Image by Samuel F. Johanns from Pixabay

তিরিশের দশকের পাঁচজন কবিকে বলা হতো বাংলা সাহিত্যের ‘পঞ্চপাণ্ডব’। তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ ছিলেন অন্যতম। তিনি ছিলেন বাংলার একজন প্রখ্যাত কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক-তথা আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ| তাঁর কবিতা ছড়িয়ে দেয় ভাবনার সূক্ষ্ম অভিব্যক্তি,মানব মনের অসীম অনুভূতি এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর উপলব্ধি । কবির কবিতা প্রকৃতি ছাড়াও, প্রেম এবং বিষাদের একটি মিশ্রণ, যা বাংলা কবিতায় এক নতুন ধারার সূচনা করেছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা শুধুমাত্র শব্দের সৌন্দর্যে নয়, তার অন্তর্নিহিত গভীরতায় সমৃদ্ধ। তাঁর কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ পায় মানুষের জীবনের অন্তর্দৃষ্টি, সহজগামী উপাত্ত, এবং ভাবনার অগোচর আলোক| নিজের কবি জীবনের বর্ণনা তিনি এভাবে করেছিলেন –

‘আমি কবি, সেই কবি-
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি
ঝরাপালকের ছবি’

১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি, বরিশাল শহরে জীবনানন্দ দাশের জন্ম হয়েছিল; বাবা সত্যানন্দ দাশ ও মা কুসুমকুমারী দাশ| মা কুসুমকুমারীর অনুপ্রেরণায়ই কবি জীবনানন্দ দাশের কবি জীবনের সূচনা। তাঁর কবিতায় ছিল প্রকৃতির কথা, আর ছিল ভালোবাসার কথা। তাই তিনি একাধারে 'তিমির হননের কবি', 'রূপসী বাংলা'র কবি।

শিক্ষাজীবনে যথেষ্ট মেধার স্বাক্ষর রাখলেও কর্মজীবন স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারেননি কবি জীবনানন্দ দাশ।কয়েকবার চাকরিও হারাতে হয়েছে-বেছে নিতে হয়েছে বহু বিচিত্র পেশা।অর্থাভাবে পীড়িত হয়ে স্ত্রী লাবণ্য দাশকে করতে হয়েছে স্কুলে শিক্ষকতা।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে উৎপীড়িত তিমির হননের কবি জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গভীরতা অন্বেষণ করেছিলেন , তাঁর ভিন্ন পন্থা লেখনীতে পরাবাস্তববাদের ছায়া পাওয়া যায়। মরুভূমি এবং মহাজাগতিক মহাবিশ্বের প্রতি তিনি ছিলেন অনুরক্ত।প্রকৃতিই সমস্ত সৃজনশীলতা এবং আধ্যাত্মিকতার উৎস ; সেটি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে।তাইতো কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘নির্জনতম কবি’; আবার অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে বর্ণিত করেছেন ‘শুদ্ধতম কবি’ হিসাবে।

কবি জীবনানন্দ দাশ ছিলেন একজন কাল ও ইতিহাস সচেতন কবি। আধুনিক কাব্যকলার বিচিত্র ‘ইজম’ প্রয়োগ ও শব্দ নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভা ছিল।কবিতার উপমা প্রয়োগে জীবননান্দ দাশের নৈপুন্য তুলনাহীন। কবিতাকে তিনি মুক্ত আঙ্গিকে উত্তীর্ণ করে গদ্যের স্পন্দনযুক্ত করেন, যা পরবর্তীকালে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে; মানুষের জীবনবোধকে নাড়া দিয়েছে। তাঁর কবিতায় বাংলার রূপ, প্রকৃতি, মানুষের জীবনধারা, তাদের কর্ম, দুঃখ-কষ্ট, বৃটিশ শাসনবিরোধী, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে। রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় তাঁর সৃষ্টিশীলতা ছিল অনন্য | যিনি হাজার বছর ধরে পথ হেঁটেছেন পৃথিবীর পথে, জেনেছেন- ভালো বেসেছেন পুরো বিশ্বকে; তিনিই জীবনানন্দ দাশ| তাঁকে ছাড়া প্রকৃতি অধরা, গ্রামের নারী অধরা, নারীর চাল ধোয়া হাত অধরা। সে যে কতটা গভীর, কতটা শ্বাশত তা উপলব্ধি হয় একমাত্র জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। নাটোরের সেই অবিনশ্বর বনলতা সেনকে তিনি চিনিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের|

কবি জীবনানন্দ দাশ বাল্যজীবন কাটিয়েছেন বাংলাদেশে। বাংলার অনিন্দনীয় সুন্দর রূপে মুগ্ধ হয়েছেন জীবনানন্দ। ঋতুর সমাবেশে ও পরিবর্তনে রূপসী বাংলার প্রকৃতি তাঁর কাছে রমণীয় হয়ে উঠেছে; লালিত হয়েছে চিরায়ত বাংলার সারস্বত ঐতিহ্য ও সৌন্দর্য্য।বাংলার নিশুতি জ্যোৎস্নার রাতে কবি শুনেছেন-"নিশুতি জ্যোৎস্না রাতে, -টুপ টুপ টুপ টুপ্ সারারাত ঝরে শুনেছি শিশিরগুলো...."|“রাঙ্গা মেঘে সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে, দেখিবে ধবল বক; আমারে পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে...’ নানা কবিতায় কল্পচিত্রে বাংলাকে উপস্থাপন করেছেন তিনি; বলেছেন- ‘সবুজের দেশ’।

ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতির পরিবর্তনের মতো মানব মনের মধ্যেও বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়| সেই বৈচিত্র্য কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ-কবিতাকে স্বতন্ত্র মহিমায় উদ্ভাসিত করেছেন ।

ঋতু কেন্দ্রিক কবিতার পাখিগুলি যাত্রা শুরু করেছিল শীত ঋতুতে এবং ক্রমশ অগ্রসর হয়ে উপস্থিত হয়েছে বসন্তের রাতে - পাখির জীবনচক্রে শীত ও বসন্ত ঋতুর ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ সেটাই কবি তুলে ধরেছেন ; ‘কোথাও রয়েছে পড়ে শীত পিছে, আশ্বাসের কাছে তারা আসিয়াছে....’; ‘আবার আজি বসন্তের রাতে....... আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর’| ধু ধু মাঠ, ধানক্ষেত, কাশফুল, বুনোহাঁস,বালুকার চর-নানা দৃশ্য কবি দেখেছেন; অনুভব করেছেন ঋতুর নব নব উপস্থিতির মধ্যে।

“তার তরে কালে কালে পেতেছে সে শৈবাল বিছানা, - শাল তমালের ছায়া
এনেছে সে নব নব খতুরাগ, -পউষনিশির শেষে ফাগুনের ফাঁগুয়ার মায়া।”

কবি জীবনানন্দের প্রথম সংকলন ঝরাপালক" (১৯২৭)। এই কাব্যে তিনি মূলতঃ নিসর্গ প্রকৃতির বর্ণনা করেছেন | এখানে যা কিছু রয়েছে সবই গ্রামের পরিচিত দৃশ্য। তাঁর ঋতু চেতনায় গড়ে ওঠা প্রকৃতির সহজ উপাদান, ফুল-গাছ-পাখি; পল্লীর জীবন্ত ছবি, পল্লীপ্রাণের উন্মুক্ত প্রকাশ হয়ে উঠেছে।গ্রীষ্মের কালবৈশাখী, ডাহুক পাখির আকুল গান, রৌদ্রতাপে অবনতমুখী মালঞ্চ কিংবা "বকের পাখার ভিড়ে বাদলের গোধূলি-আঁধারে, মালতীলতার বনে, কদমের তলে...." অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য এই কাব্যের মধ্যে রয়েছে।পরবর্তী গ্রন্থ “ধুসর পাণ্ডুলিপি'তে প্রকৃতির সঙ্গে মানব জীবনের কঠিন ও কোমল সংবেদনার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। কবি এই গ্রন্থে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে বিভিন্ন দৃশ্যের অবতারণায় অসাধারণ করে গড়ে তুলেছেন। চারিদিকের নানা দৃশ্যকে তিনি যেন একটি সূত্রে গেঁথে দিয়েছেন। এরূপ দৃশ্যের পর দৃশ্যের অবতারণা দেখে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-“'ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবিতাগুলি রূপচিত্রময়”।

“রূপসী বাংলা" কাব্যে প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে দিন-মাস-বছরের পালা বদলের সুক্ষ্ম রঙিন চিত্র অঙ্কন করেছেন। কার্তিকের অপরাহ্নে হিজলের পাতা, বাদলের জলে পরিপূর্ণ ধলেশ্বরী ক্ষেতঝরা কচি কচি শ্যামা-পোকা - প্রকৃতির বিভিন্ন রঙিন চিত্রগুলি ঋতুর অনুষঙ্গে রূপসী বাংলা'র বিভিন্ন কবিতায় তুলে ধরেছেন।

“বনলতা সেন”ও “রূপসী বাংলা” কাব্যে তিনি প্রেম-প্রকৃতি-ইতিহাস-মৃত্যু-একাকীত্ব-ইত্যাদি চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন; রহস্যময় সৌন্দর্যের জগতে পাড়ি দিয়েছেন। "মহাপৃথিবী”, “সাতটি তারার তিমির” ও “বেলা অবেলা কালবেলা" গ্রন্থে প্রধানত মানব সভ্যতা ও মানুষের মধ্যে নৈরাশ্যবোধকে অতিক্রম করার প্রয়াস দেখিয়েছেন।

ঋতুকে আশ্রয় করে জীবনানন্দ দাশের ইন্দ্রিয়ানুভূতি স্পষ্ট হয়েছে "বনলতা সেন” কাব্যের বিভিন্ন কবিতাগুলিতেও। এই কাব্যে কবির প্রেম চেতনা এসেছে ঋতুর অনুষঙ্গে। বনলতা, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সুদর্শনা,শ্যামলী, সবিতা- এই রক্তমাংসের প্রেমিকারা প্রকৃতির সৌন্দর্যের মতো রমণীয় ও চির আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়।

কালের নিয়মে কত ঋতু অতিক্রান্ত হয়; কবিও প্রিয়ার সন্ধানে পৃথিবীর পথে হেঁটে চলেন; হাজার হাজার বছর ধরে -ভাদরের ভিজে মাঠ- আকাশের পউষ নিরবতা-হেমন্তের হিম মাখানো ঘাসে - শরতের ভোরে - বিভিন্ন ঋতুর আবেশ মাখিয়ে কবিতার প্রিয়াকে তিনি খুঁজে বেড়িয়েছেন। যদিও জীবনের ভঙ্গুর প্রেম, দেখা-না-দেখা অসফল মোহগ্রস্থ সম্পর্ক জড়ো করলে জীবনানন্দ দাশের প্রেমের ভুবনটা ছিল মূলত শুষ্ক। ব্যক্তিগত জীবনে যেসব প্রেম আরাধ্য ছিল ; সেগুলো অধরাই থেকে গিয়েছিল তাঁর জীবনে ।

প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ কবি তাঁর মৃত্যুকে পর্যন্ত কামনা করেছেন এই রূপসী বাংলার বুকেই। কবি যখন মৃত্যুর ঘুমে ঢলে পড়বেন, তখন তাঁর শিয়রে উপস্থিত হবে বৈশাখী মেঘ-তিনি কাচপোকার মতো তুচ্ছ পতঙ্গের সঙ্গে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়বেন। বস্তুতঃ তিনি পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্যকে দেখেছেন বাংলার মধ্যেই। বাংলার গাছ, পাখি, নদী, এমনকি বেহুলার মতো নারীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন অপরূপ সৌন্দর্যের ভান্ডার| মৃত্যুর পর বাংলার সমস্ত কিছুকে ভালোবেসে-“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়-হয়তো মানুষ নয় হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে..”|

১৯৫৪ সালে কলকাতার রাস্তায় এক বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেননি জীবনানন্দ দাশ| শহরের ট্রামলাইনে তাঁর পথ চলা থেমে গিয়েছিল।শুধু থেকে গিয়েছে অফুরান শব্দস্রোত। তিনি আর ফিরে আসেননি তাঁর সেই ধানসিঁড়িটির তীরে। 'সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— .." আসেন না জীবনানন্দ! 'ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার’ নিকষ কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেছেন-এক অনন্য জীবনের কবি জীবনানন্দ দাশ -থেকে গেলো বাতাসে ফিসফিস করে অনুচ্চারিত অধরা প্রেমের আহ্বান - “ফিরে এসো সুরঞ্জনা”|

.    .    .

তথ্যঋণ:

  • আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলিত ও সম্পাদিত; কবিতা সমগ্র-জীবনানন্দ দাশ / অবসর প্রকাশনা;ঢাকা - ১১০০/তৃতীয় মুদ্রণ
  • জীবনানন্দ দাশ; জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ (দ্বিতীয় খন্ড)বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কলিকাতা- ৭৩

Discus