Image by Wikipedia 

১৯শে ডিসেম্বর দিনটি শুধুমাত্র গোয়াবাসীর জন্য নয়, সমগ্র ভারতীয় ইতিহাসের জন্য এক অসাধারণ তাৎপর্য বহন করে। এই দিনটি গোয়া মুক্তি দিবস (Goa Liberation Day) হিসেবে পালিত হয়, যা ভারতে পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের দীর্ঘ চার শতাব্দীরও বেশি সময়ের জাঁতাকল থেকে গোয়া, দমন এবং দিউ-এর চূড়ান্ত মুক্তির প্রতীক। এই মুক্তি কোনো সহজ বা দ্রুত প্রক্রিয়া ছিল না; এটি ছিল দীর্ঘদিনের প্রতিরোধ, কূটনৈতিক ব্যর্থতা এবং অবশেষে একটি সুচিন্তিত সামরিক অভিযানের ফসল। যখন ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে, তখন দেশের বেশিরভাগ অংশ বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত হলেও, ভারতের পশ্চিম উপকূলের এই রত্নটি, যার ঐতিহাসিক নাম 'স্বর্গভূমি', তখনও পর্তুগালের অধীনেই ছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পূর্ণতা পাচ্ছিল না যতক্ষণ না গোয়ার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। মুক্ত ভারতে গোয়ার মানুষের জীবন ছিল এক বৈপরীত্যের প্রতীক—একদিকে যখন সমগ্র জাতি নতুন করে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণ করছে, অন্যদিকে গোয়ার মানুষেরা তখনও এক বিদেশি শক্তির কঠোর শাসনের অধীনে নিষ্পেষিত হচ্ছিল। এই বৈপরীত্যই গোয়ার মুক্তির সংগ্রামকে জাতীয় আন্দোলনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছিল।

পর্তুগিজ শাসন প্রায় ৪৫০ বছর ধরে গোয়ার সমাজ, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তারা শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করেনি, বরং স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতেও হস্তক্ষেপ করেছিল, যা জনগণের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চাপা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। তাই, ১৯শে ডিসেম্বরের বিজয়কে কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতা হিসেবে দেখলে ভুল হবে, এটি ছিল গোয়ার নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধার। এই মুক্তির স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গোয়ার জনগণ অহিংস আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝুঁকি নিয়েছিল। সেই সময়ে গোয়ার মুক্তিকামী আন্দোলনকারীরা চরম দমন-পীড়নের শিকার হয়েছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে গোয়াকে ভারতের হাতে হস্তান্তরের জন্য বারবার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু পর্তুগিজ সরকার, বিশেষ করে তৎকালীন স্বৈরশাসক আন্তোনিও ডি অলিভিয়েরা সালাজার, গোয়াকে তাদের 'বিদেশি প্রদেশ' হিসেবে দাবি করে আলোচনার পথ রুদ্ধ করে দেন। দীর্ঘদিনের এই অচলাবস্থা এবং গোয়ার জনগণের ওপর ক্রমাগত নির্যাতন ভারতীয় সরকারকে এক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। অবশেষে, সামরিক পথে গোয়াকে মুক্ত করার সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যা অপারেশন বিজয় নামে পরিচিত। এই সিদ্ধান্ত এবং এর সফল বাস্তবায়ন শুধুমাত্র গোয়াকে মুক্তি দেয়নি, বরং এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংকল্পের একটি শক্তিশালী বার্তা স্থাপন করেছিল। তাই, প্রতি বছর এই দিনে আমরা শুধু একটি বিজয়ের উদযাপন করি না, বরং লক্ষ লক্ষ মানুষের স্বাধীনতা, সংকল্প এবং আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা কোনো একক দিনে অর্জিত হয় না, বরং এটি নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের দাবি রাখে। গোয়া মুক্তি দিবসের মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে ভারত সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

গোয়ার বুকে সাড়ে চার শতাব্দীর পর্তুগিজ আধিপত্য: স্বাধীনতার পথে দীর্ঘ অচলাবস্থা

গোয়া মুক্তি দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা করতে গেলে, প্রথমে ফিরে দেখতে হয় সুদীর্ঘ ৪৫০ বছরের পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনকে, যা ছিল ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিদেশি দখলদারিত্ব। ১৫১০ সালে পর্তুগিজ নৌ-সেনাপতি আফোনসো ডি আলবুকার্ক এই অঞ্চলটি দখল করার পর থেকেই গোয়ার ভূমি, সম্পদ এবং জনগণের ভাগ্য তাদের হাতে চলে যায়। এই শাসন কেবল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক শোষণেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি গোয়ার সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনেও গভীর ছাপ ফেলেছিল। পর্তুগিজরা তাদের ধর্মীয় প্রচারণার মাধ্যমে স্থানীয় হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর ক্যাথলিক ধর্ম গ্রহণে চাপ সৃষ্টি করত, যা স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর এক চরম আঘাত হেনেছিল। এই সময়ে বহু মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং স্থানীয় ভাষা ও রীতিনীতিকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়। এই ধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা গোয়াবাসীর মনে দীর্ঘদিন ধরে এক চাপা ক্ষোভ ও প্রতিরোধের জন্ম দিয়েছিল।

ভারতের অন্যান্য অংশ যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, গোয়ার মানুষেরাও তখন পর্তুগিজ শাসনের বিরুদ্ধে বারবার আওয়াজ তুলেছে। যদিও তাদের বিদ্রোহগুলি কঠোর হাতে দমন করা হয়েছিল, কিন্তু স্বাধীনতার আগুন কখনোই সম্পূর্ণরূপে নিভে যায়নি। বিখ্যাত পিন্টো ষড়যন্ত্র (Pinto Conspiracy) এবং অন্যান্য স্থানীয় প্রতিরোধ আন্দোলনগুলি প্রমাণ করে যে, গোয়ার মানুষ কখনোই বিদেশি শাসনকে মেনে নেয়নি। কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর সমস্যাটি দেখা দেয় ১৯৪৭ সালের পর। যখন ভারত ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন ভারতীয় জনগণ এবং সরকার প্রত্যাশা করেছিল যে পর্তুগালও শান্তিপূর্ণভাবে গোয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু পর্তুগালের তৎকালীন স্বৈরশাসক আন্তোনিও ডি অলিভিয়েরা সালাজার গোয়াকে ভারতের একটি অংশ হিসেবে স্বীকার করতে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন। সালাজারের চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা ছিল—গোয়া নাকি পর্তুগালের 'ওভারসিজ প্রভিন্স' বা সমুদ্রপারের প্রদেশ, এবং তাই এর হস্তান্তর নিয়ে কোনো আলোচনার অবকাশ নেই। তিনি গোয়াকে তাদের সার্বভৌম ভূখণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করতে থাকেন।

এই অনমনীয় মনোভাবের কারণে শুরু হয় দীর্ঘ এক কূটনৈতিক অচলাবস্থা। ভারত সরকার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ উপায়ে এই সমস্যার সমাধানের জন্য বহু বছর ধরে চেষ্টা করে। জাতিসংঘ (UN) সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মঞ্চে গোয়ার মুক্তির পক্ষে ভারতের দাবি জোরালোভাবে উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পর্তুগাল ন্যাটো (NATO) জোটের সদস্য থাকায় এবং পশ্চিমা দেশগুলির রাজনৈতিক সমর্থনের কারণে কূটনৈতিক সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। এই কূটনৈতিক ব্যর্থতার ফলস্বরূপ, গোয়ার অভ্যন্তরে স্বাধীনতার আন্দোলন আরও তীব্র ও সশস্ত্র রূপ নেয়। আজাদ গোমন্তক দল-এর মতো সংগঠনগুলি পর্তুগিজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ অ্যাকশন শুরু করে। অন্যদিকে, ভারত থেকে বহু সত্যাগ্রহী অহিংস পথে গোয়ার মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে অংশ নেয়। ১৯৫৫ সালের সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছিল এই সময়ের এক করুণ অধ্যায়, যখন পর্তুগিজ পুলিশ নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হত্যা করে। এই নৃশংসতা ভারতে তীব্র জনরোষের জন্ম দেয় এবং বিশ্বব্যাপী পর্তুগিজ শাসনের অমানবিক দিকটি তুলে ধরে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও যখন পর্তুগাল তাদের অবস্থান থেকে এক চুলও সরতে রাজি হলো না এবং বরং গোয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি আরও জোরদার করতে শুরু করল—এমনকি ভারতীয় মাছ ধরার ট্রলারের ওপর হামলা এবং দেশের সার্বভৌমত্বে সরাসরি আঘাত হানার মতো কাজ শুরু করল—তখন ভারত সরকার বুঝতে পারল যে সামরিক পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এভাবে, দীর্ঘ চার শতাব্দীর শোষণ এবং ১৪ বছরের ব্যর্থ কূটনৈতিক আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে অপারেশন বিজয়-এর মঞ্চ প্রস্তুত হয়, যা ছিল ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শেষ সশস্ত্র পদক্ষেপ।

৪. মুক্তির পরবর্তী পরিস্থিতি ও গুরুত্ব

অপারেশন বিজয়ের মাধ্যমে গোয়ার মুক্তি লাভের পর ভারতের জাতীয় ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। ১৯শে ডিসেম্বর, ১৯৬১-এর পর গোয়া, দমন ও দিউ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে আসে এবং এগুলিকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই অঞ্চলগুলির শাসনভার প্রাথমিকভাবে একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিল। মুক্ত হওয়ার পর গোয়ার জনগণের সামনে প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দীর্ঘ ঔপনিবেশিক প্রভাব কাটিয়ে উঠে ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল স্রোতে নিজেদের সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা। পর্তুগিজদের রেখে যাওয়া আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন এবং ভারতীয় সাংবিধানিক নীতির সাথে সেগুলিকে মানিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। গোয়ার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং পরিচিতি বজায় রাখার জন্য সরকার বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এরপর শুরু হয় গোয়ার মানুষের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। ১৯৬৭ সালে একটি গুরুত্বপূর্ণ গণভোট (Opinion Poll) অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে গোয়ার জনগণ এই বিষয়ে নিজেদের রায় দেয় যে, তারা পার্শ্ববর্তী রাজ্য মহারাষ্ট্রের সাথে মিশে যেতে চায় নাকি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকতে চায়। গোয়ার জনগণের ঐতিহাসিক রায় ছিল স্বতন্ত্র পরিচিতি বজায় রেখে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে থাকার পক্ষে, যা গোয়াবাসীর আত্মমর্যাদার প্রতীক।

এই মুক্তির ঘটনা ভারতের জন্য এক গভীর জাতীয় তাৎপর্য বহন করে। প্রথমত, এটি নিশ্চিত করে যে ভারত তার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষায় সামরিক পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করবে না, যা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের সার্বভৌমত্বের একটি শক্তিশালী বার্তা দেয়। দ্বিতীয়ত, গোয়ার মুক্তির মাধ্যমেই ভারত থেকে ঔপনিবেশিক শাসনের সম্পূর্ণ এবং চূড়ান্ত অবসান ঘটে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৯৪৭ সালে শুরু হলেও, গোয়া মুক্ত হওয়ার পরই সেই সংগ্রাম সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই দিনটি ভারতের ইতিহাসে ঐক্যের প্রতীক হিসাবেও কাজ করে, যেখানে দেশের জনগণ এবং সশস্ত্র বাহিনী একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনের জন্য এক হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে, গোয়ার জনগণের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হতে শুরু করে। অবশেষে, ১৯৮৭ সালের ৩০শে মে, ভারতীয় পার্লামেন্ট গোয়াকে পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেয়, এবং এটি ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ২৫তম রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এই দিনটিকে বর্তমানে গোয়া রাজ্য দিবস হিসেবেও পালন করা হয়। বর্তমানে গোয়া মুক্তি দিবসকে অত্যন্ত উৎসাহ ও শ্রদ্ধার সাথে পালন করা হয়। প্রতি বছর ১৯শে ডিসেম্বর, গোয়ার বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে পানাজিতে, বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ (Parade) এবং সামরিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এই উদযাপনগুলিতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্ব, মুক্তি আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগ এবং গোয়ার মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এই দিনটি গোয়ার মানুষের জন্য শুধু ইতিহাস নয়, বরং এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা, যা তাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা অর্জিত হয় আত্মত্যাগ এবং দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে।

গোয়া মুক্তি দিবস, যা প্রতি বছর ১৯শে ডিসেম্বর পালিত হয়, তা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক। দীর্ঘ ৪৫০ বছরের পর্তুগিজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে মাত্র ৩৬ ঘণ্টার 'অপারেশন বিজয়'-এর মাধ্যমে গোয়ার মুক্তি লাভ ছিল ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্ব, সংকল্প এবং সাহসিকতার এক চূড়ান্ত প্রমাণ। এই প্রবন্ধের মাধ্যমে আমরা যেমন দেখেছি দীর্ঘ কূটনৈতিক অচলাবস্থা এবং অহিংস আন্দোলনের ব্যর্থতা কীভাবে সামরিক হস্তক্ষেপের মঞ্চ তৈরি করেছিল, ঠিক তেমনিভাবে এই বিজয় আমাদের শেখায় যে, স্বাধীনতার মূল্য অপরিসীম এবং প্রয়োজন হলে জাতির অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা অপরিহার্য। ১৯শে ডিসেম্বরের তাৎপর্য কেবল রাজনৈতিক বা সামরিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়; এটি সাংস্কৃতিক মুক্তি, আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধার এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বিজয়ের প্রতীক।

গোয়া মুক্তি দিবসের এই ঐতিহাসিক স্মৃতিচারণ আমাদের বর্তমান সময়েও বহু গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একতা ও সংহতি হলো একটি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি। স্বাধীনতা অর্জনের পর গোয়ার জনগণের নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই নির্ধারণ করার সুযোগ এবং পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ—ভারতীয় গণতন্ত্রের গভীরতম মূলনীতির প্রতি তাদের আস্থার প্রতিফলন ঘটায়। গোয়া এখন কেবল একটি রাজ্য নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক ও পর্যটন মানচিত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এর সমৃদ্ধ পর্তুগিজ-ভারতীয় সাংস্কৃতিক মিশ্রণ এটিকে বিশ্বজুড়ে এক অনন্য পরিচিতি এনে দিয়েছে, যা এর মুক্ত ইতিহাসের এক ফল। বর্তমানে গোয়া মুক্তি দিবসের উদযাপনগুলি একটি জাতিকে তার সংগ্রামের উত্তরাধিকারকে শ্রদ্ধা জানাতে শেখায়। কুচকাওয়াজ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে এই বার্তা দেওয়া হয় যে, স্বাধীনতা যেন কোনোভাবেই হালকাভাবে না নেওয়া হয়। গোয়ার এই মুক্তি সংগ্রাম প্রমাণ করে যে, নিপীড়ন যত দীর্ঘই হোক না কেন, জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা এবং দেশের সংকল্পের কাছে তা একসময় হার মানতে বাধ্য। অতএব, গোয়া মুক্তি দিবস শুধু একটি তারিখ নয়, এটি ভারতের সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিধ্বনি যে, তার ভূখণ্ডে কোনো প্রকার ঔপনিবেশিক বা বিদেশি শাসনের স্থান নেই এবং থাকবে না। এই দিবসটি ভারতীয় ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে চিরকাল অনুপ্রাণিত করে যাবে, যা সাহস, দৃঢ়তা, এবং চূড়ান্ত বিজয়ের মহিমা প্রচার করে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, একটি জাতির জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের চেয়ে পবিত্র আর কিছু নেই।

.    .    .

Discus