Photo by Shravan K Acharya on Unsplash
শিশু দিবস এমন একটি দিন, যেটি আমরা সবাই জানি এবং পালন করি, যাতে শিশুদের অধিকার, তাদের সুরক্ষা, এবং তাদের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ তৈরির প্রতি সচেতনতা বাড়ানো হয়। বাংলাদেশে এটি সাধারণত ১ জুন বা ১৭ মার্চ পালিত হয়। তবে, ইসলামের দৃষ্টিতে, শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব এবং তাদের প্রতি ভালোবাসার গুরুত্ব আরও বেশি গভীর এবং বিশেষ।
ইসলাম শিশুর প্রতি খুবই সহানুভূতিশীল। এটা শুধুমাত্র তাদের ভালোবাসা এবং সঠিক যত্নের ব্যাপারে নয়, বরং তাদের অধিকার এবং সঠিক পথ অনুসরণের ব্যাপারেও স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়। আসুন, জানি কোরআন ও হাদিসে ইসলামের দৃষ্টিতে শিশুদের মর্যাদা এবং আমাদের কর্তব্য কী।
ইসলাম শিশুর প্রতি ভালোবাসা এবং স্নেহ প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেয়। একটি শিশুর জন্মকে আল্লাহর বিশেষ দান হিসেবে বিবেচনা করা হয়, এবং তার প্রতি সদয় মনোভাব রাখা আমাদের দায়িত্ব। ইসলাম মনে করে যে, শিশুর জীবনের প্রথম কিছু বছর তার চরিত্র এবং ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ বলেন:
فَلَمَّا وَضَعَتْهَا قَالَتْ رَبِّ إِنِّي وَضَعْتُهَا أُنثَىٰ وَاللَّهُ أَعْلَمُ بِمَا وَضَعَتْ وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنثَىٰ ۖ وَإِنِّي سَمَّيْتُهَا مَرْيَمَ وَإِنِّي أُعِيذُهَا بِكَ وَذُرِّيَّتَهَا مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ
"তঃপর সে যখন তা প্রসব করল, বলল, ‘হে আমার রব, নিশ্চয় আমি তা প্রসব করেছি কন্যারূপে’। আর আল্লাহই ভাল জানেন সে যা প্রসব করেছে তা সম্পর্কে। ‘আর পুত্র সন্তান কন্যা সন্তানের মত নয় এবং নিশ্চয় আমি তার নাম রেখেছি মারইয়াম। আর নিশ্চয় আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে বিতাড়িত শয়তান থেকে আপনার আশ্রয় দিচ্ছি’।’’"
(আল-ইমরান, ৩:৩৬)
এখানে, গর্ভাবস্থার সময় থেকেই শিশুর প্রতি এক পবিত্র দায়িত্ব পালন করার কথা বলা হয়েছে। মা-বাবার জন্য এটি একটি বড় দায়িত্ব, যাতে তারা সন্তানের জন্য সঠিক পথ নির্বাচন করতে পারেন।
ইসলামে শিশুদের প্রতি এই ভালবাসা এবং যত্নের আদেশ আরও পরিষ্কার হয় আল্লাহর এই আয়াতে:
وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَوۡلَادَكُمۡ خَشۡیَۃَ اِمۡلَاقٍ ؕ نَحۡنُ نَرۡزُقُهُمۡ وَ اِیَّاكُمۡ ؕ اِنَّ قَتۡلَهُمۡ كَانَ خِطۡاً كَبِیۡرًا
"তোমরা নিজেদের সন্তানদের ক্ষুধার কারণে হত্যা করো না। আমরা তাদের এবং তোমাদের জন্য রিজিক দেব। তাদের হত্যা করা একটি মহাপাপ।"
(আল-ইসরা, ১৭:৩১)
এই আয়াতে আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, সন্তান হত্যাকে ইসলাম অপরাধ মনে করে এবং শিশুর জীবনকে অত্যন্ত মূল্যবান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
অভিভাবকদের দায়িত্ব
ইসলামে বাবা-মায়ের জন্য শিশুর প্রতি যত্ন নেওয়া, তাদের সঠিক শিক্ষা প্রদান, এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা দেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তার বানীনে বলেছেন:
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا قُوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ وَ اَهۡلِیۡكُمۡ نَارًا
"হে বিশ্বাসীরা! তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।"
(আত-তাহরীম, ৬৬:৬)
এটি প্রমাণ করে যে, পিতা-মাতার প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সন্তানদের ধর্মীয় এবং নৈতিকভাবে সঠিক পথে পরিচালনা করা। ইসলাম শিশুদের লালন-পালন করার জন্য একজন মুসলিম অভিভাবকের বিশেষ দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করেছে।
ومن لا يحب أولاده فليس بمسلم كامل (صحيح مسلم).
"যে ব্যক্তি তার সন্তানকে ভালোবাসে না, সে ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ মুসলিম নয়।"
(সহীহ মুসলিম)
এটি স্পষ্টভাবে বলছে যে, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এবং মায়া ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই শিশুর প্রতি ভালোবাসা ও যত্ন ইসলামের মধ্যে একটি মৌলিক শিক্ষা।
ইসলামে শিশুদের অধিকার
ইসলামে শিশুদের জন্য কিছু মৌলিক অধিকার রয়েছে, যেগুলি তাদের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিছু প্রধান অধিকার হলো:
ইসলাম শিশুদের জীবনকে অত্যন্ত মূল্যবান বলে মনে করে। তাদের হত্যার প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কোরআনে আল্লাহ বলেন:
"তোমরা নিজেদের সন্তানদের ক্ষুধার কারণে হত্যা করো না। আমরা তাদেরকে ও তোমাদেরকে রিজিক দেব। তাদের হত্যা করা একটি মহাপাপ।"
(আল-ইসরা, ১৭:৩১)
এটি আমাদের শিক্ষা দেয় যে, ইসলাম শিশুদের জীবনকে সর্বোচ্চ সম্মান দেয় এবং তাদের জীবনের অধিকার সুরক্ষিত রাখে।
ইসলাম শিশুর প্রতি ভালোবাসা ও স্নেহ প্রদানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। মহানবী (সা.) এক হাদিসে বলেছেন:
رحم الله من أحسن تربية أولاده ورعايته
(صحيح البخاري)
"আল্লাহ সে ব্যক্তিকে দয়া করেন, যে তার সন্তানদের সঠিকভাবে পালন-পোষণ ও যত্ন নেয়।"
(সহীহ বুখারি)
এটি প্রমাণ করে যে, সন্তানের যত্নের মধ্যে শুধুমাত্র শারীরিক যত্ন নয়, তাদের মানসিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
ইসলাম শিশুদের জন্য শিক্ষা লাভকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন:
طلب العلم فريضة على كل مسلم ومسلمة
"শিক্ষা অর্জন প্রতিটি মুসলমান পুরুষ ও মহিলার জন্য ফরজ (অবশ্যই করতে হবে)।"
(সহীহ মুসলিম)
এই হাদিসে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি মুসলিম অভিভাবকের জন্য তাদের সন্তানদের সঠিক শিক্ষা প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু দুনিয়াবি শিক্ষা নয়, বরং ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
শিশু দিবস পালনের উদ্দেশ্য শুধু শিশুদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো নয়, বরং তাদের সুরক্ষা, সুখী জীবন এবং একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা। ইসলামে, শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতির পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তা, শিক্ষা এবং সুস্থ মানসিক বিকাশের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
فإذا أظهرتم الحب والمودة لأولادكم، زادكم الله حباً".
(صحيح مسلم)
"তোমরা যদি তোমাদের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এবং মায়া দেখাও, তবে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরও বেশি ভালোবাসা প্রকাশ করবেন।"
(সহীহ মুসলিম)
এটি শিশু দিবসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—যত বেশি আমরা আমাদের সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা ও মায়া প্রদর্শন করব, তত বেশি আল্লাহ আমাদের প্রতি দয়া করবেন।
ইসলামে শিশুদের প্রতি দায়িত্ব পালন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি আমাদের মানবিক কর্তব্যও। তাদের জীবন, অধিকার, এবং বিকাশ নিশ্চিত করতে বাবা-মায়েদের ভূমিকা অপরিহার্য। শিশুদের প্রতি ইসলামের নির্দেশনা অনুসরণ করে আমরা একটি সুন্দর, নিরাপদ, এবং সুখী সমাজ গড়ে তুলতে পারি। শিশুর প্রতি সঠিক মনোভাব এবং তাদের আদর্শভাবে গড়ে তোলা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর পথ।
ইসলামের দৃষ্টিতে, শিশু দিবস শুধু একটি সেলিব্রেশন নয়, বরং শিশুদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালনের এক স্মরণীয় মুহূর্ত।