Image by Kanenori from Pixabay

মানব ইতিহাসে আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম চিরকালই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে যুগ যুগ ধরে উদযাপিত বিভিন্ন উৎসব শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং মানবতার পথে চলার নির্দেশও দেয়। রাস পূর্ণিমা ও গুরু নানকের জন্মবার্ষিকী, এ দুটি উৎসব আধ্যাত্মিকতার এক গভীর মেলবন্ধন তৈরি করে যা আমাদের জীবনে প্রেম, সমবেদনা এবং একতার বাণী প্রচার করে। এই দুটি উৎসব কেবল আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নয় বরং মানুষের ভেতরকার আলোককে জাগিয়ে তোলে। রাস পূর্ণিমার আলো যেমন আকাশে এক আলোকময় পরিবেশ সৃষ্টি করে; আমাদের হৃদয়ে ভক্তির অনুরাগ জাগায় তেমনি গুরু নানকের শিক্ষা মানবসমাজে সমতা, সহানুভূতি, এবং নিঃস্বার্থ সেবার উপর ভিত্তি করে এক সমৃদ্ধ জীবন গঠনের আহ্বান জানায়; মানবতার আলোকে সত্য, করুণা ও ভালোবাসার পথে নিয়ে যায়।

রাস মূলত কৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় সনাতন ধর্মালম্বীদের অনুষ্ঠিত ধর্মীয় উৎসব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের রসপূর্ণ অর্থাৎ তাত্ত্বিক রসের সমৃদ্ধ কথাবস্তুকে রাসযাত্রার মাধ্যমে জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায়, দৈনন্দিন জীবনের সুখানুভূতিকে আধ্যাত্মিকতায় এবং কামপ্রবৃত্তিসমূহকে প্রেমাত্মক প্রকৃতিতে রূপ প্রদান করে অঙ্কন করা হয়েছে।

বৈষ্ণব পদাবলীতে পাঁচটি রস - শান্ত, দাস্য , সখ্য , বাৎসল্য , মধুর । রাস শব্দটি এসেছে 'রস'থেকে। রাস হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে মধুর রস। মধুর রসে কৃষ্ণ এই লীলা করেছিলেন বলে এর নাম রাসলীলা। এই লীলা ভগবানের সব থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ লীলা এবং চিন্ময় স্তরের সর্বোচ্চ উপলব্ধি। রাসলীলায় ছিলেন তিন শ্রেণির গোপী-নিত্যসিদ্ধা, সাধনসিদ্ধা ও কৃপাসিদ্ধা।নিত্যসিদ্ধা গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের নিত্য পার্ষদ।তাঁরা ইহ জগতের বন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে শুদ্ধ এবং শ্রীকৃষ্ণের সাথেই থাকেন। সাধনসিদ্ধা বলতে বোঝায় যারা সাধনা করে শুদ্ধ হয়েছেন, যেমন,ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রী শ্রী রামচন্দ্র যখন শ্রীমতি সীতাকে নিয়ে দন্ডকারণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, সেইসময় তাঁর সেই রূপ দর্শন করার পর দন্ডকারণ্যের ঋষিরা যাঁরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধ্যান করছিলেন,তাঁরা ভগবানকে পতিরূপে পেতে চেয়েছিলেন। ভগবান শ্রী শ্রী রামচন্দ্র তখন তাঁদের বলেছিলেন,''আমি যখন দ্বাপরের শেষে কৃষ্ণরূপে লীলা করতে আসবো, তখন তোমাদের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করব।“ তাই তাঁরাও রাসলীলাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া ছিলেন দেবকন্যা,ঋষিকন্যা, গান্ধর্ব কন্যা|

রাসলীলা প্রসঙ্গে কথিত আছে , শ্রীকৃষ্ণ যখন ইহ জগতে আবির্ভুত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে ভৌম বৃন্দাবনে দিব্যলীলা বিলাস করেছিলেন, তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল আট বছর।কৃষ্ণ শরৎ পুর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনের কুঞ্জে মধ্যরাতে তাঁর অপ্রাকৃত বংশীধ্বনি দ্বারা প্রিয় ভক্ত গোপীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন।তখন সেই রাতে শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ নিজেদের কর্তব্যকর্ম বিসর্জন দিয়ে সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন। নিত্যসিদ্ধ এবং সাধনসিদ্ধ সকলকে তিনি সেদিন আহ্বান করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন; বলেন, তাঁদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন। ভগবান ভক্তের অধীন। শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাঁদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। কিন্তু যখনই শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের অধীন হয়ে গেছেন ভেবে গোপিনীদের মন গর্ব-অহংকারে পূর্ণ হলো, তখনই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের মধ্য থেকে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন। তখন গোপিনীবৃন্দ নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। শ্রীকৃষ্ণ ত্রিজগতের অধীশ্বর, তাই কোনো মায়িক বন্ধনে তাঁকে আবদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাঁর বিচ্ছেদে গোপিনীরা একাগ্রচিত্তে তাঁর মহিমা কীর্তন করতে শুরু করলেন।ভক্তের ভক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান গোপিনীদের মানব জীবনের পরমার্থ বুঝিয়ে দিয়ে তাঁদের অন্তর পরিশুদ্ধ করেন। গোপিনীদের ইচ্ছাকে তিনি সম্মান জানিয়ে ‘যতজন গোপিনী, ততজন কৃষ্ণ’ হয়ে গোপিনীদের মনের অভিলাষ পূর্ণ করেছিলেন আর গোপীবৃন্দও জাগতিক ক্লেশ থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। এইভাবে জগতে রাসোৎসবের প্রচলন ঘটে এবং বৃন্দাবনের এই নৃত্যই রাসনৃত্য বলে সুপরিচিত।

তবে কারো কারো মতে - কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরে শ্রীকৃষ্ণ পাপমোচনের জন্য গঙ্গা স্নান করার স্বপ্ন দেখেছিলেন আর তার থেকেই শুরু হয় রাস। আরেকটি প্রবাদ অনুযায়ী, দুর্গাপূজার পর পূর্ণিমার রাতে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনের গোপীদের সঙ্গে লীলা করেছিলেন, এবং সেখান থেকেই রাসলীলার সূচনা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।

পদ্মপুরাণে শারদরাস ও বাসন্তীরাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।হরিবংশে ও ভাসের বালচরিতে উল্লেখ আছে যে, কৃষ্ণ গোপিনীদের সঙ্গে হল্লীশনৃত্য করেছিলেন। হল্লীশনৃত্য যদি তালযুক্ত ও বিবিধ গতিভেদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় তবে তাকে "রাস" নামে অভিহিত করা হয়। বিষ্ণুপুরাণের মতে, শ্রীকৃষ্ণ রাস অনুষ্ঠান করেছিলেন গোপ-রমণীদের সঙ্গে।

ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা ও বৃন্দাবনে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুর ও নবদ্বীপ সহ অন্যান্য জায়গায় রাস উৎসব পালিত হয় | উল্লেখযোগ্য যে, শান্তিপুরের প্রধান উৎসব রাস, যা ভাঙারাস নামে পরিচিত। এছাড়া ওড়িশা, আসাম ও মণিপুরেও রাসযাত্রা বিশেষ গুরুত্বসহকারে পালিত হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা গোপিনীবৃন্দের সহযোগে অনুষ্ঠিত হয়, এবং অঞ্চলভেদে কত্থক, ভরতনাট্যম, ওড়িশি, মণিপুরী প্রভৃতি শাস্ত্রীয় নৃত্যসহ বিভিন্ন লোকনৃত্যের মাধ্যমে রাসনৃত্যকে বিশেষ মর্যাদায় উপস্থাপন করা হয়।

জনশ্রুতি প্রচলিত আছে, নবদ্বীপে চৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের রাস উৎসবের সূচনা করেছিলেন। সেই হিসাবে ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভেই রাসের সূচনা হয়েছিল। তবে চৈতন্যদেবের সন্ন্যাস গ্রহণের পর নবদ্বীপের বৈষ্ণব আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। গৌরাঙ্গ-পরিজনেরা বাধ্য হয়ে নবদ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলে বৈষ্ণবীয় উৎসব ও অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। পরবর্তী সময়ে নবদ্বীপে যে দ্বিতীয় পর্যায়ের রাস উৎসব শুরু হয়, তা ছিল অত্যন্ত অনন্য এবং বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে এক অদ্বিতীয় ঘটনা।

যদিও রাস উৎসব মূলত শ্রীকৃষ্ণের ব্রজলীলার অনুকরণে বৈষ্ণব ভাবধারায় পালিত হয়, নবদ্বীপের রাস উৎসবের বৈশিষ্ট্য শাক্ত রসাশ্রিত। রাস উৎসব শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই নবদ্বীপে কয়েকটি কালীমূর্তির পূজা প্রচলিত ছিল। শাক্ত ঐতিহ্য অনুযায়ী, বঙ্গদেশ তন্ত্রসাধনার এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। নবদ্বীপের জনসমাজে আবহমানকাল থেকেই ধর্ম-সংস্কৃতিতে তান্ত্রিক বীরাচারের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। মদ-মাংস (পঞ্চমকারের প্রধানবস্তু) এবং আড়ম্বরের জৌলুস নিয়েই বীরাচারের আরাধনার পূর্ণতা ঘটে। তাই সেই সবকিছুকে নিয়ে নবদ্বীপের রাসে ঘটেছে তন্ত্রাচারের পূর্ণ প্রতিফলন। নবদ্বীপের শাক্তরাসের চাপে বৈষ্ণবীয় রাসের সাত্ত্বিক ধারা অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে । অবশ্য নবদ্বীপে এই একই দিনে মন্দির অভ্যন্তরে রাধাকৃষ্ণের চক্ররাস হয়, তবে তার জাঁকজমকপূর্ণতা শাক্তরাসের পাশে ম্রিয়মান।উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজা গিরীশচন্দ্রের পোষকতায় নবদ্বীপের রাস উৎসবের সূচনা হয়ে যায় পাটা পুজোর মাধ্যমে। পাটা শাল কাঠ দিয়ে তৈরি একটি কাঠামো, যার ওপর মূল ঠাকুরের মূর্তির কাঠামো গড়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এই পুজো পটে সম্পন্ন হতো, যার জন্য এর নাম ছিল ‘পট-পূর্ণিমা’। পরে মাটির মূর্তি নির্মাণ করে পুজোর প্রথা চালু হয়।

মণিপুরীদের অন্যতম বৃহত্তম উৎসব হলো রাসপূর্ণিমা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মণিপুরের মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের প্রবর্তিত শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা, যা রাসপূর্ণিমা নামে পরিচিত, মণিপুরীদের সর্ববৃহৎ উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলাদেশে এই উৎসব প্রায় দেড়শ বছর ধরে, আনুমানিক ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নিয়মিতভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে।কার্ত্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে দূরদূরান্তের লক্ষ লক্ষ ভক্ত-দর্শক মৌলবীবাজার জেলার সিলেটের কমলগঞ্জের মাধবপুর জোড়ামণ্ডপের এই বিশাল ও বর্ণাঢ্য উৎসবের আকর্ষণে ছুটে আসেন। কথিত আছে, একদিন রাজর্ষি ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে রাধা ও কৃষ্ণের রাসলীলার দৃশ্য দেখেন। সেই স্বপ্নের অনুসরণেই তিনি রাসলীলার রাসনৃত্য উপস্থাপন করেন। কয়েকজন কুমারী মেয়েকে দিয়ে তিনি স্বপ্নের মতো রাসলীলা প্রদর্শন করান। তাঁর কন্যা কুমারী বিশ্বাবতীকে রাধা এবং মন্দিরের শ্রীগোবিন্দকে কৃষ্ণ রূপে উপস্থাপন করে তিনি নিজেই এই রাসলীলা পরিচালনা করেন এবং মৃদঙ্গবাদনের দায়িত্বও পালন করেন। উল্লেখযোগ্য যে, তিনি যে স্বকীয় তাল ব্যবহার করেছিলেন, সেই তাল আজও অনুসরণ করা হয়।

মণিপুরী সমাজে রাসনৃত্য ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়। এগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপীরাস ও উদুখলরাস। এর মধ্যে মহারাস হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

রাসলীলা উপলক্ষে মণিপুরীরা বিভিন্ন সবজি, ডাল, গাছের লতাপাতা দিয়ে উতি, পাকাউরা, সৈবুম, ইরোলবা নামের বিশেষ খাবার তৈরি করে। ম-পে সবাই লাইন ধরে বসে কলাপাতায় এই খাবার খান। এছাড়া মণিপুরী মেয়েরা নিজেদের তাঁতে বোনা শাড়ি পরেন।সন্ধ্যার পর শুরু হয় রাসপূর্ণিমার রাসলীলা বা রাসনৃত্য। রাসনৃত্য পরিবেশনা করে মণিপুরী কুমারি মেয়েরা। রাস নৃত্যের সময় ‘পলয়’ পরা হয়। ‘পলয়’ পোশাকের মাথার উপরিভাগের নাম ‘কোকুতম্বি’। এই পোশাকের মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ আবরণ থাকে। তার নাম ‘মাইমুখ’। গায়ে থাকে সোনালি ও রূপালি চুমকির কারুকার্যের ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ । পরনে থাকে ঘন সবুজ রঙের পেটিকোট, যা শক্ত বক্রমের দ্বারা গোলাকৃতি ও ভাঁজমুক্ত করা হয় এবং অজস্র চুমকি ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়নার দ্বারা কারুকার্য করা থাকে, যা সামান্য আলোতেও ঝলমল করে ওঠে। পলয়ের এই অংশের নাম ‘কুমিন’। এছাড়া পলয়ের সঙ্গে কলথা, খবাংচিক, খুঁজিসহ ইত্যাদি স্বর্ণালঙ্কারও নৃত্যশিল্পীরা পরেন।

প্রাচীনকাল থেকে আসামে রাস পূর্ণিমাতে রাসলীলা পালন করা হয় । ১৭৬২ শতাব্দী থেকে মাজুলীর দক্ষিণপাট সত্রতে প্রথম মহোৎসব আরম্ভ হয়। আসামের সত্রতে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড ও নাট্যরূপে রাস মহোৎসব উদযাপন করা হয়। উজনি থেকে নামনি , রাজ্য জুড়ে পালিত হয় রাস-উৎসব । উজনীর রাস অভিনয় কেন্দ্রিক। অর্থাৎ মানুষ অভিনয় করে, আর নামনীর রাস মূর্তি কেন্দ্রীক। মৃন্ময়ী মূর্তির দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন অবস্থা প্রদর্শন করা হয় ।যেমন কালীয় দমন, কংস বধ, দধি মন্থন ,বৃন্দাবনের রাসলীলা ,পুতনা বধ,ঝুলন ইত্যাদির বিভিন্ন মৃন্ময়ী মূর্তি দ্বারা উপস্থাপন করা হয়।

হিন্দুধর্মে রাস পূর্ণিমা বা কার্তিক পূর্ণিমার বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, এই দিন ভগবান শিব ত্রিপুরাসুর নামক অসুরকে পরাজিত ও বধ করেছিলেন, ফলে অনেক স্থানে এটি ত্রিপুরী বা ত্রিপুরারি পূর্ণিমা নামে পরিচিত। অন্য আরেকটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, এই দিনেই শ্রীবিষ্ণু মৎস্য অবতারে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

অন্যদিকে ,"সমস্যাসংকুল পৃথিবীতে যে নিজের ওপর বিশ্বাস রাখে, সেই জয়ী হয়।"- এই ছিল প্রথম শিখ গুরু নানকের অমূল্য একটি বাণী | ১৫ এপ্রিল ১৪৬৯ লাহোরের কাছে রাই ভোই কি তালওয়ান্দিতে যা আধুনিক পাকিস্তানের সেখপুরা জেলায় অবস্থিত ;গুরু নানক জন্মগ্রহণ করেন| তাঁর বাবার নাম ছিল মেহতা কল্যাণ দাস বেদী এবং মায়ের নাম ছিল তৃপ্তা দেবী| গুরু নানক জয়ন্তী ‘গুরু পূরব’ নামে পরিচিত | তাঁর জন্মবার্ষিকী স্মরণে কার্তিক পূর্ণিমার দিনে পালিত হয় উৎসবটি | কার্তিক পূর্ণিমা হলো হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে কার্তিক মাসের পঞ্চদশ চন্দ্র দিন; গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার সাধারণত নভেম্বর মাসে পড়ে|

জন্মসূত্রে তিনি সনাতন ধর্মী হলেও পরবর্তীতে তিনি শিখ ধর্মের প্রবর্তন করেন | গুরু নানক সমতা, ভ্রাতৃত্ব ও নৈতিকতা ভিত্তিক এক অনন্য ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি আমাদের জীবনে পাঁচটি প্রধান শত্রুকে চিহ্নিত করেছিলেন, যা হলো অহংকার, ক্রোধ, লোভ, আসক্তি ও কামনা।

গুরু নানক ‘গুরু গ্রন্থ সাহিব’ লেখা শুরু করেন এবং ৯৭৪ টি স্তোত্র সম্পন্ন করেছিলেন | ২২ সেপ্টেম্বর ১৫৩৯ , ৭০ বছর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন|

আধুনিক সমাজে যেখানে মানুষের জীবনে দ্বন্দ্ব ও বিভাজন প্রতিদিন বাড়ছে, সেখানে এই উৎসবগুলির অন্তর্নিহিত বার্তা আমাদের একাত্মতার পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেয়। রাস পূর্ণিমা ও গুরু নানকের জন্মমহোৎসব দুটোই মানবতাকে একতাবদ্ধ করার আহ্বান জানায়। রাস পূর্ণিমার প্রেমময় ভক্তি এবং গুরু নানকের শিক্ষা, উভয়ই আমাদের আধ্যাত্মিকতার দিকে নিয়ে যায় এবং মনুষ্যত্বের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাস পূর্ণিমা আমাদের হৃদয়ে মমতা ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে , আর গুরু নানক আমাদের মনুষ্যত্ব, পরোপকার ও ঐক্যের পথে পরিচালিত করেন। এই দুটো উৎসবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা কেবল ব্যক্তিগত মুক্তির পথে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হওয়াটাই আধ্যাত্মিকতার আসল পরিপূর্ণতা|

.    .    .

Discus