৎপত্তি স্থিতি ও বিলয়| আবার হাতের নরমুণ্ড নির্দেশ করে যে, তিনি মানুষের জ্ঞানকে হাতে ধারণ করেন।অপরদিকে অভয় মুদ্রায় তিনি শরণাগতকে সর্বদা রক্ষা করেন আর বর মুদ্রায় তিনি ধর্ম-অর্থ-কাম- মোক্ষ-ভক্তি প্রদান করেন।

মা কালীর গলায় ৫০ টি নরমুন্ডের মালা শোভা পায়|কালীর আভরণের মুণ্ডমালা প্রথমত ও প্রধানত কৈবল্যের প্রতীক | কারো কারো মতে এই পঞ্চাশটি মুন্ড ৫০ টি বর্ণের প্রতীক অর্থাৎ তিনি সর্ববিদ্যাময়ী ও সর্বমন্ত্রময়ী | অক্ষর ব্রহ্ম থেকে আদি ধ্বনি প্রণব বা ওঙ্কার উত্থিত হয়েছিল, তার থেকে এই পঞ্চাশ বর্ণের উৎপত্তি- জগতের বিস্তার।

মায়ের সর্বাঙ্গে রক্তের ধারা | রক্তের লাল রং রজঃগুণের প্রতীক। রক্তধারা কর্মময়তার প্রতীক। আবার হাত হলো কর্মের প্রতীক, দেবীর কটিদেশ আচ্ছাদিত থাকে কাটা হাত দিয়ে । অর্থাৎ তিনি সকল কর্মের ধাত্রী ও ফল প্রদাত্রী।

দেবী এক পা শবরূপী শিবের বক্ষে স্থাপন করে দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে এগিয়ে রাখা চরণ গতির প্রতীক। তিনি পশ্চাত্যের পদে অতীতকে এবং সম্মুখের পদে ভবিষ্যৎকে অধিকার করে গতিশীলা| আবার শিব পরমপুরুষ, কালি পরমা প্রকৃতি। শিব চৈতন্যশক্তি- কালী ক্রিয়া শক্তি | শিব স্থির- কালি গতিময়ী । গতি ঠিক রাখতে স্থিরের উপর প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন| অন্য মতে তিনি মহাকালকে নিজের পদতলে ধারণ করে সৃষ্টি -স্থিতির ভারসাম্য রক্ষা করছেন ; তাই তিনিই সদাশিব মহাপ্রেত রূপে পদ্মাসনে আরূঢ়া। এই কল্পিত রূপেই শক্তির দ্বিবিধ রূপের সমাহার। একদিকে তা বিনাশী অন্যদিকে তা সৃষ্টিরও প্রতীক। কালীর মৃত্যু রূপা চরিত্র কল্পনার সূত্রেই পদতলে শবদেহের অবস্থান ঘটেছিল যা কালক্রমে শিব রূপে কল্পিত হতে থাকে। মূলত ঋক বেদের ‘রাত্রি সূক্তে’ যে দেবীর খোঁজ মেলে তাঁকেই কালীর আদি সূত্র বলে মনে করা হয়|

দেবীর রূপ বিভিন্ন। উগ্ররূপে সৌম্যরূপে সততই তিনি পূজিতা।সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবী কালীর সংহারকারী ভয়ংকর রূপকে ক্ষেমংকরী হিসেবে পূজা করেন। দেবী অশুভ শক্তিকে নাশ করে শুভ শক্তিকে জাগ্রত করেন ।

দেবী কালীকে আদি বঙ্গদেশে গৃহীদেবী রূপে পূজা করা হতো না। তিনি ছিলেন কেবল মাত্র শ্মশানচারিণী রক্তভোক্ষ্যা ভয়ংকর দেবী। গৃহস্থ্যের মনে তিনি তখনও স্থান পাননি মঙ্গলময়ী রূপে। তাঁর ভীষণদ্রষ্টা রূপ গৃহে স্থান পায় অষ্টাদশ শতাব্দীর নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে। দেবীর বর্তমান রূপটির প্রবর্তক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। যিনি আগমশাস্ত্রের প্রণেতা।

লোককথা অনুযায়ী ভূত চতুর্দশীর রাতে মর্ত্যে নেমে আসেন চৌদ্দভূত; মা কালীর চৌদ্দজন বিশেষ অনুচর।পাণ্ডুরাজার ঢিবির সময় থেকে বাঙালির তন্ত্রসাধনার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে। চৌদ্দভূত সেক্ষেত্রে সেই বিস্মৃত অতীতের তন্ত্রধর্মের আদিতম রূপটির সাথে সংযুক্ত। পাঁচজনের মণ্ডল কল্পনা বাঙালির প্রাচীন মাতৃকা উপাসনার একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। চারজন সন্তানকে নিয়ে সপরিবার মহামায়া দুর্গার রূপ সেভাবেই এসেছে। ঐ পাঁচজনের মণ্ডল কল্পনাই সম্ভবত তন্ত্রে সত্ত্ব,রজঃ,তমঃ- এই তিন গুণের ভিত্তিতে পনেরো জনের মণ্ডলে বিকশিত হয়েছে। সেখানে আদিমাতৃকা ছাড়া থাকেন আরো চৌদ্দ জন।প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কালীপুজোর সময় আমরা আজও দেবীর পঞ্চদশ নিত্যার আরাধনা করে থাকি |

কিন্তু এই চৌদ্দজনকে ভূত বলা হয় - তার কারণ হিসেবে ধরা হয় ; তন্ত্রের গরিমাময় রূপকে আমাদের সমাজে অনেক সময়েই ভয়াল রূপে দেখার একটা প্রবণতা আছে। পালযুগের জ্ঞানী সাধিকাদের ডাকিনী বলা হতো। 'ডাক' শব্দের অর্থ জ্ঞান। তিব্বতের শ্বেতবর্ণ ভিক্ষুণীদের শঙ্খচূর্ণী বলা হতো। শাঁখের চূর্ণের সাথে তাঁদের গাত্রবর্ণকে তুলনা করা হতো। অথচ আজ ডাইনি ও শাঁখচুন্নি বাঙালির মননে দুই ভয়ঙ্করতম অপ্রাকৃত অস্তিত্ব। মানবমন তাকেই ভয় করে যাকে সে বুঝতে পারে না| মাতৃকার চৌদ্দজন সঙ্গীও হয়তো সেভাবেই চৌদ্দভূত হয়ে গেছেন।

পৃথিবীর যেখানেই প্রাচীন তন্ত্রধর্মের প্রভাব ছিল; সেখানেই ভূতচতুর্দশীর ছায়াসম্পাত। ইউরোপের Halloween night তারই সাক্ষ্য বহন করে। দীপাবলির প্রদীপ জ্বালানোর মতো করেই সেখানেও jack-ó-lantern জ্বালানোর রীতি আছে। এই বিশেষ আলোটিকে বলা হয় সেইসব ভূতেদের স্মৃতি; যাঁরা স্বর্গ ও মর্ত্য কোনোটিকেই বরণ করেন নি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ভৌতিক পরাবাস্তবতা এবং অতীতচারণের ঐতিহ্যের সমন্বয়ে ভূত চতুর্দশী প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত এক নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরার চিহ্ন হয়ে আছে।

কিন্তু ভৌতিক রূপে হলেও আজও বাঙালির মননে তাঁদের অমোঘ উপস্থিতি। আবার চৌদ্দভূতের এক অর্থ চৌদ্দ পুরুষও হয় | এই তিথি ভূতকাল অর্থাৎ অতীতের চতুর্দশ প্রজন্মকে স্মরণ করার তিথিও। এই রাত বছরের অন্ধকারতম রাত। পিতৃ ও মাতৃবংশের পূর্বসূরিদের স্মরণ যেন ইতিহাসচেতনার দীপশিখা হয়ে উত্তরসূরিদের পাথেয় হয়ে উঠতে পারে; আত্মবিস্মৃতির প্রগাঢ় অন্ধকার যেন গ্রাস না করে; এই রীতি যেন তারই আকুল প্রয়াস। সম্ভবত এই কারণেই কালীপুজোর রাতে আগুন জ্বেলে আকাশের দিকে দেখিয়ে পূর্বসূরিদের পথ দেখানো হয়। যেহেতু মাকালী কালভয়হারিণী, ত্রিনয়নে তাঁর চন্দ্র-সূর্য-অগ্নি অনন্ত কোটি প্রদীপ্ত তারকা; তাই তিনিই পিতৃপুরুষদের পথপ্রদর্শক। তাঁর আলোকেই অন্ধকার থেকে জ্ঞানের পথে, শাশ্বত মুক্তির পথে মানুষ গমন করতে পারে বলেই দীপাবলির সাথে কালীপূজা জড়িয়ে আছে।তাই তাঁদের স্মরণে হেমন্তের আগমনকালে জ্বালানো হয় চৌদ্দ প্রদীপ। বাঙালির প্রধানতম মাতৃকার উপাসনার কালে অতীতচারণের এই পরম্পরা আজও শাস্ত্রে ও জনজীবনে সমান প্রাসঙ্গিক। তবে অন্ধকারতম রাত্রিকে দীপমালায় আলোকিত করে তোলার এই ঐতিহ্য সম্ভবত হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকে চলে আসছে।

আর একটি বিশেষ নিয়ম এই ভূত চতুর্দশীর দিন পালন করা হয়। সেটি হল চৌদ্দ শাক খাওয়া। অঞ্চলভেদে এই তালিকায় তারতম্য থাকলেও এদের মূল বৈশিষ্ট্য একই। এই দিন চৌদ্দ শাক সংগ্রহ ব্যাপারটি প্রাগৈতিহাসিক যুগের ক্ষীণ স্মৃতি বহন করে।এই বিশেষ দিনে পূর্বপুরুষরা মর্তে আসেন। কথিত আছে এই চৌদ্দ পুরুষ জল, মাটি , বাতাস ও অগ্নির সঙ্গে মিশে রয়েছেন। আর এজন্যই এই দিনে মাটির মধ্যে জন্মানো ১৪ টি বিশেষ শাক খেয়ে চৌদ্দ পুরুষদের উৎসর্গ করা হয় | আবার অন্য মতে চৌদ্দ ভুবনের অধীশ্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে চৌদ্দ শাক খাওয়া এবং চৌদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হয়| তবে এই শাক খাওয়ার পিছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক কারণ। আশ্বিন ও কার্তিক মাসকে যমদষ্টা কাল বলা হয়। এই সময় শীতের মরসুম শুরু হয়। যার ফলে মানুষের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই রোগভোগ থেকে রক্ষা পেতে এই ১৪ শাক খাওয়ার নিয়ম রয়েছে।

অনুমান করা হয় আদিমকালে আগুন আবিষ্কারের পর মানুষ গুহা মুখে আগুন জ্বালিয়ে রাখতো হিংস্র জীব-জন্তুদের তাড়ানোর জন্য ; তেমনি ভুত-প্রেত অশরীরীদেরও ওই আগুনের মাধ্যমে তাড়ানো সম্ভব ছিল বলে কল্পনা করা হতো । তাই কালীকে মৃত্যুদেবী রূপে পূজা করা শুরু করলে অগ্নি প্রজ্বলনের সংস্কার এই দীপ জ্বালানোর মধ্যে অনুবর্তন হয়ে এল ধীরে ধীরে।

দীপান্বিতা অমাবস্যার প্রধান আরাধ্য দেবী হলেন দক্ষিণা কালী। দীপাবলি বা দীপোৎসব হলো আলোর উৎসব । কার্তিক মাসের অমাবস্যার সন্ধ্যায় আলো-কে বরণ করার এই উৎসব বাংলা তথা ভারতবর্ষের নানা জায়গায় পালিত হয়। আবার জৈন মতে, ৫২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন। ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলির দিন মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উৎসব পালন করেন। আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করেন । তাঁরা এই দিনটি "শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি" হিসেবেও পালন করেন। তবে বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দীপাবলি আর কালীপূজা মিলে মিশে এক হয়ে গেছে|

অন্যমতে বলা হয় ভগবান শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ করে অযোধ্যায় ফিরে আসার পর প্রজারা অযোধ্যায় আলোকসজ্জা করে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল | অশুভ অকল্যাণের প্রতীক অন্ধকারকে দূর করে শুভ ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠার প্রতীকী রূপে এই উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই আলো আর উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল |

দীপাবলি ও কালীপূজা এই দুটি উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য হল আলো এবং শক্তির প্রতীকী প্রকাশ, যা অন্ধকার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বিজয়, আত্মবিশ্বাস এবং আত্মার শক্তির পরিচায়ক। দীপাবলিতে আলো জ্বালিয়ে জীবনের নানা বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে নতুন করে পথচলার আহ্বান জানানো হয়- আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ইতিবাচকতা এবং মানসিক শক্তি জাগ্রত করার আহ্বান জানায়|

অপরদিকে দীপাবলির আলো যেমন নতুন আশা ও শান্তির প্রতীক, তেমনই কালীপূজায় দেবী কালী পূজিতা হন শক্তি ও রুদ্ররূপের মূর্ত প্রতীক হিসেবে । শক্তির এই প্রতীকী আরাধনা মূলত মানব জীবনের কঠিন সময়ে আত্মশক্তি , দৃঢ়তার পরিচায়ক; ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায়কে পরাস্ত করা ; দেবীর এই রূপে শুধু ধ্বংস নয়, বরং আশ্রয় ও সুরক্ষার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাওয়া যায়। জীবন সংগ্রামে সকল বাধা অতিক্রম করে নিজের শক্তির সন্ধান খুঁজে বের করার শিক্ষাও দেয়; আবার দেবীর মুখে রক্ত চিহ্ন এবং অসুর বিনাশের রূপকে আমরা সাহসের এক অসামান্য দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখি, যা প্রতিটি মানুষের জীবনে অনুপ্রেরণা হতে পারে। দুই উৎসবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, অন্যায় এবং অন্ধকার যতই প্রবল হোক না কেন, শক্তি ও আলো সর্বদা বিজয়ী হয়।

অন্ধকারকে জয় করার প্রবল ইচ্ছাটুকুই ফুটে ওঠে আলোয় আলোয়। উৎসবের এত আলোর মধ্যে বহু হাজার বছরের সাধনার রঙিন একটা ছবি মনের গভীর থেকে একেবারে চোখের সামনে বাস্তব হয়ে জেগে ওঠে। দীপাবলি উৎসবের আলোকসজ্জায় আমরা প্রার্থনা করি আলোর যাত্রাপথে এগিয়ে যাওয়ার। মাতৃ শক্তির আরাধনার পরিসমাপ্তিতে দীপাবলির দীপশিখায় চারিদিক হয়ে উঠুক আলোকময়|

অগ্নির সপ্তজিহ্বার অন্যতমা কালী। তাই আঁধার সমুদ্রে জেগে থাকে চিরন্তন জ্যোতির উদ্ভাস।

.    .    .

তথ্যঋণ:

  • সুধীর কুমার মিত্র: দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী
  • শশীভূষণ দাশগুপ্ত: ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য, সাহিত্য সংসদ, প্রথম সংস্করণ
  • Narendra Nath Bhattacharya: History of Shakta religion
  • মধুমিতা দত্ত গৌহাটি , আসাম

Discus