জিনিয়া ট্রেনে করে শিয়ালদাহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি যাচ্ছে, গন্তব্য দার্জিলিং; ব্যাগটাগ ঠিক করে ঘুচিয়ে নিয়ে বসে ফোন টা চেক করছে আর একবার করে উঁকি দিয়ে দেখছে চা আসছে কি না, ঠিক তখন একটা বিশাল লম্বা ছেলে, সুঠাম চেহারা, মাথা ভর্তি খোঁচা খোঁচা চুল, চোখে পাওয়ার গ্লাস, একটা নেভি ব্লু শার্ট আর নীল ট্র্যাক প্যান্ট পরে, একটা পিটে ব্যাগ আর হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসছে, এসে জিনিয়ার সামনে টা বসে পরে, জিনিয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে আবার ফোন ঘাটায় ব্যস্ত হয়ে পরে।
(জিনিয়ার ফোনে তার মা ফোন করে ও জেনে নেই সে ঠিক মতো রেলগাড়ি এর সিট পেয়েছে কিনা? খাবার খেয়েছে কি না জানতে চাই)
জিনিয়া : হ্যা মা আমি ঠিক ঠাক সিট পেয়েছি, আর আমি train খাবার order করে দিয়েছি app থেকে, তুমি চিন্তা করোনা, আমাকে শুধু কয়েকটা দিন একা থাকতে দাও, সব ভুলতে দাও, নিজেকে একটু সময় দিতে দাও, বাকি আমি তোমাদের সময় মতো ফোন করে নেব। উল্টো দিকে থেকে ছেলেটা জিজ্ঞাসা করে চা এসছে, চা খাবেন? জিনিয়া একবার দেখে নিয়ে বলে হ্যা কিন্তু আমার চায়ের দাম আমিই দেব,উল্টো দিক থেকে ছেলেটা বলে
হ্যা হ্যা সে আপনি সে আপনি না হয় আমাকে পরে কফিই খাওয়াবেন আর গন্তব্য যদি এক হয় তাহলে না হয় আর অনেক বার আপনি চা খাওয়াতে পারবেন।
ফোন থেকে বিরক্তির সাথে মুখটা তুলে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললো
জিনিয়া : আপনার সমস্যাটা কি বলুন তো? তখন থেকে আজেবাজে বকে যাচ্ছেন।
নাহ! সমস্যা আমার কিছুই না কিন্তু পাহাড়ে যাচ্ছেন মন খারাপের পাহাড় নিয়ে তাই জন্য পাহাড়ে ওটার আগে আপনার মনের পাহাড় টাকে একটু সমতল বানাতে চাইছিলাম আর কি।
(এতক্ষনে চাওয়ালা এসে চা দিয়ে যাই আর জিনিয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে)
জিনিয়া : বাহ্ বেশ সুন্দর ঘুচিয়ে কথা বলতে পারেন তো, কিন্ত আপনাকে কে বললো আমি পাহাড়ে যাচ্ছি? আর মনের ই বা পাহাড় জমে আছে কি করে জানলেন।
দেখুন আপনার সাথে থাকা লাগেজ বলে দিচ্ছে আপনি অনেক দূর ট্রাভেল করবেন আর আপনার বিরক্তির সাথে বলা কথা গুলো বা মুখের বিষন্নতা বলে দিচ্ছে আপনার মনের জমে থাকা কষ্ট গুলো পাহাড়ে পরিণত হয়েছে।
(জিনিয়া হোহো করে হেসে ওঠে) আর বলে আপনার ফ্লার্টিং দক্ষতা আছে মানতে হবে, তবে এটা আর কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে হলে হয়তো বা রাজি হওয়ার চান্স ছিল কিন্তু এখন আর নেয়।
কেন নেই কেন মনে পাহাড় জমেছে বলে?
এই দুদিন আগে 1 বছর ধরে প্রেম করা boyfriend যখন engagement এর 2 দিন পর অন্য মেয়ের সাথে cheat করে হলে তাহলে সেই মেয়ের মন পাহাড় হবে না তো কার হবে বলুন?
তাই আপনি ঠিক করেছেন পাহাড়ে গিয়ে নিভৃতে নির্বাসন নেবেন এই সাংসারিক জগতের মোহো মায়া ত্যাগ করে।
নানা ঠিক মোহো মায়া ত্যাগ নয়, তবে এই প্রেম ভালোবাসার উপর বিশ্বাস চলে গেছে তাই একটু নিজেকে ঘুছিয়ে নিতে আর একলা জীবনকে উপভোগ করতে আসা।
উমম! তা অবশ্যই এই সব কিছুর জন্য পাহাড় ই একদম perfect। তা ভালোবাসার উপর বিশ্বাস চলে গেছে, কিন্ত ভালোবাসার কি দোষ বলুন যদি মানুষ টা ভুল হয়, মানুষটা যদি ঠিক হয় তাহলে সে আমরণ আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবেনা বা কোনোদিন ছাড়তে দেবেনা।
(জিনিয়া তাচ্ছিলের হাসি হেসে বলে) ওই সব সিনেমা সিরিয়ালে হয় বাস্তবে না।
হয়! হয়! বাস্তবেও হয় ম্যাডাম!
চলুন রাস্তা তো এখন অনেক বাকি আপনাকে একটা গল্প বলি তাতে আপনার একটু মন ও পরিবর্তন হবে আর রাস্তাটা ও কম লাগবে।
আমি না বললে কি আপনি শুনবে আপনি ঠিক ই বলবেন, যাইহোক আপনার গন্তব্য ও কি পাহাড়?
আজ্ঞে,হ্যা, তবে মনের পাহাড় নামাতে নয়, মনের মানুষদের কাছে যাচ্ছি ( হালকা হাসি )।
তা বেশ, শুরু করুন আপনার গল্প।
সমীক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার,দার্জিলিং এ স্থানান্তর পাওয়ার পর তার বাবা মা ঠিক করে সে দার্জিলিং যেতে পারে যদি সে বিয়ে করে,
কিন্তু সমীক সেই সময় বিয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা, তার বাবা -মা জোর করাতে সে রাজি হয় আর তার গ্রামের বাড়ি তার বাবা মায়ের সাথে মেয়ে দেখতে যাই, যেতে যেতে শহরের রাস্তা ছেড়ে যখন গ্রামে রাস্তা ধরে গ্রামের সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করে দেয়, সে তখন দেখতে পায় একটি মেয়ে কয়েক টি ছাগল ছানা আর দুটি বাচ্ছা সাথে নিয়ে ধান খেতের আল পথ ধরে আসছে, মেয়েটা তাদের গাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাই আর সমীক মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর মেয়েটাকে সাধারণের মধ্যে কি জানো একটা অসাধারনতা আছে, সমীক ভাবতে ভাবতে তার কাকার বাড়ি এসে পৌছায়, তারা সেই দিনের মতো কথা বার্তা বলে খেয়ে বিশ্রাম নিতে চলে যাই আর ঠিক করে কাল তারা মেয়ে দেখতে যাবে।
সমিকের কাকার এক বন্ধুর মেয়ে পাত্রী, সমীকের কাকা, বাবা সমীককে নিয়ে পাত্রী দেখতে নিয়ে যাই, গিয়ে দেখে সেই মেয়েটি বাচ্ছা গুলির সাথে খেলছে আর খুব হাসা হাসি করছে, সমীক গিয়ে পাত্রী দেখতে বসে কথা বলে কিন্তু তার মন পরে রয় সেই সাধারণ দেখতে মেয়েটির ওপর, বাচ্ছাদের কথা বার্তা শুনে সে বুঝতে পারে মেয়েটার নাম উমা ।
বাড়ি ফিরে সমীকের বাবা জানাই তার মেয়ে পছন্দ হয়েছে, তার কাকা জানায় মেয়ের বাবা বেশ স্বচ্ছল পরিবার বিয়েতে মেয়ে জামাইকে বেশ ভালো ভালো উপহার দেবে, সেই শুনে সমীকের মা বাবা ও বাড়ির সবাই খুব খুশি হয়ে যায়, তাও তারা একবার সমীককে জিজ্ঞাসা করে তার পছন্দ হয়েছে কি? সমীক জানায় তার মেয়ে পছন্দ হয়েছে তবে তাকে যারা দেখতে গিয়েছিলো তাকে না, তাদের বাড়িতে আরেকটা মেয়েটা ছিল উমা তাকে পছন্দ হয়েছে। সমীকের কাকা জানায় উমার বাবা নেই আর উমার মা তাদের বাড়ি কাজ করে আর তার এই ষোলো বছর, আর ওর মা এর ক্ষমতা ও নেই বিয়ে দেওয়ার ও বিয়েতে উপহার দেয়ার। সমীক বাড়িতে জানিয়ে দেয় সে উমা ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেনা। সমীকের মা বাবা কাকা সবাই চিন্তায় পরে যায় এবং তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সে তার কথাতেই অনড় থাকে, এবং একপ্রকার বাধ্য হয়ে সমীকের বাড়ির লোক রাজি হয় তার কথায় ও সমীক তার বাবা কাকাকে পাটায় উমার মায়ের সাথে কথা বলতে।
উমার মা প্রথমে রাজি না হলে ও পরে তারদুরাবস্তা আর ভালো পাত্র হাত ছাড়া হবে ভেবে রাজি হয়ে যায়, আর কয়েক দিনের মধ্যে ভালো দিন দেখে তাদের বিয়ে হয়ে যাই, তারপর তারা চলে যায় তাদের কোলকাতার বাড়িতে।
সমীকের বাবা মা সমীক কে নতুন জায়গায় প্রথমে তাকে গিয়ে গুছিয়ে নিতে তারপর উমাকে এসে নিয়ে যেতে বলে আর তারা তাকে জানাই ততো দিনে তারা উমাকে বাড়ির কিছু কাজকর্ম ও রান্না বান্না শিখিয়ে দেবে, সমীক মনে মনে রাজি না হলে ও বাবা মায়ের উপর কথা বলতে পারলোনা, সে তার বাবা মা কে জানায় যে সে এই মাস শেষ হলে সে এসে উমা কে নিয়ে যাবে তার সাথে আর ততদিন দিন যেন তারা উমার সাথে না খারাপ ব্যবহার করে।
সমীক চলে যায় দার্জিলিং কিন্তু তার মন পরে রয় উমার কাছে, এই দিকে উমাকে সমীকের বাবা মা না মেনে নিলে ও তার সরলতা মন ছুঁয়ে যায় তাদের ও। সমীক যাওয়ার সপ্তাহ দুইয়ের মধ্যে চিঠি লেখে যে তার একা রান্না করে খেতে, অফিস যেতে খুব অসুবিধা হচ্ছে, সে কিছু দিনের মধ্যে আসছে উমা কে নিয়ে যাবে।
সমীক ১৫ দিনের মধ্যে বাড়ি ফেরে আর খুব আনন্দের সাথে গোছগাছ করতে থাকে উমা কে নিয়ে যাওয়ার, এবং এটা মনে মনে ভাবতে থাকে যে শেষ পর্যন্ত সে আর উমা একসাথে থাকবে বিয়ের পর প্রথম বার।
সমীক বাড়ি ফিরে উমাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে দেখে, মাথা ভর্তি সিঁদুর, কপাল সিঁদুরে টিপ, পায়ে আলতা আর গায়ে সামান্য গয়না তাতেই যেন উমাকে লক্ষী প্রতিমা লাগছি সমিকের চোখে।
সমীক আর দেরী করতে চাইলো না সে তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে কাল ই বেরিয়ে যেতে চাইলো কিন্তু উমা রাজি হলো না সে আর একটা সপ্তাহ তার মায়ের কাছে থাকার ইচ্ছে ছিল সে সমীক আসবে বলে বেশি দিন তার মায়ের কাছে থাকতে পারেনি তাকে তার শশুর বাড়ি চলে আসতে হয়েছিল, তাই তার মন খারাপ কিন্তু সমীক কোনো কথা শুনলো না সে জোর করে উমা কে নিয়ে গেল কলকাতা শিয়ালদাহ স্টেশন।
শহরে গিয়ে উমা বড়ো বড়ো চোখ করে অবাক হয়ে সব দেখতে থাকে আর শিয়ালদাহ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন আর লোক জন দেখে সে সমিকের হাত টা জড়িয়ে ধরে আর ঘোমটা টা অনেকটা টেনে নেই সেই দেখে সমীক মুচকি হাসে আর উমার হাতটা আরো শক্ত করে ধরে।
সমীক উমা রহনা হয় ট্রেনে করে গন্তব্য দার্জিলিং, উমা ট্রেনে উঠে চারিদিক হাঁ করে দেখতে থাকে আর মাঝে মাঝে কিছু দেখে অবাক হয়ে হাসে বা কিছু তে ভয় পেয়ে মাঝে মাঝে সমিকের পাশে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে, উমার মুখের নানা রকম অভিব্যক্তি দেখে সমীক ও হাসতে থাকে আর উমা কাঁধ টা ধরে কাছে টেনে নেই, এই প্রথম সে উমাকে কাছে টানলো, তারা একটা লম্বা সফরের পর দার্জিলিং এসে পৌছালো আর সমিকের ভাড়া করে ঘরে উঠলো।
তারা সে দিন কাল্ন্ত হয়ে এসে অল্প কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো, আসতে আসতে উমা নিজের মতো করে সংসার গুছিয়ে নিতে লাগলো কিন্তু সমিকের সাথে তার এখনো সেই রকম স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে ওঠানি, সমীক মনে মনে ঠিক করেছে যে সে উমাকে কোনো রকম ভাবে জোর করবে না সে যেদিন নিজে থেকে কাছে আসবে সেদিন সে উমাকে নিজের করে নেবে সব রকম ভাবে।
দেখতে দেখতে দু -বছর কেটে গেলো তাঁদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উটেছে সমীক এখন আরো বড়ো পোস্টে চাকরি করছে তার মাইনে বেড়েছে, এর মধ্যে সমিকের মা বাবা কয়েক বার এখানে এসে থেকে গেছে আর উমা যে কবার বাড়ি গেছে সমীক কয়েক দিন ছুটি নিয়ে তাকে সাথে নিয়ে গেছে এসেছে আর উমা ভাড়া ঘরে থাকতে চাইনি সে নিজের একটা ছোট্ট বাগান ওয়ালা বাড়ি চেয়েছে তাই তার ইচ্ছে পূরণ করতে সমীক টাকা জমিয়ে একটা বাড়ি ও করা শুরু করে দিয়েছে।
এখন আসতে আসতে সমীক উমা কাছে আসে আসতে আসতে উমার সব লজ্জা কেটে যায় আর ঠিক এক বছরের মাথায় তাঁদের কোল আলো করে আসে তাঁদের সন্তান সৌরভ, সৌরভ আসার পর সমীক চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করে আর তাঁদের ছোট বাগান চা বাগানে পরিণত হয়, তারপর তাঁদের ছেলে ও দেখতে দেখতে বড়ো হয় আর ছেলে ও বাবার ব্যবসায় যোগ দেয় তারপর ছেলের বিয়ে হয় একদিন সেই ছেলের ও বিয়ে হয় তার ঘরে ও আসে এক পুত্র সন্তান তার নাম সৌন্দর্য সে যায় কলকাতা তে পড়াশোনা করতে, হটাৎ একদিন তার কাছে ফোন আসে তার ঠাকুমা আর নেই সে যেন তাড়াতাড়ি চলে আসে তাই সে তাড়াতাড়ি ট্রেন ধরে দার্জিলিং যাবে আর দার্জিলিং পৌঁছে দাদুকে সান্তনা দেয় তারপর দাদু তার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ঘরে বিশ্রাম নিতে যায় তারপর দাদু ও ঠাকুরমা কাছে চলে যায়।
বেশ নিন আমার গল্প ও শেষ আর আপনার গন্তব্য ও এসে গেছে।
জিনিয়া: আপনার নাম টাই তো জানা হলোনা।
নমস্কার আমার নাম সৌন্দর্য, সৌন্দর্য ব্যানার্জী, আর এই নিন আমাদের চা বাগান আর হোটেলের ভিসিটিং কার্ড, আপনি অবশই ঘুরে আসবেন।
বলে সৌন্দর্য হাঁটা দেয় পাহাড়ি রাস্তা ধরে।
জিনিয়া অবাক হয়ে সৌন্দর্যএর যাওয়া টা দেখতে থাকে।